অকল্পনীয়
আমাদের এই লাইনে লাস্ট ট্রেন রাত সাড়ে এগারোটায়। নেহাত দৈব দুর্বিপাক না হলে লাস্ট ট্রেনে আমরা কেউ চাপি না। তা সেবার মধ্যমগ্রাম থেকে আমার এক বন্ধুর বিয়েতে নিমন্ত্রণ খেয়ে ফিরছিলাম । তখন শীতকাল। তার ওপর ফিরতেও রাত হয়ে গেল অনেক। স্টেশনে এসে দেখি লাস্ট ট্রেন সবুজ সংকেত পেয়ে ছাড়বার উপক্রম করছে। আমি ছুটে গিয়ে একটা বগিতে উঠে পড়তেই ছেড়ে দিল ট্রেন।
আমি রামরাজাতলায় নামি। হাওড়া থেকে মাত্র দুটি স্টেশনের পরেই রামরাজাতলা। এমন কিছু দূরও নয়। কিন্তু মুশকিল হল, ট্রেনে উঠে সহযাত্রী হিসেবে কাউকে না পেয়ে। পুরো বগিটা একেবারে সুনশান। ভয় করতে লাগল খুব। কেননা দিনকাল খারাপ। বিশেষ করে টিকিয়াপাড়ায় সমাজবিরোধীদের দৌরাত্ম্য খুব। যদি কেউ সেখানে ওঠে এবং বদ মতলব প্রয়োগ করে তা হলে উপায়? একা আমার পক্ষে তাদের প্রতিহত করা কখনওই সম্ভব নয়।
এই লাইনের ট্রেনে সময় বলে কিছু নেই। তার ওপর ধীরে চলো নীতিতে চলে। তাই ধীর শ্লথ গতিতে চলতে লাগল ট্রেন। যেতে যেতে খানিক পরেই আলো নিভে অন্ধকার হয়ে গেল। সে কী ভীষণ অন্ধকার! দুটি পাওয়ার স্টেশনের আউট অব কানেকশনের জন্য এইখানে প্রতিদিনই এইরকম হয়। খানিক যাওয়ার পর আবার আপনা থেকেই আলো জ্বলে ওঠে। এবারও তাই হল। আলো জ্বলতেই আমি অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, এক সুন্দরী ভদ্রমহিলা অত্যন্ত সাদামাঠা পোশাক পরে কামরার মাঝামাঝি জায়গায় জানলার ধারে গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। ভদ্রমহিলার বয়স খুব বেশি হলেও ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের ওপরে কখনও না। এই প্রচণ্ড শীতে খোলা জানলার ধারে উনি যে কী করে বসে আছেন তা ভেবে পেলাম না। সবচেয়ে রহস্যের ব্যাপার, উনি উঠলেনই বা কখন? না কি আমারই চোখের ভুল? তাড়াতাড়ি ছুটে এসে ট্রেন ধরেছি বলে আদৌ ওঁকে লক্ষ করিনি। হয়তো তাই। তবুও আমি একা থাকায় নিঃসঙ্গতা দূর করবার জন্য আমার সিট ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে তাঁর মুখোমুখি বসলাম।
ভদ্রমহিলা একবার ফিরেও তাকালেন না আমার দিকে।
অবশেষে আমি নিজেই আলাপ জমাতে গেলাম তাঁর সঙ্গে। বললাম, “কী ব্যাপার! আপনার সঙ্গে কেউ নেই? এত রাতে একা কোথায় চলেছেন?”
ভদ্রমহিলা একই ভাবে বসে রইলেন। কথার উত্তরই দিলেন না আমার। এমনকী আমার দিকে চেয়েও দেখলেন না পর্যন্ত।
আমি আবার বললাম, “কিছু মনে করবেন না। দিনকাল খারাপ, তাই বলছি। আমারই একা যেতে ভয় করছে। অথচ আপনি…!”
ভদ্রমহিলা এবারও নিশ্চুপ। ফলে আলাপ আর জমল না। দরকারই বা কী?
ট্রেন টিকিয়াপাড়ায় থামল।
একবার ভাবলাম, নেমে গিয়ে গার্ড কম্পার্টমেন্টের পাশে উঠি। আবার ভাবলাম, আর তো মাঝে একটা স্টেশন। তারপরই রামরাজাতলা। একেবারে সেখানেই নামব। তাই চুপচাপ বসে রইলাম। বসে বসে ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে নানারকম চিন্তাভাবনা করতে লাগলাম। মনে মনে আহতও হলাম একটু। কারও সঙ্গে যেচে কথা বলতে গেলে তিনি যদি উত্তর না দেন বা এড়িয়ে যান, তা হলে খুবই অসম্মান বোধ হয়। যাই হোক, উনি কথা বলুন আর নাই বলুন আমার কী আসে যায়? আমি তো মনের মধ্যে কোনও বদ উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলতে যাইনি। একা কোনও মহিলাকে রাতের গাড়িতে এইভাবে দেখলে কৌতূহল একটু হয় বইকী! বিশেষ করে উনি যখন একজন ভদ্রমহিলা।
সিগন্যাল না পেয়ে ট্রেন দাশনগরে ঢোকবার মুখেই থেমে গেল। সেও প্রায় দশ মিনিট। তারপর দাশনগরে। দাশনগর পেরিয়ে রামরাজাতলায় ঢোকবার মুখে বেলতলা ক্রসিং-এ আবার একবার। তারপর রামরাজাতলা। রামরাজাতলা পার হতেই সাঁতরাগাছি। সাঁতরাগাছি স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ামাত্রই আমার খেয়াল হল, এ কোথায় চলেছি আমি? আমার তো রামরাজাতলায় নামবার কথা! ওই মহিলার দিকে মনোনিবেশ করায় এমনই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম যে, নিজের স্টেশনই ছেড়ে এলাম! আমি আর কোনওরকম ভাবনাচিন্তা না করে চলন্ত ট্রেন থেকেই লাফিয়ে নামতে গেলাম। যেই না নামতে যাব অমনই হঠাৎই সেই ভদ্রমহিলা উঠে এসে একটা হাত ধরে টান দিয়েছেন আমায়।
ট্রেন তখন প্ল্যাটফর্মের বাইরে। আমি খুবই বিরক্ত হয়ে বললাম, “দিলেন তো আমার নামার সুযোগটা নষ্ট করে! এখন আমি কী করব? সাঁতরাগাছিতে নামলে যেভাবেই হোক পাড়ার ভেতর দিয়ে কুকুরের তাড়া খেয়ে হেঁটেও আমি বাড়ি পৌছতে পারতাম। এখন আমার সে উপায়টুকুও রইল না।”
ভদ্রমহিলা আমার কথার কোনও উত্তর না দিয়ে আবার গিয়ে বসলেন সেই জানলার ধারে।
আমি প্রচণ্ড শীতে কাঁপতে কাঁপতে মৌড়িগ্রামে নেমে পড়লাম। ট্রেন চলে গেলে আপ প্ল্যাটফর্ম থেকে ডাউন প্ল্যাটফর্মে এসে স্টেশনমাস্টারের ঘরের দিকে গেলাম। আজ রাতে হাওড়া যাওয়ার আর কোনও ট্রেন নেই। ফলে বাধ্য হয়েই এখানে রাত কাটাতে হবে। এে ারে শেষ রাতে একটা লোক্যাল আছে অবশ্য, সেও তো তিন-চার ঘণ্টার ব্যাপার। আমার চোখ ফেটে যেন জল এল। আমি স্টেশনমাস্টারের কাছে গিয়ে আমার অবস্থার কথা জানিয়ে রাতটুকুর মতো তাঁর কাছে আশ্রয় চাইলাম। ভদ্রলোক আমাকে বিমুখ করেননি। তাঁর ঘরে একটু বসবার ব্যবস্থা করে দিলেন।
সারারাত সেই দুঃসহ শীতে মশার কামড় খেয়ে কী করে যে কাটল তা আমার মতো অবস্থায় যিনি পড়েছেন একমাত্র তিনিই জানেন। বহুকষ্টে তিন-চার ঘণ্টা অপেক্ষা করবার পর শেষরাতে একটা মেচেদা লোক্যাল পেয়ে গেলাম । এই ট্রেনে অবশ্য লোকজন যথেষ্টই ছিল। এদের মধ্যে ব্যাপারিই বেশি। তাই আর কোনও অসুবিধে হল না।
মৌড়িগ্রাম থেকে রামরাজাতলা মাত্র ন’ মিনিটের পথ। ট্রেন থেকে নেমে যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। তারপর স্টেশন থেকে বাড়ি যখন ফিরলাম তখন দেখলাম বাড়ির লোকেদের চোখমুখে রীতিমতো দুশ্চিন্তার ছাপ। সারারাত একজন মানুষ বাড়ি না ফিরলে যা হয় আর কি!
যাই হোক, আসল ব্যাপারটা বাড়িতে আমি সম্পূর্ণ চেপে গেলাম। বললাম, কাল রাতে ফিরতে দেরি হওয়ায় লাস্ট ট্রেনটা একটুর জন্য মিস করি। তাই সারারাত হাওড়া স্টেশনে পড়ে থেকে ভোরের প্রথম ট্রেনেই আসছি। এই বলে বিছানায় শুয়ে তেড়ে একটা ঘুম দিয়ে শরীরটাকে ঝরঝরে করে নিলাম।
এই কাহিনীর এখানেই সমাপ্তি ঘটলে এটা আর গল্প হত না। এই ঘটনার কিছুদিন পরেই টিকিয়াপাড়ার কাছে নটবর পাল রোডের একটা বাড়িতে আমার ভাগিনেয়র জন্য মেয়ে দেখতে গেলাম। মেয়েটি সুন্দরী না হলেও চলনসই। আমাদের পছন্দ হওয়ার ব্যাপারটাও ওঁদের জানিয়ে দিলাম।
তখন সন্ধে উত্তীর্ণ হয়েছে। আমাদের মতামত জেনে কন্যাপক্ষের লোকেরা পরমানন্দে দোতলায় নিয়ে গেলেন মিষ্টিমুখ করাতে। এমন সময় হঠাৎ লোডশেডিং। অন্ধকারে ভরে গেল চারদিক। আর ঠিক তখনই যা দেখলাম তাতে সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আমার। ঘরের দেওয়ালের মাঝামাঝি জায়গায় একটা ছবি টাঙানো ছিল। সেই অন্ধকারেও ছবিটা যেন হঠাৎ কীরকম স্পষ্ট হয়ে উঠল। দেখলাম এই ছবি আর কারও নয়, সে রাতে ট্রেনের কামরায় দেখা সেই ভদ্রমহিলার। সবচেয়ে আশ্চর্য! ছবির মুখ আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তার চোখে পাতা পড়ছে। ঠোঁট দুটো নড়ছে। আর—
আর কিছুই আমার মনে নেই। সামান্য কিছুক্ষণের জন্য সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলাম। পরে অবশ্য খবর নিয়ে জেনেছিলাম, ওই ভদ্রমহিলা মেয়েটির মা। বছরখানেক আগে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে টিকিয়াপাড়ার কারশেডের কাছে ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। বলা বাহুল্য, এর পরে ওই বাড়িতে আমার ভাগিনেয়র বিয়ের ব্যাপারটা আমরাই বাতিল করে দিয়েছিলাম।