Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অষ্টাদশ অভিযান : বোম্বে অভিযান

অষ্টাদশ অভিযান : বোম্বে অভিযান

শেষ রাতে একটা আশ্চর্য সুন্দর স্বপ্ন দেখে ঘুমটা ভেঙে গেল বাবলুর ও স্বপ্ন দেখল একটা সাদা ঘোড়ার পিঠে চেপে চারদিকে ছুটোছুটি করছে। দেখে মনটা ভরে গেল আনন্দে। সাদা ঘোড়ার স্বপ্ন নাকি খুব ভাল। রাজা হওয়া যায়। কিন্তু বাবলু তো রাজা হতে চায় না। বাবলু বাবলুই থাকতে চায়। পাণ্ডব দি গ্রেট। ঘুম ভাঙলে বিছানা আঁকড়ে পড়ে-থাকা বাবলুর নীতিবিরুদ্ধ। তাই সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে উঠে মাথার কাছে টেবিলের ওপর রাখা জলটা ঢকঢক করে খেয়ে নিয়ে দেওয়ালে টাঙানো রামকৃষ্ণ ও চৈতন্যদেবের ছবিতে প্রণাম করল বাবলু। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, রাত তিনটে ও শার্ট প্যান্ট ও গেঞ্জির ওপর হালকা একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে ছাদে ওঠার জন্য হাওয়াই চটিটা পায়ে দিল।

পঞ্চু শুয়ে ছিল ঘরেরই এক কোণে। এতক্ষণ চোখদুটো পিটপিট করে বাবলুকে দেখছিল। যেই না বাবলু চটি পরে ঘর থেকে বেরোতে যাবে, অমনি গা-ঝাড়া দিয়ে ওর কাছে ছুটে এল।

বাবলু ধমকের সুরে বলল, পঞ্চু! তোকে না একদিন মানা করেছি এইভাবে ঘরের ভেতর গা-ঝাড়বি না। তবু তুই ওই কাজ করলি?

পঞ্চু গো-ও-ও-ঔ করে বাবলুর পায়ের ওপর শুয়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল। অর্থাৎ কিনা ওর ভাবখানা এই, অন্যায় হয়ে গেছে দাদা আমার। এবারের মতো ক্ষমা করো।

ঘরের পরেই দালান। আর দালানের ভেতর দিয়েই ছাদে ওঠার সিঁড়ি। পঞ্চুকে নিয়ে বাবলু তাই সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠল। শরতের মেঘমুক্ত নির্মল আকাশে তারাদের চুমকি ঝিকমিক করছে। যেন এক অপূর্ব নীলে অজস্র জোনাকির নেভা-জ্বলা।

অনেকদিন এইরকম সময়ে ছাদে ওঠা হয়নি বাবলুর। আজ তাই খুশিতে ভরে উঠল ওর মন। বাবলু ছাদময় পায়চারি করতে করতে কত কী ভাবতে লাগল। তারপর হঠাৎ কী মনে হতেই পঞ্চুকে জড়িয়ে ধরে বলল, দ্যাখ পঞ্চু, তোকে নিয়ে এবার আমাদের কিছু একটা করা উচিত। কী করি বল তো?

পঞ্চুর সেই একই উত্তর, গো-ও-ও-ঔ! অর্থাৎ, আমি কী জানি?

বাবলু বলল, কী করব জানিস? তোর জন্মদিন করব। কবে যে তুই হয়েছিলি তা তো মনে নেই। শুধু যে-কোনও একটা ছুটির দিন দেখে জন্মদিন হবে তোর। অনেক লোকজন খাবে। অবশ্য তোর স্বজাতিদেরও নেমন্তন্ন করব। কেক কাটা হবে। তোর নামে কার্ড ছাপাব। কী দারুণ মজা যে হবে না, তা তুই ভাবতেও পারবি না।

পঞ্চু বাবলুর কথার কিছু বুঝল কি না কে জানে, শুধুই মনের আনন্দে ছাদের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে ছুটোছুটি করতে লাগল।

আর বাবলু? নতুন-কিছু করার আনন্দে মশগুল হয়ে ছাদের আলসের ধারে দাঁড়িয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে তন্ময় হয়ে গেল। কত আদরের পঞ্চু ওর! সেই পঞ্চুর জন্মদিন। কত লোকজন খাবে। উৎসবের আনন্দে মেতে উঠবে বাড়িটা। এ কি কম কথা? সকাল হলেই বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছুকে জানিয়ে দিতে হবে কথাটা। তারপর সবাই মিলে পাঁচকড়ি পাঠকের আখড়ায় গিয়ে একটা শুভদিন দেখে লাগিয়ে দেবে লাগ-ঝমা-ঝম।

দেখতে দেখতে ভোর হল। ভোর থেকে সকাল। পুব দিক রাঙা করে নতুন সূর্য উঠল নতুন দিনের আলো নিয়ে।

মা ডাকলেন, বাবলু, আই বাবলু, বাবলা?

ঝড়ের আগে যেমন পাতা উড়ে যায়, ঠিক সেইভাবে মা’র ডাক শুনে নেমে গেল পঞ্চু।

বাবলুও নামল।

মা বললেন, কী রে, এতক্ষণ ধরে ছাদে কী করছিলি? মুখ-হাত ধুবি না?

বাবলু বলল, জানো মা, খুব শিগগির এই বাড়িতে একটা উৎসবের আয়োজন করব।

কীসের উৎসব?

পঞ্চুর জন্মদিন। মা প্রথমে হেসে উঠলেন। পরে বললেন, পারিসও বটে তোরা। তবে হ্যাঁ, পঞ্চু তোদের জন্য যা করেছে তাতে ওর জন্য তোদেরও কিছু করা উচিত।

বাবলু বলল, সেইজন্যই তো!

এর পর বাথরুম সেরে বাবলু ওর ঘরে বসে খবরের কাগজটা দেখতে দেখতে ব্রেকফাস্ট সেরে নিল। টোস্ট, ডিম-সেদ্ধ, মর্তমান কলা আর সন্দেশ। সেইসঙ্গে গরম এক কাপ চ খেয়ে মাউথ অর্গানটা পকেটে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে।

প্রথমেই গেল বিলুদের বাড়ি। বিলুকে অবশ্য ডাকতে হল না। দূর থেকে বাবলুকে ওদের বাড়ির দিকে আসতে দেখে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

বাবলু খুশি খুশি মুখে বলল, জামাটা গায়ে দিয়ে আয়। একবার ভোম্বলকে সঙ্গে নিয়ে বাচ্চু-বিচ্ছুদের বাড়ি যাব। খুব তাড়াতাড়ি।

মনে হচ্ছে তুই কিছু একটা মতলব এঁটেছিস। কোনও খবর-টবর আছে নাকি রে?

বাবলু বলল, আছে। এমন একটা খবর, যাতে কয়েকদিন হইচই করে মেতে থাকতে পারব।

কী খবর রে?

ধীরে, বন্ধু, ধীরে। আগে জামাটা গায়ে দিয়ে আয়।

বিলু এক মুহুর্ত দেরি না করে জামাটা গায়ে দিয়েই মাকে বলল, মা, আমি বাবলুর সঙ্গে যাচ্ছি।

বেশি দেরি করিস না যেন।

না, মা।

বাবলু আর বিলু এবার ভোম্বলের বাড়িতে এসে ওকেও ডেকে নিল। তারপর সবাই মিলে এসে হাজির হল বাচ্চ-বিচ্ছুদের বাড়িতে।

ওদের মা বললেন, কই, তোমাদের পঞ্চু কোথায়?

বাবলু বলল, পঞ্চু এখন আসবে না। আমার মা কী যেন একটা তৈরি করছে, তাই ও রান্নাঘরের দরজা আগলে বসে আছে।

তা থাকুক। আমি এই ভাবছিলাম বাচ্চু-বিচ্ছুকে পাঠাব তোমাদের বাড়ি। যাক, তোমরা যখন নিজেরাই এসে গেছ তখন ভালই হয়েছে। একটু পরে পঞ্চুকে ডেকে এনো। মালপো তৈরি করছি।

মালপোর নামে তো ভোম্বলের নোলা লকলকিয়ে উঠল। বলল, সত্যি মাসিমা, আপনার হাতের যা মালপো না, ওরকম আমার মা কিন্তু তৈরি করতে পারে না।

তা হয়তো পারেন না, কিন্তু তোমার মায়ের পাটিসাপটা তো আমি খেয়েছি। ওরকম যে আমি তৈরি করতে পারি না!

ওরা একবার দোকানে গেছে বাবা। এক্ষুনি আসবে। তোমরা ঘরে বোসো, নয়তো ছাদে যাও।

বাবলুরা ছাদেই উঠল। আর উঠেই দেখল, একটা ঠোঙায় করে কী যেন নিয়ে বাচ্চু-বিচ্ছু ঘরের দিকেই আসছে। বিচ্ছুটা খুব ছটফটে। তাই দিদির আগে-আগেই ছুটে ছুটে আসছে। তারপর দূর থেকে বাবলু, বিলু ও ভোম্বলকে দেখতে পেয়েই ছোটা থামাল।

বাবলুর হাত নেড়ে জানাল ওরা সবাই এসে গেছে। শিঙাড়ার ঠোঙাটা রান্নাঘরে মায়ের হাতে দিয়ে ছাদে এল ওরা। বাচ্চু বলল, কী, ব্যাপারটা কী? হঠাৎ এই সাতসকালে সবাই একজোট যে? এখনও তো আমাদের বাগানে যাবার সময় হয়নি।

বাবলু বলল, আজ আমরা অসময়েই এসেছি। আর এটা তো জানিস, আমরা যখন অসময়ে এসে হাজির হই, তখন যা হোক কিছু একটা ব্যাপার থাকেই।

বাবলু বলল, শোন, আপাতত আমাদের কোনও অ্যাডভেঞ্চারের পরিকল্পনা নেই। কিছু না ঘটলে রহস্যের হাতছানি না পেলে তো কিছু করা যায় না। তাই ভাবছি, যাতে আমাদের উদ্যম নষ্ট না হয় সেজন্যে পঞ্চুকে নিয়ে একটা উৎসব করব। যার নাম হবে পঞ্চু-মহোৎসব।

সবাই একসঙ্গে বাঃ, বাঃ করে উঠল।

বিলু বলল, এ-ব্যাপারে আমরা সবাই রাজি। কিন্তু এই মহোৎসবের একটা উপলক্ষ থাকবে তো?

নিশ্চয়ই থাকবে। সেটাও আমি ঠিক করেছি। উপলক্ষ হবে পঞ্চুর জন্মদিন।

বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছু—সবাই সমস্বরে হুররে করে উঠল। আর সঙ্গে-সঙ্গেই সিঁড়ির কাছ থেকে শোনা গেল ভৌ ভোঁ ভৌ অর্থাৎ, পঞ্চু এসে গেছে।

একটু পরেই বাচ্চু-বিচ্ছুর মা মালপো আর শিঙাড়া নিয়ে ছাদে এলেন। ভোম্বল বলল, আমার জন্য দুটো বেশি করে এনেছেন তো মাসিমা? শিঙাড়া না হলেও ক্ষতি নেই, মালপো খেতে আমি কিন্তু খুব ভালবাসি।

মাসিমা বললেন, সে কি আর আমি জানি না? আমার এই পেটুকটা ভাল খাবারের মর্ম বোঝে। তাই তোমার জন্য একটা-দুটো না, পেট ভরেই মালপো খাবার ব্যবস্থা করেছি।

বাবলু বলল, এটা কিন্তু ঠিক হল না মাসিমা। ব্যাপারটা ওয়ান সাইড হয়ে গেল।

হোক। যে যত বেশি খেতে ভালবাসে, তাকে আমি তত বেশি খাওয়াতে ভালবাসি। তোমরা লজ্জা করে খাও, তাই ঠকো।

মাসিমা দু হাতে কান ঢেকে বললেন, উঃ। থাম তো তোরা।

তারপর বাচ্চুকে বললেন, তুই একবার আয় দেখি আমার সঙ্গে। চায়ের কাপগুলো নিয়ে আসবি।

বাচ্চু মা’র সঙ্গে নীচে গেল। একটু পরে ঝলমলে হাসিমুখে বাচ্চুকে নিয়ে ওপরে উঠে মাসিমা বললেন, তোমরা নাকি পষ্ণু-মহোৎসব করছ?

হ্যাঁ, মাসিমা।

সত্যি, এক-একটা মতলব চাপেও বটে তোমাদের মাথায়। পঞ্চুর জন্মদিন। এটা অবশ্য মন্দ নয়। খবরের কাগজের নিউজ হয়ে যাবে এটা।

পাণ্ডব গোয়েন্দারা সবাই মালপো শিঙাড়া আর চা খেয়ে দল বেঁধে হইহই করে চলল পাঁচকড়ি পাঠকের আখড়ায় ভাল একটা দিন দেখতে।

বিশাল শরীর, প্রশস্ত টাক পাঁচকড়ি পাঠক এই অঞ্চলের একজন নামকরা টোল-পণ্ডিত। আজকাল টোল-আখড়া—এসবের পাট তো উঠেই গেছে প্রায়। কিন্তু হাওড়া শহরের রাজবল্লভ সাহা লেনের একান্তে একটি বটতলায় ছোট্ট একটি টিনের ঘরে পাঁচকড়ি পাঠক আজও টিকে আছেন।

বাবলু গিয়ে প্রণাম করতেই পাঠকমশাই তার ঘোলা-ঘোলা চোখদুটো তুলে পুরু চশমার ফাঁক দিয়ে একনজর ওদের দেখেই বললেন, কী চাই বাবা পঞ্চুপাণ্ডবরা?

বাবলু বলল, ঠাকুরমশাই, আপনি অনুগ্রহ করে যদি ভাল দেখে একটা দিন-টিন দেখে দেন, তা হলে খুব ভাল হয়। আমরা একটা শুভ কাজ করবার জন্য আপনার কাছে এসেছি।

কী কাজ শুনি? বিয়ে, পৈতে, না শ্রাদ্ধ?

ভোম্বল বলল, এ কী কথা? শ্ৰাদ্ধ আবার শুভ কাজ কবে থেকে হল?

হয়েছে, হয়েছে। ইদানীং হয়েছে।

এমন তো আমরা কস্মিনকালেও শুনিনি।

পাঠকমশাই খেঁকিয়ে উঠে বললেন, কত বয়স তোমার হে ছোকরা? আমার এই আটাত্তর চলছে। তোমার চেয়ে অনেক বেশি দেখেছি, অনেক বেশি শুনেছি। ছাদ বাড়িতে হিন্দি গানের রেকর্ড বাজতে শুনেছ?

ভোম্বল একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, না।

তবে? আজকাল ছাদ বাড়িতে লোকজন খাওয়ানোটা পর্যন্ত শুভদিন দেখে হচ্ছে। অর্থাৎ কিনা অফিসের বাবুদের, আত্মীয়-কুটুমদের সুবিধেমতো ছুটিছাটার দিন দেখে হচ্ছে। এসব খবর রাখো?

আজ্ঞে না।

তবে? কেন আমার মুখের ওপর ফরর-ফরর করতে এসেছ?

বাবলু বলল, ওর কথায় কিছু মনে করবেন না আপনি ও ছেলেমানুষ।

অ, আর তুমি বুঝি বুড়োর বাবা? বলেই খিক-খিক করে হেসে বললেন, সবাই আমাকে বলে পাগলা পাঠক। কিন্তু আমি যে ভাল মানুষকেও পাগল করে দিতে পারি, সেটাই কেউ জানে না। যাক, এবার বলো দেখি কীসের দিন দেখে দিতে হবে?

জন্মতিথির শুভদিন।

জন্মতিথির শুভদিন? এ কী কাণ্ড রে বাবা। হে মা-কালী! করালবদনি! বেঁচে থেকে আর কত কী দেখব মা? তা কার জন্মতিথি শুনি?

বাবলু পঞ্চুকে দেখিয়ে বলল, এই যে, এর।

কিড়মিড় করে দু’ হাতে মাথার টাকটাকে শক্ত করে টিপে ধরে চিৎকার করে বললেন, বেরিয়ে যাও। সাত সক্কালবেলায় রসিকতা করতে এসেছ আমার সঙ্গে? একফোটা সব ছেলে। আমার সঙ্গে দুষ্টুমি? কুকুরের জন্মদিন, এমন তো আমি বাপের জন্মে শুনিনি। তার আবার দিন দেখা?

বাবলু বলল, শুনুন, শুনুন। আপনি আমাদের ভুল বুঝবেন না। আমরা সত্যি-সত্যিই…

তোমাদের কোনও কথাই আমি শুনব না। পূর্ণচন্দ্র, অর্ধচন্দ্র, গুপ্তপ্রেস, লুপ্তপ্রেস—কোনও পঞ্জিকাতেই কুকুরের জন্মতিথির কোনও দিনক্ষণ লেখা নেই। তবু যদি তোমরা একান্তই জানতে চাও, তা হলে শোনো, যে মাসটা তেত্রিশ দিনে কাবার হবে, যে মাসে সাতটা রবিবার, আটটা সোমবার, নটা মঙ্গলবার, যে মাসে অমাবস্যায় চন্দ্রগ্রহণ আর রাত বারোটায় উত্তর দিকে সূর্যোদয়, সেই মাসেই যে-কোনও দিনে যে-কোনও মুহুর্তে তোমরা তোমাদের কুকুরের জন্মতিথি করতে পারো। এখন এখান থেকে বেরিয়ে যাও।

বাবলু বলল, আচ্ছা যাচ্ছি। বলে একটি দশ টাকার নোট পাঠকমশাইয়ের পায়ের কাছে রেখে বেরিয়ে এল টোল থেকে।

আর পাঠকমশাই টাকাটার ওপর হুমড়ি খেয়ে সেটাকে দু হাতে কুড়িয়ে নিয়ে চোখ দুটোকে অসম্ভবরকমের বড় বড় করে অবাক বিস্ময়ে একবার টাকা আর একবার বাবলুদের দিকে দেখতে লাগলেন।

বাবলুরা তখন ছুটে ছুটে অনেক দূরে চলে গেছে।

বাবলুদের সেই ছোট থামল একেবারে মিত্তিরদের বাগানে এসে। সবাই ওরা হেসেই কুটিপাটি। বাবলু বলল, কী ঝকমারি করে ওই পাগলা পাঠকের কাছে দিন দেখতে গিয়েছিলুম রে ভাই। এমন হবে কে জানত?

ভোম্বল বলল, একেবারে খচে ব্যোম।

বিলু বলল, অবজেকশন। মুখের ভাষা মার্জিত করো ভোম্বল। হাজার হলেও উনি একজন পণ্ডিত এবং বয়স্ক লোক। ‘খচে’ আবার কী কথা, ‘রেগে’ বলো।

ভোম্বল বলল, এই হল।

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, সত্যি বাবলুদা, উনি যেরকম রেগে গিয়েছিলেন, তাতে আমরা দারুণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম, মেরেই দিলেন বোধ হয়।

আসলে উনি আমাদের ভুল বুঝেছেন। তবে টাকাটা হাতে পেয়ে পরে বুঝবেন যে, আমরা সত্যিই ওঁকে গরম করে দেবার জন্য যাইনি।

বিলু বলল, তা হলে উপায়?

উপায় আবার কী? আমাদের সুবিধেমতো যে-কোনও একটা দিন দেখে করলেই হল। এখন আমরা আমাদের ঘরটাকে একটু পরিষ্কার করার কাজে লেগে পড়ি, আয়।

বর্ষার পর প্রকৃতি এমনিতেই সবুজে সবুজে ভরে ওঠে। তার ওপর গাছপালা যেখানে একটু ঘন সেখানে যেন সবুজ-বিপ্লব লেগে যায়। মিত্তিরদের বাগানেও এখন তাই সবুজের সমারোহ। টগর ফুলের গাছগুলি সাদা-সাদা ফুলে ভরে আছে। গন্ধরাজের গন্ধে আমোদিত চারদিক। আর ওদের সেই বুড়ো বেঁটে গুলঞ্চ লগত জে দেখবার মতো। থোকা থোকা রঙ্গন ফুলগুলি বাতাসের দোলায় দুলছে। অপরূপ! বাবলু বলল, এই অপরূপের মাঝে আমাদের সাইনবোর্ডটা বড়ই বেমানান। ইতিমধ্যে আমাদের অনেকগুলো অভিযান হয়ে গেছে। অতএব, হে পুরাতন, তোমার বিদায়।

বিলু বলল, বোর্ডটা কি রং করতে দোকানে দিয়ে আসব?

দিয়ে আসবি কী? বসে থেকে করিয়ে আনবি।

যদি না দেয়?

খুব দেবে। বেশিক্ষণের কাজ নয় ওটা।

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, আচ্ছা বাবলুদা, আমাদের পঞ্চ-মহোৎসবটা, এইখানেই করলে হয় না?

না। এই বাগান সেলফিশ জায়েন্টের বাগান না হলেও পাণ্ডব গোয়েন্দাদের গোপন ঘাঁটি। এখানে বহিরাগতদের স্থান নেই।

বিলু সাইনবোর্ডটা নিয়ে চলে গেল। পঞ্চুও চলল সঙ্গে সঙ্গে।

বাবলু ঘরের ভেতর থেকে দেওয়ালগিরির খাঁজে রাখা একটি ছোট্ট নোটবুক ও ডট পেন নিয়ে বাইরের দালানে আপেলের বাক্সের ওপর বসে পঞ্চ-মহোৎসবের ফর্দ তৈরি করতে লাগল।

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, আমাদের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনটা কীরকম কী হচ্ছে শুনি?

বাবলু বলল, গরম ভাত আর মুরগির মাংস তো হবেই।

ভোম্বল বলল, ব্যাকডেটেড।

বাবলু বলল, কেন?

ও-সব সাদামাটা মেনুতে পঞ্চ-মহোৎসব হবে না।

তবে কী হবে তাই বল? যা বলবি তাই করব।

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, হ্যাঁ, যে যা বলবে তাই হবে। দশটা নয়, পাঁচটা নয়, সবেধন নীলমণি একটাই আমাদের, পঞ্চু। কেউ যেন খেয়েদেয়ে নাক না সিটকায়!

বাবলু বলল, বলেই ফেল তা হলে।

ভোম্বল বলল, লিখে নে। চিকেন বিরিয়ানি, চিলি চিকেন, মাটন চাপ, আনারসের চাটনি, রানাঘাটের পানতুয়া, বর্ধমানের সীতাভোগ, কলকাতার রাজভোগ আর ভাল আইসক্রিম।

বাবলু বলল, শেষদিকেরগুলো আনবে কে?

সে তো আমার জানবার দরকার নেই। হয় এগুলো আনাতে হবে, নয়তো বন্ধ করো উৎসব। লোক খাবে অন্তত তিনশো। আমাদের স্কুলের বন্ধুরা, বাবার অফিসের বন্ধুরা, পাড়ার লোকজন ও থানার পুলিশ। ব্যস। আর নিমন্ত্রণপত্রের গোড়াতেই লেখা থাকবে, কেউ কোনও উপহার আনবেন না। যদি কেউ লজ্জার খাতিরে ভুল করে কিছু নিয়ে আসেন, তা হলে অত্যন্ত লজ্জিত হয়েই তাকে তা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

বাবলু হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল ভোম্বলের দিকে। ভোম্বলও হাত বাড়াল। ।

বাবলু বলল, তোর এই উদার মনের পরিচয় পেয়ে খুব খুশি হলুম ভোম্বল। সবরকমের উৎসবে আমাদের সমাজে এইরকম একটা প্রথাকে চালু করার দিন এসেছে। বিয়ে, পৈতে, অন্নপ্রাশন—সবেতেই। এখন বিলু ফিরে এলেই লিস্টটা ওকে একবার দেখিয়ে নিয়ে কাজে লেগে পড়া যাবে।

বিলু যতক্ষণ না এল, ততক্ষণ সময় কাটাবার জন্য বাবলু সেই গুলঞ্চ গাছের ডালে আধশোয়া হয়ে ওর মাউথ অর্গানটা বাজাতে লাগল। বাচ্চু-বিচ্ছু এক্কাদোক্কা খেলতে লাগল। আর ভোম্বল গড়াগড়ি খেতে লাগল ঘাসে শুয়ে।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে ফিরে এল বিলু আর পঞ্চু।

বিলু বলল, খুব সাবধানে এটা টাঙাতে হবে বাবলু। কাচা রং হাত লাগলেই উঠে যাবে।

বাবলু বলল, সে তোকে বলতে হবে না। বলে ঘরের কোণ থেকে ছোট্ট মইটা এনে দেওয়ালে লাগিয়ে বলল, তোরা ধরাধরি করে বোর্ডটা তোল দেখি। আমি ঠিক জায়গায় লাগিয়ে দিচ্ছি।

বোর্ড লাগানো হতেই বিলু চেঁচিয়ে উঠল, থ্রি চিয়ার্স ফর পাণ্ডব গোয়েন্দা!

সবাই বলল, হিপ-হিপ-হুররে।

পঞ্চুও বলল, ভৌ। ভৌ ভোঁ।

আর সঙ্গে সঙ্গে ঘটে গেল এক ভয়ংকর অঘটন। সেই আনন্দঘন পরিবেশে হঠাৎ কোথা থেকে প্রাণভয়ে ভীত একজন এসে হাজির হলেন, বাঁচাও—বাঁচাও। মুঝে বাঁচাও ও লোগ হামকো মার ডালে গা।

মধ্যবয়সি একজন অবাঙালি ভদ্রলোক তাড়া-খাওয়া পশুর মতো ছুটে এলেন সেখানে। তারপর ওদের সেই ভাঙা ঘরের ভেতরে ঢুকে কোথায় যেয়ে লুকোবেন কিছু ঠিক করতে পারলেন না।

বাবলু বলল, কোনও ভয় নেই আপনার। আপনি এখানেই লুকিয়ে থাকুন।

লোকটির বুক দিয়ে পেট দিয়ে ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে। ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে অতি কষ্টে বললেন তিনি, ও লোগ আভি আয়ে গা৷ মুঝে মার ডালে গা। হিঁয়াসে নিকাল যানে কা রাস্তা কিধার হ্যায় বতাও।

বাবলু বলল, আপনি এখান থেকে কোনও দিকেই পালাতে পারবেন না। পালাতে গেলেই ধরা পড়বেন। তার চেয়ে এখানেই চুপচাপ বসে থাকুন। এরপর আমরা দেখছি।

ততক্ষণে দু-দুজন ভয়ংকর চেহারার লোক ছুটে এসে ঢুকেছে বাগানে। দেখলেই বোঝা যায় একেবারে পেশাদার খুনে। ডোরাকাটা গেঞ্জি, পায়া গোটানো কালো প্যান্ট, মাথায় কদম ছাঁট চুল, ওদের একজনের হাতে ছোরা, অপরজনের হাতে রিভলভার।

ওরা এসেই রুদ্রমূর্তিতে বাবলুদের দিকে তাকিয়ে বলল, আই, একটু আগে এদিকে তোমরা কোনও লোককে আসতে দেখেছ?

বাবলু বলল, হ্যাঁ। এইমাত্র জঙ্গলের দিকে কে যেন একজন ছুটে গেল।

লোকদুটি বাবলুর কথা শুনেই জঙ্গলের দিকে ছুটল। যেই না ছোট বাবলু অমনি লেলিয়ে দিল পঞ্চুকে, লিয়ো, লিয়ো, পঞ্চু লিয়ো।

বাবলুর নির্দেশ পেতেই পঞ্চু তাড়া করল ওদের। যে লোকটির হাতে রিভলভার ছিল পঞ্চু পিছন দিক থেকে লাফিয়ে পড়ল তার ঘাড়ে। পঞ্চুর ভার সহ্য করতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়ল লোকটি। পঞ্চু তখন ঘ্যাক করে কামড়ে ধরল ওর রিভলভার-ধরা হাতটিকে। অপর লোকটি তখন দিশেহারা। কী যে করবে, কোন দিকে পালাবে কিছুই বুঝতে পারল না।

বাবলুরা তখন হইহই করে ছুটে গেছে ওদের দিকে। বাবলু গিয়েই পঞ্চুর কামড়ে-ধরা লোকটির হাত থেকে রিভলভারটা কেড়ে নিল। অপর লোকটি পালাবার চেষ্টা করতেই বাবলু বলল, হল্ট। একদম ভাগার চেষ্টা করবে না। দমাদম চালিয়ে দেব তা হলে।

পঞ্চু যে লোকটির হাত কামড়ে ধরেছিল সে যত ওর খপ্পর থেকে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে, পঞ্চুর আঁচড়ে-কামড়ে তত বেশি ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে সে।

দেখবি আমরা কারা? বলেই ছোরা হাতে লোকটি বাবলুর কবজিতে সজোরে একটা লাথি মারল।

লাথির ঘায়ে রিভলভারটা হাত থেকে ছিটকে পড়ল অনেক দূরে, একটা ঝোপের মধ্যে। অসহায় বাবলু তখন আঘাত-পাওয়া হাতটা অন্য হাতে মুঠো করে একটু পিছিয়ে এল। ক্রুদ্ধ লোকটি এবার উন্মত্ত আক্রোশে হাতের ছোরাটা যেই-না বাবলুর বুকে বসাতে যাবে বিলু আর ভোম্বল অমনি ভল্ট খেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটির ওপর। তারপর ওর হাতটাকে মুচড়ে এমনভাবে পাকিয়ে দিল যে, যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল বাছাধন।

বাচ্চু-বিচ্ছু ততক্ষণে রিভলভারটা কুড়িয়ে এনে বাবলুকে দিয়েছে। কিন্তু দিলে কী হবে? লাথি খেয়ে বাবলুর হাতের কবজিটা তখনও ঝনঝন করছে। তবে সে কোনওরকমে সেটা নিয়ে ওদের বলল, হ্যান্ডস আপ।

একদিকে পঞ্চু অপর দিকে বাবলু। তার ওপর ওর হাতে এই উদ্যত রিভলভার। অতএব হাত না তোলা ছাড়া উপায় রইল না ওদের।

পঞ্চুর কামড়-খাওয়া লোকটি বলল, কাজটা কিন্তু ভাল করলে না ভাই। এর হিসেব কিন্তু আমরা পরে এসে তোমাদের কড়ায়-গণ্ডায় মিটিয়ে দেব।

বাবলু বলল, হিসেব-নিকেশ পরে করবে। এখন তো থানায় চলো। গো অ্যাহেড।

ওরা আর কোনও কথা না বলে দু’হাত তুলে এগোতে লাগল। ওদের পিছু পিছু রিভলভার তাক করে এগিয়ে চলল বাবলু। সঙ্গে চলল পাণ্ডব গোয়েন্দারা সবাই। বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছু ও পঞ্চু।

সে এক দেখার মতো দৃশ্য। প্রশস্ত রাজপথ ধরে যখন ওরা ওইভাবে এগিয়ে চলল, তখন মনে হল যেন কোনও সিনেমার শুটিং হচ্ছে। স্থানীয় লোকজনও তখন ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝে সঙ্গে চলেছে ওদের।

এমন সময় হঠাৎই ঘটনার মোড় অন্যদিকে ঘুরে গেল। সামান্য কিছু পথ এসেছে ওরা, দৈবক্রমে কোথা থেকে যেন একটা কালো অ্যামবাসাডর ঝড়ের বেগে ছুটে এল ওদের দিকে। যেই না আসা, যে-যে-দিকে পারল পালাল। না পালালে কে যে কখন চাপা পড়ত তা কে জনে? আর সেই সুযোগেই দুষ্কৃতী দুজন দু’ দিকের দরজা খুলে ঢুকে পড়ল গাড়ির ভেতর। পঞ্চু তবুও একজনের পা কামড়ে ধরল। কিন্তু সে আর কতক্ষণ? গাড়ি স্টার্ট নিতেই ছেড়ে দিতে পথ পেল না বেচারি। না হলে সে-ও চাপা পড়ত। গাড়িটা চোখের পলকে হারিয়ে গেল রাস্তার মোড়ে।

স্তব্ধ পাণ্ডব গোয়েন্দারা নির্বাক দাঁড়িয়ে রইল। বিলু বলল, কী ব্যাপার রে বাবলু? রিভলভারটা হাতে পেয়েও ওদের ছেড়ে দিলি কেন তুই?

বাবলু বলল, আমার কবজিতে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে বিলু। শুধু ওদের ভয় দেখাবার জন্য এটাকে ধরে রাখার অভিনয় করছিলাম। এই অবস্থায় গুলি চালালে এই ভিড়ের ভেতর আমার হাতে দু-একটা অন্য লোক মরত।

ভোম্বল বলল, তা হলে বেশ করেছিস। এইসব ব্যাপারে খুব বেশি রিস্ক না নেওয়াই ভাল।

বিলু বলল, তা হলে হাতটার কিছু ব্যবস্থা করতে হবে তো? একবার ডাক্তারখানায় দেখিয়ে…।

বাবলু বলল, ওসব পরে হবে। এখন আহত ভদ্রলোকের পাশে গিয়ে দাড়াই চল। দেখি, এতক্ষণে কী অবস্থা হয়েছে তার।

বাবলুর কথায় ওরা আবার ফিরে এল মিত্তিরদের বাগানে। সত্যিই তো! সেই আহত ভদ্রলোক এখন কী অবস্থায় আছেন কে জানে? কিন্তু ফিরে এসে যা দেখল, তা বড়ই মর্মান্তিক। ওরা দেখল ভদ্রলোক দেওয়ালে ঠেস দিয়ে চোখদুটো আধবোজা করে ঝিমোচ্ছেন। ওঁর ঠোঁটের কষ বেয়ে রক্তের ধারা। বুকের বা দিকে ছোরার ঘা। পিঠে গুলি। পেটেও ছোরা মেরেছে ওরা। জামা-কাপড় লালে-লাল।

বাবলুরা ভেবে পেল না কে ইনি। সম্পূর্ণ অপরিচিত মুখ। এই অঞ্চলে কখনও দেখা যায়নি একে। অথচ এই মানুষটি ওদের তাড়া খেয়ে কী করে ঢুকে পড়লেন বাগানের ভেতর? ভদ্রলোকের অবস্থা দেখে বাবলু বলল, তুই হাসপাতালে একটা ফোন করে দে বিলু। এক্ষুনি যেন অ্যাম্বুলেন্স পাঠায়। অমনি থানাতেও একটা খবর দিবি৷

ভদ্রলোক বললেন, কোঈ জরুরত নেহি বেটা। হামারা যানে কা টাইম হো গিয়া। বলে ছোট্ট একটা বটুয়ার মতো থলি বাবলুর হাতে দিয়ে বললেন, ইসমে যো কুছ হ্যায় আধা তুমহারা, আউর আধা হামারা মুলুক মে ভেজ দে না।

বাবলু বলল, কী আছে এতে?

ভদ্রলোক কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ভালুয়েবল চিজ। জেরা সামালকে রাখ না। শুক্রিয়া। বলেই টলে পড়লেন।

বাবলু বলল, এই যে শুনছেন? আপনার মুলুক কোথায়? নাম কী? ঠিকানা কী?

ভদ্রলোক ওই অবস্থাতেই বহু কষ্টে বললেন, মি. এস এম যোশি। একসর তালাও, বোরিওলি…।

আর মুখ দিয়ে কথা বেরোল না। কথার বদলে বেরোল এক ঝলক রক্ত। তারপর লুটিয়ে পড়লেন ভদ্রলোক। বাবলু থলিটা অল্প ফাঁক করে দেখল, কাচের মতো সাদা চকচকে কতকগুলো গোল-গোল পদার্থ। এগুলো যে দামি হিরে তা বুঝতে ওর বাকি রইল না। শুধু এই অসার বস্তুগুলোর জন্য একজন মানুষের জীবন চলে গেল, এইটাই ওর কাছে বড় দুঃখের বড় বেদনার বলে মনে হল।

পঞ্চ-মহোৎসব মাথায় উঠল।

বাবলুদের এখন একটাই চিন্তা—এই ঘন রহস্যের জট কীভাবে ছাড়ানো যায়। মি. যোশির মৃতদেহ পুলিশ ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে গেছে। কেন যে ওই লাশগুলোকে ওরা অযথা কাটাছেঁড়া করে, তা কে জানে? তবে পাণ্ডব গোয়েন্দারা দুৰ্বত্তদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া রিভলভারটা থানায় জমা দিলেও থলিভর্তি হিরের

কথা কিন্তু পুলিশকে বলেনি।

এখন ওদের আলোচনার বিষয় হল মি. যোশি অবাঙালি। সম্ভবত মহারাষ্ট্রীয়। কিন্তু ওই ভয়ংকর লোকদুটো তো বাঙালি। কেন না পরিষ্কার বাংলায় কথা বলেছে ওরা। অতএব লোকদুটোর অনুসন্ধান করা। তার পরের বিষয় হল—ওই হিরেগুলো। অতগুলো হিরে। টাকার অঙ্কে ওগুলোর দাম কত তা কে জানে?

বাজারে যাচাই করতে যাওয়ার তো অসুবিধে অনেক, এবং তার চেয়েও চিন্তার বিষয় হল ওই হিরেগুলোর অর্ধেক মি. যোশির মুল্লুকে পৌছে দেওয়াটা। একসর তালাওটাই বা কী? আর বোরিওলিই বা কোথায়? এই ব্যাপারে জোর আলোচনার আসর বসেছে তাই বাবলুর ঘরে।

এবারের মিটিং মিত্তিরদের বাগানে না হওয়ার একমাত্র কারণ ভোম্বল। কেন না, বাচ্চু-বিচ্ছুদের বাড়ি আহিঙ্কে করে অতগুলো মালপো খেয়ে পেটটাকে এমন খারাপ করল যে, সে-আর বলবার নয়। যাক, বাবলু ওর ব্র্যাডশটা বার করে ‘বোরিওলি’ নামে কোনও স্টেশন আছে কি না দেখতে লাগল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর বোম্বাই শহরতলির লোকাল ট্রেনে চার্চ গেট টু ভিরা লাইনে বরিভলি নামে একটি স্টেশনের উল্লেখ পাওয়া গেল।

বাবলু বলল, আমার মনে হচ্ছে, ওখানেই মি. যোশির বাড়ি। ভদ্রলোক যখন মহারাষ্ট্ৰীয় এবং বোম্বাই যখন মহারাষ্ট্রের রাজধানী, তখন এই বরিভলির কথাই উনি বলতে চেয়েছেন।

বিলু বলল, কিন্তু একসর তালাও?

সেইটাই তো রহস্য। একসর তালাওটা কী?

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, বাবুলদা, আমার সমুমামা বম্বেতে থাকেন, তাকে একটা চিঠি লিখলে হয় না? তা হলেই জানা যাবে ওই নামে ওখানে কোনও একটা জায়গা আছে কি না?

বাবলু বলল, দি আইডিয়া। তবে তো কথাই নেই। তোর সমুমামার ঠিকানাটা জানিস?

বাপি জানে।

তোর বাপি অফিস থেকে এলে আজ রাত্রেই তা হলে ফাইনাল হয়ে যাবে।

ভোম্বল উৎসাহিত হয়ে বলল, তার মানে আমরা কি এবার বম্বে যাব?

বাবলু বলল, অবশ্যই। এই হিরের অর্ধেক যাদের প্রাপ্য তাদের তো ফিরিয়ে দিতেই হবে।

বিলু বলল, কতগুলো হিরে আছে গুনে দেখেছিস?

দেখেছি। চবিবশটা।

হ্যাঁ। আমাদের পাঁচ দুগুনে দশ। পঞ্চুর দুই।

বাবলুর মা এতক্ষণ দরজার আড়ালে থেকে ওদের আলোচনার কথা শুনছিলেন। এবার ঘরে এসে বললেন, কী এত ভাগাভাগি করছিস তোরা?

বাবলু বলল, সে একটা জিনিস। পরে তোমাকে সব বলব। বম্বে না কোথায় যেন যাচ্ছিস শুনলুম?

হ্যাঁ, মা। মি. যোশি নামে যে ভদ্রলোক খুন হলেন তিনি আমাদের কতকগুলো মূল্যবান জিনিস দিয়ে গেছেন তার বাড়িতে পৌছে দেবার জন্যে। সেগুলো দিতেই আমরা যাব। আর ওই সঙ্গে বোম্বাই শহরটাও ঘুরে আসব একটু।

একটু আগে তোরা কী সব হিরে-টিরের কথা বলছিলি যেন?

তুমি সব শুনেছ তা হলে?

মা হেসে বললেন, সব শুনেছি। এক-একটা হিরের দাম কত জানিস? তোরা যে ওগুলো নিয়ে যাবি, কোনও বিপদ হবে না?

বাবলু বলল, সে ঠিক কায়দা করে নিয়ে যাব আমরা। তবে এ-সব কথা তুমি যেন বাবাকে বোলো না।

মা বললেন, কী যে আছে তোদের কপালে তা ভগবানই জানেন। বলে চলে গেলেন। ভোম্বল বাবলুর বিছানায় গড়াগড়ি খেতে খেতে বলল, দুটো হজমের ট্যাবলেট খেতেই পেটটা কিন্তু ধরে গেছে ভাই। আর কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।

বিলু বলল, তার ওপর বম্বে যাবার নাম শুনেছ। কাজেই পেট যে আটবে এ তো জানা কথা।

বাবলু বলল, বন্ধে গেলে খরচপত্তর কিন্তু অনেক। অবশ্য এখনও ব্যাঙ্কে আমাদের টাকা যা আছে, তাতে ওটা কোনও প্রবলেম নয়। আমি ভাবছি, এবারে ক্যাশ টাকা সঙ্গে না নিয়ে ট্রাভেলার্স চেক নিয়ে যাব কি না।

বিলু বলল, নিতে পারিস। তবে অতগুলো দামি হিরে যখন সঙ্গে নিচ্ছিস, তখন ক্যাশ টাকাগুলো ভাগাভাগি করে নিলেই বা ক্ষতি কী?

ক্ষতি কিছু নেই। তবে একটা অভিজ্ঞতা হত। ভোম্বলটা তো তালকানা। ওর হাতে টাকা-পয়সা দিয়ে ভরসা নেই। কোথায় ফেলে-মেলে দেয় তার ঠিক কী? আর বাচ্চু-বিচ্ছুকে দেওয়া যায় না। তুই-আমি কত নেব?

ওরা যখন বসে বসে এইসব আলোচনা করছে, তেমন সময় হঠাৎই দরজার কাছে একটা বোমা ফাটার শব্দে কেঁপে উঠল বাড়িটা। ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে গেল চারদিক। শব্দের রেশ মিলতে-না-মিলতে আবার একটা। তারপর ফের একটা পর পর তিনবার বোমাবাজির পর দ্রুত একটি মোটরবাইকের চলে যাওয়ার শব্দ শোনা গেল।

বাবলু ছুটে বেরোতে যাচ্ছিল ঘর থেকে, মা ওকে চেপে ধরলেন। পঞ্চু চিৎকারে মাত করে দিল। একটু পরে ওরা যখন দরজা খুলে বাইরে বেরোল তখন পাড়ার লোকজন সবাই ছুটে এসেছে। কী ব্যাপার! ব্যাপারটা কী? হঠাৎ এত বোমাবাজি কেন?

এই কেনর উত্তর অবশ্যই পাওয়া গেল। বাবলু ঘর থেকে বেরোতেই দরজার কাছে একটা চিঠি কুড়িয়ে পেল। তাতে লেখা আছে: পাণ্ডব গোয়েন্দারা, মি যোশির হিরেগুলো তোমরা যে পেয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ওগুলো আমাদের মুখের গ্রাস / অতএব ফেরত দিতেই হবে। আজই সন্ধের আগে ওগুলো তোমাদের ভাঙা বাড়িতে থলিসুদ্ধ রেখে আসবে। পুলিশে খবর দেবার চেষ্টা কোরো না। আর কুকুরটাকে সাবধানে রাখবে ওই অসহায় পশুটির জন্য অযথা একটা গুলি খরচ করতে আমরা ইচ্ছুক নই।

মা বললেন, চিঠিতে কী লেখা আছে রে?

বাবলু বলল, কিছু না। বলে চিঠিটা পকেটে রেখে ধিল। রাগে ওর চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছে তখন।

বিলু, ভোম্বল বুকে পড়ে চিঠিটায় চোখ বুলিয়ে নিয়েছিল। ওরা বলল, কী স্পর্ধা! বলে কি না অসহায় পশুটির জন্য। আমাদের পঞ্চু অসহায়?

বাবলু বলল, পঞ্চু সহায় কি অসহায় ওদের আমি দেখিয়ে দেব।

বিলু বলল, এই হিরেগুলোই যত নষ্টের গোড়া। এগুলো অভিশপ্ত হিরে। একজন মানুষই খুন হয়ে গেল এর জন্যে। হিরেগুলো তুই ওদের দিয়ে দে বাবলু।

বাবলু রেগে বলল, এই এত অভিযান করার পর তোর মুখে আমাকে এই কথা শুনতে হল বিলু? তা হলে জেনে রাখ, এই হিরে ওদের হাতে তুলে দেবার আগে বাগানে গিয়ে ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’র সাইনবোর্ডটাকেই আমি জলে ফেলে দেব।

ভোম্বল বলল, তা হলে বলছিস ফেরত দিবি না তুই?

না।

না দিলে তো ওরা আরও খেপে যাবে। যখন তখন বোমাবাজি করে যাবে এখানে।

যা খুশি করুক। ওদের ওষুধ আমি দিচ্ছি। বিষে বিষক্ষয় কী করে করতে হয়, আমি জানি। তোরা একটু বোস। আমি এক্ষুনি আসছি।

বিলু বলল, আমাকে বকাস না। বলেই ওর টেবিলের ড্রয়ার থেকে হিরেগুলো বার করে একটা কৌটোয় রেখে থলিটা নিয়ে নিল। তারপর পিস্তলটা যথাস্থানে নিয়ে বলল, আমি না আসা পর্যন্ত কেউ কোথাও যাবি না। এখন আমাকে একা একবার বেরোতে হবে।

বিলু, ভোম্বল দু’জনেই বাধা দিল, গোয়ারতুমি করিস না। এরা মোস্ট ডেঞ্জারাস।

আমিও কম ডেঞ্জারাস নই।

পঞ্চু লেজ নেড়ে-নেড়ে বাবলুর সঙ্গে চলল।

বাবলু বলল, না। তুমিও যাবে না। আমি শুধু একা যাব, একা আসব।

বাবলু একাই চলল। আর পঞ্চু করুণ চোখে দূর থেকে তাকিয়ে রইল ওর দিকে।

বাবলু ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে একেবারে সোজা চারাবাগানের বস্তিতে গিয়ে হাজির হল। সামনের দিকের কয়েকটি ছিটে-বেড়ার ঘর পার হয়ে এক জায়গায় একটি বুড়িকে দেওয়ালে ঘুটে দিতে দেখে বলল, ভাটা আছে?

বুড়ি বলল, পাঠা? এখানে পাঠা, ছাগল কিছু নেই বাবা।

অ বুঝেছি। তা সে আর থাকবে না তো যাবে কোন চুলোয়? এই জোড়া-মন্দিরের রকে শুয়ে আছে।

বাবলু আরও একটু এগিয়ে একটি জোড়া-শিব মন্দিরের কাছে গিয়ে ডাকল, ভাটা! ভাটা রে!

অমনি ন্যাটাপানী ঘোলাটে চোখের একহাত-কাটা একটি ছেলে মন্দিরের চাতাল থেকে লাফিয়ে নামল, কে রে তুই?

আমি বাবলু।

আররে, তুই এখানে কী করতে এলি? আমাদের মতন খারাপ ছেলের সঙ্গে কি তোর মেশাটা শোভা পায়? তা কী দরকার রে?

তুই শুধু-শুধু রে-রে করিস না তো। বিচ্ছিরি লাগে।

আরে ভাই, আমরা হচ্ছি রাস্তার ছেলে। আমাদের মাতৃভাষাই ওইরকম। তা যাক, কী দরকার বল।

বাবলু একটু গম্ভীর হয়ে বলল, আমি একটা ব্যাপারে কাটা দিয়ে কাটা তুলব বলে তোর কাছে এসেছি। তুই কি আমায় সাহায্য করবি?

কেন করব না? তোর ডাকে আমি সব সময় আছি।

বাবলু তখন সব কথা খুলে বলল ভাটাকে। সব শুনে ভাটা বলল, তুই থাম। একেবারে ঝাপটে উড়িয়ে দেব সব ব্যাটাকে।

শোন, খুব মাথা ঠান্ডা রেখে এই কাজ করতে হবে।

বাবলুর কথা শুনে ভাটা হেসে গড়িয়ে মুখ দিয়ে হিরর কিক্‌ করে একটা অদ্ভুত শব্দ করে বলল, সত্যি বলছি। একদম জুড়িয়ে গিয়েছিলুম। দিনকতক আগেও রোজ একবার এইরকম শব্দ না শুনলে আমার ঘুম হত না। তা ঠিক আছে। মাল আমার রেডি। কচুবনে লুকনো আছে। নিয়ে আসছি এক্ষুনি। বলেই এক ছুটে পাশের একটি এঁদো ডোবার ধারে ছাইগাদায় ভরা কচুবনের ভেতর হুড়মুড় করে নেমে গেল ভাটা। তারপর বেশ কয়েকটা তাজা বোমা নিয়ে এসে বলল, এগুলো আজই দুপুরে বানিয়েছি। কিন্তু তখন স্বপ্নেও ভাবিনি ভাই, এত তাড়াতাড়ি এগুলো কাজে লাগবে বলে।

বাবলু বলল, কাজটা কিন্তু তোকেই করতে হবে। কেন না, ওই সব ছোড়াছুড়ি তো আমার অভ্যেস নেই। তবে একটা বোমা আমাকে দে। এই থলির মধ্যে পুরে ঘরের ভেতর রেখে আসব।

ভাটা বলল, তোর হাতে দেব না। আমিই নিয়ে যাব। তবে এমনি রেখে এলে তো হবে না, চার্জ করাতে হবে। দাঁড়া। তারও ব্যবস্থা করছি। বলে একটা ছোট জিনিস দু পা ও এক হাতের সাহায্যে একটি বলের ভেতর কায়দা করে ঢুকিয়ে দিল।

বাবলু বলল, ও কী!

ভাটা বলল, এইটাই তো আমাদের কেরামতি। থলি খুলে যখন আসল জিনিসের বদলে এটা পাবে, তখন রেগে গিয়ে আছাড় ও মারবেই। আর তারপরই বুঝতে পারবে ঠেলার নাম বাবাজি কাকে বলে।

বাবলু বলল, এতে আমাদের ঘরের কোনও ক্ষতি হবে না তো?

না, না। অত হেভি নয়। এগুলো আমি তৈরি করেছি কাউকে অল্পবিস্তর জখম করার জন্য। এর অনেকরকম সাইজ আছে। কোনটা বলের ভেতর ঢোকাই। কোনটা ডিমের খোলায় পুরে মুখ এঁটে দিই। কোনটা বা ন্যাকড়া জড়িয়ে রাখি। যাতে টিপে দেখতে গেলেই দুডুম।

বাবলু বলল, তা হলে তুই এটাতে ন্যাকড়াই জড়িয়ে দে। আমি তো তাই চাইছি। ছোড়াছুড়ি না করে ওরা যাতে টিপেটুপেই দেখে।

যা তুই বলবি, তাই করে দেব। এই কাজ করতে গিয়ে মনে কর, একটা হাতই আমার উড়ে বেরিয়ে গেল। তবু আমি এ-ব্যবসা ছাড়িনি। দেখবি আমার কেরামতি? বলেই বলের ভেতরে ঢোকানো সেই মালটা পুকুরধারে একটা গাব গাছে ছুড়ে মারতেই দুম করে একটা প্রচণ্ড শব্দ। আর সেই শব্দের সঙ্গে সঙ্গে গোটা বস্তিটা কেঁপে উঠল যেন। চারদিক ধোয়ায় ধোয়াচ্ছন্ন হয়ে গেল।

ভাটা অমনি এক অনাবিল আনন্দে ওর সদিবস ঘড়ঘড়ে গলায় হেসে উঠল, হিরর কিক। বাবলু বলল, ঠিক আছে, চলবে। তুই আমায় এইরকমই একটা বোমা দে। ভাটা আর একটা ওইরকম বোমা ন্যাকড়ায় জড়িয়ে সেটাকে ঠোঙায় মুড়ে বাবলুর থলিতে পুরল। তারপর বলল, চল দেখি, কোথায় যেতে হবে?

বাবলু বলল, আয়৷ বলে দু’জনে এগিয়ে চলল মিত্তিরদের বাগানের দিকে।

যে বুড়িটা ঘুটে দিচ্ছিল সে বলল, ওরে এই হতচ্ছাড়া ভাটা, ভর সন্ধেবেলায় কী আরম্ভ করেছিস? উঁ? আবার ওই ছোড়াটার সঙ্গে ড্যাঙডেঙিয়ে চললি কোথায়?

ভাটা বলল, আজকে আমার ফিরতে একটু রাত হবে পিসি, তুমি শুয়ে পোড়ো।

রাত হবে! কেন! কোন যমের বাড়িতে যাচ্ছ শুনি?

ভাটা হেসে উঠল, হিরর কিক্‌। তারপর হাসতে-হাসতেই বাবলুর হাতে টান দিয়ে বলল, পালিয়ে আয় রে।

ওরা আর একটুও দেরি না করে সোজা এসে ঢুকল মিত্তিরদের বাগানে। তারপর সেই ভাঙা বাড়ির ভেতর ঘরের ঠিক মধ্যিখানে ছোট্ট থলিটা রেখেই পালিয়ে এল।

তখন সন্ধে হয়ে গেছে। ওরা ঘর থেকে বেরিয়েই দেখল, এক জায়গায় একটি ঝোপ কেমন নড়ে উঠল যেন। ভাটা সঙ্গে-সঙ্গে চার্জ করতে যাচ্ছিল। বাবলু ওর হাত ধরল।

ঝোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল পঞ্চু।

বাবলু অবাক হয়ে বলল, কী রে! তুই এর ভেতরে কী করছিস?

পঞ্চু বাবলুর প্যান্ট কামড়ে টানতে লাগল।

বাবলু একটু এগোতেই দেখতে পেল, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছু সবাই লুকিয়ে আছে সেখানে।

বাবলু একটু এগোতেই দেখতে পেল, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছু সবাই লুকিযে আছে সেখানে। বলল,কোনও মানে হয় এইভাবে এখানে বসে মশার কামড় খাবার? আয়, চলে আয়।

বিলু বলল, চলে গিয়ে কী করব। ওরা কতজন আছে না আছে দেখব না একটু?

বাবলু বলল, টর্চ এনেছিস?

সব রেডি।

বাবলু ভাটাকে ইশারায় চলে যেতে বলল।

ভাটা বলল, ঠিক আছে। ওই কথাই রইল তা হলে। আমি আমার জায়গায় চলে যাচ্ছি। বলেই চোখের পলকে উধাও হয়ে গেল ভাটা।

সন্ধের অন্ধকার আরও একটু গাঢ় হল।

ভাটা চলে গেলে বিলু বলল, ওটাকে কোথেকে ধরে আনলি? কোনও বোমা-টোমার ব্যাপার আছে নাকি বাবলু?

বাবলু বলল, তা তো আছে।

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, কী মজা। কিন্তু কখন যে আসবে লোকগুলো। আর ভাল লাগছে না। বড্ড মশা।

বাবলু বলল, যখন আসে আসুক না। আমরা ঘাপটি মেরে বসে থাকি। তবে কথাবার্তাটা কম বলিস।

এইভাবে বসে থাকতে থাকতে ওরা যখন বিরক্তির চরমসীমায় পৌছেছে, তখনই দেখল সেই অন্ধকারে দু’জন লোক একটা মোটরবাইক নিয়ে একেবারে আসল জায়গায় এসে থামল। তারপর বাইক থেকে নেমে চারদিকে টর্চ মেরে দেখে নিল একবার। এদিক-সেদিক দেখতে দেখতে ওপর দিকে টর্চ মেরেই একজন বলল, এঃ। আবার সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। দেব এক্ষুনি আছাড় মেরে ফেলে।

অন্য লোকটি বলল, কাজ নেই কর্ম নেই ছেলেমেয়েগুলো দিনরাত যেন জ্বলিয়ে মারছে। খাবিদাবি পড়াশুনো করবি, তা নয়, শয়তানগুলোর ঠিক আমাদের দিকে নজর।

আর বেশি দিন এ-কাজ করতে হবে না বাছাদের। মাল যদি না পাই তো এক-একদিন এসে এক-একটাকে শেষ করে দিয়ে যাব।

কথা বলতে বলতেই ভেতরে ঢুকল একজন। তারপর উল্লসিত হয়ে বলল, না রে, সত্যি-সত্যিই রেখে গেছে মালগুলো।

কী করে বুঝলি?

এই দ্যাখ, থলি। তখন যা বোমবাজি করে গেছি না, ভয় পেয়ে গেছে ব্যাটারা। একফোঁটা-ফোঁটা ছেলে, আমাদের পিছনে এসেছে কাঠিবাজি করতে। বলে, কত গোয়েন্দাকে আমরা রসাতলে পাঠালুম, এ তো ভারী পাণ্ডব গোয়েন্দা।

যা, থলিটা নিয়ে আয়।

লোকটি থলিটা নিয়ে এসে আনন্দে লাফাতে লাগল।

অন্য লোকটি বলল, লাফাবি পরে। আগে দ্যাখ, মাল ঠিক আছে কি না।

হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক আছে। বলেই ঠোঙায় মোড়া বোমাটা বার করে ফেলল।

অন্য লোকটি বলল, এ কী? এটা কী? কী আছে এর ভেতরে?

হিরে। চবিবশটা হিরে।

তোর মুণ্ডু। মনে হচ্ছে কোনও ঢেলা পুরে রেখেছে। টিপে দাখ আগে।

ব্যস। যেই না টিপে দেখা অমনি ধুন্দুমার কাণ্ড। প্রথমে দড়াম করে একটা শব্দ। তারপরই বাবা রে, গেলুম রে চিৎকার।

এই সময়টুকুর জন্যই অপেক্ষা করছিল পাণ্ডব গোয়েন্দারা। ধোয়ার ভাবটা একটু কাটতেই ওরা ছুটে এল। বলল, কী হল? কী হল ভাই? আহাহা, মরে যাই।

ওরে জল দে।

ওরে পানি দে।

ওরে হাওয়া কর।

‘ওরে বাতাস কর।

দুটো লোকই তখন জগন্নাথ হয়ে বসে আছে।

বাবলু বলল, এ কী! তোমাদের হাত কোথায় গেল?

লোকদুটি বলল, দেখতে পাচ্ছিস না শয়তান, কোথায় গেল। উঃ কী যন্ত্রণা। মরে গেলুম।

বাবলু বলল, কোনও ভয় নেই ভাই। এমন হবে কে জানত? ওই থলির ভেতর যা ছিল তাই তো রেখে গেছি।

ওই থলির ভেতর বোমা ছিল? হতভাগা।

আরে রাগ করো না কেন ভাই? এখন বলো কোথায় পাঠাব তোমাদের, হাসপাতালে না থানায়?

আমরা জাহান্নমে যাব। বলে উঠে দাঁড়াতেই বাবলু বলল, এত সহজে এখান থেকে যাওয়া যায় না ব্রাদার। আগে বলো, ওই হিরের পেছনে তোমরা ওইভাবে ছুটছিলে কেন, আর কেনই বা ওই ভদ্রলোককে তোমরা খুন করলে?

তোরা কে যে তোদের সব কথা বলতে হবে?

না বললে এই বাগানের মাটিতে গর্ত করে পুতে ফেলব। জ্যান্ত কবর দেব তোমাদের।

প্রাণ থাকতে আমাদের মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোবে না। এখন যদি নিজেদের মঙ্গল চাস তো পথ ছাড়।

বিলু তখন পকেট থেকে ছোরাটা বার করে একজনের পেটে ঠেকিয়ে বলল, কথা কী করে পেট থেকে বার করতে হয়, আমরা জানি। এটা দিয়ে পেটটা চিরে দিলেই নাড়িভুডি সমেত সব কথা বেরিয়ে পড়বে হুড়হুড় করে।

হাত-ঠুঁটো লোকদুটো দারুণ ভয় পেয়ে গেল এবার।

বাবলু বলল, শোনো, তোমরা যত বদ লোকই হও না কেন, এই মুহুর্তে আমাদের অনুগ্রহ ছাড়া তোমাদের বাঁচবার কোনও রাস্তা নেই। আমাদের দয়ার ওপর নির্ভর তোমাদের করতেই হবে। এখনও বলো, তোমরা কারা। এবং কেন ওই ভদ্রলোককে খুন করলে?

লোকদুটি আবার ধপ করে বসে পড়ে বলল, সোনাভাই, যা হবার তা হয়ে গেছে। আর থানা-পুলিশের জালে আমাদের জড়িয়ে না। আমরা আমাদের কৃতকর্মের ফল হাতে হাতেই পেয়ে গেছি। আমরা বোম্বাইয়ের কুখ্যাত দস্যু ডেভিড লোদির হয়ে কাজ করি। কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলে, বিশেষ করে সোনাপট্টিতেই আমাদের কাজকারবার।

বাবলু বলল, বম্বের কুখ্যাত দস্যুর সঙ্গে কলকাতর সোনাপট্টির সম্পর্ক?

আছে। শুধু কলকাতায় নয়, সারা ভারতেই, বিশেষ করে অন্ধ্রের রাজধানী হায়দরাবাদেও আমাদের লোক আছে। তার কারণ বোম্বাই এবং হায়দরাবাদের জাভেরি মার্কেটে দুনিয়ার যত পাথর সেটিং-এর কাজ হয়। হাওড়ার ডোমজুড় থেকে কাজ শিখে এইসব সেটিং-কারিগররা ওই দূর দেশে করে খাচ্ছে। ওরা সবাই বাঙালি। হিরে-চুনি-পান্না কাচের গুলির মতো গড়াগড়ি যায় সেখানে। ওই জহুরি বাজারের চেহারা চোখে না দেখলে কল্পনাও করতে পারবে না। কিন্তু ওই কাজের দায়িত্ব এমনই যে, লোভের বশবর্তী হয়ে যদি কেউ কোনও কিছু চুরি করে পালাতে যায়, তা হলে তার আর রেহাই নেই। সমুদ্রের জলের ভেতর গিয়ে কেউ লুকোলে আমরা তাকেও সেখান থেকে টেনে বার করে আনব।

বাবলু বলল, তা হলে কি বলতে চাও মি. যোশি নামের এই ভদ্রলোক হিরে চুরি করে পালাচ্ছিলেন?

না। এইখানে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম হয়ে গেছে। এই যে ভদ্রলোক খুন হলেন, ইনি কে বা কী নাম, কিছুই জানি না আমরা। শুধুমাত্র ওঁর কাছ থেকে ওই হিরেগুলো ছিনতাই করবার নির্দেশ পেয়ে আমরা কাজে নেমেছি। আসলে বোম্বাইয়ের এক জুয়েলারির দোকানে চব্বিশটি মূল্যবান হিরে সোনার গহনায় সেটিং-এর জন্য আসে। তা ওই কাজ করবার সময় লোভের বশবর্তী হয়ে একজন কারিগর ওগুলো চুরি করে উধাও হয়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরবার জন্য তার পিছনে লোক লেগে যায়। ডেভিড লোদির নির্দেশে আমরাও ওকে ধরবার জন্য কাজে লেগে পড়ি। তবে আমাদের ওপর নির্দেশ ছিল চোরকে ধরামাত্রই আমরা যেন তাকে মেরে ফেলি। এবং ওই হিরেগুলো উদ্ধার করে আসল মালিককে নয় ডেভিড লোদির হাত তুলে দিই। অর্থাৎ, চোরের ওপর বাটপাড়ি করি। তা সেই লোকটিকে তাড়া করে যখন আমরা হাসখালির পোলের কাছে গুলি করি, হিরেগুলো তখনই হাতে আসে আমাদের। আর ঠিক সেই মুহুর্তেই অন্য এক অনুসন্ধানকারীদল এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের ওপর। তাদের সঙ্গে আমাদের রীতিমত খণ্ডযুদ্ধ লেগে যায়। তখনই ওই ভদ্রলোক ওই হিরেগুলো ছিনতাই করে পালাতে গেলে আমাদের দু’জন গুণ্ডা তাড়া করে ওঁকে। এবং তার পরের ব্যাপার তো তোমরা জানো। এখন যেভাবেই হোক ওই হিরেগুলো উদ্ধার করতে না পারলে আমরা গুলি খেয়ে মরব।

বাবলু বলল, না, তোমরা মরবে না। যদি তোমরা ভাল হতে চাও, তা হলে আমরা তোমাদের পাশে থাকব। কেন না, শাস্তি তোমাদের যথেষ্ট হয়েছে। এ-জীবনে ইচ্ছে থাকলেও আর কোনও খারাপ কাজ করার উপায় তোমাদের নেই। এখন সত্যি করে বলো দেখি ডেভিড লোদির ড়েরা কোথায়?

ও ফাঁকা মাঠের বেড়াল। ওর কোনও ডেরা নেই। মূলত দুবাই ও বোম্বাইতেই আড্ডা ওর।

বোম্বাইতে কোথায় থাকে?

হোটেল প্রিন্স। ফাইভ স্টারে।

সেটা কোথায়?

জুহুতে।

জুহু তো ওখানে অনেক। খার, বান্দ্রা, পার্লে, সাস্তাক্রুজ—কোথায়?

আন্ধেরিতে।

ঠিক আছে। এখন চলো, আমরা তোমাদের হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে আসি।

না, না। কোনও দরকার নেই। তোমরা বরং কোনও একটা গাড়ি ঠিক করে দাও, আমরা যেখানে হোক চলে যাব। আমাদের নিজস্ব নার্সিং হোম আছে।

বাবলু বলল, তাই কি হয়? আমরা তোমাদের ভাল জায়গাতেই ব্যবস্থা করে দেব। আমাদেরও পরিচিত হেলথ সেন্টার আছে। হাসপাতাল, নার্সিং হোম আছে।

ওরা ওদের সঙ্গে করে বাগানের গেটের কাছে নিয়ে এল। নামেই গেট। দু’শো বছরের ভাঙা পাঁচিলের হা-মুখ একটা। যেই না সেখানে আসা, অমনি দেখল সেই একহাত-কাটা ভাটাটা শিম্পাঞ্জির মতো লাফাতে লাফাতে আসছে। ভাটা ওদের কাছে এসেই হিরর কিক্‌ করে হেসে গড়িয়ে পড়ল। তারপর ওই আহত দু’জনকে দেখে বলল, এ কী রে বাবা। এ যে একেবারে জগন্নাথ। ওদিকে আমি তো একটাকে জাহান্নমে পাঠিয়ে দিয়েছি।

সে কী!

হ্যাঁ। এই বাগানে বোমার শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেখি, দুটো লোক কোথেকে যেন ছুটে এসে বলল—‘এই ছেলেগুলো নিশ্চয়ই ওদের বিপদে ফেলেছে। অতএব আর দেরি নয়। এক্ষুনি বাড়িটা জ্বালিয়ে দিই আয়।’ বলে যেই না তোর বাড়িতে পেট্রল-বোমা ছুড়তে যাবে, অমনি…

অমনি, আমি ঠিক তোর বাড়ির সামনে কদমগাছের ডালে উঠে বসেছিলাম। টুপ করে ওপর থেকে নীচে একটা ফেলে দিলুম, ব্যস। কেল্লা ফতে। একজন তো পালিয়ে বাচল, আর একজন চিচিং-ফাঁক। যাক, আর তোর ভয় নেই রে। আমি এখন পালাই। না হলে এক্ষুনি যদি পুলিশ এসে পড়ে তো পিটিয়ে ছাল তুলে নেবে আমার। বলেই কারও দিকে না তাকিয়ে দৌড়ে পালাল সে।

বাবলুরাও আর দেরি না করে আহত দু’জনকে স্থানীয় ছোট্ট হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে থানায় চলল খবর দিতে। যেতে যেতে বাবলু বলল, সবই তো হল। এখন সমস্যা হল পুলিশকে আমরা সব কথাই খুলে বলেছি, শুধু চেপে গেছি হিরের ব্যাপারটা। এখন ওই লোকদুটো যদি বলে দেয়?

বিলু বলল, বলুক না। আমরা যে হিরেগুলো পেয়েছি তার প্রমাণ কী? ওগুলো তো আমরা নাও পেয়ে থাকতে পারি। পুলিশ কিছু বললে আমরা সেই কথাই বলব যে, ওরা আমাদের মিথ্যে সন্দেহ করছে। হিরের ব্যাপারে কিছুই জানি না আমরা।

ভোম্বল বলল, হ্যাঁ, আমরা বেমালুম চেপে যাব ব্যাপারটা। বাবলুরা থানায় খবর দিয়ে যখন পুলিশের গাড়িতে চেপে ওদের বাড়ির কাছে এল, তখন দেখল, বোমার ঘায়ে ছিন্নভিন্ন একজন লোক ওদের বাড়ির সামনে পড়ে আছে। তাকে ঘিরে অনেক জনতার ভিড়। পুলিশ ভিড় হটিয়ে পথ পরিষ্কার করল। তারপর মৃতদেহ মৰ্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করে যখন হাসপাতালে এল সেই আহত লোকদুটিকে দেখতে, তখন দেখল সব ভোঁ ভোঁ। দুটো লোকই ম্যাজিকের মতো উবে গেছে হাসপাতাল থেকে।

পরদিন সকালে মিত্তিরদের বাগানে পাণ্ডব গোয়েন্দাদের জোর মিটিং বসল। ওই মিটিংয়ে ওরা ঠিক করল মি. যোশির হিরের ভাগ ওরা কেউই নেবে না। ওরা তদন্ত করে দেখে যদি বুঝতে পারে মি. যোশিই হিরেগুলোর প্রকৃত মালিক, তা হলে ওরা সব হিরেই মি. যোশির পরিবারের হাতে তুলে দেবে।

বিলু বলল, আপাতত এই সিদ্ধান্তই থাক। পরে অবশ্য অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে।

বাবলু বলল, সে তো বটেই। এমনও তো হতে পারে ওই লোকদুটাের আগাগোড়া স্টেটমেন্টটাই ফলস?

হতে পারে। তবে কথা শুনে মনে হল না ওরা মিথ্যে বলেছে বলে।

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, তবে বাবলুদা, হিরের লোভ কিন্তু বড় সাংঘাতিক। ওরা কিন্তু সহজে আমাদের ছাড়বে না। তার ওপর আমাদের আক্রমণে ওদের দলের একজন হত এবং দুজন আহত। অতএব এখন কিন্তু ওরা খ্যাপা বাঘ।

বাবলু বলল, ঠিক এখন আমাদের প্রত্যেককে চলায়-ফেরায় খুব সাবধানে থাকতে হবে।

বিলু বলল, তবে আমি বলি কী ওই হিরেগুলো পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে পেপারে একটা স্টেটমেন্ট দিলে আমরা কিন্তু ওই দুষ্টচক্রের গ্রাস থেকে রক্ষা পাব। এর পরে যা কিছু ঝামেলা তা পোহাবে পুলিশ।

এখন আর তারও সময় নেই। কেন না, আমাদের মারের বদলা ওরা নেবেই নেবে। অতএব যা গোপনীয় তা গোপনই থাক।

ভোম্বল বলল, আমাদের বম্বে যাওয়ার কী হবে তা হলে?

যাব। আমাদের প্রধান কাজই তো হবে এখন ওই চব্বিশটি হিরের আসল মালিককে খুঁজে বার করা। যদি বার করতে পারি, তা হলে যাদের জিনিস তাদেরই হাতে তুলে দেব। যদি না পারি তা হলে জুহু বিচে দাঁড়িয়ে সব হিরে ফেলে দেব সমুদ্রের জলে।

সে কী!

হ্যাঁ, রত্বের আকর রত্নাকর, সমুদ্রের গর্ভেই লুকনো থাকবে ওই অমূল্য সম্পদ। এখন বাচ্চু-বিচ্ছুর বাবার কাছে গিয়ে সমুমামার বোম্বাইয়ের ঠিকানাটা নিয়ে আসতে হবে। আজ তো রবিবার। এখন গেলে ওঁকে নিশ্চয়ই বাড়িতে পাব।

বাচ্চু বলল, হ্যাঁ, বাপি তো বাড়িতেই আছেন। তা ছাড়া আমরা দু’ বোনে সব বলেছি বাপিকে। উনি শুধু এইটুকুই বলেছেন, আমরা যদি ভ্রমণের জন্য বোম্বাই যাই, তা হলে তিনি যেতে দেবেন আমাদের। আর অন্য কোনও মতলব যদি থাকে, তা হলে যথেষ্ট আপত্তি আছে ওঁর।

বাবলু বলল, তা হলে আর দেরি নয়। এখুনই চল, ওর বাপির সঙ্গে দেখা করে আসি।

পাণ্ডব গোয়েন্দারা হইহই করে বাচ্চু-বিচ্ছুদের বাড়ির দিকে চলল। বোম্বাইয়ের আরব সাগর ওদের যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে এবার।

বাচ্চু-বিচ্ছুর বাবা তখন টিভিতে অনুষ্ঠান দেখছিলেন। ওরা যেতেই বললেন, ১১৬ আবদুল রহমান স্ট্রিট, বোম্বাই-৩। আর কী জানতে চাও বলো?

বাবলু বলল, আমরা অনেক কিছুই জানতে চাই। আপনি আগে টিভিটা বন্ধ করুন। তারপর বলুন কীভাবে যাব, কোথায় থাকব?

কবে যাচ্ছ তোমরা?

যেদিনের টিকিট পাব।

কোন গাড়িতে যেতে চাও?

যে গাড়িতে জায়গা পাব।

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, কী মজা।

শোনো তা হলে, বোম্বাই যাবার ভাল গাড়ি একটাই। সেটা হল টু আপ বম্বে মেল। ভায়া নাগপুর থ্রি আপেও যাওয়া যায়। তবে ও-গাড়িটা এলাহাবাদ হয়ে ঘুরে যায়। এ ছাড়া আছে বম্বে এক্সপ্রেস। বাজে গাড়ি। সময়ও লাগে অনেক। আর একটা ভাল গাড়ি আছে। যে-গাড়িতে অনেকেই যেতে চায়, সেটা হল গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস।

বাবলু বলল, আমরা ওই গাড়িতেই যাব।

না। ও-গাড়িতে তোমরা যাবে না। তার কারণ ওই গাড়িটা বম্বে পৌঁছয় রাত প্রায় দশটা নাগাদ। নতুন যারা বম্বে বেড়াতে যায়, তাদের পক্ষে ও-গাড়িটা ঠিক নয়। তোমরা টু আপে যাবে।

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, না, বাপি। আমরা গীতাঞ্জলিতেই যাব। ওই গাড়িতে চাপবার খুব শখ আমাদের।

ছেলেমানুষি কোরো না। যা বলি তাই শোনো।

ওদের কথার মাঝখানেই বাচ্চু-বিচ্ছুর মা এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন, যাবে কারা? ওরা, না তুমি?

আরে তুমি বুঝছ না কেন? কোনও অচেনা জায়গায় দূর দেশে দিনের আলোয় ছাড়া যেতে নেই।

বুঝলুম। কিন্তু বম্বে ওদের কাছে অচেনা জায়গা হলেও ওরা তো সমুর কাছেই যাবে। সমু এসে নিয়ে যাবে ওদের। তা ছাড়া আমি শুনেছি রাত দশটায় ওখানে নাকি সন্ধে-রাত। দেড়টা-দুটোর আগে নাকি কেউ শুতে যায় না।

তা হলে যা ইচ্ছে করো।

বাচ্চু বলল, আমি বলি কী বাপি, তুমি সমুমামাকে একটা চিঠি লিখে দাও। যেন আমাদের জন্যে একটা ঘরের ব্যবস্থা করে রাখে আর আমাদের স্টেশন থেকে নিয়ে যায়।

সে তো করবই। তবু আমার মতে তোমরা টু আপেই যাও।

বাচ্চু-বিচ্ছুর মা বললেন, না। ওরা গীতাঞ্জলিতেই যাবে। যারা এত দেশ-দেশান্তর ঘুরে এত সব কাণ্ড করে বেড়াল, তারা সামান্য রাত দশটায় ট্রেন থেকে নেমে দিশেহারা হয়ে যাবে, এই ভয়ে তুমি কিনা তাদের বাধা দিচ্ছ ওই গাড়িতে যেতে? এত ভয় যদি তো না যেতে দিলেই পার?

আচ্ছা, বাবা আচ্ছা। যা করলে ভাল হয় তা ওরাই করুক। ওদের যখন অত শখ তখন গীতাঞ্জলিতেই যাক। তবে আমি হলে কিন্তু ও-গাড়িতে যেতাম না। আমি বাবা সারারাত বার্থে শুয়ে আরামে ঘুমিয়ে সকালে নামতাম। তা ঠিক আছে। ওরা টিকিট কেটে আমাকে জানালেই আমি সমুকে ট্রাঙ্ককল করব। আপাতত একটা এনভেলপ ছেড়ে দিচ্ছি।

বাবলুরা যখন বাচ্চু-বিচ্ছুদের বাড়িতে বসে এইসব আলোচনা করছে, ঠিক তেমন সময় ওদের বাড়ির সামনে একটি পুলিশের গাড়ি এসে থামল। ওদের পরিচিত দারোগাবাবু গাড়ি থেকে নেমে ঘরে ঢুকে বললেন, এই যে। পাণ্ডব গোয়েন্দারা সব এখানেই রয়েছ দেখছি। একটা বিশেষ প্রয়োজনে তোমাদের কাছে এলাম।

বাচ্চু-বিচ্ছুর বাবা বললেন, তার আগে বলুন চা না কফি?

দারোগাবাবু হেসে বললেন, সেরেছে। একে তো ঘুষখোর হিসেবে পুলিশের বদনাম। তার ওপর ডিউটিতে এসে গোয়েন্দাদের সামনে চা অথবা কফি?

বাবলু বলল, চা কিংবা কফি, স্যার, ঘুষের পর্যায়ে পড়ে না। আপনি খেলে ওই সঙ্গে আমরাও একটু ভাগ পাই। অতএব এখন গোয়েন্দা-পুলিশ এক হয়ে যাওয়াই ভাল।

দারোগীবাবু হাঃ-হাঃ-হাঃ-হাঃ করে গলা ফাটিয়ে হেসে বললেন, তা হলে কফিই হোক।

বাচ্চু আর বিচ্ছু কফি আনতে চলে গেল। দারোগাবাবু বললেন, হ্যাঁ, যে-জন্যে এসেছিলাম। কাল গভীর রাতে আমরা ওই পলাতকদের একজনকে ধরেছি। তার মুখে শুনলাম তোমরা এমন-কিছু মূল্যবান হিরে ওই মৃত ব্যক্তির কাছ থেকে পেয়েছ, যা নাকি আমাদের কাছেও চেপে গেছ।

বাবলু বলল, মিথ্যে কথা। আসলে ওই হিরের লোভেই ওরা খুন করে ভদ্রলোককে। তবে আহত হবার পর ভদ্রলোক যখন বুঝতে পারেন তিনি আর বাঁচবেন না, তখন পাছে ওই দুৰ্বত্তর ওগুলো ছিনিয়ে নেয়, সেই ভয়ে তিনি সেগুলো পথেই কোথাও ফেলে দেন। সেটা এমনই এক জায়গা যা আমরাও জানি না, ওরাও জানে না।

সে কী!

ব্যাপারটা নিশ্চয়ই এইরকমই। অথচ এই দুৰ্বত্তদের ধারণা ওগুলো নাকি আমাদের কাছেই আছে। তাই ওরা মিথ্যে সন্দেহ করছে আমাদের। আর এই সন্দেহের বশবর্তী হয়েই কাল হঠাৎ আচমকা আমাদের বাড়িতে এসে এলোপাথাড়ি বোম চার্জ করে যায়। এমনকী, একটা চিঠি দিয়েও শাসিয়ে যায়, আমরা যেন অবিলম্বে ওই হিরেগুলো ভাঙা বাড়ির মধ্যে রেখে আসি এবং এসব কথা পুলিশকে না জানাই।

আর সেই রাগে তোমরাও বস্তিতে গিয়ে ওই হাত-কাটা ছোড়াটাকে ডেকে এনে ওইরকম একটা প্যানিক করিয়ে দিলে?

বাবলু বলল, বিশ্বাস করুন, স্যার, এই কাজের কোনও পরিকল্পনাই আমাদের ছিল না। আমরা শুধু ওই দুষ্কৃতীগুলোকে জব্দ করবার জন্য ওর কাছে গিয়েছিলাম, ছোটখাটো একটা কিছু চাইতে। তা সে জিনিস আমরা ওর কাছেই পেয়েছি। তবে নেহাত ছোটখাটো জিনিস ও আমাদের দেয়নি। না হলে দু-দুটো লোকের হাত একসঙ্গে উড়ে যেত না। আর পরের ওই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য আমরা দায়ী নই। অবশ্য ওই ছেলেটিকেও দায়ী করা যায় না। তার কারণ, ও যদি ওইসময় গাছের ডালে ঘাপটি মেরে বসে না থাকত, তা হলে কিন্তু পেট্ৰল-বোমার আঘাতে আমাদের বাড়িসুদ্ধ সবাই পুড়ে মরত।

বুঝলাম। কিন্তু বিকেলবেলা ওরা যখন এসে বোমাবাজিটা করে গিয়েছিল, তখন তোমরা আমাদের একবার খবর দাওনি কেন?

বাচ্চু-বিচ্ছুর বাবা বললেন, উচিত ছিল। কিন্তু, এবার তা হলে আমি একটা কথা আপনাদের বলি মশাই, হাজার হলেও পাণ্ডব গোয়েন্দারা ছেলেমানুষ। সকালে যখন ওইরকম একটা ঘটনা হয়ে গেল, তখন আপনাদেরও কি উচিত ছিল না এদের প্রতিরক্ষার জন্য কিছু সাদা পোশাকের পুলিশকে ওদের নজরে রাখার দায়িত্ব দেওয়া। একথা কি আপনাদের একবারও মনে আসেনি যে, শত্রুপক্ষের আক্রমণ এবার যে-কোনও দিক থেকেই হোক ওদের ওপর আসতে পারে। কেন আপনারা তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেননি?

দারোগাবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, এটা অবশ্য আমাদের দিক থেকে খুবই একটা ভুল হয়ে গেছে বলতে পারেন। তবে ওদের একবার এক্ষুনি আমার সঙ্গে থানায় যেতে হবে।

বাবলু বলল, চলুন।

এমন সময় বাচ্চু-বিচ্ছু কফি এনে বলল, আগে এটা খেয়ে নিন। তারপর যাবেন।

কফি খাওয়া শেষ হলে ওরা সবাই চলল থানায়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজনে। থানায় যেতেই দেখল এক অদ্ভুত দৃশ্য। ভূত আর বাদরের লড়াই ওরা কখনও দেখেনি। লকআপের ভেতরে তাই হচ্ছে। বোমায় আহত সেই হাত-ওড়া লোকটির সঙ্গে ভাটার তুমুল বচসা হচ্ছে। ভাটার তো কাঁচা মুখ। তাই যা ইচ্ছে তাই বলে চলেছে সে।

ওরা যেতেই ঝগড়া থামিয়ে গরাদের কাছে ছুটে এল ভাটা। বলল, বাবলু, তোর দারোগাদাকে বলে দে, আমায় যেন এক্ষুনি ছেড়ে দেয়। সত্যি বলছি, আমাকে এইভাবে বিনা দোষে আটকে রাখলে আমি কিন্তু চরম বদলা নেব।

দারোগাবাবু বললেন, বিনা দোষে কী রে ব্যাটা? একজন লোককে মেরে ফেলেছিস তুই তোকে ফাঁসিতে লটকাব আমি।

ভাটা বলল, আমাকে ফাঁসিতে লটকাবেন? তা হলে জেনে রাখুন, দাদারও দাদা আছে। আগে ভাল ব্যবস্থায় ছেড়ে দিন। না-হলে আমাকে যদি কোনও দাদা ধরে বেরোতে হয় তা হলে কিন্তু আমার কাজই হবে পুলিশ অথবা পুলিশের গাড়ি দেখলেই একটা করে ঝেড়ে দেওয়া। আমি এমনিতে খুব ভালছেলে। কিন্তু আমাকে ঘটালে আমি ভাটা।

বাবলু বলল, ওকে ছেড়ে দিন স্যার। প্লিজ, ওর কিন্তু কোনও দোষ নেই।

দারোগাবাবু বাবলুকে চোখ টিপে বললেন, ছেড়ে ওকে দেবই। এমনি লোক-দেখানো ধরে এনেছি। কোনও কেসও দেব না। কিছুই করব না।

কিন্তু আপনি জানলেন কী করে যে এটা ওর কাজ?

যদি ওই লোকটি ধরা না পড়ত, তা হলে জানতেও পারতাম না। ওর মুখে চেহারার বর্ণনা শুনেই ধরে এনেছি ব্যাটাকে। বোমাবাজি করতে এসে নিজেদের অস্ত্রে নিজেরাই ঘায়েল হয়েছে, এটাই পুলিশ রিপোর্টে যাবে।

ভাটা তখনও চেঁচাচ্ছে, কী হল? দেরি করছেন কেন? খুলুন।

দারোগাবাবু বললেন, গাধার মতো চেঁচাচ্ছিস কেন? এই তো সবে এলি। এখন ঘণ্টাখানেক থাক, তারপর ছেড়ে দেব।

না। এক্ষুনি খুলতে হবে। মেজো দারোগা আসার আগেই। খুলুন। ভাটার গলায় প্রায় ধমকের সুর।

দারোগাবাবু একজন সেপাইকে বললেন, তালা খুলে ওকে বার করে দিতে।

ভাটা আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। নেহাত বাবলার ব্যাপার, তাই ওইভাবে মানুষ মারার ঝুঁকি নিয়েছিলাম। না হলে ওসব কাজ আমি করি না। আমি শুধু সাপ্লাই দিই। পেটে-মেকার।

থাক। আর ইংরেজি ঝাড়তে হবে না। বেরো এখান থেকে।

ভেরি গুড স্যার। বলে পালিয়ে বাঁচল ভাটা। লক আপে বন্দি অন্য লোকটি তখন রক্তচক্ষুতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। ওর দুটো হাতেই ব্যান্ডেজ বাধা। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছে বেচারি। বলল, আমাকেও মুক্তি দিন স্যার। আমার পাপের ফল তো হাতেনাতেই পেয়েছি। আর কেন? ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। শিগগির কোনও হাসপাতালে পাঠান। আমি আর যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না। আমাকে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়ান।

বাবলু বলল, আমরাই তো তোমাদের হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমাদের ওরকম দুৰ্মতি হল কেন? কে বলেছিল পালাতে?

ভুল করেছিলুম ভাই।

দারোগাবাবু বললেন, সত্যিই ভুল করেছ। এখন হাত দুটোর যা অবস্থা দেখছি তাতে গ্যাংগ্রিন না হয়ে যায়। তা থাক। তোমার আর-এক সঙ্গী কোথায়?

বলতে পারব না। তবে পুলিশের তাড়া খেয়ে সে একটা ট্রাক ম্যানেজ করে পালিয়েছে।

তুমি পারলে না?

পারলে কি এইভাবে এখানে যন্ত্রণায় ছটফট করতুম?

কিন্তু মিথ্যে সন্দেহ করে তোমরা এদের পিছনে লাগতে গিয়েই তো এই কাণ্ডটি ঘটালে?

মিথ্যে সন্দেহ? কী বলছেন স্যার? আমি এখনও বলছি ওই চবিবশটা হিরে ওদের কাছেই আছে।

ওরা মিথ্যে কথা বলবার ছেলে নয়।

লোকটি হেসে বলল, তার আগে বলুন তো দাদা, কটা হিরে ভাগ পেয়েছেন ওদের কাছ থেকে?

বাবলু বলল, মুখ সামলে কথা বলবি। ব্যাটা চোরের চালা চোর। আমরা খুব শিগগির বম্বে যাচ্ছি। ডেভিড লোদির সঙ্গে দেখা করে বলব, তোরাই ওই হিরে চুরি করে হিস্‌সা নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরেছিস।

তই যা। শিকারির হাঁ-মুখে তোরা নিজেরাই গিয়ে ধরা দে গে যা। তবে জেনে রাখ, এতক্ষণে অপারেশন লিস্টে তোদের নাম উঠে গেছে। ডেভিডের গ্রাস থেকে তোরা বা তোদের দারোগাবাবু কেউই বাঁচবি না।

বাঁচা-মরা পরের কথা। তবুও জেনে রাখ, ওই হিরে আমরা পাইনি।

তা হলে ওই হিরে-রাখা থলিটা তোরা পেলি কোত্থেকে?

ওটা আমরা বাগানেই কুড়িয়ে পেয়েছিলাম।

লোকটি বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, শুনলেন তো দারোগাবাবু, ওরা হিরে পায়নি। এতক্ষণ পরে বলছে হিরে রাখা শূন্য থলিটা ওরা কুড়িয়ে পেয়েছে।

দারোগাবাবু বললেন, ঠিক আছে। এ-ব্যাপারে আমি তদন্ত করছি। আপাতত তোমার একটা ব্যবস্থা করি। তুমি অনেকক্ষণ ধরে কষ্ট পাচ্ছ। বলে তিনি লোকটিকে হাসপাতালে পাঠাবার জন্য ফোন ধরলেন।

প্রায় মিনিট-পনেরোর মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্স এসে গেল। পুলিশ-প্রহরায় অপরাধীকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দারোগাবাবু বললেন, তা হলে বাবলু, এখনও সময় আছে, ঠিক করে বলো। এই সব হিরে-টিরের ব্যাপারে আমার কোনও স্বাৰ্থ নেই। শুধুমাত্র তোমাদের নিরাপত্তার জন্যই এই ব্যবস্থা। যে-মুহুর্তে ওগুলো থানায় জমা পড়বে, সেই মুহুর্তে আমি তোমাদের প্রাপ্তি স্বীকারের রসিদ দিয়ে সরকারি খরচায় কাগজে বিজ্ঞাপন দেব।

বাবলু বলল, না। হিরেগুলো সত্যি আমাদের কাছে নেই।

না থাকলেই ভাল। তবে যদি তোমরা কিছু মনে না করো তা হলে…।

আমাদের বাড়িগুলো একবার সার্চ করবেন, এই তো? আমার মনে হয় আপনার সন্দেহ দূর করবার এটাই উপযুক্ত ব্যবস্থা। আপনাদের মেটাল ডিটেকটর না কী যেন আছে, তাই দিয়েও পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।

দারোগাবাবু বললেন, শোনো, হিরেগুলো অত্যন্ত দামি। মহারাষ্ট্র সরকারও ওয়েস্ট বেঙ্গল গভর্নমেন্টকে জানিয়েছেন, এগুলোর ব্যাপারে একটু সতর্ক থাকতে। তাই এখানকার প্রত্যেক থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসারদের এই ব্যাপারে বিশেষ নজর রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেহেতু এই মূল্যবান জিনিস লুকিয়ে রাখার ব্যাপারে দুষ্কৃতীরা তোমাদের নাম বলেছে, সেহেতু এই ব্যাপারে একটা প্রকাশ্য তদন্ত তোমাদের ওপরও হওয়া দরকার। এতে তোমরাও সন্দেহ-মুক্ত হবে, আমিও বদনামের হাত থেকে বাঁচব।

বাবলু বলল, আমরা আপনাকে এই তদন্তের ব্যাপারে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আপনি আমাদের সবার বাড়িই চলুন।

বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু-বিচ্ছুর মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। বাবলুটা বোকের মাথায় এ কী কীর্তি করে বসল? ওরা তো সবাই জানে ওই মাল বাবলুর ঘরে ড্রয়ারের মধ্যে আছে। তা হলে?

যাই হোক, পুলিশ মেটাল-ডিটেকটর ইত্যাদি যা-যা ছিল সব নিয়ে দলবল বেঁধে চলল অনুসন্ধানে। তবে ভদ্র অনুসন্ধান। হাজার হলেও পাণ্ডব গোয়েন্দাদের বাড়ি তো! সব কিছু খুঁটিয়ে দেখে প্রত্যেকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তদন্ত করে মিত্তিরদের বাগানে এল। কিন্তু না। সেখানেও কিছুর হদিস পেল না ওরা। অতএব পাণ্ডব গোয়েন্দারা সন্দেহমুক্ত হল।

বিলু বলল, কী ব্যাপার বল তো বাবলু? মালগুলো তুই তো ড্রয়ারে রেখেছিলি, গেল কোথায়?

বাবলু হাসল। বলল, বোকা, মাল কখনও বাড়িতে রাখে। যে হারে ওরা আমাদের পিছনে লেগেছে, তাতে হঠাৎ যদি ডাকাতি হয়ে যায়, তা হলে তো সব যাবে।

ভোম্বল বলল, সেইজন্যেই বুঝি তুই পুলিশকে অত জোর দিলি তদন্তের ব্যাপারে?

হ্যাঁ। এখন কেমন হল? আমাদের জিনিস আমাদের কাছেই রইল, উপরন্তু পুলিশের সন্দেহভাজনও হলাম না। ’

পাণ্ডব গোয়েন্দারা এবার মনের আনন্দে পুরোপুরিভাবে বোম্বাই যাত্রার আয়োজন করতে লাগল।

এখন সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। তাই গাড়ি ফাঁকা। ফেয়ারলিতে যাওয়া মাত্রই গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেসের থ্রি-টায়ারে ছ’টি বার্থ পেয়ে গেল ওরা।

বাচ্চু-বিচ্ছুর বাবাও ট্রাঙ্ককল করে সমুমামাকে জানিয়ে দিলেন, ওদের সকলের যাবার কথা। পাণ্ডব গোয়েন্দাদের আনন্দ আর ধরে না। শুধু ডেভিড লোদির আতঙ্কটা না থাকলে ওদের এবারের ভ্রমণ অত্যন্ত সুখের। কেন না, ওরা এই প্রথম এত দূরে যাচ্ছে। আরব সমুদ্রের ধারে বোম্বাই উপকূলে পৌছবার স্বপ্নে বিভোর সকলে। হবে নাই বা কেন? শুধু মাত্র থাকার জায়গার অভাবটি ছাড়া কী নেই বোম্বাইতে? পাহাড়, সমুদ্র, শহর, বন্দর, মন্দির, মসজিদ—সব আছে। তিন লক্ষ সাত হাজার সাতশো বাষট্টি স্কোয়ার কি.মি. এর আয়তন। চাট্টিখানি কথা নয়। বোম্বাই শহরের আশপাশে আছে ঘন জঙ্গল, পাহাড়, নদী, ঝরনা, গুহা এবং প্রকৃতির নয়নাভিরাম দৃশ্য। অতীতের বিদর্ভ আজকের মহারাষ্ট্র। বোম্বাই সেই মহারাষ্ট্রের রাজধানী। এখানকার অধিবাসীরা মারাঠি। যদিও নানা ভাষার, নানা দেশের নানা জাতির লোক আছে এখানে, তবুও এটা মারাঠা দেশ। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যাদব-রাজারা এখানে রাজত্ব করেন। তারপর বাহমনি বংশের সুলতানরা ২০০ বছর শাসন করার পর মারাঠা বীর শিবাজি সঙ্ঘবদ্ধ করেন মারাঠিদের। সেই মারাঠা দেশ বোম্বাইয়ের আকর্ষণ ওদের যেন চুম্বকের মতো টানতে লাগল।

নির্দিষ্ট দিনে ওরা সবাই হাওড়া স্টেশনে এসে হাজির হল। চার্টে নাম দেখে খুব খুশি হল ওরা। রেলে রিজার্ভেশনের ব্যাপার-স্যাপারগুলো এক সময় যত খারাপ ছিল এখন তত ভাল হয়েছে। অবশ্য এই ভাল ব্যাপারটা ঘটেছে শুধুমাত্র কমপিউটারাইজড হওয়ার জন্য। এখন টিকিটেই কোচ নম্বর, বার্থ নম্বর দেওয়া থাকে। কাজেই চার্ট মেলাবার জন্য কোনও হুটোপুটির ব্যাপার নেই। ওদের বগি নম্বর এস ফাইভ। ওরা সেখানেই গিয়ে দাড়াল। প্রথমেই নাম রয়েছে পঞ্চুর। মি. পঞ্চু (ডগ), বয়স দশ। তারপর ওদের। গাড়িতে ভিড় তেমন নেই। তাই ওরা নিজেরাই বার্থ নম্বর দেখে অনায়াসে উঠে পড়ল। কিন্তু এ কী! ওদের মুখোমুখি তিন থাকের ছ’টি বার্থ। আপার বার্থটা পঞ্চুর। তা সেখানেই বিছানা পেতে শুয়ে আছেন দিব্যি দশাসই চেহারার এক সাধুবাবা। পরনে লাল চেলি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। ব্যাপার কী!

বিলু বলল, অত চালাকি নয়। নামিয়ে দে।

বাবলু ওদের মালপত্তর সব গুছিয়ে রেখে ডাকল, এ বাবা, এ তোতাবাবা, আপনার বার্থ কোথায়?

ভোম্বল বলল, তোতাবাবা নয়। বল, আলতাবাবা। পুরো দু নম্বরি মাল।

সাধুজি এবার ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, ক্যা হুয়া?

ভোম্বল বলল, ক্যা নেহি হুয়া সেইটেই বলো না বাবা। এটা আমাদের রিজার্ভ করা বার্থ। এখানে ওইরকম আয়েশ করে শুয়ে থাকলে চলবে না।

আরে বাবা, হাম ভি তো টিকিট কাটকে উঠা গাড়িমে। টি টি বাবুকো পুছো না। উনহোনে হামকো এ বার্থ দে দিয়া। ম্যায় ডব্লু টিকা আদমি নেহি হু।

বাবলু বলল, টি টি বাবু অন্যের বার্থ কী করে দেন আপনাকে?

বিলু গিয়ে কোচ অ্যাটেনড্যান্টকে ডেকে আনল। সি এ বললেন, হ্যাঁ আমিই ওঁকে ওই বার্থ নিতে বলেছি। তার কারণ তোমাদের একটা টিকিট খুবই রহস্যময়। মি. পঞ্চু (ডগ), বয়স দশ। ব্যাপারটা ঠিক বুঝলুম না। দশ বছর বয়স হলে হাফ টিকিট হয়। কিন্তু এ তো দেখছি ফুল টিকিট।

বাবলু বলল, এই দেখুন মি. পঞ্চুকে। এদের এক মাস বয়স হলেও ফুল টিকিট লাগে। হাফ টিকিট নয়।

কিন্তু এই গাড়িতে কুকুর নিয়ে তোমরা যাবে কী করে?

নিজেদের দায়িত্বে। এ আমাদের পোষা এবং অত্যন্ত বাধ্য কুকুর। কাউকে কামড়াবে না। বিরক্ত করবে না। ওপরের বাঙ্কে চুপচাপ শুয়ে থাকবে। বাথরুম যাবার দরকার হলে ডাকবে, লেজ নাড়বে।

তা হলে তো খুবই ভাল। তা এইরকম যদি চলতে থাকে তো এরপর দেখছি কেউ তার বাড়ির পোষা গোরুটাকে পর্যন্ত থ্রি-টায়ারে চাপিয়ে নিয়ে যাবার আবদার ধরবে।

ভোম্বল বলল, গোরু আর কুকুর এক হল? গোরু, মোষ নিয়ে যাবার নিয়ম আলাদা। কুকুর, বেড়াল, বাঁদর এবং খাঁচার পাখিকে নিজেদের দায়িত্বে নিয়ে যাওয়া যায়।

অ্যাটেনড্যান্ট তখন সাধুজিকে বললেন, তব ক্যা হোগা বাবা। আউর তো বাৰ্থ হ্যায়ই নেহি মেরে পাস। আপ দুসরা ডিব্বামে যাইয়ে।

সাধুজি বললেন, এ মুন্নে! তুম এক কাম করো। এ বার্থ মুঝে দে দো। নেহি তো হামকো বহুত তকলিফ হে যায়ে গা।

ভোম্বল বলল, তা হলে আমাদের পঞ্চু যাবে কী করে?

উসকো নীচে রাখো না বাবা। হাম তুমহারা রিজার্ভেশন চার্জ দে দুঙ্গা।

বাবলু বলল, ঠিক আছে। রিজার্ভেশনের টাকা দিতে হবে না আপনাকে। আপনি ওখানেই শুয়ে যান। আমরা আমাদের পঞ্চুকে নীচেই রাখছি।

একটা ঝামেলা অন্তত মিটল। ওরা মুখোমুখি বার্থে গুছিয়ে বসল সকলে। পঞ্চুকে একেবারে জানলার ধারে বসিয়ে বাবলু বসল তার পাশে।

যথাসময়ে ট্রেন ছাড়ল। দুপুরের গাড়ি। তাই সন্ধে পর্যন্ত বেশ দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে। প্রথমে টিমেতালে। তারপর টিকিয়াপাড়া, দাশনগর ও সাঁতরাগাছি পেরোবার পর এত জোর ছুটতে লাগল গাড়িটা যে, বলবার নয়। একেবারে ঝড়ের বেগ যাকে বলে, ঠিক তাই। ওরা চুটিয়ে গল্প করতে লাগল। নতুন দেশ দেখার আনন্দে ভরপুর ওরা। তার ওপর যা-তা দেশ নয়। বোম্বাই বলে কথা।

একটু পরেই কোচ অ্যাটেনড্যান্ট এসে ওদের টিকিটগুলো পরীক্ষা করতে লাগলেন। সব দেখে বললেন, এইভাবে যাত্রী গাড়িতে কুকুর নিয়ে যাওয়া ঠিক নয়। কুকুর নিয়ে গেলে ব্রেক ভ্যানে চাপাতে হয়।

বাবলু বলল, সে আমরা জানি। তবে অনেক দূরের পথ তো! ওর খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধে হবে তাই।

বুঝলাম। কিন্তু এটা বেআইনি।

এবার ওপাশের সাইড লোয়ারে বসে থাকা এক বাঙালি ভদ্রলোক বললেন, খুব তো বাচ্চা ছেলে পেয়ে আইন দেখাচ্ছেন মশাই। এই যে গাড়ির ভেতরে এত ভিখারি নাগারি ফালতু ঝাড়ুদার ঢুকে বসে আছে, এরা কোন আইনে বিনা টিকিটে আপনাদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে শুনি? এরা তো তাল পেলেই যার যা কিছু পাবে নিয়ে কেটে পড়বে, কিন্তু এই কুকুরটা তো তা করবে না।

অ্যাটেনড্যান্ট রেগে বললেন, আমি আপনার সঙ্গে কথা বলছি না মশাই। আপনি চুপ করে থাকবেন।

আপনাদের সুবিধের জন্যই এই সব প্রোটেকশন নেওয়া হচ্ছে। আপনারা যদি মেনে নেন তা হলে আমাদের কিছু বলার নেই।

এটা আমরা মেনে নিচ্ছি। নিচ্ছি কেন, নিয়েছি। কিন্তু এই বেওয়ারিশ ভিখিরি বাচ্চাগুলোকে মেনে নিতে পারছি না। আপনার সাধ্যি আছে এদের নামিয়ে দেবার? গোটা কামরাময় ছুটোছুটি করছে।

এই সময় এক অবাঙালি ভদ্রলোক একটা সিগারেট ধরাতেই অ্যাটেনড্যান্ট ছুটে গেলেন, এ মিস্টার, উপর দেখিয়ে ক্যা লিখা হ্যায়।

ভদ্রলোক দেখলেন। দেখে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, হ্যা, দেখা। ক্যা লিখা?

স্মোকিং ইজ ষ্টিকটলি প্রহিবিটেড।

তব? কাহে কো পিতা, সিগারেট ফিক দিজিয়ে। এমন সময় জ্বলন্ত কয়লার উনুনে চায়ের কেটলি বসিয়ে একজন চা-ওলা এসে হাজির, চা, এই চা, চা গরম৷

ভদ্রলোক বললেন, ইধার দেখিয়ে সাব। হামারা সিগারেট ক্যা ইসসে ডেঞ্জারাস?

বাঙালি ভদ্রলোক হেসে বললেন, সেই কথাটা বোঝায় কে? জ্বলন্ত উনুন নিয়ে গাড়িতে উঠলে দোষ নেই। অথচ সিগারেট-বিড়ি খেলে নাকি ট্রেনে আগুন ধরে যাবে!

তা হলে কি বলতে চান ট্রেনে ধূমপান চলতেই থাকবে?

মোটেই না। ট্রেনে ধুমপানও যেমন বন্ধ হওয়া দরকার, তেমনই জ্বলন্ত উনুন নিয়েও গাড়িতে উঠতে না দেওয়া উচিত।

অ্যাটেনড্যান্ট ভদ্রলোক রেগে টং হয়ে বললেন, যত্ত সব যাচ্ছেতাই প্যাসেঞ্জার আজ গাড়িতে ঢুকে বসে আছে। বলেই সেই সাধুজিকে বললেন, আপকা টিকিট দেখাইয়ে। ঔর রিজার্ভেশন চার্জ দে দিজিয়ে।

সাধুজি বললেন, মেরা টিকট কাহা বা।

কাহা বা মানে? আপনি গীতাঞ্জলিতে চেপে হাওড়া থেকে বোম্বাই যাবেন অন্যের বার্থে শুয়ে, তায় আবার বিনা টিকিটে? নামুন। এক্ষুনি নামুন। উতরিয়ে। সাহস বলিহারি।

সাধুজির বয়ে গেছে নামতে। তবে নামলেন না যেমন, তেমনই তার ঝোলার ভেতর থেকে একটা মানিব্যাগ বার করে দুটো একশো টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে বললেন, টিকিট বনা দিজিয়ে সাহাব। উইথ পেনালটি।

বাঙালি ভদ্রলোক নিজের সিটে বসেই সেই অবাঙালি ভদ্রলোককে বললেন, দেখেছেন কারবার। হাতে রিস্টওয়াচ। মানিব্যাগ-ভর্তি টাকা। তার ওপরে বিনা টিকিটের যাত্রী। এরা নাকি সাধু।

সাধুজি আড়চোখে একবার দেখলেন সবাইকে। তারপর টিকিট হয়ে গেলে ঝোলার ভেতর থেকে একটা ট্রানজিস্টার বার করে হিন্দি গানের অনুষ্ঠান শুনতে লাগলেন।

সাধুর কীর্তি দেখে মুখ টিপে-টিপে হাসতে লাগল সকলে।

ভোম্বলটা তো এমনিতেই একটু দুষ্টু, তাই তালে তাল দিয়ে বলল, ঠিক আছে দাদা, চলিয়ে যান।

বাচ্চু বলল, দাদা কাকে বলছ? সাধুবাবা তো?

ট্রেন এসে খড়গপুরে থামল। এখানে চা খাবার পালা। কিছু লোকও উঠল গাড়িতে। তারপর আবার চলতে লাগল ট্রেন। এবার টাটানগর। তারপর আরও লম্বা সফর। সারাদিন সারারাত ধরে শুধু হু হু করে ছোটা।

রাত নটা নাগাদ ট্রেন রাউরকেলায় পৌছল। এখানেই খাওয়া-দাওয়া সেরে সবাই শোবার ব্যবস্থা করতে লাগল। ঝকঝকে তকতকে বগি। গদি-মোড়া সিট। বেশ আরামেই শোওয়া যাবে।

পাণ্ডব গোয়েন্দাদের খাবারের তালিকাটা বরাবরই প্রায় একই রকম। তবে এবার একটু ব্যতিক্রম হয়েছে। লুচির বদলে এবার হয়েছে বিরিয়ানি। সেইসঙ্গে মুরগির মাংস আর বড়-বড় তালশাস সন্দেশ।

সাধুজি ওপরে বসে মেওয়া খাচ্ছিলেন আর লোলুপ দৃষ্টিতে ওদের খাবারের দিকে তাকাচ্ছিলেন। তাই দেখে বাবলু বলল, চলে গা নাকি বাবা?

নেহি বাবা। নেহি চলে গা। তুম সব খাও।

বিলু বলল, কেন? চলবে না কেন? এগুলো অখাদ্য নাকি?

মোরগা হামে নেহি খাতা।

ওদিক থেকে সেই বাঙালি ভদ্রলোক বললেন, আরে, ওসব ঘরের ব্যাপার। গাড়িতে দোষ আছে নাকি? ছোট ছেলে সব, বলছে যখন এত করে তখন খান না?

সাধুজি এবার একটু ভেবেচিন্তে যেন নিতান্তই অনিচ্ছুক এমন ভাব দেখিয়ে বললেন, তবে দে দো থোড়া কমতি করকে।

বাবলু বলল, হ্যাঁ। কমতি করেই দেব। বেশি পাব কোথায় বাবা? যা আছে তাই একটু ভাগ করে খাওয়া যাক৷

পঞ্চু এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। এবার সিট থেকে নেমে মেঝেয় বসে লেজ নাড়তে লাগল। বাবলু ওকে ওর ভাগটা দিয়ে দিতেই চেটেপুটে সাফ।

বাবলুরাও খাওয়া শুরু করল। সে কী দারুণ ভোজ। রাউরকেলা ছেড়ে ট্রেন ছুটে চলল ঝাড়সুগড়ার পথে। বাবলুরা বাৰ্থ তুলে নিয়ে শুয়ে পড়ল যে-যার। দ্রুতগামী ট্রেনে থ্রি-টায়ারে শুয়ে রাত-জার্নির চেয়ে স্বপ্নময় ভ্রমণ আর কি কিছু আছে? তাই ট্রেনের দোলায় দুলতে-দুলতে সবার চোখেই ঘুম এসে গেল।

রাত তখন কত তা কে জানে? হঠাৎ একটা বিকট চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল সকলের। কোনও গাধার গায়ে যদি ঘা থাকে আর সেই ঘায়ের ওপর কেউ যদি গরম জল ঢেলে দেয়, তা হলে সে যেভাবে চেঁচায়, ঠিক সেই ভাবে কে যেন চেঁচাতে লাগল।

বাবলুরা যে-যার নেমে পড়ল বার্থ থেকে। আশপাশের লোকেরা হইহই করে ছুটে এল সকালে। এসে দেখে, সে এক অদ্ভুত কাণ্ড!

সাধুজি কখন চুপিচুপি বার্থ থেকে নেমে এসে বার্থের নীচে রাখা বাবলুদের ব্যাগ টানতে গিয়েই কাল করেছেন। পঞ্চু ছিল নীচে শুয়ে। সে ঘ্যাক করে এমন জোরে কামড়ে ধরেছে সেই হাতখানা যে, সাধুজি প্রাণপণ চেষ্টা করেও সে হাত ছাড়াতে পারছেন না। মাঝখান থেকে একটা অমানুষিক চিৎকার করছেন, বাঁচাও, বাচাও। কুত্তা কাট দিয়া মুঝে। বাঁচাও।

বাবলু বলল, পঞ্চু ছেড়ে দে। বাবলু বলতেই ছেড়ে দিল পঞ্চু। সাধুজি এবার রাগে ধেইধেই করে নাচতে লাগলেন, আভি আভি আভি তুম সব ট্রেন সে নিকালো। চেন পুলিং করেঙ্গে হাম। সবকো উতার দুঙ্গা।

অন্যান্য সহযাত্রীরা বলল, ব্যাপারটা কী! কুকুর কামড়াল কেন?

বাবলু বলল, কেন আবার? এই দেখুন কাণ্ডখানা। বার্থের তলা থেকে আমাদের ব্যাগ টানতে গিয়েছিলেন, তাতেই এই অবস্থা।

সাধুজি বললেন, নেহি। হাম চপ্পল চুড় রহ থা।

সেই বাঙালি ভদ্রলোক বললেন, চপ্পল তো তুমি শোবার সময় মাথার কাছেই নিয়ে শুয়েছিলে বাবা। তা বার্থের নীচের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কী? বিনা টিকিটে গাড়িতে উঠে যাদের দয়ায় বার্থ পেলে, যাদের খেলে, রাতদুপুরে তাদেরই জিনিস চুরি করতে লজ্জা করল না? এখন আবার চোখ রাঙিয়ে বলছ, তাদের তুমি গাড়ি থেকে নামিয়ে দেবে?

জরুর দেঙ্গে।

ট্রেনে আরও যে-সব যাত্রী ছিল তারা সবাই সাধুর বিপক্ষে গেল। এবং আগেকার কোচ অ্যাটেনড্যান্টকে দোষারোপ করতে লাগল এই ধরনের লোককে ট্রেনে ঢুকতে দিয়েছিলেন বলে।

বাবলু বলল, সে ভদ্রলোককে দোষারোপ করে তো কোনও লাভ নেই। আসলে সাধু-সন্ন্যাসী দেখলে সবাই একটু সমীহ করে থাকেন। তিনিও তাই সরল বিশ্বাসে ওঁকে গাড়িতে উঠতে অনুমতি দিয়েছেন এবং আমরাও আমাদের বার্থ ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু তারপরে যে মাঝরাতে এই কাণ্ড হবে তা কে জানত?

যাত্রীরা বলল, সত্যিই তো। ভাগ্যিস কুকুরটা ছিল। নইলে গাড়িসুদ্ধ লোকের কার কী মাল যে হাপিস করত ও তা কে জানে?

বাঙালি ভদ্রলোক রেগে বললেন, ওর সাধুগিরি আমি দেখাচ্ছি, দাড়াও। দেখি দাদা, কেউ একটা দেশলাই ক্লিন তো আমাকে। ওর জটায় আমি আগুন ধরিয়ে দেব।

আর একজন বললেন, দুর মশাই। ওর জটায় আগুন ধরাতে গিয়ে শেষকালে ট্রেনসুদ্ধ লোককে পুড়িয়ে মারবেন নাকি? গাড়িতে আগুন লেগে যাবে যে! তার চেয়ে প্রহারেণ ধনঞ্জয় কাকে বলে দেখুন! বলেই এক রদা কষিয়ে দিলেন সাধুর ঘাড়ে।

একজন ভদ্রলোক যা-তা বলে যেই না সাধুর জটা ধরে টান দিয়েছেন অমনি সে কী কেলেংকারি। জটা গেল উপড়ে আর বিরাট একটা টাক বেরিয়ে পড়ল।

চারদিকে তখন ধর-ধর মার-মার রব। সবাই বলল, এ ব্যাটা তো সাধু নয়। এ তো চোর। মার ব্যাটাকে।

কেউ ডাকল, পুলিশ। পুলিশ।

কেউ বলল, পাকড়ো বদমাশ কো।

নকল সাধু তখন ভয়ানক রেগে ঝোলাটা কাঁধে নিয়েই তার ভেতরে হাতড়াতে লাগলেন। বাবলু হেসে বলল, আপনি যা খুঁজছেন তা ওখানে নেই দাদা। সে মাল এখন আমার হাতে। অনেক আগেই ঝোলা হাতড়ে সরিয়ে রেখেছি আমি।

নকল সাধু তখন রাগে ফুঁসতে লাগলেন। আর বাবলু একটা রিভলভার হাতে নিয়ে দোলাতে লাগল। নকল সাধু বললেন, ও মুঝে দে দে।

বাবলু বলল, উহু। এটা এখন রেল-পুলিশের প্রাপ্য।

বাবলুর হাতে রিভলভার দেখে সবাই শিউরে উঠেছে। ততক্ষণে আর পি এফ এসে গেছে কয়েকজন। কিন্তু এলে কী হবে? সবাই মিলে তখন আড়ং ধোলাই দিতে শুরু করেছে নকলবাবাকে। একে তো চুরি করতে আসার জন্যে রেগে ছিল সকলেই। তার ওপর রিভলভার দেখেই মাথায় খুন চড়ে গেল সকলের। কাজেই মেরে একেবারে আধমরা করে দিল।

বাবলু হাসতে হাসতে বলল লোকটিকে, আপনার মতো মাথামোটা লোককে কেন যে আমাদের পিছনে গোয়েন্দাগিরি করতে পাঠিয়ে দিয়েছে আপনার বস, তা ভেবে পাচ্ছি না।

লোকটি ক্রুদ্ধ চোখে তাকাল বাবলুর দিকে। বাবলু বলল, ওভাবে তাকিয়ে কোনও লাভ হবে না ব্রাদার। যে-মাল খোঁজার জন্য তুমি ব্যাগ টানছিলে, সে-মাল আমি অন্য জায়গায় সরিয়ে রেখেছি। পুলিশও হতাশ হয়ে ফিরে গেছে। তুমি কোন ছার।

লোকটি ভীষণ রেগে বলল, ক্যা বোলতা?

আরে বন্ধু, ওই জিনিস নিয়ে কেউ রাস্তায় বেরোয়? অন্যান্য যাত্রী এইসব কথোপকথনের কোনও অর্থই বুঝতে না পেরে বলল, কী ব্যাপার ভাই? কী জিনিস?

বাবলু বলল, ব্যাপার কিছুই নয়। আমাদের বাড়ির কাছে বোম্বাইয়ের এক ভদ্রলোক খুন হন। মৃত্যুর আগে তিনি কয়েকটি মূল্যবান জিনিস আমাদের হাতে দিয়ে যান তার পরিবারবর্গের হাতে তুলে দেবার জন্য। তা সেটা আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবার জন্য একটি বিশেষ দল অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আমার বাড়ির সামনে বোমা ফাটিয়েছে। আমাদের প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু সুবিধে করে উঠতে পারেনি। যতবার আমাদের ঠেকাতে গেছে ততবারই মার খেয়েছে। এখন বোম্বাই বেড়াতে যাচ্ছি খবর পেয়েই অমনি এসে পিছু নিয়েছে আমাদের। দেখছেন না কেমন সাধু সেজে চুপটি করে বসে ছিল। আমি বুঝতে পেরেই ও যখন বাথরুমে যায় তখন ওর ঝোলা হাতড়ে রিভলভারটা বার করে নিয়েছি।

গাড়ি তখন বিলাসপুরে থেমেছে। ছদ্মবেশী শয়তানটার হাতে হাতকড়ি দিয়ে আর পি এফরা টেনে নামাল তাকে গাড়ি থেকে। এরপর গার্ড চেকার সবাই এসে নানারকম ফিরিস্তি লিখে অন্যান্য প্যাসেঞ্জারদের সই-সবুদ করিয়ে সেই কাগজটা রেল-পুলিশকে দিল।

প্রায় ঘণ্টাখানেক বিলম্বের পর ছাড়ল ট্রেন। ওরা আর বৃথা বাক্যব্যয় না করে যে-যার বার্থে আরামে শুয়ে পড়ল। রাতের অন্ধকার বিদীর্ণ করে ছুটে চলল গীতাঞ্জলি এক্সেপ্রেস।

পরদিন দুপুর দুটো-আড়াইটে নাগাদ ট্রেন ভুসাওয়াল জংশনে থামল। ইতিমধ্যে গাড়িতেই ওরা দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়েছে।

বাবলু বলল, আমাদের মালপত্তরগুলো সব গুছিয়ে হাতের কাছে রাখ।

বিলু বলল, এখন কী? বম্বে পৌঁছব তো রাত দশটায়।

যা বলি তাই কর। আমি প্লাটফর্মে নেমে পায়চারি করছি। যেই তোদের ইশারা করব আমনি তোরা নেমে পড়বি। গাড়ি ছাড়ার ঠিক আগের মুহুর্তে।

ভোম্বল ভয়ে ভয়ে বলল, কেন রে?

পরে বলব! বাবলু ওদের তৈরি হতে বলে প্লাটফর্মে নেমে পায়চারি করতে লাগল। তারপর গ্রিন সিগন্যাল দেখেই ইশারা করল ওদের। ট্রেন নড়ে ওঠার আগে ওরা সবাই নেমে পড়ল।

গাড়ি চলে গেলে সবাই নির্বাক হয়ে দাড়িয়ে রইল প্লাটফর্মে। বাবলু বলল, কী রে, মন খারাপ হয়ে গেল নাকি?

বাচ্চু বলল, তুমি এ-গাড়ি ছেড়ে দিলে কেন বাবলুদা?

বাবলু হেসে বলল, কী হবে এই গাড়িতে গিয়ে রাতদুপুরে পৌঁছে?

সে কী! তা হলে এ-গাড়িতে এলে কেন? বাপি তো বলেছিলেন বম্বে মেলে আসতে। তা ছাড়া সমুমামাকে তার করা আছে। সে বেচারি হয়তো রাতদুপুরে স্টেশনে এসে ফিরে যাবে।

বাবলু বলল, তার আগেই ফোন করে আমরা তাকে আসতে বারণ করে দেব।

ভোম্বল বলল, তা না হয় দিবি। কিন্তু এখানে নামার কারণটা কী?

বাবলু বলল, কারণটা এখনও বুঝতে পারছিস না? আমরা এক ভয়ংকর চক্রান্তের জালে জড়িয়ে পড়েছি। আমাদের পিছনে রীতিমতো লোক লেগে গেছে। এই নকল সাধুর কথাই ভেবে দ্যাখ। তোরা কি কেউ ভাবতে পেরেছিলি লোকটা রাতদুপুরে ওইরকম একটা কাণ্ড করে বসবে বলে? আমি কিন্তু হাওড়া স্টেশনে ট্রেনে উঠেই যে মুহুর্তে ওই মহাপুরুষকে আমাদের বার্থে ন্যাকা-বোকার মতো শুয়ে থাকতে দেখেছি, তখন থেকেই সন্দেহ করেছি। তাই ও মাংস খেয়ে মুখ-হাত ধোবার জন্য বাথরুমে গেলে ওর ঝোলা হাতড়ে ওই মাল বার করে নিয়েছি আমি। আমরা তো অন্য সময় ব্যাগ-স্যাগগুলো আমাদের মাথার কাছে রাখি। এবারে ইচ্ছে করেই ওকে দেখিয়ে ওগুলো সিটের তলায় রেখেছি এবং পঞ্চুকেও শুইয়ে রেখেছি ব্যাগের পাশে। জানি, রাতদুপুরে ওগুলো টানাটানি করার মতো ভুল ও করবেই। করেওছে। এখন তা হলে চিন্তা কর, বম্বের মতো অজানা শহরে রাতদুপুরে আমরা নামলে কী অবস্থাটা করবে ওরা আমাদের। আমাদের কেটে ফেললেও ওই হিরে তো ওরা বার করতে পারবে না। মাঝখান থেকে একটা খারাপ ব্যাপার হয়ে যাবে। সেইসঙ্গে হিরের আসল মালিকও বঞ্চিত হবেন তার প্রাপ্য থেকে।

বিলু বলল, এখন তা হলে কী করব আমরা?

দ্যাখ না কী করি। আমি তোদের এমন এক জায়গায় নিয়ে যাব, যেখানে গেলে আর তোদের অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছেই করবে না।

ভোম্বল বলল, সত্যি!

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, কোথায় গো বাবলুদা?

আয় আমার সঙ্গে। ততক্ষণে একজন প্লাটফর্ম-চেকার এসে দাড়িয়েছেন ওদের সামনে, টিকিট দেখাইয়ে।

বাবলু টিকিট দেখিয়ে বলল, একটু ব্রেক জার্নি লিখে দিন তো, প্লিজ। টি টি বাবু খসখস করে ব্রেক জার্নি লিখে দিলেন।

বাবলু বলল, এখন জলগাঁও যাবার ট্রেন পাওয়া যাবে?

হা, হা। এক ঘণ্টে কা বাদ মিলেগা। লেকিন তুম এক কাম করো, ওভারব্রিজ পার হো কর বাস টার্মিনাস মে চলা যাও। হুয়া জলগাঁও যানেকা বহোত বাস মিলেগা। টাইম ভি কমতি লাগেগা।

বাবলুরা টিকিটের পিছনে ব্রেক জার্নি লিখিয়ে নিয়ে ওভারব্রিজ পার হয়ে স্টেশনের বাইরে এল। বাইরে বিরাট বাসস্ট্যান্ড। বিভিন্ন জায়গার অনেক বাস দাড়িয়ে আছে সেখানে। একটি বাসের কন্ডাক্টর তখন চেঁচাচ্ছে, জলগাও, জলগাঁও । জলগাও যানে বালে কোঈ হ্যায়?

বাবলুরা হইহই করে ছুটে গেল। একেবারে ফাঁকা বাস। কিন্তু বিপত্তি হল পঞ্চুকে নিয়ে। কন্ডাক্টর কিছুতেই গাড়িতে উঠতে দেবে না পঞ্চুকে। বাবলুরা যতই অনুনয় বিনয় করে, সে ততই বলে, ইয়ে কভি নেহি হে সকতা। হিয়াকা অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন বহোত স্ট্রং রিপোর্ট হো যায়েগা তো নোকরি চলা যায়গা হামারা।

এমন সময় একজন এ-দেশীয় লোক খানকয়েক মুরগি নিয়ে উঠে পড়ল বাসের ভেতর।

বাবলু বলল, এবার কী হল? তোমাদের অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন এবার কোথায় রইল বাবা?

কন্ডাক্টর ছুটে গেল এবার লোকটির দিকে, এ! উতরো। আভি উতরো। মোরগ নেহি যায়েগা।

লোকটি ড্রাইভারকে বলল, আরে এ শ্যামলাল ভাই, তুমহারা পার্টনার গুল্লুকো জেরা সমঝাও তো। উসকো নোকরি তো খতম হোগা-ই নেহি, আউর সাসপেন্ড ভি নেহি হোগা। এ গুলু যো দিন কামপর আয়েগা বহি দিন ঝামেলা লাগায় গা।

ড্রাইভার গুল্লুকে বলল, আরে আদমি তো জায়দা নেহি। লে লো সবকো।

কন্ডাক্টর বলল, ঠিক হ্যায়, উঠো। লেকিন জলগাওসে থোড়া আগাড়ি উতার যান।

বাবলু বলল, সে ঠিক আছে। স্ট্যান্ডে ঢোকবার আগে একটু থামিয়ে দেবে, আমরা নেমে পড়ব। না হলে এই কুকুরটাকে কলকাতা থেকে এত দূরে টেনে এনে এখানে তো ছেড়ে দিয়ে যেতে পারি না।

বাস ছাড়ল। মহারাষ্ট্র গভর্নমেন্টের স্টেট বাস ভীষণ গর্জনে প্রশস্ত রাজপথের ওপর দিয়ে ছুটে চলল উল্কার বেগে। বাবলুরা ছাড়া বাসে যাত্রী ছিল মাত্র পাঁচজন। ওদের নিয়ে দশ।

কন্ডাক্টর এসে টিকিট করল সকলের। বাবলু টাকা দিলেও পঞ্চুর ভাড়া নিল না। বলল, উসকো নেহি লগেগা।

প্রায় ঘণ্টাখানেক যাবার পর একটি সুসজ্জিত সুন্দর শহরে ঢুকে পড়ল ওরা। এক সময় বাসের গতিও মন্থর হয়ে গেল। বিভিন্ন দোকানের সাইনবোর্ড দেখে ওরা বুঝল জলগাও এসে গেছে। এক জায়গায় বাস থামল।

কন্ডাক্টর বলল, তুম সব হিয়া উতার যাও। জলগাঁও আ গিয়া। জলদি করো।

বাবলুরা পঞ্চুসহ হুড়মুড় করে নেমে পড়ল। ওদের বাস থেকে নামতে দেখে একটি অটো রিকশা এসে থামল ওদের পাশে, ক্যা ভাইসাব ! কাহা যানা হ্যায়?

বাবলু বলল, ভাই, এখানে থাকার কী ব্যবস্থা আছে? কোনও হোটেল বা লজ?

ক্যা? ম্যায় নেহি সমঝা।

লজ মে লে চলো। আভি সমঝা বলে ওদের অটোয় তুলে প্রশস্ত রাজপথে ধরে এগিয়ে চলল। পথে যেতে যেতে একটি পার্কে মহারাষ্ট্র-নায়ক শিবাজির এক বিশাল মূর্তি ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ওরা এ-পথ সে-পথ ঘুরে একেবারে রেলস্টেশনের সামনে চলে এল।

বাবলু বলল, আরে, আমাদের স্টেশনে কে আনতে বলল? আমরা তো বললুম একটা লজে নিয়ে চলো আমাদের।

একজন বয়স্ক লোক এবার এগিয়ে এলেন ওদের দিকে। তারপর হাসিমুখে বললেন, হিয়া পর হোটেল, লজ সব কুছ মিলেগী ও দেখো পথিকাশ্রম। উধার চলা যাও। রুম মিল যায়েগা তুমকো।

বাবলু অটোর ভাড়া পাঁচ টাকা দিয়ে সবাইকে নিয়ে পথিকাশ্রমে গিয়ে উঠল। এখন সিজন টাইম নয়। তাই যাওয়ামাত্রই ঘর পেয়ে গেল। সব ঘরই ফাকা। এখানে ডরমিটরি সিসটেমে থাকার ব্যবস্থা আছে। তাই সেখানেই যা কয়েকজনকে শুয়ে-বসে থাকতে দেখা গেল।

বাবলুরা একদিনের জন্য ঘর বুক করে ঘরে মালপত্তর রেখে আগে স্নানপর্বটা চুকিয়ে নিল। তারপর সবাই মিলে চলল দলবেঁধে জলগাঁও শহরটিকে ঘুরে দেখতে। কী চমৎকার ছবির মতো শহর। সামনেই গণেশ-চতুর্থী। মহারাষ্ট্রের জাতীয় উৎসব। তাই দোকানে-দোকানে ছোট-বড় নানা আকারের অপূর্ব শিল্পকলামণ্ডিত গণেশ-মূর্তি বিক্রি হচ্ছে দেখল। ওরা পায়ে হেঁটেই জলগাঁও শহরটাকে চষে ফেলল প্রায়। এর পর বাসস্ট্যান্ডে এসে বাবলু এনকোয়ারিতে গিয়ে ওর যা জানবার তা জেনে নিল। শুধু তাই নয়, একটা দোকানে ঢুকে জলগাঁওয়ের বিখ্যাত প্যাড়া খেতে বসল সকলে। এক কাপ করে চা-ও খেয়ে নিল। তারপর সন্ধে পর্যন্ত ঘুরে আবার ফিরে এল পথিকাশ্রমে।

আমার ব্যাপার-স্যাপার দেখে?

বিলু বলল, তা তো হচ্ছিই।

বাবলু বলল, গীতাঞ্জলি কিন্তু এখনও ছুটছে। এক-ঘণ্টা লেট গাড়ি। রাত এগারোটার আগে পৌছবে না। অথচ আমরা কেমন টুক করে এখানে নেমে পড়ে দিব্যি রেস্ট নিচ্ছি। আর আমাদের শক্ররা চারদিকে ফাদ পেতে যখন দেখবে মাঝপথে পাখি ফুডুত, তখন রাগে মাথার চুল ছিড়বে। আমরা কোথায় গেলাম, কী করলাম, কিছুই ওরা টের পাবে না। শুধু হায় হায় করবে।

ভোম্বল বলল, এর পরে যখন যাব, তখন?

আমরা কবে যাব, কখন যাব, সে ওরা জানবে কী করে? আমাদের মূল উদ্দেশ্য কিন্তু ডেভিডের বদলা নেওয়া নয়, বা তাকে জব্দ করতে যাওয়া নয়। কেন না, ওর পিছনে অযথা লাগতে গিয়ে এই দূর দেশে নিজেদের বিপদ বাড়াব না। তা ছাড়া আমাদের স্টেটের বাইরে সে যা করছে তার বিহিত সে-দেশের সরকার করুক।

বিলু বলল, কিন্তু সে-দেশ যখন ভারতে, তখন আমাদেরও তো একটা ভূমিকা আছে।

নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু আমাদের কাজ হল অপরাধীকে খুঁজে বার করে সরকারের হাতে তুলে দেওয়া। কিন্তু যে শয়তান প্রকাশ্যে গভর্নমেন্টের চোখের সামনে একটার পর একটা অন্যায় করে যাচ্ছে, আমরা তার কী করতে পারি? কাজেই ওকে নিয়ে মাথাব্যথা সরকারই করুক। আমরা শুধু বরিভলিতে গিয়ে তদন্ত করে মি. যোশির ফ্যামিলির সঙ্গে দেখা করব। তারপর বুঝলে, ওদের জিনিস ওদের হাতেই ফিরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করব। না হলে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসব।

ভোম্বল বলল, কী করে দিবি? তুই তো ওগুলো আনিসইনি সঙ্গে।

নাই বা আনলাম। যাদের জিনিস তারা আমাদের বাড়ি থেকে গিয়ে নিয়ে আসবে। আমরা কেন ঝুঁকি নিতে যাব? ওইসব দামি জিনিস নিয়ে বেরোলে রাস্তাঘাটে কেউ যদি ছিনিয়ে নেয়, তখন?

বিলু বলল, না। তোর এ-যুক্তিটা মন্দ নয়। ওগুলো সঙ্গে না এনে ভালই করেছিস। কিন্তু এখন আমরা যাব কোথায়? এত জায়গা থাকতে এখানেই বা এলি কেন?

বাবলু বলল, কেন এলাম? কাল সকালেই তা বুঝতে পারবি। দেখবি, আমরা এক স্বপ্নের দেশে চলে যাব কাল সকালে। সে এমন এক জায়গা যেখানে গেলে তোদের আর অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছে করবে না। যেখানে গেলে তোরা আমাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরবি। বম্বের পথে একই টিকিটে একটা নতুন জায়গাও দেখা হবে, উপরন্তু একটু নিরাপদও হলাম।

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, বলো না বাবলুদা, কোথায় সে জায়গা! তুমি আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে?

কাল সকালে আমরা সবাই অজন্তা দেখতে যাব।

অজন্তা! নামটা শোনামাত্রই তুড়িলাফ খেয়ে উঠল সকলে, অজন্তা! ইলোরা! বলিস কী রে! সেটা এখানে?

হ্যাঁ, ইলোরা দেখতে গেলে মানমাদে আর অজন্তার জন্য জলগাঁওতে নামতে হয়। আমরা অবশ্য দুটোই দেখব। যাক, তোরা বোস। আমি ততক্ষণ অফিসঘরে গিয়ে বম্বেতে সমুমামাকে একটা ফোন করে স্টেশনে আসতে বারণ করে দিই।

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, আমরাও যাব তোমার সঙ্গে। মামার সঙ্গে আমরাও একটু ফোনে কথা বলব। বাবলু ম্যানেজারের ঘরে গিয়ে ওর নোটবুক বার করে ফোন নম্বরটা এগিয়ে দিতেই ম্যানেজার ডায়াল করে লাইন ধরিয়ে দিলেন। বাবলু ফোন ধরে ও-দিক থেকে উত্তর পেতেই বলল, হ্যাঁ, সমুমামা! আমি বাবলু বলছি। আপনি নিশ্চয়ই বাচ্চু-বিচ্ছুদের মুখে আমার নাম শুনেছেন?

তা তো শুনেছি। পাণ্ডব দি গ্রেট। তা তোমরা এখন কোথা থেকে ফোন করছ? কোন গাড়িতে এলে? গীতাঞ্জলির তো এখন ভি টি-তে আসার সময় নয়?

আপনি ঠিকই ধরেছেন। তবে আমরা জলগাঁওতে একটা হোটেলে এসে উঠেছি। কাল সকালে অজস্তা দেখে ইলোরা দেখতে যাব। দু-একটা দিন এদিকে কাটিয়ে তারপরে বম্বে যাব আমরা। আজ আর আপনাকে কষ্ট করে স্টেশনে আসতে হবে না।

খুব ভাল কথা। একবার বাচ্চুকে দাও তো।

বাচ্চু এবার বাবলুর হাত থেকে রিসিভারটা নিয়ে কথা বলল, তা হলে মামা, সব শুনলে তো? আমরা দু’ একটা দিন পরেই যাচ্ছি।

বেশ তো! তবে হ্যা, যেদিনই আসো না কেন, স্টেশনে নেমে নিজেরা আসতে যাবে না। ওখান থেকেই পাবলিক টেলিফোনে আমাকে রিং করবে। আমি গিয়ে নিয়ে আসব।

ও কে। ফোন নামিয়ে রাখল বাচ্চু।

তারপর অনেকক্ষণ ধরে গল্পগুজব করে নীচের পাঞ্জাবি হোটেলে খাওয়াদাওয়ার পর রাত দশটা নাগাদ শুয়ে পড়ল ওরা।

পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই স্নানপর্ব শেষ করে নিল ওরা। মাঝরাতে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়েছিল। তাই গুমোটের ভাবটা একদম নেই। শরতের এই সকাল এখন মেঘমুক্ত উজ্জ্বল নীল। কী অপরূপ। ওরা একেবারে তৈরি হয়ে মালপত্তর নিয়ে হোটেল ছেড়ে বাইরে এল। তারপর স্টেশনের কাছ থেকে একটা অটো নিয়ে চলে এল বাসস্ট্যান্ডে।

অজন্তার বাস তখনও আসেনি। তাই ওরা একটি দোকানে বসে চা-পাউরুটি খেয়ে নিল। এখানকার প্যাড়া অত্যন্ত লোভনীয়। সেই প্যাড়াও কিনে নিল কেজিখানেক। তারপর সামান্য একটু সময় পায়চারি করার পরেই এসে গেল ঔরঙ্গাবাদের বাস। এই বাসই অজন্তা যাবে।

এ-বাসেও ভিড় নেই। আসলে একেবারে পুজোর মুখ এবং মাসের শেষ বলেই বুঝি এইরকম। বাবলুরা যে-যার মনের মতো সিট পছন্দ করে বসে পড়ল। পঞ্চুও একফাকে সুট করে ঢুকে পড়ল সিটের তলায়।

খানিক বাদে কন্ডাক্টর এসে টিকিট কেটে ঘণ্টি দিতেই বাস ছুটে চলল অজন্তার পথে। বেশ খানিকটা সমতলে যাওয়ার পর বাস ঢুকে পড়ল পার্বত্য এলাকায়। সে কী অপূর্ব দৃশ্যাবলী। শো-শো শব্দে ছুটছে বাস। পাহাড়ের গায়ে বাক নিচ্ছে আর ওরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে অজস্তার সেই অপূর্ব স্থাপত্য ও শিল্পকলার সম্মুখীন হওয়ার।

সব প্রতীক্ষারই শেষ হয়। তাই অজস্তার কাছে ফর্দাপুর গ্রাম পেরিয়ে লোনিতে এসে পৌছল ওরা। এই ফর্দাপুরে ডাকবাংলো আছে অজন্তা-যাত্রীদের থাকবার জন্য। আর লোনি একটি ছোট্ট গ্রাম, অজন্তা লোনি। লোনি পেরিয়ে একটি পাহাড় টপকে অজন্তা গুহার সামনে থামল বাস।

বাবলুরা হইহই করে নেমে পড়ল বাস থেকে। তারপর যেই না সিটের তলা থেকে বেরিয়ে এসে পঞ্চু নামল অমনি সকলের সে কী হাসি। কন্ডাক্টর বলল, আরে, এ মহারাজ কাহা সে আ গিয়া?

পঞ্চু বলল, ভৌ-ভৌ। বাস ওদের নামিয়ে দিয়েই অন্য যাত্রীদের নিয়ে চলে গেল ঔরঙ্গাবাদের দিকে। যাই হোক, প্রকৃতির এই স্বৰ্গরাজ্যে এসে মুগ্ধ হয়ে গেল ওরা। হবে নাই বা কেন? এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে ভুবনবিদিত। বহুদিন ধরে দেশ-বিদেশের বহু মানুষকেই আকর্ষণ করে এসেছে। রমণীয় পরিবেশ এখানকার। তাই সকলেরই মন ভরে যায়। চারদিকে উচু-উচু পাহাড়। বাঘোরা নামের একটি নদী পাহাড় থেকে নেমে এসে এখানে অশ্বক্ষুরের আকারে বাক নিয়েছে। এই পাহাড়গুলোকে ইন্দ্রাদি পর্বতমালা বলা হয়। এর একদিকে দক্ষিণাত্যের মালভূমি, অপরদিকে তাপ্তী নদীর অববাহিকা। এরই মধ্যে অজস্তায় পাহাড়ের গা বেয়ে সাতটি জলপ্রপাত নেমে এসেছে। আগের দিন বৃষ্টি হয়ে গেছে। তাই প্রপাতে জলও খুব। এখানেই পাহাড়মালার এক অর্ধচন্দ্রাকৃতি বাকের মুখে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিস্টোত্তর সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে দীর্ঘ ন’শো বছর ধরে গড়ে-ওঠা অজস্তার সেই উনত্রিশটি গুহা। পাহাড় কেটে ধনুকের জ্যা-এর মতো তৈরি যে গুহাগুলো আজ বিশ্বের বিস্ময়।

বাবলু বলল, এখনও গেট খুলতে দেরি আছে। সকাল নট থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত লেখাই আছে টাইম। ততক্ষণ সময় কাটাবার জন্য চল আমরা বাঘোরা নদীতে নেমে রঙিন পাথর কুড়োই।

এমন সময় একজন চা-দোকানি ছুটে এসে বলল, আরে, খোকাবাবু! পহলে এক কাপ করকে চায় তো পিও। অজন্তাকা পানি পিও।

বাবলু বলল, এই সময় এক কাপ করে চা পেলে অবশ্য মন্দ হয় না। বিস্কুট আছে তো?

কেক ভি আছে।

তবে কেকই দাও। দোকানদার একটা করে কেক এগিয়ে দিল ওদের দিকে। তারপর চা। ওরা চা খেয়ে নেমে পড়ল নদীতে। চারদিকে উচু পর্বতমালা। তারই মাঝখানে খাদের মতো অংশে বাঘোরার গৈরিক জল। এখন শরৎকাল। যখন-তখন বৃষ্টি হচ্ছে। তাই জলের রং এইরকম। ওরা মনের আনন্দে এ-পাথর থেকে ও-পাথরে, ও-পাথর থেকে সে-পাথরে লাফাতে লাগল। বাচ্চু-বিচ্ছু তো রংচঙে পাথর যেখানে যত ছিল, কুড়িয়ে নিল। আর পঞ্চু? ওর আনন্দের যেন তুলনা নেই। ও এই উন্মুক্ত প্রান্তরে এসে উন্মাদের মতো ছুটোছুটি করতে লাগল। এইখান থেকেই পরিষ্কার দেখা গেল অশ্বক্ষুরাকৃতি পাহাড়ের বাকে অজস্তার সারিবদ্ধ গুহা। ওরা অবাক বিস্ময়ে দূর থেকে তাকিয়ে অপলকে তাই দেখতে লাগল।

বাবলু বলল, এই যে দেখছিস অজন্তা, এ কিন্তু দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর অগোচরে ছিল। মায়ের মুখে এই অজন্তার কত গল্প যে শুনেছি তার ঠিক নেই। এই অজন্তার অনেক ফোটো আছে আমাদের অ্যালবামে।

বিলু বলল, শুনেছি, একদল ইংরেজ-শিকারি নাকি শিকার করতে এসে এই গুহাগুলো আবিষ্কার করেন।

বাবলু বলল, ঠিকই শুনেছিস। বাচ্চু বলল, তোমরা তো সবাই সব-কিছু শুনেছ, কিন্তু আমরা কেউ কিছুই জানি না। একটু বলো না গো বাবলুদা।

বাবলু অজন্তা আবিষ্কারের কাহিনী শোনাতে লাগল ওদের। বাবলু বলল, ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে একদল ইংরেজ সৈন্য অজস্তা পাহাড়ের উলটো দিকের একটি পাহাড়ে শিবির স্থাপন করেছিল। বাইনোকুলার দিয়ে এদিক-সেদিক তাকাতে-তাকাতে হঠাৎ তাদের কয়েকজনের নজরে পড়ল বাঘোরার অপর পাড়ে পাহাড়ের গায়ে সারি-সারি খিলান আর স্তম্ভ। সেই না দেখেই তো উৎসাহী ইংরেজরা লতাগুল্ম আঁকড়ে কোনওরকমে পাহাড় বেয়ে নেমে পড়ল নদীতে। তারপর নদী পার হয়ে অজন্তার গুহা দেখেই স্তম্ভিত হয়ে গেল তারা। কিছুদিন পর লোকালয়ে ফিরে গিয়ে এই কথা বললে বিশেষ কেউ গুরুত্ব দিল না এ-ব্যাপারে। অনেক পরে অবশ্য কয়েকজন প্রকৃতিপ্রেমিক ও বিদ্যোৎসাহী ব্যাপারটা যাচাই করে দেখবার জন্য সেনাবাহিনীর লোকেদের কাছ থেকে পথঘাট জেনে নিয়ে অজস্তায় এসেছিলেন। সেটা হল ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দ। তারপর তারা এশিয়াটিক সোসাইটির বার্ষিক বিবরণীতে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। সেই প্রবন্ধ পড়ে আরও দশ বছর পরে জেমস ফাগুসন নামে এক সাহেব এসে অজন্তা দেখে যান এবং তিনিও এই ব্যাপারে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এতদিনে টনক নড়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডিরেক্টরদের। এবং এর পর থেকেই বারে বারে মানুষের পদচিহ্ন পড়তে থাকে এখানে।

বিচ্ছু বলল, এ যেন রূপকথার গল্প। কী চমৎকার।

বাবলু বলল, আমি তো কিছুই বললাম না তোদের। এর অনেক ইতিহাস। সে যাই হোক। এখন নটা বেজে গেছে। গেট খুলে গেছে নিশ্চয়ই। আমরা ঢুকে পড়ি চল।

ওরা নদীগর্ভ থেকে উঠে এসে ঝোপড়ির ক্লোক-রুমে মাত্র এক টাকায় মালপত্তরগুলো জমা দিয়ে গুহায় প্রবেশ করার জন্য পঞ্চাশ পয়সা করে টিকিট কাটল এবং ১, ২, ১৬ ও ১৭ নং গুহায় লুপ্তপ্রায় চিত্রকলা দেখার জন্য আলোর সুবিধে পাবে বলে পাঁচ টাকা দিয়ে একটা টিকিট কাটল। এই পাঁচ টাকার টিকিট অবশ্য মাথাপিছু নয়। গ্রুপের।

যাই হোক, পাণ্ডব গোয়েন্দারা অজন্তার গুহামন্দিরে প্রবেশ করে ধন্য হয়ে গেল। শুধু ধন্য নয়, অভিভূত হল। পঞ্চু কুকুর। তারও শিল্পবোধের বুঝি তুলনা নেই। সে কী বুঝল তা কে জানে? এক-একটি গুহায় ঢুকছে আর আনন্দে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কখনও-বা ভগবান তথাগত-র সুবিশাল মূর্তির দিকে তাকিয়ে বিভোর হয়ে যাচ্ছে। সবাই সব কিছুই করছে। কিন্তু মজার ব্যাপার, এখানে একমাত্র পাণ্ডব গোয়েন্দারা ছাড়া আর কোনও ট্যুরিস্ট নেই।

ওরা ঘুরতে-ঘুরতে একটি গুহার দোতলায় উঠতেই এক মিউজিক্যাল পিলার দেখতে পেল। তাতে ঘুষি মারলেই সুর বেরোয়। পাণ্ডব গোয়েন্দারা সবাই একটা করে ঘুষি মেরে বাজিয়ে দেখল সেই সুর।

ওখানকার মন্দিরের পরিচর্যার কাজে যিনি ছিলেন তিনি বললেন, অ্যায়সা পিলার আউর এক থা। লেকিন ও টুট গিয়া।

বাবলু বলল, সে তো যাবেই। দলে-দলে যাত্রী এসে সবাই যদি আমাদের মতো বাজাতে থাকে তা হলে এর পরমায়ু আর কদিন? এগুলোকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় হল কাউকে হাত দিতে না দেওয়া। প্রয়োজনে আপনারা বাজিয়ে শোনাবেন।

ওরা যখন মিউজিক্যাল পিলার দেখে দোতলা থেকে নামতে যাবে ঠিক তখনই সিঁড়ির মুখে দেখতে পেল একজনকে। ক্যামেরা হাতে চুড়িদার পরা এক সুন্দরী তরুণী দাড়িয়ে আছেন সেখানে। ওদের দেখেই যেন কত পরিচিত এমনভাবে মিষ্টি হেসে বললেন, আচ্ছা ভাই, ও মিউজিক্যাল পিলার কিধার হ্যায়?

বাবলু বলল, ওপরে। আমরা তো এইমাত্র দেখে এলাম।

তরুণী বললেন, তুম বাঙালি? কামস ফ্রম বেঙ্গল?

হ্যাঁ। বলে বাবলুরা নিজেরা আবার যেমন ঘুরছিল তেমনই ঘুরতে লাগল।

এখন আর ওদের মাথায় সেই হিরে-চুরির বা খুনের তদন্ত খেলা করছে না। ওরা এখন অজানাকে জানার ও দেখার আনন্দে মশগুল।

এইভাবে ঘুরতে-ঘুরতে একেবারে শেষ গুহাটির কাছে গিয়ে বসে পড়ল সকলে। এখানে বসেই সঙ্গে আনা প্যাড়া খেয়ে ওয়াটার বটল খুলে জল খেল। সে জল শেষ হলে ঝরনার পরিশোধিত জল নিয়ে এল। কী সুস্বাদু জল জলযোগ সেরে পাথরের চাতালেই দেহগুলো এলিয়ে দিল ওরা। এমন সময় ক্যামেরা হাতে সেই তরুণী আবার ওদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। শুধু দাঁড়ানো নয়, শাটার টিপে ফোটোও তুললেন একটা। তারপর বললেন, এই, তুমনে সপ্তকুণ্ড দেখা? বাঘোরা কি ওয়াটার ফলস? ও কিধার হ্যায়?

বাবলু বলল, বাঘোরার জলপ্রপাত? এখানে তো অনেক ঝরনা। কিন্তু সপ্তকুণ্ড জলপ্রপাতের কথা শুনিনি তো।

নেহি শুনা? আরে ভাই, ও তো দেখনে কা চিজ হ্যায়।

বাবলু লাফিয়ে উঠল, সত্যি নাকি? কিন্তু মুশকিল হল কাকে জিজ্ঞেস করা যায়? এখানে তো কোনও লোকজনই নেই। না আছে ট্যুরিস্ট, না গাইড, না অন্য কোনও লোক। চারদিক মরুভূমির মতো খাঁ-খাঁ করছে।

বিলু বলল, তা হলে একটা কাজ করি আয়। আমি বরং ছুটে গিয়ে ১৭ নং গুহায় যারা আলো দেখাচ্ছে তাদেরই জিজ্ঞেস করে আসি।

বাবলু বলল, তাই যা।

একটু পরেই বিলু ছুটে এসে বলল, এই এদিকে আয়। এই দিক দিয়ে রাস্তা।

বাবলুরা বিলুর নির্দেশিত পথের দিকে এগিয়ে চলল। পাহাড়ের খাদের গায়ে নীচে নামার একটা সিঁড়ি বেয়ে ওরা ছোট্ট একটি উদ্যানের পাশে এল। তারপর আরও একটু এগোতেই শুনতে পেল জলপ্রপাতের ভীষণ গর্জন। এইখানেই বাঘোরার ছোট্ট সেতু পার হয়ে ওপাশের পাহাড়ে গেল ওরা। তারপর নির্জন পথ বেয়ে খানিক এগোতেই প্রপাতের সামনে। জলপ্রপাতের দিকে তাকিয়ে আনন্দে লাফিয়ে উঠল ওরা।

তরুণী ওদের প্রত্যেককে একটা করে চকোলেট উপহার দিলেন।

বাবলু বলল, আপনি কি একা?

তরুণী মিষ্টি হেসে ঘাড় নাড়লেন।

আমরা আপনাকে দিদি বলে ডাকব কিন্তু।

হা, হা। দিদি কহোগে তুম। নয়নাদিদি।

বাবলুরা একদৃষ্টে বাঘোরার জলপ্রপাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগল। সূর্যের রশ্মি পড়ে রামধনুর ছটা-লাগা ধোয়ার কুগুলিতে ভরা সেই জলপ্রপাত দেখতে খুব ভাল লাগল ওদের। এরকম তো ওরা কখনও দেখেনি।

এমন সময় হঠাৎ কী যেন দেখে ভীষণ জোরে চিৎকার করে উঠল পঞ্চু।

পাণ্ডব গোয়েন্দারাও সতর্ক হয়ে উঠল।

নয়নাদি বললেন, কী ব্যাপার? ক্যা হো গিয়া ইসকো?

বাবলু বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না।

বুঝতে পারবার দরকারও নেই। তার আগেই বিলু বলল, ওই দ্যাখ!

ওরা দেখল বিশ্রী চেহারার গুন্ডাকৃতি চারজন লোক অতি ধীর পদক্ষেপে সন্তৰ্পণে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। ওদের একজনের হাতে একটি চেন। একজনের হাতে ছোরা। বাকি দুজনের হাতে রিভলভার। ওদের দেখে অকস্মাৎ দারুণ ভয় পেয়ে গেল ওরা। তার কারণ জায়গাটা এমনই এক বিপজ্জনক অবস্থানে যেখান থেকে দৌড়ে পালাবার বা আত্মরক্ষা করবার কোনও উপায়ই নেই। এমনকী, সবাই মিলে একসঙ্গে চেচালেও কেউ শুনতে পাবে না।

নয়নাদির মুখও ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল।

বাবলুরাও ভেবে পেল না ঠিক এই অবস্থায় ওরা কী করবে। আক্রমণ, না আত্মসমর্পণ? একদিকে পাহাড়ের খাড়াই দেওয়াল, অপরদিকে বাঘোরার খাদ। সামনে শমন।

লোকগুলো হিংস্ৰ বাঘের মতো এক-পা এক-পা করে আরও খানিকটা এগিয়ে এল।

বাবলু শক্ত করে ধরে রইল পঞ্চুকে কেন না, যদি ও রাগের মাথায় কাউকে কামড়ে দেয়, তা হলে সঙ্গে-সঙ্গে কেউ-না কেউ গুলি করবে ওকে। বাবলুরা পঞ্চুকে ধরে পাহাড়ের দেওয়ালের গায়ে সেঁটে রইল। লোকগুলোর একজন বলল, তো তুম হিয়াতক চলা আয়া। তিন লেড়কা দো লেড়কি ঔর এক কুত্তা। লেকিন ইয়ে দিদি কাহাসে আ গিয়া?

এই লোকগুলোর একজন ওদের দিকে বিচ্ছিরিভাবে তাকাল। দুজন লোক এবার ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের ওপর।

বিলম্ব না করে বাবলুরা পঞ্চুকে ছেড়ে দিল ওদের দিকে। ক্রুদ্ধ পঞ্চু ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েই বিকট চিৎকারে চারদিক কাঁপিয়ে আঁচড়ে-কামড়ে শেষ করে দিল একেবারে।

এই অপ্রত্যাশিত আক্রমণ প্রতিহত করতে পারল না দুষ্কৃতীরা। যে লোকটার হাতে চেন ছিল ভোম্বল তার টেংরি লক্ষ করে জুতোসুদ্ধ একটা লাথি মারতেই লোকটা ছিটকে পড়ল পাহাড়ের খাদে। ছোরা হাতে লোকটি তখন বেগতিক দেখে প্রাণপণে সামনের দিকে ছুটেছে। বিলু আর বাচ্চু পাথর ছুঁড়তে ছুঁড়তে তাড়া করল ওকে।

বাবলুর হাতে চলে এসেছে এখন ওর পিস্তলটা। পঞ্চু একজনের রিভলভার-ধরা হাত সজোরে কামড়ে ধরেছে। আর নয়নাদি তখন আর একজনের হাত থেকে কেড়ে নেবার চেষ্টা করছে তার রিভলভারটা।

বাবলু তখন লোকটির পিঠে পিস্তল ঠেকিয়ে বলল, যদি ভাল চাও তো বিনা যুদ্ধে রিভলভারটা দিয়ে দাও আমাদের। না হলে তোমার আগে আমিই কিন্তু গুলি করব।

লোকটি বলল, আরে ও খিলোনা পিস্তল লেকে তুম ক্যা করোগে ইয়ার? হাম তুমকো মার মারকে খাদমে ফিক দেঙ্গে। বলেই এক ঝটকায় ফেলে দিল নয়নাদিকে।

বাবলু তখন রুখে দাঁড়িয়ে বলল, এইবার দ্যাখ শয়তান, খেলনা-পিস্তলের ম্যাজিক কাকে বলে। বলেই ট্রিগার টিপল টিসুম’।

লোকটি দু হাতে পেট চেপে বসে পড়ল সেখানে। তারপর লুটিয়ে পড়ল পাথরের বুকে। পঞ্চু যে লোকটার হাত কামড়ে ধরেছিল নয়নাদি তার হাত থেকেও রিভলভারটা কেড়ে নিয়ে সজোরে একটি ধাক্কা দিল তাকে। লোকটি অন্তিম আর্তনাদ করে পাহাড়ের খাদে বড়-বড় পাথরে আছাড় খেয়ে গড়িয়ে পড়ল নদীর জলে। বাঘোরার জলস্রোতে কুটোর মতো ভেসে চলল সে।

বাবলুরা আর এক মুহুর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে ছুটে চলল সামনের দিকে। বিলু আর বাচ্চু তখনও সমানে তাড়া করে চলেছে সেই লোকটিকে। তাই দেখে পঞ্চুর রাগ আরও বেড়ে গেল। সেও তখন ওদের সঙ্গে একজোট হয়ে তাড়া করল লোকটিকে।

লোকটি তখন পুলের ওপর। পঞ্চুর হাত থেকে বাচার জন্য সে তখন পুলের ওপর লোহার রেলিং ধরে ঝুলে পড়েছে। দু’পাশে পাহাড়। মাঝে খাদ। সেই খাদের মধ্য দিয়ে বাঘোরা জলপ্রপাতের জল নদী হয়ে প্রবল বেগে ছুটে চলেছে। একেবার যদি এখানে ঝুলে থাকা অবস্থায় হাতটা ফসকায়, বাছাধনকে আর দেখতে হবে না। তবু সে পঞ্চুর কামড় থেকে বাঁচবার জন্য অত বড় একটা ঝুঁকি নিল।

পাণ্ডব গোয়েন্দারা মার-মার চিৎকার করে ছুটে এল সেখানে। লোকটি ঝুলন্ত অবস্থায় চেঁচাতে লাগল, মুঝে মাত মারো। ম্যায় গোড় পাকড়তি হু। বিলু বলল, কী করব বাবলু? লোকটার কবজিতে একটা লাথি মারব? এক্ষুনি হাত ফসকে নীচে পড়ে যাবে তা হলে। হাড়গোড় গুড়িয়ে একশা হয়ে যাবে।

ভোম্বল তখন ওর জুতোর ডগা দিয়ে একটার পর একটা লাথি মারতে লাগল। লোকটিও সমানে চেঁচাতে লাগল, মাত মারো। মুঝে মাত মারো ভাই। ততক্ষণে দেখা গেল হইচই করে কিছু লোক ছুটে আসছে সেইদিকে। এরা সবাই অজস্তা গুহার রাজ-কর্মচারী। সবাই ছুটে এসে বলল, ইয়ে ক্যা তামাশা হো রহ হ্যায়।

নয়নাদি তখন ওদের ভাষায় সব কথা বুঝিয়ে বললেন লোকগুলোকে। তারা সবাই বলল, ইয়ে বাত? তো আভি পুলিশকো বুলানা চাহিয়ে। লেকিন আপ লোগ জলদি নিকাল যাও হিয়াসে। এ লোক বহোতই খতরনক। ইসকো আউর সাথি আ যায়গা তো মুশকিল হো যায়েগা।

বাবলুরাও তাই চাইছিল। কেন না, ওদের সামনে এখন অনেক কাজ। অজস্তা দেখতে এসে এইসব ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লে সে কাজের দেরি হয়ে যাবে। তাই নয়নাদিকে দ্রুত পা চালিয়ে ওদের সঙ্গে আসতে বলেই গেটের দিকে এগিয়ে চলল ওরা।

স্থানীয় লোকরা তখন সেই ঝুলন্ত শয়তানকে উদ্ধারের চেষ্টা করছে। ওরা সবাই গুহার বাইরে আসতেই দেখা গেল একটা অস্টিন গাড়ি এগিয়ে এল ওদের দিকে। নয়নাদি তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠেই ওদেরও উঠতে বললেন। বাবলুরা একটুও দেরি না করে ক্লোক-রুম থেকে ওদের মালপত্তর ছাড়িয়ে এনেই গাড়িতে ঢুকল। গাড়ি হুশ করে চোখের পলকে পাহাড় টপকে স্থান ত্যাগ করল।

নয়নাদি বললেন, তুম সব কঁহা যাওগে?

বাবলু বলল, ইচ্ছে তো ছিল ঔরঙ্গাবাদ হয়ে ইলোরা যাব। কিন্তু সবই গড়বড় হয়ে গেল। এখন ভাবছি বোম্বাইতেই চলে যাই।

নয়নাদি বললেন, ইলোরা তো হামকো ভি যানা। লেকিন ফর্দাপুরমে হামারা সামান হ্যায়। পহলে হুয়া চলো। উধার খানাপিনা করকে থোড়ি দেরমে যায়েঙ্গে।

বাবলু বলল, খুব একটা দেরি করবেন না কিন্তু। কেন না, যে-কাণ্ডটা আমরা করে এসেছি, তাতে যে-কোনও মুহুর্তে বিপদে পড়ে যেতে পারি আমরা। এই হত্যার বদলা ওরা নেবেই নেবে। বিশেষ করে একজন যখন এখনও বেঁচে আছে তখন ওর মুখ থেকেই সব কিছু জেনে যাবে ওরা।

নয়নাদি বললেন, ঠিক বতায়া তুমনে। ও লোক আমাদের ছাড়বে না। বাবলু পুলকিত হয়ে বলল, এ কী! আপনি বাংলা বলতে পারেন? থোড়া থোড়া। তোমাদের কলকাতায় হরিসেন রোডে আমি আমার বন্ধুর বাড়িতে মাঝে-মাঝে যাই। ওহি কে ওয়াস্তে হামি কুছু-কুছু বাংলা বলতে পারে।

নয়নাদি ফিক করে হাসলেন। ফদাপুর বাংলোয় ঠাকুর-ভৃত্যরা রান্নাবান্না করেই রেখেছিল। অবশ্য এতজনের নয়। তাই যা ছিল সবাই ভাগাভাগি করে খেয়ে নিল। পেট ভরল না। তবে পেটটা ঠান্ডা হল। নয়নাদির সামান বলতে একটি ভি আই পি সুটকেস। সেটি নিয়ে ডাকবাংলো ছেড়ে আবার ছুটে চলা রাজপথ ধরে ঔরঙ্গাবাদের দিকে। নয়নাদির সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, বিশেষ একটা জরুরি কাজে উনি খাণ্ডোয়া গিয়েছিলেন। সেখান থেকে পুনেয় যাবেন। পথে অজন্তা-ইলোরাটা দেখার লোভ সামলাতে পারেননি। ইলোরায় উনি অনেকবার এসেছেন, কিন্তু অজস্তাতেই এই প্রথম। এখান থেকে পুনে হয়ে বোম্বাই যাবেন। বোম্বাই শহরতলিতে নয়নাদিদের দোতলা বাড়ি। সেখানে ফিরে যাবেন সব শেষে। পুনেয় একদিন মাত্র থাকবেন।

নয়নাদি বললেন, ইলোরা দেখনে কি বাদ তুম সব হামারা সাথ পুনে চলো।

বাবলু বলল, আমরা ইলোরায় যাব না নয়নাদি। আপনি আমাদের ঔরঙ্গাবাদে নামিয়ে দিন। আমরা ওইখান থেকে বাস ধরে বোম্বাই চলে যাব।

তুম ইলোরা নেহি দেখোগে? অ্যায়সা বুরবাকি মাত করো। ইলোরা খুব ভাল জায়গা।

বাবলু বলল, তা জানি। তবে আমরা তো ঠিক বেড়াতে আসিনি। আমরা এসেছি একটা জরুরি কাজে। সেই কাজটা শেষ হলেই যদি বুঝি তো ফেরবার সময় এই পথে এসে ইলোরা দেখে যাব।

নয়নাদি হেসে বললেন, কিতনি মাসুম হো তুম। লেকিন ক্যা কাম লেকে আয়া? আমাকে বতাবে না?

ভোম্বল তড়বড় করে বলতে যাচ্ছিল। বাবলু ওকে চোখ টিপে বলল, আমাদের পাড়ার একটি ছেলে বম্বেতে পালিয়ে এসেছে। ওর মা-বাবা কান্নাকাটি করছেন খুব। আমাদের এক মামা থাকেন এখানে, তার কাছে উঠে এই ছেলেটির একটু খোঁজ করব।

নয়নাদি মিষ্টি হেসে বললেন, ইউ আর রিয়্যালি গুড বয়।

তারপর ড্রাইভারকে বললেন, রতনলাল, তুম জলদি ঔরঙ্গাবাদ যানে কা কোসিস করো।

নয়নাদির অস্টিন গাড়িটা দক্ষ চালকের হাতে পড়ে যেন হাওয়ায় উড়ে চলল। যেতে যেতে নয়নাদি বললেন, বিশদিন হল ঘর থেকে বেরিয়েছি। পুনেকে বাদ ঘর যান হি পড়েগা। গাড়ি ছুটে চলেছে। এই অঞ্চলে পাহাড়-পর্বত নেই। একেবারে সমতল। তবে উচু-নিচু বন্ধুর পথ। যেতে যেতে বাবলু বারবার পিছন দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল।

নয়নাদি বললেন, কী দেখছ?

দেখছি কোনও পুলিশের জিপ-টিপ আমাদের পিছু নিয়েছে কি না।

পুলিশ! পুলিশ কেন আসবে?

বাঃ। তিন-তিনটে লোক আমাদের হাতে প্রাণ হারাল। এ-কথা কি পুলিশের কানে উঠবে না ভেবেছেন? তার ওপর ওই লোকটি যখন ধরা পড়েছে তখন পুলিশকে সে সবই বলবে। অবশ্য এমন যদি হয় লোকটি পুলিশের ধারে-কাছেও না গিয়ে কেটে পড়ে, তা হলে আলাদা কথা। তবুও ভয়, গুহার কর্মচারীরা তো পুলিশকে সব কথা বলবে।

নয়নাদি বললেন, হাঁ, হাঁ ও তো জরুর বুলায় গা লেকিন পুলিশ আয়েগা তো?

বাবলু বলল, পুলিশ এলে আমরা একটা কথাই বলব যে, আমাদের ওপর অত্যাচার করতে গিয়ে ওরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরেছে। শুধু আমাদের রক্ষা করার জন্য আমাদের কুকুর একটু আঁচড়ে কামড়ে দিয়েছে ওদের।

বিলু বলল, ওই দুষ্কৃতী বদমাশগুলোর জন্যে পুলিশের অত মাথাব্যথা নেই আমাদের পিছু নেবার। এক ওদের দলের লোকেরা বদলা নেবে বলে আমাদের পিছু নিতে পারে। তবে তা করবে বলে মনে হয় না।

সন্ধের অনেক আগেই ওরা ঔরঙ্গাবাদ পৌছল। মহারাষ্ট্রের এক নামকরা ঐতিহাসিক শহর এই ঔরঙ্গাবাদ। নয়নাদি বললেন, এক কাম করো বাবলুভাই। আজ রাত হিয়া ঠার যাও। কাল শুভে ইলোরা দেখো আউর সামকে বোম্বাই চলা যাও। বহুত বাস মিলেগ হিঁয়াসে।

বাবলু বলল, আমাদের ব্রেক জানি টিকিট আছে। কাজেই মানমাদ থেকে ট্রেন ধরলেই আমাদের সুবিধে।

বিলু বলল, তা হলে আমরা থেকেই যাই।

বাচ্চু-বিচ্ছু দুজনেই বলল, আবার কবে আসব না আসব তার ঠিক নেই। এবারেই দেখে যাওয়া ভাল। তা ছাড়া একদিনে এমন-কিছু দেরি হয়ে যাবে না।

বাবলু বলল, দেরি হওয়াটা তো কোনও ফ্যাক্টর নয়। আমি ভাবছি অন্য কথা। আসলে এখনও ওদের বেল্টের মধ্যে আছি তো!

যাই হোক, নয়নাদির কথামতে ঔরঙ্গাবাদ বাসস্ট্যান্ডের কাছে হোটেল প্রদীপে উঠল ওরা। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হোটেল। একটা বড় ঘরে রতনলাল ড্রাইভারসহ বাবলু, বিলু, ভোম্বল ও পঞ্চু রইল, আর একটা ঘরে বাচ্চু-বিচ্ছুকে নিয়ে নয়নাদি। হোটেলের ঘরে মালপত্তর রেখে ওরা স্নান করে সারাদিনের ক্লাস্তি দূর করল। তারপর আর গাড়িতে নয়, পায়ে হেঁটেই ঘুরে বেড়াতে লাগল চারদিকে। একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে বেশ ভালরকম খেয়েদেয়ে এখানকার বিখ্যাত শোরুম থেকে নয়নাদি নিজের জন্য দু-একটি সিন্ধের শাড়ি কিনলেন। ঔরঙ্গাবাদের সিল্ক বিখ্যাত। তারই নিদর্শন রাখলেন। তারপর একটু রাত করেই ফিরে এলেন হোটেলে।

সে রাতটা বেশ আনন্দেই কেটে গেল। পরদিন সকালে ওরা চলল ইলোরা দেখতে। ইলোরায় নয়নাদি বেশ কয়েকবার এসেছেন। তাই এখানকার সবই ওঁর পরিচিত। এখন এই বাচ্চু-বিচ্ছুর মতো দুষ্ট মিষ্টি মেয়েদুটোকে পেয়ে বাবলু বিলু ভোম্বলের মতো ভাই পেয়ে খুব খুশি উনি। এই রমণীয় স্থানগুলি তাই ওদের সঙ্গে নিয়ে দেখিয়ে দেবার লোভ তিনি সামলাতে পারলেন না।

ওরা প্রথমেই এল দেবগিরিতে। দেবগিরি, মানে যার আর-এর নাম দৌলতাবাদ। পাহাড়ের ওপরে চমৎকার একটি দুর্গ আছে। অবশ্য পাহাড়ের ওপরে না বলে গোটা পাহাড়টাকেই একটা দুর্গ বলা উচিত। দেবগিরির দুর্গ
দেখে হতবাক সকলে। ১২৯৩ সালে আলাউদ্দিন খিলজি এই দুর্গ অবরোধ করেন। তখন যাদব-রাজারা এখানে রাজত্ব করতেন। যাই হোক, এই দুর্গ অবরোধ করে প্রচুর ধনদৌলত নিয়ে আলাউদ্দিন দিল্লিতে ফিরে যান। এর ঠিক পচিশ বছর পরে কুতবউদ্দিন মুবারক শাহ এই যাদব-রাজাকে জয় করেন এবং ১৩৩৮ সালে পাগলা-রাজা মুহম্মদ বিন তুঘলক দিল্লি থেকে তার রাজধানী এখানে স্থানান্তরিত করেন এবং এর নাম দেন দৌলতাবাদ। এই দুর্গ ১১৮৭ সালে যখন যাদব-বংশের রাজা ডালোমা তৈরি করেন তখন এর নাম ছিল দেবগিরি। মানে দেবতাদের বাসভূমি। পরে নাম হল দৌলতাবাদ, অর্থাৎ কিনা সৌভাগ্যের শহর। বাবলুরা দুর্গের ওপরে উঠে চারদিকের প্রকৃতি দেখল, তারপর ঔরঙ্গজেবের নামাঙ্কিত কামানের ওপর বসে মাউথঅগান বাজাল। কত কী করল।

তারপর আবার মোটরে চেপে হুঁ-উ-শ। এবার ইলোরা। ইলোরায় এসে প্রথমেই ওরা দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্তর্গত ঘুশুনেশ শিবের মন্দির দেখল।

তারপর দেখা শুরু করল গুহা-মন্দিরের ভাস্কর্য। এখানেও চারদিকে পাহাড়ের গা বেয়ে ছোট-বড় ঝরনা। ওরা বৌদ্ধ, জৈন ও কৈলাস গুহা অনেকক্ষণ ধরে দেখল। যত দেখে ততই ভাল লাগে। বিস্মিত অভিভূত বাবলু বলল, নয়নাদির কথা শুনে ভাগ্যিস এসেছিলাম। না এলে দারুণ ঠকতাম।

ইলোরা দেখে ওরা চলল ঔরঙ্গজেবের সমাধি দেখতে। এই জায়গাটার নাম খুলদাবাদ। তারপর ওরা গিয়ে হাজির হল আর-এর বিস্ময়ের সামনে।

বাবলু বলল, এ তো তাজমহল!

নয়নাদি বললেন, এ বিবি-কা-মকবারা।

এই বিবি-কা-মকবার ঔরঙ্গজেবের প্রথমা সম্রাজ্ঞী রাবিয়া দুরানির সমাধি। আগ্রার তাজমহলের অনুকরণে এটি তৈরি হয়েছিল ১৬৭৯ সালে। এর পর পানি চাক্কি জলাধার দেখে ওরা আবার ফিরে এল হোটেলে।

হোটেলে স্নান-খাওয়া সেরে বিল মিটিয়ে মোটরে চেপে ঝড়ের বেগে এগিয়ে চলল বম্বের পথে। নয়নাদি পুনে যাবেন। তাই ঠিক হল, মানমাদে নয়, ইগাতপুরীর বাংলোয় রাত কাটিয়ে বাবলুরা ট্রেনে যাবে আর নয়নাদি চলে যাবেন পুনেতে। বাবলুদের কাছে নিজের ফোন নম্বরটাও দিয়ে রাখলেন নয়নাদি। ঠিক হল বাবলুরা বম্বে গিয়ে একটা দিন থেকে নয়নাদিকে ফোন করলেই উনি ঠিকানা খুঁজে নিজে এসে তার গাড়িতে করে বাবলুদের নিয়ে যাবেন তার বাড়িতে।

ঔরঙ্গাবাদ থেকে বেরিয়ে মানমাদ নাসিক ছুয়ে দুরারোহ পর্বতমালা পার হয়ে পাহাড়ের ওপর ঘন জঙ্গলে পূর্ণ ইগাতপুরীতে পৌছল ওরা। ইগাতপুরীর ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার প্রথমে কিছুতেই ঘর দিতে রাজি হল না। পরে নয়নাদির হাত থেকে একশো টাকার একটি নোট পেতেই খুশি হয়ে ঘর দিল। সে-রাতে ডাকবাংলায় গরম ভাত আর মুরগির মাংস পেট ভরে খেল তারা। তারপর ঘুম-ঘুম-ঘুম।

পরদিন সকালে নয়নাদি পুনের দিকে চলে গেলেন। আর পাণ্ডব গোয়েন্দারা বম্বে মেল ধরে চলে এল ভি টি অর্থাৎ ভিক্টোরিয়া টার্মিনাসে। কী চমৎকার স্টেশন। আর কী সুসজ্জিত শহর এই বোম্বাই। ওরা প্ল্যাটফর্মের গেট পার হয়ে বা দিকে পাবলিক টেলিফোনে কথা বলল সমুমামার সঙ্গে।

সমুমামা বললেন, তোরা বোস। আমি এক্ষুনি আসছি। এক নম্বর গেটের সামনে চেয়ার আছে। সেইখানে বসে থাক তোরা।

সমুমামা জাভেরি মার্কেটের কাছেই থাকেন। ওইখানেই আবদুল রহমান স্ট্রিটে তার পাথর-সৈটিংয়ের দোকান। আর দোকান থেকে ভি টি দশ মিনিটেরও পথ নয়। তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলেন সমুমামা।

ওরা সবাই প্রণাম করল।

বাচ্চু-বিচ্ছু তো অনেকদিন বাদে মামাকে দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠল।

সমুমামা ওদের আদর করে পিঠ চাপড়ে খুব প্রশংসা করলেন। তারপর তো পঞ্চুকে দেখে হেসেই অস্থির। বললেন, এটা কি তোদের সেই বডিগার্ড কুকুরটা?

হ্যাঁ। ওর নাম পঞ্চু।

তা না হয় হল। কিন্তু ওটাকে এখানে নিয়ে এলি কী করে?

ও দারুণ চটপটে। এমনভাবে সুট করে গাড়িতে উঠে লুকিয়ে থাকবে এক কোণে যে কেউ টেরই পাবে না কারও পোষা কুকুর বলে। সবাই ভাববে রাস্তার কুকুর। তাই কেউ কিছু বলবেও না।

সবই তো বুঝলুম, কিন্তু আমি যেখানে তোদের থাকার ব্যবস্থা করেছি কুকুর নিয়ে তো সেখানে থাকা যাবে না। বহু কষ্টে একটা ঘর ম্যানেজ করেছি।

কোনও হোটেলে ব্যবস্থা করা যায় না?

যাবে না কেন? রেট শুনলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। তিন সাড়ে তিনশোর নীচে কোনও থাকার জায়গা নেই এখানে।

তা হলে?

তা হলে আর কী? আপাতত যেখানে থাকার ব্যবস্থা করেছি সেখানেই যাওয়া যাক। আসলে ঘরটা আমারই এক পরিচিত দোকানদারের। সে এক মাসের জন্য কলকাতা গেছে। তাই বলে গেছে তোর ভাগনে-ভাগনিরা এলে আমার ঘরেই ঢুকিয়ে দিস। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, সে ভীষণ কুকুর অপছন্দ করে। যদি এসে একবার শোনে যে তার ঘরে আমি কুকুর ঢুকিয়েছি, তা হলে চটে বোম হয়ে যাবে। যাক। এখন নিয়ে তো তুলি। পরে যা হয় একটা কিছু ব্যবস্থা করা যাবে।

স্টেশনের সামনেই ট্যাক্সিস্ট্যান্ড। ওর
া দিয়ে ট্যাক্সিতে উঠতেই সমুমামা ড্রাইভারকে বললেন, আবদুল রহমান স্ট্রিট।

ট্যাক্সি জনবহুল শহরের ওপর দিয়ে পুঁ-পা করে এগিয়ে চলল। এখানকার ঘরবাড়ি পথঘাট দেখে বাবলুদের মনে হল, ওরা ভারতে নয় লন্ডন বা প্যারিসের মতো কোনও দেশে যেন চলে এসেছে।

বাবলু বলল, কী বিরাট শহর। আমি ভাবতুম কলকাতাটাই বুঝি বড়। বম্বে সম্বন্ধে কোনও ধারণাই ছিল না।

এখন হল তো? তা হলে জেনে রাখ, কলকাতার আয়তন ৮৭,৮৫৩ স্কোয়ার কি মি বম্বের আয়তন ৩,০৭,৭৬২ স্কোয়ার কি মি। এর জনসংখ্যাও কলকাতার চেয়ে বেশি।

যাই হোক, একটি সাততলা বাড়ির সামনে এসে ওদের মোটর থামল। এই বাড়িতেই ফোর্থ ফ্লোরে সমুমামার দোকান। একটি বড় ঘরে চারজন দোকানদার তাদের কর্মচারীদের নিয়ে বসেন। এই দোকানদারদের এখানে শেঠ বলে। বাবলুরা সমুমামার দোকানে বসে কিছুক্ষণ পাথর-সেটিংয়ের কাজ দেখল। তারপর সমুমামা তিনতলায় ওদের জন্য নির্দিষ্ট একটি ঘরে নিয়ে এলেন ওদের।

পাণ্ডব গোয়েন্দারা তো বম্বের মতো শহরে এইরকম একটা থাকার জায়গা কল্পনাও করেনি। তাই ঘর দেখে খুব খুশি।

সমুমামা বললেন, আপাতত এই ঘরে তোরা থাক। পরে অন্য জায়গায় ব্যবস্থা করছি। কদিন থাকবি তোরা কিছু ঠিক করেছিস?

বাবলু বলল, বেশিদিন নয়। একটা কাজে এসেছি আমরা। কাজটা শেষ হলেই চলে যাব।

কাজ মানে? তোদের আবার কাজ কী?

আগে স্নান-খাওয়াটা করি। তারপর দুপুরবেলা সব বলব তোমাকে।

সমুমামা বললেন, ঠিক আছে। পরে সব শুনব। এখানে সব সময় তোরা দরজা বন্ধ করে রাখবি। মনে রাখিস, এটা গেরস্থবাড়ির ফ্ল্যাট নয়। বিজনেস সেন্টার। এই মস্ত বাড়ির ভেতর মাত্র দু-চার ঘর ফ্যামিলিম্যান আছে। বাকি সব ঘরেই বিজনেস চলছে। আর শোন, এখানে জলের ক্রাইসিস খুব বাথরুমের ভেতর একটা বড় ড্রামে আমি লোক দিয়ে জল ভর্তি করিয়ে রেখেছি। ওই জলেই অল্প-অল্প করে স্নান করে নিবি সব। মোট কথা স্নানের জন্য এক বালতির বেশি জল কেউ খরচ করবি না। তারপর বললেন, তোদের কুকুরটা ঘরদোর নোংরা করবে না তো?

না, না। সে ভয় নেই। এ-ব্যাপারে পঞ্চুবাবু খুব ভদ্র।

সমুমামা বললেন, তোরা ঘরেই থাক। আমি তোদের চা আর জলখাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।

বাবলুরা ততক্ষণে জামা-প্যান্ট ছেড়ে পোশাক পালটে ফ্রেশ হয়ে নিল। এইবার দুপুরের স্নানাহারের পর শুরু করবে ওদের আসল কাজ। মি. যোশির ফ্যামিলিকে খুঁজে বার করতেই হবে। আর এ-কাজে সমুমামা নিশ্চয়ই ওদের সর্বতোভাবে সাহায্য করবেন।

একটু পরেই একজন এসে ওদের চা, শিঙাড়া ও কচুরি দিয়ে গেল। তাই খেয়ে দরজা বন্ধ করে ওরা স্নানপর্ব শেষ করল। তারপর বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে ওপরের জানলা দিয়ে নীচের কর্মব্যস্থ শহরকে যত দেখতে লাগল, ততই ওদের বুকের ভেতরটা টিপঢিপ করতে লাগল। এ কী বিশাল কর্মযজ্ঞ রে বাবা! মস্ত শহর। ব্যস্ত শহর। গগনচুম্বি অট্টালিকা। অথচ কী মনোরম। কিন্তু এই গোলকধাঁধার শহরে ওরা কি পারবে ওদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে? ওরা কারও সঙ্গে শক্রতা চায় না। কারও বদলা চায় না। বোম্বের ভিলেনরা বোম্বেতেই থাকুক। ওরা শুধু চায় মি. যোশীর ঠিকানাটা খুঁজে পেতে এবং তার পরিবারবর্গের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে সমুমামা এলেন। বললেন, চল, খাবি চল। বাবলুরা যাবার জন্য তৈরি হল। বাবলু বলল, পঞ্চুকে কি নিয়ে যাওয়া যাবে?

অসম্ভব। বড়-বড় রেস্টুরেন্ট সব। মানুষেরই ওখানে বসবার জায়গা পাওয়া যায় না, তার ওপর কুকুর। ঢুকতেই দেবে না ওকে। ওর জন্যে বরং কিছু খাবার নিয়ে আসবি।

বাবলুরা তাই করল। কাছের একটি হোটেলে খাওয়াদাওয়া সেরে পঞ্চুর মনের মতো খাবার সঙ্গে নিয়ে এলে। এখানকার খাওয়াদাওয়ার মেনুই আলাদা তবু মন্দ লাগল না। এইবার দুপুরবেলা সবাই শুয়ে-বসে সমুমামাকে ওদের এখানে আমার প্রকৃত কারণটা খুলে বলল।

সব শুনে সমুমামা বললেন, এই যদি ব্যাপার হয় তা হলে জেনে রাখ, এই বোম্বাই শহরে তোদের চলাফেরা একদম নিরাপদ নয়। আর এও জেনে রাখ, ডেভিড এমন একজন ইন্টারন্যাশনাল স্মাগলার, যার সঙ্গে দেশের তাবড়-তাবড় মানুষও জড়িত। এবং সেইজন্যেই ওকে আজ পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার করতে পারছে না। ওকে ভয় পায় না এই বোম্বাই শহরে এমন কেউ নেই।

বাবলু বলল, তা হলে?

তা হলে একটাই উপায় আছে। আজকের দিনটা এখানে বিশ্রাম নিয়ে কাল ভোরের গীতাঞ্জলিতে তোরা পালিয়ে যা এখান থেকে।

সে কী! বিনা রিজার্ভেশনেই?

গাড়িতে উঠে পড়লে যাবার ব্যবস্থা ঠিকই হয়ে যাবে। আগে তো পালিয়ে বাঁচ।

বিচ্ছু বলল, তাই আবার হয় নাকি? আমরা বোম্বাই শহরটা একটু ঘুরে দেখব না? শুনেছি কত কী দেখবার আছে এখানে!

সমুমামা বললেন, সবই বুঝলুম। কিন্তু কোনও উপায় নেই। এখানে থাকা তোদের চলবে না। তার কারণ, আমি বাবা গোয়েন্দা-টোয়েন্দা কিছু নই। তবু আমার সাদামাটা বুদ্ধি দিয়ে যেটুকু অনুমান করছি তা হল— প্রথমত, তোরা যখন ভুসাওয়ালে হাপিস হয়ে যাস তখন থেকেই কিন্তু ওদের নোটিসে রয়ে গেছিস। অর্থাৎ কিনা বোম্বেতে তোরা না নামার ফলে ওদের লোকেরা ভুসাওয়াল টু বোম্বের মধ্যে যেখানে যত ওদের দলের লোক আছে তাদের সবাইকে ফোনে খবর দিয়ে তোদের দিকে নজর রাখতে বলেছে। দ্বিতীয়ত, বাঘোরা নদীর জলপ্রপাতের কাছে যা ঘটেছে তা ওদেরই দলের লোকের দ্বারাই ঘটেছে। ওরা তোদের দিকে নজরদারি করতে গিয়েই তোদের ফাঁদে পড়ে। না হলে অজস্তার মতো ট্যুরিস্ট-স্পটে আজ পর্যন্ত কখনও কোনওরকম খারাপ কিছু হয়নি কারও। যথেষ্ট সুনাম আছে ওইসব জায়গার। যাত্রীরা নিরাপদে ঘোরাফেরা করে। কাজেই ওটা যে এই দলেরই কাজ, তা বুঝতে বাকি থাকে না। না হলে যে জায়গায় কখনও কিছু হয় না, সেই জায়গায় তোরা যাওয়ামাত্রই যত গোলমাল বেঁধে গেল? তবে কিনা ও-সবই কাচা লোকদের নিয়ে কাজ। এখানে কিন্তু ওটি হবার উপায় নেই। এখানে সব ফেরোসাস লোক। ধরবে, মারবে।

বাবলু বলল, তাই যদি হয়, যদি ওরা সত্যিই আমাদের পিছু নিয়ে থাকে, তা হলে তো ইগাতপুরীর বাংলোয় আমাদের ওপর চড়াও হবার যথেষ্ট সুযোগ ছিল ওদের।

ছিল। হয়তো সম্ভব হয়নি। কেন না, তোদের পিছনে খবরদারি করবার জন্যে যাদের লাগানো হয়েছিল তোরা তো তাদের সবাইকে প্রায় যমের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিস। ঔরঙ্গাবাদে যারা আছে তারা হয়তো তোদের দেখা পায়নি। নয়তো লোকজনের ভিড়ে পাছে গোলমাল হয়, তাই বিপদের ভয়ে তোদের আক্রমণ করেনি। তবে ফোনে হয়তো তোদের স্থানত্যাগের কথা জানিয়ে দিয়েছে ওদের হেড কোয়াটারে। এরপর তোরা যে মানমাদ বা নাসিকের মতো জায়গা থাকতে ইগাতপুরীতে রাত কাটাবি তা ওরা ভাবতে পারেনি। তবে বোম্বে ভি টি-তে নিৰ্ঘাত কড়া নজর রেখেছে ওরা। তাই তোদের পিছু নিয়ে ওরা এসে যে এই বাড়ির ওপরও নজর রাখছে না তাও হলফ করে বলা যায় না। অতএব এখন সাবধান না হওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। তবে সাবধান হয়েও ওদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না।

বাবলু বলল, কিন্তু মামা, তাই যদি হয় তা হলে আমরা পালাতে গিয়েও রেহাই পাব না। আমরা গীতাঞ্জলিতেই যাই আর যে গাড়িতেই যাই ওরা তো ট্রেন থেকে নামিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের।

যেতে পারে।

বিলু বলল, আমার মনে হয় আমরা অকারণেই এত ভয় পাচ্ছি। ওরা যদি সত্যিই আমাদের ওপর নজর রেখে থাকে তা হলে ভি টি-তেই আমাদের আক্রমণ করত। কেন না, আমরা অনেকক্ষণ ওখানে বসে ছিলাম।

সমুমামা বললেন, ভি টি-তে করেনি অন্য কারণে। ওরে বোকা, হুইল ছিপে যারা মাছ ধরে তারা কি টোপ গেলার সঙ্গে-সঙ্গেই মাছকে টেনে ডাঙায় তোলে? তোলে না। তাকে খেলিয়ে-খেলিয়ে তোলে। এত তাড়াতাড়ি তোদের আক্রমণ করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। যেহেতু তোরা নিজেরাই সেই কলকাতা থেকে বোম্বেতে ওদের ফাঁদে পা দিতে এসেছিস।

বাবলু বলল, যা কপালে আছে, হবে।

এখন কপাল ভরসা ছাড়া আর কোনও পথই নেই। যদি মনে করি অজস্তার ওই লোকগুলো ডেভিডের নয়, যদি মনে করি কেউ এখনও তোদের পিছু নেয়নি, তবু কিন্তু বিপদ কাটছে না। তোরা যখন রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াবি, একটু নির্জনে যাবি, তখন? তা ছাড়া তোরা জানিস না, ওই হিরে কত মূল্যবান। এই হিরে-চুরির ব্যাপারে হইচই পড়ে গেছে রীতিমত। আর মি. যোশির ব্যাপারটা শোন, যোশি হলেন এই অঞ্চলের অত্যন্ত ধনী ব্যক্তি। লক্ষ-লক্ষ নয়, কোটি-কোটি টাকার মালিক। মি. যোশির একমাত্র মেয়ের বিয়ের জন্যে ওই হিরেগুলো দিয়ে উনি একটা সেটিংয়ের কাজ করতে দিয়েছিলেন এখানকার একজন নামকরা শেঠকে। ওই শেঠের এক কারিগর লোভ সামলাতে না পেরে হিরেগুলো নিয়ে উধাও হয়। কথাটা জানাজানি হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই ডেভিড তার জাল বিস্তার করে। এবং চোরের ওপর বাটপাড়ি করার জন্যে ওই মাল ছিনতাই করতে তার দলের লোকদের কাজে লাগায়। সারা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ওদের লোকেরা জাল পেতে আছে। তাই সব ব্যাপারে বাতাসের আগে খবর চলে যায় ওদের কাছে যে কারণে ওই কারিগর লোকটি কলকাতায় যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে হাওড়া স্টেশনেই খপ্পরে পড়ে যায় ওদের। অবশ্য যোশিজিও কম ধুরন্ধর নন। তারও লোক আছে। তিনিও পিছু নিয়েছেন ওদের।

বলা মুশকিল। বোম্বে পুনে ইন্দোর খাণ্ডোয়ায় তার প্রাসাদোপম বাড়ি দেখলে মাথা ঘুরে যাবে। বম্বে মানে বরিভলিতেই তার বাড়ি। ভি টি-তে নয়। দাদারে একটা হোটেলও আছে। তবে মানুষটি খুব ভদ্র। কোনও দাম্ভিকতা নেই। অত্যন্ত পরোপকারী। একমাত্র মেয়ে।

কী নাম মেয়েটির? বয়স কীরকম?

নাম-টাম বলতে পারব না। তবে বড় মেয়ে। বিয়ের কথা হচ্ছে শুনছিস না। তা হিরে-চুরির খবর শুনেই যোশিজি লোকজন নিয়ে বিমানে উড়ে নিজেই সবার আগেভাগে কলকাতায় চলে যান।

ওই লোকটা যে কলকাতাতেই গেছে তা ওঁরা জানলেন কী করে?

কারিগর তো সবাই এখানে বাঙালি। আমতার কাছে কোনও গ্রামে যেন বাড়ি লোকটার। তা ছাড়া দলেও হয়তো দু-চারজন আছে। চড়চাপড় মারতেই সব বেরিয়ে পড়েছে।

বাবলু বলল, আচ্ছা, যোশিজি যে খুন বলেন, সে-ব্যাপারে এখানে তো কোনও হইচই দেখছি না?

যোশিজি যে খুন হয়েছেন একথা এই প্রথম তোদের মুখেই শুনলাম। তা যাক, এ-নিয়ে এখানে কারও সঙ্গে কোন আলোচনা করিস না। কেন না, আমি তো এখানে ব্যবসা করে খাই। ঘটনাচক্রে তোরা যে এর মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিস, তা যেন কেউ জানতে না পারে। বিশেষ করে আমার ভয় ডেভিডের লোকেদের। তবে এও জনে রাখ, ওরা তোদের সহজে ছাড়বে না। যদি ওরা তোদের ধরে বা জিনিসগুলো ফেরত চায় তা হলে এক কাজ করিস, ওগুলো ওদের ফিরিয়েই দিস। তাতে মনে হয় কিছুটা নিরাপদ তোরা হতে পারবি। যদি না দিস, তা হলে পরিণাম ভয়ংকর।

কীরকম?

কীরকম আবার? এক-একটাকে ধরবে, গুলি করবে আর সমুদ্রের জলে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। ওদের অসাধ্য কিছুই নেই। চৌপট্টির মতো জায়গায় একবার এক পরিবারকে গাড়ি থেকে নামিয়ে গুলি করেছিল ওরা।

বাবলু দু হাতে কপাল টিপে বলল, কিছু ভেবে পাচ্ছি না। কী যে করি।

বিলু বলল, তবুও আমরা একবার যোশিজির পরিবারের সঙ্গে দেখা করবই।

ওরা তো বরিভলিতে থাকেন।

হ্যাঁ। একসর তালাও।

বরিভলি স্টেশন থেকে শান্তি আশ্রমের বাসে চাপলেই চলে যাবি। দশ মিনিটের পথ। একটা শিবমন্দিরের পাশে নামবি।

সে আমি চিনিয়ে দেব। চার্চ গেট থেকে ভিরার লাইলে বরিভলি হল বোম্বাই শহরতলির এক উল্লেখযোগ্য স্টেশন। কানহেরি ন্যাশনাল পার্ক হয়ে কানহেরি গুহা দেখতে লোকে ওখানেই যায়। কানহেরির বৌদ্ধ গুহাগুলো আজও দর্শকদের বিস্ময়। তোদের অবশ্য ট্রেন ধরার জন্য চার্চ গেটে যেতে হবে না। মেরিন লাইন্সেই ট্রেন পেয়ে যাবি তোরা। তবে এখনও বলছি, আগুন নিয়ে খেলতে যাস না।

ভোম্বল বলল, আমরা যাবই।

বাবলু বলল, ঠিক আছে যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন তো আর ফেরবার পথ নেই। কাজেই বিপদ যদি আসে তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে। কারও সঙ্গে আমাদের কোনও দুশমনি নেই।

কে বললে নেই? ওদের মুখের গ্রাস তোরা কেড়ে নিয়েছিস, আর বলছিস দুশমনি নেই?

বাবলু বলল, জয় মা-কালী। আর ভাল লাগছে না। একান্তই যদি পালাতে হয়, তা হলে চলুন দেখি, এখন কোথাও থেকে একটু ঘুরে আসি।

সমুমামা বললেন, ঠিক আছে। চল, এদিক-সেদিকে একটু ঘুরিয়ে আনি তোদের।

ওরা ঘরে তালা দিয়ে সবাই বেরিয়ে পড়ল বোম্বাই শহর দেখতে। বাবলু, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছু সবাই। এমনকী, পঞ্চুও বাদ পড়ল না।

আবদুল রহমান স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে বা দিকে বাক নিয়ে প্রথমেই ওরা মুম্বা দেবীর মন্দিরে এল। তারপর জাভেরি মার্কেটের ভেতর দিয়ে সম্পূর্ণ হাটাপথে ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস বায়ে রেখে চলে এল গেটওয়ে অব ইন্ডিয়ায়।

সমুমামা বললেন, এই যে টার্মিনাস দেখলি, সুন্দর ইতালীয় গথিক পদ্ধতিতে তৈরি, এরকম স্টেশন-বিল্ডিংটিও সারা ভারতে আর কোথাও নেই। ১৮৮৮ সালে আই ডব্লু স্টিভেন্স-এর পরিকল্পনায় এটি তৈরি। ভারতের বাষ্পচালিত প্রথম ট্রেনটি এই ভি টি থেকেই রওনা হয়েছিল ১৮৫৩ সালে।

বাবলুরা গেটওয়ে অব ইন্ডিয়ায় এসে ভারতের বুকে লন্ডনকে অনুভব করল। বিদেশ থেকে ভারতে আসার এই প্রবেশদ্বার হল গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া। ১৯১১ সালে রাজা পঞ্চম জর্জ ও রানি মেরি ভারতে আসেন। তাদেরই সম্মানে তৈরি হয়েছিল এই তোরণদ্বার। পরবর্তীকালে সেই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে ১৯২৪ সালে গেটওয়ে অব ইন্ডিয়ার সুদৃশ্য মিনারটি তৈরি হয়। কত লোক যে তখন সমুদ্রের বুকে লঞ্চে বিহার করছে তার ঠিক নেই। কী সুন্দর ছোট-ছোট লঞ্চ।

সমুমামা দূরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ওই যে দেখছিস, সমুদ্রের বুকের ওপর একটা দ্বীপের মতো পাহাড়, ওইখানেই বিখ্যাত এলিফ্যান্টা কেভ। এবারে যা ঝামেলা নিয়ে এসেছিস তাতে এবারে আর হচ্ছে না। পরের বার এলে দেখিয়ে দেব। শীতের সময় আসবি।

মেরিন ড্রাইভ দেখে ওরা হেঁটে হেঁটেই চলে এল আর এক নয়নাভিরাম জায়গায়। এ-জায়গাটার নাম নরিম্যান পয়েন্ট।

সমুমামা বললেন, এইখানে বসে সূর্যাস্ত দেখে লোকে। তবে যেহেতু এখন সিজন টাইম নয়, তাই ট্যুরিস্টের ভিড় এখানে একদম নেই।

বাবলু বলল, কী নির্জন জায়গাটা। তাই না?

বিলু বলল, কী অপরূপ!

আর পঞ্চু যেন বোবা হয়ে গেছে এইসব দেখে। নরিম্যান পয়েন্টে বসে অনেকক্ষণ ধরে ওরা অনেক আলোচনা করল। বাবলু বলল, তুমি আমাদের কাল অথবা পরশু বরিভলির ট্রেনে চাপিয়ে দিয়ো মামা। আমাদের আসল কাজটা সেরে নিয়ে কেটে পড়ব আমরা।

সমুমামা বললেন, বেশ তো! আমি তোদের মেরিন লাইন্স থেকে ট্রেন ধরিয়ে দেব। তোরা বরিভলিতে গিয়ে নামবি। বরিভলি লোকালেই উঠিয়ে দেব তোদের।

ওরা নরিম্যান পয়েন্টে বসে সূর্যাস্ত দেখে এগিয়ে চলল মেরিন ড্রাইভের দিকে বা দিকে সমুদ্র, ডান দিকে আকাশছোয়া অট্টালিকা, সামনে অর্ধচন্দ্রাকৃতি পথ। সেই পথ ধরে দ্রুতগামী মোটর বাস ও ইলেকট্রিক ট্রেনের যাতায়াত। অনেক দূর যাবার পর ওরা মেরিন ড্রাইভের সেই বিখ্যাত উড়ালপুলের কাছে এল।

যেতে যেতেই সমুমামা ডান দিকের একটি বাড়ি দেখিয়ে বললেন, ওই হচ্ছে তারাপোরওয়ালা অ্যাকোয়ারিয়াম। ১৯৫১ সালে আট লক্ষ টাকা ব্যয়ে সামুদ্রিক ও মিষ্টি জলের মাছের এই অ্যাকোয়ারিয়াম তৈরি হয়। যদি সময় পাই তো কাল এটা দেখিয়ে দেব।

সন্ধে উত্তীর্ণ হয়ে রাত্রি হয়েছে তখন। বোম্বাই উপকূল তখন আলোকমালায় হাসছে। সমুমামা বললেন, ওই দেখা যায় মালাবার হিলস। ওখানকার কমলা নেহরু পার্ক দেখার মতো। কিন্তু মুশকিল হল, তোরা তো দেশভ্রমণে আসিসনি, এসেছিস গোয়েন্দাগিরি করতে। কী দেখাই আর কী না দেখাই, তা ভেবে পাচ্ছি না।

যাই হোক, পায়ে পায়ে ওরা বোম্বাইয়ের বিখ্যাত চৌপট্টিতে এসে হাজির হল। কত মানুষের ভিড় যে সেখানে, তার আর সীমা-সংখ্যা নেই। চা কফি ভেলপুরি শিঙাড়া কোল্ড ড্রিঙ্ক—সব-কিছুরই ব্যবস্থা আছে সেখানে। ওরা সবাই ভেলপুরি খেতে খেতে লোকজন দেখতে লাগল।

বাবলু বলল, সমুদ্রটা এখন গভীর অন্ধকারে ডুবে আছে। তাই কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

সমুমামা বললেন, রাত্রিবেলা সমুদ্রতীর এইজন্যই দৃষ্টি আকর্ষণ করে না কারও। যদিও এখানকার সমুদ্রে ঢেউ খুব কম, মানে নিস্তরঙ্গ বলা চলে, তবু সমুদ্র তো। তবে কাল যদি তোরা জুহুতে যাস তো দেখবি ঢেউ কাকে বলে!

না। তার অর্ধেক। তবে জুহু বিচ ভারী মনোরম।

ওরা অনেক রাত পর্যন্ত এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াল। পঞ্চু কখনও ওদের সঙ্গে থাকে, কখনও ঝাউবনে বালিতে গড়াগড়ি খায়। কখনও-বা এর-ওর দেওয়া খাবার খায় মনের আনন্দে। এক মারাঠি ভদ্রলোক তো পঞ্চুকে ভালবেসে দহিবড়া খাইয়ে দিলেন খানিকটা। তারপর ওরা আবার রওনা দিল ঘরের দিকে।

সমুমামা বললেন, ভাগ্য ভাল যে, কোনও অঘটন ঘটল না। আমি তো ভাবলুম এইখানেই একটা কিছু না হয়ে যায়!

বাবলু বলল, সবই মায়ের আশীৰ্বাদ।

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, আমরা তো কেবলই ভাবছিলুম, এই বুঝি আমাদের ধরবার জন্য কেউ বেরিয়ে আসে ঝাউবনের আড়াল থেকে।

ওরা বাড়ি ফেরার আগেই একটা হোটেলে ঢুকে পেট ভরে খেয়ে নিল। তবে পঞ্চু বেচারিকে হোটেলের ওরা কিছুতেই ঢুকতে দিল না ভেতরে। পঞ্চু তাই রাস্তারই একধারে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে রইল।

সে-রাত তো ভালভাবেই কাটল ওদের। পরদিন সকালে নাস্তা সেরে ট্যাকসি নিয়ে চলল সবাই মালাবার হিলসে কমলা নেহরু পার্ক দেখতে। পার্কের মধ্যে ছোটদের ভাল লাগার জন্য মস্ত একটি জুতোর প্রতীক’ ঘরের স্লিপারে নামা-ওঠা করল ওরা। এইখান থেকে ওরা দু’ চোখ ভরে সমুদ্র দেখল। তারপর আবার ট্যাক্সি নিয়ে চলল হাজি আলির সমাধি ও মহালক্ষ্মীর মন্দির দেখতে। তারপর দুপুরের খাওয়া সেরে আবার মেরিন লাইন্সে ফিরে এসে ট্রেন ধরল আন্ধেরির। মাত্র কয়েকটা স্টেশন। তারপরই আন্ধেরি এসে গেল।

সমুমামা বললেন, এই আন্ধেরির দু-চারটে স্টেশন পরেই তোদের বরিভলি। কাল ইচ্ছে করলে তোরা যেতে পারিস। এখন আমি তোদের রাস্তাঘাট চিনিয়ে দিই। কাল-পরশু দুদিন আমি একটু নিজের কাজে ব্যস্ত থাকব। কেন না, বিশ্বকৰ্মা পুজো তো! তার ওপরে গণেশ-চতুর্থী। মহারাষ্ট্র জুড়ে এই গণেশ-উৎসব দেখবার মতো। তোদের ওখানে যেমন বড়-বড় প্যান্ডেল করে দুর্গাপুজো হয়, এখানেও তেমনই বারোয়ারি গণেশ পুজো হয়।

ওরা আন্ধেরি স্টেশন থেকে একটা অটাে নিয়ে সোজা চলে এল জুহু বিচে। তবে সমুদ্রতীরে যাবার আগে ইসকনের মন্দিরটাও একবার দেখে নিল। পঞ্চু বেচারি এখানেও অসহায়। অর্থাৎ, ওকে কেউ ঢুকতেই দিল না ভেতরে।

যাই হোক, ইসকনের মন্দির দেখে ওরা হাজির হল জুহু চৌপট্টিতে। কী চমৎকার জায়গা এই জুহু চৌপট্টি। সি বিচে সাজানো-গোছানো রথের মতো, ঘোড়ায়-টানা, উটে-টানা গাড়ি কেমন লোকজন বসিয়ে ছুটে চলেছে। নাগরদোলা বসেছে। যেন মেলা বসেছে একটা। সবচেয়ে বড় কথা এখানকার সমুদ্রের ঢেউ। কত লোকে কত ছবি তুলছে। মেমসাহেবরা সান বাথ করছে। মাথার ওপর দিয়ে ঘন-ঘন প্লেন উড়ছে।

সমুমামা বললেন, এইখানেই একটু দূরে সান্তাকুজ বিমানবন্দর। বিমান ওঠা-নামা করে এখান দিয়ে। আর এই যে সমুদ্রটা দেখছিস, এর ঠিক ওপারেই আরব দেশ।

সত্যি নাকি?

এমন সময় পিছন থেকে কে বা কারা যেন বলল, হা, মামা ঠিকই বতায়া তুমকো। এই সাগর পার হলেই আরব দেশ। অ্যারেবিয়ান কাস্ট্রি। হাম তো তুমকো হুয়া লে যানেকে লিয়ে আয়া। আও হামারা সাথ।

বাবলুরা দেখল দুজন ভীষণদর্শন লোক মাথায় হ্যাট, টাওয়েল-গেঞ্জি আর পা-গোটানো প্যান্ট পরে গলায় রুমাল বেঁধে ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসছে ওদের দিকে।

ও তো আভি মালুম হো যায়েগা মেরে লাল।

দু’জনের একজন এগিয়ে এসে প্রথমেই একটা ঘুষি দিল সমুমামাকে।

ততক্ষণে জুহু বিচ লোকজনে ভরে গেছে। সবাই হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে চুপচুপ। যেন সিনেমার শুটিং দেখছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় কেউই এগিয়ে আসছে না ওদের দিকে।

ইতিমধ্যে শত্রুপক্ষের আরও লোক এসে ঘিরে ফেলল ওদের। মানুষ তো নয় ওগুলো। ঠিক যেন যম। আর পঞ্চুকে সামলানো গেল না। সে তখন তারও আদেশের তোয়াক্কা না করেই বিকট একটা ডাক ছেড়ে লাফিয়ে পড়ল একজনের ঘাড়ে। কিন্তু পড়লে কী হবে? পরক্ষণেই আর-একজন একটি নাইলনের জাল দিয়ে ঢেকে ফেলল পঞ্চুকে। পঞ্চুর চিৎকারে জুহু বিচ চমকে চমকে উঠল। ওরা তখন জালে জড়ানো পঞ্চুকে বাঁই বাঁই করে কয়েক পাক ঘুড়িয়ে ছুড়ে দিল সমুদ্রের জলে।

বাবলুরা হায় হায় করে উঠল। বাচ্চু আর বিচ্ছুকে তখন দুজন লোক টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে তুলল একটা ট্যাক্সিতে। বিলু আর ভোম্বলকে ধরল আরও দু’জন।

আর বাবলু? বাবলুর হাতে তখন সূর্যের রোদ লেগে চকচক করছে ওর পিস্তলটা। সে আর কালবিলম্ব না করে ওর দিকে এগিয়ে আসা লোকদুটোকে গুলি করল। বিশাল শরীর লোকদুটো ভাবতেও পারেনি এমন অঘটন ঘটবে বলে। কলাগাছের গুড়ির মতো দুটাে ভারী লাশ ধূপ-ধাপ করে লুটিয়ে পড়ল বালির ওপর।

সমুমামা অতিকষ্টে উঠে দাঁড়িয়েছেন তখন। ইতিমধ্যে একজন ফরেনার জালে বাধা পঞ্চুকে জল থেকে টেনে তুলেছেন। পঞ্চু বেচারি ভয়ে কাপতে কাপতে কোনওরকমে গা ঝাড়া দিয়ে বালিতে একটু লুটোপুটি খেয়েই ছুটে এল বাবলুর কাছে।

ততক্ষণে অনেক লোকজনও ছুটে এসেছে বাবলুর কাছে। বলল, ভাই, তুম যে কাম কিয়া ও ঠিকই কিয়া। লেকিন আভি তুম ভাগো হিয়াসে। নেহি তো আউর আদমি আ যায়েগা ও লোক মার ডালেগা তুমকো।

বাবলু বলল, এরা কারা?

আরে বাবা, লোদি কা আদমি, ডেভিড লোদি। তুম দের মাত করো। ভাগো হিয়াসে।

বাবলু আর সমুমামা বিচের ওপর থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ঝড়ের বেগে উড়ে চলল আন্ধেরির দিকে।

সমুমামা বললেন, আমি জানতাম এইরকমই একটা ঘটনা ঘটবে। কে যে তোদের মনে এইসব বদ বুদ্ধি ঢোকাল তা ভাগবানই জানেন। দু-চারটে ছিচকে চোর ধরে তোরা নিজেদের শের ভাবছিস। এখন কী করবি?

সমুমামার বিদ্রুপাত্মক কথাগুলো মুখ বুজে হজম করল বাবলু। এ ছাড়া উপায়ই বা কী? এই ভয়ানক গোলকধাঁধার শহরে বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছুকে যে কোথায় নিয়ে গেল ওরা, তা কে জানে? ওরা যে ওদের কোথায় লুকিয়ে রাখবে বা খুন করে ফেলে দেবে তাই বা জানে কে?

সমুমামা বললেন, শোন, আমি আর তোদের কোনও দায়িত্বই নিতে পারব না। আর এই ব্যাপারে থানা-পুলিশ করেও কোনও লাভ নেই। তুই আজই রাতের গাড়িতে বাড়ি চলে যা। আমি জামাইবাবুকে এক্ষুনি ট্রাঙ্ককলে সব কথা জানিয়ে দিচ্ছি। তুই কিন্তু আর এক মুহুর্ত এখানে থাকবি না।

বাবলু বলল, যা আপনি বলবেন তাই হবে।

আন্ধেরি স্টেশনে ট্যাক্সি থামল। ট্যাক্সি থেকে নেমে বাবলু বলল, মামা, আপনি একাই বম্বেতে ফিরে যান। আমি আজ ফিরছি না।

সে কী! এই অচেনা জায়গায় কোথায় যাবি তুই?

যেখানেই যাই না কেন ভি টি-তে যাচ্ছি না। তবে যদি ওদের সন্ধান পাই বা কোনওরকমে ওদের উদ্ধার করতে পারি, তবেই ফিরব। নচেৎ নয়। আপাতত এই আমাদের শেষ দেখা।

সমুমামা বললেন, ডোন্ট বি সিলি, বাবলু। বাবলু সমুমামার দিকে আর ফিরেও না তাকিয়ে কোথায় হারিয়ে গেল সেই আন্ধেরির ভিড়ে। পঞ্চু অবশ্য সঙ্গেই রইল ওর।

বাবলু কাউন্টারে গিয়ে বরিভলির টিকিট কেটে পঞ্চুকে নিয়ে ট্রেনে উঠল। উঃ, সে কী ভিড় ট্রেনে। ঘরে-ফেরা ডেলি প্যাসেঞ্জারের ভিড়। এই ট্রেনটা বরিভলি ছাড়াও ভিরা পর্যন্ত যাবে। পঞ্চু বহুকষ্টে ঠেলেঠলে ভেতরে ঢুকল। মাত্র দু-চারটে স্টেশন। তারপরই বরিভলি এসে গেল।

এখানে গেটে কোনও চেকার নেই। তাই গেট পার হতে কোনও ঝামেলাও নেই। বরিভলিও অত্যন্ত ঘিঞ্জি এবং ব্যস্ত শহর ও স্টেশন থেকে বেরিয়েই একটা অটো ভাড়া করল। অটো ড্রাইভারকে একসর তালাও নাম বলতেই ফুল স্পিডে অটাে চালিয়ে দিল সে।

তখন সন্ধে উত্তীর্ণ হয়ে রাত্রি হয়েছে।

বাবলুর মনে সংশয়। তবুও এই মুহুর্তে এখানে আসার মূলে ওর একটাই উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্যটা এই মিস্টার যোশি যে ধরনের ধনী লোক, তাতে মনে হয় খুব একটা দুর্বল লোক নন উনি। অতএব তাঁর পরিবারবর্গের হাতে হিরেগুলো ফিরিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিলে তাঁরা কি ওকে লোকজন দিয়ে সাহায্য করবেন না? যাতে করে লোদির কবল থেকে সকলকে ও মুক্ত করতে পারে? কিছু না করুন, শয়তানের ঘাঁটিটাও যদি চিনিয়ে দেয় ওরা, তা হলে নিজের জীবন দিয়েও ওই কালপ্রিটের জীবনান্ত ও করবেই।

অটো একসময় একসর তালাওয়ের শিবমন্দিরের সামনে থামল। বাবলু ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ভাবল এইবার ও কোন দিকে যাবে? পিচ-ঢালা বড় রাস্তাটা ডান দিকে বাক নিয়ে চলে গেছে শান্তি আশ্রমের দিকে। এখানে শুধু সারি-সারি ফ্ল্যাটবাড়ি। আর সামনের দিকে ছোট্ট একটি টিলা পাহাড়কে ঘিরে এক ঘিঞ্জি বস্তি। মহারাষ্ট্র এবং অন্ধের লোকই বেশি এখানে। রাস্তায় দাড়িয়ে একজন পথচারিকে মি, যোশির নাম বলতেই সেই বস্তির ভেতরের গলি-রাস্তাটা দেখিয়ে দিলেন তিনি।

বাবলুর সন্দেহ হল খুব। কেন না, সমুমামার মুখে ও শুনেছে মি. যোশি একজন বিত্তবান ব্যক্তি। অতএব সেই লোকের বাড়ি এই ঘিঞ্জি বস্তির ভেতর কী করে হবে? তবু ও আরও দু-একজনকে জিজ্ঞেস করে এবং সকলের কাছ থেকে একই নির্দেশ পেয়ে সেই গলিপথেই এগিয়ে চলল। গলির একেবারে শেষ প্রান্তে আবার প্রশস্ত রাজপথ। আর সেই রাজপথের ধারেই প্রাসাদোপম এক সুবিশাল অট্টালিকা। অর্থাৎ, এই রাজপথ বেঁকে ওদিক থেকে এদিকে এসেছে। আর এই বস্তির গলিটা একটা শর্টকাট রাস্তা ছাড়া কিছুই নয়।

বাবলু সেই বাড়ির সামনে গিয়ে দেখল নেমপ্লেটে লেখা আছে—মি. এস এম যোশি। অর্থাৎ এই সেই বাড়ি।

বাবলু ডোর বেল টিপতেই একজন বুড়ো দারোয়ান বেরিয়ে এল ঘর থেকে। তারপর কোনও কথা না বলে বাবলুর মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ।

বাবলু বলল, এটা কি মি. যোশির মকান?

বৃদ্ধ ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ।

বাড়ির কাউকে একটু ডেকে দিন তো!

অন্দর আইয়ে।

বাবলু পঞ্চুকে নিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকল। একেবারে বিলাসবহুল সুসজ্জিত ঘর। দেওয়াল-ঘড়িতে রাত দশটা বাজল। অবশ্য এইসব অঞ্চলে এটা এখন সন্ধে-রাত। কেন না, এখানকার লোকেরা রাত একটা-দেড়টার আগে কেউ ঘুমোয় না। বাবলু ঘরে ঢুকে একটি আরাম-কেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে বসল।

একটু পরেই এক দীর্ঘদেহী সুদর্শন পুরুষ এসে ঘরে ঢুকলেন। কী সুন্দর ভারিক্কি চেহারা তার ঘাড় পর্যন্ত লটকানো বাবরি চুল। ইয়া মোটা গোফ গলায় সোনার হার। হাতে নাম-লেখা পদক। জালি গেঞ্জি ও ধুতি পরা সেই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষটি বাবলুর সামনে এসে বসলেন। তারপর ওর আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বললেন, কোন হো তুম?

আমি বাবলু। কলকাতার দিক থেকে আসছি। মি. যোশির ব্যাপারে একটা খবর ছিল।

তুমি বাঙালি? কিন্তু বয়স তো খুব কম তোমার। এত অল্প বয়সে এত রাতে একা এই বোম্বাই শহরতলিতে, ব্যাপারটা কী?

বাবলু বলল, সে অনেক কথা। কিন্তু আপনি বেশ ভাল বাংলা বলতে পারেন তো?

পারি বলেই তো বললাম। না হলে কী করে বলতাম?

আমি মি. যোশির পরিবারের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

বেশ তো, বলো।

আপনি?

আমিই মি. যোশি।

বাবলু হতাশ হয়ে বলল, তা হলে বোধ হয় আমি বাড়ি চিনতে ভুল করেছি।

মোটেই ভুল করেনি। এই অঞ্চলে যোশি-পরিবার একটাই আছে, এবং সেটা এই বাড়িতেই।

না, মানে আমি তো জানি তিনি মৃত।

মি. যোশি হাঃ-হাঃ-হাঃ-হাঃ করে হেসে বললেন, মৃত লোক কখনও কথা বলতে পারে? তার ওপর এইভাবে মুখোমুখি বসে?

বাবলু বলল, আমার সব কীরকম গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।

কেন, গোলমাল হবার কী আছে? তুমি মি. যোশির কাছে এসেছ। মি. যোশি তোমার সামনে বসে আছেন। পুলিশি রিপোর্টে জেনেছি, তোমরা পাঁচ বন্ধু এবং তোমাদের একটি কুকুর নাকি আমার শক্রদের রীতিমতো ঘায়েল করেছে। তবে আমার ম্যানেজার এবং দু’জন লোক খুন হয়েছে।

যিনি মারা গেলেন তিনি তা হলে আপনার ম্যানেজার?

হ্যাঁ। খুব ভাল লোক। একজন সদাচারী ব্রাহ্মণ।

কিন্তু তিনি যে নাম বললেন মি. এস এম যোশি?

আসলে মরবার সময় বলেছেন তো? তার পরিচয় দিতে গেলে আমার নাম-ঠিকানা বলবার আর সময় পেতেন না। তোমরা ধরে নিয়েছিলে মি. যোশি তারই নাম।

ঠিক তাই। অবশ্য এই ধরে নেবার আরও একটা কারণ ছিল। উনি মরবার আগে কতকগুলো মূল্যবান জিনিস আমাদের দিয়ে যান। এবং বলেন, ওতে যা আছে তার অর্ধেক আমাদের এবং বাকিটা যোশি-পরিবারের হাতে তুলে দিতে। তাতেই আমরা ধরে নিয়েছিলাম উনিই মি. যোশি।

উনি তোমাদের হাতে চব্বিশটা হিরে তুলে দিয়েছিলেন, এই তো? তা ঠিকই বলেছেন উনি। আমি যে মুহুর্তে বুঝতে পেরেছিলাম ওই পলাতক চোরটির পিছনে ডেভিড তার লোভের থাবা এগিয়ে দিয়েছে তখনই ধরে নিয়েছিলাম ও জিনিস আমাকে আর ফেরত পেতে হবে না। তাই বলছিলাম, যদি ওগুলো তুমি উদ্ধার করে আনতে পারো তা হলে এর অর্ধেক ভাগ তোমার। সেই হিসেবেই তিনি মরবার আগে তার প্রাপ্যটা তোমাদের নিতে বলেছেন। তা বাবা, তোমরা যে দারুণ বিপদের ঝুঁকি নিয়ে ওগুলো উদ্ধার করেছ তাতে আমি অভিভূত। তোমরা ওই সময় না থাকলে ওই হিরেগুলো ডেভিডের লোকেরাই মেরে দিত। তুমি কি ওগুলো নিয়ে এসেছ?

না। আমাদের পিছনে ভীষণভাবে লোক লেগেছে। যদি ওগুলো পথেই ছিনতাই হয়, সেই ভয়ে আনিনি।

খুব ভাল করেছ। তবে আমি কিন্তু পুলিশি রিপোর্টে শুনলাম ওই মালগুলো নাকি আদৌ পাওয়া যায়নি। ওখানকার পুলিশ তোমাদের বাড়িও নাকি সার্চ করেছিল। অথচ এদিকে ডেভিডের লোকেরাও ওগুলো পায়নি। না পেয়ে তোমাদের ওপর অত্যাচারও করেছে খুব।

বাবলু বলল, আপনি এইটুকু সময়ের মধ্যে এত খবর কী করে পেলেন? আমরা ইচ্ছে করেই হিরে পাওয়ার খবর পুলিশকে বলিনি। পুলিশের হাতে ও মাল পড়লে হয়তো পুলিশ ওগুলো বাজেয়াপ্তই করে দিত। কিন্তু আমার একটাই বক্তব্য, ওই ডেভিড-শয়তানকে কি কিছুতেই ঘায়েল করা যায় না?

কেন যাবে না? কেউ কিছু করার চেষ্টা করেনি, তাই এত দাপট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর আমরা তো বিজনেসম্যান, সেইজন্যে ওইসব লোকেদের ঘাটাই না। ওর বাহিনী বিরাট। তবে ও যখন একবার আমার দিকে থাবা বাড়িয়েছে তখন আর ওর নিস্তার নেই। আমি শনির মতন লেগে থাকব ওর পিছনে। তবে মুশকিল হয়েছে কী জানো? ওর থাকার কোনও নির্দিষ্ট জায়গা নেই। ওর পাকাপোক্ত ডেরা আছে। কিন্তু ওকে কোথাও পাওয়া যায় না।

তবে যে শুনলাম জুহুতে হোটেল প্রিন্সে উনি থাকেন।

আরে ওটা তো ওর নিজেরই হোটেল। কিন্তু হোটেল থাকলে কী হবে? ও কি থাকে? ওর নিজস্ব প্লেন আছে। যেখানে-সেখানে উড়ে যায়। তা তোমার আর সব বন্ধুরা কোথায়?

বাবলুর দু’চোখে তখন জল এসে গেছে। অতিকষ্টে জুহু বিচের সমস্ত ঘটনাটা খুলে বলল ও মি. যোশিকে। যোশি বললেন, ঘাবড়াও মাত। আমি তো আছি। দেখছি আমি কীভাবে কী করা যায়। বাবলু বলল,

মুশকিল হল, আমি যে এখানকার কিছুই চিনি-জানি না। সম্পূর্ণ অপরিচিত শহর।

মি. যোশি গম্ভীর হয়ে পাশের ঘরে উঠে গিয়ে টেলিফোন ধরলেন, হ্যালো, হ্যালো, আন্ধেরি পুলিশ-স্টেশন।

ওদিক থেকে কী যেন উত্তর আসতেই মিঃ যোশির গলা শোনা গেল, আজ জুহুমে ক্যা হো গিয়া কুছ পতা হ্যায়?

ওদিকের কথা শোনা গেল না।

আরে মার্ডার কা বাত ছোড়ো ইয়ার। মরনে দো ও বদমাশকো। লেকিন উস বাচ্চেকো ক্যা হুয়া? এসব কাম পাবলিককো করনা পড়েগা? …নেহি নেহি, হাম কুছ ভি নেহি শুনেঙ্গে। জলদি উস বাচ্চেকো তালাশ করো আউর হামারা কোঠিমে লে আও।

টেলিফোন নামিয়ে রেখে যোশিজি আবার এ-ঘরে এলেন। এসে ডাকলেন, কামাল! এ কামাল!

কামাল নামে একজন দুর্দান্ত চেহারার লোক এগিয়ে এসে বলল, ফরমাইয়ে সাব।

যোশিজি তাকে ডেকে নিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে কী যেন বলতেই লোকটি একবার তাকিয়ে দেখল বাবলুকে। তারপর একটুও দেরি না করে ভেতর বাড়িতে ঢুকে গেল। পরক্ষণেই দেখা গেল জনাচারেক সাংঘাতিক চেহারার লোক মুখে কাপড় বেঁধে বন্দুক কাঁধে দ্রুত বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

এমন সময় বাবলুরই বয়সি চোদ্দো-পনেরো বছরের একটি কিশোরী মেয়ে হাসি-হাসি মুখে ডিশ-ভর্তি খাবার নিয়ে ঘরে এল। তারপর বাবলুর সামনে টি-টেবিলে নামিয়ে রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

মি. যোশি বললেন, বাবলু, তোমার বন্ধুদের উদ্ধারের জন্যে আমার লোকেরা গেছে। পুলিশও চেষ্টা করছে ওদের সন্ধান নেবার। এখন দেখা যাক, কতদূর কী হয়। যদি ওরা ওদের প্রাণে না মারে, তা হলে ফিরিয়ে আমি আনবই। আর তারপরই হবে ডেভিডের সঙ্গে আমার শেষ বোঝাপড়া।

দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে মি. যোশি বললেন, সুন্দরী, তুম বাবলুকো খেয়াল রাখ না। আজ সে ও হিয়া রহেগা। দিদিকে আনে দো। দিদি আ যানে সে উসকো দেখভাল দিদি করেগী।

নিদারুণ মানসিক উত্তেজনায় বাবলুর তখন কোনও কিছুই খেতে ইচ্ছে করছিল না। তবু যা ছিল তাই পঞ্চুকে ভাগ দিয়ে খেতে হল।

সুন্দরী বসে থেকে সব-কিছু খাওয়াল ওকে। মি. যোশি বললেন, এখানে তুমি কোনওরকম লজ্জা কোরো না বাবলু। এটা তোমার নিজেরই ঘর মনে করবে। শুধুমাত্র তোমার জন্যই ওই বহুমূল্য হিরেগুলো শয়তানদের হাতে পড়তে পেল না। ওই হিরের অর্ধেক তোমার। বাকি আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসব।

বাবলু বলল, অর্ধেক কেন? সবই আপনি ফেরত নিন। অতগুলো হিরে নিয়ে আমারই বা কী করব? আপনি শুধু একটু চেষ্টা করুন যাতে আমার বন্ধুদের উদ্ধার করে আনা যায়।

এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল পাশের ঘরে। মি. যোশি হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, নিশ্চয়ই কোনও সুখবর আছে। থানা থেকে ফোন এসেছে নিশ্চয়ই। বলে পাশের ঘরে গিয়ে রিসিভার কানে লাগিয়ে বললেন, মি. যোশি ম্পিকিং…হোয়াট? নো, নো। ইমপসিবল। এ কভি নেহি হে সকতা। নেহি নেহি নেহি৷ মি. যোশির হাত থেকে রিসিভারটা খসে পড়ল।

অবস্থার গুরুত্ব বুঝে ঠাকুর-ভৃত্য-দারোয়ান যে যেখানে ছিল সবাই এসে দাঁড়াল তার পাশে। ভয়ে বুক টিপ-টিপ করতে লাগল বাবলুর। কী হল মি. যোশির? ওদের কোনও খারাপ খবর নয় তো? কিন্তু তা যদি হয় তা হলে সেই খবরে উনি এত বিচলিত হয়ে পড়বেন কেন?

সুন্দরী পাশের ঘরে গিয়ে সব-কিছু জেনে এসে বলল, সর্বনাশ হো গিয়া দাদা।

কী হল?

দিদিকা অ্যাকসিডেন্ট হো গিয়া।

মেরা মতলব সবকা দিদির। ম্যায় তো কাম করতা হিয়া পর। নোকরানি।

কীভাবে অ্যাকসিডেন্ট হল?

মালুম নেহি! লোনাভালাকে পাস মোটর খাদমে গির গিয়া। ড্রাইভারকা বডি মিলা, লেকিন দিদিকা লাশ নেহি মিলা।

মিনিট-দশেক বসে থাকার পর বাবলু দেখল মি. যোশি একেবারে সুটেড বুটেড হয়ে বেরিয়ে এলেন। তার সঙ্গে দু’জন বলবান লোকও চলল। মি. যোশির মুখের দিকে আর তাকানো যাচ্ছে না তখন। কী ভয়ংকর মূর্তি তার। মি. যোশি বললেন, বাবলু, তুমি নির্ভাবনায় বসে থাকো এখানে। সুন্দরী তোমার সব-কিছুর ব্যবস্থা করে দেবে। কোনও অবস্থাতেই এখন ঘর থেকে বেরোতে যাবে না তুমি। শুনেছ বোধ হয় আমার মেয়ের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে?

শুনেছি।

কিন্তু আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। মেয়েটাকে ওরা গুম করে ড্রাইভারকে গাড়িসুদ্ধ খাদে ফেলে দিয়েছে। আমি একবার থানায় দেখা করে লোনাভালায় যাচ্ছি।

বাবলু বলল, আপনি আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আমি তো নিরাপদেই আছি। আমি ঠিক থাকব।

মি. যোশি চলে গেলেন। বাবলু চুপচাপ বসে রইল পঞ্চুকে নিয়ে। ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজল। বাইরে কোথাও টাইমকলে জল এসেছে বোধ হয়। সেই জল নেবার জন্য বস্তির লোকেদের লাইন পড়েছে। তাদেরই গলাবাজিতে সরব চারদিক।

একটু পরে সুন্দরী এসে বলল, দাদা, আভি খানা খাওগে তুম?

না রে। এই তো একটু আগে খেলাম। আমার একদম খিদে নেই। আজ আর কিছু খাব না।

তুমকো ক্যা হো গিয়া দাদা?

সে তুই বুঝবি না রে।

সুন্দরী বাবলুর মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসল।

বাবলু বলল, নামের সঙ্গে তোর চেহারারও একটা অপূর্ব মিল আছে। এ-বাড়িতে কতদিন কাজ করছিস?

পাঁচ সাল।

তুই মারাঠি?

নেহি। ম্যায় বিলাসপুরকা।

তা হলে এখানে তুই কী করে এলি?

দাদা, ও যো লোদি আছে না, ও মেরা মাতা-পিতাকো মার ডালা। আউর হামকো লেকে ভাগা। মেরা পিতাজি খাণ্ডোয়াকা ব্যাঙ্ক ম্যানেজার থা। ও লোগ হুয়া ডাকাইতি করনে গিয়া। তো মেরা পিতাজি নে বাধা দিয়া। ইসি ওজোঃসে মার ডালা উনকো।

তারপর তুই এখানে কী করে এলি?

ইধার যো গোরাইখেড়ি হ্যায় না, ও লোগোনে হুয়া পরা রাখা তা হামকে। হাম হুয়াসে ভাগকে আয়া। ওহি টাইম দিদি হুয়াপর পিকনিকমে গিয়া। ব্যস, মেরা সাথ পরিচয় হো গিয়া আউর হামকো লে আয়া হিয়া পর।

সেই থেকেই তুই এখানে আছিস, এই তো?

হ্যাঁ।

আমার দলের দুটি ছেলে আর তোর মতো দুটি বোনকে জুহু বিচ থেকে তুলে নিয়ে গেছে লোদির লোকেরা।

তব তো ও জরুর গোরাইখেড়িমে হোগা। হুয়া লোদিকা এক মকান হ্যায় সমুন্দর কা পাশ। হুয়া সবকো রাখতা আউর আরবমে ভেজ দেতা।

এমন সময় ঝড়ের বেগে মি. যোশির দু’জন লোক বিলু আর ভোম্বলকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। বলল, দো মিল গিয়া আউর দোনো আভি মিল যায়েগা। লেকিন তুম বাহার মাত যাও। বাবু কাহা?

সুন্দরী বলল, দিদিকা অ্যাকসিডেন্ট হো গিয়া। লোনাভালাকে পাশ। হুয়া চলা গিয়া।

কোন বতায়া?

পুলিশনে।

সাথ মে কৌন গিয়া?

বিরজু আউর শান্তাপ্রসাদ।

ঠিক হ্যায়। দরোয়াজা বন্ধ কর দো। আউর শুনো, কামালকো গোলি লাগা। হাম উসকে ডক্টরকা পাশ ভেজা। হামারা আনেমে দের হোগা।

ওরা চলে গেল।

বিলু আর ভোম্বল বোবার মতো বসে রইল সোফার ওপর। ওরা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল বাবলুর দিকে।

বাবলু ওদের চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখে বুঝল প্রচণ্ড মারধোর করা হয়েছে ওদের। ভোম্বলের নাকের কাছটা ফোলা-ফোলা, বিলুর কপালে বড় একটা কালশিটে।

বাবলু বলল, এ কী অবস্থা হয়েছে তোদের?

খুব মেরেছে।

না, ওদের মনে হয় অন্য কোথাও রেখেছে।

তোরা কোথায় ছিলি?

আমরা জুহুতেই ছিলাম। লোদির ফাইভ স্টার হোটেলে। ওরা একটা ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে খুব মারধোর করেছে আমাদের। বারবার জানতে চেয়েছে হিরেগুলো আমরা পেয়েছি কি না, পেয়ে থাকলে কোথায় রেখেছি।

তোরা কী বললি?

বললাম, পেয়েছি। তবে ওগুলো এখন আমাদের কাছে নেই। আমাদের বাড়ির কাছেই এক জায়গায় লুকিয়ে রেখেছি। আমাদের সবাইকে বাড়ি পৌছে দিলে এবং আর মারধোর না করলে ওগুলো দিয়ে দিতে পারি।

ঠিক বলেছিস। লোদিকে দেখলি?

না। শুধু ওর লোকেদেরই দেখেছি। তবে যেহেতু আমরা ওর লোকেদের মেরেছি সেহেতু ওরাও নাকি আমাদের মেরে ফেলবে বলে শাসিয়েছে।

তা হলে হিরে পাবে কী করে?

তা জানি না। কিন্তু পঞ্চুকে তুই উদ্ধার করলি কী করে? তুই এখানে কী করে এলি?

সেসব পরে শুনবি। এখন তোদের কথা বল।

আমাদের আর কী কথা? লোদির লোকেরা যখন আমাদের মারধোর করছে তেমন সময় হঠাৎ চারদিকে দুমদাম গুলির শব্দ। এমন সময় দেখি এই বন্দুকধারী লোকগুলো হুড়মুড় করে আমাদের ঘরে ঢুকল। তারপর যে লোকগুলো আমাদের মারছিল তাদের গুলি করে ধরে নিয়ে এল আমাদের। ওদেরই মুখে শুনলাম মি. যোশির বাড়িতে তুই আছিস।

এবং মি. যোশি জীবিত। আমরা যার কাছে থেকে হিরেগুলো পেয়েছি, তিনি যোশির ম্যানেজার।

বলিস কী!

বাবলু বলল, হ্যাঁ।

তারপর সুন্দরীকে বলল, তোদের ঘরে কোনও ওষুধ বা ফাস্ট এডের ব্যবস্থা আছে রে?

সুন্দরী কিছু না বলে পাশের ঘরে চলে গেল। তারপর ফোনে সম্ভবত কোনও ডাক্তারকে কল দিয়ে কাছে এসে বিলু ভোম্বলকে বলল, কুছ খাওগে তুম?

ভোম্বল বলল, হ্যাঁ। খুব খিদে পেয়েছে। শুধুমার ছাড়া আর কিছু খাইনি আমরা।

সুন্দরী চলে গেল। তারপর দুটো প্লেট ভর্তি করে খাবার সাজিয়ে ওদের জন্য নিয়ে এল। ওদের জন্য মানে বিলু আর ভোম্বলের।

ওরা খাওয়া শেষ করতেই একজন ডাক্তার এলেন। তারপর সামান্য একটু স্টিচিং করে কয়েকটা ওষুধ দিয়ে চলে গেলেন।

সুন্দরী পাশের ঘরে ওদের শোবার ব্যবস্থা করে এসে বলল, তুম সব আরাম করো দাদা।

বাবলু বলল, আমার ঘুম আসছে না রে। যতক্ষণ না বাচ্চু-বিচ্ছুর খবর পাই, ততক্ষণ ঘুম আসবে না।

বাচ্চু-বিচ্ছু কৌন?

তোরই মতো ফুটফুটে দুটি মেয়ে। আমাদের বোনের মতো। ডেভিডের লোকেরা ওদেরও ধরে নিয়ে গেছে।

তব তো ও জরুর গোরাইখেড়িমে হোগা ও লোগ খানদানি ঘর কি লেড়কি কো চুরাকে লে আতা ঔর গোরাইখেড়িমে ভেজ দেতা।

তারপর?

উসকে বাদ আরব দেশমে পাচার করতা সবকো ও লোদি গোরাইখেড়িমে হ্যায়।

বাবলু এবার সোজা হয়ে বসে বলল, গোরাইখেড়িটা কোথায়? আমি যাব।

বহুত দূর হিয়াসে। লেকিন আভি তুম হুয়া জানে নেহি সকোগ। উধার তুমকো কুছ হো যায়েগা তো বাবুজি বহুত নারাজ হোগা হামসে।

বাবলু বলল, তোর কোনও ভয় নেই সুন্দরী। তুই আমাকে রাস্তাঘাট বলে দিলে আমি ঠিক চলে যাব। দেরি করলে যদি ওরা সত্যিই পাচার করে দেয় ওদের তা হলে?

জরুর দেগা।

তবে?

লেকিন হুয়া পর সমুন্দর হ্যায়। তুমকো সমুন্দর পার হোনে পড়েগা। ও এক ছোটাসা দ্বীপ হ্যায়।

বাবলু সুন্দরীর একটি হাত ধরে বলল, সুন্দরী, তুইও আমার আর-এক বোন। তুই কি চাস না তোর অন্য সব বোনেরা ফিরে আসুক?

সুন্দরী ঘাড় নেড়ে জানাল, হ্যাঁ।

তা হলে তুইও আমার সঙ্গে চল না। তোর কোনও ভয় নেই। এই দ্যাখ, আমার কাছে পিস্তল আছে। সঙ্গে কুকুর আছে। পুলিশের দেওয়া পিস্তল এটা। লাইসেন্স আছে। বেকায়দায় পড়লে আমি টিসুম-ঢুসুম চালাতে পারি বুঝলি?

লেকিন দারোয়ানজি কিসিকো যানে নেহি দেগা।

বিলু, ভোম্বল বলল, আমরাও কিন্তু যাব বাবলু তোর সঙ্গে।

সুন্দরী কী করবে কিছু ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইল। বাবলু বলল, শোন তবে, কী করে কী করবি বলে দিই। আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে যাই। তুই দরজায় খিল দে। তারপর ওপরে গিয়ে ঝুলবারান্দার রেলিংয়ে একটা দড়ি বেঁধে ঝুপ করে নেমে পড়। কেউ টের পাবে না।

সুন্দরী আর একটুও দেরি না করে ওদের বার করে দিল। তারপর তরতর করে উঠে গেল ওপরে। কিশোরী মেয়ের রক্তে এবার অ্যাডভেঞ্চারের নেশা জাগল।

এত রাতে পথ খুব নির্জন। অধিকাংশ দোকানপাটও বন্ধ হয়ে গেছে। বাবলুর পরিকল্পনামতো সুন্দরী ওইভাবেই পালিয়ে এল। প্যান্ট-শার্ট পরে ওকে এখন বেশ স্মার্ট দেখাচ্ছে। ওরা একসর তালাওয়ের সেই শিবমন্দিরের কাছে আসতেই একটি অটো দেখতে পেল।

সুন্দরী বলল, গোরাইখেড়ি ঘাট। জলদি চলো।

ড্রাইভার বলল, নেহি। ইতনা রাতমে উধার হাম নেহি যাউঙ্গা।

সুন্দরী হাতজোড় করে বলল, আরে বাবা চলো না।

কিতনা উমর তুমহারা? ইতনা রাতমে কাহে কো হুয়া যাতা?

সুন্দরী একটু লজ্জা পেয়ে বলল, বুরা মাত সমঝো দাদা। হামারা দে বহিন খো গিয়া হুয়া পর। ম্যায় যোশিজিকা মকানমে কাম করতা হু।

এইবার কাজ হল। অটো ওদের সকলকেই তুলে নিয়ে খানিকটা আলোর পথ পার হয়ে অন্ধকার নির্জন পথে এগিয়ে চলল। অন্ধকার বলতে যে একেবারে ঘন অন্ধকার তা নয়। রাস্তায় আলো আছে। তবে পথের ধারে কোনও ঘরবাড়ি না থাকায় অন্ধকার একটু বেশি। দু’পাশে ফাঁকা মাঠ। যেতে যেতে কত কথাই ভাবতে লাগল বাবলু। এক অজানা আশঙ্কায় ওর বুক দুরু-দুরু করতে লাগল। এত কষ্টের পরও যদি বাচ্চু-বিচ্ছুকে না পাওয়া যায়? যদি ওরা ওদের এতক্ষণে আরব দেশে পাঠিয়েই দিয়ে থাকে? এইসব চিন্তা ওর মনের ভিতর তোলপাড় করতে লাগল।

এক সময় গোরাইখেড়ির নির্জন ঘাটে পৌছে গেল ওরা। জনপ্রাণী নেই সেখান। সামনে সমুদ্রের খাড়ি। ওপারে জঙ্গলময় দ্বীপ। সমুদ্রে এখন জোয়ার এসেছে। তাই খাড়ির জল ফুলছে।

সুন্দরী হেঁকে বলল, ইধার কোই হ্যায়?

কারও কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

পঞ্চু একটা হাক দিল এবার, ভৌ। ভোঁ ভৌ।

এমন সময় পাশের একটি গুমটি ঘরের ভেতর থেকে একজন লোক টলতে টলতে এসে বলল, এই কৌন হো তুম। ভাগো হিঁয়াসে। লঞ্চ বন্ধ হো গিয়া। নেহি যায়েগা। ভাগো।

সুন্দরী বলল, সবকে পার কর দো ভাই। জলদি করো। বহোত জরুরি কাম হ্যায় হুয়া পর।

লোকটি এবার রেগে বলল, এই লেড়কি, হাম পুলিশকে ফোন করেগা। যাও। ভাগো হিয়াসে।

আসলে দোষ কারও নেই। এই গোরাইখেড়ি হল বোম্বাই উপকূলে বরিভলি সীমান্তে এক মনোরম দ্বীপ। ভটভটি লাগানো নৌকোয় করে ওপারে যেতে হয়। লঞ্চও আছে। চারদিকে অসংখ্য টিলা আর নারিকেল কুঞ্জে ভরা এই দ্বীপটির সৌন্দর্য অপরিসীম। এই সুন্দর দ্বীপের কথা সাধারণ লোক জানে না। তাই আসে না। তবে বোম্বাই শহরতলির বহু লোকজনই এই দ্বীপে পিকনিক অথবা প্রমোদভ্রমণে এসে থাকেন। এই দ্বীপের বাসিন্দাদের অনেকেরই চেহারা গোয়ানিজদের মতো। এরা ধীবর এবং খ্রিস্টান।

যাই হোক, বাবলুরা অনেক করে বোঝাতে লাগল লোকটিকে। কিন্তু ভবি ভোলবার নয়।

লোকটি বলল, আরে ভাই তুম পাগল হো গিয়া ক্যা? হুয়া বহোতই খারাপি কাম হোতা। চৌদ-পন্দরো সাল কা লেড়কিকো ইতনা রাতমে উধার যানা ঠিক নেহি।

বাবলু বলল, সে আমরা বুঝব। তুমি নিয়ে তো চলো।

লোকটি এবার আর একটা খারাপ কথা বলতেই বিলু আচমকা ওর মুখে মারল এক ঘুষি।

বাবলু পিস্তলটা ওর বুকে ঠেকিয়ে বলল, লঞ্চ স্টার্ট করো। না হলে ভোগে পাঠিয়ে দেব একেবারে।

আর পঞ্চু? সে এক-পা এক-পা করে এগিয়ে এসে লোকটির পথ রোধ করল।

অগত্যা বাধ্য হল লোকটি ওদের ওপারে নিয়ে যেতে। মস্ত খাড়ি। চারদিকে শুধু জল আর জল। পেছনে বরিভলির আলো-ঝলমলে শহর। সামনে অন্ধকার দ্বীপ। ওদের মনে হল, ওরা যেন কোনও স্বপ্নরাজ্যের দিকে চলেছে।

ওপারে পৌছেও খুব একটা সুবিধে হল না ওদের। কেন না, গোরাইখেড়ির সমুদ্রতীর এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটারের পথ। যাবার জন্য রংচংয়ে টাঙ্গা আছে। ভাগ্যক্রমে ঘোড়াও জোতা আছে তাতে কিন্তু এত রাতে টাঙ্গা চালাবার লোক নেই।

সুন্দরী বলল, তুম সব চড় যাও। ম্যায় দেখতি হু।

বাবলু বলল, তুই পারিস টাঙ্গা চালাতে?

থোড়া থোড়া।

দেখিস বাবা, যেন অ্যাকসিডেন্ট করির্স না।

ভোম্বল বলল, যাদের টাঙ্গা তারা কিছু বলবে না?

ও বাদমে শোচেগা।

বাবলুরা টাঙ্গায় উঠে বসতেই সুন্দরীও চালকের জায়গায় বসল। কিন্তু বসলে কী হবে? ঘোড়া কিছুতেই যাবে না। চি হি হি হি করে চিৎকার করতে লাগল। আর সেই চিৎকার শুনে পাশের একটি ঝোপড়ি-ঘর থেকে ছুটে এল একটি ছেলে, এই, এই, এ ক্যা করতা? হামারা গাড়ি লেকে কাঁহা ভাগতা?

সুন্দরী বলল, হামকো গোরাইখেড়ি চৌপট্রিমে যানা। বহুতই জলদি কাম হ্যায়।

হাম লে যায়েঙ্গে। আভি খানা খায়েগা। দশ মিনিট রুখো। আভি আতা হুঁ।

নেহি, তুম আভি লে চলো। খানা বাদমে খাও।

দশ রুপেয়া লাগেগা।

আরে ইয়ার, তুমকো বিশ রুপিয়া মিলেগা। টাঙ্গা তো চালাও। বহুত জলদি সে।

ছেলেটি বাদরের মতো লাফিয়ে উঠে বসল। তারপর ঘোড়ার লাগাম ধরে টানতেই ঘোড়া ছুটে চলল টগবগিয়ে। প্রায় ঘণ্টাখানেক যাবার পর এক জায়গায় গিয়ে টাঙ্গা থামল। ছেলেটি বলল, হিয়া উতারিয়ে। আউর নেহি যায়েগা।

সেখানে তখন রাতের নীরবতা ভঙ্গ করে সমুদ্রের জলোচ্ছাসের ভয়ংকর শব্দ শোনা যাচ্ছে। কী নির্জন নিস্তব্ধ চারদিক। মাঝেমধ্যে দু-একঘর বসতি।

বাবলু বলল, এই গোরাইখেড়ি?

সুন্দরী বলল, হ্যাঁ। বলে ছেলেটির হাতে একটি কুড়ি টাকার নোট গুজে দিল।

বাবলু বলল, তুমি দিচ্ছ কেন? আমি তো দেব।

হিসাব বাদমে হোগা। আগাড়ি চলো।

ওরা ধীরে-ধীরে এগিয়ে চলল সমুদ্রের দিকে। কী বিচ্ছিরি মাছের গন্ধ চারদিকে। সব শুটকি মাছের গন্ধ। এই জায়গাটায় জেলেদের বসতি। চারদিকে ক্রস পোতা। পাতার ছাউনি দেওয়া ঘর। এই গভীর রাতে ঘুমিয়ে আছে গ্রাম। দু-একটি কুকুর অবশ্য পঞ্চুকে দেখে চিৎকার করে তেড়ে এল প্রথমে। তারপর ভোম্বলের লাথি আর বাবলুর তাড়া খেয়ে পালিয়ে গেল।

ওরা একটা বালির ঢিবি পার হয়ে সমুদ্রের ধারে এল।

কতকগুলো ভাঙা নৌকো একপাশে অবহেলায় পড়ে আছে দেখা গেল। তারই পাশে জেলেদের বড় বড় নাইলনের জাল শুকোচ্ছে।

একটি দোতলা বাড়ির আলো জ্বলছে। আর সেই দোতলার ঘরের জানলায় সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে এক তরুণী দাড়িয়ে আছে। এত রাতে ঘুম নেই চোখে, ব্যাপারটা কী?

সুন্দরী বলল, ওহি মকান শয়তান লোদিকা।

কিন্তু ওই মহিলা কে?

কৌন জানে। মালুম হোতা হ্যায় কিসিকো ভাগাকে লে আয়া ও লোক।

উনি তা হলে বন্দিনী? ঠিক আছে, দেখছি এবার কে কোথায় আছে। সুন্দরী, তুই এখানেই অন্ধকারে ভাঙা নৌকোর খোলের কাছে কোথাও লুকিয়ে থাক।

সুন্দরী দারুণ ভয় পেয়ে বলল, না বাবা, মুঝে ডর লাগেগা।

কোনও ভয় নেই তোর। হয়তো একটু পরেই মারপিট লেগে যাবে। হয়তো আমরা ধরা পড়ে যাব। তখন কী হবে? লুকিয়ে থাকলে তুই তো পালিয়েও যেতে পারবি।

কথাটা মনে ধরল সুন্দরীর। বাবলুর নির্দেশমতো সে একটা মাস্তুল-ভাঙা কাঠ হাতে নিয়ে অন্ধকারে লুকিয়ে রইল।

বাবলু খুঁজেপেতে একটা লোহার মরচে-ধরা পাইপ জোগাড় করে ভোম্বলের হাতে দিয়ে বলল, তুই এক কাজ কর, ভোম্বল। ওদের বেরোবার মেন দরজার মাথায় যে সানশেডটা আছে, তার ওপর বসে থাক। দরজা খুলে যে কেউ বেরোতে যাবে তারই মাথায় বসিয়ে দিবি এক ঘা করে। এমন মারবি যে মাথাটা যেন গুড়িয়ে যায়।

ভোম্বল বলল, ঠিক আছে। ও আর আমাকে বলে দিতে হবে না। বলে বাবলুর কাঁধে ভর করে সানশেডের ওপর উঠে বসে রইল ভোম্বল।

আর বিলু করল কী, পাশের একটা নারকোল গাছ বেয়ে ঝুপ করে নামল দোতলার ছাদে। আর বাবলু? সে ধীরে ধীরে পাইপ বেয়ে উঠে এল দোতলার জানলার কাছে। যেখানে একটু আগেই এক তরুণী সমুদ্রমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ঘরের ভেতরে নীল রঙের একটা জিরো পাওয়ারের আলো জ্বলছে।

বাবলু জানলার কাছে এসে ঘরের দিকে তাকিয়েই অবাক, এ কী নয়নাদি। আপনি?

নয়নাদি চমকে উঠলেন, বাবলু তুম!

আপনি তো পুনে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এ বাড়িতে এলেন কী করে? এটা তো এক কুখ্যাত দস্যুর বাড়ি?

হ্যাঁ ভাই। হাম পুনে গয়ে থে। লেকিন আনে কা বখত লোনাভালামে এ লোক হামারি গাড়ি রুখ দিয়া। রতনলালকো সাথ গাড়ি গিরা দিয়া খাদমে। আউর হামকো হিয়া লে আয়া।

আপনি তা হলে মি, যোশির মেয়ে?

তুমহে কায়সে মালুম।

ওসব পরে বলব। অজন্তায় আমি সব কথা খুলে বলিনি। তবে আপনাদের সঙ্গে দেখা করব বলেই আমরা কলকাতা থেকে এসেছি। সে যাক। আপনার বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছে। আমরা এখন আপনাদের বাড়িতেই আছি। আপনার বাবা পুলিশ নিয়ে লোনাভালায় গেছেন। আমরা সুন্দরীকে সঙ্গে নিয়ে এখানে এসেছি। আমাদের বাচ্চু-বিচ্ছুকেও ওরা ধরে এনেছে এখানে।

ও বাইরে অন্ধকারে লুকিয়ে আছে। আপনি কি বাচ্চু-বিচ্ছুকে দেখেছেন?

নেহি তো। হাম আভি আয়া।

বিলুকে আমি ওপরে উঠিয়ে দিয়েছি। আপনি কি কোনওরকমে একবার ছাদের দরজাটা খুলে দিতে পারবেন?

দরোয়াজা উধার সে বন্ধ হ্যায়। হাম ইধার সে লক কর দিয়া।

বাবলু যখন নয়নাদির সঙ্গে এইসব কথা বলছে, তেমন সময় হঠাৎ ওর গায়ের ওপর একটা সার্চলাইটের জোরালো আলো এসে পড়ল। সমুদ্রের গর্জনে ওরা বুঝতে পারেনি কখন একটা মোটর এসে সেই বাড়ির কাছে থেমেছে।

বাবলু কী করবে কিছু ঠিক করতে না পেরে পাইপ বেয়ে অর্ধ পথে এসেই ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ল বালির ওপর। সঙ্গে সঙ্গে দুজন গোয়ানিজ ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শক্ত করে ধরে ফেলল ওকে।

আর মূর্তিমান যমের মতো একজন দীর্ঘ পুরুষ রিভলভার হাতে ধীরে ধীরে ওর দিকে এগিয়ে এসে বলল, ও। তুম হো ও হিরা-চোরি করনেবালা হিরো?

বাবলু বলল, হ্যাঁ। ঠিকই ধরেছেন। কিন্তু আপনি কে? কোনও হিন্দি ছবির ভিলেন বুঝি?

হাঁ, হাঁ। ম্যায় তো ইন্টারন্যাশনাল ভিলেন। মেরা নাম ডেভিড লোদি।

বুঝেছি। তবে এত তাড়াতাড়ি যে আপনার দেখা পাব তা আমি ভাবিনি।

আরে, এ তো ম্যায়নে ভি নেহি শোচা।

হিঁয়া পর হোগা। হিয়া তো বহোতই লেড়কি হ্যায়। ইসমকানকা নাম লেড়কি মহল।

আপনি ওদের প্রত্যেককে ছেড়ে দিন।

হাঁ হাঁ। ছোড় দেঙ্গে। লেকিন তুম হামারা সাথ দোস্তি করোগে? তুমহারা মাফিক লেড়কা হামারা পার্টি মে রহনে সে মেরা বিজনেস সাকসেসফুল হো যায়েগা। তুম হামারা সাথ রহোগে তো একদিন হামারা মাফিক শের বন যাওগে।

বাবলু থুঃ করে থুথু ফেলে বলল, তোমার মতো শের? তুমি তো পুলিশের ভয়ে চোরের মতো পালিয়ে বেড়াও ! শের, আমি এখনও আছি, পরেও থাকব। তোমার মতো কুত্তা বনব না।

আর যায় কোথা। লাফিয়ে উঠল ডেভিড। রক্তচক্ষু হয়ে গোয়ানিজ দুটোর হাত থেকে জামার কলার ধরে টেনে আনল বাবলুকে। তারপর এক ঝটকায় বালির ওপর ফেলে দিয়েই রিভলভার তাক করল, শয়তান কাহাকা। আভি শমশান যানে কে লিয়ে তৈয়ার হো যাও।

রিভলভার তোলার সঙ্গে সঙ্গেই অন্ধকারের বুক চিরে পঞ্চু আঁউ করে লাফিয়ে পড়ল ডেভিডের হাতের ওপর।

গোয়ানিজ দুটো তখন এমনই হতভম্ব যে কী করবে কিছু ঠিক করতে পারল না। পঞ্চুর ভয়াবহ কামড়ে ডেভিডের মারাত্মক চেঁচানিতে সমুদ্রও বুঝি চমকে উঠেছে তখন। গোয়ানিজ দুটো তখন ছুটে এসে যেই না পঞ্চুর খপ্পর থেকে ডেভিডকে বাচাতে গেল অমনি বাবলুর পিস্তল গর্জে উঠল টিসুম-ঢুসুম।

বিলু ছাদের ওপর থেকে এতক্ষণ মজা দেখছিল। এবার আনন্দে তুড়ি লাভ খেতে লাগল সে। আর মাঝেমধ্যে দু’হাত মুখে পুরে সিটি দিতে লাগল।

নয়নাদিও অবাক বিস্ময়ে জানলা থেকে সব দেখতে লাগলেন। ডেভিডের হাত থেকে রিভলভারটা খসে পড়েছে তখন। তাই নিরুপায় হয়ে পঞ্চুর বুকে ঘুষি মেরে ওকে ছাড়াবার চেষ্টা করছে ডেভিড। কিন্তু করলে কী হবে? পঞ্চুকে যত মারে পঞ্চু তত কামড়ায়। আঁচড়ে-কামড়ে ফালাফালা করে দেয় একেবারে!

বাবলু ডেভিডের রিভলভারটা কুড়িয়ে নিয়ে বলল, মি. লোদি, এটা আরব দেশের মাল, তাই না? বহু লোকের প্রাণ তো এটা দিয়ে নিয়েছ। তা দেব এবার এটা দিয়েই তোমারই পেটের বেলুনটা ফুটো করে?

বিলু ছাদের ওপর থেকে হেঁকে বলল, দিবি দিবি করছিস কেন? দে না। মজাটা দেখি।

দারুণ উত্তেজনায় সুন্দরীও তখন কারও অনুমতির অপেক্ষা না রেখেই সেই মাস্তুল ভাঙাটা নিয়ে ছুটে এসেছে। সে এত রেগেছে যে, এসেই দমাদম করে পেটাতে লাগল ডেভিডকে। ভাবটা এই যে পিতৃ-মাতৃ হত্যার প্রতিশোধ সে নেবেই নেবে।

বাবলু বলল, মার, মার। মার ব্যাটাকে। যত খুশি মার। মেরে ফেল।

মারের চোটে বাবা রে মা রে করে লাফাতে লাগল ডেভিড। আর পঞ্চু ওকে ছিড়ে টুকরো-টুকরো করতে লাগল।

বাবলু বলল, চিরকাল লোককে তুমি মেরেই এসেছ শয়তান। কিন্তু মার তো কখনও খাওনি। এখন বোঝে মার কীরকম ভিটামিনযুক্ত উপাদেয় জিনিস।

রাতের অন্ধকারে গোরাইখেড়ির সমুদ্রতীরে সেই খণ্ডযুদ্ধ তখন দেখবার মতো জমে উঠেছে।

এদিকে বিলু তো তখন ছাদের দরজায় শিকল তুলে দিয়ে এমন নাচানাচি আরম্ভ করেছে যে, নারকোল গাছের পাতায় বসা প্যাঁচাগুলো পর্যন্ত শ্যাঁসশ্যাঁস করে ভয়ে উড়ে পালাতে পথ পেল না। ওদিকে ভেতরে যেসব লোক ছিল তারা তখন সিড়ি বেয়ে ছাদে উঠতে বাধা পেয়ে দরজা ভেঙে ফেলবার চেষ্টা করছে।

বিলু তখন ওর চাকুটা হাতে নিয়ে সমানে চেঁচিয়ে চলেছে, কে আসবি আয় না ব্যাটা, দেখব কে কত মায়ের দুধ খেয়েছিস। এক-এক করে আয়, আর গলাটা অমনি কেটে দিই।

কিন্তু সেই দরজা ভেঙে আসবে কে? অগত্যা নীচের দরজা খুলেই বেরোতে গেল সব। কিন্তু বেরিয়ে যাবে কোথায়? ওরা তো জানে না যে সাক্ষাৎ-যম বসে আছে মাথার ওপর। তাই যে-ই বেরোতে যায় বিলুর ডাণ্ডা তাকে ঠান্ডা করে দেয়। শেষকালে যখন কেউ-ই আর বেরোল না তখন যুদ্ধ থামল।

যুদ্ধশেষে দেখা গেল গোয়ানিজ দুটো মরেছে।

ডেভিডও নিশ্চল। বেঁচে থাকলেও আর কোনও আশা নেই। ওর চোখ-মুখের বীভৎস চেহারা হয়েছে।

ভোম্বলের ডাণ্ডার ঘা খেয়ে যারা ঠান্ডা হয়েছে সুন্দরী তাদের বন্দুক রিভলভার যার কাছে যা ছিল কেড়ে নিল। বাবলুও হাত লাগাল অবশ্য। গুনে দেখল হতাহতের সংখ্যা তেরো।

বাবলু এবার হেঁকে বলল, ভোম্বল, তুই নেমে আয়। মনে হচ্ছে আর আমাদের বাধা দেবার কেউ নেই।

ভোম্বল বলল, ঠিক তো!’ বলেই লাফিয়ে নামল।

যেই না নামা অমনি বাড়ির ভেতর থেকে সুডুত করে একটা বামন বেরিয়ে এসে বলল, লা পেলাপাপ্পা পারেরাম পাম পুম।

বাবলু বলল, কে তুই?

আমি পঞ্চু।

সুন্দরী হেসে উঠল খিলখিল করে।

বামনটা বলল, না, না, হাসি নয়। আমার নাম পঞ্চানন। ডাক নাম পঞ্চু।

তারপর বাবলুর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি নিশ্চয়ই বাবলুদা। আরে দোস্ত আগে হ্যান্ডশেক করো।

বাবলু বলল, কিন্তু তুমি আমার নাম জানলে কী করে?

হাঃ হাঃ। লা লা লারাল্লা লা।

আরে গান গাইবে পরে। আগে বলো কী করে আমার নাম জানলে?

বাচ্চু-বিচ্ছু আমাকে সব বলেছে। ওরা বলেছে তুমি ওদের উদ্ধার করতে আসবেই-আসবেই-আসবেই। বলেই বালির ওপর দু-একটা ডিগবাজি খেয়ে তুডুক-তুডুক করে লাফিয়ে নেচে সেই আহত-নিহত লোকগুলোর মুখে একটু করে বালি দিয়ে বলল, নে, বালি খা। এতক্ষণ মারামারি করেছিস, এবার খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই।

বাবলু বলল, এরা কি তোমাকেও ধরে এনেছে এখানে?

ধরে এনেছে মানে? আজ দশ বছর আমাকে এখানে আটকে রেখেছে এরা। আগে আমি একটা সার্কাস-পার্টিতে জোকারের কাজ করতুম। ‘মেরা নাম জোকার দেখে আমি রাজকাপুরদার সঙ্গে দেখা করতে আসছিলাম সিনেমায় একটা চান্স নেব বলে। তা শয়তানগুলো আমাকে ভি টি স্টেশনে ট্রেন থেকে নামতেই খপ করে ধরে নিল। আমি কত গালাগালি করলাম, তা কিছুতেই ছাড়ল না আমাকে। ওরা বলল, আমাদের আড্ডায় তোর মতো একটা লোক থাকা দরকার। চেঁচিয়ে পুলিশ ডাকলাম। হাত-পা ছুড়লাম। তা পুলিশগুলো এত অসভ্য যে, আমাকে ছাড়ানো দুরের কথা, উলটে খ্যাঁ খ্যাঁ করে হাসতে লাগল। আমি এখান থেকে যতবার পালাতে গেছি ততবার এরা আমাকে আৰ্দ্ধেক রাস্তা থেকে ধরে এনেছে। যাই হোক, বাচ্চু-বিচ্ছুর দেখাশোনার ভার আমার ওপরে পড়েছিল বলেই সব জানতে পারলাম। ওরাই বলেছে যে, তুমি ঠিক আসবে। তা এইভাবে যে এসেই রাবণ বধ করবে, তা কিন্তু ভাবতে পারিনি।

বাবলুরা ওকে সঙ্গে নিয়ে হইহই করে ঢুকে পড়ল সেই শত্রুপুরীর ভেতর। তারপর বাচ্চু-বিচ্ছু, নয়নাদি এবং আরও অনেক বন্দিনীকে মুক্ত করল ওরা। বিলুও তখন ছাদের দরজা খুলে নেমে এসেছে ওদের কাছে।

সকলের অন্তরে যেন আনন্দের জোয়ার এসে গেল।

নয়নাদি বামনটাকে নিয়ে ডেভিডের চেম্বারে ঢুকে বাড়িতে এবং থানায় ফোন করলেন।

দেখতে দেখতে ভোর হল। গোরাইখেড়ির সমুদ্র-সৈকতে দাড়িয়ে নতুন সূর্যোদয় দেখল ওরা। তারপর অপেক্ষা করতে লাগল পুলিশ আসার জন্য।

পাণ্ডব গোয়েন্দাদের দারুণ ভাল লাগল এই জায়গাটা। চারদিকে টিলা পাহাড় অরণ্য আর সমুদ্রের জলের ওপর নয়নাদির চোখের পাতার মতো বুকে থাকা নারকোল পাতার দৃশ্য ওদের মন ভরিয়ে দিল।

বাবলু বলল, এই জায়গাটার আমরা একটা নাম দিই।

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, কী নাম দেবে?

বাবলু বলল, এর নাম হোক মিনি গোয়া।

সবাই বলল, হিপ হিপ হুরারে।

অনেক বেলায় পুলিশ এল। দু-তিনটি জিপ এবং গাড়িভর্তি পুলিশ নিয়ে। এখানে গাড়ি আসার জন্য অন্যদিক থেকে নাকি একটা রাস্তা আছে। সে যাই থাক, মি. যোশিও এলেন পুলিশের গাড়িতে। মেয়েকে ফিরে পেয়ে এবং বাবলুর প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার চোখে জল এসে গেল। পঞ্চুকেও বুকে জড়িয়ে অনেক আদর করলেন তিনি।

এবার যাবার পালা। গোরাইখেড়ির সেই কুখ্যাত বাড়িটা পুলিশে দখল করল। আহত এবং নিহতদের একটা গাড়িতে তুলে পাণ্ডব গোয়েন্দাদের নিয়ে এগিয়ে চলল পুলিশের গাড়ি। রয়ে গেল শুধু বামনটা। শত অনুরোধেও সে কিছুতেই গেল না। বলল, এখানে নাকি কোনও এক ধীবর-পরিবারের সঙ্গে সম্প্রতি খুব ভাব হয়ে গেছে তার। ও সেখানেই থেকে যাবে।

গাড়িতে যেতে যেতে বাবলু বলল, নয়নাদির ওখানে গিয়ে আগে ফোন করতে হবে সমুমামাকে। আর…

আর?

তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে জামরুল গাছের কোটরের মধ্যে লুকিয়ে-রাখা হিরেগুলো ফিরিয়ে দিতে হবে নয়নাদিকে।

সবাই বিস্মিত হয়ে বলল, শেষ পর্যন্ত হিরেগুলো তুই জামরুল গাছের কোটরের ভেতর লুকিয়ে রাখলি?

বাবলুর হয়ে পঞ্চুই জবাব দিল, ভৌ। ভৌ ভোঁ। কেন না, পঞ্চুই তো সেই লুকোনোর সাক্ষী ছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress