নিঃসঙ্গ ছিলাম আফ্রিকার গণ্ডারের থেকেও; তবু মুহূর্তের জন্যেও
বুঝি নি নিঃসঙ্গ আমি। একলা, সম্পূর্ণ একলা, বান্ধব নিঃসঙ্গতা সঙ্গী ক’রে,
একলা, সম্পূর্ণ একলা, উঠেছি পর্বতে, তুষারচুড়োয়, কাঞ্চনজংঘায়,
নেমেছি ভূতলে, গুহার গহ্বরে; সাঁতার কেটেছি প্রচণ্ড সাগরে, বালুঝড়ে খালি
পায়ে দাউদাউ অগ্নিকুণ্ডের ভেতর দিয়ে পার হয়ে গেছি মরুভূমি।
অতিশয় দরিদ্র ছিলাম, অত্যন্ত নিঃস্ব, বস্ত্র ও গৃহহীন, কপর্দকশূন্য,
বাঙালির থেকেও গরিব; তবু তা-ই ছিলো আমার সম্পদ, সোনা ও মাণিক,
ঝলমল করতো সূর্যালোকে, চন্দ্রালোকে, পূর্ণিমার চাঁদের মতোই
জ্বলতো অরণ্যের চুড়োয় চুড়োয়, এক কণা ধান ছিলো স্বর্ণমুদ্রার থেকেও দীপ্ত
দারিদ্র্য আমার উদ্ধত মস্তকে শোভা পেতো জ্যোতিশ্চক্রের মতো।
অসুস্থ ছিলাম খুব, আক্রান্ত অজস্র রোগে, তীব্র রক্তচাপে কাঁপতো শরীর,
চোখ ভ’রে ছিলো অন্ধকার, কানে বধিরতা, ফুসফুস জুড়ে ছিলো
শূন্যতা, হয়তো কর্কটও বাসা বাঁধছিলো কোনো কোষে; তবে তাই ছিলো
আমার সুস্থতা, আমার অজর স্বাস্থ্য; আমার অপূর্ব অসুস্থতা রক্ত হয়ে
প্রচণ্ড বন্যার মতো প্রচণ্ড গতিতে বইতো রক্তনালিতে,
হৃৎপিণ্ড কখনোই ক্লান্ত হতো না।
তুমি, স্পর্শমণি, রক্তপদ্ম, স্বপ্নলোক থেকে এসে যখন আমাকে দিলে
পরম সুন্দর সঙ্গ, আমাকে দ্বিগুণ ক’রে তুললে প্রেমে- আমার অচেনা পদ্ম- আর
তীব্রতম দেহে- আমার অচেনা নদী-, তুমি এসে যেই মুঘলদের
থেকেও আমাকে ধনী ক’রে তুললে একজোড়া ওষ্ঠ আর রক্তপদ্ম দিয়ে,
তুমি এসে যেই আঙুল ছুঁইয়ে আমাকে ক’রে তুললে সুস্থ,
স্বাস্থ্যবান, তার পর থেকে আমি হয়ে উঠলাম প্রকৃত নিঃসঙ্গ, হয়ে
উঠলাম বাঙলার একমাত্র ভিখিরি, হয়ে উঠলাম পৃথিবীর
একমাত্র অচিকিৎস্য রোগী।