আরোগ্য নিকেতন – 24
বিপিন সুস্থ আছে। নিজেই বললে—ভালই মনে হচ্ছে।
রতনবাবু বললে—আজ ইউরিন রিপোর্ট এসেছে। যে দোষটুকু ছিল অনেকটা কমে গিয়েছে।
মশায় যখন গেলেন, তখনও ডাক্তারেরা আসে নি। বিপিনের হাতের জন্য হাত বাড়িয়ে মশায় বললেন–ভাল হবার হলে এইভাবেই কমে। আমাদের সে আমলের একটা কথা ছিল।
রতন—তোমার নিশ্চয় মনে আছে—রোগ বাড়বার সময় বাড়ে তালপ্ৰমাণ, কমবার সময় কমে তিলে-তিলে।
—তুমি একবার নাড়ি দেখে আমাকে বল। কী বুঝছ? কী পাচ্ছ?
–রোজই তো বলছি রতন।
–না। আজ কেমন দেখলে—এখন কেমন আছে এ কথা নয়। সেই পুরনো আমলের নাড়ি দেখা দেখ। কত দিনে বিপিন উঠে বসতে পারবে।
বিপিন বললে—এ শুয়ে শুয়ে আর পারছি না। চাকাওয়ালা ইনভ্যালিড চেয়ারে যদি একটু বারান্দায় বসতে পাই—কি একটু বাইরে ঘুরে আসতে পারি তা হলে মনের অবসাদটা কাটে। তা ছাড়া এ যেন লজ্জায় আমি মরে যাচ্ছি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের করুণার পাত্র। লোকে আহা উঁহুঁ করছে, গোটা সংসারের লোকের বোঝা হয়ে ঘাড়ে চেপে রয়েছি—এ আমার পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠেছে।
মশায় চমকে উঠলেন মনে মনে। প্রতিষ্ঠাবান বিপিনের অন্তরলোকের অবস্থাটা যেন রঞ্জনরশ্মির মতই কোনো এক রশ্মিদ্টায় উদ্ভাসিত হয়ে প্রকাশিত হয়ে পড়ল। মশায়ের কাছে এটিও একটি উপসর্গ।
বিপিনের মুখের দিকে তাকিয়ে তার হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে তুলে নিলেন। নাড়িতে উত্তেজনার আভাস ফুটে উঠেছে।
হাতখানি নামিয়ে রাখতেই বিপিন বললেকবে উঠতে দেবেন?
মশায় বললেন–কাল বলব। আজ তুমি নিজেই চঞ্চল হয়ে রয়েছ।
–চঞ্চল উনি অহরহই। সেইটেই আপনি নিষেধ করুন ওকে। বিপিনের খাটের ওদিকে দাঁড়িয়েছিল একটি মেয়ে বিপিনের স্ত্রী। রোজই থাকে। কথা বলে না। আজ সে বোধ করি থাকতে পারলে না, আজ সে কথা বলে ফেললে। প্রাণস্পর্শী সেবার মধ্যে এ উপসর্গটি তার মনে কাটার মত ঠেকেছে; সব থেকে গভীরভাবে বিদ্ধ করছে বলে মনে হয়েছে। তাই বোধ করি থাকতে পারে নি।
পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বৎসর বয়স; শান্ত শ্ৰীময়ী মেয়ে; কপালে সিঁদুরের টিপসিঁথিতে সিঁদুর উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে, পরনে লালপেড়ে শাড়ি। ঘোমটা সরিয়ে আজ প্রাণের আবেগে তাঁর সামনে আত্মপ্রকাশ করে দাঁড়িয়েছে।
তিনি উত্তর দেবার আগেই উত্তর দিলে বিপিনদুর্বল কণ্ঠস্বর কাঁপছে, চোখ দুটি ঈষৎ। প্রদীপ্ত। সে বলে উঠল—নিষেধ করুন! নিষেধ করুন! নিষেধ করলেই মন মানে? মেয়ে জাত! কী করে বুঝবে তুমি আমার এ যন্ত্রণা!
মশায় ব্যস্ত হয়ে বললেন–বিপিন, বাবা! বিপিন।
রতনবাবু ডাকলেন বিপিনবিপিন!
দুটি জলের ধারা গড়িয়ে এল বিপিনের দুটি চোখ থেকে। শ্ৰান্ত ভগ্নকণ্ঠে সে বললে–আমি আর পারছি না। আমি আর পারছি না।
রতনবাবু গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়ালেন। বিপিনের স্ত্রী পাখা নিয়ে এগিয়ে এল; বিপিন অভিমানভরেই বললে–না। শ্ৰীমন্ত, তুমি বাতাস কর।
শ্ৰীমন্ত বিপিনের ছেলে। সে পাখাঁখাঁনি নিলে মায়ের হাত থেকে।
মশায় স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন—রোগীর দিকে লক্ষ্য রেখে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আলস্যের ভারে চোখের পাতা দুটি ভেঙে পড়ল বিপিনের। হাতখানি স্পর্শ করলেন মশায়। বিপিন আয়ত চোখ দুটি মেলে দেখে আবার চোখ বুজলে। বিপিনের নাড়িতে স্তিমিত উত্তেজনা অনুভব করতে পারছেন মশায়। দীর্ঘক্ষণ নাড়ি পরীক্ষা করে তিনি বেরিয়ে এলেন।
–জীবন! পিছন থেকে মৃদুস্বরে ডাকলেন রতনবাবু!
চিন্তিত হবার কারণ নাই রতন। অনিষ্ট কিছু ঘটে নি। কিন্তু সাবধান হতে হবে। এ রকম উত্তেজনা ভাল নয়, সে তো তোমাদের বলতে হবে না।
–সচরাচর এ রকম উত্তেজিত বিপিন হয় না। আজ হল। কিন্তু আমি যা জানতে চাইছি। তোমাদের বংশে নিদান দেবার মত নাড়িজ্ঞানের কথা আমি জানি বিশ্বাস করি। আমি তাই জানতে চাচ্ছি।
হেসে মশায় বললেন–সে নাড়ি দেখার আমল চলে গিয়েছে রতন। এ আমল এ কাল আলাদা। আজ কত ওষুধ কত চিকিৎসা আবিষ্কার হয়েছে। এখন কি আর সে আমলের বিদ্যেতে চলে? ধর ম্যালেরিয়ার জ্বর, আমার বিদ্যেতে ন দিনে জ্বর ছাড়বে, কিন্তু এখন ইনজেকশন বেরিয়েছে, প্যালুদ্রিন এসেছে, তিন দিনে জ্বর ছেড়ে যাচ্ছে। টাইফয়েড দেখে আমরা বলব আঠার দিন, একুশ দিন, আটাশ দিন, বত্রিশ দিন, আটচল্লিশ দিন। অথচ নতুন ওষুধে দশ-বার দিনে জ্বর ছেড়ে যাবে। আজ নাড়ি দেখে আমি কী বলব? আজ তো ডাক্তারেরা আসছেন, দেখবেন, তাদের জিজ্ঞেস কোরো।
–আপনি বলছেন না, আপনি লুকোচ্ছেন। কিন্তু নিজের ছেলের বেলায় তো লুকোন নি। নারীকন্ঠে এই কথাগুলি শুনে চমকে উঠলেন মশায়। ফিরে পিছনের দিকে তাকালেন। পিছনে দাঁড়িয়ে বিপিনের স্ত্রী। কপালে সিঁদুর-বিন্দু, সিঁথিতে সিঁদুরের দীর্ঘ রেখা। উৎকণ্ঠিত মুখে স্থির দৃষ্টিতে প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
স্মৃতি যেন তাকে চাবুক দিয়ে নির্মম আঘাত করলে। নিজেকে প্রাণপণে সংযত করে তিনি বললেন– সত্যি বলছি মা, আমি ঠিক কিছু বুঝতে পারছি না। তোমার বাড়ি এলেই আমার নিজের ছেলেকে মনে পড়ে। চঞ্চল হয়ে পড়ি। বুঝতে ঠিক পারি না। এর মধ্যে কোনো কোনো অৰ্থ নাই। আমাকে তোমরা ভুল বুঝে না।
জীবনমশায় হনহন করে বেরিয়ে এলেন।
–ডাক্তারবাবু, ফি-টা; ডাক্তারবাবু।
–কাল। কাল দিয়ে। কাল।
মর্মান্তিক স্মৃতি একেবারে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে হচ্ছে—ঠিক যেন সেই! প্রভেদ আছে। সে ছিল তরুণী যোল-সতের বছরের নিতান্তই গ্রাম্য মেয়ে। ঠিক এমনি দৃষ্টি নিয়েই প্রথম তার দিকে তাকিয়েছিল শশাঙ্কের স্ত্রী।
সে তাঁকে একরকম অভিসম্পাত দিয়েছিল। সে অভিসম্পাত পূর্ণ হয়েছে। বনবিহারী মরেছে। শশাঙ্ক মরেছিল আগন্তুক ব্যাধির আক্রমণে। তার নিজের কোনো অপরাধ ছিল না। নিজের প্রবৃত্তি রিপু হয়ে মৃত্যুকে সাহায্য করে নি। একালের বীজাণু পরীক্ষার ব্যবস্থা এবং একালের বিস্ময়কর বীজাণুনাশক ওষুধ থাকলে হয়ত–। না। আপন মনেই ঘাড় নাড়লেন মশায়। বাচত না শশাঙ্ক। একালেও পেনিসিলিন প্রয়োগ করে সকল রোগীকে বাঁচানো যায় না। রোগের কারণ, বীজাণুর স্বরূপ নির্ণয় করেও ফল হয় না। তবু শশাঙ্কের কোনো অপরাধ ছিল না। তার মৃত্যু মানুষের চিকিৎসাবিজ্ঞানে অপূর্ণতা অসম্পূর্ণতা। মৃত্যু ধ্রুব—কিন্তু সে মৃত্যু–আয়ুর পরিপূর্ণ ভোগন্তে সূর্যাস্তের মত; প্রসন্ন-সমারোহের মধ্যে। সেই কারণেই শশাঙ্কের কোনো অপরাধ ছিল না এবং ওই বটির প্রতি মমতায় তিনি অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। মুখে বলতে পারেন নি, ওই বধূটিকে নিমন্ত্রণ করে জীবন শেষবারের মত মাছ-মাংস খাইয়ে মনের বেদনাকে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে মেয়ে বিচিত্র মেয়ে! এই অদ্ভূত দেশের অদ্ভুত মেয়ে। যারা সেই কোন্ আদিকাল থেকে বৈধব্য পালন করে আসছে, দেহের ভোগকে ছেড়ে দিয়ে ভালবাসাকে বড় করতে চেয়েছে, এ মেয়ে সেই জাতের মেয়ে। অসাধারণ মেয়ে। বুঝতে পারেন নি মশায়।
সে তাঁকে অভিসম্পাত দিয়েছিল।
বিচিত্র যোগাযোগ, বনবিহারী এই অভিসম্পাত ফলবতী করবার জন্য আগে থেকেই সকল আয়োজন করে রেখেছিল তার জীবনে। সেই মেলার পর–প্রমেহ হয়েই শেষ হয় নি। বনবিহারী ক্ষান্ত হয় নি। আবারও হয়েছিল তার ওই ব্যাধি।
সে স্মৃতি তাঁর মর্মান্তিক।
দেহ যতক্ষণ জীর্ণ না হয় ততক্ষণ মৃত্যু কামনা করা পাপ, সে কামনা আত্মহত্যার কামনার শামিল। তিনি তাই করেছিলেন। আহার, বিহার সমস্ত কিছুর মধ্যে জীবনমশায় হয়ে উঠেছিলেন আর-এক মানুষ। কুলধর্মকে তিনি লঙ্ন করেন না। লঙ্ন করেছিলেন আয়ুকে রক্ষা করার, দীর্ঘ করার নিয়মকে। কোনো ব্যভিচারের পাপে কলঙ্কিত করেন নি বংশকে কিন্তু নিজের উপর অবিচারের আর বাকি রাখেন নি। মন উদ্ভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। দু হাতে উপার্জন করে চার হাতে খরচ করেছেন। অন্তর্দাহে যত পুড়েছেন তত সমারোহ বাড়িয়ে তুলেছেন বাইরের জীবনে। শুধু চিকিৎসাধর্মেই নিজেকে আবদ্ধ রাখেন নি, নানান কর্মে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। মদ খেয়ে নেশা করে লোক শোক দুঃখ ভুলতে চায়। তিনি কাজের নেশায়, নামের নেশায় নিজেকে ড়ুবিয়ে দিয়েছিলেন।
তাঁর আরোগ্য-নিকেতনের পাশে এই ইন্দারা করিয়েছিলেন তখনই। সেই শুরু। নিজে ছিলেন প্রেসিডেন্ট পঞ্চায়েত সরকারকে ধরে তিন ভাগ টাকা আদায় করে সিকি টাকা নিজেই দিয়েছিলেন। গ্রাম থেকে হাসপাতালের সামনে দিয়ে সেই দুর্গম পথচোর ধরার খানা, ঠ্যাঙভাঙার খন্দ-সঙ্কুল পথকে সুগম করে তুলেছিলেন। তাতেও দিয়েছিলেন সিকি টাকা।
দু-তিনখানা গায়ের মজুরেরা মজুরি না পেলে আরোগ্য-নিকেতনের সামনে এসে দাঁড়াত। তিনি যে-কোনো কাজে লাগিয়ে দিতেন।
মশার বংশের মহাশয়ত্ব তো যাবেই, যাবার আগে রক্তসন্ধ্যার মত সমারোহ করে তবে যাক।
নিজের দেহের উপর অবিচারেরও শেষ ছিল না।
সারাটা দিন না খেয়ে ঘুরেছেন। কল থাক বা না থাক, ঘুরেছেন—নেপালের ভাই সীতারামের ওষুধের দোকানে বসে গল্প করেই একবেলা কেটে গেছে। যে ডেকেছে গিয়েছেন চিকিৎসা করেছেন, ফিজ দিয়েছে নিয়েছেন—না দিয়েছে নেন নি। আবার পরদিন গিয়েছেন। সারারাত দাবা খেলা তখনই শুরু। গানবাজনার আসর বসিয়েছেন, যে-কোনো ওস্তাদ এলে সংবর্ধনা করেছেন, তার সঙ্গে খাওয়াদাওয়ার সমারোহ জুড়ে দিয়ে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে উল্লাস করেছেন। কিন্তু সন্ধ্যার সময় কালীমায়ের নাটমন্দিরে জনকয়েককে নিয়ে হরিনাম সংকীর্তন করতে বিস্মৃত হন নি। কল থেকে ফিরতে রাত্রি হলেও একবার মায়ের ওখানে গিয়ে একা হাত জোড় করে গেয়ে এসেছেন—
রাধাগোবিন্দ জয়, রাধাগোবিন্দ।
ওটুকু ভুলে যান নি। মশার বংশের বৈষ্ণব মন্ত্রের চৈতন্য তাঁর জীবনে হল না। পরমানন্দ মাধবকে পাওয়া তার ভাগ্যে নাই—তবে স্মরণ কীর্তন করতে ভুলে যান নি। উদ্দাম উদ্ভ্রান্ততার মধ্যেও ওইটুকু স্থিতি প্রশান্তি ছিল।
আতর-বউ বার বার আপত্তি করত, বলত-পস্তাবে শেষে বলে রাখছি।
হা-হা করে হাসতেন মশায়—কাছাকাছি কেউ না থাকলে বলতেন—আরে মঞ্জরীর জন্যে সে আমলে বাজারে ধার করে খরচ করেও পস্তাই নি আমি। তার বদলে তোমাকে পেয়েছি। আজ রোজগার করে খরচ করছি—তাতে পস্তাব?
–কত রোজগার কর শুনি? আতর-বউয়ের মুখ লাল হয়ে উঠত।
–কত দরকার বল না! কত টাকা! আজই এখুনি দিচ্ছি তোমাকে। বল কী গয়না চাই। কী চাই?
—কিছু চাই না। আমি তোমার কিছু চাই না। মেয়েদের বিয়ে—ছেলের লেখাপড়া হলেই হল। আমি দাসীবাদী হয়ে এসেছিলাম—তাই হয়েই থাকব।
–মিছে কথা বলছ। তুমি এসেছিলে শাসনদণ্ড হাতে নিয়ে। সেই শাসন চিরকাল করছ। বুঝছ না, তোমার ছেলের জন্যে বড় আটন উঁচু আসন তৈরি করে দিয়ে যাচ্ছি। ছেলে তো। তোমার আমার মত হাতুড়ে হবে না। হবে পাস-করা ডাক্তার। কিন্তু আমাদের ঘর তো নবগ্রামের ব্রাহ্মণ বনেদি জমিদারদের চেয়ে খাটো হয়েই আছে আজও। তাকে উঁচুতে তুলে ওদের সঙ্গে সমান করে দিয়ে যাচ্ছি।
এইখানে আতর-বউ চুপ করত। স্তব্ধ হয়ে বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের দোলার মধ্যে স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকত।
না থেকে উপায় ছিল না। বনবিহারী ওই রোগাক্রান্ত হয়েই ক্ষান্ত হল না; রোগমুক্ত হওয়ার পরই সে লজ্জা-সংকোচ ঝেড়ে ফেলে দিলে অশোভন বেশভূষার মত। বৎসর খানেকের মধ্যেই বাপ এবং মায়ের যুধ্যমান অবস্থার সুযোগে প্রায় স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসল। একদা সে এসে বললে—স্কুলে পড়া আর হবে না আমার দ্বারা।
মশায় তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন–হবে না?
–না। সংস্কৃত, অঙ্ক-ও আমার মাথায় ঢোকে না।
–ততঃ কিম্? হেসেই জীবনমশায় প্রশ্ন করেছিলেন।
অন্তরালবর্তিনী জননী প্রবেশ করে বলেছিলেন কলকাতায় নতুন ডাক্তারি স্কুল হয়েছে সেইখানে পড়বে ও। এখানে বছর বছর কত ফেল করবে?
—সেখানেও যদি ফেল করে?
–তখন তোমার মত ডাক্তার হবে। তুমি তো না পড়ে না পাস করে মুঠো মুঠো টাকা আনছ। বাপ যখন, তখন কুলবিদ্যেটা না হয় দয়া করে ছেলেকে শিখিয়েই দেবে।
—আমাদের কুলবিদ্যেতে যে সংস্কৃত বিদ্যে কিছু দরকার হয় ভদ্রে।
–কী, কী বললে আমাকে?
–ভদ্রে বলেছি। ভাল কথাই। মন্দ নয়।
–কিন্তু ঠাট্টা করে তো! তোমার মত অভদ্র আমি দেখি নি। বাপ হয়ে ছেলের উপর মমতা নাই?
চুপ করেই ছিলেন জীবনমশায়। কী বলবেন? ছেলের উপর মমতা? বনবিহারীকে এম. বি. পড়াবার বাসনা ছিল তাঁর। সে বাসনার মর্ম আতর-বউ বুঝবে না। ইচ্ছা ছিল ইচ্ছা ছিল বনবিহারী এম. বিহা তখন এল. এম. এস. উঠে এম. বি. হয়েছে—পড়তে আরম্ভ করলে তার বিয়ের আয়োজন করবেন। ঘটক পাঠাবেন। কান্দীতে কোনো জমিদার ঘরের মেয়ে আনবেন। গ্রামের জমিদারির এক আনা অংশ নবগ্রামে জমিদারি বলে গ্রাহ্য হলেও কান্দীতে গ্রাহ্য হয় না; বনবিহারী এম. বি. ডাক্তার হলে সে অগ্রাহ্য সাদর সাগ্ৰহ গ্রাহ্যে পরিণত হবে। কান্দী যাওয়ার বাসনা পূর্ণ করবেন। ওই ভূপীদের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর ঘরের মেয়ে আনবেন। থাক, সে থাক।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মশায় বলেছিলেনভাল, তাই হবে। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন—তুমি তো বেলগাছিয়া আর. জি. কর মেডিক্যাল স্কুলের কথা বলছ?
–হ্যাঁ, সেখানে পাসটাসের দরকার হয় না।
—জানি বাবা, জানি। কিন্তু সেখানেও ফেল হয়, আমাদের নবগ্রামের রায়বাবুদের অতীন পাস করতে পারে নি। স্কুলে পাস করতে না পার সেখানে পাস করতে হবে তো। সেইটে যেন মনে রেখো।
—সে পাস ঠিক করবে। তিন পুরুষ এই বিদ্যে ঘটছে। দেখিস বাবা, ভাল করে পড়িস। হাতুড়ে বলে লোকে যেন মুখ না বাঁকায়। মশায় বংশের এই অখ্যাতিটা তোকে ঘুচোতে হবে।
ডাঃ আর. জি. কর মহাপুরুষ। অল্পবিদ্যা অল্প-সম্বল গৃহস্থ ছেলেদের মহা উপকার করেছিলেন। দেশে তখন ম্যালেরিয়ার মহামারণ চলেছে—বিলাতি ডাক্তারির হাঁকেডাকে, সরকারি অনুগ্রহে, তাঁর পসারে কবিরাজদের ঘরগুলি বন্ধ হতে বরু হয়েছে। দেশে বৈদ্যের অভাব। সেই সময়ে এইসব আধাডাক্তারেরা অনেক কাজে এসেছিল। শতমারি ভবেদ্ বৈদ্য, সহস্ৰমারি চিকিৎসক। হাজার হাজার লোক হয়ত এদের ভুলে ত্রুটিতে মরেছে ভুগেছে—কিন্তু হাজারের পর লোকেরা বেঁচেছে, সেরেছে।
হাসলেন বৃদ্ধ জীবনমশায়। আর. জি. কর মেডিক্যাল স্কুলে পড়তে গেল বনবিহারী। বনবিহারীর সঙ্গে গেল মামুদপুরের গন্ধবণিকদের ছেলে-বনবিহারীর অন্তরঙ্গ বন্ধু রামসুন্দর। মাস ছয়েক পরে বনবিহারী প্রথম ছুটিতে বাড়ি এল। গায়ে ডবল ব্রেষ্ট কোট, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, সে আর এক বনবিহারী। বনবিহারীর মুখে সিগারেট। গায়ে কাপড়ে জামায় সিগারেটের গন্ধ; ডান হাতের তর্জনী ও মধ্যমা আঙুল দুটির আগায় হলদে রঙের দাগ ধরেছে। সিদ্ধ জ্যোতিষী যেমন মানুষের আচারে আচরণে বাক্যে রূপে কর্মে নিজের গণনার রূপায়ণ দেখতে পান, অনিবার্য অবশ্যম্ভাবীকে সংঘটিত হতে দেখেন এবং লীলাদর্শন-কৌতুকে মৃদু হাস্য করেন, ঠিক তেমনি হাসিই তার মুখে ফুটে উঠেছিল সেই মুহূর্তে। পরমুহূর্তেই সে হাসি বিস্ময়ে পরিণত হয়েছিল তার। ইন্দির গাড়ি থেকে নামিয়ে রেখেছিল হারমোনিয়ামের বাক্স, এক জোড়া বায়া-তবলা, একটা পিতলের বাঁশি, জোড়া দুই মন্দিা, একজোড়া ঘুঙুর।
তা ভাল, তা ভাল। নৃত্যগীত-কলাবিদ্যা চৌষট্টি কলার শ্রেষ্ঠ কলা, তা আয়ত্ত করা ভাল। নাদব্ৰহ্ম। সঙ্গীতে ঈশ্বর-সাধনা হয়, প্রেম জন্মায় তা ভাল! এবং দীনবন্ধুমশায় নাম-সংকীর্তন করতেন—জগৎমশায় পদাবলী শিখেছিলেন, জীবনকে শিখিয়েছিলেন, তিন পুরুষের তিনটে মৃদঙ্গ—আরোগ্য-নিকেতনেরই উপরের ঘরে যত্ন করে রাখা আছে। হাল আমলে তার কেনা বড় খোলখানাই এখন ব্যবহার হয়, এরপর নূতন কালে এবং কালের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে বংশের কর্মফলে অর্থাৎ তার কর্মফলে পরবর্তী পুরুষ খোল তিনখানার সঙ্গে বায়া-তবলা মন্দিরা বশি হারমোনিয়াম ঘুঙুর যোগ করলে তা ভাল! তা ভাল!
সময়টা ছিল সন্ধ্যা। আকাশে মাথার উপরে ছিল একাদশী দ্বাদশীর দ। জ্যোৎস্না ফুটিফুটি করছে। স্থানে স্থানে গাছপালা ঘরবাড়ির ছায়ার মধ্যে অন্ধকার যেখানে গাঢ় হয়েছে সেইসব স্থানে ফাঁকে ফাঁকে বেশ স্পষ্ট হয়ে ফালি ফালি ধোঁয়া কাপড়ের মত এসে পড়েছে। কোথাও কোথাও মনে হচ্ছে বোয়া কাপড় পরে কেউ যেন রহস্যময়ী আড়ালে গোপনে দাঁড়িয়ে সংকেত জানাচ্ছে। অতর্কিতে এই ছায়া দেখে চমকে উঠেছিলেন জীবনমশায়। প্রশ্ন করেছিলেন—কে? কে ওখানে?
হঠাৎ মঞ্জরীকে মনে পড়ে গিয়েছিল।
বনবিহারীর কুৎসিত রোগ প্রথম প্রকাশ হলেও তাকে মনে পড়েছিল। মনে হয়েছিল ভূপীর কুৎসিত রোগে তিনি হেসেছিলেন, তাই বোধহয় বনবিহারী সেই রোগ ধরিয়ে তাকে উপহাস করলে।
পরক্ষণেই হেসেছিলেন না কেউ নয়। জ্যোত্স পড়েছে দুটি ঘরের মাঝের গলিতে।
মঞ্জরী নয়, কৌতুকে সে হাসছে না।
মঞ্জরী তো মরে নি; সে ছায়ামূর্তি ধরে আসবে কী করে? তবে এ তারই অভিশাপ। তাঁর অভিশাপে মঞ্জরীর জীবন ব্যর্থ হয়েছে। মঞ্জরীর অভিশাপ তাঁকে লাগবে না? অথবা তার নিজের অভিশাপ মঞ্জরীর মত একটা সামান্য মেয়ের জীবন পুড়িয়ে শেষ হয় নি—ফিরে তাকে নিজেকেই লেগেছে।
মঞ্জরী বিধবা হয়েছে। ভূপী বোস মরেছে। ওই সেদিন আতর-বউ ছেলের সামনে মঞ্জরীর কথা তুলে তাঁকে মনে করিয়ে দিলে নতুন করে। তারপর তিনি খোঁজ নিয়েছিলেন। মঞ্জুরী বিধবা হয়েছে। সন্তান বলতে একটি মেয়ে। সে পেয়েছে বাপের সোনার মত রঙ আর মায়ের তনুমহিমা, মুখশ্ৰী। ভূপী সর্বস্বান্ত হয়ে মরেছে। মেয়েটির কিন্তু ওই রূপের জন্য এবং বংশগৌরবের জন্য বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে। মঞ্জুরী এখন মেয়ের পোষ্য। মেয়ের মেয়েকে নিয়ে সে নাকি সব ভুলেছে। পরমানন্দে আছে।
দাঁড়িয়ে ভাবছিলেন জীবনমশায়।
আতর-বউ এসে ডেকেছিল—বাড়ির মধ্যে এস! ছেলে এল। তুমি দাঁড়িয়ে রইলে।
জীবনমশায় বলেছিলেন আজ রাত্রে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে একটা খাওয়াদাওয়া করব ভাবছি। বনু এল।
—তা কর না।
জীবনমশায় ইন্দিরকে ডেকে একটা ফর্দ তৈরি করে দিলেন—কালাচাঁদ চন্দ রোকায় অবগত হইবা। ফর্দ অনুযায়ী জিনিসগুলি ফৰ্দবাহককে দিবা। দাম পরে পাইবা। ফর্দের শেষে পুনশ্চ লিখে দিলেন—আমার নামে বরং একটা হিসাব খুলিবা। অতঃপর তোমার দোকান হইতেই জিনিস আনিব। মাহ চৈত্র ও আশ্বিনে দুই দফায় হিসাবমত টাকা পাইবা।
নন্দ তখন ছোট। নন্দকে ডেকে বলেছিলেন নোটন জেলেকে ডেকে আন, বল। চার-পাঁচজন জাল নিয়ে আসবে। মাছ ধরানো হবে পুকুরে।
আর ডাকতে পাঠালেন বিখ্যাত পাখোয়াজী বসন্ত মুখুজ্জেকে। গাইয়েও তিনি নিয়ে আসেন।
হোক, গানবাজনা হোক। বাকি যে কটা দিন আছে—সে কটা দিন খেলে হইহই করেই কাটুক। পরমানন্দ মাধবকে পাওয়া তার ভাগ্যফলও নয়, কর্মফলও নয়।