অসুর বধ
সারাটাদিন অপেক্ষা করে সবিতা ঠায় রাস্তায় তাকিয়েছিল এই বুঝি কত্তা ফিরবে!আজ সে পূজার জামা শাড়ি তত্ত্ব নিয়ে মেয়ের ঘর গেছে কিনা। ‘এই তুমি এখানে ! কি গো এলে কখন, অন্ধকারে বসে কেন তুমি,ফুলকি ভালো আছে তো’।সদর দরজায় সন্ধ্যা প্রদীপ দেখাতে এসে সমীরকে থম মেরে বসে থাকতে দেখে ঘাবড়ে গেল সবিতা। বউয়ের কৌতূহলী প্রশ্নের ধাক্কায় খ্যাঁক করে উঠলো সমীর।অলক্ষ্যে চোখের জল মুছে ভাবলো বলেই দেই আসল সত্যিটা যে তোমার মেয়েটাকে ওরা বাঁচতে দেবে না বউ।
‘ওগো এভাবে বসে না থেকে বলো না গো ,কেমন দেখলে ওকে! আমার ফুলকি মা আসবে কবে পূজায় বাপের ঘর’? সবিতার প্রশ্নে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না সমীর । দীর্ঘ নিঃশাস নিয়ে বলল,’না আসবে না,এমনই পোড়া কপাল আমাদের! বাপের মাটির ঘরে আসতে বয়েই গেছে তোমার মেয়ের, জমিদার ঘরের বউ কিনা!
বুকের মাঝে জোর ধাক্কা খেলো এবার গ্রাম্য সরল মতি মায়ের হৃদয়!মনের মধ্যে কু গাইলো তার জন্যই সমীর ঘরে না ঢুকে হতাশায় এভাবে বাইরে বসে।তবে কি ওরা এখনো মেয়েটাকে অত্যাচার করে! এবারও পূজায় আসতে দেবে না!পুকুর পাড় থেকে আসা দমকা হাওয়ায় সন্ধ্যা প্রদীপ শিখা টলমলে হতেই হাত দিয়ে আড়াল দেওয়ার চেষ্টায় সবিতা।দপ করে প্রাণ বায়ু বের হওয়ার মতো শিখা নিভে যেতেই জাঁকিয়ে বসা আঁধারে ঝিঁ ঝিঁ ডাকের মধ্যে মধ্যবয়সী খেটে খাওয়া দুই স্বামী স্ত্রীর নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের কেবল ওঠানামা।
আজ তিন বছর হলো সেই যে মেয়েটা ওই কয়েদ সমান পেল্লাই জমিদার বাড়িতে ঢুকেছে আর নিস্তার নেই।মা বাপে নিশ্চিন্ত ছিল মেয়ে তাদের মস্ত রাজরানী হয়েছে,গা ভর্তি গয়না,সিঁথে ভরা মা দুগ্গার মতো সিঁদুর।কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই গ্রাম জুড়ে জোর হাওয়া মেয়েটাকে না ওরা শ্বশুর জামাই মিলে অত্যাচারে কোনোদিন মেরেই না ফেলে! এমন গুঞ্জন শুনে দৌড়ে গেছিলো মা বাপে সে বাড়ি কিন্তু পালোয়ান পাহারাদার তাড়িয়ে দিয়েছিল ঘাড় ধাক্কায়।সেই থেকে ছটফট করে তারা একটু খবরের অপেক্ষায়।
সে ক্ষমতাও নেই আঙুল তোলার চৌধুরীদের বিরুদ্ধে।বড় লোক জমিদারের ব্যভিচারী সন্তান ফুলকি কে একা পেয়ে মাঠে যখন ধর্ষণ করে। প্রমান লোপাট করতে মরিয়া গ্রামের লোকজন এককাট্টা হলে ওদের বিয়ে দেয় জমিদার। মা বাবা ভেবেছিল যাক অমন করে মুখ পুড়িয়েও মেয়েটার অন্তত গতি হয়েছিল নইলে বিষ খেয়ে ফুলকির মরা ছাড়া উপায় ছিল না!
সামনের দত্তদের বাড়ির প্রতিমায় রঙ শুরু হয়েছে।সবিতা দূর থেকে দেখে আর তার মন হু হু করে মেয়ের জন্য।আজ পূজার শেষ দিন,বিজয়া দশমী । খুব ভোরে ঘুমটা ভেঙে গেল সবিতার! কে যেন উঠোনের ওদিকে দাঁড়িয়ে! ‘ফুলকি, তুই একি অবস্থা হয়েছে রে মা তোর’-বলে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো সবিতা।কাপড় সরিয়ে দেখে মেয়ের মুখ,বুক শরীরের এক দিক যেন নৃশংসতায় জ্বালিয়ে দিয়েছে শয়তান গুলো।পায়ে হাত দিয়ে নুয়ে প্রনাম করতে কষ্ট হচ্ছিল ফুলকির।মা এখন যাই ওরা জানতে পারলে মেরে দেবে আমায় বলে ইতস্তত পা বাড়ালো ফুলকি।সবিতা জলদি রান্নাঘর থেকে দুটো নাড়ু মেয়ের হাতে গুঁজে দিলো।মা আসি গো বলে চলে গেল মেয়ে।সবিতা স্বপ্ন দেখছিল ঘুমটা ভেঙে গেল,পাশে সমীর এখনো গভীর ঘুমে।
সন্ধ্যায় বিজয়ার বিসর্জনের তোড়জোড় হচ্ছে।মায়ের মুখটা যেন আরো জ্বল জ্বল করছে।একটা ছেলে খবর দিলো জমিদারের ছোট ছেলের বউ, এ পাড়ার ফুলকি জলে ডুবে মরেছে ।যদিও তার আগে অসীম সাহসে বাড়ির দুই লম্পট পুরুষ অসুরকে কুপিয়ে খুন করে গেছে।শুনে বিশ্বাস হচ্ছিল না কথাটা সবিতার,জীবন্ত দুর্গা হয়ে যেন তাদের কন্যা ফুলকি অসুর বধ করে নিজেই বিসর্জন নিলো।