আলো ও ছায়া নামে শরৎচন্দ্রের এক ছোট গল্পের শ্রুতি নাটক প্রসঙ্গে
মাত্র পাঁচটি চরিত্র নিয়ে এ গল্প গঠিত। সংলাপের মাধ্যমে শ্রুতি নাটক তৈরি করতে হয় অতি সন্তর্পনে যাতে কাহিনী অব্যাহত থাকে, সেখানে ছোট গল্পকাহিনী উপস্থাপনা আরও কঠিন। শ্রুতিনাটিকাটি তৈরি এখন আমার টেবিলে, যবনিকা উত্তোলনের অপেক্ষায়—
সমাজের নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি, কুসংস্কার, ভন্ডামি নিয়ে শরৎচন্দ্রের কলম সর্বদাই সোচ্চার হয়ে উঠত। কিন্তু এ গল্পে এমন এক সমাজ বার্তা আছে যে, প্রতিষ্ঠিত লেখক লিখেছেন বলেই হয়ত সে সময়কার বা পরবর্তী কালেও কোন না কোন আপত্তিকর সমালোচনা পাওয়া যায় নি। আসলে কালজয়ী লেখা এমনই ধারা যে, যুগের সাথে সাথে সমালোচনাও পরিবর্তিত হতে থাকে। কারণ জীবনযাত্রা নদীর মতো , নিত্য নতুন পথে এগোতে থাকে, দৃষ্টিভঙ্গির ধারাও বদলাতে থাকে। গল্পটি লিখেছিলেন শরৎচন্দ্র আজ থেকে একশ পাঁচ/ছয় বছর আগে। প্রথম যমুনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরে পুস্তকাকারে ” কাশীনাথ ” গল্প গ্রন্থের সাথে, সময় ১লা সেপ্টেম্বর ১৯১৭। বিংশ শতাব্দীর দোর গোড়ায় শরৎচন্দ্র ভেবেছিলেন, ও প্রত্যক্ষ করেছিলেন এক নব্য ধারার জীবন দর্শন। তাঁর দূরদর্শিতার ক্ষমতায় বুঝেছিলেন, একবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের পরিবর্তনে , জীবন বৈচিত্র্যে রূপবদলের পালা আসবে।
এখানে ব্যাখ্যা উঠে আসে তাঁর অন্যান্য গল্প রচনাতেও –‘ “গৃহদাহ”, “দেনাপাওনা ” , “মন্দির ” , “শুভদা ” , “শেষপ্রশ্ন” ও অসমাপ্ত “শেষের পরিচয় ” ইত্যাদিতেও, এবং অবশ্যই আর এ ছোট গল্প ” আলো ও ছায়া”। অতএব কি সমাজ বার্তা দিয়েছেন শরৎচন্দ্র ?
বলা বাহুল্য , বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কোন সমালোচকই এ বিশ্লেষণের গুরুত্ব তেমন দেন নি। ঠিক সেই কারণেই হয়ত এ গল্প “লাইম লাইটে” আসে নি। শ্রী সুবোধ সেনগুপ্ত তার পুস্তক–
“শরৎচন্দ্র সমালোচনা সাহিত্য” এ লিখেছেন দুটি গল্পের উদ্দেশ্যে, “অনুপমার প্রেম” এবং “আলো ও ছায়া”
—এ এক নিষিদ্ধ প্রেমের বিশুদ্ধ চিত্র। ব্যস্ ঐ অবধি। সিনেমা, নাটক কিছুই হয় নি। বর্তমানে ইউ টিউবে নাটক শোনা যাচ্ছে, “আলো ও ছায়া” র । নাহলে এ গল্প বরাবর এক বড়ো লেখকের এক লেখা হিসেবে শুধু আসন-পিঁড়িতে বসে ছিল, মাত্র।
কারণ , উপলব্ধ বা অনুভূত হয় সমাজ জীবনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই। তাই কালজয়ী রচনার ব্যাখ্যা দিন দিন নতুন কলেবরে রূপায়িত হয়।
একান্নবর্তী পরিবার একটু একটু করে নিউক্লিয়ার পরিবারে পরিণত খুব সহজে মেনে নেওয়া হতো না, অথচ পরিস্থিতিতে হচ্ছে। কলঙ্কের সংজ্ঞা নির্ধারণের পর ধোপা নাপিত বন্ধ করে একঘরা করার প্রয়াস ছিল এক “স্যাডিসম্ “। সেকালের সব বহুপ্রজ পিতা নিশ্চিত থাকতেন, তার মৃত্যু হলেও ক্ষতি নেই , ভ্রাতা বা বড়ো পুত্র তার সন্তান সন্ততিদের মানুষ করবার ভার নেবেন।
কন্যাদায় , পিতৃমাতৃদায় নিয়েও মানুষ বিশেষ মাথা ঘামাচ্ছেন না বিকল্প প্রথা হাত ধরে এগিয়ে আসে। বয়স যা হোক না কেন বিধবার পুনর্বার বিবাহ কিছু অসংগত নয়, এখন। কমে এসেছে সর্বত্র বৈধব্য জীবনের অহেতুক কৃচ্ছ্বসাধনার ব্যাপ্তি, যা নারীদের সংস্কারেই বেশি ছিল!!! অন্য কোন ধর্মে কি তা ছিল বা আছে? বিবাহের ন্যুনতম বয়স এখন যেমন ধার্য তেমনই নারী প্রগতি ঊর্ধ্বমুখী। বর্তমানে জীবন দর্শন জীবন ভঙ্গীমা, জীবন –সঙ্গী চয়ন ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে , বদলে দিচ্ছে সমাজ ব্যাকরণ, তার রসায়ন।
শরৎচন্দ্র জানতেন পরিবর্তনশীল মনুষ্য জীবনধারার গতি , কিছু ধীর কিছু ছুটন্ত দামাল বেগময় ধারায় বদলাতে থাকবে।
একশ বছর আগে সমাজ শাসনে যা ছিল ব্যভিচার, আজ যুব সমাজ তাকে ঐ সংজ্ঞা দিতে নারাজ। আইন যেমন তৃতীয় লিঙ্গকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য তেমনই নারী পুরুষের সঙ্গী নির্বাচন ও তথা একত্র যাত্রাও আইনি সংকট এড়ানোর পক্ষেও সুবিধাজনক বলে বিকল্প আইন বলবৎ।
শরৎচন্দ্র জানতেন এ পরিবর্তন আসবে, তাই গল্পটি লিখে পাঠকদের একটু উস্কে রেখেছিলেন। ছা-পোষা মধ্যবিত্তের ঘরে যা কেলেঙ্কারির শেষ, উচ্চবিত্তের দুয়ারে হলে, তা মুখে কুলুপ। তাই গল্পের নায়ক যজ্ঞদত্ত অঢেল টাকার মালিক। অর্থাত যেখানে লক্ষ্মীর ঝাঁপি পূর্ণতায় টইটম্বুর সেখানে নারদ বারতা কানপাতলা লোকেদের কান ভারী করলেও কিছু যায় আসে না এ রীতি চিরকালই সমাজে বিদ্যমান।
কাব্যিক কোন সম্পর্ক কে বা কখন স্বীকার করে ? আসলে চতুরাশ্রমের প্রভাব সমাজ মজ্জায় ঢুকে আছে। সে রুটিনে গোলমালের গন্ধ মন থেকে মেনে নেওয়া কঠিন। কারণ সমাজ মঙ্গলের জন্য সমাজ শাসন ত অবশ্যই আবশ্যক। সেদিক থেকে পরিবর্তন আসে ধীরে, সব কিছুই প্রকৃতিগতভাবে পরিবর্তনশীল। বিচ্ছিন্ন ঘটনা তখন অসামাজিক , সমাজে অসুস্থকর, অসোয়াস্তির।
ক্রমে লোপ পাচ্ছে হিন্দুধর্মের ছুৎমার্গ প্রথা , বিলোপ হচ্ছে বিলোম( intercast) বিবাহের বাঁধা। কন্যাদায় বা একঘরা করবার রীতি ইত্যাদি ত হাস্যকর । নিউক্লিয়ার পরিবারে নিজ সন্তানের দায়িত্ব নিজস্ব, পাড়াশাসন বলে কিছু নেই। রক্ষণশীল জনতা বলবেন স্বার্থপর সমাজ। যুব সমাজ বলবেন, এ হলো ব্যক্তি স্বাধীনতা। সমাজ ও সংস্কার পরিবর্তন সর্বদা অবশ্যম্ভাবী, সৃষ্টি হয় নতুন সংস্কৃতির নতুন সংস্কার। ভাল মন্দ ত ভবিষ্যত , শরৎচন্দ্র যা বুঝেছিলেন অনেক অনেক আগেই । আমরা আছি সর্বদাই এক ঘেরাটোপের সন্ধিক্ষণে।
আরও দুটি কথা এই “আলো ও ছায়া ” প্রসঙ্গে বলে নিতে চাই, এক–
“Platonic Love ” নয় অথচ নর-নারী সম্পর্কে “Abstract Concept of Love ” এর রূপ, যা খোলা বাতাবরনে শরৎচন্দ্র টেনে এনেছেন। অশ্লীলতাকে অছুৎ রেখেও কিভাবে গল্প কাহিনীতে নায়ক নায়িকার সম্পর্কের মূল নির্যস তুলে ধরতে হয় তা শরৎচন্দ্র খুব ভাল ফুটিয়ে তুলতে পারতেন।
দুই– সংস্কারের মূল বা শিকড় নারীদের অতি গভীরে, পুরুষদের তুলনায়।
তাই লেখক সেই সূতোটি ধরে রেখেছেন সুরমার চরিত্রে, যাতে “ধরি মাছ না ছুই পানি” অবস্থায় পাঠকদের মনে শেষরক্ষার জন্য। সুরমা ,যজ্ঞদত্তের বিবাহের ব্যবস্থা করে ও দেয়। তারপর ? শেষ পরিণতি , জানতে হলে পড়তে হবে গল্পটি।
লেখকের লেখার মুন্সিয়ানা এখানেই, আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে লাটাই হাতে আবার গুটিয়ে নিলেন। শুধুমাত্র সম্ভাবনার সংকেত পাঠকমনে ছড়িয়ে দিলেন। উত্তর আসছে ধীরে ধীরে। সংস্কার ভেঙে গড়ছে নতুন সম্পর্ক ঘরানার, নব প্রগতির বাহুল্যে। যাহোক বিপদমুক্তি হলে পরবর্তীকালে অনুষ্ঠিত হবে এ নাটক। আপাতত ইতিবাচক মনোভাবে নাহয় সেদিনের অপেক্ষায় থাকি।