অন্য সকাল
মাহি একমনে গাছের পরিচর্যা করছে, ছোট্ট লনে সে নানা রকম ফুলের গাছ লাগিয়েছে। শীত শেষে বসন্তের নানা ফুল ফুটে আছে। লাল-হলুদ গাঁদা নানা রঙের ডলিয়া আর চন্দ্রমল্লিকা। বড় রাস্তার পাশেই ছিমছাম সুন্দর একতলা বাড়ি ওদের, বাড়ির সামনে সবুজ ঘাসে ঢাকা ছোট্ট লন। ইট বিছানো রাস্তা সদর গেট পর্যন্ত চলে গেছে। তার দু’ধারে ফুলের গাছ কিছু টবও আছে।
সে গত বছর তিনটে গোলাপের গাছ লাগিয়েছে লাল, গোলাপি আর সাদা। এবার গাছে কুঁড়ি সবে মাত্র ফুটতে শুরু করেছে। বাবার হাত ধরে তুতুল বাগানে এসেছে, ভাইয়ের কাজ দেখছে। বাবা বললেন, “মাহি তোমার ফুলবাগান তো খুব সুন্দর ফুলে ফুলে ভরে গেছে।” মাহি বললো, “বাবা সারপ্রাইজ!” বাবা হাসলেন শুধু। তুতুল উৎসুক দৃষ্টিতে ভাইয়ের কাজ দেখছে।
মাহি এবার ক্লাস এইটে, তুতুল এর বয়স সাত কিন্তু সবে ভর্তি হয়েছে, ব্যতিক্রমী পাঠদানের স্কুলে। মাহি ভেবেছে, এবার সে তুতুলকে শহিদ মিনারে নিয়ে যাবে। আর মাত্র দু’দিন পরেই একুশে ফেব্রুয়ারি। মাহিদের স্কুল থেকে প্রভাত ফেরির আয়োজন করা হয়। ছাত্র শিক্ষক অবিভাবক সবাই ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যান। মাহি অধীর অপেক্ষায় দিন গুণছে গোলাপ ফোটার। কারণ তুতুলকে নিয়ে নতুন গাছের গোলাপ দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে যাবে শহিদ মিনারে। আজ সে দেখলো কুঁড়ি গুলো বেশ পাপড়ি মেলেছে। তার খুব আনন্দ, বোনকে হাত ধরে নিয়ে দেখালো, নিজে আলতো ছুঁয়ে দেখলো।
নির্বাক তুতুলের বড় বড় সরল চোখে রাজ্যের কৌতূহল! ভাইয়ের মতো সেও ছুঁয়ে দেখলো, অনাবিল হাসি মুগ্ধতায় ভরে উঠলো ওর মুখ। মা ডাকলেন, “মাহি তুতুলকে নিয়ে ভিতরে এসো।”
মাহি ভীষণ আনন্দিত কাল একুশে ফেব্রুয়ারি খুব ভোরে উঠতে হবে, মাকে বললো, “আম্মা সকালে আমাকে ডাকবেন ফজরের আজানের সময়।” মা ছেলের মাথায় হাত দিয়ে হেসে বললেন,”আচ্ছা বাবা।”
সে বিকেলে অনেক গুলো ফুল তুলে আনলো দুইটা তোড়া বানাতে হবে, বাবা বানাবেন অফিস থেকে ফিরে এসে। ভোরে শুধু গোলাপ তুলে সাজিয়ে রওনা হবে। সকালে বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে যাবে প্রভাতফেরি।
ভোরে দু’ভাইবোন তৈরি হয়ে ফুলের তোড়া হাতে খালি পায়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালো। সবার মুখে মাস্ক, নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে এগিয়ে আসছে দীর্ঘ শোভাযাত্রা। হাতে ব্যানার প্ল্যাকার্ড ফুলের তোড়া,ফুলের শ্রদ্ধার্ঘ। সবাই গলা মিলিয়ে গাইছে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কী ভুলিতে পারি।” ভোরের বাতাসে বিমোহিত সুরের মূর্ছনায়, ফুলের সুরভিতে পবিত্র এক অন্য সকাল। মাহি বোনের হাত ধরে এগিয়ে গেলো চলমান মানুষের সঙ্গে।এগিয়ে চললো কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের দিকে।
তুতুল বাকহীন তার পৃথিবী ঘিরে আছে নৈঃশব্দ্য। কিছু বুঝতে পারছে না শুধু অবাক বিস্ময় নিয়ে হেঁটে চলেছে…
ঠিক অবোধ ধরিত্রীর মত ভাষাহীন তবুও আবেগ অনুভূতির তোলপাড় চোখে মুখে। হাজারো অব্যক্ত কথা ভিতর নাড়িয়ে দিচ্ছে তার, ভাইয়ের হাত চেপে রেখেছে হাতে। মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইছে এই ছোট বড় নানা মানুষের মিছিল কোথায় চলেছে? কোথায় চলেছে সে, বা তারা?
সব বোধের উর্ধ্বে অবোধ্য তার অনুভব থমকে যায়, সন্মুখে বেদিমূল! অজস্র ফুল! নিবেদনে শ্রদ্ধাবনত মানুষের সারিবদ্ধ পদযাত্রা।
তুতুল আর মাহি পৌঁছে যায় বেদির সামনে। হাতের ফুল রেখে তাকিয়ে রইলো তুতুল, মাঝের মিনারের বুকে রক্তলাল বৃত্ত অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট মিনারে অক্ষর অ,আ,ক,খ ভোরের সূর্য-লালিমায় অভূতপূর্ব দৃশ্য। অবুঝ চোখে ভাইয়ের দিকে তাকালো সে, অনেক জিজ্ঞাসার উত্তর চাওয়া সজল চোখ। হতবিহ্বল! ছুঁয়ে দেখছে ফুল বেদি, অসহায় দৃষ্টি, ভাইয়ের হাত সজোরে চেপে ধরলো তুতুল..
হঠাৎ মাহির বুকটা মুচড়ে উঠলো, তুতুলকে জড়িয়ে ধরলো, তার চোখে জল। তুতুলকে শিখাতে হবে, মুখে ভাষা নাই তাতে কি! নীরবতার মাঝেও ভাষার সরবতা আছে। নিশ্চয়ই সেও স্কুলে সব আবেগ অনুভূতির নীরব ভাষা শিখে নেবে, মায়ের আর মাতৃভূমির প্রেরণায় উজ্জীবিত হবে। একুশের ত্যাগ মহিমা সেও জানবে বুঝবে।
অঢেল ফুলের উপঢৌকন মানুষজন আর শহিদ মিনার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রইলো, চারিদিকে আলো, পাখিদের কিচির মিচির, কিছু দূরে লাল পলাশে ছেঁয়ে আছে গাছ। মাহি তুতুলের হাত ধরে ফিরে চলল, আকাশে তখন ঝলমলে সূর্য….।