আরোগ্য নিকেতন – 20
দাঁতু ঘোষাল চিৎকার করছিল।
এসেছে সকালবেলা আটটা না-বাজতে। এখন সাড়ে দশটা। নবগ্রাম ইস্টিশানে সাড়ে দশটার গাড়ি চলে গেল, এখনও বসে থাকতে হয়েছে। কেন? এত গুমোর কেন জীবন মশায়ের? কী মনে করে মশায়? দেশে ডাক্তারের অভাব? না—দাঁতু ঘোষাল এতই অবহেলার মানুষ?
নবগ্রামে চারটে ডাক্তার বসে ফ্যা-ফ্যা করছে। চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি ছিলচার বিছানার হাসপাতাল—তারপর যুদ্ধের সময় দেশে মন্বন্তর হলে দশ বিছানার হাসপাতাল হয়েছিল—এখন পঞ্চাশ বিছানার হাসপাতাল তৈরি হচ্ছে। একজন ছোট ডাক্তার ছিল—এখন দুজন ডাক্তার হয়েছে—নার্স এসেছে। সেখানে গিয়ে এলাম বলে একটা বিছানায় শুয়ে পড়লেই হল। সময়ে খাওয়া—সময়ে ওষুধ-য-বার খুশি ডাকলেই ডাক্তার। কেবল জাত থাকবে না। আর মান থাকবে না বলে যায় না। এ ছাড়া কবরেজ দুজন, তার মধ্যে ভূদেব কবরেজ দস্তুরমত পাসকরা, হোমিওপ্যাথ দুজন-আলি মহম্মদ আর বাঙাল ডাক্তার। দোকানে গেলে কেউ পয়সা নেয় না। জীবন মশায়ের মতিভ্ৰম হয়েছে, নইলে রোগীদের এমন অবহেলা কখনও করত না। কেবল পুরনো লোক-ধাত চেনে, মশার বংশের বংশধর—তাই আসে। আর আসবে না। কালই হয় ভূদেব কবরেজের কাছে নয় হরেন ডাক্তারের কাছে যাবে। যে দেশে গাছ থাকে না–সে দেশের ভেরে গাছই বিরিক্ষি। সেকালে ডাক্তার-বৈদ্যের অভাব ছিল, তাই জীবনমশায় ছিল ধন্বন্তরিনিদান হাকত। যেটা ফলত, সেটাই জাহির করত; যেটা ফলত না—সেটার বেলা চুপচাপ থাকত। মরার বদলে বাঁচলে, কে আর তা নিয়ে ঝগড়া করে? এবার এই বাঘা প্রদ্যোত ডাক্তারের হাতে পড়েছে; এইবার মজাটা বুঝবে। এই তো মতি কর্মকার বর্ধমান হাসপাতালে মাকে ভর্তি করে দিয়েছে। পায়ের ফটো নিয়েছে, ভিতরে হাড়ের কুচি আছে, কেটে বার করবে–বাস, ভাল হয়ে যাবে। প্রদ্যোত ডাক্তার বলেছে, আসুক ফিরে মতির মা। তারপর নাড়ি দেখার নিদান হকার ফাঁপা বেলুন ফুটিয়ে দেব।
ঘরে এদিকে রোজগারের অভাবে হাঁড়ি ঢনন—আর রোগীদের অবহেলা! বকেই চলেছে দাঁতু।
নন্দ বার কয়েকই বলেছে—এই দেখ ঠাকুর, ভাল হবে না। যা-তা বোলো না বলছি। কিন্তু দাঁতু ঘোষাল গ্রাহ্য করে নি। বলেছে—তুই বেটা বাঁশ চেয়ে কঞ্চি দড়, পীর চেয়ে খাদিম জিলে—সকাল থেকে পাঁচবার বলেছি তামাক দিতে। গ্রাহ্যই করলি না! তোর কি, মাস পোহলেই মাইনে নিবি। চুরি করে মশায়বাড়ির যাও ছিল শেষ করলি। এইবার রোগী তাড়িয়ে লক্ষ্মী ছাড়িয়ে তুই ছাড়বি।
পরান খাঁও প্রতিবাদ করেছিল—দেখ ঘোষাল, কথাগুলান তুমি অন্যায় বলছ। কঠিন রোগী দেখতে গেছেন মশায়, তাতে দেরি যদি হয়ে থাকে তবে ই সব কথা তুমি কী বলছ? ছিঃ আর কারে কী বলছ?
বলুক খা, ওকে বলতে দাও। ওই কথা ছাড়া অন্য কথা এখন ওর মুখে আসবে না। ওর বুদ্ধিই এখন বিপরীত বুদ্ধি। সর্বনাশকালে মানুষের বিপরীত হয়। আর মৃত্যুকালের চেয়ে সর্বনাশের কাল তো মানুষের আর হয় না। ঘোষাল যাবে। যাবার কাল যত কাছে আসবে তত এটাই ওর বাড়বে।
হেসেই কথাগুলি বললেন– জীবনমশায়। তিনি আরোগ্য-নিকেতনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন। চণ্ডীতলা থেকে গ্রামে ঢুকবার পথটাই সদর-রাস্তার উলটো দিকে। সেই পথে কবিরাজখানার পিছন থেকে ঢুকে তিনি বেরিয়ে এলেন সামনে।
দাঁতু ঘোষাল এক মুহূর্তে যেন জমে পাথর হয়ে গেল। ভয়ার্ত বিস্ময়ে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল জীবন মশায়ের দিকে। হতবাক হয়ে গিয়েছে সে। হাত দুটো শিথিল হয়ে ঝুলে পড়েছে।
জীবনমশায় চেয়ারখানা টেনে নিয়ে বসলেন, বললেন–দেরি একটু হয়ে গেল আজ। চণ্ডী মায়ের স্থানের গোঁসাইজীর অসুখ। হয়তবা যাচ্ছেন গোঁসাই। সেখানে যেতে হয়েছিল সকালে উঠেই। নবগ্রামের রতনবাবুর ছেলে বিপিনবাবুর কঠিন অসুখ, সেখানেও যেতে হয়েছিল। যারা এতদূর দেখাতে এসেছে তাদের তো এমন জরুরি অবস্থা নয়।
দাড়িতে হাত বোলাতে লাগলেন জীবনমশায়। রোগীর দল তবু কেউ কোনো কথা বলতে পারলে না। দাঁতু ঘোষালের দিকেই তারা তাকিয়ে ছিল। দাঁতু দাঁড়িয়ে ছিল মৃত্যু দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত আসামির মত।
অকস্মাৎ সে ভাঙা গলায় বলে উঠল—কী বললে মশায়? আমি বাঁচব না? আমি মরব?
জীবনমশায় নিস্পৃহ নিরাসক্তের মত বললেন–এ রোগ তোমার ভাল হবে না ঘোষাল। এই রোগেই তোমাকে যেতে হবে। এ তোমার ভাল হবার রোগ নয়। তবে দু মাস কি ছ মাস কি দু বছর পাঁচ বছর—তা কিছু বলছি না আমি।
দাঁতু এবার চিৎকার করে বলে উঠল—তুই গো-বদ্যিতুই গো-বদ্যি হাতুড়ে, মানষুড়ে।
জীবনমশায় বলেই গেলেন—এ যদি তোমার ভাল হবার হত ঘোষাল তবে দুদিন যেতে না যেতেই তুমি কী খুব কী খাব করে ছুটে আসতে না, তামাক গাঁজার জন্যে তুমি ক্ষেপে উঠতে না। মৃত্যু-রোগের এ হল একটা বড় লক্ষণ। রাগের সঙ্গে রিপুর যোগাযোগ হলে আর রক্ষে থাকে না। তোমার তাই হয়েছে।
দাঁতু এবার পট করে তার পৈতেগাছটা ছিঁড়ে ফেলে চিৎকার করে উঠল—আমি যদি বামুন হই তবে ছ মাস যেতে-না-যেতে তোর সর্বনাশ হবে। বামুনের মেয়ের অভিশাপে তোর ব্যাটা মরেছে এবার ব্ৰহ্মশাপে তোর সর্বনাশ হবে।
বলেই সে হনহন করে নেমে পড়ল, আরোগ্য-নিকেতনের দাওয়ার উপর খানিকটা গিয়েই সে থমকে দাঁড়াল। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে–চললাম আমি হাসপাতালে বড় ডাক্তারের কাছে। আজই আমি হাসপাতালে ভর্তি হব। বাঁচি কি না দেখ।
মশায় হাসলেন। তারপর বললেন–কার কী বল?
এসে দাঁড়াল একটি লোক। কালাজণ্ডিস হয়েছে। মানুষটা যেন হলুদ মেখে এসেছে। প্রতিবিধান অনেক করেছে। কামলার মালা নিয়েছে মালাটা হাঁটু পর্যন্ত লম্বা হয়েছে; তাতে সারে নি। হাসপাতালে গিয়েছে—তাতেও বিশেষ কিছু হয় নি। অবশেষে মশায়ের কাছে এসেছে।
জীবন দত্ত বললেন–তাই তো বাবা। হাসপাতালে যখন কিছু হয় নি তখন সময় নেবে। আর ওষুধ যদি কবিরাজি মতে খাও—বোধহয় তাই ইচ্ছে, নইলে আমার কাছে আসতে না, মুশকিল হচ্ছে আমি তো ওষুধের কারবার তুলে দিয়েছি।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন–আমি মোটামুটি চিকিৎসা করাই ছেড়ে দিয়েছি। নতুন কাল, নতুন চিকিৎসা, নতুন রুচি এ তো আমার কাছে নাই। তা ছাড়া আমার নিজেরও আর ভাল লাগে না। তবু এককালে চিকিৎসা করতাম; দু-চার জন পুরনো লোক আজও ছাড়ে না, তাই তাদের দেখি। বুঝেছ না?
একটু হাসলেন। বোধহয় দাঁতু ঘোষালের প্রসঙ্গটা তার মনের মধ্যে তখনও ঘুরছিল।
—তুমি বরং ভূদেব কবরেজের কাছে যাও। সে ওষুধপত্র রাখে। আর নতুন কালে কবিরাজি শিক্ষার কলেজ হয়েছে, সেখানে পাস করেও এসেছে। বুঝেছ না? কবিরাজিতে নিজের ওষুধ ছাড়া চিকিৎসা করে ফল হয় না।
—আজ্ঞে না ডাক্তারবাবু, আপনি দেখুন আমাকে। নইলে আমি হয়ত বাঁচব না। আমার বাবা দাদা সবাই ঠিক এই বয়সে মারা গিয়েছে। পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের ভিতর। আমাকে বাঁচান।
–না-না। না-বাচবার মত তোমার কিছু হয় নি বাপু। আর বাঁচা মরার ব্যাপারটাই একটা আশ্চর্য ব্যাপার। ওর উপরে যদি মানুষের হাত থাকত! হাসলেন ডাক্তার। শুনলে না, দাঁতু বলে গেল—আমার ছেলের কথা! সে নিজেও ডাক্তার ছিল। এ কী, কাঁদছ কেন তুমি? আচ্ছা আচ্ছা। আমিই দেখব। তুমি বস। আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি, ভূদেবের কাছে কিনে নিয়ে যাও। তারপর আমি ঘরে তৈরি করে দেব। বুঝেছ! ভয় নেই। ভাল হয়ে যাবে। এত ভয় পেয়েছ কেন?
দাড়িতে হাত বোলাতে লাগলেন ডাক্তার। লোকটি বড় ভয় পেয়েছে। ভয় রোগের জন্য নয়। বাবা দাদা ঠিক এই বয়সে মরেছে বলে ও বেচারিও ভয় পেয়েছে। ভয়টা খুব অহেতুকও নয়। এমন হয়। বিচিত্রভাবে হয়।
পরান হেসে লোকটিকে বললে—আর কিছু ভয় তুমি করিয়ো না বেটা। মশায় বলেছেন ভয় নাই। উ একেবারে বেদবাক্যি!
পরান তার মন রাখছে সে জীবনমশায় জানেন কিন্তু এ মন রাখাটুকু তার ভাল লাগে। পরান লোক ভাল। কৃতজ্ঞতা আছে। সেই তার প্রথম জীবনে জীবন দত্ত তাকে টাইফয়েড থেকে বাঁচিয়েছিলেন, তখন পরানের অবস্থা সচ্ছল ছিল না, দিনমজুরি করত। জীবন দত্তের বাড়িতেই মজুরি খেটেছে, তখন তিনি তার বিনা পয়সায় চিকিৎসা করেছিলেন—সে কথা পরান আজও ভুলে যায় নি। সে এখন বড় ডাক্তার ডাকতে পারে। দৈনিক চার টাকা ফি দিতেও তার গায়ে লাগে না, তবু সে জীবন দত্ত ছাড়া কাউকে দেখায় না। শুধু কৃতজ্ঞতাই নয়—জীবনমরণ প্রশ্ন নিয়ে রোগ আসে মানুষের শরীরে, সেখানে কৃতজ্ঞতার ক্ষেত্র খুব বড় নয়, বড় বিশ্বাসের কথা সেই বিশ্বাস আছে পরানের। যে তাকে এত বড় বিশ্বাস করে, তাকে স্নেহ না করে কি পারেন। তিনি? তবে বিবির জন্য পরানের ভাবনায় ডাক্তার কিঞ্চিৎ কৌতুক না করে পারেন না। একবার তিনি নিজেই বলেছিলেন, পরান বিবিকে একবার না হয় কলকাতা নিয়ে যাও। এখন সব নানা রকম পরীক্ষা হয়েছে—পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে এস। ডাক্তার কথাটা গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন। কৌতুক করেন নি।
ডাক্তার বলেছিলেন—তা হলে এক কাজ কর, হাসপাতালের ওই বড় ডাক্তারকে একদিন কল দাও। ওঁকে দেখাও। উনি বলে দেবেনচিঠি দিয়ে দেবেন কোথায় কার কাছে দেখাতে হবে।
প্রদ্যোত ডাক্তার রোগিণীকে দেখে একটু হেসেছিলেন। বলেছিলেন—অসুখ মনের, শরীরের নয়। এবং—হুঁ। একটু থেমে বলেছিলেন—কোনো মনস্তাত্ত্বিক ডাক্তারকে দেখালে ফল হতে পারে।
মশায় কথাটা বুঝেছিলেন, পরান বুঝতে পারে নি; কিন্তু তবু পরান ওই নতুন ডাক্তারের উপর বিরক্ত হয়েছিল। তার বিবি তার চোখের সামনে রোগে ভুগছে—সে তার সেবা করছে, চোখে দেখে স্পৰ্শ দিয়ে সে অসুখ অনুভব করছে—আর ডাক্তার বলছে অসুখ নয়!
সে শুধু প্রদ্যোত ডাক্তারকেই বাতিল করে নি—কলকাতায় যাওয়ার কথাও বাতিল করে দিয়েছিল। শুধু প্রশ্ন করেছিল—আপুনি কী বুঝছেন বলেন যদি, বুঝেন কি পরানের ভয় আছে মিত্যু হতে পারে—তা হলে না হয়
—না, সে ভয় নেই। তবে ভুগতে পারে। বুঝছ না?
–তা ভুগুক। না হয় ভুগবে কিছুদিন। আপুনি ছাড়া কারুর দাওয়াই আমি খাওয়াব না।
সে অবধি এই চলছে। ডাক্তার তিন দিন অন্তর যান। কিন্তু পরানের ইচ্ছা রোজ যান তিনি। ডাক্তার তা যান না। পরান রোজ আসে। খবর বলে যায়, বলে—কিছু বদল করবেন নাকি?
–না—না। ওই যা চলছে—চলুক।
–এই পোস্টাই যদি কিছু দিতেন! আর এই ঘুম হবার ওষুধ! রাতে একবারও চোখ বোজে না, ছটফট করে। এ পাশ আর ও পাশ। আর টুকটুক করে জল খাবে।
একটা কিছু দিলেই পরান খুশি।
আজও পরানের একটা ওষুধ চাই। সে ভয়ার্ত জোয়ানটিকে জীবন মশায়ের অদ্ভুত চিকিৎসা পারঙ্গমতার কথা বোঝাতে বসেছে সেই উদ্দেশ্যেই।
ডাক্তার রোগীর পর রোগী দেখে চলেছেন। এই সময়ে এসে দাঁড়াল এক ছফুট লম্বা মানুষ—মশায়, একবার যে দেখতে হবে। গম্ভীর ভরাট গলা।
–কী? তোমার কী হল?
–কী হল বুঝতে তো পারছি না। কাশি সর্দি—মধ্যে মধ্যে জ্বর; কিছুতেই ছাড়ছে না। হাতখানা বাড়িয়ে দিলে—ছ-ফুট লম্বা—তেমনি কাঠামো—এক পরিণত বয়সের জোয়ান। ঘাট মহেশপুরের রানা পাঠক। এ অঞ্চলে রানা পাঠক শক্তিশালী জোয়ান; লাঠি খেলা, কুস্তি করা, নদীর ঘাটে নৌকা খেয়া দেওয়া, দেবস্থানে বলিদান করা তার কাজ। বছর কয়েক আগে পর্যন্ত প্রতি বৎসর অম্বুবাচীতে কুস্তি প্রতিযোগিতায় রানা পাঠকের নাম একবার কয়েক দিনের জন্য মুখে। মুখে ফিরত। আর-একবার রানার নাম শোনা যেত কালীপূজার সময়। রানার মহিষবলির কৃতিত্ব লোকের মুখে গল্পের কথা। বাড়িতে কিছু জমিজেরাত আছে—তার ধানে ফসলে আর খেয়াঘাটের নৌকার আয়ে রানা পাঠকের বেশ ভালই চলে যায়। মহেশপুরের ঘাটের ডাক তার একচেটে। ও ঘাটে অন্য কেউ ডাক নিয়ে নৌকা পার করতে পারে না। রানা পাঠকের অসুখ কখনও শোনেন নি মশায়। কিন্তু আজ রানাকে দেখে জীবনমশায় বিস্মিত হলেন। এ কী চেহারা হয়েছে রানার? চোখের কোলে কালি পড়েছে, শক্ত বাঁশের গোড়ার দিকের মত মোটা কবৃজির হাড় বেরিয়ে পড়েছে—জামার ফাঁক দিয়ে কণ্ঠ দেখা যাচ্ছে।
–রানা, বাবা এ তুমি ভাল করে দেখাও। তুমি বরং বর্ধমানে গিয়ে দেখিয়ে এস। নয়তো এখানেই আজকালকার ভাল ডাক্তারদের দেখাও। এ তোমার টোটকাতে কি মুষ্টিযোগে যাবে না।
রানা মাথাটা ঝাঁকি দিয়ে বললে—উঁহুঁ! ওরা গেলেই বলবে যক্ষ্মা হয়েছে। বুঝলেন না–ওদের এইটে বাতিক। তারপর ফর্দ দেবে ইয়া লম্বা। বুকের ফটো তোলাও, চায়ের থুতু পরীক্ষা করাও-এই কর—তা কর। চিকিৎসা তারপর! যক্ষ্মা হয়ত আমার হয়েছে। বুঝেছেন…একটা মেয়েছেলের কাছ থেকে ধরার কথাই বটে। তার আবার পরীক্ষা কিসের? এত পরীক্ষাই যদি করতে হবে তো—ডাক্তারি কিসের? আপনি হাত দেখুন। বলে দেন কী করতে হবে। ওষুধ দেন। আমি সব ঠিক ঠিক করব। তারপরে আমার পেরমায়ু আর আপনার হাতযশ! আর ওইসব ফোঁড়া-যুঁড়ি আমার ধাতে সইবে না মশায়। যক্ষ্মার ওষুধ তো আপনাদেরও আছে।
–আছে। কিন্তু এখন যেসব ওষুধ বেরিয়েছে সেসব অনেক ভাল ওষুধ রানা। অনেক ভাল।
–আপনি বলছেন?
–বলছি রানা। তাতে তো লজ্জা নাই বাবা। তুমি বরং হরেন ডাক্তারের কাছে যাও। আর ওই বুকের ফটো তোলানোর কথা বললে না বাবা, ওটা করানো ভাল। এক্স-রে করলে বোঝা যাবে, চোখে দেখা যাবে কতখানি রোগ হয়েছে। আবার ভাল হলে একবার এক্স-রে করলে বুঝতে পারবে—একেবারে নির্দোষ হল কি না। এখন ধরহয়ত একটু থেকে গেল। শরীর ভাল হয়েছে—সেটা ধরা গেল না। সেই একটুই আবার বাড়বে—কিছুদিন পর।
রানা ঘাড় নাড়লে।
বার কয়েক ঘাড় নেড়ে বললে–উঁহুঁ। তা হলে আমি ভূদেব কবরেজের কাছে যাই। উ সব কড়া ডাক্তারি ওষুধ আমার ধাতে সইবে না। তা ছাড়া মশায়, ডাক্তারদের কথা বড় চ্যাটাং চ্যাটাং। বুঝেছেন—আমাদিগে যেন মানুষই মনে করে না। আপনি দেখতেন সেকালে—সে পসার তো দেখেছি আমি।—এরা টাকা রোজগার করে অনেক, ফি বেশি। ফি ছাড়ে না। কিন্তু সে পসার নাই। আপনারা রোগীর সঙ্গে আপনার লোকের মত কথা বলতেন। ঘরের লোকের মত। আমার আবার মেজাজ খারাপ। কে জানে ঝগড়া হয়ে যাবে কবে। তার চেয়ে কবরেজি ভাল। লোহাতে মাথা বাঁধিয়ে তো কেউ আসে নাই সংসারে, মরতে তো হবেই। আজ নয় কাল। তা কড়া কথা শুনে-খারাপ কথা শুনে মরি কেন?
রানা উঠে চলে গেল।
–রানা! অ–রানা!
–আজ্ঞে?
–কবিরাজিই যদি করবে বাবা তবে পাকুড়িয়া যাও। সেন মশায়দের বংশ বড় বংশ বড় আটন। বিচক্ষণ বৈদ্য আছেন—ভাল ওষুধ রাখেন—সেখানে যাও। বুঝেছ? এ অবহেলার। রোগ নয়।
–পাকুড়ে যাব বলছেন?
–হ্যঁ তাই যাও। ভূদেব এখনও ছেলেমানুষ! বুঝেছ? ইচ্ছে কর তো ভূদেবকে সঙ্গে নিয়ে যাও।
—দেখি! টাকাতে কুলানো চাই তো! হাসল রানা। আপনার কাছে আসা—সেজন্যেও বটে যে! কম টাকায় চিকিৎসা—এ আর কোথায় হবে?
চলে গেল রানা পাঠক। শক্তিশালী বিপুলদেহ অকুতোভয় রানা বন্যার সঙ্গে ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে; কিন্তু অসহায় হয়ে পড়েছে আজ। মৃত্যুর কাছে মানুষ নিতান্ত অসহায়।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন জীবনমশায়। রানার কথাই ভাবছিলেন। কথাটা মিথ্যা বলে নি রানা। দরিদ্র দেশ, দরিদ্র মানুষ, টাকা পাবে কোথায়? ডাক্তারেরাই বা করবে কী? তারাই বা। খাবে কী? নিজের অবস্থা ভেবেই কথা বলছেন জীবনমশায়। আজ সকাল থেকে চারটি টাকা ফি পেয়েছেন। তাঁর পিতামহ, পিতা, তিনি—এতকাল পর্যন্ত যে সম্পত্তি করেছিলেন তার অনেক। চলে গিয়েছে এই পনের-কুড়ি বছরের মধ্যে। আজ তিনি প্রায় নিঃস্ব। লোকে বলে ভাগ্য। আতর-বউ নিজের কপালে করাঘাত করে। কিন্তু তিনি তো জানেন-দায়ী তিনি নিজে। তা ছাড়া আর কে দায়ী?
সশব্দে একখানা গরুর গাড়ি এসে দাঁড়াল।
–কই, গুরুদেব কই?
নামল শশী। শশীর চোখ লাল। মদ খেয়েছে এই দিনে-দুপুরে। রামহরিকে দেখবার জন্য নিতে এসেছে। রামহরি মৃত্যু-কামনায় জ্ঞানগঙ্গা যাবে। গত রাত্রের কথাগুলি আবার সব মনে হল মশায়ের। রামহরি যাবে মৃত্যুবরণ করতে?
চারটি টাকা নামিয়ে দিলে শশী।
–আমি বলেছি চার টাকা দিয়ে সারলে হবে না রামহরি। জীবন মশাকে শেষ দেখা দেখাবে, আরও লাগবে বাবা। আমাদিকে বরং সেকালে চোলাই মদ খাইয়েছ-পাটা খাইয়েছ, জীবন মশায়কে তো কিছু খাওয়াও নি। খাইয়ে থাকলে বড়জোর লাউ-কুমড়ো। বেটা উইলটুইল করছে। বললে, মশায়কে সাক্ষী করব। পেনামী দোব তখন। নিশ্চয় দোব।
হঠাৎ হাসি থামিয়ে বললে—দাঁতু ঘোষাল বেটা মরত, ও বেটার নিদান অ্যাঁকলেন কেন? বেটা কাঁদছে—প্রদ্যোত ডাক্তার তড়পাচ্ছে।
মশায় সেকথা গ্ৰাহ্য করলেন না। দাঁতু মরবে, এই রোগেই মরবে, প্রবৃত্তিকে এমন প্রবল রিপু হয়ে উঠতে কদাচিৎ দেখা যায়। কোনোমতেই বাঁচাতে পারবে না প্রদ্যোত। বাড়ির দিকে অগ্রসর হলেন তিনি, বললেন– দাঁড়া, গিনি বকছে কেন দেখি। আতর-বউয়ের তীক্ষ তিরস্কার তিনি শুনতে পেয়েছেন।
আতর-বউ তিরস্কার করছেন তাকেই যাকে আজীবন তিরস্কার করে আসছেন নিজের অদৃষ্টকে। হায়রে অদৃষ্ট, হায়রে পোড়াকপাল!
নন্দ ও-পাশে চুপ করে বসে আছে, মাথা হেঁট করে মাটি খুঁটছে। নন্দ জড়িত আছে, তাতে সন্দেহ রইল না তাঁর।
মশায় দুজনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন–কী হল?
–কিছু না।
নন্দ বললে—দাঁতুকে উব বলবার আপনার কী দরকার ছিল? হাসপাতালের ডাক্তার যাতা বলছে—আমি শুনে এলাম। নিজের কানে।
–নিদান হাকবে তো আমার নিদান হক। দেখ হাত দেখ।
–তোমার নিদান হাত না-দেখেই আমি হাকতে পারি।
–বল, বল—তাই বল, কবে মরব আমি? এ জ্বালা আমি আর সইতে পারছি না। শুধু নাই। শুধু নাই আর নাই। আর তুমি ন্যায়ের অবতার সেজে বসে আছ। রতনবাবুরা চার টাকা ফি দিতে এসেছিল—তুমি দু টাকা নিয়ে দু টাকা ফেরত দিয়ে এসেছ। তুমি যাকে দেখছ তাকেই বলে আসছ—মরবে তুমি মরবে।
জীবনমশায় হা-হা করে হেসে উঠলেন এবার। সে হাসিতে স্তব্ধ হয়ে গেলেন আতর-বউ। জীবনমশায় বললেন–মরবার জন্যেই জন্ম আতর-বউ। সবাই মরবে, সবাই মরবে, কেউ অমর নয়।
ঘোরটা কাটিয়ে আতর-বউ অকস্মাৎ চিৎকার করে উঠলেন—পৃথিবীর কথা আমি জানতে চাই না। আমি কবে মরব তাই বল।
—আমার মৃত্যুর পর।
নিষ্ঠুর বজের মত কঠোর কথা! আতর-বউ নির্বাক বিমূঢ় হয়ে গেলেন।
–আমার মৃত্যু কবে হবে সেইটেই বুঝতে পারছি না। পারলে দিন-তারিখ বলে দিতাম! বনবিহারীর মৃত্যু জানতে পেরেছিলাম। তোমাকে বলেছিলাম, তুমি বিশ্বাস কর নি। এটা বিশ্বাস কোরো।
জীবনমশায় বেরিয়ে এলেন। শশী রাঙা চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
–চল। শশী!
শশীর যেন এতক্ষণে চেতনা ফিরে এল। বললে–চলুন। হঠাৎ হেসে বললে–ঠিক বলেছেন। মরবে না কে? সবাই মরবে। ওই হাসপাতালের ডাক্তার, ও বেটা কি অমর নাকি?
ডাক্তার বললেন–চুপ কর। ওসব কথা থাক।
হায়রে মানুষ! নানা, হায় কেন? এই তো রামহরি, হাসতে হাসতে মরতে চলেছে।
সত্য সত্যই প্রদ্যোত ডাক্তার কঠিন ক্রোধে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে। গণেশ ভট্টাচার্যের মেয়েকে আর-একবার দেখে একটু আশান্বিত হয়েই এসে আপিসে বসেছে ঠিক এমনই মুহূর্তেই দাঁতু এসে হাউ হাউ করে কেঁদে পড়ল।
প্রদ্যোত ডাক্তারের প্রায় পা চেপে ধরে বললে—ডাক্তারবাবু গো! আমাকে বাঁচান আপনি!
–কী হয়েছে? উঠুন। ভাল করে বলুন। চেঁচাবেন না মেলা।
–ওগো আমাকে বাঁচান গো। আমি আর বাঁচব না।
–কী হয়েছে যে তাই বাঁচবেন না?
–মশায় বললে গো! জীবনমশায়!
–কে? জীবন দত্ত?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। বললে এই তোর মৃত্যুরোগ। শিবের বাবা এলেও বাঁচাতে পারবে না।
–জীবন ডাক্তারের সঙ্গে শিবের বাবার আলাপ-পরিচয় আছে তা হলে? না-মাথা খারাপ হয়েছে লোকটার।
–আজ্ঞে? ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল দাঁতু ঘোষাল।
–উঠুন, কী হয়েছে দেখি। চলুন ওই ঘরে, টেবিলের উপর শুয়ে পড়ুন। বলুন কী হয়েছে। সমস্ত শুনে ডাক্তার ভ্রূ কুঞ্চিত করে বললেন–এই সমস্ত লিখে আপনি আমাকে দিতে পারবেন?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। হাজার বার। এখুনি লিখে দিতে পারি। বেটা কায়েত—
ডাক্তার ধমক দিয়ে বললও সব কী বলছেন? বেটা কায়েত কী? জানেন আমিও কায়স্থ?
জিভ কেটে দাঁতু বললে–আপনাকে তাই বলতে পারি? আমি বলছি ওই জীবনকে। বেটা হাতুড়েকে। কিন্তু আমি বাঁচব তো? ঝরঝর করে কেঁদে ফেললে দাঁতু।
–কী হয়েছে তাই বাঁচবেন না। ওষুধ খান–নিয়ম করে চলুন–
কম্পাউন্ডার হরিহর পাশের ঘরে ওষুধ তৈরি করছিল। সে বললে–তা দাঁতু পারবে না। রোগ তো ওর ডেকে আনা। খেয়ে খেয়ে করেছে। দুদিন ভাল থাকলেই ব্যস ছুটবে কারুর বাড়ি—আজ তোমাদের বাড়ি দুটো খাব। হাসতে লাগল সে।
ডাক্তার বলল-হাসপাতালে থাকতে হবে আপনাকে। থাকবেন?
—তাই থাকব। দাঁতু বাঁচতে চায়। সে মরতে পারবে না।
–ওকে ভর্তি করে নিন। বলেই ডাক্তার একটা কাগজ টেনে নিল—ম্যাজিস্ট্রেটকে লিখবে এই কথা। এই ধরনের নিদান হেঁকে মানুষের উপর মর্মান্তিক পীড়ন—এ যুগে এটা অসহনীয় ব্যাপার। এর প্রতিকার করা প্রয়োজন।
কিছুক্ষণ পরে আধলেখা দরখাস্তখানা টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিলে। থাক।
লোকটিকে যেন একটা বাতিকে পেয়েছে। মৃত্যু ঘোষণা করে আনন্দ পাচ্ছে। আশ্চর্য! মৃত্যু পৃথিবীতে নিশ্চিতই বটে, সে কে না জানে? তাকে জয় করবার জন্য মানুষের চেষ্টার অন্ত নাই। সে সাধনা অব্যাহত চলে আসছে। আবিষ্কারের পর আবিষ্কার হয়ে চলেছে। আজও তাকে রোধ করা যায় নি। আজও সে ধ্রুব—তবু তো মর্মান্তিক, বিয়োগান্ত ব্যাপার। তার মধ্যে যেন একটা আধ্যাত্মিক কিছু আরোপ করে এই মৃত্যুদিন ঘোষণা চমকপ্রদ বটে, রোমান্টিকও বটে কিন্তু নিষ্ঠুর। ঠিক পশুকে বলি দেওয়ার মত। পূজা-অৰ্চনার আড়ম্বরে আধ্যাত্মিকতার ধূম্ৰজালে আচ্ছন্ন। এক কল্পলোক সৃষ্টি করে মৃত্যুকে মুক্তি বলে ঘোষণা করে খাঘাত করার মতই নিষ্ঠুর প্রথা। জীবন দত্ত তারই পুরোহিত সেজে বসে আছে।
হি মাস্ট স্টপ থামতে হবে তাকে। না থামে—থামাতে হবে, হি মাস্ট বি স্টপ্ড্।
এই অৰ্চনা মেয়েটির হাত দেখলেও ও নিদান হেঁকে যেত। ওকে তা না দেখতে দিয়ে ভাল করেছেন তিনি। অদৃষ্টবাদী এই দেশের এই নিদান-হাকিয়েরাই যোগ্য চিকিৎসক ছিল। কবচ মাদুলি জড়িবুটি চরণামৃত কিছু দিতে বাধে না এদের।
লোকটা নিজের ছেলেরও নাকি মৃত্যু ঘোষণা করেছিল এবং করেছিল মায়ের অর্থাৎ নিজের স্ত্রীর সম্মুখে। উঃ, কী নিষ্ঠুর! কল্পনা করা যায় না।
প্রদ্যোত ডাক্তার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সিগারেট ধরিয়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে নার্সদের অফিসের দিকে গেল। নার্সকে ডাকল—বলল—ওই পেশেন্ট ওই বুড়ো বামুনকে ভর্তি করা হয়েছে। ভাল করে নজর রাখবে। ওর স্ট্রল একজামিনেশন দরকার। আজই করে রাখবে।
তারপর সমস্ত ওয়ার্ডটা ঘুরে বেড়িয়ে এসে দাঁড়াল ফাঁকা মাঠে–নতুন বাড়িটার সামনে। সুন্দর হচ্ছে বাড়িখানা। ডিসেন্ট বিল্ডিং। চারিদিকে চারটে উইং থাকলে আরও সুন্দর হত। হবে, স্কিম আছে। পরে হবে।
নতুন কাল। বিজ্ঞানের যুগ। অদৃষ্ট নিয়তি নির্বাসনের যুগ। ব্যাধিকে জয় করবে মানুষ। মৃত্যুর সঙ্গে সে যুদ্ধ করবে। মৃত্যুর মধ্যে অমৃত খুঁজেছে মানুষ—অসহায় হয়ে। এবার জীবনের মধ্যে অমৃত সন্ধানের কাল এসেছে। একালে অনেক আয়োজন চাই। অনেক কিছুর আয়োজন। সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন—এই লোকগুলির নির্বাসন। এই জীবন মশায়দের। নিদান! নিদান! মৃত্যুর সঙ্গে যেন একটা প্রেম করে বসে আছে এদেশ! গঙ্গার ঘাটে গিয়ে জলে দেহ ড়ুবিয়ে মরাই এখানে জীবনের কাম্য। মতির মায়ের এক্স-রের রিপোর্ট পেয়ে প্রদ্যোত যেন প্রেরণা পেয়েছে। একটা। এক্স-রে রিপোর্ট নিয়ে মতি আজ সকালে বর্ধমান থেকে ফিরে এসেছে। বর্ধমানের হাসপাতালের ডাক্তার প্রদ্যোতের চেয়ে সিনিয়র হলেও তার সঙ্গে প্রদ্যোত ডাক্তারের বেশ একটি সম্প্ৰীতি আছে। সে তাকে লিখেছিল—আমাকে যেন সমস্ত রিপোর্ট অনুগ্রহ করে জানাবেন। কারণ এই কেসটিতে আমি খুবই ইন্টারেস্টেড; এই বুড়িকে মরণ ধ্রুব বলে খোল করতাল সহযোগে নাম সংকীর্তন করে জ্ঞানগঙ্গা পাঠাবার ব্যবস্থা হচ্ছিল এখানকার সে আমলের এক জ্ঞানবৃদ্ধ বৈদ্য মহাপ্রভু নিদান হেঁকেছিল—কয় মাস, কয় দিন, কয় দণ্ড, কয় পলে যেন বৃদ্ধার প্ৰাণ-বিহঙ্গ পিঞ্জর ত্যাগ করবে; এই পায়ের-ব্যথা রোগেই মরবে; সেই কেস আমি জোর করেই হাসপাতালে পাঠাচ্ছি। এখানকার লোকেরা নাকি মনে মনে হাস্য করছে এবং বলাবলি করছে—জীবন দত্ত যখন নাড়ি দেখে বলেছে বুড়ি মরবে তখন ওকে বাঁচায় কে?
এই কারণেই সেখানকার ডাক্তার রিপোর্টের পুরো নকল মতির হাতে পাঠিয়েছেন। সেই রিপোর্ট পড়ে প্রদ্যোতের মুখে ব্যঙ্গহাস্য ফুটে উঠেছিল—তার সঙ্গে বিরক্তিও জমা হয়েছিল। পড়ে গিয়ে বুড়ির একটা পায়ের গাঁঠে আঘাত লেগেছে, খানিকটা হাড়ের কুচি ভেঙে সেখানে থেকে গিয়েছে, সেই হেতুই বৃদ্ধার এই অবস্থা। ওই জায়গাটা কেটে হাড়ের কুচিটাকে বের করে দিতে হবে এবং হাড়ের যদি আর কোনো অংশ বাদ দিতে হয় দিতে হবে, দিলেই বুড়ি সেরে উঠবে। এতে আশঙ্কার কোনো কারণ নাই।
নিদান! নিদান! নিদান!
কাল সন্ধ্যাতেও এই নিদানের কথা একদফা শুনে এসেছেন। এই বি কে মেডিক্যাল। স্টোর্সের মালিক বিনয়দের ওখানে। ওইওই একটি রক্তশোষণকারী রোগের সুযোগে মানুষকে সর্বস্বান্ত করে। জাল ওষুধ বিক্রি করে। মুখে বড় কথা বলে। বাধ্য হয়ে প্রদ্যোতকে ওখানে যেতে হয়, নইলে ওকে ঘৃণা করে প্রদ্যোত।
প্রদ্যোত ডাক্তার ওখানে গিয়েছিল একটা বিশেষ জরুরি ইনজেকশনের অর্ডার দিতে। কাল সন্ধে পর্যন্ত পাওয়া চাই-ই। তার সঙ্গে আরও দু-চারটে ওষুধ। বিনয়ের দোকানের একটি। বিশেষ ব্যবস্থা আছে যে, প্রতিদিন রাত্রি দশটার ট্রেনে তার লোক কলকাতা যায়, সকালে পৌঁছে বরাতী জিনিস কিনে আবার দুপুরেই রওনা হয়ে সন্ধ্যার সময় নবগ্রাম ফিরে আসে। পুরো চব্বিশ ঘণ্টাও লাগে না। এর জন্য হাওড়া পর্যন্ত মান্থলি টিকিট করেছে।
ওদের ওখানে মজলিসের মাঝখানেই এই কথা হচ্ছিল। এই মতির মায়ের কথা। কাল যে ছেলেটি তার হাতে মারা গেছে তার কথা। বিপিনবাবুর হিষ্কার কথা। বিনয় নিজে ওষুধের দোকান করে, লাভও করে প্রচুর কিন্তু নিজে অ্যালোপ্যাথিতে খুব বিশ্বাসী নয়, কবিরাজিতেই তার নিজের রুচি এবং মধ্যে মধ্যে ডাক্তারদের বলে আপনাদের এ আমলের চিকিৎসা, ও তো কানাতেও পারে মশায়। রক্ত পরীক্ষা, মল মূত্র ও থুতু গরের পরীক্ষা, এক্স-রে, এসব হবে, তারপর আপনারা চিকিৎসা করবেন। সে আমলে নাড়ি টিপে ধরেই বলে দিত এই হয়েছে! বলে দিত-আঠার মাস কি ছ মাস কি সাত দিন মেয়াদ। এই আমাদের জীবনমশায়—
জীবন মশায়ের নিদান হকার গল্প বলেছে। শেষে বলেছে—মতির মাকে মশায় যখন বলেছেন ডাক্তারবাবু তখন–
এক্স-রে রিপোর্ট এবং চিঠিখানা পেয়ে প্রদ্যোত মনে বল পেয়েছে, প্রেরণা পেয়েছে। এখানকার লোকে এমনভাবে বলে যে মধ্যে মধ্যে নিজেকে যেন দুর্বল মনে হয়। চারুবাবুসুদ্ধ। ওদের সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলেন। হরেন ডাক্তার তরুণ। কিন্তু সে এখানকার ছেলে। সে বিশ্বাস হয়ত করে না, কিন্তু অবিশ্বাস করার মত দৃঢ়তাও তার নেই। বাল্যস্মৃতি তাকে নাড়া দিয়ে দুর্বল করে দেয়। মশায় নাকি তাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। এবং তার গল্প নাকি আশ্চর্য। তার বাল্যজীবনের আরও অনেক আশ্চর্য স্মৃতি আছে।
এবার সে প্রমাণ করবে।
মতির মা বাঁচবে, দাঁতু বাঁচবে।
ডাক্তার বাসার দিকে চলল।
গানের সুর এসে কানে ঢুকল। মঞ্জু গান গাইছে। বেলা প্রায় একটা। রান্নাবান্না হয়ে গেছে—কাজ নাই—গান গাইছে মঞ্জু। আশ্চর্য জীবনময়ী মেয়ে মঞ্জু। মূর্তিমতী জীবনের ঝরনা। উচ্ছ্বসিত আবেগে সম্মুখের পানে বেয়ে চলেছে। বহু যুদ্ধ করে ডাক্তার তাকে জয় করেছেন।
তার বাড়িতে এই কারণেই মঞ্জুকে পছন্দ করে না। বলে—দুলালীপনা কি ভাল!
ডাক্তারের ভাল লাগে। মঞ্জুকে ডাক্তার সাইকেল চড়া শিখিয়েছেন। বন্দুক ছুঁড়তে শিখিয়েছেন। মোটর ড্রাইভিং শেখাবেন। বাধা তিনি দেবেন না।
এই তো—এই তো জীবন! গতিশীল, উল্লাসময়, ওইখানেই তো আছে সবল জীবনের আনন্দ! দি ইজ লাইফ।
সিঁড়ির উপর ব্লিচিং পাউডার ছড়ানো আছে। তাই মাড়িয়ে ডাক্তার তোর তলা পরিশুদ্ধ করে নিয়ে উপরে উঠলেন। ওদিকে সাবান, জল, লোশন, ভোয়ালে সাজানো রয়েছে।
মন্থর গতিতে ক্যাঁ ক্যাঁ শব্দ তুলে একখানা ছইওয়ালা গাছ আসছে। হাসপাতালের পাশ দিয়েই রাস্তা। শ্ৰাবণের আকাশে মেঘ ঘুরছে ছায়াচ্ছন্ন ম্লান দ্বিং হরটিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে মধ্যে মধ্যে। গাড়িখানার ছইয়ের ভিতর ঠিক সামনেই বসে কে? পাকা দাড়ি, পাকা চুল, স্কুল স্থবির–মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে চেয়ে রয়েছে, গাড়ির চাকা খালে পড়ছে, ইটে হোঁচট খাচ্ছে, তার সঙ্গে দেহখানা ঝাঁকি খাচ্ছে—ভ্রূক্ষেপ নাই।
জীবন মশায় তো! ডাকে চলেছেন কোথাও।