Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অগ্নিবান – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 7

অগ্নিবান – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

পুলিস আসিয়া পৌঁছতে বিলম্ব হইল না। আমরা দেবকুমারবাবুর ঠিকানা পুলিসকে জানাইয়া বাহির হইয়া আসিলাম।

তখন রাস্তায় গ্যাস জ্বলিয়াছে। দ্রুতপদে বাসার দিকে ফিরিতে ফিরিতে ব্যোমকেশ কয়েকবার যেন ভয়ার্ত শ্বাস-সংহত স্বরে বলিল‌, ‘উঃ! নিয়তির কি নির্মম প্ৰতিশোধ! কি নিদারুণ পরিহাস!’

আমার মাথার ভিতর বুদ্ধিবৃত্তি যেন স্তম্ভিত নিশ্চল হইয়া গিয়াছিল; তবু অসীম অনুশোচনার সঙ্গে কেবল এই কথাটাই মনে হইতে লাগিল–পরলোক যদি থাকে‌, তবে যাহার মৃত্যুতে হাবুল এত কাতর হইয়াছিল সেই পরম স্নেহাস্পদ ভগিনীর সহিত তাহার এতক্ষণে মিলন হইয়াছে।

বাসায় পৌঁছিয়া ব্যোমকেশ নিজের লাইব্রেরি-ঘরে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিল। শুনিতে পাইলাম‌, সে টেলিফোনে কথা বলিতেছে।

প্রায় এক ঘণ্টা পরে সে ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া ক্লান্তস্বরে পুটরামকে চা তৈয়ার করিতে বলিল‌, তারপর বুকে ঘাড় গুজিয়া একখানা চেয়ারে বসিয়া পড়িল। যে ট্র্যাজেডির শেষ অঙ্কে যবনিকা পড়িতে আর দেরি নাই‌, তাহার সম্বন্ধে বৃথা প্রশ্ন করিয়া আমি আর তাহাকে বিরক্ত করিলাম না।

রাত্রি সাড়ে আটটার সময় বীরেনবাবু আসিলেন। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘ওয়ারেন্ট এনেছেন?’

বীরেনবাবু ঘাড় নাড়িলেন।

তখন আবার আমরা বাহির হইলাম।

দেবকুমারবাবুর বাসায় আসিতে তিন চার মিনিট লাগিল। দেখিলাম‌, বাড়ি নিস্তব্ধ‌, উপরের ঘরগুলির জানালায় আলো নাই‌, কেবল নীচে বসিবার ঘরে বাতি জ্বলিতেছে।

বীরেনবাবু কড়া নাড়িলেন‌, কিন্তু ভিতর হইতে সাড়া আসিল না। তখন তিনি দ্বার ঠেলিলেন‌, ভেজানো দ্বার খুলিয়া গেল। আমরা ভিতরে প্রবেশ করিলাম।

বাহিরের ক্ষুদ্র ঘরটিতে তক্তপোশ পাতা‌, তাহার উপর দেবকুমারবাবু নিশ্চলভাবে বসিয়া আছেন। আমরা প্রবেশ করিলে তিনি রক্তবর্ণ চক্ষু তুলিয়া আমাদের পানে চাহিলেন। কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিবার পর তাঁহার মুখে একটা তিক্ত হাসি দেখা দিল‌, তিনি মাথা নাড়িয়া অস্ফুট স্বরে বলিলেন‌, ‘সকলি গরল ভেল–’

বীরেনবাবু অগ্রসর হইয়া বলিলেন‌, ‘দেবকুমারবাবু্‌, আপনার নামে ওয়ারেন্ট আছে।’

দেবকুমারবাবুর যেন চমক ভাঙ্গিল‌, তিনি দারোগাবাবুর পরিচ্ছদের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন‌, ‘আপনারা এসেছেন-ভালই হল। আমি নিজেই থানায় যাচ্ছিলুম—’ দুই হাত বাড়াইয়া দিয়া বলিলেন‌, ‘হাতকড়া লাগান।’

বীরেনবাবু বলিলেন‌, ‘তার দরকার নেই। কোন অপরাধে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হল শুনুন— বলিয়া অভিযোগ পড়িয়া শুনাইবার উপক্ৰম করিলেন।

দেবকুমারবাবু কিন্তু ইতিমধ্যে আবার অন্যমনস্ক হইয়া পড়িলেন; পকেটে হাত দিয়া তিনি যেন কি খুঁজতে খুঁজতে নিজ মনে বলিলেন‌, ‘নিয়তি! নইলে হাবুলও ঐ বাক্স থেকেই দেশলায়ের কাঠি বার করতে গেল কেন? কি ভেবেছিলুম‌, কি হল! ভেবেছিলুম‌, রেখার ভাল বিয়ে দেব‌, নিজের একটা বড় ল্যাবরেটরি করব‌, হাবুলকে বিলেত পাঠাব–’ পকেট হইতে সিগার বাহির করিয়া তিনি মুখে ধরিলেন।

ব্যোমকেশ নিজের দেশলাই জ্বালিয়া তাঁহার সিগারে অগ্নি সংযোগ করিয়া দিল। তারপর বলিল‌, ‘দেবকুমারবাবু্‌, আপনার দেশলাইটা আমাদের দিতে হবে।’

দেবকুমারবাবুর চোখে আবার সচেতন দৃষ্টি ফিরিয়া আসিল‌, তিনি বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু? আপনিও এসেছেন? ভয় নেই–আমি আত্মহত্যা করব না। ছেলেকে মেরেছি–মেয়েকে মেরেছি‌, আমি খুনী আসামীর মত ফাঁসিকাঠে ঝুলতে চাই–’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘দেশলাইয়ের বাক্সট তবে দিন।’

সাবধান‌, বড় ভয়ানক জিনিস। প্রত্যেকটি কাঠি এক-একটি মৃত্যুবাণ। একবার জ্বলিলে আর রক্ষে নেই—‘ বোমকেশ দেশলাইয়ের বাক্সটা বীরেনবাবুর হাতে দিল‌, তিনি সন্তৰ্পণে সেটা পকেটে রাখিলেন। দেবকুমারবাবু বলিয়া চলিলেন‌, ‘কি অদ্ভুত আবিষ্কারই করেছিলুম; পলকের মধ্যে মৃত্যু হবে‌, কিন্তু কোথাও এতটুকু চিহ্ন থাকবে না। আধুনিক যুদ্ধ-নীতির আমূল পরিবর্তন হয়ে যেত! বিষ নয়–এ মহামারী। কিন্তু সকলি গরল ভেল—’ তিনি বুকভাঙা গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিলেন।

বীরেনবাবু মৃদুস্বরে বলিলেন‌, ‘দেবকুমারবাবু্‌, এবার যাবার সময় হয়েছে।’

‘চলুন’–তিনি তৎক্ষণাৎ উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

ব্যোমকেশ একটু কুষ্ঠিত স্বরে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘আপনার স্ত্রী কি বাড়িতেই আছেন?’

‘স্ত্রী!’–দেবকুমারবাবুর চোখ পাগলের চোখের মত ঘোলা হইয়া গেল। তিনি হা হা করিয়া অট্টহাস্য করিয়া উঠিলেন‌, বলিলেন‌, ‘স্ত্রী! আমার ফাঁসির পর ইন্সিওরেন্সের সব টাকা সেই পাবে! প্রকৃতির পরিহাস নয়? চলুন।’

একটা ট্যাক্সি ডাকা হইল। ব্যোমকেশ হাত ধরিয়া দেবকুমারবাবুকে তাহাতে তুলিয়া দিল; বীরেনবাবু তাঁহার পাশে বসিলেন। দুইজন কনস্টেবল ইতিমধ্যে কোথা হইতে আবির্ভূত হইয়াছিল‌, তাহারাও ট্যাক্সিতে চাপিয়া বসিল।

দেবকুমারবাবু গাড়ির ভিতর হইতে বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনি আমার রেখার মৃত্যুর কিনারা করতে চেয়েছিলেন–আপনাকে ধন্যবাদ—’

আমরা ফুটপাথে দাঁড়াইয়া রহিলাম‌, ট্যাক্সি চলিয়া গেল।

দিন দুই বোমকেশ এ বিষয়ে কোনও কথা কহিল না। তাহার মনের অবস্থা বুঝিয়া আমিও পীড়াপীড়ি করিলাম না।

তৃতীয় দিন বৈকালে সে নিজেই বলিতে আরম্ভ করিল; এলোমেলোভাবে কতকটা যেন নিজ মনেই বলিতে লাগিল–

‘ইংরেজিতে একটা কথা আছে–vengeance coming home to roost‌, দেবকুমারবাবুর হয়েছিল তাই! নিজের স্ত্রীকে তিনি মারতে চেয়েছিলেন‌, কিন্তু এমনই অদৃষ্ট্রের খেলা‌, দু’বার তিনি তাঁর অমোঘ অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করলেন‌, দু’বারই সে অগ্নিবাণ লাগল গিয়ে তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় পুত্ৰ-কন্যার বুকে।

‘দেবকুমার অপ্রত্যাশিতভাবে এক আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। কিন্তু টাকার অভাবে সে আবিষ্কারের সদ্ব্যবহার করতে পারছিলেন না। এ এমনই আবিষ্কার যে‌, তার পেটেন্ট নেওয়া চলে না; কারণ‌, সাধারণ ব্যবসায়-জগতে এর ব্যবহার নেই। কিন্তু ঘৃণাক্ষরে এর ফরমুলা জানতে পারলে জাপান জামানী ফ্রান্স প্রভৃতি যুদ্ধোদ্যত রাজ্যলোলুপ জাতি নিজেদের কারখানায় এই প্রাণঘাতী বিষ তৈরি করতে আরম্ভ করে দেবে। আবিষ্কর্তা কিছুই করতে পারবেন না‌, এতবড় আবিষ্কার থেকে তাঁর এক কপর্দক লাভ হবে না।

‘সুতরাং আবিষ্কারের কথা দেবকুমারবাবু চেপে গেলেন। প্রথমে টাকা চাই‌, কারণ এ বিষ কি করে ব্যবহার করা যেতে পারে‌, সে বিষয়ে আরও অনেক এক্সপেরিমেন্ট করা দরকার। কিন্তু টাকা কোথায়? এত বড় এক্সপেরিমেন্ট গোপনে চালাতে গেলে নিজের ল্যাবরেটরি চাই–তাতে অনেক টাকার দরকার। কিন্তু টাকা আসে কোথা থেকে?

‘এ দিকে বাড়িতে দেবকুমারবাবুর স্ত্রী তাঁর জীবন দুর্বাহ করে তুলেছিলেন। মানসিক পরিশ্রম যারা করে‌, তারা চায় সাংসারিক ব্যাপারে শান্তি‌, অথচ তাঁর জীবনে ঐ জিনিসটির একান্ত অভাব হয়ে উঠেছিল। এক শুচিবায়ুগ্ৰস্ত মুখরা স্নেহহীনা স্ত্রীর নিত্য সাহচর্য তাঁকে পাগলের মত করে তুলেছিল। এটা অনুমানে বুঝতে পারি; দেবকুমারবাবু স্বভাবত নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক নন‌, শান্তিতে নিজের বৈজ্ঞানিক চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকতে পারলে তিনি আর কিছু চান না। তাঁর মনটি যে খুব স্নেহপ্রবণ‌, তাঁর ছেলেমেয়েদের প্রতি ভালবাসা দেখেই আন্দাজ করা যায়। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীও চেষ্টা করলে এই স্নেহের অংশ পেতে পারতেন; কিন্তু স্বভাবদোষে তিনি তা পেলেন। না; বরঞ্চ দেবকুমারবাবু তাঁকে বিষবৎ ঘৃণা করতে আরম্ভ করলেন।

‘নিজের স্ত্রীকে হত্যা করবার ইচ্ছা মানুষের স্বাভাবিক নয়; যখন এ প্রবৃত্তি তার হয় তখন বুঝতে হবে–সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে। দেবকুমারবাবুরাও সহ্যের সীমা অতিক্রান্ত হয়েছিল। তারপর তিনি যখন এই ভয়ঙ্কর বিষ আবিষ্কার করলেন‌, তখন বোধ হয়‌, প্রথমেই তাঁর মনে হল স্ত্রীর কথা। তিনি মনে মনে আগুন নিয়ে খেলা আরম্ভ করলেন।

‘তারপর তাঁর সংশয়ের সমাধান করে বীমা কোম্পানির যুগ্মজীবন পলিসির বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল-স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে বীমা করতে পারে‌, একজন মরলে অন্য জন টাকা পাবে। এমন সুযোগ তিনি আর কোথায় পাবেন? যদি এইভাবে জীবনবীমা করে তাঁর আবিষ্কৃত বিষ দিয়ে স্ত্রীকে মারতে পারেন—এক টিলে দুই পাখি মরবে; তিনি তাঁর বাঞ্ছিত টাকা পাবেন‌, স্ত্রীও মরবে এমনভাবে যে কেউ বুঝতে পারবে না‌, কি করে মৃত্যু হল।

‘দেবকুমারবাবু একেবারে পঞ্চাশ হাজার টাকার জীবনবীমা করলেন‌, তারপর অসীম ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করতে লাগলেন। তাড়াতাড়ি করলে চলবে না‌, বীমা কোম্পানির সন্দেহ হতে পারে। এইভাবে এক বছর কেটে গেল। তিনি মনে মনে স্থির করলেন‌, এই বড়দিনের ছুটিতে তাঁর মৃত্যুবাণ নিক্ষেপ করবেন।

‘তাঁর আবিষ্কৃত বিষের প্রকৃতি অনেকটা বিস্ফোরক বারুদের মত; এমনিতে সে অতি নিরীহ‌, কিন্তু একবার আগুনের সংস্পর্শে এলে তার ভয়ঙ্কর শক্তি বাম্পরূপ ধরে বেরিয়ে আসে। সে-বাস্প কারুর নাকে কণামাত্র গেলেও আর রক্ষে নেই‌, তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হবে।

‘দেবকুমারবাবু তাঁর স্ত্রীর উপর এই বিষ প্রয়োগ করবার এক চমৎকার উপায় বার করলেন। বৈজ্ঞানিক মাথা ছাড়া এমন বুদ্ধি বেরোয় না। তিনি কতকগুলি দেশলাইয়ের কাঠির বারুদের সঙ্গে এই বিষ মাখিয়ে দিলেন। কি উপায়ে মাখালেন‌, বলতে পারি না‌, কিন্তু ফল দাঁড়ালো—যিনি সেই কাঠি জ্বালবেন‌, তাঁকেই মরতে হবে। এইভাবে বিষাক্ত দেশলাইয়ের কাঠি তৈরি করে তিনি দিল্লীতে বিজ্ঞান-সভার অধিবেশনে যোগ দেবার জন্যে প্ৰস্তুত হতে লাগলেন। ক্রমে দিল্লীতে যাবার সময় উপস্থিত হল; তখন তিনি সময় বুঝে তাঁর স্ত্রীর দেশলাইয়ের বাক্সতে একটি কাঠি রেখে দিয়ে দিল্লীতে যাত্রা করলেন। তিনি জানতেন‌, তাঁর স্ত্রী রোজ রাত্ৰিতে শোবার আগে ঐ দেশলাই দিয়ে ল্যাম্প জ্বলেন-এ দেশলাইয়ের বাক্স অন্যত্র ব্যবহার হয় না। আজ হোক‌, কাল হোক‌, গৃহিণী সেই কাঠিটি জ্বালাবেন। দেবকুমারবাবু থাকবেন তখন ন’শ মাইল দূরে—এ যে তাঁর কাজ‌, এ কথা কেউ মনেও আনতে পারবে না।

‘সবই ঠিক হয়েছিল‌, কিন্তু রাম উল্টো বুঝলেন। স্ত্রীর বদলে রেখা উনুন ধরাতে গিয়ে সেই কাঠিটি জ্বালালে।

‘দিল্লী থেকে দেবকুমারবাবু ফিরে এলেন। এই বিপর্যয়ে তাঁর মন স্ত্রীর বিরুদ্ধে আরও বিষিয়ে উঠল। তাঁর জিদ চড়ে গেল‌, মেয়ে যখন গিয়েছে‌, তখন ওকেও তিনি শেষ করে ছাড়বেন। কয়েকদিন কেটে গেল‌, তারপর আবার তিনি স্ত্রীর দেশলাইয়ের বাক্সে একটি কাঠি রেখে পাটনা যাবার জন্য তৈরি হলেন।

‘কিন্তু এবার আর তাঁকে যেতে হল না। হাবুল সিগারেট খেত; বোধহয়‌, তার দেশলাইয়ের বাক্সটা খালি হয়ে গিয়েছিল‌, তাই সে সৎমার ঘরের দেশলাইয়ের বাক্স থেকে কয়েকটি কাঠি নিজের বাক্সে পুরে নিয়ে বেড়াতে চলে গেল। তারপর–

‘কি ভয়ঙ্কর সর্বনাশী কালকূট যে দেবকুমারবাবু বিজ্ঞানসাগর মন্থন করে তুলেছিলেন তাঁর জীবনে—সকলি গরিল ভেল।’

ব্যোমকেশ একটা নিশ্বাস ফেলিয়া চুপ করিল। কিয়ৎকাল পরে আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘আচ্ছা‌, দেবকুমারবাবু যে অপরাধী‌, এটা তুমি প্রথম বুঝলে কখন?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘যে মুহুর্তে শুনলুম যে‌, দেবকুমারবাবু পঞ্চাশ হাজার টাকার জীবনবীমা করিয়েছেন‌, সেই মুহুর্তে। তার আগে রেখাকে হত্যা করবার একটা সন্তোষজনক উদ্দেশ্যই পাওয়া যাচ্ছিল না। কে তাকে মেরে লাভবান হল‌, কার স্বার্থে সে ব্যাঘাত দিচ্ছিল-এ কথাটার ভাল রকম জবাব পাওয়া যাচ্ছিল না। রেখা যে হত্যাকারীর লক্ষ্য নয়‌, তা তো আমরা জানতুম না।

‘কিন্তু আর একদিক থেকে একটি ছোট্ট সূত্ৰ হাতে এসেছিল। রেখার দেহ-পরীক্ষায় যখন বিষ পাওয়া গেল না‌, তখন কেবল একটা সম্ভাবনাই গ্রহণযোগ্য রইল—অর্থাৎ যে-বিষে তার মৃত্যু হয়েছে‌, সে-বিষ বৈজ্ঞানিকদের অপরিচিত। মানে‌, নূতন আবিষ্কার। মনে আছে—দিল্লীতে দেবকুমারবাবুর বক্তৃতা? আমরা তখন সেটা অক্ষমের বাহ্বাস্ফোট বলে উড়িয়ে দিয়েছিলুম। কে জানত‌, তিনি সত্যই এক অদ্ভুত আবিষ্কার করে বসে আছেন; আর‌, তারই চাপা ইঙ্গিত তাঁর বক্তৃতায় ফুটে বেরুচ্ছে!

‘সে যাক হোক‌, কথা দাঁড়ালো—এই নূতন আবিষ্কার কোথা থেকে এল? দুজন বৈজ্ঞানিক হাতের কাছে রয়েছে–এক‌, ডাক্তার রুদ্র‌, দ্বিতীয় দেবকুমারবাবু। এঁদের দুজনের মধ্যে একজন এই অজ্ঞাত বিষের আবিষ্কর্তা। কিন্তু ডাক্তার রুদ্রর উপর সন্দেহটা বেশি হয়‌, কারণ তিনি ডাক্তার‌, বিষ নিয়ে নাড়াচাড়া তাঁরই বেশি। তা ছাড়া দেবকুমারবাবু বিষের আবিষ্কর্তা হলে তিনি কি নিজের মেয়ের উপর সে বিষ প্রয়োগ করবেন?

‘কাজেই সব সন্দেহ পড়ল গিয়ে ডাক্তার রুদ্র’র উপর। কিন্তু তবু আমার মন খুঁতখুঁত করতে লাগল। ডাক্তার রুদ্র লোকটা অতি পাজি‌, কিন্তু তাই বলে সে এত সামান্য কারণে একটি মেয়েকে খুন করবে? আর‌, যদিই বা সে তা করতে চায়‌, রেখার নাগাল পাবে কি করে? কোন উপায়ে আর একজনের বাড়িতে বিষ পাঠাবে? রেখার সঙ্গে মন্মথর ছাদের উপর থেকে দেখাদেখি চিঠি-ফেলাফেলি। চলত; কিন্তু রুদ্রর সঙ্গে তো সে রকম কিছু ছিল না।

‘কোনও বিষাক্ত বাস্পই যে মৃত্যুর কারণ‌, এ চিন্তাটা গোড়া থেকে আমার মাথায় ধোঁয়ার মত ঘুরে বেড়াচ্ছিল। মনে করে দেখ‌, রেখার এক হাতে পোড়া দেশলাইয়ের কাঠি্‌্‌, আর এক হাতে বাক্স ছিল; অর্থাৎ দেশলাই জ্বালার পরই মৃত্যু হয়েছে। সংযোগটা সম্পূর্ণ আকস্মিক হতে পারে‌, আবার কার্য কারণ সম্বন্ধও থাকতে পারে। দেবকুমারবাবু্‌, কিন্তু বড় চালাকি করেছিলেন‌, বাক্সে একটি বৈ বিষাক্ত কাঠি দেননি–যাতে বাক্সের অন্যান্য কাঠি পরীক্ষা করে কোনও হদিস পাওয়া না যায়। আমি সে বাক্সটা এনেছিলুম‌, পরীক্ষাও করেছিলুম‌, কিন্তু কিছু পাইনি। হাবুলের বেলাতেও বাক্সে একটি বিষাক্ত কঠিই ছিল‌, কিন্তু এমনই দুৰ্দৈব যে‌, সেইটেই হাবুল পকেটে করে নিয়ে এল–আর প্রথমেই জ্বালালে।

‘অজিত‌, তুমি তো লেখক‌, দেবকুমারবাবুর এই ব্যাপারের মধ্যে একটা প্ৰকাণ্ড রূপক দেখতে পাচ্ছ না? মানুষ যেদিন প্ৰথম অন্যকে হত্যা করবার অস্ত্র আবিষ্কার করেছিল‌, সেদিন সে নিজেরই মৃত্যুবাণ নির্মাণ করেছিল; আর আজ সারা পৃথিবী জুড়ে গোপনে গোপনে এই যে হিংসার কুটিল বিষ তৈরি হচ্ছে‌, এও মানুষ জাতটাকে একদিন নিঃশেষে ধ্বংস করে ফেলবে–ব্ৰহ্মার ধ্যান-উদ্ভূত দৈত্যের মত সে স্ৰষ্টাকেও রেয়াৎ করবে না। মনে হয় না কি?’

ঘর অন্ধকার হইয়া গিয়াছিল‌, ব্যোমকেশকে ভাল দেখা যাইতেছিল না। আমার মনে হইল‌, তাহার শেষ কথাগুলো কেবল জল্পনা নয়–ভবিষ্যদবাণী।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7
Pages ( 7 of 7 ): « পূর্ববর্তী1 ... 56 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress