১৮. লখাইয়ের ব্যাপারটা
লখাইয়ের ব্যাপারটা এমনভাবে শেষ হল, ঠিক যেন শেষ নয়। ঝুলে থাকার মতো অস্বস্তিতে সকলেই পীড়িত। জমি পাওয়ার আনন্দের চেয়ে এমন বিচিত্র ঘটনায় দুশ্চিন্তাটাই যেন চেপে রইল বেশি করে।
লখাইয়ের যেন হঠাৎ কাজকর্মহীন দিনগুলি বড় দীর্ঘ অবসরময় হয়ে উঠল। সে প্রায় রোজই গাড়লিয়া মুরলীদাসের আখড়ায়, কাঠুরেপাড়া শ্রীনাথের কাছে যায়। খানিকক্ষণ বসে থাকে, কথা বলে। এদিক ওদিক ঘোরে। কিন্তু কোনও কিছুরই ঠিক নেই। কাজের নয়, চিন্তারও নয়।
কয়েক দিন এমনি ঘোরার পর সেজবাবুর কথা মনে হতেই লখাই সেখানে গেল। জগদ্দলের হালদার বাড়ীতে সেদিন কলকাতা থেকে কোন এক আচার্য এসেছেন ব্রাহ্ম বৈঠকের ও অনুষ্ঠানের পৌরোহিত্য করতে। এ অঞ্চলের মধ্যে জগদ্দলেই ব্রাহ্মদের একটিমাত্র শাখা এবং তার কার্যস্থল হালদার বাড়িতেই বরাবর রয়েছে।
সেজবাবুরাও ব্রাহ্ম। তিনি সেখানে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়েছেন। গোল বাধিয়েছে তার প্রিয়তম বন্ধু ভাটপাড়ার বনমালী এসে।
সেজবাবু বললেন, একে তো তুমি ভট্টপল্লীবিদ্বেষী, আবার ব্রাহ্মদেরও টিটকারি দেবে, তবে তোমার মতে উচিতটা কী?
বনমালী তার বিশাল চোখ ধ্যানস্থ করে তুলল। বলল, আমার মতে ফোর্ট গ্লস্টার!
সেজবাবু বিস্মিত হয়ে বললেন, ফোর্ট গ্লস্টার মানে?
ইংরেজের একটা ব্যবসায়ী কোম্পানি।
তা তো বুঝলাম, তার ব্যাপারটা কী?
বনমালী চোখ বুজে বলল, ব্যাপারটা ওখানেই। সে ভাটপাড়ার আমার বাপঠাকুরদারা যতই তাদের বৈদিক মহিমার গুণকীর্তন করুন, আর তোমার ব্রেহ্মজ্ঞানীরা যতই হিন্দু যীশু খাড়া করুক, ফোর্ট গ্লস্টারের পুজো আজ কে না করবে?
এ সময়ে লখাই ঢুকল। সেজবাবু ও বনমালীকে আলোচনা করতে দেখে নীরবে এককোণে বসে পড়ল সে। সেজবাবু তা দেখলেন। কিন্তু বনমালী চোখ বুজেই ছিল বলে লক্ষ করল না।
সেজবাবু বললেন, তা মানুষকে উদরসংস্থানের দিকটা তো দেখতেই হবে। তবে তো
ধর্ম কর্ম। বলে বনমালী হো হো করে হেসে উঠল। অর্থাৎ কিছু একটা নিয়ে থাকতে হবে তো? আমার বক্তব্য সেখানেও ঠিক নয়। বেহ্মজ্ঞানীরা সেদিন থেকে ইংরেজি শিক্ষা ও আদবকায়দা বেশ রপ্ত করে নিয়েছে। বলছি, তোমারদের নিরাকার ব্রহ্মের কাছে তবে জাতিভেদই বা কেন, উৎকৃষ্ট বামুন না হলে আচাৰ্য্যি হওয়া যায় না কেন, আর তোমার চালকলার নৈবিদ্যি—সেও তো দেখি ঢোলকাঁসি বাজিয়েই হয়।
ঠিক এ সময়েই দরজার আড়ালে সেজগিন্নির চুড়ির ঝনৎকারে আগমন টের পেয়ে বনমালী বলে
তৎকালঙ্খলদঙ্গভঙ্গিমাচলামালিঙ্গ্য সেজলক্ষ্মী বলাদ্
আলোলানজবিম্বচুম্বনপরঃ প্রীণাতু সেজবাবুঃ।
গতকাল বৃহস্পতিবারে নিশ্চয় সেজঠাকুরানী নারায়ণপত্নী লক্ষ্মীর পুজো করেছেন এবং তার প্রসাদকণিকার কিয়দংশ তুমি কপালে ঠেকিয়ে ভক্ষণ করেছ বেহ্মজ্ঞানী হয়েও?
এবার সেজবাবু তো বটেই, সেজগিন্নিও খিলখিল করে হেসে উঠলেন।
বনমালী হাসল না। তেমনি গলায় বলে চলল, আর শাস্ত্রজ্ঞ আমার বাবার কাণ্ডটা দেখো। আমি বেচারির কী দোষ ছিল যে টোলে পাঠিয়ে আমাকে এমন এ-যুগের মূখ তৈরি করে রাখা? পুরোতগিরি আর পরস্ত্রীর প্রণাম নেওয়া ও গুরু হওয়ায় আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু পেট তাতে মানবে কি?
কথাগুলো দুঃখেরই বটে, কিন্তু বনমালীর বলার ভঙ্গিতে হাসি চেপে রাখা সম্ভব হল না। হাসছে। না শুধু লখাই কেন না সে সব কথা ঠিক ধরতে পারছে না।
বনমালীকে নিতান্তই কথায় পেয়ে বসেছে। বলল, এ তো গেল একদিকের কথা, অন্য দিকের কথাটা একটু শোনো। সেদিন দেখি জ্যাঠামশাই সকাল থেকে ঘরের মধ্যে অধ্যয়নে ব্যস্ত। কী ব্যাপার! গোপনসন্ধানে টের পেলাম, বঙ্কিম চাটুজ্যের এক উপন্যাস। হায় গোড়াকপাল, ওই বইটি আমার এক বিবাহিতা যুবতী ভগ্নীর, স্বামীর দেওয়া উপহার। ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে তার কাছ থেকে পুড়িয়ে ফেলার জন্য ওই ইংরেজি অনুবাদ, অশ্লীল কুসাহিত্য বলে।
এ দিকে স্বামী স্ত্রীর হাসির ঝরনা বইতে লাগল। বনমালীর তখনও থামার নাম নেই। বলল, বলব কী, আমি একদিন বন্ধুজনের কাছে রাধার রূপ বর্ণনা করছিলাম। আমাদের এক নীতিশাস্ত্রের পণ্ডিততো আমাকে মারে আর কী। অপরাধ? না, ও-সব পরনারীর যৌবনমুগ্ধ একদল গোঁসাইয়ের কেচ্ছাকাব্য। আসলে রাধার উল্লেখ নাকি কৃষ্ণচরিতে বর্জনীয় ছিল। ভাল কথা, কিন্তু শুনলে বিশ্বাস করবে না, সেই পণ্ডিতকেই এক দিন তাঁর দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়াকে মিষ্ট এবং নিম্নস্বরে কাব্য বলতে শুনলাম, হরিমভিসর সুন্দরি সিতবে, রাকা রজনিরজনি গুরুরেষা।
সেজবাবু আর হাসতে না পেরে এবার বলে উঠলেন, দোহাই তোমার, এবার একটু থামো বনমালী, পাগল হয়ে যাব।
কেন, তোমাদের আচার্যদের ব্যাপারটা একবার শোনো।
দোহাই তোমার, আর পারিনে। গিন্নিকে বললেন, হালদার বাড়ি আমি একটু পরে যাব। তুমি বনমালীর জলযোগের ব্যবস্থা করো।
তার পর লখাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী খবর তোমার লক্ষীন্দর, শুনেছি এবার তুমি নতুন কীর্তি কী সব করেছ? লখাই বিষণ্ণভাবে একটু হাসল।
ওর উপর নজর পড়তেই বনমালী বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো দাঁড়িয়ে বলে উঠল, কিমাশ্চর্য অতঃপরম্। তুমি বল্লভীচিত্তহারা, এখানে কী করে?
লখাই হাতজোড় করে বলল, এঁজ্ঞে?
সেজবাবু বললেন, চেনো নাকি?
বিলক্ষণ। তবে একলাকে নয়, সেদিন দূর দেহলীতে ছিল উন্মত্তা সুবর্ণকাঞ্চনী রাধা। অহো, অপরূপ সেই রূপ দেখেই বলেছিলাম দেবী আপনজন গণনাতে আমার নামেও একটি দাগ অঙ্কিত করো। টোলে আমার সেই শেষদিন, অদ্যাবধি চরিত্রের সে কলঙ্ক আমার দূর হয়নি।
বলে কালীবাড়ির সেই ঘটনা বিবৃত করল। লখাইয়ের মনে পড়ল, কাঞ্চন তাকে বলেছিল এক পুরোতের তাকে দেখে মন্ত্র বলার কথা।
সেজবাবু তখন লখাইয়ের সবকথা বললেন বনমালীকে। এমন কী, সেদিনের দুর্ঘটনা ও বিতাড়নের কথাও।
বনমালী সব শুনে বলল, এই এদের আমি কিছুটা বুঝতে পারি যারা আজকের সব কিছুকেই বিদ্বেষের চোখে দেখে। একে সাহেবরা যতই ধর্মান্ধ বলুক না, আসলে সে ইংরেজ-বিদ্বেষী কিন্তু নকলনবীশ হিন্দুর তাৎপর্য আমি বুঝিনে। এ দেখছে এর সবই ড়ুবে যাচ্ছে। একে এখন যতই বলি, ফোর্ট গ্লাস্টার আর শিবঠাকুর সেবা যুগপৎ চালাতে হবে, তা মানবে কেন? অথচ লক্ষ করবার বিষয়, বিবাহিতা বাগদী-নারীকে নিজের অঙ্কশায়িনী করতে ওর বাধেনি।
খাবার এল বনমালীর! সে খাবার খেতে বসল।
সেজবাবু কিন্তু তখন অন্য কথা ভাবছিলেন। তিনি বললেন লখাইকে, লক্ষ্মীন্দর, কাল আমি কলকাতা চলে যাব, তার আগে তোমাকে দুটি কথা বলে যাব। যেখানেই যাই, তোমার কথা আমি ভুলতে পারব না। কিন্তু তোমার অবস্থা যা দেখে যাচ্ছি অ আমাকে বড় ভাবিয়ে তুলেছে। তোমার মতলবে এ দেশ চলবে না, আজকের কেউ তোমাকে বুঝতে চাইবে না। চাইলেও সাহস পাবে না। সাহস যদিও বা হয়, তাকে পরিকল্পনা দেওয়া আজ সম্ভব নয়। এ-দেশে তুমি যা চাও তা কোনও দিন হবে কি না জানি না। যদি কোনও দিন হয়, তার জন্য তোমাকে যে কত জন্ম অপেক্ষা করতে হবে তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন।
বলে একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন, এ যদি শুধু মাত্র একতরফের ব্যাপার হত তবে কথা ছিল না, কিন্তু মনে রেখো, আজ যাদের তুমি এ-দেশের মাটিতে সইতে পারছ না, তাদের সঙ্গে এ-দেশের কিছু মানুষও যোগ দিয়েছে। সুতরাং যখন তখন ঘরে বাইরে বিপদ ডেকে এনে নিজের সর্বনাশ ঘটিয়ো না।
বনমালী বলে উঠল, আর যদি ঘটাও, তবে এ বনমালীকে ডাকতে সেদিন ভুলো না।
বলে সে হঠাৎ খাওয়া থামিয়ে বলল, আমি কী দেখতে পাচ্ছি, জানো সেজ? শিবমন্দির আর গঙ্গার, প্রাচীনধর্ম আর উপবীতের অবরোধে ঢাকা ভাটপাড়া যেন শূন্যে ঘুরতে ঘুরতে কোথায় ছুটে চলেছে। তার মধ্যে আমিও ডিগবাজি খাচ্ছি আর ভাবছি সেখানটা আর যাই হোক, পুরনো নয়, একেবারেই নতুন।”
বলে সে খাওয়া শেষ করে হাতমুখ ধুয়ে উঠতেই অবগুণ্ঠনবতী সেজগিন্নি চট করে দরজার আড়াল থেকে এসে গলবস্ত্র হয়ে তাকে প্রণাম করল।
বনমালী সেজবাবুর দিকে চেয়ে টেপা ঠোঁটে হাসল। সেজবাবুও তাই।
লখাই বলল সেজবাবুকে, বাবু, কানু ভড়ের বউয়ের একটা দরখাস্ত লিখে দেবেন বলেছিলেন? সেজবাবু বললেন, হাঁ, সংবাদপত্রের সম্পাদকের কাছে একটা চিঠি লিখে দেব বলেছি। কিন্তু কিছু হবে কি?
লখাই বলল শান্ত অথচ ক্ষুব্ধ গলায়, কাটুনি নিজের পেট চালাতে সামান্য তুলো যদিও বা পেল, বিলিতি সুতোর হলবানিতে তাঁতিরা তার সুতো নেয় না। তবে সে কি মরবে? এ প্রশ্নের যে নির্মম জবাব হওয়া উচিত ছিল তা না বলে সেজবাবু বললেন, সন্ধ্যায় এসো, আমি লিখে রাখব।
লখাই গড় করে উঠে দাঁড়াল। বনমালী বলল, তোমার কাঞ্চন সঙ্গিনীকে বলল, কালীবাড়ির সেই বামুন তাকে মন্দ কথা বা অপ্রিয় কিছু বলেনি। তবে একটু ভুল বলেছিলাম। আজ সেই রূপ স্মরণ করে সখীর উক্তিই করতে ইচ্ছে হচ্ছে :
পশ্যোন্মত্তে বরিবভিযৌ নাধুনাপি প্রতীচীং
মা চাঞ্চল্যং কলয় কুচয়োঃ পত্ৰবল্লীং তনোমি।
লখাই অবুঝ হেসে ফিরে যেতে যেতে দরজার কাছে হঠাৎ থেমে ঘুরে দাঁড়িয়ে ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল বনমালীকে, দাদাঠাকুর, আপনি ওই ফোর্ট গেলাসটার না কি বলছেলেন, সেটা কী?
বনমালী বলল, সেটা এক ইংরেজ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের নাম। শুছি সে কোম্পানি শীঘ্রই জগদ্দলে পাটের সুতোর একটা কারখানা খুলবে।
পাটের সুতোর কারখানা! হঠাৎ খোঁচা-খাওয়া ঘুমন্ত সিংহের মতো লখাইয়ের চোখজোড়া জ্বলে উঠল, শক্ত হয়ে উঠল চোয়াল। হাত দুটো মুঠি পাকিয়ে উঠল, পাকিয়ে উঠল শরীরের পেশি। যেন হাত-পা বাঁধা এক দুরন্ত জাম্বুবান যন্ত্রণায় ছটফট করছে।
কিন্তু কিছু না বলে এক মুহূর্ত পরে পিছন ফিরে সে চলে গেল দুপদাপ করে।
সেজবাবু আর বনমালী একবার পরস্পর, তার পর লখাইয়ের চলার পথের দিকে তাকিয়ে রইল।