Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অদৃশ্য হাত || Sasthipada Chattopadhyay

অদৃশ্য হাত || Sasthipada Chattopadhyay

রাজহাটি গ্রামের শেষ প্রান্তে একটি ছিটেবেড়ার ঘরে এক বুড়ি থাকত। বুড়ির কেউ কোথাও ছিল না। সারাদিন গ্রামে গ্রামে ভিক্ষে করে সন্ধের পর ঘরে ফিরত। আজ থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে গ্রামগুলোর যে কী চেহারা ছিল তা আশা করি কাউকে বুঝিয়ে বলতে হবে না। গ্রাম তখন গ্রাম ছিল । গ্রামের বাইরে মাঠ ছিল, বন ছিল, জঙ্গল ছিল— দুর্ভেদ্য অরণ্য ছিল। এই ছিল তখনকার প্রকৃতি। সে যাক, বুড়ির ঘরের কাছে মস্ত একটি বটগাছ ছিল। আর সেই বটগাছের ছায়ার নীচে ছিল বুড়ির কুঁড়েঘর। খুবই দুঃখে দিন কাটত তার। ভোরবেলা উঠে মাঠে গোবর কুড়োত। কাঠ কুড়োত। তারপর দুটো শুকনো মুড়ি জল দিয়ে ভিজিয়ে খেয়ে ভিক্ষেয় বেরোত। ভিক্ষেয় বেরিয়ে দোরে দোরে ঘুরে যা জুটত তাই খেত। আর সারাদিনের ভিক্ষার সামগ্রী যা জুটত, রাত্রে ঘরে ফিরে সেগুলো কাঠকুটো জ্বেলে ফুটিয়ে ফাটিয়ে খেত। চাল ডাল আলু বেগুন সব একসঙ্গে খিচুড়ির মতো করে রেঁধে পেটভরে খেয়ে মাটির দাওয়ায় শুয়ে ঘুমোত বুড়ি।

হঠাৎ একদিন বুড়ির মনে হল সে যা কিছুই খায়, খেয়ে তার পেট আর ভরে না। খেয়ে দেয়ে শুয়ে এক ঘুম দেওয়ার পরই খিদেয় চনচন করে পেটের ভেতরটা। এই না দেখে বুড়ি ক্রমশ তার খাওয়া বাড়িয়ে যেতে লাগল। কিন্তু আশ্চর্য! সে যত খেতে লাগল ততই তার খিদে বাড়তে লাগল। ক্রমে ভাতের হাঁড়ির চেহারাও বদল হতে লাগল। কিন্তু না। তাতেও কোনও সুরাহা হল না। চারজনের রান্না একসঙ্গে রেঁধে খেয়েও পেট ভরাতে পারল না বুড়ি। তাই মনের দুঃখে একদিন গ্রামের দু-চারজন লোকের কাছে কথাটা বলেই ফেলল। সবাই শুনে অবাক হয়ে বলল, “বলো কী! চারজনের রান্না একজনে খেয়েও পেট ভরাতে পারো না? তার ওপর তোমার মতো বুড়িমানুষ। এ হতে পারে না।”

নিরাপদ মাস্টার এই গ্রামেরই পাঠশালার গুরুমশাই ছিলেন। বললেন, “বেশ, দেখব বুড়ি তুমি কতবড় খাইয়ে। আজ তুমি ভিক্ষেয় বেরিয়ো না। আমার ঘরে এসো। আজ তোমার নেমন্তন্ন। দেখব তুমি কত খাও।”

বুড়ির তো আনন্দ আর ধরে না।

সে রাতে নিরাপদ মাস্টারের বাড়িতে খেতে এল বুড়ি। কিন্তু কী আশ্চর্য! চারজন কেন, একজন মানুষের খাবারও খেতে পারল না বুড়ি। সামান্য দু-চার গ্রাস মুখে দিতেই পেট ভরে গেল।

নিরাপদ মাস্টার বললেন, “আসলে কি জানো? তোমার এবার মতিভ্রম হয়েছে। বয়স কত হল?”

“তা ধরো না কেন, তিন কুড়ি দশ।”

“তা হলে এমন আর কী? সত্তর বছর। চোখে দেখতে পাও?”

“একেবারে কানা নই। তবে কখনও ঠাওর হয়, কখনও হয় না। কিন্তু বাবা, বিশ্বাস করো আমার কিচ্ছু হয়নি। ঘরে আমার খেয়ে পেট ভরে না।”

“ভরবে ভরবে। আসলে তুমি বুড়িমানুষ। নিজের ঘোরে থাকো। চাল ডাল ঠিকমতো নাও না।”

“সে কী বাবা! আমার সারাদিনের ভিক্ষের চাল, সে বড় কম নয়! এতবড় একটা হাঁড়িতে করে সব রেঁধেও খেয়ে আমি পেট ভরাতে পারি না।”

“কিন্তু এই তো, আমার এখানে পোয়াটাক চালের ভাতও তুমি খেতে পারলে না।” বুড়ি আর কী করে, ঘরে ফিরে এসে মাটির দাওয়ায় আঁচল বিছিয়ে শুয়ে নানারকম চিন্তাভাবনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে আবার মাঠে গিয়ে গোবর কুড়িয়ে দু’মুঠো শুকনো মুড়ি চিবিয়ে ভিক্ষেয় চলল বুড়ি। সারাদিন ভিক্ষে করে দিনের শেষে ঘরে ফিরে ভিক্ষার সমস্ত চাল ডাল আলু বেগুন একসঙ্গে বড় হাঁড়িতে ফুটিয়ে নিয়ে খেতে বসল। কিন্তু আশ্চর্য! দু-এক গ্রাস মুখে দিতে না দিতেই খাবারও ফুরিয়ে গেল, পেটও ভরল না তার—।

আর যা ঘটল তা ভারী মজার!

বুড়ি যখন খাচ্ছিল আর মনে মনে কাঁদছিল তখন তার মনে হল একটা অদৃশ্য হাত যেন তার পাত থেকে মুঠো মুঠো করে খাবারগুলো তুলে খেয়ে নিচ্ছে। বুড়ি যতবার হাতটা ঠেলে দিতে লাগল, হাতটা ততবারই ওর পাত থেকে খাবার তুলে নিতে লাগল। বুড়ি বুঝতেও পারল না কেন এমন হল, আর কেই বা সব খেল।

এই কথাটা বুড়ি পরদিন গিয়ে বলল নিরাপদ মাস্টারকে।

নিরাপদ মাস্টার বললেন, “বলো কী ! একটা হাত তোমার পাত থেকে খাবার তুলে খেয়ে নিতে লাগল, আর তুমি বসে বসে তাই দেখলে?”

“কী করব বাবা?”

“তা কে সে? চিনতে পারলে তাকে?”

“কী করে চিনব? অন্ধকারে কি কিছু দেখা যায়? আমার ঘরে লম্ফ পিদিম কিছুই নেই।” “বুঝেছি। এ নিশ্চয়ই কোনও চোর ছ্যাঁচড়ের কাজ।”

“তা যদি হয় বাবা, তা হলে তো তার আসা-যাওয়ার বা মুখ নেড়ে নেড়ে খাবার শব্দ শুনতে পেতুম। কিন্তু শুধু একটা হাত ছাড়া আর কিছুই তো টের পেলুম না অন্ধকারে। হাতটাকে যত ঠেলে দিই, সেটা ততই এগিয়ে আসে।’

নিরাপদ মাস্টার বললেন, “দেখো বুড়ি, তোমার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে তোমার খাবার সত্যিই কেউ খেয়ে নিচ্ছে। হয় কোনও চোর, নয়তো হনুমানে। তোমার বাড়ির পাশেই যে বটগাছটা আছে সেই বটগাছে নিশ্চয়ই একদল হনুমান আছে। এ তাদেরই কাজ।”

“না বাবা, হনুমান নয়। ও গাছে বাঁদর হনুমান মাঝেমধ্যে আসে বটে, তবে সন্ধে হলেই দিঘির পারে চলে যায়। এখানে থাকে না। তা ছাড়া আমি নিজে হাত দিয়ে ঠেলে দেখেছি ও মানুষের হাত।”

“বেশ। তবে তুমি এক কাজ করো, আমার চিমনিটা নিয়ে যাও। ওটা জ্বেলে রেখে আজ রাত্রে খেতে বসে দেখো দেখি কে কীভাবে আসে।” বুড়ি তাই করল।

নিরাপদ মাস্টারের কথামতো সে রাতে চিমনি লণ্ঠনটা জ্বেলেই খেতে বসল।

কিন্তু কই? কেউ তো এল না। না কোনও মানুষ, না বাঁদর হনুমান। এমনকী একটা কুকুরকেও আসতে দেখা গেল না। আর বুড়ি যে রান্না করেছিল তার প্রায় সবই ফেলা গেল। কেননা আলো জ্বেলে রাখার ফলে কেউই না আসায় যেমনকার খাবার তেমনিই রইল। বুড়ি আগে যেমন খেত তেমনই খেতেই পেট ভরে গেল তার। সে আর কত? সামান্য দু-এক মুঠো।

এর পর থেকে বুড়ি রোজই কম করে রাঁধতে লাগল। আর আলো জ্বেলে খেতে থাকল। ফলে কাউকেই আসতে দেখা গেল না।

তবে মুশকিল হল এই, তেলের অভাবে বুড়ি যেদিনই আলো জ্বালতে পারত না সেদিনই অনুভব করত একটা অদৃশ্য হাত তার পাত থেকে খাবার তুলে খেয়ে নিচ্ছে। কিন্তু যেদিন আলো জ্বেলে খেত সেদিন কিছুই হত না। বুড়ি তাই নিরাপদ মাস্টারের কথামতো রোজই আলো জ্বেলে খেতে লাগল।

এইভাবে প্রায় দিনদশেক কাটবার পর একদিন এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। এক গভীর রাতে সবাই শুনতে পেল একটি করুণ কান্নার সুর। কে যেন ইনিয়ে বিনিয়ে গ্রামের পথে ঘাটে আনাচে কানাচে কেঁদে বেড়াচ্ছে এই কথা বলে, ‘বুড়িকে এমন বুদ্ধি কে দিলি রে? খিদেয় আমি মরে গেলুম। তার সর্বনাশ হোক—তার সর্বনাশ হোক—তার সর্বনাশ হোক।’ গ্রামের লোকেরা সবাই তখন সচকিত হয়ে উঠল। কে! কে কাঁদে? কে ওই কেঁদে কেঁদে

অভিশাপ দেয়। বিলাপ করে আর অমঙ্গলের কথা বলে?

এক জ্যোৎস্নারাতে নিরাপদ মাস্টার নিজেই দেখলেন দৃশ্যটা। রাত তখন একটা। কী একটা কাজে বাইরে বেরিয়েছিলেন। এমন সময় দেখতে পেলেন একটা প্রকাণ্ড সাইজের কুলোর ওপর কালো কিম্ভূতকিমাকার বিচ্ছিরি চেহারার মানবাকৃতি কী যেন একটা বসে আছে। চেহারার তুলনায় হাত দুটো তার বিশাল। কুলোটা বাতাসে ভেসে ভেসে গ্রামের পথ পরিক্রমা করছে। আর সেই কিম্ভূতকিমাকার তার হাত দুটো দুলিয়ে কখনও নৌকো বাওয়ার মতো করে, কখনও কপাল চাপড়ে সুর করে কেঁদে কেঁদে বলছে, ‘বুড়িকে এমন বুদ্ধি কে দিলি রে? খিদেয় আমি মরে গেলুম। তার সর্বনাশ হোক—তার…।’

এই দৃশ্য শুধু নিরাপদ মাস্টার নয়, ওই গ্রামের আরও অনেকেই প্রত্যক্ষ করল । নিরাপদ মাস্টারের বউ অনেক ঠাকুর-দেবতা ওঝা-বদ্যি করতে লাগলেন যাতে তাঁদের সংসারে কোনও অমঙ্গল না হয়। কিন্তু না, কিছুতেই কিছু হল না। শাপ-শাপান্তও কমল না। তাই দেখে অনেকেই অবশ্য বলল, ‘ওর কথায় কান দিয়ো না। আসলে ওটা একটা উজবুক তাই ওইসব বলে বেড়াচ্ছে। তোমরা তো ওর কোনও ক্ষতি করোনি। তবে ভয় কী! শকুনির শাপে গোরু মরে না। ওর যা ইচ্ছে বলুক।”

এইভাবে আরও দু-তিন মাস কেটে যাওয়ার পর এক ঝড়জলের রাতে বটগাছের একটি ডাল ভেঙে পড়ল বুড়ির কুঁড়েঘরের ওপর। ঘুমন্ত বুড়ি ঘরচাপা পড়ে মরে গেল। আর বলতে নেই, সে রাত থেকেই সেই বিচ্ছিরি চেহারার কিম্ভূতকিমাকারটাকে কুলোয় চেপে গ্রামের আনাচে-কানাচে ভেসে বেড়াতে দেখা গেল না। এমনকী তার শাপ-শাপান্ত কান্নাকাটি সবকিছুই থেমে গেল চিরতরে। তবে সেই ঘটনার পর থেকে রাজহাটি গ্রামের লোকেরা আজ পর্যন্ত সন্ধের পর আলো না জ্বেলে কখনও খেতে বসে না কেউ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress