ফেলুদা মনমরা
ফেলুদাকে বেশ কিছুদিন থেকেই মনমরা দেখছি। আমি বলছি মনমরা। সেই জায়গায় লালমোহনবাবু অন্তত বারো রকম বিশেষণ ব্যবহার করেছেন—একেক দিনে একেক রকম। তার মধ্যে হতোদ্যম, বিষণ্ণ, বিমর্ষ নিস্তেজ, নিম্প্রভ ইত্যাদি তো আছেই। এমনকী মেদামারা পর্যন্ত আছে। এর কোনওটাই অবিশ্যি উনি ফেলুদাকে বলেননি, বলেছেন আমাকে। আজ আর থাকতে না পেরে সোজাসুজি ফেলুদাকেই প্রশ্ন করে বসলেন, মশাই, আপনাকে ক’দিন থেকে এত ম্ৰিয়মাণ দেখছি কেন?
ফেলুদা সোফায় হেলান দিয়ে সামনের কফি-টেবিলের উপর পা ছড়িয়ে বসেছিল মেঝের দিকে তাকিয়ে; লালমোহনবাবুর প্রশ্নের পরও সেই একইভাবে বসে রইল।
এটা কিন্তু মশাই আনফেয়ার, অভিমানের সুরে বললেন জটায়ু। আমার এখানে আসার একমাত্ৰ উদ্দেশ্য হচ্ছে জমিয়ে আজ্ঞড়া দেওয়া। আপনি দিনের পর দিন এমন বোজার ভাব করলে তো আসা বন্ধ করে দিতে হয়! একটু আলোকপাত করুন, যাতে কী হয়েছে আঁচ করতে পারি। এমন তো হতে পারে যে আপনার এই কন্ডিশনের রেমিডি হয়তো আমি সাপ্লাই করতে পারি। আগে তো আমি ঘরে ঢুকলেই আপনার ভুরু নেচে উঠত, আজকাল দেখছি আমাকে দেখলেই মুখ ঘুরিয়ে নেন।
সরি, মেঝের দিকে চেয়েই মৃদুস্বরে বলল ফেলুদা।
নো নিড ঢুঁ আপলজাইজ, ফেলুবাবু; আপনি কেন গুমরোচ্ছেন সেইটে বলুন, তার পর বাকি কথা হবে। কাইন্ডলি বলুন। এত আনন্দের স্মৃতিভরা ঘর এমন গুমোট মেরে যাবে এটা বরদাস্ত করা যায় না; বলবেন কী হয়েছে?
চিঠি, বলল ফেলুদা।
চিঠি?
চিঠি।
কার চিঠি? এমন কী থাকতে পারে চিঠিতে যা আপনার মনে অন্ধকার আনবে? কার চিঠি মশাই?
পাঠক।
কীসের পাঠক?
শ্ৰীমান তপোশের লিপিবদ্ধ করা প্রদোষচন্দ্ৰ মিত্রের কীর্তিকলাপ।
পাঠক কি তাতে অবজেকশন নিয়েছে?
পাঠক সিঙ্গুলার নয়, লালমোহনবাবু; পাঠক প্লুর্যাল। গুনে দেখেছি। ছাপান্নখানা চিঠিতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই কথা।
আমি কিন্তু এইসব চিঠিপত্রের কথা কিছুই জানি না! ফেলুদা রোজই চার-পাঁচটা করে চিঠি পায় সেটা জানি, কিন্তু সেগুলো কী চিঠি সেটা কোনও দিন জিজ্ঞেস করিনি।
একই কথা মানে? জিজ্ঞেস করলেন জটায়ু। কী কথা?
ফেলুমিত্তিরের মামলা আর তেমন জমাটি হচ্ছে না, জটায়ু আর তেমন হাসাতে পারছেন। না, তপোশের বিবরণ বিবৰ্ণ হয়ে আসছে… লালমোহনবাবু হঠাৎ খেপে উঠলেন। –হাসাতে পারছেন না? জটায়ু হাসাতে পারছেন না? আমি কি সং?
না না, ফেলুদা বলে উঠল, আপনি সং হতে যাবেন কেন? সং, ভাঁড়, ক্লাউন, জোকার-এ সব অত্যন্ত অপমানকর কথা। আপনি হলেন বিদুষক। এইভাবে নিজেকে কল্পনা করে নিলে দেখবেন আমার কোনও ঝঞ্ঝাট নেই।
কথাটায় লালমোহনবাবুর রাগ তো গেলেই না, বরং তিনি বেশ বিরক্তির সঙ্গে ফেলুদার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে বললেন, আই অ্যাম রিয়েলি ডিস্যাপয়েন্টেড। হ্যাঁ ছা ছদ্মা—এইসব চিঠি আপনি জমিয়ে রেখেছেন? পাওয়ামাত্র দল পাকিয়ে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে নিক্ষেপ করেনকি?
না, করিনি, গম্ভীরভাবে বলল ফেলুদা, কারণ এই সব পাঠকই এতকাল আমাকে সাপোর্ট করেছে; এখন যদি তারা বলে যে, থ্রি মাসকেটিয়ার্স-এর অকাল বাৰ্ধক্য দেখা দিয়েছে, তা হলে কথাটা আমি উড়িয়ে দিতে পারি না।
অকাল বাৰ্ধক্য। হাঁটুতে চাপড় মেরে চোখ কপালে তুলে বললেন জটায়ু। তপেশের কথা ছেড়েই দিলাম—আপনি তো সুপারফিট চিরতরুণ। তপেশও আপনারই মতা রেগুলার যোগব্যায়াম করে। শরীরে মেদের লেশমাত্র নেই। আর আমি যে আমি-এখনও। -এই সে দিনও—আমার পড়শি—সেভেনটিন ইয়ারস মাই জুনিয়র-সোমেশ্বর হাজরাকে পাঞ্জায় কাত করে দিলুম। –সেটা বার্ধক্যের লক্ষণ? বয়স তো মানুষের বাড়বেই, কিন্তু সেই সঙ্গে যে আক্কেলও বাড়ে, অভিজ্ঞতাও বড়ে তার কি কোনও দাম নেই?
এটা বোঝাই যাচ্ছে যে, সে সন্ধের কোনও পরিচয় পাঠকরা পাচ্ছে না।
এও তো এক রহস্য। কিনারা করতে পারলেন?
ফেলুদা টেবিল থেকে পা দুটো নামিয়ে সোজা হয়ে বসল।
শুনুন, লালমোহনবাবু-জনপ্রিয়তার লেজুড় হিসেবে বেশ কিছু ঝক্কি এসে পড়ে সেটা আপনারও অজানা নয়। প্রকাশকের চাপ আপনাকে ভোগ করতে হয় না?
ওরেব্বাস-সে তো ট্রিমোন্ডাস ব্যাপার?
জানি। কিন্তু ফেলুদার জনপ্রিয়তা আর প্রখর রুদ্রের জনপ্রিয়তা এক জিনিস নয়। আপনার উপর চাপ এলে আপনি কল্পনার আশ্রয় নিয়ে সাপ-ব্যাঙ-বিছু যা হয় একটা দাঁড় করিয়ে প্রকাশকের চাহিদা মেটাতে পারেন। কিন্তু তোপ্সের উপর যখন চাপ আসে তখন কল্পনার আশ্রয় নিলে চলে না। বাস্তবে আমার মামলায় যা ঘটেছে, সেটাকেই একটু পালিশ করে উপন্যাসের আকারে প্রকাশকের হাতে তুলে দিতে হয়। তার মাস খানেকের মধ্যেই ফেলুদার একটি টাট্কা নতুন অ্যাডভেঞ্চার বইয়ের বাজার দখল করে বসে। তার একটা ফল হল এই ছাপান্নখানা চিঠি। কারণ আর কিছুই নয়; প্রতি বছরই যে আমার হাতে এমন একটি মামলা আসবে যা থেকে জমাটি উপন্যাস হয় তার কী গ্যারান্টি আছে? এটা ভুললে চলবে না। যে, আমার পাঠক প্রধানত কিশোর-কিশোরী। আমার এমন অনেক মামলার উদাহরণ দিতে পারি। যেগুলো চিত্তাকর্ষক হলেও, তাতে এমন সব উপাদান থাকে যা কখনওই কিশোরদের পাতে দেওয়া চলে না।
যেমন লখাইপুরের সেই জোড়া খুনের মামলা?
তা তো বটেই। সেটাতে তো তোপ্সেকে আমার ধারে-পাশেই আসতে দিইনি—যদিও সে এখন আর খোকাটি নেই, এবং বয়সের তুলনায় অনেক বেশি জানে-বোঝে।
তার মানে আপনি বলতে চান যে, তোপ্সের বাছাইয়ে গলদ রয়েছে?
সেটা হত না যদি না ও প্রকাশকের তাগিদের চোটে বিভ্ৰান্ত হয়ে পড়ন্ত। ওকে দোষ দিই। কী করে বলুন? আমার মামলা থেকে ও যা খাড়া করে তাকে কিশোর উপন্যাসই বলা হয়ে থাকে। এইসব উপন্যাস যদি শুধু কিশোররাই পড়ত, তা হলে কিন্তু কোনও সমস্যা ছিল না; আসলে যেটা ঘটে সেটা হল, কিশোরদের সঙ্গে তাদের মা, বাবা, মাসি, পিসি, খুড়ো, জ্যাঠা সকলেই এসব উপন্যাস পড়ে। একসঙ্গে এত স্তরে চাহিদা মেটানো কি চাট্টিখানি কথা?
আপনি তপেশকে একটু গাইড করুন না। সেটা করব। আগে করতাম, ইদানীং করি না। আবার করব। তবে তার আগে প্রকাশকের সঙ্গে একটা মোকাবিলা করা দরকার। তাদের বোঝাতে হবে যে, লাগসই মামলা পেলেই তারা উপন্যাস পাবে, নচেৎ নয়। তাতে যদি একটা বছর ফেলুদা বাদও যায়, সেটাও। তাদের মেনে নিতে হবে। তারা ঘোর ব্যবসাদার; আমার মান-ইজত নিয়ে তারা চিন্তিত নয়—সে চিন্তা আমাদেরই করতে হবে।
পাঠকদের সঙ্গেও তো একটা মোকাবিলার প্রয়োজন, তাই নয় কি? এই যে সব যারা রাগী-রাগী চিঠি দিল?
এরা বোকা নয়, লালমোহনবাবু। এদের চাহিদা অত্যন্ত সঙ্গত। সেটা মেটাতে পারলেই এরা আবার আমাকে তুলে ধরবে।
শুধু আপনাকে? আমাকে নয়?
একশোবার! আপনি-আমি তো পরস্পরের পরিপূরক। সোনায় সোহাগা। অ্যারালভাইট দিয়ে আমার সঙ্গে সেঁটে রয়েছেন। আপনি সেই সোনার কেল্লার সময় থেকেই। আমাকে ছাড়া আপনার অস্তিত্বই নেই—অ্যান্ড ভাইসি ভারসা।
লালমোহনবাবু আমার দিকে ফিরে গভীর গলায় বললেন, বি ভেরি কেয়ারফুল, তপেশ! এটা বলার কোনও দরকার ছিল না, কারণ ফেলুদা স্পষ্টই বুঝিয়ে দিয়েছে যে, এবার থেকে কেয়ারফুল হবার অর্ধেক দায়িত্ব ওর।
কথার ফাঁকে ফেলুদা একটা চারমিনার ধরিয়েছিল। এবার সেটা আধাপোড়া অবস্থায় অ্যাশ-ট্রেতে ফেলে দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল, সোজা নিয়ম, বুঝলি তোপ্সে। এবার থেকে আমার গ্রিন সিগন্যাল না পাওয়া পর্যন্ত তুই হাত পা গুটিয়ে বসে থাকিবি। ঠিক হ্যায়?
আমি হেসে মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলাম ঠিক হ্যায়।