Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আগুন পাখির রহস্য || Sunil Gangopadhyay » Page 6

আগুন পাখির রহস্য || Sunil Gangopadhyay

পরদিন সকালে প্রথম কাজই হল সম্ভকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া।

সন্তুর অবশ্য একটু পরেই জ্ঞান ফিরে এসেছিল। টোবি দত্তর বাড়ির সামনে থেকে সে হেঁটেই ফিরেছে। ওই বাড়ির ছাদে কী কী ঘটেছিল, তাও কাকাবাবুকে শুনিয়েছে। কাকাবাবু কোনও মন্তব্য করেননি। শুধু একবার বলেছিলেন, ঠিক আছে, এসব পরে দেখা যাবে!

অনির্বাণের গাড়িটা রয়েছে বলে সুবিধে হয়ে গেল। সকালবেলা শুধু এককাপ চা খেয়েই কাকাবাবু বেরিয়ে পড়তে চাইলেন, মণিকাও ঝোলাঝুলি করতে লাগল সঙ্গে যাওয়ার জন্য। হেডমাস্টারমশাই বাধ্য হলেন মত দিতে।

কাকাবাবু সামনে আর মণিকা-সন্তু পেছনে। সন্তু জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে গুম হয়ে আছে। কাল রাত্তিরের ঘটনাগুলো সে কিছুতেই মেলাতে পারছে না। কাকাবাবু বললেন, তিনি টোবি দত্তর দুটো চোখই দেখেছেন। অথচ একটু আগে সন্তু দেখেছে, তার একটামাত্র চোখ, সেটা ধকধক করে যেন জ্বলছিল, অন্য চোখটার জায়গায় শুধু একটা গর্ত। বীভৎস মুখখানা। সেটা সন্তুর চোখের ভুল? এরকম ভুল তো তার আগে কখনও হয়নি? আর ওই কঙ্কালের ব্যাপারটা তার নিজেরই এখন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। অথচ সত্যিই তো সে দেখেছিল! কেন অত তাড়াতাড়ি সে অজ্ঞান হয়ে গেল? না হলে সে রহস্যটা ঠিকই ধরে ফেলত।

বনবাজিতপুর ছাড়াবার পর মণিকা বলল, দ্যাখো দ্যাখো, সন্তু ওই পুকুরটায় কত শাপলা ফুটে আছে। আমরা এটাকে বলি শাপলা পুকুর।

সন্তু মুখটা ফিরিয়ে বেশ জোরে-জোরে ঘেউ-ঘেউ করে ডেকে উঠল।

মণিকা শিউরে উঠে খানিকটা সরে গিয়ে বলল, এ কী! এ কী!

কাকাবাবুও পেছন ফিরে তাকিয়েছেন।

সন্তু বলল, তুমি তো দেখতে চাইছিলে আমার জলাতঙ্ক রোগ হয়েছে কি না? হ্যাঁ, হয়েছে, ঘেউ-ঘেউ-ঘেউ!

কাকাবাবু বললেন, এই সন্তু, মেয়েটাকে ভয় দেখাচ্ছিস কেন?

মণিকা বলল, আমি মোটেই ভয় পাইনি। পোষা কুকুর অমন বিচ্ছিরিভাবে ডাকে না। এইরকম ডাকে, ভুক-ভুক, ভুক-ভুক, ভুক।

সন্তু বলল, পোষা কুকুর পাগল হয়ে গেলেও বুঝি ওরকম মিষ্টি সুর করে ডাকবে?

গাড়ির ড্রাইভার বলল, আমি একবার একটা পাগলা কুকুরের ডাক শুনেছিলাম, এইরকম, ঘ্যা-ঘ্যা-ঘ্যা, ঘ্যা-ঘ্যা-ঘ্যা!

কাকাবাবু বললেন, গাড়িটা যে কুকুরের খাঁচা হয়ে গেল! তার চেয়ে বরং সেই হেমমা দুধওলার গান গাওয়া যাক। তুমি জানো, মণিকা?

মণিকা বলল, না।

কাকাবাবু নিজেই গেয়ে শোনাতে লাগলেন, হেমো গয়লার ছিল যে এক গাঁয়ের বাড়ি/ সেথায় ছিল মস্ত বড় একটা হাঁসের ঝাঁক/ হেথায় প্যাঁক, হোথায় প্যাঁক, চারদিকেতে প্যাঁক প্যাঁক/ হেমমা গয়লার ছিল যে এক..

সন্তু জানলেও এই গানে গলা মেলাল না। তার মন ভাল নেই।

ডাক্তারের বাড়িতে এসে কিছু ভাল খবর পাওয়া গেল।

শৈবাল দাশগুপ্ত সন্তুর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, নো প্রবলেম। কুকুরটার মাথা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সে পাগল ছিল না। তবে কেউ তাকে বিষ খাইয়েছিল ঠিকই। সেই বিষের জ্বালায় ছটফটিয়ে সে কিছুক্ষণ পরেই মারা যেত। হয়তো তোমার মতন চেহারার কোনও ছেলে ওকে বিষ খাইয়েছে, সেই জন্য হঠাৎ তোমাকে কামড়াতে এসেছিল।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তা হলে সন্তুকে আর অত ইঞ্জেকশন নিতে হবে না?

শৈবাল দাশগুপ্ত বললেন, নাঃ, কোনও দরকার নেই।

মালবিকা বললেন, কাল আপনারা আমার বাড়িতে কিছুই খাননি। আজ কিন্তু ব্রেকফাস্ট খেতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, কোনও আপত্তি নেই। কী রে সন্তু, এখনও মুখ গোমড়া করে আছিস কেন?

মালবিকা বললেন, নিশ্চয়ই ওর খিদে পেয়ে গেছে।

শৈবাল দাশগুপ্ত বললেন, অনিবার্ণ ফোন করেছিল, সেও এসে যাবে একটু পরেই। কালকের খুনের ব্যাপারটা নিয়ে পুলিশ মহলে সবাই খুব চিন্তায় পড়ে গেছে। লোকটার বয়েস বছর-চল্লিশেক, কেউ তার গলাটা মুচড়ে ভেঙে দিয়েছে। কোনও দৈত্য-দানব ছাড়া মানুষের পক্ষে ওরকম গলা মুচড়ে ভাঙা সম্ভব নয়। মৃত লোকটির গলায় আঙুলের দাগ, তাও মানুষের মতন নয়, সরু-সরু লম্বা-লম্বা।

মালবিকা বললেন, থাক, সক্কালবেলাতেই খুন-জখমের কথা বলতে হবে।

কাকাবাবু কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকালেন মালবিকার দিকে।

খাওয়ার টেবিলে বসার একটু পরেই হাজির হল অনিবার্ণ মণ্ডল। এসেই সে ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করল, কাল সেই আলো দেখতে পেয়েছিলেন?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, দেখেছি।

তারপর তিনি টোবি দত্তর বাড়ির ছাদে সন্তু যে উঠেছিল, সেই অংশটা বাদ দিয়ে শুধু আলো আর আগুন-পাখির মতন হেলিকপটার দেখার অংশটুকু শোনালেন।

সন্তু জানে, কাকাবাবু যখন কোনও ঘটনা বাদ দিয়ে বলতে চান, তা হলে তখন চুপ করে থাকতে হয়।

কিন্তু মণিকা তো তা জানে না। সে বলল, বাঃ, আর আমি যে ওই পাহারাদারটাকে বাইরে বের করে আনলাম?

কাকাবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, মণিকাও কাল অনেক সাহস দেখিয়েছে। সেসব পরে শুনবে। আচ্ছা অনির্বাণ, তুমি যে বলেছিলে, পুলিশের লোক সর্বক্ষণ টোবি দত্তর বাড়ির ওপর নজর রাখছে। কাল রাত্তিরে কেউ ছিল?

অনির্বাণ বলল, থাকবার তো কথা। কেন, আপনারা তাকে দেখতে পাননি?

কাকাবাবু বললেন, আমরা ওখানে অনেকক্ষণ দেখেছি। বাড়িটার চারপাশ ঘুরেছি। কিন্তু পুলিশের কোনও পাত্তা পাইনি।

অনির্বাণ বলল, তা হলে সে ব্যাটা নিশ্চয়ই ফাঁকি মেরে বাড়িতে গিয়ে ঘুমিয়েছে! কাল ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ছিল। দিন আর রাতে দুজনের ডিউটি থাকে পালা করে। খবর নিয়ে দেখতে হবে, কে ফাঁকি মেরেছে।

কাকাবাবু বললেন, টোবি দত্তর ওই আলোটা কতদিন ধরে জ্বলছে?

অনির্বাণ বলল, মাসদেড়েক হবে। প্রায় প্রতিদিনই জ্বলে। খুব ঝড়বৃষ্টি হলে বন্ধ থাকে।

কাকাবাবু বললেন, পুলিশের লোক যদি প্রত্যেকদিন নজরে রাখত তা হলে বলতে পারত যে, হেলিকপটার ওই বাড়ির ওপর ঠিক কতবার গিয়েছিল।

যেমন, কাল রাতেও যে এসেছিল, পুলিশের খাতায় তার কোনও রেকর্ড থাকবে না।

অনির্বাণ বলল, আমিও তো ভাবছি। কর্নেল সমর চৌধুরী বললেন, উনি আর যাবেন না। অথচ কাল রাতেই আবার গেলেন কেন? সন্তু মুখ তুলে কিছু বলার জন্য কাকাবাবুর দিকে তাকাল।

কাকাবাবু বললেন, সমর চৌধুরী কাল যাননি, অন্য কেউ গেছে। আমার মতে যেটা হেলিকপটার, সন্তুর মতে সেটা অন্য কোনও বায়ুন কিংবা মহাকাশযানও হতে পারে।

মালবিকা উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ইউ এফ ও? সত্যি-সত্যি ইউ এফ ও দেখেছেন?

মণিকা বলল, ওটা একটা আগুনের পাখি।

কাকাবাবু বললেন, সন্তু ওর ক্যামেরায় অনেক ছবি তুলেছে। সেই ফিল্মগুলো ডিভেলাপ করলে ঠিকঠাক বোঝা যাবে। এখন একবার সমর চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করা যাবে?

অনির্বাণ বলল, হ্যাঁ, চলুন সেখানেই যাই।

খাওয়া শেষ করে ডাক্তার-দম্পতিকে ধন্যবাদ জানিয়ে কাকাবাবুরা আবার গাড়িতে চাপলেন।

যেতে-যেতে অনির্বাণ বলল, কাকাবাবু, কলকাতায় ফোন করে আমি টোবি দত্ত সম্পর্কে অনেক খবর জোগাড় করেছি। ওর ভাল নাম তরুবর দত্ত। কিন্তু সবাই টোবি দত্ত নামেই জানে। পাসপোর্টেও ওই নামই আছে। টোবি দত্ত অল্প বয়েসে এক পাদ্রির সঙ্গে জামানি চলে যায়। সেখানে লেখাপড়া শিখে ইলেকট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়ার হয়। সেখানে কিছুদিন চাকরি করে চলে যায় জাপানে। জাপানে একটা বড় কারখানায় কাজ করত। গত বছর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে কাজ ছেড়ে দেয়। কয়েক মাস জাপানেরই এক হাসপাতালে ছিল। তারপর অনেক টাকা-পয়সা নিয়ে ফিরে এসেছে দেশে। সঙ্গে নানারকম যন্ত্রপাতিও এনেছিল। এয়ারপোর্টের কাস্টমসের খাতায় তার রেকর্ড আছে। আমাদের পুলিশের খাতায় ওর নামে কোনও অভিযোগ নেই।

কাকাবাবু বললেন, জানা গেল যে, লোকটি ইলেকট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়ার। জাপানিদের কাছে পাত্তা পাওয়া সহজ কথা নয়! যে-যন্ত্রপাতি এনেছে, তা দিয়ে ওরকম আলো তৈরি করতে পারে। আর একটুখানি খবর নিতে পারবে? জাপানে ওর কী অসুখ করেছিল আর কোন হাসপাতালে ছিল?

অনির্বাণ বলল, জানবার চেষ্টা করব।

কাকাবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, সুশীল গোপ্পী কোথায় থাকে?

অনির্বাণ বলল, সুশীল গোপ্পী কে?

কাকাবাবু বললেন, বাঃ, তুমিই তো তার নাম বলেছিলে। টোবি দত্তর সঙ্গে দিনহাটায় এক স্কুলে, এক ক্লাসে পড়ত। যাকে দেখে টোবি দত্ত চিনতে পারেনি। তার সঙ্গে আমি একবার দেখা করতে চাই।

অনির্বাণ বলল, সে বোধ হয় এখন কোচবিহার শহরেই থাকে। আমার ডিএস: পি-কে বলে তাকে খুঁজে বার করছি।

মণিকা বলল, ওই টোবি দত্ত আমাদের গ্রামের কোনও লোকের সঙ্গে মেশে। বাবা একদিন ইস্কুলের একটা ফাংশানে নেমন্তন্ন করেছিলেন, তাও আসেনি। তবে ইস্কুলের ফান্ডে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছে!

অনির্বাণ বলল, টোবি দত্ত কারও সঙ্গে মেশে না, ওর কোনও বন্ধু নেই। মাস দু-এক আগে একটা হাট থেকে ফিরছিল টোবি দত্ত, এই সময় সন্ধের অন্ধকারে দু-তিনটে লোক ওকে ঘিরে ফেলে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল। ছুরি মেরেছিল ওর পিঠে। খুব বেশি আহত হয়নি। টোবি দত্ত পালিয়ে গিয়েছিল কোনওরকমে। তারপর থেকে টোবি দত্ত আর একলা-একলা কোথাও যায় না। ওর একটা বড় স্টেশান ওয়াগন গাড়ি আছে, সেটা নিয়ে মাঝে-মাঝে বেরোয়।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ওকে গুণ্ডারা মারতে গিয়েছিল, সেজন্য ও পুলিশের সাহায্য চায়নি?

অনির্বাণ বলল, পিঠে ছুরি-বেঁধা অবস্থায় টোবি দত্ত রাস্তা দিয়ে দৌড়োচ্ছে, সেই অবস্থায় ওকে হাট থেকে ফেরা অনেক মানুষ দেখতে পায়। ঘটনাটা জানাজানি হয়ে যায়। পুলিশেরও কানে আসে। ওখানকার থানার ও. সি. নিজেই টোবি দত্তর কাছে খোঁজ নিতে গিয়েছিল। তাকে ভাগিয়ে দিয়ে টোবি দত্ত বলেছে, যান, যান, আপনারা পুলিশ কিছু করতে পারবেন না!

কাকাবাবু বললেন, পুলিশের ওপর ওর রাগ আছে দেখা যাচ্ছে। সেইজন্য তোমার সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করেছিল। কাল টোবি দত্ত বলল, ওর কুকুরকে কেউ বিষ খাইয়েছে। তার মানে ওর একটা শত্রুপক্ষ আছে।

অনিবার্ণ বলল, সবাই জানে ওর অনেক টাকা-পয়সা আছে। তা ছাড়া ওর ব্যবহারটা খুবই রুক্ষ, সুতরাং ওর শত্রু তো থাকতেই পারে। মুশকিল হচ্ছে, লোকটা যে আমাদের সঙ্গে দেখাই করতে চায় না।

গাড়ি এবার কর্নেল সমর চৌধুরীর বাংলোর কম্পাউন্ডে ঢুকল। কর্নেল চৌধুরী তখন বাগানে ঘোড়ায় ঘুরছেন। আর কয়েকজন অফিসার পায়ে হেঁটে তাঁর সঙ্গে যেতে-যেতে কথা বলছে। কাকাবাবুদের দেখে তিনি ইঙ্গিতে ভেতরে গিয়ে বসতে বললেন।

একটু পরে তিনি অন্যদের সঙ্গে কথা শেষ করে বারান্দার কাছে এসে ঘোড়া থেকে নামলেন। তাঁর অঙ্গে পুরোপুরি সামরিক পোশাক। মাথায় টুপি। সিঁড়ি দিয়ে যখন তিনি উঠে আসছেন, তখন মণিকা বলল, ওমা, এঁকে তো আমাদের গ্রামে একদিন দেখেছি। তখন এঁর থুতনিতে দাড়ি ছিল।

কর্নেল চৌধুরী কাছে এসে বললেন, এই মিষ্টি মেয়েটি কে?

কাকাবাবু বললেন, বনবাজিতপুরের হেডমাস্টারের মেয়ে। আমরা এদের বাড়িতেই অতিথি। এই মেয়েটি আমাদের খুব যত্ন করছে।

কর্নেল চৌধুরী বললেন, আমি তো তোমাদের গ্রামে কখনও যাইনি, মা। মানে, আকাশ দিয়ে উড়ে গেছি, মাটি দিয়ে কখনও যাইনি। আমি জীবনে কখনও দাড়ি রাখিনি। তুমি অন্য কোনও লোককে দেখেছ।

তারপর সন্তুর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার তো আর কোনও প্রবলেম নেই শুনলাম। গুড নিউজ!

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কর্নেল চৌধুরী, আপনি কাল রাত্তিরে হেলিকপটার নিয়ে ওখানে গিয়েছিলেন?

কর্নেল চৌধুরী খুবই অবাক হয়ে ভুরু তুলে বললেন, আমি তো কাল রাতে কোথাও বেরোইনি। ওখানে মানে কোথায়?

কাকাবাবু বললেন, টোবি দত্তর বাড়ির ওদিকটায়?

কর্নেল চৌধুরী বললেন, ওখানে আর শুধু-শুধু যাব কেন? আপনাদের তো কালই বললাম, ওখানে গিয়ে আর কোনও লাভ নেই। না, না, না, কাল কোনও হেলিকপটার ওড়েনি।

তিনি গলা চড়িয়ে ডাকলেন, সেলিম! সেলিম!

পাশের ঘর থেকে একজন সুদর্শন যুবক দরজার কাছে স্যালুট দিল। কর্নেল চৌধুরী বললেন, পরিচয় করিয়ে দিই, ইনি ফ্লাইট লেফটেনান্ট সেলিম চৌধুরী। কোনও হেলিকপটার উড়লে সেলিম জানবে, লগ বুকে এন্ট্রি থাকবে। সেলিম, কাল কোনও হেলিকপটার উড়েছিল?

সেলিম বলল, না সার!

কর্নেল চৌধুরী বললেন, হেলিকপটার নিয়ে তো আমি একা আকাশে উড়ি। সেলিমও সঙ্গে থাকে। গ্রামের লোক বুঝি কালও একটা দেখেছে? ওদের তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই।

কাকাবাবু বললেন, কাল যে ওখানে একটা হেলিকপটার সত্যিই এসেছিল তা তো আমরা নিজের চোখেই দেখেছি।

কর্নেল চৌধুরী তবু বললেন, তা কী করে হয়! এখানে আর কারও কাছে হেলিকপটার নেই, থাকা সম্ভবও নয়।

কাকাবাবু বললেন, কিন্তু আমরা তিনজনেই তো ভুল দেখিনি।

মণিকা বলল, ওইটার শব্দ শুনেই আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

সন্তু বলল, গ্রামের লোক ভুল বলে না। ওটা থেকে আগুন ছড়াচ্ছিল।

কাকাবাবু বললেন, আগুন তো তৈরি করা যায়। তুবড়ি, রংমশাল থেকে যেরকম আগুনের ফুলকি বেরোয়, অনেকটা সেই রকমই মনে হল।

কর্নেল চৌধুরী বললেন, এটা তো খুব চিন্তার বিষয় হল! অন্য একটা হেলিকপটার আসে? কোথা থেকে আসে? তবে কি ইউ এফ ও হতে পারে?

কাকাবাবু বললেন, আপনারা তো গ্রামের লোকের কথায় পাত্তা দেন না। তারা তো আগেই বলেছে যে, একটা আগুনের পাখি পাঁচ-ছ বার এসেছে।

কর্নেল চৌধুরী অনিবাণের দিকে ফিরে বললেন, আপনারা কোনও কম্মের! ওই টোবি দত্তকে এখনও অ্যারেস্ট করতে পারলেন না? ওকে ধরে পেটে কয়েকটা গুঁতো মারলেই সব কথা জানা যেত।

অনির্বাণ বলল, ওকে অ্যারেস্ট করার কোনও কারণ যে এখনও খুঁজে পাচ্ছি না!

কর্নেল চৌধুরী বললেন, পুলিশকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। আর্মি অ্যাকশান নিতে হবে। আমি দিল্লিতে খবর পাঠিয়েছি। বাড়ির ছাদে ওরকম একটা আলো জ্বেলে রাখলে বিমান চলাচলের অসুবিধে হতে পারে। আরও অনেক অসুবিধে আছে!

তারপর তিনি মণিকার দিকে তাকিয়ে বললেন, আজ আমি তোমাদের গ্রামে যাব। রাত্তিরবেলা। তোমাদের সঙ্গে বসে ওই আগুনের পাখিটা দেখব। যদি সত্যি হয়, তা হলে তো সারা পৃথিবীতে বিরাট খবর হয়ে যাবে! তোমাদের বাড়িতে গেলে কী খাওয়াবে বলো।

মণিকা বলল, মাছভাজা। মুরগির মাংস।

কর্নেল চৌধুরী বললেন, ওসব তো রোজই খাই। নতুন কী খাওয়াবে বলো?

কাকাবাবু বললেন, কুলের আচার? ওটা মণিকা দারুণ বানায়!

সবাই হেসে উঠল।

ওইরকমই ঠিক হল, আজ রাতে সবাই আসবেন বনবাজিতপুরে। টোবি দত্তের ছাদের আলো আর রহস্যময় বায়ুনটি একসঙ্গে বসে দেখা হবে।

কাকাবাবুরা ফিরে এলেন গ্রামে।

কিন্তু সে-রাত্রে কিছুই করা গেল না। রাত নটার পর শুরু হলে প্রবল ঝড় বৃষ্টি। ঘণ্টাখানেক বাদে ঝড় কিছুটা কমলেও বৃষ্টি চলতেই থাকল। এই বৃষ্টির মধ্যে বাইরে বেরনো যাবে না, আকাশে কিছু দেখাও যাবে না।

কর্নেল চৌধুরী কিংবা অনির্বাণও এল না। মণিকা ও তার বাবার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করার পর সন্তু ও কাকাবাবু শুতে গেলেন নিজেদের ঘরে।

ঘর অন্ধকার, বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে সন্তু। কিছুতেই তার ঘুম আসছে।

কাকাবাবু এক সময় জিজ্ঞেস করলেন, কী রে সন্তু, তোর শরীর খারাপ লাগছে নাকি?

সন্তু কাতর গলায় বলল, না, আমার শরীর খারাপ লাগছে না। আমার মনটা কীরকম যেন করছে?

কেন, কী হয়েছে?

কাকাবাবু, আমি ভূত মানি না। জানি যে ভূত বলে কিছু নেই। সবই গল্প। তবু সবকিছু আমার মাথার মধ্যে গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।

ভূতের গল্প শুনলে গা-ছমছম করে। সেটা বেশ ভালই লাগে। কিন্তু কোনও ভদ্দরলোক ভূতে বিশ্বাস করে নাকি?

কিন্তু আমি যে দেখলাম একটা জ্যান্ত কঙ্কাল।

কঙ্কাল কক্ষনো জ্যান্ত হতে পারে না। সন্তু, সোনার পাথরবাটি কি হয়? মানুষ যখন হাঁটে-চলে, হাত-পা ছোড়ে, তখন মানুষকে চালায় তার মস্তিষ্ক। কঙ্কালের তো থাকে শুধু মাথার খুলি, তার মধ্যে ব্রেন কিংবা মস্তিষ্ক তো থাকে না। তা হলে একটা কঙ্কাল নৱে-চড়বে কী করে?

তা তো আমি জানি। কিন্তু একটা কঙ্কাল আমার দিকে এগিয়ে এল। আমাকে দু হাতে চেপে ধরে উঁচু করে তুলল। অসম্ভব তার গায়ের জোর।

সেটা কঙ্কাল হতেই পারে না।

কাকাবাবু, আমি আগে কখনও অজ্ঞান হইনি। নিজের কাছেই আমার এত লজ্জা করছে!

শোন সন্তু, তুই কি ভাবছিস আমি ব্যাপারটা মাঝপথে ছেড়ে দেব? টোবি দত্তর ছাদে কী করে কঙ্কাল ঘুরে বেড়ায় তা আমি দেখবই দেখব। যেমন করে পারি ওর বাড়ির মধ্যে ঢুকব। ব্যাখ্যা একটা পাওয়া যাবেই।

আমি যে ওই ছাদে কাল উঠে ধরা পড়েছিলাম, সেটা তুমি এস পি সাহেব কিংবা অন্যদের বললে না কেন?

দ্যাখ, কঙ্কাল-টঙ্কালের কথা শুনলে ওরা হাসত। তুই টোবি দত্তের বাড়িতে ট্রেসপাস করতে গিয়ে ধরা পড়েছিস। তবু কিন্তু সে তোকে মারধোর করেনি কিংবা কোনও ক্ষতি করেনি। আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। সুতরাং এই ব্যাপারে ওর নামে কোনও অভিযোগও করা যায় না।

তারপর পাশ ফিরে কাকাবাবু বললেন, সর্বক্ষণ এইসব কথা চিন্তা করার কোনও দরকার নেই। এটা কাঠের বাড়ি, টিনের চাল। টিনের চালে বৃষ্টির কী সুন্দর শব্দ হয়। কান পেতে শোন, মনে হবে, রবিশঙ্কর দ্রুত লয়ে সেতার বাজাচ্ছেন। জানলার ধারের গাছগুলোতে হাওয়ায় এমন শোঁ-শোঁ শব্দ হচ্ছে। যে, মনে হতে পারে, কাছেই সমুদ্র। মাঝে-মাঝে এমন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, যেন ওটা কোনও ম্যাজিকের খেলা!

একটু বাদে সন্তু ঘুমিয়ে পড়লে কাকাবাবু উঠে গিয়ে ওর গায়ে একটা চাদর টেনে দিলেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress