Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অঘোরগঞ্জের ঘোরালো ব্যাপার || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 4

অঘোরগঞ্জের ঘোরালো ব্যাপার || Shirshendu Mukhopadhyay

সকালবেলায় যখন করালীডাক্তার

সকালবেলায় যখন করালীডাক্তার দান করছেন, সেই সময় বগলে ছাতা আর হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বটকৃষ্ণ মণ্ডল এসে হাজির। বটকৃষ্ণ ঝগড়ুটে এবং মামলাবাজ লোক। সবাই তাঁকে সমঝে চলে।

বটকৃষ্ণ বেশ তড়পানির গলায় বলে উঠলেন, “এটা কী হল হে করালী? কাজটা কি তুমি ভাল করলে? ওতে যে আমার সংসারে অশান্তি হবে, চারদিকে বদনাম রটবে! না না, কাজটা তুমি মোটেই ভাল করোনি! তুমি বিচক্ষণ নও তা জানি। দুরদর্শীনও তা-ও কারও অজানা নেই। তা বলে এক গাঁয়ে থেকে এরকম শত্রুতা করবে, এটা তো বরদাস্ত করা যায় না!”

করালী উত্তেজিত হলেন না। দাঁতনের ছিবড়ে ফেলে বললেন, “তাই নাকি? তা হলে তো ভাবনার কথা!”

“কোন আক্কেলে আমার শালাকে তুমি নিজের বাড়িতে তুললে? এটা ঠিক যে শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভাল নয়। মুখ দেখাদেখিও নেই। মামলা চলছে। আর আমার এই সেজো শালাটিকে আমি মোটেই পছন্দ করি না। অতি বখাটে ছেলে। কিন্তু তা বলে আমি বেঁচে থাকতে এ গাঁয়ে এসে সে অন্য বাড়িতে উঠবে, এটা কেমন কথা? বুঝতে পারছি, আমাকে অপমান করার জন্যই ষড়যন্ত্র করে এটা করা হয়েছে। কিন্তু সেই ষড়যন্ত্রে যে তুমিও আছ এটা কখনও ভাবিনি। শুনে অবধি আমার গিন্নি তো কেঁদেকেটে শয্যা নিয়েছেন। তোমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হতে পারে তা জানো?”

করালী ঘটির জলে কুলকুচো করতে করতে মুখের জলটা ফেলে বললেন, “তাই বলুন! আপনার শালা! আমি ভাবলাম কে না কে! তা আপনার শালা যদি আপনাকে ভগ্নিপতি বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পায়, তা হলে আমার কী করার আছে বলুন তো?”

বটকৃষ্ণ চোখ কপালে তুলে বললেন, “অ্যাঁ! কী বললে! এই বটকৃষ্ণ মণ্ডলের পরিচয় দিতে লজ্জা পায়! জানো, আমি যখন জামাই হয়ে প্রথম বিষ্ণুপুর গেলুম, তখন সেখানে ঘরে-ঘরে দেওয়ালি হয়েছিল? আমার এক মামাশ্বশুর কী বলেছিলেন জানো? বলেছিলেন, বটকৃষ্ণ বটগাছের মতো স্থির আর অবিচল! আর কৃষ্ণের মতোই বিচক্ষণ। আমার শাশুড়ি ঠাকরুন তো এখনও বলেন, বিট-র মতো জামাই চট করে দেখা যায় না। ওরে বাপু, ঝগড়াঝাটি আছে বটে, কিন্তু তা বলে হ্যাঁটা করার উপায় নেই।”

করালীডাক্তার ধীরেসুস্থে কুলকুচো সেরে কাঁধের গামছাখানায় মুখ মুছতে মুছতে বললেন, “অত কথায় কাজ কী মশাই? ছোঁকরাকে যদি আপনার শালা বলে মনে হয় তা হলে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান না!”

বটকৃষ্ণ বুক চিতিয়ে বললেন, “নিয়ে যাবই তো! এ তো আর তোমার শালা নয়। আমার শালাকে আমি নিয়ে যাব, কে আটকায় দেখি!”

বলে বটকৃষ্ণ সবেগে গিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লেন। একটু পরেই মাথা নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে এসে, “দুর দুর! সকালটাই নষ্ট!”

একটু পরেই রুদ্রাক্ষের মালা গলায় নবকুমার এসে পড়ল। মুখে বিনয় মাখানো হাসি। গলা খাটো করে রসস্থ মুখে বলল, “ডাক্তারবাবু! শুনলুম, কাল রাতে মথুরাপুরের রাজাবাহাদুর ছদ্মবেশে এসে আপনার বাড়িতেই উঠেছেন! কী সৌভাগ্য!”

করালীডাক্তারও গলা খাটো করে বললেন, “চুপ! চুপ! পাঁচজনে জানতে পারলে যে ধুন্ধুমার লেগে যাবে! কাউকে বলে দিয়ো না যেন!”

নবকুমার গ্যালগ্যালে মুখে বলল, “আরে না, না। এসব গুহ্য কথা কি পাঁচকান করতে আছে! তা এই অঘোরগঞ্জের মতো জায়গায় রাজা-গজার আগমন তো চাট্টিখানি কথা নয়! বলি আপ্যায়ন টাপ্যায়ন ঠিকমতো হচ্ছে তো! বলেন তো বাড়ির গোরুর দুধ একঘটি দিয়ে যেতে পারি। আর সীতাপতি ভাণ্ডারের বিখ্যাত কঁচাগোল্লা। রাজত্ব নেই বটে, কিন্তু তবু রাজা তো!”

“সে তো ঠিক কথাই হে নবকুমার। মরা হাতি লাখ টাকা।” নবকুমার বিদায় হওয়ার পর খুবই উৎকণ্ঠিত মুখে হাঁফাতে হাঁফাতে শিবকালীবাবু এসে হাজির। চোখ বড় বড় করে বললেন, “ওহে করালী, তোমার বাড়িতে নাকি বোমাবন্দুক নিয়ে কে এক উগ্রবাদী ঢুকে পড়েছে! এ তো সর্বনেশে কথা! বলি, তোমরা সব বেঁচেবর্তে আছ তো!”

করালী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আধমরা হয়ে আছি দাদা!”

“পুলিশে খবর পাঠিয়ে দিয়েছ তো!”

“এখনও দেওয়া হয়ে ওঠেনি বটে, একটু ফাঁক পেলেই থানায় গিয়ে খবরটা দিয়ে আসব।”

শিবকালী সবেগে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বললেন, “খবর দিয়ে কোনও লাভ নেই অবশ্য। উগ্রবাদী ঢুকেছে জেনে আমি সকালবেলাতেই থানায় হানা দিয়েছিলাম। মনোহর দারোগার কাঁঠাল খেয়ে পেট ছেড়েছে। উগ্রবাদী শুনেই আঁতকে উঠে বলল, “ওরে বাবা, উগ্রবাদীর মোকাবিলা করার সাধ্যি আমাদের নেই। থানায় মোট পাঁচটা বন্দুক, তার মধ্যে তিনটে মরচে ধরে ঠান্ডা মেরে গেছে। একটায় কুঁদো ভেঙেছে, আর-একটা চলনসই আছে বটে, কিন্তু তাতে ভরার মতো টোটা নেই। টোটাগুলো বহুঁকাল ব্যবহার না হওয়ায় বারুদ সেঁতিয়ে মাটি হয়ে গেছে। পাঁচজন সেপাইয়ের তিনজন দেশে গেছে, বাকি দু’জন দারোগাগিন্নির ফাঁইফরমাশ খাটতে ব্যস্ত। মনোহর বলেই দিল, “উগ্রবাদীর জন্য পুলিশের কী দরকার, আপনারা হুড়ো দিন, টিন, ক্যানেস্তারা পেটাতে থাকুন। পুলিশ আসছে বলে ভয় দেখান। দেখবেন ঠিক পালিয়ে যাবে।”

করালী বিরস মুখে বললেন, “তা অবশ্য যাবে। তবে তাড়া নেই। উগ্রবাদীটা এখন ঘুমোচ্ছে। আপনারা ততক্ষণে ক্যানেস্তারা ট্যানেস্তারা জোগাড় করুন, লোকজন জুটিয়ে আনুন।”

শিবকালী চোখ কপালে তুলে বললেন, “ঘুমোচ্ছ! উগ্রবাদীটা ঘুমোচ্ছে! এ তো ভাল কথা নয়! দেশটা যে অরাজকতায় ভরে গেল হে! জন্মে কখনও শুনিনি যে, উগ্রবাদীরা ঘুমোয়!”

করালী ব্যথিত গলায় বললেন, “ঠিকই বলেছেন, খাঁটি উগ্রবাদীই কি দেশে আর আছে?”

“না, এর একটা বিহিত করতেই হবে।” বলে উত্তেজিত শিবকালী প্রস্থান করলেন।

বেলা ন’টা নাগাদ হাতে একটা বল্লম নিয়ে ব্যায়ামবীর বিরজা এসে বলল, “করালীবাবু, শুনলুম ডাকাতটা নাকি আপনার বাড়িতেই লুকিয়ে আছে?”

“আছেই তো!”

“আপনি কি জানেন ওর মাথার দাম দশ হাজার টাকা?”

“এ তো পুরনো খবর। সবাই জানে।”

“ডাকাতটার কাছে বন্দুক-পিস্তল নেই তো!”

“তা আর নেই। কোমরে দুটো পিস্তল, আর ঝোলা ব্যাগে গোল গোল কী যেন দেখছিলাম বটে! বোমা হতেও পারে!”

বিরজা একটু দমে গিয়ে বলল, “আপনি বরং ওকে আমার কাছে সারেন্ডার করতে বলুন। সারেন্ডার করলে আমি বেশি কিছু করব না। শুধু আলগোছে নিয়ে গিয়ে সরকার বাহাদুরের হাতে জমা করে দেব।”

করালী সপ্রশংস গলায় বললেন, “তোমার মতো ডাকাবুকো ছেলেই তো গায়ের ভরসা। ডাকাতটার কপালে কষ্ট আছে দেখছি। কিন্তু আমি বলি কী, একটু রয়েসয়ে এগনোই ভাল। তুমি বীর এ তো সবাই জানে! আর বল্লমও ক্ষেত্রবিশেষে অস্ত্র হিসেবে মন্দ নয়। কিন্তু গুলিটুলি ছুটলে লেগেটেগে যেতে পারে তো!”

বিরজা দেড় পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, “বেশি দেরি করা কি ঠিক হবে? খবর চাউর হয়ে গেলে মেলা ভাগীদার জুটে যাবে যে!”

করালী গলা চুলকোতে-চুলকোতে বললেন, “সেটাও একটা চিন্তার কথা বটে! ডাকাত তো মোটে একটা। আর খবরও সবাই ৪৪

জানে কিনা! দশ হাজার টাকা যে কত ভাগে ভাগ হবে কে জানে! খুঁজে পেতে দ্যাখো তো আর দু-চারটে ডাকাত পাও কিনা!”

এ কথায় বিরজা কী বুঝল কে জানে। তবে মুখটা শুকনো করে চলে গেল।

একটু বেলার দিকে জটেশ্বর এসে হাজির হতেই করালী খাপ্পা হয়ে বললেন, “এ নিশ্চয়ই তোমার কাজ!”

জটেশ্বর নিরুদ্বেগ মুখে বারান্দার চেয়ারে বসে বললেন, “তা তো বটেই। কিন্তু কোন কাজটার কথা বলছ? সারাদিনে লোকের শতেক কাজ থাকে। কোন কাজটার কথা হচ্ছে সেটা খোলসা করে না বললে বুঝব কী করে?”

“লোটার কথা সারা গায়ে রটিয়ে বেড়িয়েছ, আর সকাল থেকেই নানা মতলবে নানা লোক এসে হাজির হচ্ছে।”

“আহা, রটাতে যাব কেন? অঘোরগঞ্জ ছোট জায়গা, হাওয়ায় খবর ছড়িয়ে যায়। বটব্যালের বাতব্যাধি থেকে অটলবাবুর পটলতোলা অবধি কোন খবরটা গোপন আছে বলতে পার? তা তোমার অতিথির খবর কী? সে কি এখনও বেঁচেবর্তে আছে? তোমার চিকিৎসায় তো তার পটলতোলার কথা! তোলেনি এখনও?”

করালী চিন্তিত মুখে বললেন, “না হে।”

জটেশ্বর উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, “এখনও গ্যাট হয়ে বসে আছে নাকি?”

“মরার মতো অবস্থা নয়। তবে তার কিছু মনে পড়ছে না। এমনকী শঙ্কাহরণ, বিপদভঞ্জন আর গিন্নি মিলে অনেক চেষ্টা করেও তাকে কথা পর্যন্ত বলাতে পারেনি। কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।”

“সর্বনাশ! তবে তো ভাল জ্বালা হল!”

“তা হল। জলে ডুবে থাকলে অনেক সময় এরকম হতে পারে। তার উপর গুলি লেগেছে।”

“আরে, একটা তেজি ওষুধ বা ইনজেকশন দাও না ঠুকে! নইলে এক দলা চ্যবনপ্রাশ খাইয়ে দাও। সঙ্গে একোনাইট থার্টি বা পালসেটিলা…”

করালী ভ্রু কুঁচকে বললেন, “আর ডাক্তারি বিদ্যে ফলিয়ো না তো! ওটা পয়সা খরচ করে শিখতে হয়, বুঝলে?”

“পয়সা খরচ করলেই কি আর শেখা যায় হে! তা হলে তো তুমিও শিখতে! একটা জলেডোবা রুগিকে ভাল করতে পারলে না, আবার ডাক্তারি শেখাচ্ছে! যাও, বরং বউঠানকে চায়ের কথাটা বলে এসো গিয়ে!”

করালীডাক্তার জটেশ্বরের দিকে রোষকষায়িত লোচনে একটু চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “ডাক্তার ভগবান নন, এটা মনে রেখো!”

“যাক, পাপমুখে তবু ভগবানের নামটা উচ্চারণ করলে। আজ ভগবান যে কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছেন কে জানে! তা তোমার ডাক্তারি বিদ্যেয় যখন হল না, তখন আমিই বরং ছোঁকরাকে একটু নেড়েচেড়ে দেখি?”

“কী দেখবে, কুষ্ঠি না কররেখা? দুটোর কোনওটাই তো তুমি জান না। বুজরুকি দিয়ে কি আর সব হয়? দেখতে চাও, দেখতে পারো। আমার আপত্তি নেই!”

“যা দেখার আমি কালকেই দেখে নিয়েছি। শুধু কররেখা আর কোষ্ঠীই নয় হে, কপাল দেখেও অনেক কিছু বলে দেওয়া যায়। ওসব তুমি বুঝবে না।”

“তা কপাল দেখে কী বুঝেছ সেটাই না হয় বলো।”

“তা তোমাকে বলতে যাব কেন? বিদ্যেটা আমাকেও পয়সা খরচ করেই শিখতে হয়েছে।”

“পয়সা খরচ করে কেউ জ্যোতিষ শেখে নাকি? গুল-গল্প আর মিথ্যে কথা বলতে কি আর বিদ্যের দরকার হয় হে?”

জটেশ্বর একটা উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বললেন, “বিদ্যে না লাগলেও প্রতিভার দরকার হয়। এখন বলো তো বাপু, ছোঁকরাকে সত্যিই কেউ গুলি করেছিল নাকি?”

করালীডাক্তার মাথা নেড়ে বললেন, “সেটাই মনে হচ্ছে। তবে ইজুরি সামান্য, পেটের একধার দিয়ে গুলি ঢুকে বেরিয়ে গিয়েছে। রক্তপাত হলেও ক্ষত মারাত্মক নয়। আইনমতো ঘটনাটা পুলিশকে জানানো দরকার।”

জটেশ্বর হাত তুলে বললেন, “রক্ষে করো বাপু, ও কাজ আর করতে যেয়ো না! মনোহরদারোগা বোমা বন্দুক শুনলেই মূৰ্ছা যায়।”

করালীডাক্তার ভাবিত মুখে বললেন, “ছোঁকরা গুন্ডা বদমাশের পাল্লায় পড়েছিল বলেই মনে হয়। আবার এও হতে পারে যে, ছোঁকরা নিজেও ওই দলেরই। গুন্ডারা গুডার হাতেই বেশি মরে। কিন্তু স্মৃতি না ফিরলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে না। ইতিমধ্যে আমার গিন্নি তো ছেলেটাকে প্রায় কোলে নিয়ে বসে আছেন। আদর করে নাম দিয়েছেন ‘ভোলানাথ। ছেলেপুলে নেই বলে অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে দেখলেই ওঁর মাতৃভাব উথলে ওঠে।”

“উনি তোমার মতো পাষণ্ড নন বলেই ওরকম করেন। কিন্তু তুমি তো চিন্তায় ফেলে দিলে হে!”

“চিন্তারই কথা। ছোঁকরার মানিব্যাগে হাজার পাঁচেক টাকা আছে। গলায় সোনার চেন আর হাতে হিরের আংটি মিলিয়ে বিশ পঁচিশ হাজার টাকার পাল্লা। কবজির ঘড়িখানাও বিদেশি। রীতিমতো মালদার লোক।”

“মানিব্যাগে কাগজপত্র কিছু পেলে না?”

“সেগুলো জলে ভিজে প্রায় গলে গেছে। টাকাগুলোরও ওই একই দশা। শঙ্কাহরণ আর বিপদভঞ্জন সেগুলোকে ছাদে নিয়ে গিয়ে রোদে শুকিয়ে এনেছে। নাঃ, নাম-ধাম, পরিচয় কিছুই জানার উপায় নেই। ছেলেটা কথা কওয়া শুরু করলেই একমাত্র হদিশ পাওয়া যেতে পারে।”

“মূক-বধির নয় তো?”

“না। শুনতে পাচ্ছে। আমার গিন্নি যা বলছে তা লক্ষ্মীছেলের মতো শুনছে। ‘খাও’ বললে খাচ্ছে, দাঁড়াতে বললে দাঁড়াচ্ছে, বসতে বললে বসছে।”

জটেশ্বর হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজে বললেন, “হুঁ।”

.

কাল রাতে বিভূতিবাবুদের বিড়ালটা এমন বিচ্ছিরি খক-খক করে শব্দ করছিল যে, সুরবালা ভারী ভয় পেয়ে গেলেন। অবশ্য সুরবালার ভয় আর দুশ্চিন্তার কোনও অবধি নেই। চারদিকে এত বিপদআপদ আর ভয়ভীতি নিয়ে যে কী করে মানুষ বেঁচেবর্তে আছে, সেটাই তিনি বুঝতে পারেন না। চারদিকে সর্বদাই নানা অমঙ্গলের সংকেত দেখতে পান তিনি। তাই বিড়ালটার ওই শব্দ শুনে করালীডাক্তারকে গিয়ে ভারী মিষ্টি করেই জিজ্ঞেস করেছিলেন, “হ্যাঁ গো, বিভূতির বিড়ালটার কি কাশি হয়েছে?”

করালীডাক্তার খিটখিটিয়ে উঠে বললেন, “তা হতেই পারে। বিড়ালের কাশি হয়, বাঘের মৃগী হয়, কুমিরের ম্যালেরিয়া হয়, গাছের বাতব্যাধি হয়। বিচিত্র কী?”

“আহা, রেগে যাচ্ছ কেন? আসলে ভোলানাথের তো ভীষণ জ্বর। বেঁহুশ হয়ে পড়ে আছে। ভাবছিলাম, বিড়ালটা তো এরকম অদ্ভুত শব্দ কখনও করে না, কোনও অমঙ্গল হবে না তো গো ছেলেটার?”

করালীডাক্তার খুবই তেতো গলায় বললেন, “আচ্ছা, আমি একজন এম বি বি এস পাশ, তিরিশ বছর প্র্যাকটিস করা ডাক্তার হয়েও যদি ভোলানাথের অবস্থা বুঝতে না পারি, তা হলে কি বিভূতির বিড়াল বেশি বুঝবে?”

সুরবালা ছলছলে চোখে বললেন, “তা তো বলিনি। বলছিলাম কী, অবোলা প্রাণীরা তো অনেক কিছু টের পায়। শুনেছি, গিরগিটিরা ভূমিকম্পের আগে টের পায়। পিঁপড়েরা বন্যার আগে টের পায়। এই তো সেদিন ভূষণবাবু মারা যাওয়ার আগের রাতে ভুলো কুকুরটা কেমন ভেউ-ভেউ করে কাঁদছিল।”

“ভূষণবাবুর কত বয়স হয়েছিল জানো? একশো তেরো বছর। ভূষণবাবুর বড় ছেলের বয়স নব্বই, মেজোর ঊননব্বই, আর ছোট ছেলের সাতাশি। ভূষণবাবু মারা যাওয়ার পর সম্পত্তি নিয়ে তিন বুডোর সে কী ঝগড়া, হাতাহাতির উপক্রম। তা তারাই কেউ কাদল, ভুলো কুকুরের কোন গরজ পড়েছে ভূষণবাবুর জন্য চোখের জল ফেলার?”

“তুমি যে কিছুই গ্রাহ্যি করো না, এ কিন্তু ভাল নয়। একটু আগে যে একটা প্যাচা অদ্ভুতভাবে ডাকছিল, সে কি এমনি?”

করালীডাক্তার নির্বিকারভাবে বললেন, “ডাকার জন্যই পাচারা মাইনে পায়।”

এ কথায় সুরবালার পিত্তি জ্বলে গেল। কিন্তু আর কথা বাড়ালেন। করালীডাক্তারকে তিনি হাড়ে হাড়ে চেনেন।

ছেলেটাকে দেখা ইস্তক তাঁর বড় মায়া পড়ে গেছে। কী সুন্দর কেষ্টঠাকুরের মতো মুখোনা! তাঁর নিজের একটা ছেলে থাকলে আজ এত বড়টিই হত। কোন বাড়ির ছেলে, কোথা থেকে এল, কী হয়েছিল, কিছুই জানার উপায় নেই। যতক্ষণ হুশ ছিল একটাও কথা বলতে পারেনি। করালীডাক্তার বলেছেন, স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে। শুনে অবধি সুরবালার মনটা হায়-হায় করছে। সারা রাত উঠে-উঠে গিয়ে তার নাকে হাত দিয়ে দেখেছেন, খাস চলছে কি না, জ্বর কমেছে কি না। আর সারা রাত কত যে অলক্ষুনে শব্দ শুনেছেন তার হিসেব নেই। এই শিয়াল ডাকল তো ওই শোনা গেল তক্ষকের শব্দ। হঠাৎ একটা কাক খা-খা করে উঠল। এই কুকুরের ঝগড়া তো ওই বিড়ালের ফ্যাস-ফাঁস। সুরবালার স্থির বিশ্বাস, এসব মোটেই শুভ লক্ষণ নয়। কিন্তু করালীডাক্তারকে বলে তো কোনও লাভ নেই।

সকালে দেখা গেল, ভোলানাথের জ্বর একটু কম। চোখ চেয়ে এদিক-ওদিক কাকে যেন খুঁজছে। বাচ্চারা মা ছাড়া এ সময়ে আর কাকেই বা খুঁজবে? সুরবালা তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়ে বললেন, “কাকে খুঁজছ বাবা? মাকে?”

ভোলানাথ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। মুখে কথা নেই। “তোমার বাড়ি কোথায় বাবা? বাড়িতে কে কে আছে?” ভোলানাথ জবাব দিল না।

অনেক চেষ্টা করে সুরবালা হাল ছাড়লেন। তারপর শঙ্কাহরণ আর বিপদভঞ্জনকে ডেকে বললেন, “শোন বাবারা, ডাক্তারি চিকিৎসায় আমার যেন কেমন ভরসা হচ্ছে না। তোরা বরং লুকিয়ে বগলাঠাকুরকে একটা খবর দিয়ে আয়। প্রেসিদ্ধ মানুষ, শুনেছি মন্তরতন্তরের জোর আছে। এই তো সেদিন বাসন্তীর হারানো ছাগলটা খুঁজে দিল। পুণ্যবাবুর বাতব্যাধি সারিয়ে দিল।”

শঙ্কাহরণ চোখ বড় বড় করে বলল, “কিন্তু মাঠান, বগলাঠাকুরের আগমন হলে যে কর্তাবাবু আমাদের আস্ত রাখবেন না। বগলা তান্ত্রিকের উপর যে উনি সাংঘাতিক খাপ্পা। চোর, ধাপ্পাবাজ, শয়তান কত কী বলেন?”

“উনি কার উপর খাপ্পা নন, বল তো! সবাইকেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন বলেই তো গাঁয়ের লোক ওঁকে পছন্দ করে না। আজকাল তো অনেকের বিয়ে বা শ্রাদ্ধে আমাদের নেমন্তন্ন হয় না।”

বিপদভঞ্জন বলল, “গাঁয়ের লোকগুলোর কথা আর কবেন না মাঠান। প্রাণ নিয়ে টানাটানি হলে করালীডাক্তারের পায়ে পড়ে। কিন্তু কাজ উদ্ধার হয়ে গেলে আর চিনতে চায় না।”

“তা সে যাই হোক, বেলা দশটায় উনি চেম্বারে যাবেন। তখন গিয়ে চুপটি করে ডেকে আনিস। মন্তরতন্তরে অনেক সময় কাজ হয়।” শঙ্কাহরণ মাথা চুলকে বলল, “কিন্তু গেলবার কর্তাবাবুর রুগি চারু ঘোষকে বগলাবাবা জলপড়া খাইয়েছিলেন বলে কর্তাবাবা দা নিয়ে এমন তাড়া করেছিলেন যে, বগলাপতি পাঁইপই করে ছুটে সেই শ্বশুরবাড়িতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তিন মাস এমুখো হননি। শেষে বগলাপতির শালা সম্বন্ধীরা এসে কর্তাবাবার হাতে-পায়ে ধরে বগলাপতিকে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করে।”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *