আ মরি বাংলা ভাষা
বাংলা ভাষা আন্দোলনকে স্মরণ করে একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে উদযাপিত হয়। মাতৃভাষার জন্য লড়াই করে জীবন উৎসর্গ করে যারা আজ মহান তাদের আত্মত্যাগের জন্য বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। ভাষা শুধু কিছু শব্দের সমষ্টি হয় না।ভাষা ছাড়া আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা-ভাবনা, স্বপ্ন, কল্পনা করা যায় না। একমাত্র মানুষই ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করে। আর কোনো প্রাণীর এই ক্ষমতা নেই।
কারণ মানুষের স্বরযন্ত্রের সঙ্গে, মস্তিষ্কের যে অংশের চিন্তাভাবনা যুক্ত হয়ে কাজকর্ম করে তার সঙ্গে সংযোগ আছে কেবল মানুষের। তাই মানুষ তার নিজের মাতৃভাষার মাধ্যমেই ভালোভাবে চিন্তা-ভাবনা ও মনের কথা প্রকাশ করতে পারে।
ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে পূর্ণাঙ্গ শিশু হিসেবে জন্মলাভের আগে থেকেই তার মধ্যে মাতৃভাষার বিকাশ ঘটে।যে শিশুটি জন্ম নিতে যাচ্ছে তার মাতৃগর্ভে, সেই শিশুর ভ্রূণের বিকাশের প্রথম কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই স্পর্শানুভূতির প্রারম্ভিক সূচনা ঘটে।এ সময়ই তার সঙ্গে মায়ের চিন্তা ভাবনা ও আবেগ অনুভূতির আত্মিক সংযোগ স্থাপিত হয়।
শিশু জন্মলাভের পর থেকে দেখে মা তার সঙ্গে কিভাবে কথা বলছে। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সে বুঝতে পারে মায়ের ভাষা। সে তাই মায়ের কথায় হেসে আনন্দ প্রকাশ করে।আবার মা বকলে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। শিশু কথা বলতে শেখার আগেই নিজের মনের ভাব বিভিন্ন ধ্বনির মাধ্যমে প্রকাশ করে আপত্তি আনন্দ জানাতে পারে। এখানেই মাতৃভাষার গুরুত্ব। শিশুরা মাতৃভাষা সবচেয়ে সহজে আয়ত্ত করে এবং এটা তার একেবারে নিজের ভাষা।
মাতৃভাষায় দক্ষ হলেই সে অনেক বেশি চৌখস হয়। নিমিষেই সবকিছু বুঝতে পারে। তার ব্যাক্তিত্ব সকলকে আকৃষ্ট করে।অনায়াসেই সকল কাজে খুব সহজেই এগিয়ে যায়। তার পক্ষে অন্য একটি বা দুটি বিদেশি ভাষা শেখা অনেক সহজ হয়। এতে শিশুর জ্ঞানের বিকাশ ঘটে।তার চিন্তার গতি খুব দ্রুত হয়। মাতৃভাষা বাংলার জন্য যারা রক্ত দিয়েছিল সাময়িক কোনো আবেগের কারণে নয়। বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী চিরকাল তাদের পদানত করে রাখতে চেয়েছিল। সেজন্যই তারা রুখে দাঁড়িয়ে রক্ত দিয়ে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল।ভাষা শহীদদের স্মরণ করে প্রভাত ফেরি করে অমর একুশে উদযাপন করা হয়।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ স্বরূপ।‘ অর্থাৎ একজন সন্তানের জন্য মাতৃদুগ্ধ যেমন সব থেকে উৎকৃষ্ট খাবার তেমনি মাতৃভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। মাতৃভাষায় শিক্ষাদান যে একান্ত প্রয়োজনীয় সে বিষয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। বর্তমান শিক্ষাব্যবিস্থায় আমাদের দেশে প্রাথমিক শ্রেণী থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বস্তরেই মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অফিস-আদালতেও ইংরেজির পাশাপাশি বর্তমানে মাতৃভাষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে উচ্চতর শিক্ষাতেও বিদেশি ভাষার পাশাপাশি মাতৃভাষা প্রাধান্য পেয়েছে। ‘শিক্ষা জাতীর মেরুদণ্ড‘। মানুষের মেরুদন্ডের মতো শিক্ষাকেও জাতির অন্যতম একটি অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ একটি জাতির উন্নতির শীর্ষে আরোহণের পেছনে একমাত্র শিক্ষাই সব থেকে বেশী অবদান রাখতে পারে। বিদেশি ভাষা জানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাতৃভাষায় শিক্ষাদান শিশুদের একাডেমিক কর্মক্ষমতা উন্নত করতে সহায়তা করে। কারণ যে কোনো মানুষের নিজের ভাষাই অত্যন্ত সহজ এবং বোধগম্য। ফলে যখন সে তার নিজের ভাষায় কোনো কিছু শোনে কিংবা পড়ে সেটি আয়ত্ত করা কিংবা তার মর্ম বোঝা সহজ ও দ্রুত হয়। মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কিছু গুরুত্ব হলোঃ
ক। শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকের যোগাযোগ সহজ হয়। একজন শিক্ষার্থী যখন তার শিক্ষকের কাছ থেকে মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহণ করে তখন সেটি তার অধিক বোধগম্য হয়।
খ। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে অধিক মনোযোগী হয়ে ওঠে।
গ। অভিভাবকগণও সাহায্য করতে পারেন এবং বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষামূলক কাজে অংশগ্রহণে সুবিধা হয়।
ঘ। শিক্ষার্থীরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে। শিক্ষাগ্রহনের স্পৃহা বাড়ে।
ঙ। অন্য ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করতে গেলে শিক্ষার্থীরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। শিক্ষাক্ষেত্রে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
চ। মাতৃভাষা মনোভাব প্রকাশের উৎকৃষ্ট মাধ্যম।
ছ। মাতৃভাষা নিজের ভাষা, মায়ের ভাষা- এই ভাষার চেয়ে সহজ আর কোনো ভাষা হতে পারেনা।
মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ফলে একজন শিশুর মধ্যে বেশকিছু গুণাবলী সৃষ্টি হয়। সে তার নিজের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হতে শেখে এবং তার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে নিজের মধ্যে লালন করার মানসিকতাও সৃষ্টি হয়। জ্ঞানের পরিধিকে আরো বৃদ্ধি করে।
মাতৃভাষার ব্যবহার একজন মানুষের মধ্যে স্বদেশপ্রীতি, নিজ মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে। অপরদিকে, বিদেশি ভাষার আধিপত্য মানুষের মনে বিদেশের প্রতি আকর্ষণ, পরানুকরণ প্রবৃত্তির জন্ম দেয়। দেশ ও জাতির উন্নয়নে মাতৃভাষার ব্যবহারের বিকল্প কিছু হতে পারে না।
একজন শিক্ষার্থীকে শুধু মাতৃভাষায় শিক্ষিত হলেই হবে না। উচ্চিশিক্ষার জন্য তাকে অবশ্যই সহযোগী ভাষা জানতে হবে। সহযোগী ভাষা জানা থাকলে একজন মানুষ অন্য ভাষাভাষীর কারো সাথে সহজেই যোগাযোগ করতে পারেন। দ্বিভাষিকদের ব্যক্তিগত এবং পেশাদার জীবনে বিস্তৃত লোকের সাথে যোগাযোগের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
উচ্চশিক্ষাগ্রহনের উদ্দেশ্যেই সহযোগী ভাষা শিখতে হবে। জীবন ও শিক্ষার মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করা শিক্ষার অন্যতম প্রধাণ উদ্দেশ্য। ব্যক্তিসত্তার পুর্ণতা সাধনের জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের বিকল্প কিছু নেই। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে পরিপূর্ণভাবে সাধন করতে চাইলে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তার অপরিহার্য। যেকোনো মানুষের কাছেই তার মাতৃ ভাষা গর্বের বিষয়।
“মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!”