হারুর ভাগ্য
হারাধন ধাড়া বারো বছর বয়সে এ বাড়িতে কাজে এসে ঢুকে ছিল। এখন তার বয়স কুড়ি। হারাধনের ডাক নাম হারু।
হারু বলল, মালিক অনেকদিন হলো আমি এখানে কাজ করছি। প্রায় আট বছর হয়ে গেল। মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। কাল রাতে মাকে স্বপ্ন দেখছি। আমি এবার বাড়ি যাব। আপনি আমার পাওনা-গন্ডা বুঝিয়ে দিলে ভাল হয়।
নিবারণ বাবু শুনে বললেন, হ্যাঁ তুমি আমার খুব বিশ্বস্ত ও অনুগত কাজের লোক। তোমার পাওনা মিটিয়ে দেব। তুমি কবে যাবে?
– আজই মালিক
নিবারণ বাবু বললেন, আজই?
– হ্যাঁ, মালিক
– আচ্ছা, দাঁড়াও দেখছি বলে তিনি নিজের ঘরে ঢুকলেন। তারপর হাতে কিছু কাগজের নোট কয়েন নিয়ে ফিরে এসে বললেন, হারু ঘরে তো এখন এর বেশি নগদ কিছু নেই, এখানে দু’একশো টাকার মতো হবে। এটা দিয়ে যাতায়াত আর হাত খরচ চালিয়ো। আর এই রূপোর বাটগুলি নিয়ে যাও, দোকানে বেচে অনেক টাকাস পাবে।
হারু খুশি হয়ে বলল, আচ্ছা মালিক। সে কাঁধের
গামছা মেঝেতে ফেলে, রূপোর বাটগুলি সেখানে রেখে ভাল করে বাঁধল। তারপর সেটা কাঁধে ফেলে, খুচরো কয়েন আর কাগজের নোটগুলি সাবধানে ট্যাকে গুঁজে, মালিককে বিদায় জানিয়ে সে সকাল সকাল বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়ল।
অনেকটা পথ যেতে হবে তাকে। তাই সে অলসভাবে ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করল। এক পা এক পা করে এইভাবে যখন সে হাঁটছিল, তার চোখে অনেককিছু পড়ছিল। সে দেখল দূর থেকে একজন লোক ঘোড়ায় চড়ে এদিকে আসছে। ঘোড়াটাকে দেখে সে মনে মনে ভাবল। ইশ্ আমার যদি এমন সুন্দর একটা ঘোড়া থাকত। তাহলে, এতটা কাঁকুড়ে পাথুরে পথ আমায় হাঁটতে হত না। লোকটা ঘোড়ায় চড়ে কাছে আসতেই। হারু হাত দেখিয়ে লোকটাকে দাঁড় করালো। দাঁড় করিয়ে বলল, ঈশ্ আপনার ঘোড়াটা কী সুন্দর। বলে হারু ঘোড়াটার রোমশ লেজে হাত বুলিয়ে একটা শিহরণ অনুভব করল। তারপর বলল, আমার যদি এমন সুন্দর একটা ঘোড়া থাকত।
শুনে লোকটা বলল, তুমি আমাকে কি দেবে, যদি আমার এই ঘোড়াটা তোমাকে আমি দিই?
হারু তখন কাঁধের গামছাবাঁধা পোটলাটা দেখিয়ে বলল, এখানে অনেকগুলি রূপোরবাট আছে। এগুলি আমি ঘোড়াটার বদলে তোমাকে দিতে পারি।
– বেশ দেখি, কেমন রূপোরবাট ?
হারু গামছার বাঁধন খুলে, রূপোরবাটগুলি তাকে দেখাল। লোকটা দেখেই বলল, এগুলি তুমি কোথা থেকে চুরি করে এনেছো?
– মাইরি বলছি, আমি চুরি করব কেন? আমি মালিকের বাড়িতে আট বছর কাজ করেছি, তার বিনিময়ে মালিক আমাকে এগুলি দিয়েছেন। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। মালিকের নাম নিবারণ শেঠ। থাকেন বেনেপুকুর শেঠবাগানে।
হারুর কথা বলার ভঙ্গি এবং তার চোখ মুখের ভাব দেখে তিনি বুঝতে পারলেন, হারু মিথ্যে কথা বলছে না।
তাই তিনি বললেন, ঠিক আছে। তোমার ওগুলি তুমি গামছায় বেঁধে দাও ভাল করে। আর আমার ঘোড়াটা তুমি নিয়ে যাও।
হারু তার কথা শুনে ভীষণ খুশি হল। আর মনে মনে ভাবল, আমার মতো এতো ভাগ্যবান কেউ আর নেই।
ঘোড়া-অলা ঘোড়া থেকে নীচে নেমে দাঁড়াল।
হারুকে ঘোড়ায় চড়ে বসতে সাহায্য করল। তার দু’হাতে ঘোড়ার লাগাম ধরিয়ে দিল হারুর হাতে। আর বলল, ঘোড়াকে যদি দ্রুত চালাতে চাও তবে মুখে – ‘ছোট্ ছোট্’ আওয়াজ করবে। বলে লোকটা গামছায় বাঁধা পোটলাটা কাঁধে তুলে নিল।
হারু তাকে ‘বিদায় বন্ধু’ জানিয়ে ঘোড়া চালাতে শুরু করল। ধীরে ধীরে ঘোড়া চালাতে চালাতে, চারপাশ দেখতে দেখতে তার মনটা ভরে যাচ্ছিল।
আর মনে মনে সে ভাবছিল, আমি কত ভাগ্যবান মানুষ। এই ঘোড়াটার মালিক আমি। সম্পূর্ণ ঘোড়াটা আমার। আমি এটায় চড়ে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে পারি। ভেবেই তার মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল।
এতক্ষণ ঘোড়াটা শ্লথ গতিতে হেঁটে হেঁটে বেশ সহজ সাবলীল যাচ্ছিল।
মন চঞ্চল হয়ে ওঠার ফলে, তার মনে হল, ‘ছোট্ ছোট্’ আওয়াজ করলে ঘোড়াটা কত দ্রুত ছোটে, তা একবার পরীক্ষা করে দেখলে মন্দ হয় না। একবার পরখ করে দেখাই যাক তবে। এই ভেবে হারু ‘ছোট্ ছোট্’ আওয়াজ করে উঠল মুখে।
ঘোড়াটা দ্রুত গতিতে ছুটতে শুরু করল। অনেক কষ্টে কিছুটা টাল সমলাতে পারলেও, শেষপর্যন্ত টাল সামলাতে না পেরে, হারু রুক্ষ পাথুরে মাটিতে ছিটকে পড়ে গেল ঘোড়া থেকে। ঘোড়াটা তাকে ফেলে রেখে সামনে এগিয়ে গেল। উল্টো দিক থেকে একজন চাষী একটা গরু নিয়ে মাঠ থেকে ফিরছিল। সে লাফিয়ে পড়ে, ঘোড়ার টাগাম টেনে ধরে ঘোড়াটাকে থামাল। মাটিতে পড়ে গিয়ে হারুর বুকে চোট লেগেছে। হাঁটুর চামড়া ছড়ে গেছে। হাতের কনুইয়ে জোর ব্যথা লেগেছে। হারু তবু কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়ে, খোঁড়াতে খোঁড়াতে লোকটার দিকে গেল। তারপর মনে মনে ভাবল, আমার দুষ্ট ঘোড়াটাকে নিয়ে, তার বদলে লোকটার গরুটা আমাকে দিলে, গরুটার দুধ দই খেয়েই আমার চলে যাবে। লোকটার কাছে এসে বলল, আমার এই তেজী ঘোড়াটাকে আমি সমলাতে পারছি না। আপনি যদি এটা নিয়ে এর বদলে আমাকে আপনার গরুটা দেন, তাহলে আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।
লোকটা হারুর কথা শুনে রাজী হয়ে গেল। ঘোড়ার বদলে তার গরুটা চাষী তাকে দিয়ে দিল।
হারু গরুটা পেয়ে খুব খুশি হয়ে, তাকে বিদায় জানাল। আর মনে মনে ভাবল, আমার মতো ভাগ্যবান আর কেউ নেই। আমি যা চাইছি, তাই হচ্ছে। আমার সব ইচ্ছাই পূরণ হচ্ছে।
এদিকে দুপুর হয়ে গেছে। চড় চড় করে রোদ চড়েছে জৈষ্ঠের দুপুরে। আর বাইরে থাকা যায় না। হারু গরুটাকে নিয়ে একটা বড় গাছের তলায় দাঁড়াল। গরমে তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছিল। সে ভাবল গুরুটার থেকে কিছুটা দুধ দুয়িয়ে নিয়ে পান করলে, তার তৃষ্ণা মিটবে। তাই সে গরুটাকে দোয়াবার চেষ্টা করে কোন দুধ পেল না। বরং দ্বিতীয়বার দোয়াবার চেষ্টা করতে যেতেই গরুটা তাকে লাথি মেরে দূরে ছিটকে ফেলে দিল। তাতে কোমড়ে খুব চোট পেল হারু।
কোন মতে দাঁড়িয়ে উঠে সে দেখল, একজন ধোপা একটা গাধার পিঠে কাপড়ের একটা বোচকা ও নিজের পিঠে একটা কাপড়ের বোচকা নিয়ে গাছ তলার এদিকেই আসছে। ধোপাটি কাছে এসে বলল, কি হয়েছে ভাই?
হারু তাকে সব কথা বলল। ধোপা তার সব শুনে আর গরুটাকে দেখে বলল, এ তো একটা বুড়ো গরু। এটা দুধ দেয় কখনও?
হারু তার কথা শুনে মনে মনে ভাবল, তাহলে এই গরুটাকে অযথা বাড়িতে টেনে নিয়ে যাওয়ার কোন মানে হয় না? তার চেয়ে গরুটার বদলে গাধাটা নিয়ে গেলে, তাতে চড়ে বাড়ি ফেরা যাবে। বেশ একটা মজার ব্যাপার হবে, গাধায় চড়ে বাড়ি ফেরা।
হারু মনে মনে এইসব কথা ভেবে বলল,
তোমার গাধাটা ভারি সুন্দর। দাদা একটা কথা বলব?
– হ্যাঁ, বল ভাই।
– আমার গরুটা নিয়ে, তোমার গাধাটা আমায় দেবে দাদা?
ধোপা ভাবল, গাধার চেয়ে গরু বেশি মাল বইতে পারবে। সে তখন তার নিজের পিঠের বোচকাটা নামিয়ে গরুর পিঠে রাখল, আর গাধার পিঠের বোচকাটা তুলে নিয়ে গরুর পিঠে রেখে বলল।
– নাও, গাধাটা তাহলে তুমি নিয়ে যাও ভাই।
হারু খুব খুশি হয়ে গরুটা তাকে দিয়ে, গাধাটা নিয়ে, তারপর তাকে বিদায় জানিয়ে, গাধার পিঠে চড়ে বসল। আর মনে মনে ভাবল, আমার মতো এতে ভাগ্যবান আর কেউ নেই। যা মনে মনে চাইছি, তাই পেয়ে যাচ্ছি।
এইসব ভাবতে ভাবতে হারু কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল, একটা লোক সুন্দর সাদা একটা রাজহাঁস নিয়ে এদিকেই আসছে। সফেদ সুন্দর সাদা রাজহাঁসটা দেখে হারুর ভীষণ পছন্দ হলো।
মনে মনে ভাবল, এমন সুন্দর যদি আমার একটা রাজহাঁস থাকত, তাহলে প্রতিদিন রাজহাঁসের ডিম খাওয়া যেত। সে লোকটাকে দাঁড় করিয়ে বলল, বাঃ কী সুন্দর তোমার রাজহাঁসটা। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তুমি আমার গাধাটার বদলে এই রাজহাঁসটা আমায় দেবে?
লোকটি রাজহাঁসটিকে বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যাচ্ছিল। সে ভেবে দেখল, রাজহাঁসের চেয়ে গাধার দাম বাজারে বেশি। তাই সে বলল, কেন নয়? গাধাটা দিয়ে তুমি আমার রাজহাঁসটা নিয়ে যেতে পার।
হারু তাই করল। রাজহাঁসের দু’পায়ে দড়ি বাঁধা ছিল। লোকটাকে গাধাটা দিয়ে, রাজহাঁসটাকে নিজে বগলদাবা করে নিয়ে, মনের আনন্দে বাড়ি ফিরতে লাগল। আর মনে মনে ভাবল,আমি কত ভাগ্যবান। আমার মতো ভাগ্যবান আর কেউই নেই। আমি যা যা মনে মনে চাইছি, অনায়াসে পেয়ে যাচ্ছি।
রাজহাঁস নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় এসে দেখতে পেল, একজন গণৎকার একটা টিয়া পাখি খাঁচায় নিয়ে বসে আছে। আর তার সামনে দু’জন ভাগ্যান্বেষী ভাগ্য গণনা করতে এসেছেন। গণৎকারের সামনে কয়েকটি খাম পড়ে আছে। খামের ভিতর লোকের ভাগ্য লেখা আছে। যে লোক দু’জন তাদের ভাগ্য গণনা করতে এসেছে। গণৎকার টিয়া পাখিটাকে খাঁচা থেকে বের করে দেয়। পাখিটা খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসে নীচে পড়ে থাকা খাম ঠোঁটে তুলে নেয়। গণৎকার তখন টিয়া পাখিটাকে আবার খাঁচায় পুড়ে রেখে, খাঁচার ছিটকিনি আটকে দেয়। গণৎকার তখন টাকার বিনিময়ে খাম খুলে পড়ে ভাগ্য বলে দেয় তাদের। এইসব দেখে শুনে হারু ভাবল, বাঃ এ তো দারুণ ব্যাপার ! এমন ভাগ্যগণক টিয়া পাখি যদি আমার থাকত, তাহলে কী দারুণ মজা হতো। লোকের ভাগ্য গণনা করেই, যা আয় হতো, তাতেই আনন্দে আমাদের দিন চলে যেত। এই ভেবে ভাগ্যান্বেষী লোক দু’টি তাদের ভাগ্য জেনে নিয়ে গণৎকারকে টাকা দিয়ে চলে যেতেই হারু তখন গণৎকারের কাছে গিয়ে বলল, আপনার টিয়াপাখিটা অপূর্ব সুন্দর। এই পাখিটা পেলে আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করব। আপনি কি আমার রাজহাঁসটা নিয়ে, আপনার ওই টিয়া পাখিটা আমায় দিতে পারেন? গণৎকার ভেবে দেখল, সে রাজহাঁসটা বিক্রি করে এমন চারটি টিয়াপাখি কিনতে পারবে। তাই সে হারুর কথায় রাজী হয়ে গেল, হারুর রাজহাঁস নিয়ে, খাঁচা খুলে টিয়াপাখিটা বের করে হারুর হাতে দিয়ে দিল।
হারু তার কাছে খাঁচাটা চাইলে, সে বলল, ওটা দেওয়া যাবে না ভাই। আর একটা টিয়াপাখি এনে আমি ওই খাঁচাটায় রাখব। অগত্যা হারু টিয়া পাখিটা হাতে ধরে নিয়েই মনের আনন্দে বাড়ি ফিরতে লাগল। আর মনে মনে ভাবতে লাগল, আহা আমি কত ভাগ্যবান, তাই এই ভাগ্যগণক টিয়াপাখিটা আমার হাতে পেয়েছি। এবার থেকে টিয়া পাখিটাই সবার ভাগ্য গণনা করে বলে দেবে। আর আমি তার বিনিময়ে অনেক টাকা পেয়ে সব কিছু কিনে ঘরের হাল ফিরিয়ে নেব। এইসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়ে, হারু মনের আনন্দে হাততালি দিতে যেতেই, টিয়া পাখিটা তার হাত থেকে উড়ে গিয়ে, সামনের আম গাছটায় বসল। হারু সেই দিকে বোকার মতো তাকিয়ে রইল। হারুর এই প্রথমবার মনেহল, আমি কী দুর্ভাগা। না হলে, রূপোরবাট দিয়ে ঘোড়া, ঘোড়া দিয়ে গরু, গরু দিয়ে গাধা, গাধা দিয়ে রাজহাঁস, রাজহাঁস দিয়ে গণক টিয়াপাখি। আর সেই টিয়াপাখি এখন আম গাছে বসে আছে। হারু এইসব ভাবতে ভাবতেই টিয়াপাখিটা তখন আবার সেখান দিয়ে উড়ান দিয়ে দূরে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। হারু অবাক হয়ে সেদিকে চেয়ে রইল।