Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

প্রদ্যোত ডাক্তারের বাসায় সেদিন এ অঞ্চলের পাসকরা ডাক্তারেরা সকলেই এসে জমেছিলেন। প্রদ্যোতই উদ্যোগী হয়ে সকলকে ডেকেছে। এখানে একটি কো-অপারেটিভ মেডিক্যাল স্টোর্স খোলার কথা হবে।

বিনয়কে বয়কটের জন্য ঠিক নয়; তবে বিনয়কে মুশকিলে পড়তে হবে বৈকি। শুধু তাই নয়, এখানে ছোটখাটো ক্লিনিকও সে করতে চায়। ডাক্তারের বন্ধু ক্লিনিকাল প্র্যাকটিস করেন এই জেলার সদরে। সদর থেকে বিপিনবাবুর ইউরিন ও ব্লাড রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তার নিজেই এসে গতকাল থেকে বসে আছেন। বিপিনের রিপোর্ট আশাপ্রদ বটে কিন্তু পরীক্ষক ডাক্তারের কী একটি সন্দেহ হয়েছে। তিনি আবার একবার ইউরিন ব্লাড নিজে নিয়ে যাবেন। সেইসঙ্গে এই মিটিঙেও যোগ দিয়েছেন তিনি। প্রদ্যোতের অনুরোধেই যোগ দিয়েছেন। প্রদ্যোত ডাক্তারের মত, একালে ক্লিনিকের সাহায্য ছাড়া চিকিৎসা করা অন্যায়; যে বিজ্ঞান নিয়ে সাধনা, সেই বিজ্ঞানকে এতে লঙ্ন করা হয়। সাধারণ ম্যালেরিয়া বা সামান্য অসুখবিসুখে উপসর্গ দেখে, থার্মোমিটার স্টেথোেসকোপের সাহায্যে চিকিৎসা করা হয়ত যায়, কিন্তু অসুখ যেখানে একটু জটিল বলে মনে হয়, যেখানে এতটুকু সংশয় জাগে, সেখানে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে রক্ত মল মূত্র—এসব পরীক্ষা না করে চিকিৎসা করার ঘোরতর বিরুদ্ধে সে। নাড়ি পরীক্ষার উপর বিশ্বাস তার নাই। বায়ু পিত্ত কফও বুঝতে পারে না। এবং চোখে উপসর্গ দেখে, রোগীর গায়ের গন্ধ বিচার করে রোগনির্ণয় দু-চার জন প্রতিভাবানের পক্ষে সম্ভবপর বটে, কিন্তু সাধারণ চিকিৎসকদের সে শক্তি নাই। যারা করেন তাঁরা পাঁচটাতেই ঠিক ধরেন—সঁচটাতে ভুল করে পরে শুধরে নেন পাঁচটাতে ভুল শেষ পর্যন্ত ধরাই পড়ে না। রোগী যখন মারা যায় তখন মনে হয় চিকিৎসা আগাগোড়াই ভুল হয়েছে। রোগটা বোধহয় ম্যালেরিয়া ছিল না, কালাজ্বর ছিল; অথবা কালাজ্বর ছিল না, ছিল ম্যালেরিয়া। ম্যালেরিয়াকে টি-বি ভুল করতেও দেখা গিয়েছে। সেদিন একটা ছেলের চিকিৎসার মারাত্মক ভুল হয়েছে। ছেলেটা মরা অবধি তার মন পীড়িত হয়ে রয়েছে।

বিনয়ের দোকানে যেসব প্রেসক্রিপশন সরবরাহ হয়, তার মধ্যে অসাধুতা আছে। কোনো ওষুধ না থাকলে নিজেরাই বুদ্ধিমত একটা বিকল্প দিয়ে চালিয়ে দেয়। তাও না থাকলে সেটা বাদ দিয়েই চালিয়ে দেয়। কোনো ওষুধটা যথানিয়মে ক্রম রক্ষা করে তৈরি করে না। ওষুধের শিশি। স্থির থাকলেই দেখা যায় বিভিন্ন ভেষজ স্তরে স্তরে স্বতন্ত্র হয়ে আসছে অথবা তলায় জমে রয়েছে। একদফা ওষুধ এনে তাতেই চালায় ছ মাস, এক বছর। নিস্তেজ, নিগুণ ওষুধের ক্রিয়া হয় না। সব থেকে বিপদ হয়েছে এখানকার বিশেষ ওষুধগুলি নিয়ে। পেনিসিলিন যে বিশেষ তাপমানে রাখার কথা তা রাখা হয় না। যেসব ওষুধ আলোকরশ্মিতে বিকৃত হয় সেগুলিও নিয়মমত রাখে না এরা। মানুষের জীবনমরণ নিয়ে যেখানে প্রশ্ন—সেখানে অবহেলা, অজ্ঞতা এবং কুটিল ব্যবসায়-বুদ্ধির স্বেচ্ছাচারে ব্যভিচারে মানুষের জীবন হচ্ছে বিপন্ন। এ ছাড়া জাল ওষুধ চালায়। বলেও প্রদ্যোত বিশ্বাস করে।

তার ওপর দাম। দরিদ্র মানুষ সরল গ্রামবাসী অসহায়ভাবে সর্বস্বান্ত হয়ে এই লোলুপতার খঙ্গের নিচে ঘাড় পেতে দিতে বাধ্য হচ্ছে। শুধু দামই নয়, বাকির খাতায় বাকি বেড়েই চলে। এদের পীতপাণ্ডুর চোখের দৃষ্টি দেখলে প্ৰদ্যোতের করুণাও হয়, রাগও ধরে। এক-এক সময় মনে হয়—মরুক, এরা মরুক, মরে যাক। শেষ হয়ে যাক। নির্বোধ মূর্খেরা নিজেদের অজ্ঞতা মূৰ্খতা নির্বুদ্ধিতা কিছুতেই স্বীকার করবে না। বললে শুনবে না। বুঝিয়ে দিলে বুঝবে না, বিশ্বাস করবে না। আজও কবচ-মাদুলি জড়ি-বুটি ঝাড়-ফুক ছাড়লে না এরা। এদের বিজ্ঞানবোধ জীবন মশায়ের নাড়িজ্ঞান পর্যন্ত এসে থেমে গেছে।

তাই অনেক চিন্তা করে সে এখানকার ডাক্তারদের এবং এই বন্ধুটিকে নিয়ে একটি নূতন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চায়। বড় একটি ওষুধের দোকান। তার সঙ্গে একটি ছোটখাটো ক্লিনিক।

এখানকার অবস্থা দেখে সে যা বুঝেছে তাতে বড় একটি কারবার বেশ সমৃদ্ধির সঙ্গেই চলবে। নবগ্রামে একটি মাঝারি ওষুধের দোকান আজ তিরিশ বৎসরেরও বেশি কাল ধরে ভালভাবেই চলে আসছে। তার আগে হরিশ ডাক্তারের বাড়িতে এক আলমারি ওষুধ নিয়ে তার নিজস্ব কারবার চলত। জীবন মশায়ের আরোগ্য-নিকেতন নাকি সমারোহের সঙ্গে চলেছে দীর্ঘকাল। আজ উনিশশো পঞ্চাশ সালে কি এখানে ক্লিনিক ও বড় ওষুধের দোকান চলবে না?

আজ নবগ্রামেই দুজন এম. বি., দুজন এল. এম. এফ. রয়েছেন। আশপাশে চারিদিকে দশ-বার মাইলের মধ্যে আরও চার জন এল. এম. এফ. আছেন। তাদের সকলেরই কোনো রকমে চলে যাচ্ছে। তাদের সকলকেই আজ নিমন্ত্রণ করেছেন প্রদ্যোত ডাক্তার। সকলে মিলে অংশীদার হয়ে এই কারবার গড়ে তোলার কল্পনা। তাতে সকলেরই লাভ। তাঁরা ব্যবসায়ীর মত লাভ করবেন না, তবুও যেটুকু লাভ হবে তারাই পাবেন। প্রেসক্রিপশনে কমিশন যে যেমন পান। পাবেন। এখানকার লোকও অপেক্ষাকৃত কম দামেই ভাল ওষুধ পাবে।

কোয়ার্টারের বারান্দায় চেয়ার-টেবিল বিছিয়ে আসরটি বেশ মনোরম করেই পাতা হয়েছিল। সন্ধ্যার সময়ে চা-পর্ব থেকে শুরু হয়েছে। মাঝখানে একটা পেট্রোম্যাক্স আলো জ্বলছে। রাত্রে খাওয়াদাওয়া আছে। কিছু পাখি শিকার করা হয়েছে—তার সঙ্গে কয়েকটি মুরগিও আছে। রান্না করছে হাসপাতালের কুক। মঞ্জু ঘুরেফিরে রান্নাবান্নার তদ্বির করছে। বারান্দার আসরে একপাশে একটি অর্গান রাখা হয়েছে। মধ্যে মধ্যে গান গাইবে সে।


এখানে নবগ্রামের আশপাশে যারা প্র্যাকটিস করে—তারা সকলেই স্থানীয় লোক। গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে ডাক্তারিই সব পেশার চেয়ে ভাল পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ম্যালেরিয়ার প্রকোপই এর প্রধান কারণ। ম্যালেরিয়ার সঙ্গে আছে দু-চারটে টাইফয়েড, দু-দশটা রেমিটেন্ট, তার সঙ্গে আমাশয়, পেটের অসুখ। বসন্ত হয়, কিন্তু মহামারী হয়ে দেখা বড় দেয় না, তবে কলেরা মাঝে মাঝে হয়। সেকালে কলেরা হত মহামারীর মত, একালের টিকার কল্যাণে তা হয় না। এ ছাড়া এটা-ওটা নানান ব্যাধি লেগেই আছে। সেই কারণে ডাক্তার হতে পারলে নিশ্চিন্ত; উপার্জন হবেই। আগে লেখাপড়া শিখে সকলেই আইনটা পড়ত। চাকরি না পেলে উকিল হবে। কিন্তু উকিলদের পেশা অনিশ্চিত, যার কপাল খুলল সে রাজা, যার হল না সে ফকির বললেও চলে। ডাক্তারিতে তা নয়, কিছু হবেই। কপাল খুললে কথাই নাই। তার ওপর বাড়িতে বসে চলে। দশ বছর আগে এখানে চারিপাশে দুজন পাস-করা ডাক্তার ছিল। হাতুড়ে অনেক কজনই করে খেত। এখন এখানে ছজন পাস-করা ডাক্তার। কেউ বর্ধমানে, কেউ বাঁকুড়ায়, জনচারেক কলকাতায় ক্যাম্বেল এবং মেডিক্যাল স্কুলে পড়ে পাস করে এসেছেন। এঁরা সকলেই বিনয়ের পাইকিরি খদ্দের। বিনয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের নেই এমন নয়, আছে; পুরনো ওষুধ বিনয় চালায়। দাম বেশি ঠিক নেয় না তবে কো-অপারেটিভে দাম আরও কম হবে। ক্লিনিকের তেমন প্রয়োজন তারা অনুভব করে না। তবে হলে মন্দ কী? শক্ত রোগে দু-এক ক্ষেত্রে প্রয়োজন হতেও পারে। এবং প্রদ্যোত ডাক্তারকে একটু তুষ্ট রাখারও প্রয়োজন তাদের আছে। দু-একটা শক্ত রোগী, বিশেষ করে অপারেশন কেস, নিয়ে এলে হাসপাতালে সেগুলি করে দেবে প্রদ্যোত ডাক্তার। কিছুটা বিজ্ঞানের প্রেরণার তাগিদও অবশ্যই আছে। তারা সকলেই অপেক্ষা করে রয়েছে। বিপিনবাবুকে দেখে ডাক্তারেরা ফিরলেই আলোচনা আরম্ভ হবে।

প্রদ্যোতেরা বিপিনের কেস আলোচনা করতে করতেই ফিরলেন। বিপিনবাবু আজ বলেছেন—আপনারা কী বলছেন বলুন। এইভাবে আমি আর বেঁচে থাকতে চাইনে। জীবনমশায় বলে গেছেন আমি বাঁচব না।

রতনবাবু বলেছিলেন না, তা তো তিনি বলেন নি বিপিন। তাঁর উপর ইনজাস্টিস কোরো না তুমি।

দৃঢ়ভাবে বিপিনবাবু বলেছিলেন না, ইনজাস্টিস করি নি আমি। তিনি যেভাবে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না বলে চলে গেলেন, ফি না নিয়েই চলে গেলেন—তার মানে ও ছাড়া আর কিছু হয় না। বলুন না, আপনিই বলুন, তার মতামত সম্পর্কে আপনার কী মনে হয়েছে?

বিপিনবাবুর ছেলেটিও বলেছে–হ্যাঁ। উনি একরকম তাই-ই বলে গেছেন ইঙ্গিতে।

বিপিনবাবু বলেছেন—এখন আপনারা বলুন আপনাদের মত। এবং কতদিনে আমি বিছানা ছেড়ে–অন্তত ইনভ্যালিড চেয়ারেও একটু-আধটু ঘুরতে পারব বলুন। আমার রাশীকৃত কাজ পড়ে রয়েছে। মধ্যে মধ্যে প্রাণের দায়ে মক্কেলরা আসে, তাদের সঙ্গে আপনারা দেখা পর্যন্ত করতে দিচ্ছেন না। তাই বা কখন থেকে দেবেন বলুন। ফ্র্যাঙ্কলি বলুন। আমি শুনতে চাই।

চারুবাবু একটু বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন, বলেছিলেন আপনার মত লোক অধীর হলে আমরা কী করব বিপিনবাবু! আপনি তো নিজেই জানেন এ রোগের কথা। তা ছাড়া চঞ্চল হচ্ছেন। আপনি, এতে আপনার অনিষ্ট হবে।

—জানি। জেনেই বলছি। আমি এইভাবে থাকতে পারছি না। জীবনমশায় তাঁর কথা বলেছেন এবং চলে গেছেন একরকম। এখন আপনাদের পালা। আপনারা বলছেন ভাল আছি আমি। বেশ। এখন বলুন কতদিনে আমি উঠব। অবশ্য পূর্বের জীবন ফিরে পাব না আমি জানি। কিন্তু তার সামান্য অংশ। বলুন।

প্রদ্যোত বলেছে কলকাতায় ডাঃ চ্যাটার্জি আপনাকে দেখছিলেন। তাঁর নির্দেশমত এখানে আমরা চিকিৎসা করছি। মতামত তিনি দেবেন। আপনি তাকে আনান। আমরা বলতে পারি জীবন মশায়ের সঙ্গে আমরা একমত নই। আপনি আগের থেকে ভাল আছেন এবং এই উন্নতির যদি ব্যাঘাত না হয় তবে ক্ৰমে ক্ৰমে সেরে উঠবেন আপনি। কতদিনে, সে বলতে হলে ডাঃ চ্যাটার্জির সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।

–বেশ তাই হোক। ডাঃ চ্যাটার্জি আসুন। হরেন, তুমি যাও—তাকে নিয়ে এস। যা চাইবেন দেব। লজ্জায় ঘেন্নায় আমি দগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। এর শেষ কথা জানতে চাই আমি। আর–

মাথা তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে বলেছেন–জীবন মশায়কে যেন আর না ডাকা হয়। আমি মরব কি না জানতে চাই না। মরবে সবাই একদিন। এ রোগে আমি বাঁচব কি না জানতে চাই।

কথাটা বলেছেন বাপকে লক্ষ্য করে।

সেই কথা বলতে বলতেই ফিরে এলেন ওঁরা। চাকর চা এনে সামনে নামিয়ে দিলে। হরিহর কম্পাউন্ডার চারুবাবুর সামনে নামিয়ে দিলে একটি কাচের গ্লাসে দু আউন্স ব্রান্ডি এবং একটি সোডার বোল। চারুবাবুরই এ প্রস্তাবে উৎসাহ বেশি। তিনিই হবেন সোসাইটির চেয়ারম্যান। ব্রান্ডির গ্লাসে চুমুক দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে চারুবাবু পকেট থেকে ঘড়িটা বের করে বললেন– নটা সঁচ। কাজ শুরু করে দিন প্রদ্যোতবাবু। সময় এখন ভাল। দুৰ্গা দুৰ্গা-–সিদ্ধিদাতা গণেশ! করুন আরম্ভ।

চারুবাবু আগে থেকেই পাজি দেখে রেখেছেন। প্রদ্যোত এসব মানে না, বরং মানা অপছন্দ করে, তবু এক্ষেত্রে চারুবাবুর ইচ্ছায় বাধা দেয় নি।

প্রদ্যোত কাগজ-কলম টেনে নিয়ে বসল।

চারুবাবু হেসে বললেন–কী রকম মিটিং মশায়? একটা ওপনিং সঙ হবে না? হারমোনিয়ম মিসেস বোস উপস্থিত থাকতে!

ডাক্তারের স্ত্রী অত্যন্ত সপ্রতিভ মেয়ে। সে মাথাটি নত করে সসম্ভ্ৰমে বললে—সভাপতির আদেশ শিরোধার্য। এবং অর্গানটার সামনে বসে গেল।

একটা ব্যাঘাত পড়ল।

হঠাৎ হাসপাতালের ফটকে চার-পাঁচ জন লোক এসে ঢুকল। একটি মেয়ে বুক চাপড়ে কাঁদছিল—ওরে সোনা রে, ও মানিক রে! ওরে বাবা রে!

প্রদ্যোত একমনে হিসেব কষে যাচ্ছিল। কান্না শুনে কাগজ-কলম ধীরতার সঙ্গে গুছিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল। এত রাত্রে এমন বুক চাপড়ে কাঁদছে-হাসপাতালে ছুটে এসেছে—নিশ্চয় অ্যাকসিডেন্ট। ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের কেস। কিন্তু এখানে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড মানে দুটি বেড এখন। একটি বেড ছিল, প্রদ্যোত এসে অনেক চেষ্টা করে কিশোরবাবুকে দিয়ে চেষ্টা করিয়ে আরএকটা বাড়িয়েছে। থানা হেলথ সেন্টার হলে পাঁচটা বেড হবে। কিছু নূতন ব্যবস্থাও করেছেন। কিন্তু ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের সব থেকে বড় প্রয়োজন রক্তের। রক্ত কলকাতার ব্লড ব্যাঙ্কে দেড়শো মাইল দূরে।

–আমি আসছি। দেখি কী হল। প্রদ্যোত চলে গেল।

চারুবাবু বললেন–এমন কর্তব্যপরায়ণ লোক আমি দেখি নি। আমিও একসময় এখানে ছিলাম তো। আমারও খুব কড়াকড়ি ছিল। বুঝলেন মিসেস বোস, আমিও খুব কড়া লোক ছিলাম। তবে করব কী? সে কালই ছিল আলাদা। তখন হাসপাতাল ছিল বাবুদের, ডি-বি গ্র্যান্ট ছিল এই পর্যন্ত। বাবুরাই হৰ্তাকৰ্তা বিধাতা। ডিসপেনসারিতে কাজ করছি, বাবুদের কল এল, আসুন, আরজেন্ট। কী করব, যেতে হল! গিয়ে দেখি ছোট ছেলে খুব চিৎকার করছে। তারস্বরে। বাবুর মেয়ের প্রথম ছেলে, বার বছরের মেয়ের ছেলে-বুঝছেন ব্যাপার?

–বার বছরের মেয়ের ছেলে? মঞ্জুর বিস্ময়ের আর অবধি রইল না।

—তার আর আশ্চর্য কী? সে আমলে এ তো হামেশাই হত। এগার বছরের মেয়ের ছেলে আমি দেখেছি। চোদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলে না হলে সেকালে হায় হায় পড়ত সংসারে। আর ছেলে হল না। দেবতাস্থানে মানত করত।

মঞ্জু বললে–আমার মায়ের মা, গ্ৰেট-গ্র্যান্ডমা—তার ছেলে হয়েছিল তের বছরে, আমার মায়ের মা। তাই শুনি যখন তখন আশ্চর্য হয়ে যাই সে বুড়ি আজও বেঁচে আছে। ওঃ, যা কালা হয়েছে বুড়ি! জানেন–

হঠাৎ একটা ভয়ার্ত চিৎকারে সকলে চমকে উঠল। কী হল? চিৎকারটা ডাক্তারের বাসার ভিতরে।

কেউ যেন বু-বু করে চেঁচাচ্ছে। কে? ঠাকুরের গলা বলে মনে হচ্ছে।

মঞ্জু দাঁড়িয়ে উঠে ছুটল। সঙ্গে সঙ্গে প্রদ্যোতের বন্ধুও ছুটল। চারু ডাক্তার বললেন–কী হল, চোরটোর নাকি? হরেন বললে—কী জানি।

–না, কড়াই-ফড়াই উলটে ফেললে পায়ে? না কি? চারুবাবু বললেন–দেখ হরেন। সকলেই সচকিত হয়ে চেয়ে রইল দরজার দিকে।

চারুবাবু শেষ ব্রান্ডিটুকু পান করে ডাকলেন ও মশায়, ও মিসেস বোস! হল কী।

ওদিকে ভিতরে হাউমাউ করে কী বলছে ঠাকুরটা। কিছু বুঝতে পারা যাচ্ছে না। প্রদ্যোতের বন্ধু ধমকাচ্ছে। ডাক্তারের বউ খিলখিল করে হাসছে।

চারু ডাক্তার বললেন–বলি হরেন!

–আজ্ঞে!

–এ মেয়েটা কী হে? কী হাসছে দেখ তো? আবার বন্দুক নিয়ে নাকি শিকার করে। হরেন বললেন—হাঁ, সাইকেলও চড়েন।

চারু ডাক্তার এবার বললেন–এ একটা গেছো মেয়ে! ডাক্তারটি লোক ভাল কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই গেছো মেয়ের পাল্লায় পড়ে গাছে উঠে না বসতে হয়; লেজ না গজায়।

সব ডাক্তাররাই হেসে উঠল।

চারুবাবু মাথার টাকে হাত বুলিয়ে সরস হেসে বললেন––কিন্তু ওরা আছে বেশ। কপোতকপোতী সম। বেশ! হাসছে খেলছে গাইছে। বেশ আছে! মাঝে মাঝে মনে আফসোস হয় হে। বলি একালে জন্মলাম না কেন? ডাক্তার এবার নিজেই হেসে উঠলেন।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খিলখিল করে হেসে যেন বর্ষার ঝরনার মত ঝরে পড়তে পড়তে ওদিক থেকে বেরিয়ে এল প্রদ্যোত ডাক্তারের গেছো বধূটি। ডাক্তারের বন্ধুও হাসছিল, সে বললে–ইডিয়ট কোথাকার! কাণ্ড দেখুন তো!

চারু ডাক্তার বললেন– হল কী?

মঞ্জু বললে—ভূত। চারুবাবু-ভূত এসেছিল। আবার সে উচ্ছ্বসিত হয়ে হাসতে লাগল।

ভূত! চারু ডাক্তারের আমেজ ছুটে গেল।

হ্যাঁ। চাকরটা ঘরে খাবার জায়গা করছে, ওদিকে রান্নাঘরে ঠাকুর গরমমসলা বেটে মাংসের সঙ্গে গুলে দিচ্ছে; সারি সারি থালা বাটি সাজানো হঠাৎ টুপটাপ শব্দে ঢিল পড়তে শুরু করে। ঠাকুর তাইতে উঠে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে আপাদমস্তক সাদা কাপড় পরে কে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই বলেছে—একটু মাংস পেঁ! একটু পেঁ! বাস ঠাকুর অমনি বু-বু করে উঠেছে।

প্রদ্যোতের বন্ধু বললে—আমার ইচ্ছে হল ব্যাটার গালে ঠাস করে চড় কষিয়ে দিই গোটা কয়েক।

চারু ডাক্তার বললেন–উঁহুঁ। এতটা উড়িয়ে দিলে চলবে না। জায়গাটা ভাল নয়। বহু লোকে বহুবার ভয় পেয়েছে এখানে। একটু এগিয়ে গিয়ে একটা বড় গাছ ছিল। সেখানে নানা প্রবাদ ছিল। আর হাসপাতাল যেখানে-ওখানটা তো ছিল মুসলমানদের কবরস্থান। ওই ভয়ে হাসপাতালে সেকালে রোগী হত না। গোটা সাত বছরে সাতটা রোগী হয় নি। যা গোটা চারেক হয়েছিল তাও মরণদশায় ভিখিরি আর নাকারিগোটা দুয়েক অ্যাকসিডেন্ট কেস প্রায় আনক্লেমড় প্রপার্টির মত। সেসব ওই কিশোরবাবুর সোসাল সার্ভিসের দল কুড়িয়ে-বাড়িয়ে ভরে দিত। একটা ছাড়া মরেছেও সব কটা। এবং সব রোগীতেই ভয় পেত।

মঞ্জু আবার খিলখিল করে হেসে উঠল, বললে—আপনি ভূত বিশ্বাস করেন নাকি ডাক্তারবারু?

চারুবাবু বললেন– হ্যাঁ। মানে, করি আবার করিও না। করি না আবার করি, দুই-ই বটে। মানে, কী যে আছে কী যে নাই-এ ভারি মুশকিল।

প্রদ্যোত ফিরে এলেন। গম্ভীর মুখ। আস্তিন পর্যন্ত জামা গুটানো। ডিসইন-ফেকট্যান্টের মৃদু গন্ধ উঠছে। চেয়ারের উপর বসে পড়ে বললেন––ছোট ছেলে, ছ-সাত মাস বয়স। গরম দুধ পড়ে একেবারে

চারু ডাক্তার আপনার অজ্ঞাতসারেই একটা জৈবিক যন্ত্ৰণাকাতর শব্দ করে উঠলেন।–আঃ!

অন্য সকলে শিউরে উঠল। উঃ!

প্রদ্যোতের বন্ধু প্রশ্ন করলে–টিকবে?

—মরে গেছে। টেবিলের উপরে শোওয়াবার পর মিনিট কয়েক ছিল। তারপর বার কয়েক স্প্যাজ্‌ম্‌–ব্যস। আমি আর করি নি কিছু। শুধু দেখলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।

মঞ্জু স্থির হয়ে গিয়েছে। তার সকল চঞ্চলতা, হাসি, কৌতুকসব যেন শুকিয়ে গিয়েছে।

প্রদ্যোতের বন্ধু বললে–এখানে আর-এক হাঙ্গাম!

–হাঙ্গাম? মানে?

–তোমার ঠাকুর ভূত দেখেছিল। বু-বু শব্দে চিৎকার—সে এক কাণ্ড।

–ননসেন্স! বদমায়েশি করছে বেটা! বোধহয় মাংস-টাংস সরিয়েছে। পরে বলবে ভূতে খেয়ে গেছে।

চারু ডাক্তার বললেন– ঊঁহুঁ। সব ওরকম করে উড়িয়ে দেবেন না! ঊঁহুঁ।

প্রদ্যোত হেসে উঠল।—আপনি ভূত মানেন নাকি?

চারু ডাক্তার বললেন– মানি মানে? এই গোরস্তানেওদিকে একটা মানুষের বাচ্চা মল অপঘাতে, এদিকে মাংসের গন্ধে ঘরে ঢেলা পড়ল; খোনা-সুরে কথা কইলে। ব্রান্ডির আমেজ কেটে গেল। দিন, এখন আমাকে আর-এক আউন্স ব্রান্ডি দিন। সব মাটি। এক আউন্সের বেশি। না। ব্যস, ব্যস।

প্রদ্যোত গ্লাসটি বাড়িয়ে দিয়ে বললে—সে যা হোক, ভূত থাক বা না থাক, মারামারি নাই। এদিকের কথা বলুন। তা হলে আমাদের এদিকের সব ঠিক তো!

–হ্যাঁ, ঠিক বৈকি। না কি হে সব?

–তা হলে কাগজখানা দেখুন, সই করে দিন।

–আপনি পড়ুন ডাক্তার। ইউ সি ব্যান্ডি খেয়ে চালশের চশমা চোখে দিলে বড্ড বেশি। উঁচু-নিচু লাগে আমার। আরে, ওই জন্যে রাত্রে কল এলে আমি যাই না। নেভার। রাত্রে রোগী মরলে চারু ডাক্তার ইজ নট রেসপনসিবল। পড়ুন-আপনি পড়ুন।

প্রদ্যোত বলে গেল—কোম্পানির নাম হবে নবগ্রাম কো-অপারেটিভ মেডিক্যাল স্টোর অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল ল্যাবোরেটরি।

চারু ডাক্তার বললেন–গুড।

ক্যাপিটাল পাঁচ হাজার টাকা। শেয়ার দশ টাকা হিসেবে। চারুবাবু একশো শেয়ার নিচ্ছেন। মঞ্জু বোস একশো। আমার বন্ধু নির্মল সেন একশো। হরেনবাবু পঞ্চাশ।

—না মিঃ বোস। আমার পঁচিশ করুন।

কেন হে হরেন? তোমার তো চলতি ভাল হে। জীবনমশায় তোমায় ডেকে ইনজেকশন দেওয়াচ্ছেন, ওদিকে রতনবাবুর ছেলে বিপিনবাবুর অ্যাটেন্ডিং ফিজিশিয়ান তুমি, এই দুটো কেসেই তো তোমার পঞ্চাশের দাম উঠে যাবে হে!

হরেনের মুখখানা লাল হয়ে উঠল। কুরনাহারের ডাক্তার হরিহর পাল এতক্ষণে বললে—তা রামহরিকে জীবনমশায় আর হরেনবাবু বাঁচিয়েছেন খুব। আমাকেই প্রথম ডেকেছিল পাগলা শশী। একেবারে সরাসরি কথা বলেছিল। উইল একখানা করে রেখেছে রামহরি—তাতে সাক্ষী হতে হবে তোমাকে। টিপসই আমরা দিয়ে নোব। তুমি সাক্ষী হয়ে যাও। হাঙ্গামা-হুজ্জত কিছু হবে না, ভয় কিছু নাই। যদি হয় বলবে-সজ্ঞানেই টিপসই করেছে রামহরি। টনটনে জ্ঞান ছিল। পঞ্চাশ টাকা শেষে বলে একশো টাকা। কিন্তু আমি বললামওতে আমি নাই শশীবাবু। মাফ করবেন আমাকে। টাকায় কাজ নাই। আমি যা দেখেছিলাম—তাতে তো প্রায় শেষ অবস্থা। ও কেসটা খুব বাঁচিয়েছেন জীবনমশায়।

চারুবাবু বললেন– ওইটেই জীবন মশায়ের ভেলকি। আমি ভেলকি বলি বাপু। বুঝেছ না। রোগটা ঠাওর করতে পারে। তা পারে। নাড়িজ্ঞানই বল আর বহুদৰ্শিতাই বল, যাই বল লোকটা এগুলো প্রায় ঠিক ঠিক বলে দেয়। আর লোকটির গুণ হচ্ছে—ধার্মিক। কিন্তু ওই একটা ব্যাপারওই, এ রোগী বাঁচবে না-ওই নিদানওইটেতে যেন একটা কেমন বেঁক আছে।

প্রদ্যোত ডাক্তার বললে–আমি কিন্তু কথার মধ্যে একটু ইন্টারাপ্ট করছি। আমরা আসল কথা থেকে সরে যাচ্ছি। আমাদের কাজটা পাকা করে নিতে হবে।

হরেন বলেন আমার তা হলে চল্লিশখানা শেয়ার লিখুন।

চারু বাবু বললেন–তোমার দশখানার দাম আমি এখন দিয়ে দেব হে। তুমি আমাকে মাসে মাসে দিয়ে। যাও যাও, আপত্তি কোরো না, বস্ খতম। ওয়ান্ টু থ্রি।

টেবিলের উপর চড় মেরে হাসতে লাগলেন। তারপর আবার বললেন–এই তো সাড়ে তিন হাজার উঠে গেল। বাকি দেড় হাজার রইল—এরা দিক। এরা রয়েছে পাঁচজনে, ওরা দুশো করে মানে, কুড়িখানা করে দেবে। আর বাকি পাঁচশো আমি বলি ওপন থাক—দু-চার জন কোয়াক আছে—তারা যদি–

প্রদ্যোত দৃঢ়কণ্ঠে বললে–আমি কিন্তু এর বিরোধী ডাক্তারবাবু।

টাকে হাত বুলিয়ে চারুবাবু বললেন– আপনার এখন নতুন রক্ত প্রদ্যোতবাবু। অনেক। কোয়াক ভাল চিকিৎসা করে, তাদের ভাল প্র্যাকটিস, তাদের টানুন। এই ধরুন জীবনমশায়।

বাধা দিলে প্রদ্যোতবাবু। বললে—এ নিয়ে তর্ক আমি করব না। কিন্তু এ ইনস্টিটিউশন খাঁটি পাস-করা ডাক্তারদের। এখানে খ্ৰীটি সায়ান্স ছাড়া ভেল্কিকে আমরা প্রশ্রয় দেবার কোনো দরজা খোলা রাখব না। ডাক্তারবাবু আপনি অস্বীকার করবেন না যে এখানে এখনও দৈব ওষুধ অনেক চলে। কবচ মাদুলি চলে। এই তো আপনাদের এখানকার ধর্মঠাকুরের বাতের তেল ওষুধের খুব খ্যাতি। কলকাতা থেকে লোক আসে। কিন্তু আপনি ডাক্তার হয়ে প্রেসক্রিপশনে অবশ্য লিখবেন না-ধর্মঠাকুরের তেল এক আউন্স। এবং সে তেলও আপনি এই ডাক্তারখানায় রাখতে বলবেন। না। কবচ মাদুলিও আমাদের মেডিক্যাল স্টোর থেকে অবশ্যই বিক্রি হবে না।

–আপনি আমাকে দমিয়ে দিলেন ডাক্তারবাবু। চারু ডাক্তার ঘাড় নাড়তে লাগলেন।–যুক্তি আপনার কাটবার উপায় নেই। উকিল হলে আপনি ভাল উকিলও হতে পারতেন কিন্তু।

—বলুন কিন্তু কী? খুব গম্ভীর মুখেই প্রদ্যোত প্রশ্ন করলে। এবং টেবিলের উপর হাত রেখে চারুবাবুর দিকে একটু ঝুঁকেও পড়লে আগ্রহ প্রকাশ করে।

হেসে ফেললেন চারুবাবু, বললেন– কিন্তু এটা এমন কিছু নয়, মানে ভাবছিলাম আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া অবশ্যই হয়, তাতে জেতে কে?

সমস্ত মজলিসটাই হো-হো করে হেসে উঠল। মিসেস বোস হেসে উঠল সর্বাগ্রে।

হাসি একটু কমে আসতেই চারুবাবু বললেন–তবে ওই পঞ্চাশটা শেয়ার পাবলিকের জন্যে ভোলা থাক। কেউ একটার বেশি শেয়ার পাবে না। যারা কিনবে তারা ওষুধ পাবে একটা কনসেশন-রেটে।

—তাতে আমি রাজি। এবং ওটাকে বাড়িয়ে পঞ্চাশের জায়গায় একশো করার পক্ষপাতী আমি।

—বাস-বাস। দিন সই করে দি। নাও, সব সই কর!

সই করে চারু ডাক্তার কাগজখানা প্রদ্যোত ডাক্তারকে এগিয়ে দিয়ে বললেন–খাবার দেরি কত মিসেস বোস? অন্নপূর্ণার দরবারে শিব ভিখারি—তাকে চুপ করেই হাত পেতে থাকতে হয়। কিন্তু শিবের চ্যালারা হল ভূত। তারা খিদে লাগলে মানবে কেন?

—হয়ে গেছে। জায়গা করতে বলে এসেছি। হয়ে যেত এতক্ষণ। ঠাকুরটা যে ভয় পেয়ে মাটি করলে। চাকরটা তাকে আগলাচ্ছে। রান্নাঘর থেকে সব এ ঘরে এনে তবে জায়গা করবে।

–ওই দেখুন। ভূতের চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে।

–দেখছি আমি।

–দাঁড়ান।

–কী?

–আমি বলি কি, মাংসটা-ওটা না খাওয়াই ভাল।

–মাংস বাদ দেব? আপনি কি পাগল হলেন ডাক্তারবাবু?

–উঁহুঁ। মুসলমানের কবরখানা—তার উপর মুরগির মাংস। উঁহুঁ! মানে ভূত মানি চাই নাই মানি, আমরা ডাক্তারভূত মানা আমাদের উচিত নয়—মানবই বা কেন? তবে যখন একটা খুঁত হয়ে গেল, মানে বু-বু করবার সময় ঠাকুরটার থুতু-টুতু পড়ল কি না কে জানে? কিংবা আরও কিছু হল কি না কে বলতে পারে—তখন কাজ কী? মানে—আমি, মানে আমার ঠিক রুচি হচ্ছে না।

খাওয়ার সময় দেখা গেল মাংসের রুচি সমাগত স্থানীয় ডাক্তারদের কারুরই প্রায় হল না।

প্রদ্যোত ডাক্তার রেগে আগুন হয়ে উঠলেন ঠাকুরটার উপর। এ ওর বদমাইশি। আপনারা এটা বুঝতে পারছেন না? একেবারে স্পষ্ট হয়ে গেছে এইবার। এই রকম একটা ব্যাপার করলে আপনারা কেউ মাংস খাবেন না। নোকাল লোক এখানকার বিশ্বাস অবিশ্বাস জানে। ঠিক হিট করেছে। এইবার ব্যাটারা গোগ্রাসে গিলবে!

চারুবাবু বললেন–তাই খাক। ব্যাটারা খেয়েই মরুক। বুঝেছ না, হেভি ডোজে ক্যাস্টর অয়েল ইকব। তবে বুঝেছ না, আমাদের রুচি মানে বললাম তো। থাক না। যা আসল কাজ। তো হয়ে গেল নবগ্রাম কো-অপারেটিভ মেডিকেল স্টোর অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল ল্যাবোরেটরি। এ একটা মস্ত কাজ আপনি করলেন। ক্লিনিক্যাল টেস্ট ছাড়া এ যুগে এক পা এগুনো যায় না। উচিত না। অ্যান্ড—আপনি ওই কথাটা যা বললেন– সেটা আমি মানি। ঠিক বলেছেন। কবচ মাদুলি দৈব ওষুধে ফল যদি হয়—আমরা প্রতিবাদ করব না, কিন্তু ওকে প্রশ্রয় দেব না।

তাঁরা চলে গেলেন একে একে।

প্রদ্যোত চাকর এবং ঠাকুরকে ডেকে বললেন–কালই দুজনে মাইনে মিটিয়ে নিয়ে চলে যাবে।

মঞ্জু বললে—এটা তোমার অন্যায় হল।

–না, হয় নি।

—তুমি সে সময়ে ঠাকুরের চেহারা দেখ নি। লোকটা ঠকঠক করে কাঁপছিল। কী, বলুন। না মিস্টার সেন?

সেন বললেন–ভয় লোকটা পেয়েছিল প্রদ্যোত, সেটা মিসেস বোস ঠিক বলেছেন। হি ওয়াজ ট্রেমব্লিং লাইক এ লিফ। পাতার মত কাঁপছিল।

প্রদ্যোত বললেন–তোমাদের কথা মানতে হলে—আমি বুঝবলোকটা অত্যন্ত ভূতবিশ্বাসী; এটা কবরস্তান বঁধছে মুরগির মাংস সুতরাং কবর থেকে ভূত উঠে আসবে এইসব মনে মনে কল্পনা করছিল সন্ধে থেকে এবং তারই অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে সে ভিশন দেখেছে। এ লোককে আমি হাসপাতালে রাখতে পারব না। আমার রোগীরা ভয় পাবে। কাল ভোরেই ওদের চলে যেতে হবে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress