আরোগ্য নিকেতন – 31
এ লজ্জা রাখবার আমার আর জায়গা নাই। মৃত্যু হবার আগেই আমি মরে গেলাম লজ্জায়। আমি আপনাকে দুঃখ দিয়ে গেলাম। শত্ৰু-পুত্রের কাজ করে গেলাম।
কথাগুলি বিপিনবাবুর প্রায় শেষ কথা। বলে গেছে বাপকে। রতনবাবুকে। এ দেশে চলতি একটা প্রাচীন ধারণা আছে;–পূর্বজন্মের ক্ষুব্ধ শত্রু পরজন্মে পুত্র হয়ে জন্মায়, বড় হয়, মাবাপের মনে বিপুল প্রত্যাশা জাগিয়ে তোলে, তারপর একদিন সে মরে, নিষ্ঠুর আঘাত দিয়ে–পূর্বজন্মের শত্ৰু এ জন্মের বাপের উপর শোধ নিয়ে যায়। মৃত্যুর পূর্বে উচ্চশিক্ষিত বিপিনও এ ছাড়া বলবার কথা খুঁজে পায় নি।
দিন বিশেক পরের কথা।
মশায় বসে ছিলেন বিনয়ের দোকানে। কথাগুলি বলছিল কিশোর। গতকাল বিপিন রাত্রি সাড়ে এগারটায় মারা গিয়েছে। দশ দিন আগে ডাক্তারেরা বলেছিলেন বিপিনবাবু ভাল আছেন। অন্তত এবারের মত বিপদ কেটেছে। এবং আর অবস্থা খারাপ না হলে ধীরে ধীরে সেরে উঠবেন। আটদিন আগে কলকাতা থেকে ডাক্তার চ্যাটার্জি এসেছিলেন। তিনি ডাক্তারদের মত সমর্থন করেছিলেন, কিন্তু উৎসাহের সঙ্গে নয়।
রতনবাবু একবার মশায়ের কথা তুলতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন–আমাদের এখানে একজন। নাড়ি দেখার বিশেষজ্ঞ আছেন। তিন পুরুষ ধরে নাড়ি দেখার সুনাম। নিদান দিয়েছেন।
বাধা দিয়ে প্রদ্যোত বলেছিল—তার কথা বিশ্বাস করলে—
ডাঃ চ্যাটার্জি ভ্রূ কুঞ্চিত করে বলেছিলেন কী বলেছেন তিনি? নিদানটিদান দিয়েছেন নাকি?
–না। তা ঠিক বলেন নি—তবে–।
ডাঃ চ্যাটার্জি বলেছিলেন-হাত দেখায় অবিশ্বাস আমি করি না, আমার বয়স হয়েছে। প্রথম জীবনটা হাত দেখার উপর নির্ভর করতে হত অনেকটা। আমাদের ডাক্তারেরাও অনেকে খুব ভাল হাত দেখতে পারতেন। পারেন। কিন্তু চিকিৎসা যখন আমরা করছি আমাদের কথাই বিশ্বাস। করুন। তিনি হয়ত বলেছেন—রোগ একেবারেই অসাধ্য। এই এতদিনের মধ্যে কিছু হবে। আমরা বলছিনা হতেও পারে। অসাধ্য রোগ আমরা বলব না। শেষ পর্যন্ত লড়াই করব। তার কথায় বিশ্বাস করলে রোগীকে আত্মীয়স্বজনকে হাল ছেড়ে দিয়ে চরম দুর্ঘটনার জন্যই শুধু অপেক্ষা করতে হবে।
তারপর আবার বলেছিলেন—একটু হেসেই বলেছিলেন-আমিও এদেশের লোক, ডাক্তারি করি অবশ্য। কিন্তু যা তিনি বলেছেন—তা তো বুঝছি। সে তো একটা বড় জিনিস। কষ্টদায়ক দুঃসাধ্য ব্যাধি, কোনোক্রমে বাঁচলেও সে জীবন্ত হয়ে বেঁচে থাকা। এবং সংসারে জন্ম হলেই যেখানে মৃত্যু ধ্রুব সেখানে যদি অনায়াসে স্বচ্ছন্দে জীর্ণ অকেজো দেহটার পতনই কাম্য মনে করতে পারেন, সে তো বড় জিনিস। সেটা আপনাদের দিকের কথা, আমরা বলব কেন?
ডাঃ চ্যাটার্জি চলে যাবার তিন দিন পর রোগ হঠাৎ বেঁকে দাঁড়াল। প্রস্রাবের রঙ খারাপ হল, পরিমাণে কমে গেল। এবার প্রস্রাব পরীক্ষার ফল দাঁড়াল শঙ্কাজনক। হার্টের অবস্থা খারাপ। দাঁড়াল। হার্টে রেট একশো তিরিশ। এবং গতি তার বাড়বার দিকে।
হরেন আবার ছুটে গেল কলকাতা। ডাঃ চ্যাটার্জি বললেন–ওইটেই আমার আশঙ্কা ছিল। তাই দাঁড়াল। এখন
একটু চিন্তা করে বলেছেন হাতে আর কিছু নেই।
ঘাড় নেড়েছেন বার বার।-নাঃ, হাত নেই। শেষ পর্যন্ত বলেছিলেন-ডিজিটিলিস ইনট্রাভেনাস দিয়ে দেখ।
হরেন আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল শুনে। ডিজিটিলিস ইনট্রাভেনাস? আপনি চলুন তা হলে।
–আমি? আমি গিয়ে আর কী করব? আমি তো বলছি—সামনে চরম অবস্থা। ধ্রুব বললেই হয়। এখন চান্স নিয়ে দেখতে পার। যদি ভাল করে, ক্রাইসিসটা কাটবে। ক্রাইসিসটা কাটলে দরকার হয় যাব।
কিন্তু সে ঝুঁকি এখানে কেউ নিতে চায় নি। হরেন চারুবাবু কেউ না। প্রদ্যোত একটু ভেবেছিল। শেষ পর্যন্ত সেও সাহস করে নি। মনে অস্বস্তিরও শেষ ছিল না।
বিপিনবাবুর তখনও জ্ঞান ছিল। কলকাতার ডাক্তার না আসতেই বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। নিজেকে প্রস্তুত করতে গিয়েই বৃদ্ধ পিতার দিকে লক্ষ্য করে ওই কথাগুলি বলেছিলেন।
–এ লজ্জা রাখবার আমার ঠাঁই নাই। মরণের আগেই আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছি। আপনাকে দুঃখ দিয়ে গেলাম। শত্ৰু-পুত্রের কাজ করে গেলাম।
অসাধারণ মানুষ রতনবাবু। বিষণ্ণ হেসে তিনি ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন তুমি আমার বীরপুত্র। জীবন-সংগ্রামে ভয় পাও নি, পিছু হট নি, বিশ্রাম নাও নি—যুদ্ধ করতে করতেই পড়লে; তার জন্য লজ্জা কী?
–লজ্জা? বৃদ্ধ বয়সে আবার আপনাকে বর্ম পরতে অস্ত্র ধরতে হবে। এ থেকে আপনাকে আমি রক্ষা করতে পারলাম না। এই লজ্জা। এই তো আমার চরম হার।
রতনবাবু ছেলের মাথায় হাত রেখে চোখের জলের সঙ্গে ঠোঁটের বিচিত্র হাসির সঙ্গে বলেছিলাম—কার কাছে হার? যার কাছে তোমার হার তার কাছে রাম কৃষ্ণ বুদ্ধ থেকে ভীষ্ম দ্রোণ নেপোলিয়ান-হার মেনেছে। ও কথা ভেবো না।
ঘাড় নেড়ে বিপিন বলেছেনা। আর আমার নিজের কাছে। ডাক্তার চ্যাটার্জি আমাকে বার বার বলেছিলেন, এ কর্মজীবন আপনি ছাড়ন। এ রোগ রজগুণের রোগ, রাজসিকতা সব ছেড়ে সাত্ত্বিক জীবন না হলে আপনার রোগ সারবে না, বাড়বে। আমি বলি নি কাউকে। চেষ্টা করেও পারি নি ছাড়তে। আর আমার নিজের কাছে।
এরপর আর কিশোর ঘরে থাকতে পারে নি। বেরিয়ে চলে এসেছিল। এর আগের দিন থেকেই বিপিনের প্রস্রাব বন্ধ হয়েছিল। তারই পরিণতিতে ক্রমশ মোহাচ্ছন্ন হয়ে বিকেলবেলা পর্যন্ত অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। রাত্রি এগারটার সময় মৃত্যু হয়েছে।
সমস্ত গ্রামটা—শুধু গ্রামটা কেন, এ অঞ্চলটা বিপিনের মৃত্যুতে মুহ্যমান হয়ে পড়েছে। এত বড় একটা মানুষ, কৰ্মবীর, স্বনামধন্য পুরুষ। তার মৃত্যুতে হওয়ারই কথা। সকালবেলা শবযাত্রার সময় কাতারে কাতারে লোক ভেঙে এসেছে। স্লান বিষণ্ণ মুখ। সমস্ত অঞ্চলটার আকাশে যেন একটা ছায়া পড়েছে। জীবনমশায়ও উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন বাইরের দিকে। মৃত্যুমুখরা পৃথিবী! হেন ক্ষণ নাই যে ক্ষণে লয় না ঘটছে, মৃত্যুর রথ না চলছে। জীবন জন্ম দিয়ে মৃত্যুকে ছেয়ে ফেলতে চেষ্টা করছে। তবু তাকে জানা যায় না, জানবার উপায় নাই। তাই তাকে এত ভয়। মধ্যে মধ্যে তো ভয় ঘোচে, মানুষ তো জয় করে মৃত্যুভয়কে, দলে দলে তো ছুটে চলে মৃত্যুবরণ করতে। তখন তো মৃত্যু অমৃত হয়ে যায়। বিপিন যে ধরনের মানুষ, যে শিক্ষা সে পেয়েছিল, তাতে তার দেশের জন্যে মৃত্যুবরণ করা আশ্চর্যের কথা ছিল না, তাই যদি সে করত, তবুও কি এমনি ছায়া পড়ত? তা তো পড়ত না! অকস্মাৎ মশায়ের খেয়াল হল, কিশোর কখন উঠে গিয়েছে। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন মশায়। তারপর নিজের নাড়িটা ধরে বসলেন।
কিছু বুঝতে পারা যায়? কোনো বেলক্ষণ, কোনো ইঙ্গিত? না।
–হাত দেখছেন? নিজের? বিনয় এসে ঢুকল।
–হ্যাঁ। শরীরটরীর—
–না। হাসলেন মশায়।
–ক এসেছে। ওর আজ ইনজেকশনের দিন।
–কই?
–হুজুর! এসে দাঁড়াল বুড়ো জুতো-সেলাইওয়ালা।
বিনয়ের এখানে কই তার প্রথম রোগী। রানা সেদিন এখানে আসবার আগেই সে এসেছিল। বুড়ো, আমাশয়ের রোগী। পুরনো রোগ। কিন্তু আশ্চর্য রোগী। এমন সাবধানী রোগী আর দেখা যায় না। রোগ তার দুরারোগ্য, আজও সারল না। কিন্তু ককে কখনও পাকড়াও করতে পারলে না। রোগ বাড়লেই ক খাওয়াদাওয়া প্রায় ছেড়ে দেয়। চিকিৎসক যদি বলেন—এক পোয়া খাবে তবে সে আধ পোয়র বেশি খাবে না।
বাতিক তার ওষুধের। বার মাসই একটা-না-একটা ওষুধ তার খাওয়া চাই-ই। তা সে ডাক্তারি, কবিরাজি, হাকিমি, টোটকা যা হোক। পালা আছে। কিছুদিন ডাক্তারি তারপর কিছুদিন
কবিরাজি।
কদ্রু তার পুরনো রোগী। কদ্রু এ দেশের লোক নয়। বোধ করি বিলাসপুর অঞ্চলের চর্ম-ব্যবসায়ী। সেকালে এ দেশে তাদের যে প্রথম দল এসেছিল তাদের মধ্যে ছিল করু। কদ্রু তখন নূতন জোয়ান, সঙ্গে বউ আর একটি ছেলে।
মশায় সেকালে ওর ছেলেটাকে কঠিন রোগ থেকে বাঁচিয়েছিলেন। সেই কারণে কৰ্ম্ম মশায়কে দেখলেই এসে পথ রোধ করে দাঁড়াত। জুতোটা বুরুশ করে দিব মহাশা।
জুতো পরিষ্কার না করিয়ে উপায় ছিল না তার। দাঁড়াতেই হত। সে যেখানেই থোক। বাজারে, হাঁটে, স্কুলের সামনে, সবরেজিস্ট্রি আপিসের অশ্বত্থতলায়—করু এক-একদিন একএক জায়গায় পালা করে বসত। সেদিক দিয়ে যেতে হলেই ককে দিয়ে জুতো পালিশ করিয়ে নিতে হত।
পয়সা অবশ্যই দিতেন মশায়। কর আগ্রহের দাম দেওয়া যায় না। বনবিহারীর মৃত্যুর পর যখন তিনি ঘর থেকে বের হতেন না তখনও মধ্যে মধ্যে কদ্রু বাড়ি গিয়ে জুতো পালিশ করে দিয়ে এসেছে। তখন কোনোদিন পয়সা পেয়েছে কোনোদিন পায় নি। আজ বছর কয়েক কদ্রু বুড়ো হয়ে অক্ষম হয়েছে। সবরেজিস্ট্রি আপিসের অশ্বত্থতলাটি ছাড়া অন্য কোথাও আর যায় না, যেতে পারে না। বিনয়ের দোকান সাবরেজিস্ট্রি আপিসের কাছেই। এবার কদ্রু ঠিক এসে হাজির হয়েছে। জুতোও সাফ করে দিয়েছে। এবার অসুখটা বেশি।
কদ্রুর মৃত্যুকাল নিরূপণ করা কঠিন। ক রোগকে প্রশ্রয় দেয় না। সাবধানী লোক। কিন্তু রোগটা যেন ক্রমশ গ্রহণীতে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে মনে হচ্ছে। তার পায়ের ধ্বনি এইবার
কোনোদিন বেজে উঠবে।
এবার কদ্রু বলেছে—সুই দাও বাবা মহাশা। বেশ ভাল তেজী টাটকা আমদানি দাওয়াই দিয়ে সুই দাও।
–সুই? ইনজেকশন? মশায় হাসলেনজলদি আরাম চাই কদ্রু?
–হাঁ বাবা। বিনা কামসে খাই কী করে?
কদ্রুর ছেলেরা বড় হয়ে বাপকে ফেলে অন্যত্র চলে গেছে। স্ত্রী মরেছে। কদ্রু এখন। একা। কাজেই খাটতে হবে বৈকি।
মশায় বলেছিলেন তার থেকে তুই হাসপাতালে যা না ক! তোর সাহেবকে ধরলেই তো হয়ে যাবে।
কদ্রুর সাহেব হল কিশোর। কিশোরকে, কেন কে জানে, কিশোরের ছেলেবেলা থেকেই কদ্রু বলে সাহেব। ওই আর-একজন তার ভালবাসার জন। কিশোরকে সে ভারি ভালবাসে।
কিশোরের সঙ্গে কর আলাপ ফুটবল মেরামতের সূত্র ধরে। তখন কিশোর হাফপ্যান্ট, জারসি পরে ফুটবল খেলত। ছেলেদের দলের ক্যাপ্টেন ছিল, বোধ করি সেই কারণেই বলত। সাহেববাবু। পরে খদ্দরধারী কিশোর কত আপত্তি করেছে, কখনও কখনও ধমকও দিয়েছে। ককে, তবু কদ্রু সাহেববাবু নাম ছাড়ে নি।
কদ্রু হাসপাতালে যেতে রাজি হয় নি।–নেহি মা-বাপ। উসমে হামি যাবে না। উ সব বাবু লোক—মেমসাহেব লোক ওষুধ পিলায়, আর তা ছাড়া বাবা, দিনরাত বিস্তারায় শুয়ে থাকা, ওই সব লোকের সেবা নেওয়া কি আমার মত চামারের কাজ?
–আরে! ওই জন্যেই তো ওরা আছে। হাসপাতাল তো সবারই জন্যে। রোগী তো হল হাসপাতালের দেবতা রে। তার জন্যে তুই শরম করিস না।
—না বাবা। না।
—কেন রে? আমি বলছি ভাল হবে। তুই যে রকম নিয়ম করিস তাতে চট করে সেরে যাবি। আর রোগ হলে শুয়ে থাকাই তো নিয়ম।
—তাই তো থাকি বাবা। গাছতলায় চ্যাটাই পেড়ে বসে থাকি, বসে বসেই কাম করি। ঘুম পেলে ঘুমুই।
—সেই হাসপাতালে ঘুমোবি।
–আমি দাওয়াইয়ের দাম দেব বাবা।
–তার জন্যে আমি বলি নি করু। হাসপাতালে গেলে তোর ভাল হবে।
–নেহি বাবা। হাসপাতালে যে যাবে সে বাঁচবে না। আমি বলে দিলাম।
–কেন?
–হাসপাতালে দেও আছে বাবা। রাতমে ঘুমে ঘুমে বেড়ায়। কবরস্তানের উপর হাসপাতাল; সেই কবর থেকে ভূত উঠেসে।
মশায়ের মনে পড়ে গেল কথাটা। সেদিন রাত্রে প্রদ্যোত ডাক্তারের রান্নাঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে ভূতে নাকি মাংস চেয়েছিল। ডাক্তারেরা কেউ মাংস খান নি। পরের দিন দাঁতু ঘোষাল হাসপাতাল থেকে পালিয়েছে।
মশায় ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন। একটা কথা তার মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কিন্তু থাক সে কথা। ভূত একবার তিনি দেখেছিলেন। সে মাছ খাচ্ছিল। রাজি তখন একটা। তিনি ডাক থেকে রোগী দেখে ফিরছিলেন। পথে নবগ্রাম ঢুকবার মুখে বাগানওয়ালা পুকুরটার ঘাটের পাশে গাছতলায় দাঁড়িয়ে ছিল একটা আপাদমস্তক সাদা-কাপড়-ঢাকা মূর্তি। কিছু যেন খাচ্ছিল। জ্যোৎস্নার মধ্যে হাত মুখের কাছে তোলা বুঝতে পারা যাচ্ছিল।
গাড়োয়ানটা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তিনি ভয় পান নি। গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গিয়েছিলেন। দেখেছিলেন প্রেতই বটে। মাছ খাচ্ছে। সে ছবিটা যেন চোখের উপর ভেসে
উঠছে। দেখেছেন তিনি।
এবার তার মুখে এক বিচিত্র ধরনের হাসি দেখা দিল। এ সংসারে সবই আছে। ভূত প্ৰেত ব্ৰহ্মদৈত্য সবই আছে। নাই কে বলে? যদি সত্যকারের সেই দৃষ্টি থাকে তবে নিশ্চয় দেখতে পাবে।
কদ্রুকে ইনজেকশন দিয়েই চিকিৎসা তিনি শুরু করেছিলেন। বিনয়ের দোকানে নতুন আটনে ক তাঁর প্রথম রোগী। আজ আবার কর ইনজেকশনের দিন। ঠিক সে এসে দাঁড়িয়েছে।
মশায় জিজ্ঞাসা করলেন–কেমন আছিল?
—না—না। ঘাড় নাড়লে করু। ভাল না বাবা মহাশা। ভাল না। থোড়াথুড়ি বুখার ভি হয়।
–দেখি, হাত দেখি। হাত ধরে মশায় বললেন–বড় যে দুর্বল হয়ে পড়েছিস করু। অসুখ বেড়েছে? বেশি ঝাড়া যাচ্ছি?
—না বাবা। কম হোয়েসে। সো তো কম হোয়েসে।
–তবে? খাচ্ছিস কী?
–কী আর খাব বাবা? থোড়াসে বার্লিকে পানি। ব্যস। আর কুচ্ছ না। কুছ না।
–কিন্তু খেতে যে হবে রে। না খেয়েই এমন হয়েছে।
–ডর সে মারে, খেতে পারি না বাবা মহাশা।
–ডর করলে হবে না। খেতে হবে। না খেয়েই তুই মরে যাবি।
—মরণকে তোডর নেহি বাবু। বেমারির দুঃখকে ডর করি বাবা। খানাপিনা করব, যদি বেমারি বাড়ে? পেটকে দরদ যদি বেড়ে যায় বাবা? শেষে কি ময়লা মিট্টি মেখেই মরব বাবা?
মশায় আজও বললেন–তুই হাসপাতালে যা। তোর সাহেববাবু রয়েছেন বলে দিলেই হয়ে যাবে। আর তুই যে রকম রোগী, হয়ত অল্পেই ভাল হয়ে যাবি।
কদ্রু বললেওই তো বাবু, এত বড়া বাবু এতনা কিস্মত-কাঁচা উমরমে চলিয়ে গেল। এতনা দাওয়াই, ভারী ভারী ডাকডর! কী করলে হুজুর? কুছ না। হুজুরকে বাতই সাচ হইয়ে গেল।
–কী? মশায় আর্ত চকিত স্বরে প্রশ্ন করলেন।
–হুজুর তো বলিয়ে দিয়েছিলেন বাবু নেই জীয়েগা, ওহি তো সত্যি হইল হুজুর। কলকাত্তা সে ডাকডর আইল—কুছ হইল না।
মশায়ের সমস্ত শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠল। এ কী বলছে কদ্রু! চুপ করে বসে রইলেন তিনি, আত্মসংবরণ করছিলেন।
কদ্রু বলেই গেল—আর বাত আছে বাবা। উ রোজ আপনাকে বলিয়েছি, বিনয় বাবা ভি জানে হাসপাতালমে পিরেত আছে, হঁয়া কোই নেহি বঁচেগা।
বিনয় বাইরে দাঁড়িয়েছিল—ঘরে এসে ঢুকল। বললে—মিথ্যে বলে নি করু। সেদিন প্রদ্যোত ডাক্তারের বাসায় খাওয়াদাওয়ার জন্যে মাংস রান্না হয়েছিল। জানালার বাইরে থেকে ভূতে মাংস চেয়েছিল। ডাক্তারের রাঁধুনী বামুন চোখে দেখেছে। গণেশ ভটচাজের মেয়ের প্রসব হয়েছিল হাসপাতালে, ডাক্তার কেসটা খুব বাঁচিয়েছে। সে মেয়ে ভয়ে বাঁচে না। গণেশ তাকে নিয়ে পালিয়ে এসেছে।
মশায় যেন আগুনের হেঁকা খেয়ে চঞ্চল হয়ে উঠলেন। ভুরু কুঁচকে তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে সবিস্ময়ে বললেন–ভূত?
বিনয় বললে—দাঁতু দেখেছে। কবরস্থান থেকে–
—দাঁতু?
–হ্যাঁ। আজ সকালে মহা হাঙ্গামা করেছে। থাকবে না সে হাসপাতালে। কাল সারা রাত্রি নাকি ঘুমোয় নি ভয়ে।
এ কথায় মশায় যা করলেন তা বিনয়ের কল্পনাতীত। ক্রোধে ঘৃণায় তিনি যেন ফেটে পড়লেন।—দাঁতু মরবে। নিদানে আমার ভুল হয় নি। প্ৰেত দেখা দিয়েছে দাঁতুকে নেবার জন্যে। এ প্রেত দাঁতুর সঙ্গে সঙ্গে ফেরে। অন্যে পায় না দেখতে, আমি পাই।
কদ্রু বিনয় স্তম্ভিত হয়ে গেল কথা শুনে। বিনয়ের মনে হল—মশায়ের মাথার গোলমাল হল না তো?
মশায় বললেন– ডাক যারা রোগী আছে। উঠব। সেতাব এল না কেন?
বিনয়ের দোকানেই এখন সেতাব আসে ছক খুঁটি নিয়ে। এখানেই বসে দাবার আসর। বেশ একটি মজলিস জমে যায়।
সেতাব আসে নি, সেতাবের বাড়ির দোরে নিশিঠাকরুনের ভাইঝি মারা গিয়েছে। সেই পনের বছরের মেয়ে, দুটি সন্তানের জননী—সূতিকায় যার দেহবর্ণ হয়েছিল অতসী ফুলের মত। মশায় যার নাড়ি দেখে মৃত্যু স্থির বলে জেনে এসেছিলেন। নিশি শেষ পর্যন্ত দেখিয়েছিল শশীকে। শশী বিচিত্ৰ উদ্ভট চিকিৎসা পদ্ধতিতে মেয়েটাকে খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিয়েছে খেয়ার ওপারে।
শেষ তিন দিন অবস্থা খুব খারাপ হওয়ায় নিশি হরেনকে ডেকেছিল।
গ্রামের লোক হরেন বিনা ফিজেই দেখেছিল। কয়েকটা ইনজেকশনও দিয়েছিল। আধুনিক মূল্যবান ওষুধ।
নিশি এখন গালাগাল করছে হরেনকে।
মশায় বাড়ি ফিরবার পথে সেতাবের বাড়ি এসেছিলেন। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ফিরে গেলেন। কাল রাত্রে বিপিন মারা গিয়েছে; আজ সূর্যোদয়ের পূর্বে বিপিনের শবযাত্রায় এ অঞ্চলের আবালবৃদ্ধবনিতা ভিড় করে রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়েছিল, শ্মশান পর্যন্ত বিরাট জনতা অনুসরণ করেছে। সারাটা দিন জীবনের জ্যোতির উপর একটা ম্লান ছায়া ফেলে রেখেছে। মানুষ ক্লান্ত, শোকাৰ্ত। আর তারা পারছে না। নিশির ভাইঝির মৃতদেহের পাশে নিশি বিলাপ করে কাঁদছে, ডাক্তারকে গাল দিচ্ছে। দু-তিনটি প্রতিবেশিনী বসে আছে। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কিপোর আর তিন-চার জন কিশোরপন্থী জোয়ান ছেলে। তারাই নিয়ে যাবে শবদেহ।
বাজারটা আজ ম্রিয়মাণ। আলো আছে। কয়েকটাই হ্যাজাক-বাতি জ্বলছে। বাতির সংখ্যা বেড়েছে এখন। ডাক্তারদের নতুন কো-অপারেটিভ মেডিক্যাল স্টোর্সে দুটো আলো জ্বলছে। একটা ভিতরে একটা বাইরে। এখনও সব ওষুধের চালান আসে নি, কিছু কিছু নিয়ে দোকান খোলা হয়েছে। চারুবাবু বসে আছেন বাইরে। হরেনও রয়েছে। বিপিনের কথাই হচ্ছে।
মশায় ভাবছিলেন নিশির ভাইঝির কথা। সেদিন ওকে দেখেই মনে পড়েছিল তার জীবনে নাড়ি-পরীক্ষা বিদ্যায় দীক্ষার দিন—তাঁর বাবা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন একটি কঠিন রোগী দেখতে। ঠিক এই রোগী। এমনই বয়সের মেয়ে, এমনি দুটি সন্তানের জননী, আর একটি গর্ভে। বাবা আসবার পথে বলেছিলেন—এই হল মৃত্যুরোগের নাড়ি! মেয়েটি বাঁচবে না, বাবা। আর একটি লক্ষণ দেখলে? মেয়েটির রুচি যাতে রোগ বাড়ে তাতেই।
মেয়েটির হাতে তেলেভাজার তৈলাক্ততা এবং গন্ধ তার দৃষ্টি এড়ায় নি। নিশির ভাইঝিও সেদিন আচার চুরি করে খাচ্ছিল। ওঃ, সেদিন মেয়েটিকে খুঁকি বলাতে ওর কী হাসি। বার বছর বয়সেই মেয়েটির প্রথম সন্তান হয়েছিল; সাড়ে তেরতে দ্বিতীয় সন্তানের মা হয়েছে; পনেরতে তৃতীয়টিকে গর্ভে ধারণ করে রয়েছে। সে খুকি!
মেয়েটা হাসলে গালের দুদিকে দুটি টোল পড়ত।
অন্ধকার রাত্রে ছায়ামূর্তির মত কে যেন মনশ্চক্ষুর সামনে দাঁড়াল। কালো কোঁকড়া একপিঠ খাটো চুল। এও মুখে কাপড় দিয়ে হাসে। এও হাসলে গালে টোল পড়ে।
মঞ্জরী বোধহয় মরেছে। মধ্যে মধ্যে নির্জন অবসরে ঠিক এমনিভাবে চকিতের মত ভেসে উঠে মিলিয়ে যায়।
হাসপাতালের কম্পাউন্ডে প্রদ্যোত ডাক্তারের বারান্দায় আলো জ্বলছে। প্রদ্যোত আজ চুপ করে বসে আছে। বোধহয় ভাবছে ডাক্তার। ডাক্তার মাত্রই ভাবে। ভাবে কোথাও কোনো ত্রুটি তার ঘটেছে কি না!
ত্রুটি ঘটে থাকলে নীরব অনুশোচনায় স্তব্ধ হয়ে বসে থাকবে। অন্তরটা হায় হায় করবে। ক্ৰটি না থাকলে এমনি গ্লানিহীন উদাসীনতায় আচ্ছন্ন হয়ে বসে থাকবে। মনটা শূন্য হয়ে যায়। হঠাৎ বাতাস জাগে শূন্য-মণ্ডলে। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চিকিৎসক ভাবে অসহায়, মানুষ বড়। অসহায়! কারও মনে বিদ্যুচ্চমকের মত প্রশ্ন জেগে ওঠে ডেথ! হোয়াট ইজ ডেথ!