Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অদৃশ্য ত্রিকোণ – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 3

অদৃশ্য ত্রিকোণ – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

ঠিক ছ’টার সময় বীরেনকে লইয়া রমণীবাবু আসিলেন; পুলিসের গাড়ি তাঁহাদের নামাইয়া দিয়া চলিয়া গেল।

রমণীবাবু বলিলেন‌, ‘একটু আগেই এলাম। কি জানি সুনীল যদি সাতটার আগে এসে উপস্থিত হয়।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বেশ করেছেন। প্রথমে আপনারা পাশের ঘরে থাকবেন‌, যাতে সুনীল জানতে না পারে যে‌, পুলিসের সঙ্গে আমার যোগ আছে। আমি আর অজিত বসবার ঘরে থাকব; সুনীল আসার পর আপনি তাক বুঝে আমাদের সঙ্গে যোগ দেবেন।’

‘সে ভাল কথা।’ রমণীবাবু বীরেনকে লইয়া পাশের ঘরে গেলেন এবং দরজা ভেজাইয়া দিলেন। আমরা দু’জনে আসার সাজাইয়া অপেক্ষা করিয়া রহিলাম।

ক্রমে অন্ধকার হইল। আমি আলো জ্বালিয়া দিয়া বসিলাম। ব্যোমকেশ সকালবেলার সংবাদপত্রটা তুলিয়া লইয়া চোখ বুলাইতে লাগিল। আমি সিগারেট ধরাইলাম। কান দুটা অতিমাত্রায় সচেতন হইয়া রহিল।

সাতটা বাজিবার কয়েক মিনিট আগেই ডাকবাংলোর সদরে একটি মোটর আসিয়া থামার শব্দ শোনা গেল; আমরা দৃষ্টি বিনিময় করিলাম। মিনিট দুই-তিন পরে সুনীল সরকার দ্বারের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।

রমণীবাবু যে বৰ্ণনা দিয়াছিলেন তাহার সহিত বিশেষ গরমিল নাই; উপরন্তু লক্ষ্য করিলাম‌, তাহার বিভক্ত ওষ্ঠ্যাধরের ফাঁকে দাঁতগুলা কুমীরের দাঁতের মত হিংস্ব। ভোঁতা মুখে ধারালো দাঁত। সব মিলাইয়া চেহারাটি নয়নরঞ্জন নয়। তার উপর দুশ্চরিত্র। পতিভক্তিতে রেবা হয়তো সীতা-সাবিত্রীর সমতুল্য ছিল না‌, কিন্তু সেজন্য তাঁহাকে দোষ দেওয়া যায় না। সুনীল সরকার স্পষ্টতাই রাম কিংবা সত্যবানের সমকক্ষ নয়।

সুনীল বোকার মত কিছুক্ষণ দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া রহিল‌, শেষে ভাঙা ভাঙা গলায় বলিল‌, ‘ব্যোমকেশবাবু—’

ব্যোমকেশ খবরের কাগজের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া বসিয়াছিল‌, ঘাড় ফিরাইয়া বলিল‌, ‘সুনীলবাবু? আসুন।’

ন্যালা-ক্যাবলার মত ফ্যালফেলে মুখের ভাব লইয়া সুনীল টেবিলের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল; কে বলিবে তাহার ঘটে গোবর ছাড়া আর কিছু আছে! ব্যোমকেশ শুষ্ক কঠিন দৃষ্টিতে তাহাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া বলিল‌, ‘আপনার অভিনয় ভালই হচ্ছে‌, কিন্তু যতটা অভিনয় করছেন ততটা নির্বোধ আপনি নন। —বসুন।’

সুনীল থাপ করিয়া চেয়ারে বসিয়া পড়িল‌, সুবর্তুল চক্ষে ব্যোমকেশকে পরিদর্শন করিয়া স্বলিত স্বরে বলিল‌, ‘কী— কী বলছেন?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কিছু না। আপনি যখন বোকামির অভিনয় করবেনই তখন ও আলোচনায় লাভ নেই। —সুনীলবাবু্‌, পৈতৃক সম্পত্তি ফিরে পাবার জন্যে আপনি দুটো মানুষকে খুন করেছেন; এক‌, আপনার স্ত্রী; দুই‌, হুকুম সিং। এখানে এসে আমি সব খবর নিয়েছি। আপনি হুকুম সিংকে দিয়ে স্ত্রীকে খুন করিয়েছিলেন‌, তারপর নিজের হাতে হুকুম সিংকে মেরেছিলেন। হুকুম সিং ছিল আপনার ষড়যন্ত্রের অংশীদার‌, তাই তাকে সরানো দরকার ছিল; সে বেঁচে থাকলে সারা জীবন ধরে আপনাকে দোহন করত। আপনি এক টিলে দুই পাখি মেরেছেন।’

সুনীল হ্যাঁ করিয়া শুনিতেছিল‌, হাউমাউ করিয়া উঠিল‌, ‘এ কি বলছেন। আপনি! রেবাকে আমি মেরেছি! এ কি বলছেন! একটা গুণ্ডা-যার নাম হুকুম সিং-সে। আমার স্ত্রীকে গলা টিপে মেরেছিল। আন্না দেখেছে-আন্না নিজের চোখে দেখেছে। হুকুম সিং রেবাকে গলা টিপে মারছে–’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হুকুম সিং ভাড়াটে গুণ্ডা, তাকে আপনি টাকা খাইয়েছিলেন।’

‘না না‌, এসব মিথ্যে কথা। রেবাকে আমি খুন করাইনি; সে আমার স্ত্রী‌, আমি তাকে ভালবাসতাম—’

‘আপনি রোবাকে কি রকম ভালবাসতেন‌, তার প্রমাণ আমার পকেটে আছে—’ বলিয়া ব্যোমকেশ নিজের বুক-পকেটে আঙুলের টোকা মারিল।

‘কী? রেবার চিঠি? দেখি কি চিঠি রেবা আপনাকে লিখেছিল।’

ব্যোমকেশ চিঠি বাহির করিয়া সুনীলের হাতে দিতে দিতে বলিল‌, ‘চিঠি ছিঁড়বেন না। ওর ফটো-স্ট্যাট্‌ নকল আছে।’

ফুল তাহার সতর্কবাণী শুনিতে পাইল না‌, চিঠি খুলিয়া দুহাতে ধরিয়া একাগ্রচক্ষে পড়িতে লাগিল।

এই সময় নিঃশব্দে দ্বার খুলিয়া রমণীবাবু ব্যোমকেশের চেয়ারের পাশে আসিয়া দাঁড়াইলেন। দু’জনের দৃষ্টি বিনিময় হইল; ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িল।

চিঠি পড়া শেষ করিয়া সুনীল যখন চোখ তুলিল তখন প্রথমেই তাহার দৃষ্টি পড়িল রমণীবাবুর উপর। পলকের মধ্যে তাহার মুখ হইতে নিবুদ্ধিতার মুখোস খসিয়া পড়িল। ভোঁতা মুখে। ধারালো দাঁত নিষ্ক্রান্ত করিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল‌, ‘ও-এই ব্যাপার। পুলিসের ষড়যন্ত্র! আমাকে ফাঁসাবার চেষ্টা।–ব্যোমকেশবাবু্‌, রেবার মৃত্যুর জন্যে দায়ী কে জানেন? ঐ রমণী দারোগা।’ বলিয়া রমণীবাবুর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিল।

আমরা সুনীলের দিক হইতে পাল্টা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না‌, ব্যোমকেশ সবিস্ময়ে ভ্রূ তুলিয়া বলিল‌, রমণীবাবু দায়ী! তার মানে?’

সুনীল বলিল‌, ‘মানে বুঝলেন না? রমণী দারোগা রেবার প্রাণের বন্ধু ছিল‌, যাকে বলে বঁধু। তাই তো আমার ওপর রমণী দারোগার এত আক্ৰোশ।’

ঘর কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। আমি রমণীবাবুর মুখের পানে তাকাইলাম। তিনি একদৃষ্টি সুনীলের পানে চাহিয়া আছেন; মনে হয় তাহার সমস্ত দেহ তপ্ত লোহার মত রক্তবর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। ভয় হইল এখনি বুঝি একটা অগ্নিকাণ্ড হইয়া যাইবে।

ব্যোমকেশ শান্ত স্বরে বলিল‌, ‘তাহলে এই কারণেই আপনি স্ত্রীকে খুন করিয়েছেন?’

সুনীল বলিল‌, ‘আমি খুন করাইনি। এই জাল চিঠি দিয়ে আমাকে ধরবেন ভেবেছিলেন ‘ সুনীল চিঠিখানা মুঠির মধ্যে গোলা পাকাইয়া টেবিলের উপর ফেলিয়া দিল—’সুনীল সরকারকে ধরা অত সহজ নয়। চললাম। যদি ক্ষমতা থাকে আমাকে গ্রেপ্তার করুন‌, তারপর আমি দেখে নেব।’,

আমরা নির্বাক বসিয়া রহিলাম‌, সুনীল ময়াল সাপের মত সর্পিল গতিতে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

এই কয়েক মুহুর্তে সুনীলের চরিত্র যেন চোখের সামনে মূর্তি ধরিয়া দাঁড়াইল। সাপের মত খল কপট নৃশংস‌, হঠাৎ ফণা তুলিয়া ছোবল মারে‌, আবার গর্তের মধ্যে অদৃশ্য হইয়া যায়। সাংঘাতিক মানুষ।

রমণীবাবু একটা অতিদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন। ব্যোমকেশ কতকটা নিজমনেই বলিল‌, ‘ধরা গেল না।’

সহসা বাহির হইতে একটা চাপা গোঙানির আওয়াজ আসিল। সকলে চমকিয়া উঠিলাম। সর্বাগ্রে ব্যোমকেশ উঠিয়া দ্বারের পানে চলিল‌, আমরা তাহার পিছন পিছন চলিলাম।

ডাকবাংলোর সামনে সুনীলের মোটর দাঁড়াইয়া আছে এবং তাহার সামনের চাকার পাশে মাটির উপর যে মূর্তিটা পড়িয়া আছে তাহা সুনীলের। তাহার পিঠের উপর হইতে একটা ছুরির মুঠ উঁচু হইয়া আছে।

মৃত্যুযন্ত্রণায় সুনীল কাৎ হইবার চেষ্টা করিল; আমি ও ব্যোমকেশ তাহাকে সাহায্য করিলাম বটে‌, কিন্তু অন্তিমকালে আমাদের সাহায্য কোনও কাজে আসিল না। সুনীল একবার চোখ মেলিল; আমাদের চিনিতে পারিল কিনা বলা যায় না‌, কেবল অস্ফুট স্বরে বলিল‌, ‘মুকুন্দ সিং–’

তারপর তাহার হৃৎস্পন্দন থামিয়া গেল।

পথের সামনে ও পিছন দিকে তাকাইলাম‌, কিন্তু কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না; পথ জনশূন্য। আমার ব্বিশ মস্তিষ্কে একটা প্রশ্ন ঘুরিতে লাগিল-মুকুন্দ সিং কে? নামটা চেনা-চেনা। তারপর মনে পড়িয়া গেল‌, হুকুম সিং-এর ভাইয়ের নাম মুকুন্দ সিং। মুকুন্দ সিং ভ্ৰাতৃহত্যার প্রতিশোধ লইয়াছে।

লাশ চালান দেওয়া এবং আইনঘটিত অন্যান্য কর্তব্য শেষ করিতে সাড়ে নটা বাজিয়া গেল। আমরা ফিরিয়া আসিয়া বসিলাম। রমণীবাবুও ক্লান্তমুখে আসিয়া আমাদের সঙ্গে বসিলেন। বীরেন তখনও পাশের ঘরে যন্ত্র লইয়া অপেক্ষা করিতেছিল‌, রমণীবাবু তাহাকে ডাকিয়া বলিলেন‌, ‘তুমি যাও‌, যন্ত্রটা থাক। আমি নিয়ে যাব।’

বীরেন চলিয়া গেল।

কিছুক্ষণ তিনজনে সিগারেট টানিলাম। তারপর ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সুনীল আইনকে ফাঁকি দিয়েছিল বটে কিন্তু নিয়তির হাত এড়াতে পারল না। আশ্চর্য! মাঝে মাঝে গুণ্ডারাও অনেক নৈতিক সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে।’

রমণীবাবু বলিলেন‌, ‘একটা সমস্যার সমাধান হল‌, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আর একটা সমস্যা তৈরি হল। এখন মুকুন্দ সিংকে ধরতে হবে। আমার কাজ শেষ হল না‌, ব্যোমকেশবাবু।’

কিছুক্ষণ নীরবে সিগারেট টানিবার পর ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সুনীলের অভিযোগ সত্যি–কেমন?’

রমণীবাবু নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ। আমার আর রেবার বাড়ি এক শহরে‌, এক পাড়ায়। ওকে ছেলেবেলা থেকে চিনতাম‌, কিন্তু ভালবাসা-বাসি ছিল না…তারপর রেবার যখন ওই রাক্ষসটার সঙ্গে বিয়ে হল তখন এই শহরেই ওর সঙ্গে আবার দেখা হল…রেবা মন্দ ছিল না‌, কিন্তু কি জানি কেমন করে কী হয়ে গেল…সুনীল যে জানতে পেরেছে তা একবারও সন্দেহ হয়নি…সুনীলকে আহাম্মক ভেবেছিলাম‌, তারপর রেবা যখন মারা গেল তখন বুঝলাম সুনীল কেউটে সাপ…তারপর ফাঁসাবার চেষ্টা করেছিলাম…শেষে আপনি এলেন‌, আপনার সাহায্যে শেষ চেষ্টা করলাম—’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘যে চিঠির ছেড়া অংশটা আপনি আমাকে দিয়েছিলেন সেটা রেবা আপনাকে লিখেছিল?’

রমণীবাবু বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ। আমাদের দেখাশোনা বেশি হত না। রেবা আমাকে চিঠি লিখত‌, মনের-প্ৰাণের কথা লিখত। অনেক চিঠি লিখেছিল।–কিন্তু রেবার কথা আর নয়‌, ব্যোমকেশবাবু। এখন বলুন টেপ-রেকর্ডের কী হবে?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কি আর হবে‌, ওটা মুছে ফেলা যাক। —আসুন।’

পাশের ঘরে গিয়া আমরা রেকর্ডার চালাইলাম। সদ্যমৃত সুনীলের জীবন্ত কণ্ঠস্বর শুনিলাম। তারপর ফিতা মুছিয়া ফেলা হইল।

Pages: 1 2 3

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress