Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আগুন পাখির রহস্য || Sunil Gangopadhyay » Page 7

আগুন পাখির রহস্য || Sunil Gangopadhyay

কোচবিহার শহরে সুশীল গোপ্পীর একটা চায়ের দোকান আছে। সেই দোকানেরই পেছন দিকে একটা ছোট বাড়িতে সে বউ, ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকে।

দোকানে বেশ ভিড়, কাউন্টারে বসে আছে সুশীল। অনির্বাণের ড্রাইভার তাকে বাইরে ডেকে নিয়ে এল।

অনির্বাণ বলল, আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। দোকানের মধ্যে তো বসা যাবে না। অন্য কোথাও বসতে হবে।

অনির্বাণকে চিনতে পেরেছে সুশীল। পুলিশের এস পি সাহেবকে দেখে তার মুখ শুকিয়ে গেল। আমতা-আমতা করে বলল, কিছু বুঝতে পারছি না, সার। আমি তো কিছু…মানে, আমার অপরাধ কী হয়েছে?

অনির্বাণ বলল, আপনার চিন্তার কিছু নেই। আপনাকে জেরা করতে আসিনি। এঁর নাম রাজা রায়চৌধুরী, ইনি আপনার কাছে কয়েকটা খবর জানতে চান।

ক্রাচ বগলে একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক আর তাঁর সঙ্গে একটি কিশোর, এদের দেখেও সুশীল কিছু বুঝতে পারল না। সে সবাইকে নিজের বাড়িতে এনে বসাল। তারপর হঠাৎ কিছু একটা আবিষ্কারের ভঙ্গিতে বলে উঠল, আপনারা, মানে, আপনারা দুজন কি সন্তু আর কাকাবাবু?

কাকাবাবু হেসে বললেন, আমি খোঁড়া বলে অনেকেই আমাকে দেখে চিনে ফেলে।

সুশীল ব্যস্ত হয়ে বলল, আপনি আমাদের বাড়িতে পায়ের ধুলো দিয়েছেন, আমার কী সৌভাগ্য! আমার বউকে আর ছেলেকে ডাকছি।

কাকাবাবু হাত তুলে বললেন, ওসব পরে হবে। আগে কাজের কথা বলে নিই। আপনার বাড়ি দিনহাটায়?

সুশীল বলল, হ্যাঁ সার, বাড়ি দিনহাটায়, এখন এখানে দোকান খুলেছি।

ওখানে হাই স্কুলে পড়েছেন?

হ্যাঁ সার।

টোবি দত্ত আপনার সহপাঠী ছিল? ক্লাস নাইনে আপনারা একসঙ্গে পড়েছেন?

ও, বুঝতে পেরেছি কার কথা বলছেন। টোবি নয়, তার ডাকনাম ছিল ত্যাপা। ফার্স্ট-সেকেন্ড হত। সে অনেক বছর আগের কথা। এই সেদিন একজনকে দেখলাম, মনে হল যেন আমাদের সেই ত্যাপা। তার সঙ্গে কথা বলতে গেলাম, পাত্তাই দিল না। বলল, আমাকে চেনে না!

তবু কি আপনার ধারণা, এই টোবি দত্ত আর আপনাদের সেই ত্যাপা একই?

হ্যাঁ সার, আমার তো তাই ধারণা। ছোটবেলার বন্ধুদের চেহারা ঠিক মনে থাকে। ত্যাপা অনেকদিন নাকি ফরেনে ছিল, তাই আমাদের ভুলে গেছে।

এই ত্যাপা ক্লাস নাইনে ইস্কুল ছেড়ে চলে গিয়েছিল কেন?

আপনি ত্যাপার খবর জানতে চান? তা হলে মামুনকে ডাকি? মামুনও আমাদের সঙ্গে এক ক্লাসে পড়ত। সে-ই ছিল ত্যাপার বেশি বন্ধু। পাশেই মামুনের দোকান। সে সেতার, তবলা, হারমোনিয়াম সারায়।

ঠিক আছে, ডাকুন।

সুশীল দৌড়ে বেরিয়ে গেল।

অনির্বাণ বলল, ত্যাপা বিদেশে গিয়ে নাম বদলে হয়েছে টোবি। একটা ব্যাপার লক্ষ করেছেন, কাকাবাবু? টোবি আর সুশীল একই ক্লাসে পড়ত, কিন্তু টোবির তুলনায় সুশীলকে বেশি বয়স্ক দেখায়। বিদেশে খাবারদাবার অনেক ভাল, তাই লোকে সহজে বুড়ো হয় না।

কাকাবাবু বললেন, শুধু কি খাবারের জন্য? ওটাও মনের ব্যাপার। যেসব মানুষ জীবনে কোনও ঝুঁকি নেয় না, অ্যাডভেঞ্চার করতে ভয় পায়, সারাটা জীবন একই জায়গায় কাটিয়ে দেয়, তারাই তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে যায়।

সুশীল যাকে ডেকে আনল, তার চেহারা আরও বুড়োটে মতন। চেক লুঙ্গির ওপর সাদা পাঞ্জাবি পরা, চোখে নিকেলের ফ্রেমের চশমা, মাথার চুল প্রায় সব সাদা।

কাকাবাবু বললেন, আদাব, মামুন সাহেব, বসুন। আপনার স্কুলের বন্ধু ত্যাপা সম্পর্কে কয়েকটা কথা জানতে এসেছি। টোবি দত্তই যে সেই ত্যাপা, আপনি চিনতে পেরেছেন?

মামুন আস্তে-আস্তে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ চিনেছি। একটা ভ্যানগাড়ি চেপে ঘুরে বেড়ায়। শুনেছি সে খুব ধনী হয়েছে। একদিন পেট্রোল পাম্পে নেমে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন দেখলাম, এ আমাদের সেই ত্যাপা।

আপনি কাছে গিয়ে কথা বলেননি?

না। সুশীলের কাছে আগেই শুনেছি, সে সুশীলকে পাত্তা দেয়নি। তা বড়লোক হয়ে গেলে গরিব বন্ধুদের আর চিনতে পারবে না, এ আর এমন অস্বাভাবিক কী!

এক সময় সে আপনার খুব বন্ধু ছিল?

আমরা ক্লাস থ্রি থেকে একসঙ্গে পড়েছি। সব সময় পাশাপাশি বসতাম। মেধাবী ছাত্র ছিল, আমি পড়া জেনে নিতাম তার কাছ থেকে। আমাদের বাড়িতে আসত প্রায়ই।

ক্লাস নাইনে সে হঠাৎ ইস্কুল ছেড়ে চলে গেল কেন?

সেটা সার বড় দুঃখের ঘটনা। তোর মনে নেই রে, সুশীল?

সুশীল বলল, একটু-একটু মনে আছে। সে-সময় আমরাও তাকে কিছু সাহায্য করতে পারিনি। সেইজন্যই বোধ হয় ইস্কুলের বন্ধুদের ওপর সে আজও রাগ পুষে রেখেছে।

কাকাবাবু মামুনকে বললেন, আপনিই ঘটনাটা খুলে বলুন।

মামুন বলল, ত্যাপারা ছিল বড়ই গরিব। দু বেলা খাওয়া জুটত না। তারই মধ্যে ত্যাপা পড়াশুনো করত খুব মন দিয়ে। কোনওবার ফার্স্ট, কোনওবার সেকেন্ড হত। আমাদের ক্লাসে আর-একটা ছেলে ছিল, তার নাম বিশু।

সুশীল বলল, বিশু না রে, রাজু। থানার দারোগার ছেলে তো? তার পদবিটা মনে নেই।

মামুন বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, রাজু। রাজপুত্তুরের মতন চেহারা, কিন্তু ভারী, নিষ্ঠুর আর অহঙ্কারী। দারোগার ছেলে বলে আমাদের সে মানুষ বলেই গণ্য করত না। সেও লেখাপড়ায় ভাল ছিল বটে, কিন্তু ত্যাপার সমান না। সেইজন্যই। ত্যাপার ওপর ছিল তার খুব হিংসে। আমরা সার, ইস্কুলে যেতাম হাফ প্যান্ট পরে, আর রাজু পরে যেত ফুল প্যান্ট। তার পোশাকের বাহার ছিল কতরকম। থানার দারোগার ছেলের তো পয়সার অভাব হয় না।

মুখ তুলে সে অনিবাণের দিকে তাকিয়ে জিভ কেটে বলে উঠল, মাপ করবেন সার, আপনার সামনে এই কথাটা বলে ফেলেছি!

অনির্বাণ কাষ্ঠহাসি দিয়ে বলল, পুলিশ ঘুষ খায়, এ-কথা তো সবাই জানে!

মামুন বলল, আপনারা ওপরতলার অফিসার, আপনাদের কানে অনেক খবরই পৌঁছয় না! কিন্তু নীচের তলায়, থানায় থানায় ঘুষের রাজত্ব! এখানে তো আমাদের ওপর পুলিশ জুলুম করে।

সুশীলও সাহস সঞ্চয় করে বলল, আমি সামান্য একটা চায়ের দোকান চালাই, আমার কাছেও পুলিশ ঘুষ চায়। এদিকে যে স্মাগলাররা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, পুলিশ তাদের কিছু বলে না।

কাকাবাবু বললেন, ওসব কথা পরে হবে। ইস্কুলের ঘটনাটা আগে শুনি।

মামুন বলল, একদিন ইস্কুলে ওই রাজুর মানিব্যাগ চুরি গেল। আমরা পাঁচ নয়া, দশ নয়া পয়সা নিয়ে স্কুলে যেতাম। আমাদের আর কারও মানিব্যাগ ছিল না। রাজুর ব্যাগে গোছ-গোছ টাকা। সেদিন ওর ব্যাগে ছিল নাকি আড়াইশো টাকা! সে তো অনেক টাকা! আমাদের বাপ-চাচারা এক মাসে অত টাকা রোজগার করত। রাজুর ব্যাগ হারিয়েছে বলে সারা ইস্কুলে তোলপাড় হয়ে গেল।

অনির্বাণ বলল, রাজু সন্দেহ করল ত্যাপাকে?

মামুন বলল, সত্যিই ব্যাগ হারিয়েছিল কি না তাই-বা কে জানে! ত্যাপার ওপর তো আগেই রাগ ছিল। ত্যাপা ছিল জেদি আর গোঁয়ার। মান-সম্মান জ্ঞান ছিল খুব। সেদিন আবার ত্যাপার পকেটে ছিল কুড়ি টাকা। ইস্কুলে কয়েক মাসের মাইনে বাকি পড়েছিল, সেই মাইনে দিতে এসেছিল। রাজু জিজ্ঞেস করল, তুই হঠাৎ এত টাকা কোথায় পেলি? ত্যাপা কিছুতেই তা বলবে না।

সুশীল বলল, তারপর শুরু হল মার। কী মার মারল ত্যাপাকে। দারোগার ছেলে বলে রাজুর অনেক চ্যালা ছিল। আমরা ভয়ে কিছু বলতে পারিনি।

মামুন বলল, আমি ত্যাপার পাশে দাঁড়াতে গিয়ে অনেক লাথি-ঘুসি খেয়েছি। ত্যাপাকে ওরা টানতে টানতে নিয়ে গেল থানায়। সেখানেও রাজুর বাবা কোনও বিচার না করেই মারতে লাগলেন। ত্যাপার একটা চক্ষু দিয়ে দরদর করে রক্ত পড়তে লাগল ঝরঝর করে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, চোখে মেরেছিল?

মামুন বলল, ইচ্ছে করে মেরেছিল। রাজু একটা বেল্ট দিয়ে মারতে মারতে চ্যাঁচাচ্ছিল, শয়তান, তোর চোখ গেলে দেব! সেই বেল্টের লোহার আংটা ত্যাপার একটা চোখে ঢুকে যায়। তখন ত্যাপাকে আমিই ওর বাড়িতে নিয়ে যাই। ত্যাপার বাবা গরিব মানুষ, ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। ওই অবস্থায় ছেলেকে দেখে তিনি বললেন, অপোগণ্ড ছেলে, তুই দারোগাবাবুকে চটিয়েছিস? এখন আমাদের কপালে আরও কত দুঃখ আছে কে জানে! তাই শুনে এক হাতে চক্ষু চেপে ত্যাপা এক দৌড় লাগাল। আমরা পেছন-পেছন ছুটে গিয়েও তাকে ধরতে পারিনি। সেই যে গেল, আর কোনওদিন দিনহাটায় ফেরেনি ত্যাপা। শুনেছি, শিলিগুঁড়িতে এক পাদ্রি সাহেব সেই অবস্থায় তাকে দেখে দয়া করে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তারপর আর কিছু জানি না।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, চোখের জখম কতখানি ছিল?

মামুন বলল, শিলিগুঁড়িতে আমার আর-এক বন্ধু আখতার সেই সময় ত্যাপাকে দেখেছিল, সে বলেছিল, ত্যাপার একটা চোখ নাকি নষ্টই হয়ে গেছে। ভুল খবর। এই তো সেদিন দেখলাম, ওর দুটো চোখই আছে।

কাকাবাবু বললেন, পাথরের চোখ! সেইজন্যই ওর দৃষ্টি অমন কঠিন আর ঠাণ্ডা মনে হয়।

অনির্বাণ বলল, ঠিক বলেছেন তো! টোবি দত্তর দৃষ্টি অস্বাভাবিক, কিন্তু একটা চোখ যে পাথরের হতে পারে, সে-কথা আমার মনে পড়েনি।

কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, যাদের ওরকম হয়, তারা মাঝে-মাঝে পাথরের চোখটা খুলে রাখে।

সন্তু বিরাট একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সেই রাজু এখন কোথায়?

মামুন বলল, পরের বছরই তার বাবা এই থানা থেকে বদলি হয়ে গেলেন দিনাজপুরে। আর তার কোনও খবর জানি না। পরের যে দাবোগা এলেন, তাঁর কোনও ছেলেপুলে ছিল না, তাই কয়েকটা বছর আমরা বেশ শান্তিতে ছিলাম।

অনিবার্ণ জিজ্ঞেস করল, ত্যাপার কোনও ভাইবোন ছিল না?

মামুন বলল, একটা ছোট ভাই ছিল। সে লেখাপড়া বিশেষ করেনি। চাকরিবাকরিও পায়নি। স্মাগলারদের সঙ্গে গিয়ে ভিড়েছিল। তারপর তাদের হাতেই খুন হয়ে যায়। তার বাবাকেও ওরাই মেরেছিল শুনেছি। মায়ের খবর জানি না।

সুশীল অনির্বাণকে বলল, সার, এদিকে স্মাগলারদের উৎপাত খুব বেড়েছে। পুলিশ সব জেনেও কিছু করে না!

কাকাবাবু বললেন, টোবি দত্তর পুলিশের ওপর কেন এত রাগ, তা কিছুটা বোঝা গেল?

অনির্বাণ বলল, সব পুলিশ তো এক নয়! ডাক্তার, ইস্কুল মাস্টার, আর্মি অফিসার, ব্যবসায়ী, এদের মধ্যে খারাপ লোক নেই?

কাকাবাবু বললেন, রাগের সময় যে এই কথাটা মনে থাকে না!

সুশীল এর পর তার দোকানের ফিশ ফ্রাই আর চা না খাইয়ে ছাড়ল না। বিদায় নেওয়ার সময় মামুন বলল, সার, ত্যাপার সঙ্গে দেখা হলে বলবেন, আমরা পুরনো বন্ধুরা তাকে ভুলিনি।

গাড়িতে উঠে অনির্বাণ বলল, টোবি দত্তর ব্যাক গ্রাউন্ড অনেকটাই জানা গেল। এই জায়গাটার ওপর তার রাগ আছে। বোধ হয় সে প্রতিশোধ নিতে চায়। কিন্তু এতকাল পরে রাজুকে সে পাবে কোথায়?

কাকাবাবু বললেন, হয়তো রাজুও এখানে আবার ফিরে এসেছে। কোনও গুণ্ডার দলের সদার হয়েছে!

অনির্বাণ বলল, কাকাবাবু, আপনি খুনটুনের ব্যাপারে মাথা ঘামাতে চান না। কিন্তু বনবাজিতপুরে যদি দুরকম হেলিকপটার আসে, তা হলে তার মধ্যে একটা ইউ এফ ও হতেই পারে। এ সম্ভাবনাটা আর উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আর কোনও হেলিকপটার এখানে আসা অসম্ভব।

কাকাবাবু বললেন, সন্তুর মতন তুমিও ইউ এফ ও বিশ্বাসী হয়ে গেলে দেখছি। কিন্তু ইউ এফ ওর সঙ্গে তোমার এই খুনটুনের কী সম্পর্ক?

অনির্বাণ বলল, যদি পৃথিবীর বাইরে থেকে কিছু এসে থাকে, তার মধ্যে কী ধরনের অদ্ভুত প্রাণী থাকবে তা আমরা জানি না। তারা খুব হিংস্র হতে পারে।

কাকাবাবু হেসে বললেন, অনেক কমিক স্ট্রিপে গল্প আর ছবি থাকে, মহাকাশে ইদুরের মতন প্রাণী মানুষের চেয়েও অনেক শক্তিশালী আর বুদ্ধিমান। সন্তু ওইসব গল্প খুব পড়ে। তুমিও পড়ো নাকি?

সন্তু বলল, আজকাল ওগুলো সবাই পড়ে।

কাকাবাবু বললেন, আমিও তো কয়েকখানা পড়েছি তোর ঘর থেকে নিয়ে। সায়েন্স ফিকশান হল একালের রূপকথা। পড়তে ভালই লাগে। কিন্তু অনির্বাণ, অন্য গ্রহের অদ্ভুত প্রাণীরা এসে তোমার এই কোচবিহারের সাধারণ মানুষদের মারবে কেন?

অনির্বাণ বলল, তা ছাড়া যে আর কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না। ইউ এফ ওর প্রাণীরা হয়তো রাত্তিরে মাটিতে নেমে ঘুরে বেড়ায়। কোনও গ্রামের মানুষ দৈবাৎ তাদের দেখে ফেললেই সেই মানুষটাকে তারা মেরে ফেলছে গলা টিপে। যে কজন খুন হয়েছে, তাদের প্রত্যেকেরই মুখে সাঙ্ঘাতিক ভয়ের ছাপ। একজন ভয়েই মারা গেছে, আর দুজনকে গলা মুচড়ে মেরেছে। কিন্তু আঙুলের ছাপ মানুষের মতন নয়! এই ব্যাপারটাতেই আমরা ধাঁধায় পড়েছি।

কাকাবাবু বললেন, হুঁ, আচ্ছা, এই যে লোকগুলো খুন হয়েছে, এদের কারও সঙ্গে কারও কোনও সম্পর্ক আছে?

অনির্বাণ বলল, এরা এক গ্রামের লোক নয়। কারও সঙ্গে কারও চেনা ছিল বলেও জানা যায়নি। শেষ যে লোকটা খুন হয়েছে, তার নাম ভবেন সিকদার। লেখাপড়া শেখেনি, বেকার, তিরিশ-পঁয়তিরিশ বছর বয়েস। পাড়ায় একটু মাস্তানি করত, কিন্তু এমন কিছু না, পুলিশের খাতায় নাম নেই।

কাকাবাবু বললেন, বেকার ছেলে, স্বাস্থ্য ভাল, কিছু একটা কাজ করতে চায়, অথচ আমাদের দেশ এদের কোনও কাজ দিতে পারে না। এটাই তো আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য। শেষ পর্যন্ত এই ছেলেদের কেউ-কেউ বদ লোকদের পাল্লায় পড়ে। এই ছেলেটা চোরা চালানিদের দলে যোগ দেয়নি তো?

অনির্বাণ বলল, তা অসম্ভব কিছু নয়। সীমান্ত এলাকায় স্মাগলারদের উৎপাত তো আছেই। পুলিশ আর কতদিন সামলাবে!

কাকাবাবু একটুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ আবার বললেন, টোবি দত্তকে যারা ছুরি মেরেছিল, তাদের কেউ ধরা পড়েছে?

অনির্বাণ আমতা-আমতা করে বলল, না, মানে, টোবি দত্ত থানায় কোনও অভিযোগ জানায়নি। ওখানকার থানাও আর বেশি দূর এগোয়নি, আরও অনেক কাজ থাকে তো!

কাকাবাবু বললেন, বাঃ, একটা লোককে রাস্তার ওপর কয়েকজন লোক ঘিরে ধরে ছুরি মারল, পুলিশ তার জন্য কোনও ব্যবস্থা নেবে না?

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, টোবি দত্তর পিঠে ছুরি গেঁথে গিয়েছিল, তবু সে স্বাভাবিকভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে কী করে?

কাকাবাবু বললেন, তুই কি এখনও ভাবছিস, টোবি দত্তর অলৌকিক ক্ষমতা আছে? ছুরিটা বেশিদূর ঢোকেনি, তাই ক্ষতটা সেরে গেছে।

অনির্বাণ বলল, টোবি দত্তর গায়েও বেশ জোর আছে। সে লোকগুলোকে ঘুসি চালিয়ে দৌড়ে পালিয়েছে। তাতে বোঝা যায়, সে সঙ্গে ছুরি, ছোরা, বন্দুক রাখে না।

কাকাবাবু বললেন, তা বলে সে প্রতিশোধ নেবে না? প্রকাশ্য রাস্তায় কয়েকজন লোক তাকে খুন করতে গেল, তার মতন একজন তেজি লোক সেটা হজম করে যাবে? পুলিশ কিছু না করলেও সে নিশ্চয়ই ওই লোকগুলোকে খুঁজে বের করবে!

অনির্বাণ বলল, তা বলে আপনি বলতে চান, টোবি দত্তই এই লোকগুলোকে খুন করে প্রতিশোধ নিয়েছে? কিন্তু গলায় ওরকম অদ্ভুত আঙুলের ছাপ…

সন্তু উত্তেজিতভাবে কিছু বলার জন্য ডাকল, কাকাবাবু…

কাকাবাবু তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, সেসব পরে দেখা যাবে। অনির্বাণ, তুমি আগে খোঁজ নাও। এই তিনজন লোকই এক দলের কি না! থানাগুলোতে চাপ দাও, ওরা গুণ্ডা-চোরাচালানিদের ঠিকই চেনে! অন্য গ্রহের প্রাণীরা এসে কোচবিহারের গ্রামের মানুষদের খুন করছে, একথা প্রকাশ্যে বোলো না, লোকে হাসবে!।

অনির্বাণ বলল, খবরের কাগজেও এই ধরনের লিখছে!

কাকাবাবু খানিকটা ধমকের সুরে বললেন, খবরের কাগজে লিখুক! আমাদের আপাতত ইউ এফ ও নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে। তোমরা গ্রামের মানুষদের কথায় পাত্তা দাও না। ওদের কথাগুলো ভাল করে ভেবে দেখলে বুঝতে, ইউ এফ ওর ব্যাপারটা পুরো ধাপ্পা!

সন্তু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, গ্রামের লোকরাই তো প্রথম থেকে বলছে, হেলিকপটার নয়, আগুনের পাখি, অন্য গ্রহের আকাশযান এসেছে পাঁচ-ছ বার!

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, এই কথাগুলোরই ঠিক-ঠিক মানে যদি আমরা বুঝতে না পারি, তা হলে আর আমরা শিক্ষিত কীসে?

সন্তু তবু চোখ-মুখ খুচিয়ে রইল। কাকাবাবুর কথাগুলি তার ধাঁধার মতন মনে হচ্ছে।

নাছোড়বান্দার মতন সে বলল, কাকাবাবু, আমি কিন্তু এখনও বুঝতে পারছি। আমাকে বুঝিয়ে দাও!

কাকাবাবু হেসে বললেন, যথাসময়ে বলব। এর মধ্যে আরও ভেবে দ্যাখ নিজেই বুঝতে পারিস কি না!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress