রামায়ণ : অযোধ্যাকাণ্ড – শ্রীরামের রাজা হওয়নোদ্যোগ ও অধিবাস
সুখেতে বঞ্চিয়া রাত্রি উদিত অরুণে।
আনন্দে গেলেন রাম পিতৃ-সম্ভাষণে।।
ভক্তিভাবে পিতার বন্দেন শ্রীচরণ।
রামেরে কহিল রাজা শুভাশীর্ব্বচন।।
সিংহাসনে বসাইল রাজা শ্রীরামেরে।
পিতা পুত্র উভয়ের আনন্দ অন্তরে।।
রাজা বলিলেন, রাম কর অবধান।
যত কর্ম্ম করিয়াছি, কহি তব স্থান।।
যজ্ঞ করি তুষিলাম যত দেবগণে।
তুষিলাম পিতৃলোক শ্রাদ্ধ ও তর্পণে।।
রাজা হয়ে করিলাম লোকের পালন।
তোমা হেন পুত্র পাই যজ্ঞের কারণ।।
পালিলাম রাজনীতি ধর্ম্ম আনিবার।
তোমারে করিব রাজা ভাবিয়াছি সার।।
বৃদ্ধ হইলাম আমি, মরিব কখন।
তোমারে করিব রাজা, পাল সর্ব্বজন।।
আজি হতে তোমারে দিলাম রাজ্যভার।
স্বপক্ষ পালন কর বিপক্ষ সংহার।।
কিন্তু আজি কুস্বপন দেখেছি উৎপাত।
আকাশ হইতে ভূমে পড়ে উল্কাপাত।।
পূর্ণিমায় চন্দ্র গ্রাস শাস্ত্রের বিহিত।
দেখি অমাবস্যায় এ অতি বিপরীত।।
ইত্যাদি জঞ্জাল আমি দেখিনু স্বপনে।
গর্দ্দভের পৃষ্ঠে চড়ি গেলাম দক্ষিণে।।
কুস্বপ্ন দেখিনু আজি, নিকট মরণ।
তুমি রাজা হও তবে সফল জীবন।।
কনিষ্ঠ ভরত, তার না জানি আশয়।
তারে রাজ্য দিতে কভু উপযুক্ত নয়।।
জ্যেষ্ঠ সত্ত্বে কনিষ্ঠের নাহি অধিকার।
তুমি রাজা হও রাম, কর অঙ্গীকার।।
কত শত শত্রু তব আছে কত স্থানে।
কেবা শত্রু, কেবা মিত্র, কেবা তাহা জানে।।
আমি বিদ্যমানে ধর ছত্র নব দণ্ড।
কি জানি আসিয়া কেহ হয় বা পাষণ্ড।।
আজি অধিবাস পুনর্ব্বসু সুনক্ষত্র।
পুষ্যা কল্য হইবে ধরিবে দণ্ডছত্র।।
এতেক বলিয়া রামে দিলেন বিদায়।
অন্তঃপুরে রামচন্দ্র গেলেন ত্বরায়।।
বসেছেন কৌশল্যা বেষ্টিত সখীবৃন্দে।
সাত শত রাণী তথা আছেন আনন্দে।।
দেবপূজা করে রাণী নানা উপহারে।
হেনকালে শ্রীরাম গেলেন তথাকারে।।
রামেরে দেখিয়া রাণী সহাস্য বদন।
মায়ের চরণ রাম করেন বন্দন।।
মায়ের সম্মুখে দাণ্ডাইয়া রঘুনাথ।
কহেন সকল কথা করি যোড়হাত।।
আমারে দিলেন পিতা সর্ব্ব রাজ্যখণ্ড।
আজি অধিবাস, কালি পাব ছত্র দণ্ড।।
আমা রাজা করিতে সবার অভিলাষ।
শুভবার্ত্তা কহিতে আইনু তব পাশ।।
নানা উপহারে মাতা কর ইষ্টপূজা।
মম প্রতি যেন তুষ্টা হন দশভুজা।।
এতেক শুনিয়া রাণী হরষিত মন।
রামের কল্যাণ করিলেন অগণন।।
কৌশল্যা বলেন, রাম হও চিরজীব।
সহায় হউন তব শ্রীপাব্বর্তী শিব।।
অনেক কঠোরে আমি পূজিয়া শঙ্করে।
তোমা হেন পুত্র রাম ধরিনু উদরে।।
শুভক্ষণে জন্ম নিলা আমার ভবনে।
রাজমাতা হইলাম তোমার কারণে।।
সুমিত্রা সপত্নী সে আমাতে অনুরক্ত।
তার পুত্র লক্ষ্মণ তোমার বড় ভক্ত।।
তোমার কুশল সেই চাহে অনুক্ষণ।
অতি হিতকারী তব সুমিত্রা নন্দন।।
এতেক কৌশল্যা দেবী কহিলেন কথা।
হেনকালে শ্রীলক্ষ্মণ আইলেন তথা।।
লক্ষ্মণেরে দেখিয়া হাসেন রঘুনাথ।
কৌশল্যারে বন্দেন লক্ষ্মণ যোড়হাত।।
লক্ষ্মণেরে প্রেমভরে দিয়া রাম কোল।
বলেন সহাস্য বদনেতে মিষ্ট বোল।।
মম ভক্ত ভাই তুমি পরম সুধীর।
তুমি আমি ভিন্ন নহি একই শরীর।।
আমার হিতৈষী তুমি, যদি পাই রাজ্য।
উভয়েতে মিলিয়া করিব রাজকার্য্য।।
এতেক বলিয়া রাম হইল বিদায়।
আশীর্ব্বাদ করিল সকল রাণী তায়।।
গেলেন পিতার কাছে শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
রাজা বলে, রাম এল হৈল শুভক্ষণ।।
বশিষ্ঠ নারদ আদি আইল সে স্থানে।
আজ্ঞা পেয়ে আয়োজন করে সর্ব্বজনে।।
নিমন্ত্রণ করিয়া আনিল রাজগণ।
রাম রাজা হবেন, সকলে হৃষ্টমণ।।
বিদ্যাধরী নাচে, গায় গন্ধর্ব্বে সঙ্গীত।
চতুর্দ্দিকে জয়ধ্বনি শুনি সুললিত।।
লক্ষ লক্ষ পতাকা উড়িছে নানা রঙ্গে।
রাজগণ এল সব কটকের সঙ্গে।।
নানা রঙ্গে রথ রথী হস্তী ঘোড়া সাজে।
নানা জাতি বাদ্য শুনি নানাদিকে বাজে।।
অধিবাস করিতে আইল ঋষি মুনি।
রামজয় বলিয়া করিছে বেদধ্বনি।।
নারিকেল গুবাক রোপিল সারি সারি।
ঘৃতের প্রদীপ জ্বালে প্রজার কুমারী।।
নানা রত্নে নির্ম্মাইল লক্ষ লক্ষ ঘর।
বিবিধ পতাকা উড়ে চালের উপর।।
পৃথিবীতে আছে যত নানা উপহার।
তাহা আনি লক্ষ লক্ষ ভরিল ভাণ্ডার।।
নানা রত্নে শোভিত বসন পরিহিত।
অযোধ্যার যত লোক, সবে আনন্দিত।।
আইল দেশের লোক অযোধ্যানগরে।
কেহ নাচে কেহ গায় হরিষ অন্তরে।।
অধিবাস দেখিতে আইল দেবগণ।
অন্তরীক্ষে রহে সবে চাপিয়া বাহন।।
ব্রহ্মা শিব আদি করি যত দেবগণ।
ভগবতী আদি করি দেবী অগণন।।
অধিবাস দেখিতে আইল সর্ব্বজন।
কৌতুকেতে পুষ্পবৃষ্টি করেন তখন।।
ঋষিগণে দেখিয়া উঠিয়া রঘুনাথ।
পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া পূজে করি প্রণিপাত।।
বশিষ্ঠ বলেন, রাম শাস্ত্রের বিহিত।
তব অধিবাস আমি করি যে উচিত।।
পিতৃ-বিদ্যমানে ধর দণ্ড আর ছাতি।
নহুষ রাজার যেন তনয় যযাতি।।
বশিষ্ঠ করেন সুমঙ্গল বেদধ্বনি।
অখিল ভুবনে শব্দ রামজয় শুনি।।
অধিবাস রামের হইল সমাপন।
আনন্দে দেখিয়া স্বর্গে গেল দেবগণ।।
জয় জয় হুলাহুলি করে রামাগণ।
নৃত্য গীতে আনন্দিত অযোধ্যা-ভুবন।।
রামসীতা উপবাসী রহে দুইজন।
চন্দনে চর্চ্চিত অঙ্গ, সকৌতুক মন।।
নানা রত্ন ধন সবে দিলেক যৌতুক।
নিজালয়ে গেল সবে দেখিয়া কৌতুক।।
বলেন বশিষ্ঠ মুনি রাজার সদনে।
অধিবাস রামের হইল শুভক্ষণে।।
শুনিয়া হাসেন রাজা আনন্দিত মনে।
নানা রত্ন দানে রাজা তুষিল ব্রাহ্মাণে।।
বেলার হইল শেষ, নক্ষত্র গগনে।
অধিবাস দেখি ঘরে গেল সর্ব্বজনে।।
সুগন্ধি পুষ্পের গন্ধ বহে চতুর্ভিত।
দেবতুল্য বেশে সবে শুইয়া নিদ্রিত।।
রাত্রি অবসান হয় সূর্য্যের উদয়।
শয়ন ত্যজিল সবে আনন্দ হৃদয়।।