ঘোড়া এবং তলোয়ার
গাজি সইদুর রহমান তাঁর দহলিজ-ঘরের উঁচু বারান্দায় আরামকেদারায় বসে স্টেটসম্যান পড়ছিলেন। আগের দিন কলকাতা থেকে তিনি বাড়ি ফিরেছেন। পাশের একটি টুলে আরো খানকতক বাসি স্টেটসম্যান রাখা আছে। সইদুর হরিণমারা তল্লাটে বড়োগাজি নামে খ্যাত। জেলাবোর্ডের মেমবার তিনি। প্রসন্নময়ী এইচ ই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিরও মেমবার। দক্ষিণের বারান্দায় সকালের ঝকমকে রোদ সবে টেরচা হয়ে ছুঁয়েছে। তাঁর পরনে আলিগড়ি চুস্ত পাজামা আর ঢিলেঢালা কুর্তা, পায়ে কলকাতায় কেনা লালরঙের নাগরা-ধাঁচের সুদৃশ্য চটি! বড়োগাজি শৌখিন মানুষ। তাঁর পত্নীর সংখ্যা এখন মোটে দুই এবং সেই বেগমদ্বয়ের সখি-ভাব লোকদের তাজ্জব করেছে এতকাল। ইদানীং নাকি সেই মধুর ভাবটি কোনো গোপন কারণে চটে গেছে এবং বাড়ির বাদি কুলসুম পুকুরঘাটে রটিয়েছে, বড়োগাজি ছোটোবেগমকে তালাক দেবেন। কলকাতা থেকে ফেরার পর লোকেরা সেই উত্তেজনাপ্রদ ঘটনার জন্য কান খাড়া করে আছে। শরৎকালের এই সকালে যারাই নিচের রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করছে, তারাই লক্ষ্য করে যাচ্ছে বাগাজিকে। তার মুখমণ্ডলে অবশ্য ভরাট গাম্ভীর্য। সেটা ইংরেজি পড়ার জন্য, না দাম্পত্য অশান্তিজনিত, বোঝ কঠিন।
এইসময় বড়োগাজির ভাই ছোটোগাজি মইদুর রহমান মসজিদ থেকে ফজরের নমাজ সেরে তামার প্রকাণ্ড বদনা হাতে বাড়ি ফিরছিলেন। তাঁর পরনে লুঙ্গি, শাদা থানের পিরহান, মাথায় বাবরি চুল, মুখে চাপ-চাপ দাড়ি। তিনি বড়োগাজির তুলনায় একটু বেঁটে এবং মোটাসোটা। তাঁর পায়ে স্থানীয় মুচির তৈরি কাঁচা চামড়ার তোবড়ানো জুতো। জুতোয় ধুলোকাদা এবং লুঙ্গির নিচের দিকে প্রচুর চোরকাঁটা আটকে আছে। বোঝা যায় তিনি নমাজ সেরে জমিতে-জমিতে ধানের অবস্থা দেখতে গিয়েছিলেন । তাই শিশিরে জুতো আর লুঙ্গি ভিজেছে। নোংরা হয়ে গেছে।
সিঁড়ি বেয়ে উঠে বারান্দায় ছোটোগাজি একটু দাঁড়ালেন। কিছু বলার জন্য ঠোঁট ফাঁক করলেন। সেই সময় বড়োগাজি কাগজে চোখ রেখেই বাঁকা হেসে বললেন, মদু নাকি বদুপিরের মুরিদ (শিষ্য) হয়েছে?
ছোটোগাজি চটে গেলেন। বললেন, হুঁ। হয়েছি।
বদুপির শুনেছি আসমান থেকে জিনদের ডেকে দুনিয়ায় আনে!
ছোটোগাজি ফুঁসে উঠলেন। আপনি ইংরিজি পড়েন বটে, তবে আপনার কথাবার্তা নাদান লোকের মতো। বুজুর্গ লোকের খামোখা বদনাম রটালে গোনাহ হয় জানেন না?…ছোটোগাজি উদাত্ত কণ্ঠস্বরে বলতে থাকলেন। আপনি যান। গিয়ে দেখুন হুজুর পিরসাহেবকে। তারপর বাতচিত করবেন।
বড়োগাজি হাসলেন।….আচ্ছা মদু, তুমি তো পাঁচওয়াক্ত নমাজ পড়। তোমার কপালে মুসল্লিদের ছাপ পড়েছে। তুমি বলো তো, ফরাজি যারা, তারা কেমন করে পির-টিরে বিশ্বাস করে? কেমন করেই বা তারা পির হয়? আমার কথা শোনো আগে! এই বদু মৌলানা শুনেছি খয়রাডাঙায় পিরের থান ভেঙে এসেছে। সে নিয়ে এক তুলকালাম হয়েছে। ওকে শেষ অব্দি খয়রাডাঙা থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছে। আর সেই বদমৌলানা নিজেই পির সেজে বসল! তোমাদের মতো কতকগুলো বুড়বক গিয়ে তার পাগড়ি ধরে মুরিদ হলে!
ছোটোগাজি খাপ্পা হয়ে দলিজঘরের ভেতর দিয়ে অন্দরে ঢুকে গেলেন।
ঠিক এই সময় দুটি ছেলে রাস্তা দিয়ে আসতে-আসতে থমকে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিল। চোখ পড়ায় বড়োগাজি জিগ্যেস করলেন, কে রে তোরা?
রবি আদাব দিয়ে বলল, আমি রবিউদ্দিন, চাচাজি!
অ। আর ওটা?
রবি কাঁচুমাচু একটু হেসে বলল, এ শফি! মৌলাহাটের পিরসাহেবের ছেলে।
বড়োগাজি সোজা হয়ে বসলেন। তারপর হো-হো করে অট্টহাসি হাসলেন।… শুনে ফেললে নাকি গো ছেলে? তোমারই আব্বার নিন্দে করছিলাম আমার আবার বড্ড বেফাঁস কথাবার্তা বলার হ্যাবিট আছে। রবিকে জিগ্যেস করো। না কী রে, রবি?
রবি শুধু খিকখিক করে হাসতে লাগল। শফি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
বড়োগাজি ডাকলেন, কী নাম গো তোমার? ও রবি, কী নাম, বললি যেন?
রবি বলল, শফিউজ্জামান।
ও এখানে কী করে?
আমার সঙ্গে পড়ে স্কুলে। আমাদের বাড়ি ‘জায়গির’ আছে।
ভেরি ওয়েল! কাম অন বয়, কাম হেয়ার! বড়োগাজি হাত তুলে ডাকলেন শফিকে।
কিন্তু শফি গোঁ ধরে দাঁড়িয়ে রইল। রবি তাকে ফিসফিস করে বলল, বড়োগাজি! মস্ত লোক। চল না! তবু শফি গেল না।
বড়োগাজি হাসতে হাসতে বললেন, অলরাইট! বলো তো– আমার একটি ঘোড়া আছে ইংরেজি কী? বলল –দেখি তুমি পিরসাহেবের ছেলে হয়ে কেমন লেখাপড়া শিখেছ। বলল, আমার একটি ঘোড়া আছে।
শফি আস্তে বলল, মাই..মাই হ্যাজ এ…হ…হ–
তুমুল অট্টহাসি হেসে বড়োগাজি বললেন, এ কী রে রবি? পিরসাহেবের ছেলে এ কী ইংরেজি শিখেছে! মাই হ্যাজ হয় না –আই হ্যাভ। আমার একটা ঘোড়া আছে –আই হ্যাভ এ হর্স। শোনো গো পিরসাহেবের ছেলে, আমার কাছে রোজ সকালে এসো। ইংরেজি পড়াব। রবি, ওকে নিয়ে আসিস। তুইও পড়বি। মরনিংয়ে আমি ফ্রি থাকি ।…
শফি হনহন করে হাঁটতে লাগল। জীবনে এ এক প্রচণ্ড পরাজয়ের লজ্জা তাকে খেপিয়ে দিচ্ছিল। তা ছাড়া একটু আগে সে ওই লোকটার মুখে তার আব্বার নিন্দাও। শুনেছে। রবি ধুকুর-ধুকুর করে প্রায় দৌডে তার নাগাল নিচ্ছিল। সে ওকে বোঝাতে চাইছিল বড়োগাজি লোকটি এমনি। বড় আমুদে আর বাঁচাল স্বভাবের মানুষ। শফি, ওর এ অব্দি কতগুলো নিকে, জানিস? এগারোখানা– আল্লার কসম। এখন দুখানা টিকে আছে। তার একখানাকে ছাড়ব-ছাড়ব করছে। আসলে ছোটোবেগমটা হল ছোটো ঘরের বেটি । ওর বাপ ছিল বিলপারের বুনো গাঁ কাঁদুরির হোসেন কাঠুরে। জঙ্গলে কাঠ কেটে বেড়াত। আর নসু –মানে তার বেটি, যে এখন বড়োগাজির ছোট বউ, বুঝলি তো তারও আঠারোখানা নিকে। কোনো লোকের ‘ভাত খায়নি। নিকে করত আর কদিন পরেই লোকটার বুকে লাথি মেরে পালিয়ে আসত। হোসেন কাঠুরে ছিল আসলে মস্ত খুনে ডাকাত। তার ভয়ে লোকটা বাপ-বাপ বলে তালাক দিতে পথ পেত না। একদিন হয়েছে কী শান, বড়োগাজি যাচ্ছে ঘোড়ায় চেপে কাঁদুরিতে একটা সালিশি করতে। রাস্তায় দেখা নসুর সঙ্গে। তারপর কী হল কে জানে, হঠাৎ দেখি, নসু বলাই হাজির বউ হয়ে এল আমাদের গাঁয়ে। সেখপাড়ার বলাই হাজিকে তুই দেখিসনি। থুখুড়ে বুড়ো। তার ‘ভাত খাবে’ কেন জোয়ান মেয়ে? বলাই হাজি নাকি বরকত নামে তার বাড়ির মাহিন্দারের সঙ্গে খড়কাটা ঘরে নসুকে শুয়ে থাকতে দেখেছিল। তাড়া খেয়ে নসু এল পালিয়ে এসে কোথায় ঢুকল জানিস তো? বড়োগাজির বাড়িতে। সন্ধ্যাবেলা বলাই হাজির রাগ পড়ল। তখন শালা বুড়ো লণ্ঠন হাতে বড়োগাজির বাড়ির দরজায় এসে কান্নাকাটি করে ডাকাডাকি করতে লাগল। বড়োগাজি বললেন, এখন যাও হাজিসায়েব। বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাঠিয়ে দেব। কিন্তু রাত গেল, দিন গেল। নসু ফেরে না। বলাই হাজি গিয়ে কান্নাকাটি করে। শেষে বড়োগাজি বললেন, হাজিসায়েব। মনে হচ্ছে, নসুবিবি তোমার ভাত আর খাবে না। ওকে বরঞ্চ তালাক দাও। বুঝলি তো শফি, বড়োগাজি হল এ তল্লাটের এক মানুষবাঘ। বাঘের ঘরে পুষ্ট কাউ। হিঃ হি হিঃ!
রবি খুব হাসতে লাগল। নসু হয়ে গেল নাসিমা বেগম। চাষার মেয়ের বরাত! মিয়াঁবাড়ির বেগম। ইদানীং শুনেছি, বড়োগাজির বড়ো বউ, সে আবার কোন সাবডেপুটি ম্যাজিসট্রেটের বোন, তার সঙ্গে দিনরাত খিটিমিটি চলছে নসুর। নসু বলছে, পরদায় বাঁধা সে থাকতে পারছে না। যখন-তখন খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বড়োগাজি তো– (অশ্লীল শব্দ) পেলেই খুশি। বকাঝকা করে না। কিন্তু এবার নাকি নসুর এক কীর্তি দেখেছে।
রবি শফির কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল, বলাই হাজির মতোই বড়োগাজি কদিন আগে হাতে-নাতে ধরেছে নসুকে। মোমিনপাড়ার রুহুলের সঙ্গে দিনদুপুরে আখের খেতে– আল্লার কসম! বড়োগাজি বন্দুক নিয়ে আখের জমির চারপাশে ঘোরে আর গুলি মারে। চক্কর দেয় আর গুলি মারে। রুহুল কোন ফাঁকে সুরুত করে পালিয়ে গিয়েছিল। নসু বলেছে, মিয়াঁবাড়ির পায়খানায় বসতে পারে না। অভ্যেস নেই কিনা! আখের ভুইয়ে হাগতে গিয়েছিল।
রবি শফিকে জড়িয়ে ধরে হাঁটতে লাগল। হাসির চোটে সে ঝুঁকে পড়ছিল । একটু পরে সে আবার ফিসফিসিয়ে উঠল, আল্লার কসম– নসুকে আমিও একদিন– যখন বলাই হাজির বিবি ছিল, তখন –কী? বিশ্বাস হচ্ছে না?
শফি চুপ করে রইল। শুধু একবার তাকাল রবির দিকে। রবি চোখ নাচিয়ে বলল, বোশেখ মাসের দুপুরবেলা। তখন কী খাঁ খাঁ অবস্থা হয় জানিস তো? হাজি গিয়েছিল বিলের জমিতে বোরো ধান দেখতে। বাড়ি ফাঁকা। দরজায় উঁকি মেরে দেখি, নসু চিত হয়ে শুয়ে আছে। যা আছে কপালে বলে ঢুকে পড়লাম। ও শফি! তোকে কী বলব? নসুর ওপর গিয়ে যেই পড়েছি, নসু আমাকে জড়িয়ে ধরে কামড়াতে লাগল। ও এক রাক্ষুসি মাগি, আল্লার কসম!….
সেদিনই বিকেলে স্কুলে ছুটির পর দলবেঁধে শফি বন্ধুদের সঙ্গে আসছে, পেছনে ঘোড়ার পায়ের শব্দ শোনা গেল। দলটা রাস্তার একধারে দাঁড়িয়ে গেল। শফি দেখল, কালচে-লাল একটা ঘোড়ার পিঠে চেপে বড়োগাজি চলে গেলেন। পরনে ব্রিচেস, ছাইরঙা শার্ট, মাথায় একটা অদ্ভুত টুপি– বইয়ের ছবিতে এক ইংরেজ সায়েবের মাথায় যেমন টুপি শফি দেখেছে। সে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল।
স্কুলটি গ্রামের বাইরে মাঠের ধারে। তার একপাশে বাদশাহি সড়ক। প্রতিদিন মিয়াঁপাড়ায় একই রাস্তায় শফি আর রবি স্কুল থেকে ফেরে। ফেরার পথেই গাজিদের একতালা বিশাল বাড়িটা পড়ে। দহলিজঘরটা রাস্তার ধার ঘেঁষে। কিন্তু বড়োগাজিকে সে দেখেনি বা লক্ষ করেনি এতদিন। আজ সেখানে পৌঁছে দেখল, বড়োগাজি নেই, কিন্তু পাশের একটুকরো খোলামেলা ঘাসজমিতে সেই ঘোড়াটিকে টহল খাওয়াচ্ছে একটা লোক। ঘোড়াটি ভালো করে দেখার জন্য শফি দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু রবি। তাকে দাঁড়াতে দিল না।
সে-রাতে শফি ঘোড়াটাকে স্বপ্নে দেখল। ঘোড়াটার চোখ টানা-টানা, প্রচণ্ড লাল। আর সেই চোখে কাজল পরানো। ঘোড়াটাকে কেন যেন খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ঘোড়াটির খুব দুঃখ। তার জন্য কান্না পাচ্ছিল শফির।
একরাতে ঠিক এমনি করে বারুচাচাজির হাতিটিকে স্বপ্নে দেখেছিল শফি। হাতিটির পাঁজরের হাড় দেখা যাচ্ছিল। রুণ সেই পাঁজরবেরকরা হাতিটিকে দেখে শফি হু হু করে কেঁদে ফেলেছিল। রবি তার ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়ার পরও কিছুক্ষণ শফির মনে কান্নার আবেগটা থেকে গিয়েছিল।….
স্কুলে পুজোর ছুটির আগের দিন বিকেলে শফি তার বন্ধুদের সঙ্গে বাদশাহি। সড়কে কাঁদরের সাঁকোর ধারে বসে আছে। দিনশেষের কুয়াশামাখানো ধূসর আলোয় আবার বড়োগাজিকে ঘোড়া ছুটিয়ে আসতে দেখল শফি। সড়কে বর্ষার কাদা শুকিয়ে কোথাও-কোথাও ধুলো জমেছে। অনেকদিন বৃষ্টি হয়নি। চাষিরা উদ্বিগ্ন। উঁচু জমির ধানখেতে মাটি শুকিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। কাঁদরের জল ‘দোন’ (দ্রোণী) দিয়ে দিনমান সেচ দিচ্ছে অনেকে। বড়োগাজির ঘোড়াটা ধুলো উড়িয়ে আসতে-আসতে সাঁকোর। কাছে থেমে গেল। শফিরা গল্প করছিল। থেমে গিয়ে তাকিয়ে রইল। বড়োগাজি ঘোড়া থেকে নেমে সড়কের নিচে কাঁদরের ধারে গেলেন। দোনে সেচ-দেওয়া চাষি লোকটির সঙ্গে চাপাগলায় কথা বলতে থাকলেন। দোন থামিয়ে লোকটি সেলাম। দিয়ে সসম্ভ্রমে কথা বলছে। তারপর শফি ঘোড়াটার দিকে তাকাল। এ ঘোড়াটা তার স্বপ্নে দেখা ঘোড়া নয়। একে তেজী আর রাগী দেখাচ্ছিল। মুখে লাগামপরা ঘোড়াটি স্থির দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেগুলো একটা হ্রেষাধ্বনির প্রতীক্ষা করছিল। কিন্তু ঘোড়াটি চুপ। তারপর বড়োগাজি কদরের ধার থেকে সড়কে উঠে এলেন। তখন ঘোড়াটিকে চঞ্চল দেখাল। মনে হল, সে বড়োগাজিকে পিঠে নিয়ে বহু ক্রোশপথ পেরিয়ে যেতে তৈরি। ঠিক এই মুহূর্তে শফির মনে হল, এতদিন সে বারুচাচাজির হাতিটির মতো একটি হাতির সাধ করে এসেছে। কিন্তু হাতি নয়, তার যদি এমন একটি ঘোড়া থাকত! তার শরীর শিউরে উঠল। বুকের ভেতর একটা চাপা আবেগ দুলে উঠল। আর বড়োগাজি তখন তার সামনে। মুখে মিটিমিটি হাসি। মাথায় ইংরেজ-টুপি, শার্ট-ব্রিচেস-বুটপরা, শকুনের মতো বাঁকা নাক, সাতমার কাল্লুখার মতো গোফ-জুলফিওয়ালা মুখ, তামাটে রঙের মানুষটির চোখে চোখ পড়তেই শফি চোখ নামাল। বড়োগাজি বললেন, তুমি মৌলাহাটের পিরসাহেবের ছেলে না? তারপর পোদোর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি প্রহ্লাদ ঘোষের ছেলে –হুঁ, কী যেন নাম তোমার?
তুখোড়, গোঁয়ার এবং সাহসী বলে পরিচিত পোলদা নেতিয়ে গিয়ে বলল, আজ্ঞে হরেন্দ্রকুমার ঘোষ।
বড়োগ্নাজি বললেন, আর ওটা কে রে? চেনা-চেনা মনে হচ্ছে?
রবি ঝটপট বলল, সমু। বড়োরায়বাবুর ছেলে, চাচাজি।
কী হে? বড়োগাজি চোখ নাচিয়ে রবি আর শফিকে দেখিয়ে বললেন, তুমিও এই পাতি-নেড়েদের দলে জুটলে কেন?
সৌম্যেন্দু হাসল। কোত্থেকে আসছেন গাজিজ্যাঠা?
জবাব না দিয়ে বড়োগাজি শফির দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার নামটা কী যেন
শফি গম্ভীরমুখে বলল, শফিউজ্জামান।
ইন্দ্রাণীর কাছারিতে দেওয়ানসায়েবের সঙ্গে দেখা হল। বড়োগাজি বললেন। তোমার সব কথা শুনলাম। শুনে ভালোই লাগল। তুমি কি জান দেওয়ান বারু চৌধুরি আমার বুজ ফ্রেনড?
শফি তাকিয়ে রইল।
বড়োগাজি হাসলেন। হি ইজ ইওর গার্জিয়ান। দেয়ারফোর আই অ্যাম অলসো ইওর গার্জিয়ান। বুঝলে কিছু? নাকি ‘মাই হ্যাজ এ হর্স’ বুঝলে?
ধেড়ে ছেলেগুলো খ্যা-খ্যা খি-খি করে হাসতে লাগল। শফি মুখ নামিয়ে ঘাস ছিঁড়তে থাকল।..
বড়োগাজি বললেন, দেওয়ানসায়েবের কাছে শুনলাম তুমি ইনটেলিজেনট ছেলে। কিন্তু ট্রেনিং-এর অভাবে তোমার এ অবস্থা। তোমাকে বলেছিলাম আমার কাছে ইংরেজি পড়তে এসো। আসছ না কেন?
রবি দ্রুত বলল, যাবে। কাল সকালেই নিয়ে যাব।
বড়োগাজি তার ঘোড়ার কাছে গিয়ে জন্তুটার চোয়ালে হাত বুলিয়ে তারপর রেকাবে পা রেখে পিঠে উঠলেন। এতক্ষণে শফির চোখে পড়ল, ঘোড়ার পিঠে জিনের পাশে একটা বাদামি রঙের ভেলভেটের খাপে টাকা তলোয়ার ঝুলছে। ঘোড়াটা চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল। তারপর শফি আস্তে আস্তে বলল, বড়োগাজির ঘোড়ায় তলোয়ার ঝুলছে কেন রে?
সৌম্যেন্দু জমিদারবাড়ির ছেলে। সে বলল, বাবাও যখন ঘোড়ায় চেপে কোথাও। যান, এমনি সোর্ড থাকে। সে-সোর্ড দেখলে তোমার মুণ্ডু ঘুরে যাবে! প্রকাণ্ড! আমার ঠাকুর্দা ওই সোর্ড দিয়ে ডাকাতদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন।
রবি বলল, এই সমু! তোদের হলঘরখানা একবার দেখিয়ে আনব শফিকে। কখন যাব, বল?
সৌম্যেন্দু বলল, পুজোর দিন যাস! অষ্টমীর দিন রাত্রিবেলা। দেখবি একশো আটখানা পাঁঠা বলিদান হচ্ছে।
ধুস! রবি বলল। সে নয়। তোদের হলঘরখানা দেখাতে বলছি। জানিস শফি? কত হরিণের মাথা, আস্ত বাঘ, হাতির পা। উরে আল– বলেই সে সামলে নিল। আল্লাখোদা বা মুসলমানি বুলি সে হিন্দু বন্ধুদের সামনে উচ্চারণ করে না।
পোদো হেঁ-হেঁ করে হেসে বলল, শালা নেড়ের বাচ্চা! আল্লাতান্না কথায় কথায়।
বিনোদ হাসতে-হাসতে বলল, মাইরি বড়োগজি কী জিনিস রৈ! নিজে মোছলমান হয়ে রবি আর শফিকে দেখিয়ে আমাদের বলে গেল কী শুমলি তো? বলে, পাতিনেড়ে!
কালীচরণ বলল, হ্যাঁ রে রবি? তোদের নেড়ে কেন বলে রে?
সৌম্যেন্দু বলল, মোচলমানরা যে গোরু খায়।…
পরে রবি চুপিচুপি শফিকে বলত, হিন্দুদের সব ভালো। শুধু এই একটা জিনিস বড্ড খারাপ লাগে। ঠাট্টা-ইয়ারকি হোক, যাই হোক, গোরু খাওয়া-টাওয়া আর নেড়ে-টেড়ে বলা– এ কিন্তু সহ্য হয় না। ভাবি মিশব না ওদের সঙ্গে। কিন্তু আর কার সঙ্গে মিশব বল? সেখপাড়ার ছেলেগুলোর সঙ্গে? যত্তসব চাষাভুষো রাখাল-বাগালের দল! খালি গোরু-বলদের আর চাষবাসের এঁড়ে গল্প!
রবি এসব কথা বলে। আবার বিকেল হলেই ছুটে যায় হিন্দুপাড়ার দিকে। ঠাকরুনতলার কাছে প্রথমে পোদোকে ডেকে নেয়। জীর্ণ শিবমন্দিরের চত্বরে একটু অপেক্ষা করতেই এসে পড়ে বিনোদ, কালীচরণ– ইদানীং জমিদারবাড়ির ছেলে সৌম্যেন্দুও জুটেছে দলবেঁধে বাদশাহি সড়কের দিকে হাঁটতে থাকে।
অথচ শফির একলা থাকার বড়ো ইচ্ছা। রুকুর সঙ্গে বিয়ের কথা শোনার পর থেকে সে একলা হয়ে ওইসব নিয়ে ভাবতে চায়। কিন্তু রবি তাকে সঙ্গছাড়া করার পাত্র নয়! রবিকে সে পাত্তা না দিয়ে পারে না। তাদের বাড়ি ‘জায়গির’ আছে সে। একটা আনুগত্যবোধ শফিকে দমিয়ে দেয়।…
পুজোর ছুটি যে এমন করে ঘোষিত হয়, শফি জানত না। খয়রাডাঙা ছিল মুসলিম প্রধান গ্রাম। ওখানে ছিল মাদ্রাসা-স্কুল। হরিণমারা হিন্দুপ্রধান গ্রাম। গন্ডায় গণ্ডায় জমিদার। তাঁরা সবাই ব্রাহ্মণ। প্রসন্নময়ী হাই ইংলিশ স্কুলে পুজোব ছুটি ঘোষণা যে সকালবেলায় হয়, শফি জানত না। সেই গ্রীষ্মকালে ভরতি হওয়ার পর মরনিং স্কুল করেছে। এদিন ভোরে রবি তাকে ঝটপট শার্ট-পেনটুল পরে স্কুলে যেতে বলায় অবাক হয়েছিল। গিয়ে সে অবাক হল! স্কুলের গেটে ছাত্ররা দেবদারুপাতা এনে তোরণ গড়ছে। বারান্দার থাম ঘিরেও দেবদারুপাতা,গাঁদাফুল, পদ্মফুল, জবাফুল থরেবিথরে সাজানো। বিশাল এক হলঘরে কাঠের ফুট ছয়েক উঁচু দেয়াল তুলে চারটে ক্লাস। ফাইভ থেকে এইট। তার ওধারে ফার্স্টক্লাস আর সেকেনড ক্লাস। মধ্যিখানে ওইরকম কাঠের দেয়াল। তার পাশের বড়োঘরটিতে অফিস আর লাইব্রেরি । আজ সকালে হলঘরে ঢুকে ফুলের ঝাঁঝালো গন্ধ শফিকে চমকে দিল। মুহূর্তে তার মনে হল, হিন্দুরা ফুল কেন এত ভালোবাসে? অথচ তার মৌলানা। আব্বা মুরিদদের সামনে ওয়াজনসিহতের সময় আরবিবাক্য উচ্চারণ করের বাঙলায় ব্যাখ্যা করেন, আমার হুজুর মুহম্মদ সাল্লাল্লাহ আলাইহেসসাল্লাম বলেছেন, হে মোমিনগণ! দিনে যদি দু পয়সা কামাও, তো এক পয়সার রুটি কেনো, আরেক পয়সার ফুল কেনো। আমার রসুলে করিম (সাঃ আঃ) ফুল ভালোবাসতেন। খুশবু (সুগন্ধ) ভালোবাসতেন।…শফির সেই মুহূর্তে মনে হল, তবু ফুলের সঙ্গে মুসলমানদের কোনো সম্পর্ক নেই কেন? আর হিন্দুরাই বা কেন ফুল ভালোবাসে? হরিণমারায আসার পর জীবনে এই প্রথম এত বেশি হিন্দু সে দেখেছে। হিন্দুবাড়ি– সে হোক না কেন, কুনাই-বাউরি অথবা একেবারে নিরন্ন মুনিশখাটা মানুষ, তার বাড়ির উঠোনে উজ্জ্বল ফুলফোঁটা গাছ থাকবেই থাকবে। এই শরতের সন্ধ্যাসকাল হিন্দুপাড়া ভেতর দিয়ে যেতে-যেতে শফির স্নায়ুকে চমকে দেবেই শিউলির গন্ধ। সেই শিউলির মালায় সাজানো কাঠের দেয়াল। এত সুঘ্রাণ আর কখনও আবিষ্ট করেনি শফিকে। সৌম্যেন্দু এসে তার কাঁধে হাত না রাখলে এই সুগন্ধের ভেতর ঘনীভূত হয়ে যেত যেন তার সত্তা। সে ভীষণ চমকে উঠে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। সৌম্যেন্দুর পরনে ঝকঝকে ফুলশার্ট, সোনার বোতাম, এবং আজ সে ধুতি পরেছে, কিন্তু শার্ট তার ধুতির ভেতর গোঁজা। রামকৃষ্ণ ভূগোলস্যারের মতো। রামকৃষ্ণবাবু বারোমাস ওইভাবে ধুতির ভেতর শার্ট খুঁজে কোট গায়ে স্কুলে আসেন। শফি দেখল, সৌম্যেন্দুর হাতে জড়ানো শিউলিফুলের মালা। কপালে একটু লাল ছোপ। সৌম্যেন্দু বলল, তুমি একলা দাঁড়িয়ে কেন শফি? শফি হাসল, এমনি। সৌম্যেন্দু তার কাঁধ ধরে নিয়ে চলল স্কুলবাড়ির বাইরে। কলকেফুলের জঙ্গলের ভেতর ঢুকে শফি দেখল। রবি, পোদো, বিনোদ, কালীচরণ বসে বিড়ি ফুকছে। সৌম্যেন্দু পকেট থেকে একটা বিস্ময়কর জিনিস বের করল। সেটি একটি সিগারেটের প্যাকেট। পুরো দলটা হকচকিয়ে গেল। সৌম্যেন্দু সবাইকে একটা করে সিগারেট বিলি করল। শফি বারুচাচাজিকে সিগারেট খেতে দেখেছে। সিগারেটের গন্ধটা তার ভালো লাগে। জীবনের প্রথম সিগারেট টেনে শফির কিন্তু ভালো লাগল না। সে রবির কাছে বিড়ি টানতে শিখে গেছে। বিড়িই সিগারেটের চেয়ে সুস্বাদু মনে হচ্ছিল তার। তবু সিগারেট খুব সামান্য জিনিস নয়– দামিও বটে! তার চেয়ে বড়ো কথা, সৌম্যেন্দু তাকে এমন করে ডেকে এনে সিগারেট দিয়েছে। সে হাসিমুখে টানতে থাকল।
শফি সেই প্রথম আবিষ্কার করেছিল, পৃথিবীতে অজস্র সুন্দর-সুন্দর ঘটনাবলী ঘটে। আছে বহু চমকেঁদেওয়া সুখের মুহূর্ত। সেই প্রথম তার মনে হয়েছিল, এই পৃথিবীতেই আছে এমন সব জিনিস, যার তুলনায় মা-বাবার কাছে শোনা বেহেশতের। জিনিসগুলোও হয়তো তুচ্ছ হয়ে উঠবে। এখানে আসার পর শফিকে কেউ আগের। মতো ‘পিরসাহেবের ছেলে’ বলে আপনি-টাপনি করে না। রাস্তা থেকে সসম্ভ্রমে সরে দাঁড়ায় না কোনো মানুষ। বউঝিরা ঘোমটার ফাঁকে তার দিকে চেয়ে থাকে না। স্কুলের মাস্টারমশাইরাও তাকে পাত্তা দেন না। এমন কী, একদিন পদ্য মুখস্থ বলতে না পারায় তাকে বেনচে উঠে দাঁড়াতেও হয়েছিল। একটা তীব্র অভিমান তাকে কাঁদিয়ে ছেড়েছিল। ভেবেছিল, সেদিনই মৌলাহাটে পালিয়ে যাবে। কিন্তু ক্লাসসুদ্ধ সেদিন পদ্য মুখস্থ বলতে পারেনি। বাঙলার স্যার হরিপদবাবুর গলাটি ছিল জোরালো। গতিক দেখে হেসে ফেলেছিলেন, এ যে দেখছি ঠক বাছতে গাঁ উজোড়। সিট ডাউন! শফি বসছে না দেখে হরিপদস্যার খাপ্পা হয়ে গর্জেছিলেন, সিট-ডাউন! তারপর শফি বসেছিল। তখন হরিপদবাবু মুচকি হেসে বললেন, তুমি সেই পিরবাবার ছেলে না? পরে রবি চুপিচুপি বলেছিল, হরিমাস্টারের মেয়ে বাণীকে ভুতে পেয়েছে। তোর আব্বার কাছে তাবিজ এনে দিয়েছেন আমার আব্বা। হরিমাস্টার আব্বাকে বলেছে, কেউ যেন জানতে পারে না। জানলে একঘরে করবে। শফি বলেছিল, কেন? খয়রাডাঙার যে পিরের গান ভেঙে দিয়েছেন আব্বা, সেখানে তো হিন্দুরাও মানত দিত। রবি বলেছিল, ধুর বোকা! সে তো মাজার। হিন্দুরা ঢিবি-টিবি দেখলেই পেন্নাম ঠোকে। আর তোর আব্বা তা মানুষ-পির!….
ছুটি ঘোষণার দিন স্কুল থেকে ফেরার পথেই শফি পড়ে গেল বড়োগাজির পাল্লায়। দহলিজের বারান্দায় মাঝখানে খানিকটা গোলাকার অংশ বেরিয়ে এসেছে খোলা আকাশের নীচে। সেখানে লাইম-কংক্রিটের দুধারে অর্ধবৃত্তাকার বেনচ। মাঝখানে ফাঁকা এবং সিঁড়ির ধাপ। সেই বেনচে বসে বড়োগাজি বাসি স্টেটসম্যান পড়ছিলেন– রবির মতে, যা নাকি স্রেফ লোকদেখানো ভড়ং।
রবি হনহন করে চলে গেল। কিন্তু বড়োগাজির ‘শফিউজ্জামান’ ডাকটিতে কিছু ছিল, শফি দাঁড়িয়ে পড়েছিল। বড়োগাজি ডাকলেন, কাম অন মাই বয়, কাম অন!
শফি আড়ষ্টপায়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠে গেল। বড়োগাজি বললেন, সিট ডাউন। তিনি তাঁর পাশের জায়গায় একটি থাপ্পড় স্থান নির্দেশও করলেন। শফি বসল।
বড়োগাজি বললেন, স্কুলের পুজো ভ্যাকেশন হল?
জি।
হাসতে লাগলেন বড়োগাজি।…পিরসায়েবের ছেলে তুমি! জি বলছ! ভেরি ওয়েল! তবে তোমার ওই দেওয়ানসায়েবের চেয়ে আমি এককাঠি সরেস। জি টি পসন্দ করি না।
শফি মৃদুস্বরে এবং একটু হেসে বলল, তাহলে কী বলব?
বড়োগাজি তার কাঁধে একটা হাত রেখে বললেন, তুমি আমাকে গাজি আংকেল বলবে! বলো তো আংকেল মানে কী?
কাকা –স্কুলের অভ্যাসে শব্দটি বলেই শফি শুধরে নিল। চাচা।
বড়োগাজি ঠিক বারু চৌধুরির প্রতিবিম্বের মতো অট্টহাসি এবং ভঙ্গি করে বললেন, কাকা, চাচা, খুড়ো, জ্যাঠা, মামা –এভরিওয়ান। কিন্তু তুমি কাকা বললে, ওটা কিন্তু মুসলমানি ওয়ার্ড। তুর্কি সুলতানদের আমলে কাকা চালু হয়েছিল। দ্যাটস এ টার্কি ওয়ার্ড।
বলে বড়োগাজি চোখ নাচিয়ে চাপা স্বরে ফের বললেন, পুজো ভ্যাকেশানে বাড়ি যাচ্ছ তো?
শফি আস্তে মাথাটা শুধু নাড়ল। সে নিজেই জানে না কী করবে।
বড়োগাজি একই ভঙ্গিতে বললেন, সেদিন দেওয়ানসাহেবের কাছে শুনলাম লেট তোফাজ্জেল চৌধুরির যমজ মেয়েদের সঙ্গে তোমাদের দু-ভাইদের বিয়ে হবে?
শফি চুপ করে থাকল।
তোফাজ্জেলও আমার বন্ধু ছিল। বড়োগাজি একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, ওকে সবাই তোফা চৌধুরি বলে ডাকত। কেন জান? লাইফটাকে সে আনন্দে কাটাতে চাইত। হি ওয়াজ আ ম্যান অফ প্লেজর।…তো দা পুওর ম্যান ফেল্ড আ ভেরি-ভেরি স্যাড ডেথ। রাস্তার মরে পড়ে ছিল।
শফি তাকাল। তাকে তো একথা কেউ বলেনি।
বড়োগাজি আস্তে বললেন, হি ওয়জ আ ফুলিশ ম্যান। তুমি নিশ্চয় আশরাফ আজলাফ বোঝ।
জি।
আবার জি? বড়োগাজি কপট ধমক দিলেন। তারপর বললেন, আজলাফ ঘরের মেয়েকে বিয়ে করাটাতে দোষের কিছু নেই। আমিও–তো…বড়োগাজি থেমে গেলেন হঠাৎ। মুখ তুলে সামান্য দূরে একটা তালগাছের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর একটু হাসলেন।… দেওয়ানসাহেবের মতে, তোমার বিয়ে করাটা ঠিক হবে না। আর আমার মতেও তাই। আমরা চাইছি, মুসলমান ছেলেরাও ইংরেজি স্কুলে পড়ুক। যে মুসলমান এই সেদিন পর্যন্ত বাদশাহি করেছে, সে মুসলমান হিন্দুর গোলাম হয়ে যাবে –এটা সহ্য করা যায় না। ক-বছর ধরে ফাইট করে হরিণমারা স্কুলে মৌলবি টিচার রাখতে বাধ্য করেছি। মুসলমান ছাত্র আরবি-ফারসিও শিখুক, আবার ইংরেজি শিখুক। কেন? না-আরবি-ফারসি শিখলে সে তার পূর্বপুরুষের কালচার-সিভিলাইজেশান কী ছিল, জানতে পারবে। আর ইংলিশ শিখলে সে। হিন্দুদের গোলামে পরিণত হবে না। কী? ‘মাই হ্যাজ’?
শফি চুপচাপ ইংরেজি খবরের কাগজের দিকে তাকিয়ে ছিল। খয়রাডাঙার। জমিদারকেও সে ইংরেজি কাগজ পড়তে দেখেছে। চোখে পড়লে বড়োগাজি কাগজগুলো ভাঁজ করে কপট লুকোনোর ভঙ্গিতে বললেন, ওসব পরে– পরে হবে। কথা হচ্ছে, তোমাদের স্কুলে যখন ফাইনাল একজামিনেশন, তখনই তোমার বিয়ের দিন ধার্য হয়েছে। দেওয়ানসাহেবকে আমি বললাম, ঠিক আছে। আই অ্যাম হেয়ার– দা টাইগার অফ হরিণমারা। লোকে আড়ালে আমাকে বলে বাঘাগাজি। জান তো?
শফি মাথা নাড়ল।
জেনে রাখো। তো–
এইসময় দলিজঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে একটা লোক মৃদুস্বরে বলল, নাশতা, ছার!
বড়োগাজি শফির হাত ধরে ওঠালেন। কাগজগুলো বগলদাবা করে হাসতে হাসতে বললেন, করিমকে কিছুতেই স্যার শেখাতে পারলাম না, বুঝলে? ছার! ভেংচি কাটলেন করিমের উদ্দেশে, ছা–আ–র। ধুর হতভাগা। যা, গিয়ে বল, একজন খুদে গেস্ট আছে। বুঝলি তো?
করিম দাঁত বের করে বলল, বুঝেছি। ম্যামান ছার।
বড়োগাছি তেড়ে গেলেন।…মেহমান বলতেও পারে না। বুঝতে পারলে শফি? এই তো মুসলমানের অবস্থা। না ঘরকা না ঘাটকা।
ঘরের ভেতর ঢুকে শফি অবাক হয়ে দেখল, স্কুলের লাইব্রেরি-ঘরের মতো সারবন্দি বইভরতি আলমারি। চেয়ার, টেবিল, আরামকেদারা। দেয়ালে বাঁধানো সব অচেনা মানুষের ছবি। শফি আব্বা-আম্মার কাছে জেনেছে, মানুষ বা জীবজন্তুর ছবি মুসলমানের জন্য হারাম (নিষিদ্ধ)। ঘরের একপাশে একটি নকশাকরা পালঙ্ক। পালঙ্কে সুন্দর বিছানা। কিন্তু বিছানার ওপাশে দেওয়াল ঘেঁসে এলোমেলো প্রচুর বই-কাগজ। শফি ভাবল, বড়োগাজি তাহলে রাতে এখানেই শোন।
টেবিলের কাছে তাকে নিয়ে গেলেন বড়োগাজি। একটি চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। অন্যদিকে মুখোমুখি নিজে একটা চেয়ারে বসলেন। টেবিলে সুদৃশ্য দস্তরখান। তার ওপর রাখা আছে নকশাদার চীনামাটির থালা আব ততরি (ছোটো প্লেট)-তে একরাশ সুখাদ্য। থালায় আছে পরোটা, প্লেটে ভুনা গোশ আর ফিরনি। ফিরনিতে কিসমিস দেওয়া আছে। একটা প্লেটে শাদা ঘন কাথের মতো লাচ্ছা সেমাই। শফি খোনকারবাড়ি সকালের নাশতার কথা ভাবছিল। রোজ সকালে রবি আর সে একথালা মুড়ি-গুড়, কিংবা গুড়ের বদলে দুটুকরো বাতাসা খায়। কোনো-কোনোদিন মিষ্টি আচার দিয়ে পান্তাভাতও। একদিন রবির দুলাভাই (জামাইবাবু এসেছিল বলে তিনিসুদ্ধ তত্তাপোশে দস্তরখান পেতে পরোটা-সুজি আর আর হালুয়া খাওয়া হয়েছিল।
তার চেয়ে বড়ো ঘটনা চেয়ারে বসে টেবিলে খাওয়া। ভৃত্য করিম খাঞ্চায় (ট্র) সাজিয়ে আরেকপ্রস্থ খাদ্য এনে যত্ন করে সাজিয়ে দিল শফির সামনে। বড়োগাজি ঘোষণা করলেন, নাও, লেটাস বিগিন!
শফি লক্ষ্য করল, বারুচাচাজির মতো উনিও বিসমিল্লাহ উচ্চারণ করলেন না। পরোটা ছিঁড়ে চিবুতে শুরু করলেন। শফি অভ্যাসে বিসমিল্লাহ বলে হাত লাগালে বড়োগাজি তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন শুধু।
করিম একটু তফাতে দাঁড়িয়ে শফিকে সন্দিগ্ধদৃষ্টে দেখছিল। একসময় সে আর চুপ করে থাকতে পারল না। বলে উঠল, ইনি মৌলাহাটের পিরসাহেবের ছেলে না? হুঁ –তাই ভাবছি, চেনা-চেনা মনে হয়, অথচ –সালাম বাপজান! সে কপালে হাত ঠেকিয়ে আদাব দিল।
বড়োগাজি ধমক দিলেন।…দেখবি, আজ যেন চা ঠাণ্ডা না হয়। গিয়ে বল!
করিম যেতে-যেতে কিছু ফিরে বলল, উনি চাহা খাবেন তো ছার?
বড়োগাজি মুখ টিপে হেসে শফিকে বললেন, কী? চা চলবে তো?
শফি মাথা দোলাল। চলবে! চা সে জীবনে একবার খেয়েছে মনে আছে। তার একটি ভাই, যে ছোটোবেলাতেই মারা যায়, তার জন্মের সময় তার আব্বা বাড়িতে ছিলেন না। দূরের কোনো গ্রামে শিষ্যবাড়ি ছিলেন তখন! খবর পেয়ে উনি বাড়ি ফিরেছিলেন। সঙ্গে ‘চা’ এনেছিলেন। প্রসবের পর মেয়েদের শরীরের রস শুকোতে ‘ঝাল’ খাওয়ানো হয়। শফি জানে। পুঁটপিপুলের বাটনার সঙ্গে আতপচালের আটা আর গুড় রান্না করা হয়। খেতে বড় ঝাল। কিন্তু মিঠে। নাকচোখ দিয়ে জল বেরুলেও শফি তারিয়ে-তারিয়ে খেয়েছিল ঝাল। সেবার আব্বা চা খাওয়ালেন মাকে। কেমন একটা নতুন আর আশ্চর্য স্বাদ-গন্ধ! শুধু চা নয়, কেটলিও কিনে এনেছিলেন তার আব্বা। কেটলির ভেতর চায়ের পাতার গন্ধটা মনে আছে। তারপর আর কোনোদিন তাদের বাড়িতে চা হয়নি। কেটলিটা রাখা থাকত তত্তাপোশের তলায়। লুকিয়ে বের করে ঢাকনা খুলে শুঁকত শফি। যেন পেত সেই আশ্চর্য গন্ধটা। না পেলেও পেত!…
হাঁ-হাঁ করে উঠলেন বড়োগাজি!…ও কী! ওইটুকু খেয়ে বাঁচবে কী করে? সবটা খাও। তবে না একজন ফাইটার হবে। লড়াই করতে পারবে।
অমনি শফির মনে পড়ে গেল তলোয়ারটার কথা। তখন কথাটা সে তুলল না। বড়োগাজির পীড়াপীড়িতে অন্তত ফিরনিটা সবই খেতে হল। টেবিলের তলায় একটি সেলেপচি বা হাত ধোওয়ার পাত্র রাখা ছিল। কারুকার্যময় উজ্জ্বল পেতলের। সেলেপচিটি বড়োগাজি নিজেই টেবিলে তুললেন। শফির হাতে একটি সুন্দর ছোট্ট সোরাহি থেকে জল ঢেলে দিলেন। তারপর নিজের হাত রুমালে মুছে বললেন, ওয়েট আ বিট। করিম টাওয়েল এনে দিচ্ছে।
শফি রুমাল বের করল। এই রুমালটি রুকু তাকে দিয়েছিল। সবার সামনেই দিয়েছিল। রুমালটি রেশমের। মৌলাহাটে ‘মোমিন সম্প্রদায়’ বা তাঁতশিল্পীরা আছে। অন্য লোকে তাদের জোলা বলে। তাই রুমালের কাপড়টি ছিল স্থানীয় এবং রুকু তাতে লালসুতোয় আরবি হরফে ‘আল্লাহ’ শব্দ, তার তলায় একটি গোলাপ বুনে দিয়েছিল। দুই বোনই এসব কাজে বড় পাকা– আয়মনির উক্তি। আর সেই রুমালটিতে এতদিনে মুখ মুছে নোংরা করে ফেলেছিল শফি। বড়োগাজির দৃষ্টি এড়াল না। বললেন, রুমাল কাচো না কেন? সবসময় ফিটফাট থাকবে কেমন?
তারপর আবদুল চা আনল। সুন্দর চায়ের কাপ-প্লেট দেখে শফি আরও অভিভূত। তারপর চায়ে চুমুক দেওয়ামাত্র মায়ের কথা মনে পড়ে গেল তার। বুকের ভেতর একটা তোলপাড় জাগল। সঙ্গে-সঙ্গে সে ঠিক করে ফেলল, ছুটিটা সে বাড়িতেই কাটাবে।
কিন্তু তার আগে তলোয়ারটি দেখে যাওয়ার ইচ্ছে তাকে পেয়ে বসল। বড়োগাজি চা খেতে-খেতে কিছু ভাবছিলেন। শফি তাঁকে কী সম্বোধন করবে ঠিক করতে পারছিল না। চাচাজি বললে উনি রাগ করবেন। একটু পরে দ্বিধাজড়িত কণ্ঠস্বরে সে আস্তে ডাকল, গাজি আংকল!
ইয়েস! বডোগাজি মিটিমিটি হাসতে লাগলেন।
আপনার ঘোড়ার জিনে একটা তলোয়ার দেখেছিলাম।
দেখবে তুমি? বলে হাঁক দিলেন, করিম! করিম বখ্শ্!
করিম অন্দর থেকে দৌড়ে এসে বলল, ছার!
আমার তলোয়ার নিয়ে আয়। বলে শফির দিকে ঘুরলেন বড়োগাজি। বললেন, তলোয়ার ইংরেজি কী?
সোর্ড।
ব্র্যাভো! শাব্বাশ! বড়োগাজি টেবিলে থাপ্পড় মারলেন।…আমাদের ফ্যামিলির পদবি গাজি কেন জান? আমার পূর্বপুরুষ এ অঞ্চলে এসেছিলেন আকবর দা গ্রেটের আমলে। সেনাপতি মানসিংহের আনডারে মনসবদার ছিলেন একজন। তাঁর নাম ছিল ফরিদ খান। এই পরগনার নাম ছিল ফতে সিং পরগনা। ফতে সিং নামে একজন হাড়িবংশীয় রাজা– কুঁজোর সাধ যায় চিত হয়ে শুতে– যাকে দয়া করে। পরগনার জায়গিরদার করা হয়েছিল, সে বলল, আমি বদাশাহকে খাজনা দেব না । বোঝ অবস্থা। মানসিংহ এলেন বিদ্রোহদমনে। আব ফরিদ খান মনসবদার তলোয়ারের এক কোপে ঘ্যাচাং করে হাড়িরাজার মুভুটি কেটে পাঠিয়ে দিলেন দিল্লিতে বাদশাহের কাছে। বাদশা খুশি হয়ে খেতাব পাঠালেন সিলমোহর করে। অ্যানড দ্যাট ওয়জ দা মোসট অনারেবল টাইটেল অ্যামং দা মোসলেম ও গাজি। তুমি পিসাহেবের ছেলে। ডু ইউ নো হোয়াট ডজি ইট মিন?
শফি আবৃত্তি করল, কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধে যারা মারা যায়, তারা শহিদ। আর কাফেরদের যারা মারতে পারে তারাই গাজি।
দ্যাটস কারেকট। বড়োগাজি মুখে বললেন। আমরা গাজির বংশধর। কথা হচ্ছে, একসময় মোসলেমরা খ্রিস্টিয়ানদের সঙ্গে ক্রুসেড–আই মিন, জেহাদ করেছে। ইনডিয়াতেও ইংরেজের সঙ্গে মোসলেমরা লড়েছে। পলাশির যুদ্ধে হেরে গেছে। সেদিনও এইটটিন ফিফটিসেভেনেও শেষবার লড়াই করেছে। বেঙ্গলে হিন্দুদের ট্রেচারির জন্যই বাহাদুর শাহ ওয়জ ডিফিটেড। অ্যানড নাও এগেন দা টাইম হ্যাজ কাম। কিন্তু এ লড়াই অন্য লড়াই। ওয়র অফ ব্রেইন। ডু ইউ আনডারস্ট্যানড?
শফি তলোয়ারটার জন্য অস্থির। সে কিছুই কানে নিচ্ছিল না। করিম বখশ কোষবদ্ধ অস্থটি দুহাতে সসম্ভ্রমে নিয়ে এলে বড়োগজি উঠে দাঁড়ালেন। সেটি হাতে নিয়ে শফিকে ভীষণ চমকে দিয়ে নিষ্কাশিত করলেন। তারপর মহরম অনুষ্ঠানে তলোয়ারখেলার মতো বারকতক সঞ্চালিত করে হাসতে হাসতে বললেন, নাও, দ্যাখো। তবে তলোয়ারের দিন আর নেই রে, বাবা! এটা নেহাত পূর্বপুরুষের একটা স্মৃতিচিহ্ন– জাস্ট এ স্যুভেনির। র্যাদার –এ শো। যেমন আমি ফেলট্ হ্যাট পরি।
শফি তলোয়ারের মুঠো ধরে ওজন পরখ করল। ওজনদার। কিন্তু তার গায়ে কাঁটা দিল। হঠাৎ কী এক উত্তেজনা ভর করল তার শরীরে। মহরম অনুষ্ঠানে সে দেখেছে। তার আব্বার মতে, ওইগুলা শিয়াদের কফরি কাম। হানাফি মজহাবের লোকেরা হুজুগে ওইসব করে-টরে। সুন্নি মজহাব মুহরমের দিন রোজা রাখবে। এতিম-ফকিরকে দানখয়রাত করবে। হানাফিরা সুন্নি হয়েও শিয়াদের মতো কাম করে। তাজিয়া বানায়। দুলদুল’ ছিল হজরত হোসেনের ঘোড়র নাম। তওবা, তওবা! কোথায় হজরত হোসেনের দুলদুল, কোথায় এই হাড্ডিসার ঘোড়া! স্রিফ ‘শেরেকি’ (ঈশ্বরের অংশীদারি) কাম। বেরাদানে ইসলাম! মুহরমের দিন শোকের দিন। তলোয়ার নিয়ে কুস্তোকুস্তির দিন নয়। কান্নার দিন। প্রায়শ্চিত্তের দিন।
শফির কিছু অনুভূতি, যা ওই ধারালো, নকশাখচিত, ইস্পাতের বাঁকা, দীর্ঘ, সুচ্যগ্র বস্তুটি দেখতে-দেখতে এবং ছুঁতে-ছুতে সারা শরীরকে শক্ত করে ফেলছিল, ক্রমশ একটি বোধ এনে দিল। তার মনে হল, সে তলোয়ারটি দিয়ে সহজেই কাউকে বিদ্ধ করতে পারে। কেটে দু-টুকরো করে দিতে পারে। আর এ মুহূর্তে যেন বা সারা পৃথিবী তার করতলগত। সে ইচ্ছে করলেই শাহ (আলেকজানডার) হতে পারে।
আর সেইসময় বাইরে কেউ এসে ডাকল, গাজিসায়েব আছ নাকি? ও সদু!
বড়োগাজি দরজার দিতে ঘুরে সহাস্যে বলে উঠলেন, হ্যাল্লোও! এ বোলট ফ্রম দা ব্লু বলব, নাকি মেঘ না চাইতেই পানি বলব?
শফি ঘুরে দেখে, বারুচাচাজি।
দেওয়ান আবদুল বারি চৌধুরী ঘরে ঢুকেই শফিকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। বললেন, ও কী রে? তলোয়ার নিয়ে কী করছিস তুই? তারপর বড়োগাজিকে বললেন, ডন কুইকজোটিক কারবার কবে ছাড়বে ভাই, সদু? বয়স তো কম হল না।
শফি তলোয়ার টেবিলে রেখে বারুচাচাজির পদচুম্বন করতে এল। কিন্তু তিনি তাকে বাধা দিলেন। গম্ভীরমুখে বললেন, খোনকারের বাড়ি হয়ে আসছি। খোনকারের ছেলে বলল তুই এখানে আছিস। আয়!
বড়োগাজি হাঁ-হাঁ করে উঠলেন।… চলে যাচ্ছ কী? কী হয়েছে, বলবে তো?
বারিমিয়াঁ বললেন, পরে বলব’খন।
বাইরে গিয়ে শফি দেখল একটা কালো ঘোড়া বাঁধা আছে নিমগাছের গোড়ায়। বারুমিয় সেদিকে পা বাড়িয়ে বললে, মৌলাহাট থেকে আসছি। তোদের বাড়ির খবর ভালোই। তবে –চল, যেতে-যেতে বলছি। ইন্দ্রাণীর কাছারিবাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম সেই ভোরে। মৌলাহাটে গিয়ে নাস্তাপানি করিনি। চল, ইন্দ্রাণীর আগেই ফতেপুর বাজারে কিছু খেয়ে নেব…