২১
নদী কখনো কাঁদে, কখনো হাসে
এই শহরের পাশ দিয়ে একটি নদী বয়ে চলেছে। আসছে অনেক ওপর থেকে। চলেছে সাগরের দিকে। সাগরে লীন না হতে পারলে নদীর শান্তি নেই। জীবনের মতো। মৃত্যুর কোলে গিয়ে উঠতেই হবে। এত কোলাহল, নর্তন, কুর্দন, আস্ফালন, তেলানো, শাসানো, প্রেম, বিচ্ছেদ, বিরহ, নাচতে নাচতে জীবন চলেছে সেই একই দিকে। মৃত্যু—মহাসাগরে। নদীর দানে সাগর পবিত্র। বহু ভক্তের পদ—রজে যেমন তীর্থ। ‘সাগরে সর্বতীর্থানি।’ আমাদের আচমনের মন্ত্রটিও ভারি সুন্দর :
গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরি সরস্বতী।
নর্মদে সিন্ধু কাবেরি জলোস্মিন্ সন্নিধিং কুরু।।
সেই শৈশব থেকে নদীর তীরে আমার বসবাস। একটি পথ চলে গেছে এঁকে বেঁকে মহাতীর্থ দক্ষিণেশ্বরের দিকে। এক সময় এই অঞ্চলে ছিল বড়ো বড়ো লোকের বাগানবাড়ি, নদীর ধার ঘেঁষে ঘেঁষে। প্রাচীন মন্দির। বিশাল বটবৃক্ষ। শিকড়ের জটলা নেমে এসেছে মহাসাধকের জটাজালের মতো। রানি রাসমণির কালীবাড়ি আর এই কালীবাড়িটি সমবয়স্ক। বারাণসীর শিল্পী একটি পাথর থেকে মায়ের দুটি মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন। একই নৌকোয় চেপে মূর্তি দুটি এসেছিল। এক মা নামলেন দক্ষিণেশ্বরে। আর এক মা নামলেন এই মন্দিরটিতে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরকে পরিণত করলেন মহাতীর্থে। তাঁর লীলামৃত কথামৃত হয়ে যুগের পারে ভেসে এল পাল তোলা নৌকোর মতো।
তব কথামৃতম তপ্তজীবনম কবিভিরীড়িতং কল্মষাপহম।
এই নদীর মতো আর এক প্রবাহিত নদী। একটু উজানে হালিশহরে রামপ্রসাদ, আর একটু উজানে শ্রীচৈতন্য। এগোতে এগোতে প্রয়াগ, বারাণসী, হরিদ্বার ছাড়িয়ে একবোরে গোমুখী।
সে যুগের বাগানবাড়ির স্বতন্ত্র একটা গাম্ভীর্য ছিল। জলের কিনারা ঘেঁষে পোস্তা উঠেছে। কয়েকটি জলটুঙ্গি। এলিয়ে থাকা সবুজ একটি ভূখণ্ড। ধারে ধারে দেবদারু, কদম, শিরীষ অর্জুন। আলো আর ছায়া মিশে জীবনমৃত্যুর মতো একটা রহস্যময় পরিবেশ। দোতলায় পশ্চিমমুখো প্রশস্ত ছাদ। সামনে তর তর করে বয়ে চলেছে গৈরিক জলধারা। ওপারের আকাশ তুঁতে নীল। তারই গায়ে লেপ্টে আছে হরিতবৃক্ষ, ধূসর মন্দিরের চুড়ো।
আভিজাত্য জিনিসটাই যুগের সঙ্গে লোপাট হয়ে গেছে। মানুষ আছে তবে মানুষের আর সে চেহারা নেই। সেই হাঁটা চলার ভঙ্গি, সেই দাঁড়ানোর ভঙ্গি, সেই কথাবলার ধরন। অনুচ্চ কণ্ঠ। প্রতিটি শব্দের কি ওজন! জলটুঙ্গিতে হলুদ শাড়ি পরে সুন্দরী এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন, সূর্যের লাল গোলক পৃথিবীর পরপারে যাবার জন্যে পশ্চিম আকাশে নেমে এসেছে। এখুনি যেন জলস্পর্শ করবে! ছ্যাঁক করে বুঝি শব্দ হবে। ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছেন মহিলা। একসঙ্গে তিনটে পাল তুলে চলেছে মহাজনি নৌকো। জ্বলন্ত আকাশের গায়ে ছইয়ের মানুষটিকে মনে হচ্ছে কাঠকয়লার মূর্তি।
মাঝে মধ্যে হঠাৎ কোনো প্রৌঢ়ের দর্শন মিলে যেত। দুগ্ধ শুভ্র ফিনফিনে পাঞ্জাবি। দুগ্ধশুভ্র চুল। মাঝখানে সিঁথি। খাড়া নাকে এক ধরনের শেষবেলার ঔদ্ধত্য। সামনে লোটানো কালো পাড় ধুতির কোঁচা। পায়ে বার্নিস করা জুতো। ধীর চলন অনেকটা অপগত—জোয়ার নদীর মতো। ভাঁটার টান ধরেছে। সাগর ডাকছে, ‘বেলা শেষ হল, আয় এবার চলে আয়। পড়ে থাক তোর ব্রুহাম গাড়ি। আস্তাবলে ওয়েলার ঘোড়া, জলটুঙ্গিতে সুন্দরী পুত্রবধূ। ঝাড়ে জ্বলে উঠুক সহস্র দীপ। ওই শোনো রাধাকান্ত জিউর মন্দিরে সন্ধ্যারতির ঘণ্টা বাজছে টিং টিং করে। জীবন গোধুলিতে প্রস্তুত হও, সব গোরুকেই বিচরণের তৃণভূমি ছেড়ে ঘরে ফিরতে হয়।’
শনিবারের রাতে এইসব বাগানবাড়িতে আলোর মালা জ্বলে উঠত। দোতলার হলঘরের সব জানালা খোলা। সার সার আলোকিত ঝাড়। গেটের বাইরে ছায়া ছায়া রাস্তায় দামি দামি গাড়ি। ফোর্ড, বুইক, স্টুডিবেকার, চেভ্রলে, স্ক্রাইসলার, সানবিম, অস্টিন, মরিস। পেট্রলের গন্ধে গুমোট হয়ে আছে। সালঙ্কারা মহিলারা দোতলার চওড়া বারান্দায় কখনো এসে দাঁড়াচ্ছেন, কখনো ভেতরে চলে যাচ্ছেন। হাস্নুহানার গন্ধে বাতাস মাতাল। হঠাৎ হারমোনিয়ামে ঠুমরির মুখ বেজে উঠল। চড়া পর্দায় বাঁধা তবলায় পড়ল তীক্ষ্ন চাঁটি। বুলবুল পাখির মতো গানের ছোটো ছোটো কলি উড়তে লাগল পিয়া বিনা ক্যায়সে রাতিয়া গুজারে। ওদিকে বটতলার কোটরে শিবলিঙ্গের মাথার ওপর মাটির প্রদীপ জ্বলছে কেঁপে কেঁপে। খড়ের চালায় কামার বধূ কাঠের আগুনে মেটে হাঁড়িতে ভাত বসিয়েছে। পেছন দিক থেকে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে উদোম শিশু ঘুম আর খিদেতে খুঁত খুঁত করছে। দেয়ালে তাদের ছায়া কাঁপছে বিশাল আকারে। নাটমন্দিরের দোতলায় আস্তানা গেড়েছেন বিন্ধ্যাচলের শৈব—সাধক। একপাশে খাড়া ত্রিশূল। নিমকাঠের কমণ্ডলু। ধূনির আগুনে মুখ টকটকে লাল। জটা পিঙ্গল বর্ণ।
নদী দু ধরনের জীবনধারাকেই প্রশ্রয় দিয়ে আসছে। ভোগ আর যোগ। রাসমণির কালীবাড়িতে স্বামী বিবেকানন্দ গাইছেন, মন চল নিজ নিকেতনে, সংসার বিদেশে, বিদেশীর বেশে ভ্রম কেন অকারণে। ঠাকুর ভাবে বিভোর। ওদিকে বাঈজি নন্দলালের নাচঘরে।
এক মন্দিরের নির্জন ঘাটে প্রেমিক প্রেমিকার মুখ চুম্বন করছে। হোরমিলারের জাহাজ চলেছে বিশাল চাকার জল কেটে কেটে যেন আলো স্বপ্ন। ওদিকে মহাশ্মশানে ধূ ধূ চিতা জ্বলছে। তরুণী বধূর হাতের শাঁখা ভাঙা হচ্ছে ঘাটের পইটেতে ইট দিয়ে ঠুকে ঠুকে। নদী আর জীবন—নদী দুয়েরই বিচিত্র ধারা। নীলকণ্ঠ দেখেশুনে গান বাঁধলেন, শ্যামাপদে আশ নদীর তীরে বাস কখন কী যে ঘটে ভেবে হই মা সারা। এককূল নদী ভাঙে নিরবধি আবার অন্য কূলে আকুলে সাজায়।
সেই সময়টায় আমি ছিলুম না যে সময়ে চৈতন্যদেব নৌকো করে সপার্ষদ পানিহাটি থেকে এই দিকে এসেছিলেন। একটি কাঁথা ফেলে গিয়েছিলেন কাঁথাধারীর মঠে। সেই সময়েও ছিলুম না যে সময় সিরাজ ফিরছিলেন কলকাতা জয় করে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ যেদিন একই সঙ্গে জপ আর বিষয় চিন্তায় রত জয়নারায়ণকে নৌকো থেকে নেমে এসে একটি চড় মেরেছিলেন সে দিনও আমি ছিলুম না। কিংবা হয়তো ছিলুম অন্য নামে, অন্য দেহে। হয়তো বসেছিলুম ঘাটের আর একটি ধাপে, আঁজলায় গঙ্গাজল নিয়ে। সূর্য সেদিনও ডুবছিল আকাশে জবা—কুসুম ছড়িয়ে। এই নদী ওই সূর্য আমার বহু জন্মের সাক্ষী। বহুবার আমাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছে। অস্ত অন্ধকারে চোখের সামনে একটি দুটি করে তারার খই ছড়িয়ে দিয়েছে। এক মায়ের কোল থেকে তুলে নিয়ে আরেক মায়ের কোলে ফেলেছে। এক সম্পর্ক ভেঙে আর এক সম্পর্ক গড়ে দিয়েছে। এক এক নামে এসেছি। বইতে বইতে লীন হয়ে গেছি মৃত্যু—সাগরে? আবার এসেছি। মুণ্ডকোপনিষদের শ্লোকটি মনে পড়ছে,
যথা নদ্যঃ স্যন্দমানাঃ সমুদ্রে
অস্তং গচ্ছন্তি নামরূপে বিহায়।
কে বলতে পারে বার্নিয়ের যখন পিপলি থেকে হুগলি আসছিলেন আমি তাঁর নৌকোতে অন্য নামে ছিলুম কি না? ১৬৫৬ সালের কথা। তিনশো তিরিশ বছর হয়ে গেল। কোথায় বার্নিয়ের! কোথায় পিপলিপত্তন! আর আমিই বা কে! উড়িষ্যার উপকূলে, সুবর্ণরেখা নদী থেকে প্রায় ষোলো মাইল দূরে ছিল এই বিখ্যাত বন্দর। ১৬৩৪ সালে পর্তুগিজদের হটিয়ে ইংরেজরা কুঠি স্থাপন করেছিলেন। নদীর খেয়ালে নদী সরে গেল। তাম্রলিপ্তের মতো পিপলিপত্তনের গৌরবও হারিয়ে গেল। সেই আগমন—পথে বার্নিয়ের যা দেখেছিলেন আর কি তা দেখা যাবে? ‘যে—নৌকায় আমি যাত্রা করেছিলাম সেটি একখানি সাত দাঁড় যুক্ত নৌকা।’ সাত দাঁড়, তিন দাঁড়, দু দাঁড়, কত রকমের নৌকো ছিল। এখনও আছে। তবে যুগ একেবারে পালটে গেছে। ভয় আর রহস্য যেখানে যা কিছু ছিল, মানুষ আর তার যন্ত্র—দৈত্য সব শেষ করে দিয়েছে। বার্নিয়ের দেখলেন, ‘বড়ো বড়ো রুই মাছের মতন মাছের ঝাঁক তাড়া করে নিয়ে যাচ্ছে জলের মধ্যে এক জাতীয় তিমি মাছ। মাঝগুলোর কাছাকাছি নৌকো নিয়ে যেতে বললাম মাঝিদের। কাছে গিয়ে মনে হল, মাছগুলো যেন মড়ার মতন অসাড় নিস্পন্দ হয়ে রয়েছে। দু’ চারটে মাছ মন্থর গতিতে নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে, আর বাকিগুলো যেন দিশাহারা বিহ্বল হয়ে প্রাণপণ লড়াই করছে আত্মরক্ষার তাগিদে। আমরা হাত দিয়েই প্রায় গোটা চব্বিশ মাছ ধরলাম এবং দেখলাম মাছগুলোর মুখ দিয়ে ব্লাডারের মতন রক্তাক্ত একরকম কী যেন বেরিয়ে আসছে।’
অমন অদ্ভুত মাছ আমি দেখিনি। আমি ইলিশ দেখেছি। বিয়াল্লিশ, তেতাল্লিশ, চুয়াল্লিশ ছিল ইলিশের বছর। গঙ্গার ধারে মাইলের পর মাইল টাকী, বসিরহাট, হাসনাবাদ থেকে আসা ইলশে নাওয়ের সারি। আমাদের লাফালাফির শেষ নেই। এ নৌকো থেকে ও নৌকো লাফাতে লাফাতে এক ঘাট থেকে আর এক ঘাটে। রাতের অন্ধকারে লণ্ঠনের সারি মালার মতো লুটিয়ে আছে জলের কিনারায়। হু হু উনুন জ্বলছে। বাতাসে উড়ছে আগুনের ফুলকি। মাঝিদের রান্নার মশলার কড়া গন্ধ। বাঁশে বাঁশে আটকানো জিলজিলে জাল। নদী তখন বড় দয়ালু ছিল। একবার জাল ফেললেই এক কুড়ি রুপোলি মাছ। ইলিশে মানুষের আতঙ্ক ধরে গিয়েছিল। শেষে মাটিতে ইলিশ কবর দেওয়া শুরু হল। কোথায় সেই তপসে, ভাঙড়, দাড়িঅলা কাদা চিংড়ি। পেঁয়াজের সঙ্গে শিলে বেটে ঝালদার চিংড়ির চপ।
জনপদের যত আবর্জনা, কলকারখানার পরিত্যক্ত বিষে পুণ্যতোয়া জরজর। সমুদ্র থেকে ইলিশ আর উঠে আসে না মিঠেপানির লোভে। ঈশ্বর গুপ্ত নেই তপসেও নেই। প্রাণী না থাক নদীর প্রাণ এখনও আছে। প্রবাহিতা। সময়ের জোয়ারভাঁটা খেলে। প্রাণ হরণের ক্ষমতাও আছে। এই তো সেদিন এক নৌকো জীবন গ্রাস করেছে। বিসর্জিতার জন্যে পেতে রেখেছে গৈরিক বুক। লক্ষ লক্ষ উত্তাল বাহুর আঘাতে পুবপাড়ের সব বাগানবাড়ি ভাঙতে শুরু করেছে। পোস্তা খণ্ড খণ্ড। জলটুঙ্গি কাত। সেই সুন্দরী মহিলা, শুভ্র কেশ অভিজাত বৃদ্ধ সময়ের ট্রেন ধরে চলে গেছেন অন্য স্টেশনে?
ক্যালেন্ডারে উনিশশো তিরাশি। ঘড়ির কাঁটা সহস্র কোটিবার পাক মেরেছে। পৃথিবী আরও বৃদ্ধ হয়েছে। বটবৃক্ষের আরও ঝুরি নেমেছে। শৈশবের আমি প্রৌঢ় আমি হয়ে বসে আছি ভাঙা বেদিতে। এখন আর ইলিশের চিন্তা নয়। পূর্ণচন্দ্রের রাত। বসে আছি সেই আশায়। দেখতে চাই বার্নিয়ের যা দেখেছিলেন, চাঁদের রামধনু। ‘চাঁদের বিপরীত দিকে ঠিক দিনের আলোর রামধনুর মতো উদ্ভাসিত। আলো যে খুব উজ্জ্বল সাদা তা নয়। নানা রঙের ছটা তার মধ্যে পরিষ্কার দেখা যায়। সুতরাং আমি প্রাচীনদের চাইতে অনেক বেশি ভাগ্যবান বলতে হবে। কারণ দার্শনিক আরিস্ততেলের মতে, তাঁর আগের যুগের কেউ চাঁদের রামধনু চোখে দেখেনি কোনোদিন।’ বহু রাত জেগেছি নদীর ধারে। নদী কখনো কাঁদে, কখনো হাসে, কখনো তার নাভিদেশ থেকে ওঁকার ধ্বনি ওঠে। নদী ডাকে, আয় চলে আয়।
Sunset and evening star
And one clear call for me