Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

বিজয় দশমী, রাত পৌনে দশটা। ঘোষালবাড়ির একতলার বৈঠকখানা। যাঁরা ঘরে রয়েছেন তাঁরা হলেন-গোয়েন্দা প্রদোষ মিত্তির, লালমোহন গাঙ্গুলী, সাব-ইনসাপেক্টর তেওয়ারি, অম্বিকা ঘোষাল, উমানাথ ঘোষাল, উমানাথবাবুর স্ত্রী, রুক্মিণীকুমার ঘোষাল, বিকাশ সিংহ, আর আরও সব যাঁরা বাইরে থেকে এসেছেন যাঁদের নাম জানি না, আর আমি-তপেশরঞ্জন মিত্র। এ ছাড়া ঘরের দরজার বাইরে থেকে উঁকি মারতে দেখছি তিনজন লোককে—দারোয়ান ত্ৰিলোচন পাণ্ডে, বেয়ারা বৈকুণ্ঠ আর বুড়ে চাকর ভরদ্বাজ।

কোলাকুলি শেষ, মিষ্টি শেষ-অন্তত প্লেটে শেষ, যদিও কারুর কারুর চোয়াল এখনও নড়ছে। যেমন ফেলুদার। ঠাকুর ভাসান হয়ে যাবার পর বাড়ির লোকের মন খারাপ হয়ে যায়; এখানেও তাই হয়েছিল। কিন্তু এখন আবার এক ঠাকুর চলে গিয়ে আরেক ঠাকুর ফিরে পাবার আশায় সকলের মুখেই বেশ একটা হাসিহাসি উত্তেজনার ভাব। এটা বলে রাখি যে গণেশ পাওয়া গেছে কি না সেটা কিন্তু এখনও জানা যায়নি। যেটা জানা গেছে সেটা হল। মছলিবাবার ঘটনা। আজ বিকেল চারটের সময় ভক্তের দল আসার আধা ঘণ্টা আগে অভয়বাবুর বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে পুলিশ মছলিবাবাকে অ্যারেস্ট করে। বাবাজী আসলে ছিলেন। সেই রায়বেরিলির জেল থেকে পলাতক জালিয়াত। তা ছাড়াও তিনি ছিলেন। মগনলালের একজন স্যাঙাৎ। তার আসল নাম নাকি পুরুন্দর রাউত, বাড়ি পূর্ণিয়া। লোকটা অনেক’দিন কলকাতায় ছিল, মনুমেন্টের তলায় হাত সাফাইয়ের খেলা দেখানো থেকে শুরু করে অনেক রকমের অদ্ভুত কাজ করে শেষটায় জালিয়াতি ধরে। অ্যারেস্টের এক ঘণ্টার মধ্যে বেঙ্গলি ক্লাবের কাছ থেকে ধার করা মেক-আপের সরঞ্জামের সাহায্যে মছলিবাবার চেহারা নিয়ে ফেলুদা ভক্তদের সামনে হাজির হয়। তার আগেই অবিশ্যি পুরুন্দর রাউত পুলিশের চাপে পড়ে সব কথা ফাঁস করে দিয়েছিল। আজ গঙ্গার ঘাটে যে দুর্ধর্ষ নাটকটা মগনলাল প্ল্যান করেছিল সেটাও পুরন্দর বলে দিয়েছিল। আসলে মছলিবাবাকে মগনলালই খাড়া করেছিল। তার পিছনে যে কী সাংঘাতিক শয়তানি ফন্দি ছিল সেটা পরে ফেলুদার কথা থেকে জানা যায়।

সবাই মুখ বন্ধ করে উদ্‌গ্ৰীব হয়ে বসে আছে, সকলেরই দৃষ্টি ফেলুদার দিকে। লালমোহনবাবু যে কেন মাঝে মাঝে হেসে উঠছেন জানি না; হয়তো বিকাশবাবু ওকে জোর করে সিদ্ধি খাইয়েছেন বলে। সিদ্ধি খেলে নাকি হাসি পায়।

ফেলুদা জল খেয়ে হাতের কাচের গেলাসটা আওয়াজ বাঁচিয়ে খুব সাবধানে পিতলের কাশ্মীরি টেবিলটার উপর রেখে বলল, মগনলালই মছলিবাবার সৃষ্টিকতা এ কথা আমি আপনাদের আগেই বলেছি। মছলিবাবা অন্তর্যামী, মছলিবাবা অলীকিক ক্ষমতার অধিকারী—এ ধরনের কয়েকটা ধারণা রটাতে পারলেই কাৰ্য্যসিদ্ধি হয়। কেদার ঘাটে মছলিবাবাকে এনে ফেলার আগে অভয় চক্রবর্তী এবং লোকনাথ পাণ্ডা সম্বন্ধে দু-একটা কথা জেনে নেওয়া মগনলালের মতো লোকের পক্ষে কিছুই কঠিন ছিল না। বাকি কাজটা সম্ভব হয়েছিল। অভয়বাবুর অন্ধ ভক্তির জোরে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের বিশ্বাসের জোরে।

ফেলুদা থামল। লালমোহনবাবু হাসবার জন্য মাথা পিছনে হেলিয়ে মুখটা খুলতেই আমি ওর কনুইয়ে খোঁচা মেরে ওকে থামালাম। ঘরের আর প্রত্যেকটি লোক হাঁ করে ফেলুদার কথাগুলো গিলছে। ফেলুদা বলে চলল—

মগনলালের সঙ্গে সম্প্রতি তার বাড়িতে বসে আমার কিছু কথা হয়েছিল। মগনলাল বলেছিল গণেশটা তার কাছে আছে, এবং উমানাথবাবু নিজে নাকি সেটা তাকে বিক্রি করেছেন।

অ্যাঁ!–চোখ রাঙিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। উমানাথ ঘোষাল। আপনি বিশ্বাস করেছিলেন তার কথা?

রহস্যের একটা নতুন দিক হিসাবে কথাটা শুনতে, যে খুব খারাপ লেগেছিল তা বলব না। কিন্তু পরমুহূর্তেই যখন মগনলাল তদন্ত বন্ধ করার জন্য আমাকে একটা মোটা ঘুষ অফার করল, তখন মনে একটা খটকা লাগল! বন্ধ করার একটা কারণ অবিশ্যি মগনলাল বলেছিল, কিন্তু সেটা আমার কাছে খুব বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি। তার কথা সত্যি হলে বরং আপনি আমাকে ঘুষ আফার করতে পারতেন–কারণ কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে গেলে সেটা আপনার পক্ষে মোটেই সুবিধের হত না! অথচ আপনি আমাকে নিজে থেকে অনুসন্ধান চালাতে বলেছেন।

নিজে থেকে, প্ৰতিধ্বনি করলেন লালমোহনবাবু, হাঃ হাঃ–নিজে থেকে।

ফেলুদা লালমোহনবাবুর পাগলামো অগ্ৰাহ্য করে বলে চলল–

তখনই আমার প্রথম সন্দেহ হয় যে তা হলে হয়তো গণেশটি আপনাদের বাড়িতেই কোথাও রয়ে গেছে, এবং মগনলাল কোনও উপায়ে কোনও একটা সময়ে সেটা পাবার অংশ করছে। বাড়িতে রয়েছে, অথচ সিন্দুকে নেই–তা হলে গেল কোথায় জিনিসটা? সেই সঙ্গে আবার এটাও মনে হল যে এ বাড়ির সঙ্গে মগনলালের একটা যোগসূত্র না থাকলে সেই বা কী করে আশা করছে। গণেশটা পাবার?

এই সব যখন ভাবছি, তখন একটা কারণে হঠাৎ সন্দেহটা গিয়ে পড়ল মিস্টার সিংহের উপর; কারণ আমি জানতে পারলাম যে তিনি একটা জরুরি সত্য আমার কাছ থেকে গোপন করে রেখেছিলেন। জেরার ফলে বিকাশবাবু স্বীকার করলেন যে তিনি দৰ্শই অক্টোবর লুকিয়ে লুকিয়ে মগনলালের সঙ্গে উমানাথবাবুর কথাবার্তা শুনেছিলেন। শোনার পর থেকে তার মনে গণেশটা সম্পর্কে একটা উদ্বেগ থেকে যায়। মিস্টার ঘোষাল যেদিন মছলিবাবাকে দেখতে যান, সেদিন আর থাকতে না পেরে বিকাশবাবু দোতলায় অম্বিকাবাবুর ঘরে গিয়ে তাঁর দেরাজ থেকে চাবি নিয়ে সিন্দুক খোলেন। খুলে দেখেন গণেশ নেই।

গণেশ তখনই নেই? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন উমানাথবাবু। তার মানে তার আগেই চুরি হয়ে গেছে?

চুরি না, ফেলুদা বলল। ফেলুদা উঠে দাঁড়িয়েছে।–তার হাত দুটো প্যান্টের পকেটে। চুরি না। একজন অত্যন্ত বুদ্ধিমান ব্যক্তি গণেশটিকে মগনলালের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সেটিকে লুকিয়ে রেখেছিল।

ক্যাপ্টেন স্পার্ক।–বলে উঠল রুক্মিণীকুমার।

সবাইয়ের দৃষ্টি রুকুর দিকে ঘুরে গেল। সে ঘরের এক কোণে একটা দরজার পাশে পদার্গ হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

ঠিক বলেছ। ক্যাপ্টেন স্পার্ক, ওরফে আমাদের রুকুবাবু। –আচ্ছা, ক্যাপ্টেন স্পার্ক, সেদিন যখন তোমার বাবার সঙ্গে একজন মোটা ভদ্রলোক এ ঘরে বসে কথা বলছিলেন–

রুকু ফেলুদার কথা শেষ না হতেই চেঁচিয়ে উঠল—ডাকু গণ্ডারিয়া -ক্যাপ্টেন স্পার্ক তাকে বার বার বোকা বানায়।

সে যখন কথা বলছিল, তুমি কি তখন ওই পাশের ঘর থেকে শুনছিলে?

রুকু তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল, শুনছিলাম তো। আর তক্ষুনি তো সিন্দুক খুলে গণেশ নিয়ে লুকিয়ে রাখলাম। না হলে তো ও নিয়ে নিত।

ভেরি গুড, ফেলুদা বলল। তারপর অন্যদের দিকে ফিরে বলল, আমি ক্যাপ্টেন স্পার্ককে গণেশের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। তাতে ও বলেছিল। গণেশ পাওয়া যাবে না। করুণ সেটা রয়েছে আফ্রিকার এক রাজার কাছে! কথাটার মানে আমি তখন বুঝতে পারিনি। শেষে বুঝলাম একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে-প্টয়তাল্লিশ বছরের পুরনো টার্জনের একটা ফিল্ম দেখতে গিয়ে।

ফেলুদা থামতেই চারিদিক থেকে–সে কী! অ্যাঁ? টার্জনের ছবি? ইত্যাদি অনেকগুলো প্রশ্ন একসঙ্গে শোনা গেল! ফেলুদা সরাসরি উত্তর না দিয়ে আবার রুকুর দিকে তাকিয়ে বলল, ক্যাপ্টেন স্পার্ক, টারজানের ছবির এক্কেবারে শুরুটা কী সেটা মনে করে বলতে পার তুমি!

পারি, বলল রুকু, মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ার প্রেজেন্টস—

ঠিক কথা-মিস্টার তেওয়ারি, দেখুন তো আমরা মেট্রো-গোন্ডউইনের খেলা কিছু দেখাতে পারি কি না।

তেওয়ারি তার চেয়ারের নীচ থেকে একটা খবরের কাগজের মোড়ক নিয়ে সেটা খুলে তার থেকে একটা অদ্ভুত জিনিস বার করে ফেলুদার দিকে এগিয়ে দিল। তার উপরে বিজলির ঝাড়ের আলোটা পড়তেই বুঝলাম সেটা একটা জলে নষ্ট হয়ে যাওয়া মাটির তৈরি হাঁ-করা সিংহের মাথা! ফেলুদা মাথাটা হাতে তুলে ধরে বলল, এই দেখুন আফ্রিকার পশুরাজ তথা দুৰ্গরি বাহনের মাথা। এই সিংহের হাঁ-এর মধ্যে গণেশ লুকিয়ে রেখেছিল। ক্যাপ্টেন স্পার্ক। তার ধারণা ছিল বিসর্জনের পর গণেশ ভাসতে ভাসতে চলে যাবে সমুদ্রে, আর সেখানে একটি হাঙর সেটাকে গ্রাস করবে, আর স্পার্কই আবার সেই হাঙরকে হারপুন দিয়ে মেরে গণেশটাকে পুনরুদ্ধার করবে। তাই না, ক্যাপ্টেন স্পার্ক?

তাই তো, বলল রুকু।

আর মছলিবাবার প্ল্যান ছিল তিনি ঠাকুর ভাসানের আগে নিজে জলে ঝাঁপ দেবেন। তারপর কিছু দূর সাঁতরে গিয়ে আবার ডুব সাঁতারে ফিরে আসবেন ঘাটের দিকে-এসে নীকের আড়ালে অপেক্ষা করবেন। তারপর ভাসানের পরমুহূর্তে আবার ডুব দিয়ে সিংহের মাথাটি চাড় দিয়ে খুলে নিয়ে চলে যাবেন মুনশীঘাট আর রাজঘাটের মাঝামাঝি একটা নির্জন জায়গায়। ততক্ষণে মগনলালের বজরাও এসে যাবে সেইখানে। ব্যস-বাকি কাজ তো সহজ।

উমানাথবাবু বললেন, কিন্তু বাবাজী যে দস্যেরার দিনে যাবেন, সে তো তার ভক্তরাই ঠিক করে দিয়েছিল। আর গণেশ কোথায় আছে সে খবরই বা বাবাজী জানবেন কী করে? আর মগনলালই বা জানবে কী করে?

দুটোর উত্তরই খুব সহজ, বলল ফেলুদা।তৃতীয়ার দিনে বাবাজী তাঁর ভক্তদের জিজ্ঞেস করেন এক থেকে দশের মধ্যে একটা নম্বর বলতে। যথারীতি অধিকাংশ উত্তরই হয় সাত। এটাই নিয়ম। ফলে হয়ে গেল তিনে সাতে দশ-অর্থাৎ দিসেরা। আর সিংহের মুখে গণেশ লুকোনোর কথাটা ক্যাপ্টেন স্পার্ক সবাইকে না বললেও, তার বন্ধু সূরযকে নিশ্চয়ই বলেছিল, তাই না, ক্যাপ্টেন স্পার্ক?

রুকু স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে, তার ভুরু কুঁচকে গেছে। সে ছোট্ট করে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে দিল।

ফেলুদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, শয়তান সিং সত্যিই শয়তান সিং। সূরায্যের পুরো নাম সূরফলাল মেঘরাজ। সে মগনলালের ছাট ছেলে। যাকে বলে বাপকা বেটা। থাকত মানমন্দিরের কাছে মগনলালের দুটো বাড়ির একটাতে। ওটায় ফ্যামিলি থাকত। অন্যটায় থাকত মগনলাল নিজে। সূরযই তার বাপকে খবরটা দেয়, এবং তার পরেই মগনলাল তার বিরাট চক্রান্তটি খাড়া করে।

বিশ্বাসঘাতক! —বলে উঠল রুকু।

এতক্ষণে অম্বিকাবাবু মুখ খুললেন—

সিংহের মাথাটা তো টেবিলের উপর রেখে দিয়েছে, কিন্তু গণেশ কই?

ফেলুদা মাথাটাকে আবার হাতে তুলে নিল। তারপর তার হাঁ-করা মুখের ভিতর হাত ঢুকিয়ে টান দিয়ে যে জিনিসটা বার করল সেটা গণেশ নয় মোটেই। সেটা তার আঙুলের ভগায় লেগে থাকা চটচটে একটা সাদা জিনিস।

ক্যাপ্টেন স্পার্ক গণেশটাকে আটকাতে একটা আশ্চর্য সহজ উপায় বার করেছিল।

চিকলেট!–বলে উঠল রুক্মিণীকুমার।

হ্যাঁ, চুইং গাম, বলল ফেলুদা, সেই চুইং গামের খানিকটা এখনও রয়ে গেছে, কিন্তু গণেশ আর এখানে নেই।

ফেলুদার এই এক কথাতেই ঘোষাল বাড়ির সকলের মুখ কালো হয়ে গেল। উমানাথবাবু কপাল চাপড়ে বলে উঠলেন, তা হলে এত করে কী হল মিস্টার মিত্তির? গণেশই নেই?

ফেলুদা সিংহের মাথাটা আরেকবার নামিয়ে রেখে বলল, আমি আপনাদের আশায় ঠাণ্ডা জল ঢেলে দেবার জন্য আপনাদের এখানে ডাকিনি, মিস্টার ঘোষাল। গণেশ আছে। সেটা কোথায় বলার আগে আমি আপনাদের একটি ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। আপনাদের একজন খুব পরিচিত ব্যক্তির মৃত্যুর কথা! শশীভূষণ পাল।

তাকে তো তার ছেলে মেরেছে বলে উঠলেন। উমানাথবাবু, সেই নিয়েছে নাকি গণেশ?

ব্যস্ত হবেন না, বলল ফেলুদা, আমার কথাটা আগে মন দিয়ে শুনুন। আমি যা বলতে যাচ্ছি সেটা প্রমাণসাপেক্ষ, এবং সে প্রমাণ আমরা পাব বলেই আমার বিশ্বাস।

ঘরের প্রত্যেকটি লোক আবার স্তব্ধ হয়ে ফেলুদার দিকে দেখছে। লালমোহনবাবু আর জোরে হাসছেন না, কিন্তু সব সময়েই তার মুখে হাসি লেগে রয়েছে। আর কেন জানি মাঝে মাঝে ডান হাত দিয়ে নিজের কপালে চাঁটি মারছেন।

ফেলুদা বলল, সিংহের মুখের মধ্যে যদি গণেশ লুকোনো থাকে তা হলে সেটা দেখে ফেলার সব চেয়ে বেশি সুযোগ ছিল শশীবাবুর। বিশেষ করে যেদিন তিনি সিংহের মুখের বাইরে এবং ভিতরে তুলির কাজ করছিলেন সেই দিন। অথাৎ পঞ্চমীর দিন! অর্থাৎ যেদিন তিনি খুন হন। সেদিন আপনারা সন্ধ্যায় বাড়ি ছিলেন না-মনে আছে কি? ত্ৰিলোচন বলেছে আপনারা বিশ্বনাথের মন্দিরে আরতি দেখতে গিয়েছিলেন।

উমানাথবাবু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন। ফেলুদা বলল, আমরা পুলিশের কাছ থেকে জেনেছি যে শশীবাবু সেদিন আবার অসুস্থ বোধ করাতে তাঁর কাজ শেষ করে বিকাশবাবুর কাছে ওষুধ চাইতে গিয়েছিলেন। এ কথা বিকাশবাবুই পুলিশকে বলেছিলেন। শশীবাবু ওষুধ নিয়ে বাড়ি চলে যান। আমরা ত্ৰিলোচনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি যে শশীবাবু যাবার কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিকাশবাবুও বেরিয়েছিলেন। তিনি কেন বেরিয়েছিলেন সেটা তাঁকে জিজ্ঞেস করতে পারি কি?

বিকাশবাবু গভীর গলায় বললেন, এটা জিজ্ঞেস করার কারণ কী বুঝতে পারছি না। যাই হাক, মিস্টার মিত্তির যে প্রশ্নটা করলেন তার উত্তর হচ্ছে-আমি সিগারেট কিনতে বেরিয়েছিলাম।..আরও কিছু প্রশ্ন আছে কি মিস্টার মিত্তিরের?

হ্যাঁ, আছে। —সিগারেট কিনে বাড়ি ফিরতে এক ঘণ্টার উপর সময় লাগল কেন আপনার, বিকাশবাবু?

তার কারণ আমি গঙ্গার ঘাটে একটু হাওয়া খেতে গোসলাম। কোন ঘাট জানতে চান তো তাও বলছি। হরিশ্চন্দ্র। সোনারপুরা রোডের ডাক্তার অশোক দস্তুর সঙ্গে সেখানে দেখা হয়, মিনিট দশেক কথাও হয়। তাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।

আপনার হরিশ্চন্দ্ৰ ঘাটে যাওয়ার ব্যাপারটা আমি অবিশ্বাস করছি না বিকাশবাবু। আপনার সেখানে যাবার একটা বিশেষ কারণ ছিল। সেটায় আমরা আসছি। এক্ষুনি; তার আগে ক্যাপ্টেন স্পার্ককে আমার আরেকটা প্রশ্ন আছে। ক্যাপ্টেন স্পার্ক, তুমি কি তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট খুদে রক্ষিতকে বলেছিলে সিংহের মুখে গণেশ লুকিয়ে রাখার কথা?

ও তো বিশ্বাসই করেনি, বলল রুকু।

জানি। সেইজন্যেই ও সিন্দুক খুলে দেখতে গিয়েছিল রুকূর কথা সত্যি কি না। যখ দেখল। সত্যি, তখন থেকেই ওর লোভ হয়। গণেশটার উপর। সেটা আপনিই চলে আসে ওর হাতে যখন শশীবাবু গণেশটা পেয়ে বাড়িতে আর কাউকে না পেয়ে বিকাশবাবুর হাতে সেটা জমা দিতে চায়। কিন্তু বিকাশ সিংহ তো জিনিসটা এভাবে পেতে চাননি; শশীবাবু যে পরের দিনই সব কথা ফাঁস করে দেবেন! তাকে খতম না করতে পারলে তো বিকাশবাবুর উদ্দেশ্য সিদ্ধি হয় না। তাই তিনি শশীবাবুকে ধাওয়া করেন। যাবার পথে শ্ৰীধর ভ্যারাইটি স্টোর্স থেকে একটি ছোরা কেনেন। তাই দিয়ে গণেশ মহল্লার অন্ধকার গলিতে শশীবাবুকে নির্মমভাবে হত্যা করেন; তারপর হরিশ্চন্দ্ৰ ঘাটে গিয়ে রক্তাক্ত ছুরিটা গঙ্গায়—

মিথ্যে! সর্বৈব মিথ্যে! প্রত্যেকটা কথা মিথ্যে!—বিকাশবাবুর এরকম অদ্ভুত চেহারা কোনওদিন দেখব কল্পনা করিনি। তার চোখ দুটো আর কপালের রাগ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে-গণেশ যদি আমি নেব তো সে গণেশ কোথায়? কোথায় সে গণেশ?

আর এক’দিন পরে হলে হয়তো সে গণেশ থাকত না। আপনি নিশ্চয়ই মগনলালকে বিক্রি করে দিতেন। কিন্তু পুজোর কাঁটা দিন আপনার বাড়ি থেকে বেরোনো সম্ভব হয়নি।–তাই আপনাকে গণেশ লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল।

মিথ্যে কথা।

তেওয়ারিজী! ফেলুদা দারোগাসাহেবের দিকে হাত বাড়াল। তেওয়ারি এবার আরেকটা জিনিস ফেলুদার হাতে তুলে দিল।

বিকাশবাবুর রেডিয়ো।

ফেলুদা রেডিয়েটাকে চিত করে ব্যাটারির খুপরির ঢাকনাটা খুলে তার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে টেনে বার করল একটা লম্বা হিরে-বসানো আড়াই ইঞ্চি সোনার গণেশ।

পরমুহূর্তেই অম্বিকাবাবুর বিশাল তালতলার চটির একটা পাটি গিয়ে সজোরে আছড়ে খো বিকাশবাবুর গালে।

সব শেষে শুনলাম রুকুর রিনারিনে চিৎকার—

বিশ্বাসঘাতক! বিশ্বাসঘাতক! বিশ্বাসঘাতক!


ঘোষালদের বাড়িতে তারিফ আর ভূরিভোজ ছাড়া আর যে জিনিসটা পাওয়া গেল, সেটা রয়েছে এখন ফেলুদার পকেটে একটা খামের মধ্যে। আমরা মদনপুরা রোড দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছি। লালমোহনবাবুর সিদ্ধির নেশা ছুটেছে কি না জানি না। হতে পারে ফেলুদার চোখ রাঙানি আর আমার চিমটির চোটে তিনি নিজেকে সামলে রেখেছেন।

কীর্তিরাম ছোটুরামের পানের দোকানের সামনে থামতে হঠাৎ আবার বেসামালভাবে হেসে উঠলেন লালমোহনবাবু!

কী হল মশাই, ফেলুদা বলল, আপনাকে রাঁচি পাঠাতে হবে নাকি? এত বড় একটা ঘটনা আপনার হাস্যকর বলে মনে হচ্ছে?

আরে দুর মশাই, লালমোহনবাবু কোনও রকমে হাসি থামিয়ে বললেন, কী হয়েছে সে তো জানেন না। রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের তেষট্টি নম্বর বই—রিক্ত-হীরক রহস্য বাই জটায়ু—সেদিন দেখলুম। রুকুর তাকে। হিরো একটা হিরে লুকিয়ে রাখছে। হাঁ-করা এক কুমিরের স্ট্যাচুর মুখের মধ্যে—ভিলেন যাতে না পায়। ভাবতে পারেন, আমারই লেখা বই আর আমিই কিনা ফেল মেরে গেলুম, আর ফেলুমিত্তির হয়ে গেলেন হিরো!

ফেলুদা কিছুক্ষণ লালমোহনবাবুর দিকে চেয়ে রইল। তারপর বলল, আপনি ভুল করছেন। লালমোহনবাবু। তার চেয়ে বরং বলুন আপনি আপনার কলমের জোরে এমন একটি রহস্য ফেদেছেন যে বাস্তবে তার সামনে পড়ে ফেলু মিত্তিরের গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেবার উপক্রম হয়েছিল। কাজেই আপনিই বা হিরো কম কীসে?

সাত রকম মশলাওয়ালা তবক দেওয়া পানটা চার আঙুলের ঠেলা দিয়ে মুখে পুরে লালমোহনবাবু বললেন, যা বলেছেন মশাই—জটায়ুর জবাব নেই।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12
Pages ( 12 of 12 ): « পূর্ববর্তী1 ... 1011 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *