তিন নম্বর কোণ
স্বর্ণার ভয়ংকর ফোনটা যখন এল তখন দুপুর দুটো মতন হবে৷ আমি রোজকার মতো অফিসে—এইচ. আর. ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার তুষার পারেখের চেম্বারে বসে কথা বলছি৷ নেক্সট মাসের শুরুতে একটা ইন্টারভিউ অ্যারেঞ্জ করতে হবে—সেটা নিয়েই পারেখের সঙ্গে ‘কবির লড়াই’ চলছিল৷ পারেখ যে-কোনও ইস্যুতেই আরগিউ করে৷ তাই অফিসে ওর নিকনেম আরগিউমেন্ট পারেখ৷
ওর সঙ্গে কথা বলতে-বলতে পকেটের মোবাইল বেজে উঠেছিল৷ ফোন বের করে দেখি স্ক্রিনে স্বর্ণার নাম৷
পারেখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘এক্সকিউজ মি—ওয়াইফ৷ কলটা নিচ্ছি—৷’
কল অ্যাকসেপ্ট করে ‘হ্যালো’ বলামাত্রই ও-প্রান্ত থেকে স্বর্ণমালার ভয় পাওয়া চিৎকার শোনা গেল৷
আমি পাথর হয়ে গেলাম৷
‘রীতেশ! রীতেশ! হেলপ! বাঁচাও! বাড়িতে একটা লোক ঢুকে পড়েছে! শিগগির এসো—!’
ওর কথা মাঝপথেই আচমকা থেমে গেল৷
আমি কয়েক সেকেন্ড হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম৷ মাথাটা পুরো ব্ল্যাঙ্ক হয়ে গিয়েছিল৷ তারপরই ইলেকট্রিক শক খাওয়া পাবলিকের মতো ছিটকে উঠে দাঁড়ালাম৷
পারেখ বড়-বড় চোখ করে আমার দিকে তাকাল: ‘কী হয়েছে, মজুমদার?’
‘হরিবল ক্রাইসিস৷ আমাকে এক্ষুনি বাড়ি যেতে হবে—৷’
পারেখ পুলিশে খবর দেওয়ার কথা বলছিল, কিন্তু ততক্ষণে আমি ওর চেম্বারকে পাঁচ হাত পেছনে ফেলে এসেছি৷
আমার বুকের ভেতরে বিগ ড্রাম বাজছিল: ডুম-ডুম-ডুম৷ সেই অবস্থাতেই ছুটে চললাম লিফটের দিকে৷ ফ্লোরের দু-তিনজন কলিগ যে আমাকে অবাক চোখে দেখছে সেটা চোখের কোণ দিয়ে স্পষ্ট টের পেলাম৷
একতলায় নেমে আবার ছুট রাস্তার দিকে৷
একটা ট্যাক্সিকে বাড়তি ভাড়া কবুল করে কোনওরকমে রাজি করালাম৷ তারপর সোজা বাড়ির দিকে৷
ফেরার পথে অন্তত দশবার স্বর্ণার ফোনে ফোন করলাম৷ কোনও সাড়া নেই৷ সুইচড অফ৷
আধঘণ্টা কি পঁয়ত্রিশ মিনিট পর বাড়িতে পৌঁছে গেলাম৷
সদর দরজার কাছে গিয়ে দেখি দরজা বন্ধ৷ কাঁপা হাতে পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুললাম৷ সামনেই ড্রয়িং-ডাইনিং স্পেসের অনেকটা চোখে পড়ছে৷ সেখানে কেউ নেই৷ থাকার কথাও নয়৷ স্বর্ণমালার এখন ভেতরের বেডরুমে ঘুমিয়ে থাকার কথা৷ কিন্তু ফোনের ওই এস. ও. এস. টাইপের চিৎকার…৷
কান পেতে যে-কোনওরকম শব্দ শোনার চেষ্টা করলাম৷ না, কোনও শব্দ নেই৷ সব চুপচাপ৷
সদর দরজা বন্ধ করে দিলাম৷
স্বর্ণা ছাড়া বাড়িতে কি আর কেউ আছে?
উদভ্রান্তের মতো এ-ঘর সে-ঘর খুঁজে বেড়ালাম৷
না, স্বর্ণা কোথাও নেই! কোথায় গেল ও?
এরপর বাকি রইল শুধু দোতলা—মানে, ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি আর ছাদ৷
দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলাম৷
ছ’-সাতটা ধাপ উঠতে না উঠতেই স্বর্ণমালার মোবাইলের দেখা পেলাম৷ ভেঙে চুরচুর৷ ভারী কিছু দিয়ে হ্যান্ডসেটটাকে কেউ প্রবল আক্রোশে থেঁতো করেছে৷ সেইজন্যেই ওর ফোনে আট-দশবার ফোন করে ফোন সুইচড অফ পেয়েছি৷
মোবাইল ফোনের পর স্বর্ণমালাকে দেখতে পেলাম৷ আরও তিন-চার ধাপ ওপরে চিৎ হয়ে পড়ে আছে৷ পা দুটো ছাদের দরজার দিকে, মাথা নীচের দিকে৷ বাদামি আর কালোয় ছাপা ম্যাক্সিটা অনেকটা নেমে এসে মিনিস্কার্ট হয়ে গেছে৷
স্বর্ণমালার মাথাটা একেবারে রক্তারক্তি ব্যাপার৷ খুনি মোবাইল ফোনটার ওপরে নেট প্র্যাকটিস করার পর স্বর্ণার মাথাটা নিয়ে যেন প্রবল আক্রোশে ছক্কা হাঁকিয়েছে৷ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, স্বর্ণা আর বেঁচে নেই৷ তবুও ছড়িয়ে থাকা ডানহাতের কবজি টিপে পালস চেক করলাম৷ কোনও দপদপানি নেই৷ স্বর্ণা আর নেই৷
আমার মুখ দিয়ে একটা চাপা চিৎকার বেরিয়ে এল৷ একইসঙ্গে মাথাটা কেমন টলে উঠল৷ সিঁড়িতে বসে পড়লাম৷ তারপর আর কিছু মনে নেই৷
যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখি আমি সিঁড়ির রেলিঙে হেলান দিয়ে অলসভাবে বসে আছি৷ স্বর্ণমালা ঠিক একইভাবে পড়ে রয়েছে৷ ওর মুখের ওপরে মাছি বসছে৷
আমি কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে ছিলাম কে জানে! একটা ভয়ের ঢেউ আছড়ে পড়ল মাথায়৷ তারপরেই এল শোকের প্লাবন৷
স্বর্ণা আর নেই! ওকে যে আমি পাগলের মতো ভালোবাসতাম! স্বর্ণা! স্বর্ণা!
আমার কান্নাটা বোধহয় বুকের ভেতরে দলা পাকিয়ে গিয়েছিল৷ কারণ, আমার শরীরটা থরথর করে কাঁপলেও মুখ দিয়ে কোনও আওয়াজ বের করতে পারছিলাম না৷ খুব কাছের একজন ভালোবাসার মানুষকে আচমকা হারালে অবস্থাটা বোধহয় এরকমই হয়৷
আমি রেলিং ধরে কোনওরকমে উঠে দাঁড়ালাম৷ এখন বসে থাকলে চলবে না৷ প্রথমে গোটা বাড়িটা ভালো করে একবার খুঁজে দেখা দরকার৷ কে জানে, মার্ডারার হয়তো এখনও পালাতে পারেনি৷ হয়তো বাড়ির ভেতরেই কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে রয়েছে৷
শরীরের কাঁপুনিটা থিতিয়ে আসছিল৷ তার বদলে জায়গা করে নিচ্ছিল রাগ, রাগ এবং রাগ৷ টের পাইনি, কখন যেন মাথার ভেতরে আগুন জ্বলতে শুরু করেছে৷
সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম৷ সতর্ক চোখে এপাশ-ওপাশ দেখতে লাগলাম৷
ড্রয়িং-ডাইনিং স্পেসে কালার টিভির পাশে একটা সুন্দর ছোট্ট টেবিল৷ তার গায়ে বাটালির আলপনা৷ সেই শৌখিন টেবিলটার ওপরে বসানো একটা বড়সড় পেতলের ফুলদানি৷ ফুলদানিতে অনেকগুলো রঙিন ফুল৷ নকল৷
চট করে এগিয়ে গেলাম ফুলদানিটার কাছে৷ রঙিন ফুলগুলো বের করে টেবিলে রেখে দিলাম৷ তারপর ফুলদানিটা ডানহাতে মুগুরের মতো বাগিয়ে ধরলাম৷
টের পেলাম, ফুলদানিটা যথেষ্ট ভারী এবং অস্ত্র হিসেবে মারাত্মক৷ কিন্তু আমার নার্ভের যা দশা তাতে দরকারি মুহূর্তে আমি কি ওটা ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারব?
ওটা হাতে নিয়ে সতর্ক পা ফেলে গোটা বাড়িটা ট্যুর করে ফেললাম৷ খোঁজাখুঁজির সময় খাটের তলা বা আলমারির পেছনও বাদ দিলাম না৷
কিন্তু কোত্থাও কেউ নেই৷
তবে দুটো ব্যাপার লক্ষ করলাম৷ কিন্তু সেদিকে আমি আগে মন দিইনি৷ কারণ, স্বর্ণার খোঁজে আমি পাগল ছিলাম৷ আর…তারপর…ওর খুনির খোঁজে৷
প্রথম ব্যাপারটা হল, আমাদের বেডরুমের আলমারিটা হাট করে খোলা৷ তার কয়েকটা তাকের জিনিসপত্র বেশ ওলটপালট৷ কাছে গিয়ে চেক করতেই বুঝতে পারলাম ক্যাশ পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা আর একটা সোনার চেন উধাও৷
টাকাটা পরশুদিন আমরা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে এনেছিলাম৷ প্ল্যান ছিল, আজ-কালের মধ্যেই আমরা একটা উঁচু মডেলের অটোমেটিক ওয়াশিং মেশিন কিনব৷ কারণ, কাচাকাচির পরিশ্রম আর মেসি ব্যাপারটা স্বর্ণমালা একেবারেই পছন্দ করত না৷
বাকি রইল সোনার চেন৷ ওটা স্বর্ণা সবসময় গলায় পরত, আর মাঝে-মাঝেই খেয়ালখুশি মতো ওটা গলা থেকে খুলে আলমারির বুকসমান তাকটায় ফেলে রাখত৷
আলমারিটায় চাবি দেওয়ার জন্যে বহুবার ওকে বলেছি, কিন্তু স্বর্ণা সে-পরামর্শ কখনও কানে তোলেনি৷ বরং হেসে বলেছে, ‘আলমারির দরজায় চাবি দিয়ে কোনও ফ্যামিলি কখনও চোর-ডাকাতের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে?’
কথাটা সাড়ে ষোলো আনা ঠিক৷
আমি ফুলদানিটা মুঠোয় ধরে আলমারির সামনে পাঁচ-দশ সেকেন্ড ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম৷ স্বর্ণা চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠল৷ আমার চোখে আবার জল এসে গেল৷
নিজেকে সামলে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোলাম৷
রান্নাঘরের সব বাসনপত্র মেঝেতে ছড়ানো৷ ঠিকমতো পা রাখার জায়গা নেই৷ আর মেঝেটা ভিজে৷ কোণের একটা কল অল্প খোলা৷ ক্যাবিনেটের তাকে কাপ-প্লেট সাজানো থাকলেও সেগুলো খুনি ভাঙচুর করেনি৷
এটাই দ্বিতীয় ব্যাপার৷
খুনি কেন এমন পাগলামো করেছে জানি না৷ তবে যাকগে, ওসব পাগলামোর কারণ-টারণ পুলিশ খুঁজে বের করবে৷ সেইসঙ্গে খুনিকেও৷
ফুলদানিটা জায়গা মতো রেখে দিয়ে বাড়ির সদর দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম৷ পুলিশ—পুলিশে খবর দিতে হবে৷ পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করলাম৷ লোকাল থানার নম্বর কত? আমি তো জানি না৷ তা হলে কি ১০০ ডায়াল করব? সেই ফোনটা কোথায় লাগে? লালবাজারে?
আমি কনফিউজড অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ৷
আমার বাড়ির সামনেটায় একটুকরো ফাঁকা জমি৷ সেখানে তিন-চারটে ফুলগাছ৷ স্বর্ণাই ওদের যত্ন করত৷ ওদের খারাপ দিন শুরু হল এখন থেকে৷ সেই সঙ্গে আমারও৷
আমাদের বাড়ির লাগোয়া ব্যানার্জিদের দোতলা বাড়ি৷ রণেন ব্যানার্জি আর মিনতি ব্যানার্জি—দুই বুড়ো-বুড়ি৷ ওঁদের একটাই ছেলে—সায়ন৷ বিয়ে-টিয়ে করেনি৷ বিন্দাস আছে৷ ‘ম্যাগনাম’ নামের একটা এম. এন. সি.-তে চাকরি করে৷
রণেন ব্যানার্জি দিন-রাত দাবা খেলেন—একা-একাই৷ কখনও-কখনও আমাকে ডাকাডাকি করেন৷ আমি বহুবার ওঁর কাছে দাবায় হেরেছি৷ হারতে যে আমার খারাপ লাগে তা নয়৷ তবে হেরে যাওয়ার পরই রণেনবাবু আমাকে দাবা খেলার বিষয়ে আধঘণ্টা কি চল্লিশ মিনিট ‘শর্ট টার্ম কোর্স’ উপহার দেন৷ আমার হাল তখন সুকুমার রায়ের ‘শ্যামাদাস’-এর মতো৷ হাত-পা বাঁধা মুরগি—যার কান দিয়ে ক্রমাগত জ্ঞান ঢুকছে৷
এই সমস্যাটুকু বাদ দিলে রণেন ব্যানার্জি বেশ পরোপকারী ভদ্রলোক৷ ওঁকে ডেকে আমি খারাপ খবরটা জানিয়ে হেলপ চাইতে পারি৷ বয়স্ক মানুষ—নিশ্চয়ই থানা-পুলিশ সম্পর্কে আমার চেয়ে ঢের বেশি খোঁজখবর রাখবেন৷
হঠাৎ দোতলার দিকে চোখ গেল আমার৷ মিনতি ব্যানার্জি দোতলার বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে আছেন৷ ধবধবে সাদা গায়ের রং৷ চুল কাঁচাপাকা৷ চোখ উজ্জ্বল, চকচকে৷ ভদ্রমহিলা ওই চেয়ারে বসে-বসেই অত্যন্ত উঁচুমানের নজরদারি চালান৷ তাছাড়া পাড়ার খোঁজখবরও কিছু কম রাখেন না৷ সব ব্যাপারে নাক গলানো ওঁর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে৷ তাই আমি ওঁর নাম রেখেছি শার্লক হোমস৷ এবং ওঁকে আমি একটু এড়িয়েই চলি৷
কিন্তু এখন, এই বিপদের সময়, ওসব ব্যাপার ভুলে গিয়ে আমি ‘মিসেস ব্যানার্জি—’ বলে চিৎকার করে ডেকে উঠলাম৷
মিনতি চট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে বারান্দার রেলিঙের কাছে চলে এলেন৷ রেলিং ধরে ঝুঁকে পড়লেন আমার দিকেঃ ‘কী হয়েছে? আপনি আজ অফিসে যাননি?’
আমি ওঁকে স্বর্ণমালার কথা বলতে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম৷ আমার শোরগোলে রণেন ব্যানার্জি সদর দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন৷ তারপর একে-একে জড়ো হল আরও পাড়াপড়শি…জনগণ৷
আর একেবারে শেষে হসপিটালের অ্যাম্বুলেন্স এবং পুলিশ৷
এতক্ষণ ধরে যে-কথাগুলো বললাম, সেগুলো পুলিশকে আমি বারবার বলেছি৷ এতবার বলেছি যে, কথাগুলো আমার পরীক্ষার পড়ার মতো মুখস্থ হয়ে গেছে৷ কিন্তু উপায় কী! পুলিশ যতবার জানতে চাইবে ততবারই আমাকে বলতে হবে—বিরক্ত হলে চলবে না৷ পুলিশের ইনভেস্টিগেশানে আমার হান্ড্রেড পারসেন্ট কো-অপারেট করা উচিত৷ কারণ, আমি চাই, স্বর্ণমালার মার্ডারার ধরা পড়ুক৷
সেইজন্যেই আমার মুখোমুখি বসে থাকা প্লেন ড্রেসের ডিটেকটিভ ভদ্রলোক যখন আরও একবার সেই ‘গোল্ডেন স্টোরি’ শুনতে চাইলেন, আমি গড়গড় করে শুনিয়ে দিলাম৷
এই ভদ্রলোক সেই শুরু থেকেই আমার পেছনে পড়ে রয়েছেন৷ স্বর্ণা মারা গেছে প্রায় একমাস পেরিয়ে গেছে৷ পুলিশের ইনভেস্টিগেশান যে-স্পিডে শুরু হয়েছিল সেটা যথেষ্টই থিতিয়ে পড়েছে৷ এই নাছোড়বান্দা বৃদ্ধ ডিটেকটিভটি না থাকলে হয়তো সেই তদন্ত একেবারেই থেমে যেত৷ কিন্তু ইনি এখনও তদন্তের লেজ ধরে রয়েছেন৷ এরকম ঠ্যাঁটা ডিটেকটিভ সত্যি খুব রেয়ার৷
বেশ বুঝতে পারছি, স্বর্ণমালার খুনিকে আর কখনওই ধরা যাবে না, কিন্তু তা সত্ত্বেও এই ভদ্রলোকের মহা ধৈর্য আর নিষ্ঠার তারিফ করতে হয়৷ ওঁকে দেখে বোঝা যায় ‘লেগে থাকা’ কাকে বলে৷
ভদ্রলোকের নাম মোহনলাল পাল৷ বয়েস পঞ্চান্ন থেকে ষাটের মাঝামাঝি কোনও একটা সংখ্যা হবে৷ মোটাসোটা লম্বা চেহারা৷ রং ময়লা৷ চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা৷ তাতে যে বেশ পাওয়ার আছে সেটা বোঝা যায় লেন্সের কৃপায় মোহনলালের বড়-বড় হয়ে যাওয়া চোখ দেখে৷
সেই চোখের ওপরে বেশ ঘন কাঁচা-পাকা ভুরু৷ মাথার চুলও একই ধরনের৷ দু-ভুরুর মাঝে বিরক্তির স্থায়ী ভাঁজ৷ কিন্তু একইসঙ্গে ওঁর মুখে সবসময় একটা হাসি-হাসি ভাব লেগে আছে৷ তাই ঠিক বোঝা যায় না উনি বিরক্ত, না খুশি৷
তবে মোহনলালের চেহারায় সবচেয়ে অ্যাট্রাকটিভ হল ওঁর ঝাঁটা গোঁফ৷ ঠিক যেন একটা শজারু লম্বা হয়ে নাকের নীচে শুয়ে আছে৷
আমার বাড়িতে ড্রয়িং-ডাইনিং স্পেসে আমরা বসেছিলাম৷ আমাদের মাঝে একটা শৌখিন টি-টেবল৷ টেবিলে দু-কাপ চা, আর তার পাশে একটা প্লেটে নোনতা বিস্কুট৷ আমরা মাঝে-মাঝে চায়ে চুমুক দিচ্ছিলাম, আর তার সঙ্গে টুকটাক করে বিস্কুট চলছিল৷
আমি আড়চোখে দেওয়াল-ঘড়ির দিকে তাকালাম৷ চারটে বাজে৷ মোহনলাল এসেছেন তিনটে নাগাদ৷ তবে ওঁর বসার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে না খুব শিগগির গা তুলবেন৷
‘বুঝলেন, রীতেশবাবু…’ চায়ে চুমুক দিলেন মোহনলাল৷ ওঁর গলার কাছটা একটু ফোলা মতন৷ সেখানে বারদুয়েক আঙুল বুলিয়ে বললেন, ‘আপনার ওয়াইফের মার্ডারটা ঠিক যেন একটা পারফেক্ট মার্ডার৷ সুন্দরী তরুণী দিনদুপুরে খুন এবং খুনি হাওয়া—পুলিশ তার নাগাল পাওয়ার কোনও ক্লু-ই পাচ্ছে না৷’ মাথা নাড়লেন আক্ষেপে: ‘অথচ পারফেক্ট মার্ডার বলে কিছু হয় না৷ ওটা পুরোপুরি থিয়োরিটিক্যাল, ইম্যাজিনারি, রুট ওভার মাইনাস ওয়ান—বুঝলেন কি না?’ আমার চোখে তাকিয়ে হাসলেন মোহনলাল৷
আমি আর কী বলব! তাই বোকার মতো একটু হাসলাম৷
শব্দ করে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন মোহনলাল৷ একটু সময় নিলেন৷ তারপর সামান্য হেসে বললেন, ‘রীতেশবাবু, জানি, লাস্ট একমাস ধরে আমি আপনাকে যাকে বলে তিতিবিরক্ত করে চলেছি৷ আমি হলফ করে বলতে পারি, এরকম ঠ্যাঁটা ডিটেকটিভ আপনি আগে কখনও দেখেননি৷ আসলে আমার নেচারটাই এই টাইপের৷ ছোটবেলায় অঙ্ক আটকে গেলে তার পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন লেগে থাকতাম৷ তারপর চাকরি-বাকরি করতে এসেও তাই৷ কেস সলভ করতে না পারলে তার পেছনে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর লেগে থাকি৷ তা আপনার ওয়াইফের কেসটা তো সবে একমাস হয়েছে! একটা ব্যাপার কী জানেন, আমার কোনও তাড়া নেই৷ শুধু অঙ্কটা আমার সলভ করা চাই…৷’
আমার ঘুম পেয়ে যাচ্ছিল৷ আজ শনিবার—ছুটির দিন৷ তার মধ্যে বিনা নোটিশে ভদ্রলোক তিনটের সময় এসে হাজির৷ কী আর করা যাবে! স্বর্ণা চলে যাওয়ার পর যে-দু-একটা রান্না রপ্ত করেছি তার মধ্যে চা একটা৷ তো সেটাই করে ওঁকে আপ্যায়ন করেছি৷ তারপর থেকে চলছে মোহনলালের অ্যাকশান রিপ্লে৷ কতবার যে ওঁর মুখে এসব কথা শুনেছি! ঘুমের আর দোষ কী!
চা-বিস্কুট শেষ করে হাতে তালি দিয়ে হাত ঝাড়লেন ডিটেকটিভ৷ গোঁফে আঙুল ঘষলেন৷ তারপর ছোট্ট করে দু-তিনবার কেশে বলতে শুরু করলেন৷
‘দেখুন, কোনও হাজব্যান্ড মার্ডার হলে প্রাইম সাসপেক্ট হচ্ছে ওয়াইফ৷ আবার উলটোটা হলে, মানে, ওয়াইফ খুন হলে সন্দেহ করার এক নম্বর পাবলিক হল স্বামী৷ আর স্ট্যাটিসটিক্স বলছে, শতকরা চুরানব্বই দশমিক তিন ভাগ ক্ষেত্রে সন্দেহটা সত্যি হয়৷ তা আপনার কেসেও আমরা হেলপলেস৷ যেহেতু আপনার ওয়াইফ মার্ডার হয়েছে তাই—আপনিই হলেন আমাদের প্রাইম সাসপেক্ট…৷’
সে আমি ভালো করেই জানি৷ পুলিশ আমাকে যেভাবে প্রশ্নে-প্রশ্নে হ্যারাস করেছে সে আর বলার নয়৷ মাঝে-মাঝে আমার কান্না পেয়ে গেছে৷ স্বর্ণাকে হারানোর দুঃখের সঙ্গে নুনের ছিটের মতো মিশে গেছে পুলিশের জেরার যন্ত্রণা৷ মাঝে-মাঝে মনে হয়, স্বর্ণা যদি একটা নোট লিখে যেতে পারত যে, ‘রীতেশ আমাকে খুন করেনি,’ তা হলে হয়তো রেহাই পেতাম৷
কিন্তু এসব তো অলীক কল্পনা৷ ইম্যাজিনারি৷ মোহনলালের ভাষায় ‘রুট ওভার মাইনাস ওয়ান’৷
‘পয়েন্ট নাম্বার ওয়ান হল, আপনার ওয়াইফ রীতিমতো সুন্দরী, ইয়ং—তার ওপর ওঁর যৌবন দারুণ ভাইটাল—মানে, মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স…৷’
মোহনলালের কথাগুলো একটু মোটা দাগের শোনালেও তথ্যগুলো সত্যি৷ তবে স্বর্ণমালা ফ্রিজিড—মানে, কামশীতল—ছিল৷ এই তথ্যটা মোহনলাল পাল জানেন না৷ শুধু উনি কেন, আমি ছাড়া আর কেউই জানে না৷ কিন্তু ফ্রিজিড বলে স্বর্ণাকে আমি কিছু কম ভালোবাসতাম না৷ ওকে আমি এখনও প্রতি মুহূর্তে মিস করি৷ স্বর্ণা! আই লাভ ইউ!
‘বিয়ের পর পাঁচটা বছর কাটতে না কাটতেই আপনার ওয়াইফ এরকমভাবে ব্রুটালি মার্ডার হয়ে গেলেন৷ খুব স্যাড৷
‘আচ্ছা, শুরু থেকেই ব্যাপারটা রিকনস্ট্রাক্ট করার চেষ্টা করা যাক…৷’
আবার! আমি ঠান্ডা চায়ে চুমুক দিলাম৷ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুকের খাঁচা থেকে৷ কতবার যে পুলিশকে এসব কথা বলেছি৷ মোহনলালও বোধহয় কম করে সাড়ে চোদ্দোবার আমার বক্তব্য শুনেছেন৷ কিন্তু উপায় নেই৷ ওঁদের তদন্তের স্বার্থে পুরোনো রেকর্ড বাজাতে হবে৷ তা ছাড়া মোহনলাল তো খোলাখুলি বলেই দিয়েছেন, আমাকে তিনি নাইনটি ফোর পয়েন্ট থ্রি পারসেন্ট সন্দেহ করেন৷ পরিসংখ্যান সে-কথাই বলছে৷ নাকি এই একমাসে শতকরা হিসেবের সংখ্যাটা আরও বেড়ে গেছে?
পেটে কয়েকবার হাত বোলালেন ডিটেকটিভ৷ তারপর বডিটাকে কাত করে যথেষ্ট কসরত করে প্যান্টের পকেট থেকে একটা ডায়েরি আর বলপয়েন্ট পেন বের করলেন৷ ভুরু কুঁচকে ডায়েরির পাতা ওলটাতে লাগলেন৷ পাতা ওলটানোর সুবিধের জন্যে তিনি বারবার জিভে আঙুল ঠেকাচ্ছিলেন৷
ওঁর পুরু কালচে ঠোঁট, দাঁত হলদেটে৷ তার ওপরে এই জঘন্য হ্যাবিট—আমার গা ঘিনঘিন করছিল৷
‘আপনার ওয়াইফের ফোনটা যখন আপনি রিসিভ করেন তখন টাইম কত ছিল?’ ডায়েরির পৃষ্ঠাতে চোখ রেখেই প্রশ্নটা করলেন৷
ঢিলে গলায় জবাব দিলাম, ‘দুটো বাজতে পাঁচ—৷’
‘কারেক্ট৷ আগে নানান সময়ে সাতবার আপনি এই একই টাইম বলেছেন…৷’
‘তা ছাড়া আপনারা তো আমার মোবাইল ফোনের কল রেকর্ডসও চেক করেছেন—’ বিরক্ত হয়ে মন্তব্য করলাম৷
কিন্তু মোহনলাল পাল আমার বিরক্তি গায়ে মাখলেন না৷ ডায়েরির পাতা ওলটাতে-ওলটাতেই বিড়বিড় করে বললেন, ‘ইয়েস—তা চেক করেছি৷ আপনার ওয়াইফের মোবাইল ফোনটা তো থেঁতলে ভজহরি হয়ে গিয়েছিল—তাই সেটা চেক-টেক আর করা যায়নি৷ তবে সার্ভিস প্রোভাইডারের কাছ থেকে আমরা কল রেকর্ডস-এর রিপোর্ট নিয়েছি৷ সত্যিই স্বর্ণমালা ম্যাডাম আপনাকে সেসময় ফোন করেছিলেন৷ আপনি সত্যি কথাই বলছেন৷’ একটু চুপ করে থাকার পরঃ ‘তখন আপনি অফিসে কার চেম্বারে যেন ছিলেন?’
‘এইচ. আর. ম্যানেজার তুষার পারেখের চেম্বারে৷ ওকে জিগ্যেস করলেই ও আমার কথা করোবোরেট করবে৷ আসক হিম…৷’
হাসলেন মোহনলাল, বললেন, ‘হ্যাঁ—হ্যাঁ৷ সে তো জিগ্যেস করেইছি৷ উনি করোবোরেট করেছেন…৷’
‘তবে আবার আমাকে জিগ্যেস করছেন কেন?’
‘মিস্টার মজুমদার, বিরক্ত না হওয়াটা একটা আর্ট৷ আপনি বিরক্ত হলেও আমি বিরক্ত হতে পারি না৷ আমরা একই কথা বারবার জিগ্যেস করি৷ অ্যাকশন রিপ্লে, রিপ্লে, রিপ্লে, অ্যান্ড রিপ্লে৷ দেখবেন, এইসব রিপ্লের ফাঁকফোকর থেকে হঠাৎ-হঠাৎ পিকিউলিয়ার সব ক্লু বেরিয়ে আসে৷ কেঁচোর বদলে সাপ…৷’ শব্দ করে হাসলেন ডিটেকটিভ৷ তারপর আচমকা: ‘তুষার পারেখের চেম্বারে আপনি নিজে থেকে গিয়েছিলেন, নাকি উনি আপনাকে ডেকেছিলেন?’
এ-প্রশ্নটা নতুন৷ আগে শুনিনি৷
আমি একটু চিন্তা করে জবাব দিলাম, ‘আমি নিজে থেকে গিয়েছিলাম৷ একটা ইন্টারভিউ অ্যারেঞ্জ করার ব্যাপারে…৷’
ডায়েরিতে কী যেন লিখে নিলেন মোহনলাল৷ ওঁর মামুলি শার্ট থেকে ঘামের গন্ধ বেরোচ্ছিল৷
ডায়েরির লেখার দিকে গভীর মনোযোগে তাকিয়েছিলেন ডিটেকটিভ৷ সেই অবস্থাতেই বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, ‘আগেই তো আপনাকে বলেছি, আপনি আমাদের প্রাইম সাসপেক্ট৷ আপনাকে সন্দেহ করাটাই আমাদের ব্রত৷ অন্তত থিয়োরি তাই বলছে৷ সুতরাং, আমাদের কাজ হল আপনাকে খুনি ঠাউরে মোটিভ খুঁজে বের করা, খুনটা আপনি কী করে করলেন সেটা গেস করা—তারপর তার সাপোর্টে প্রমাণ-টমান খুঁজে বের করা৷
‘ইয়ং স্বামী বা স্ত্রী খুন হলে আমরা প্রথমেই একটা লাভ ট্র্যাঙ্গেল-এর কথা ভাবি৷ মানে, ত্রিকোণ প্রেম৷ এইরকম প্রেমের একটা কোণ হচ্ছেন স্বর্ণমালা ম্যাডাম, সেকেন্ড কোণটা আপনি৷ আর আমি—মানে, পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে তিন নম্বর কোণটা৷ কোথায় সেই কোণ? কে সেই কোণ?
‘তো আপনার ওয়াইফের মার্ডার কেসটাকেও আমরা লাভ ট্র্যাঙ্গেল-এর অ্যাঙ্গেল থেকে ছানবিন করতে চাইছি…’ কাশলেন মোহনলাল৷ কাশিতে কফের ঘড়ঘড়ে শব্দ হল৷ তারপরঃ ‘তুষার পারেখের চেম্বারে আপনি তা হলে নিজে থেকে গিয়েছিলেন?’
‘বললাম তো, হ্যাঁ—৷’
‘হুঁ—৷’ ডায়েরির পাতা থেকে চোখ তুলে ঘরের সিলিং-এর দিকে তাকালেনঃ ‘এমনটা তো হতেও পারে রীতেশবাবু, আপনি জানতেন ওই স্পেশাল ফোনটা আসবে—তাই একজন উইটনেস রাখতে চেয়েছিলেন৷’
আমি হাঁ করে শজারুর গোঁফওয়ালা ডিটেকটিভ ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে রইলাম৷ লোকটা বলে কী! আমি আগে থেকে জানতাম, স্বর্ণমালা ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ টাইপের কিছু একটা বলে আমাকে ফোন করবে! তার মানে তো আমি আগে থেকেই জানতাম যে, স্বর্ণা খুন হবে!
ওঃ ভগবান! লোকটার মনটা কি জিলিপি দিয়ে তৈরি? তা ছাড়া কী করেই বা এরকম একটা ফোনের কথা কেউ আগে থেকে জানতে পারে?
‘আচ্ছা, মিস্টার পাল, সত্যি করে বলুন তো, এরকম একটা এস. ও. এস. ফোনের কথা কারও পক্ষে কি আগে জানা পসিবল?’
‘ঠিক—ঠিক৷ আন্ডার নরমাল সারকামস্ট্যান্সেস, পসিবল নয়৷ কিন্তু আন্ডার কন্ট্রোলড সিচুয়েশান, ইট ইজ নট ইমপসিবল…৷’
‘তার মানে?’
‘তার মানে, আপনার কোনও অ্যাকমপ্লিস—মানে, ওই তিন নম্বর কোণ—হয়তো ওই ফেক এস. ও. এস. কলটা করেছে৷ এবার সেটা যে আপনার ওয়াইফের গলা নয় সেটা প্রুভ করা খুব টাফ৷ কারণ, মোবাইল ফোনের সার্ভিস প্রোভাইডাররা যে-ভয়েস রেকর্ড পুলিশকে দেয় তাতে অনেক নয়েজ আর ডিসটরশন থাকে৷ ফলে ঠিকঠাক ভয়েস ম্যাচ পাওয়া খুব ডিফিকাল্ট৷ আমরা সার্ভিস প্রোভাইডারের কাছ থেকে ভয়েস রেকর্ড নিই কথাবার্তা শোনার জন্য আর ইনফরমেশন পাওয়ার জন্যে…৷’
লোকটার মুখে সপাটে একটা ঘুসি মারতে ইচ্ছে করছিল আমার৷
মোহনলাল হয়তো প্রচুর গোয়েন্দাগিরি করেছেন, কিন্তু গোয়েন্দা গল্প আমিও তো কিছু কম পড়িনি! সুতরাং কিছুটা তর্কাতর্কি ওঁর সঙ্গে করাই যায়৷ তাই বললাম, ‘একটা কথা জিগ্যেস করছি—প্লিজ, মনে কিছু করবেন না…৷’
‘মনে করব কেন?’ জোরে হেসে উঠে টেবিলে দু’বার আলতো চাপড় মারলেন: ‘করুন কী জিগ্যেস করবেন—৷’
‘স্বর্ণার মোবাইল ফোনটা আমার সেই তিন নম্বর কোণের হাতে গেল কেমন করে? তারপর সেই ফোনটাই থেঁতলানো অবস্থায় দোতলার সিঁড়িতে পাওয়া গেছে৷ এই ব্যাপারগুলো আপনি কীভাবে এক্সপ্লেইন করবেন, মিস্টার পাল?’
ডায়েরির পাতায় চোখ রাখলেন পালবাবু৷ কয়েকটা পাতা এদিক-সেদিক ওলটাতে-ওলটাতে নীচু গলায় বললেন, ‘রাগ করবেন না, রীতেশবাবু, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুব একটা কঠিন নয়…’ মুখ বিকৃত করে হঠাৎই ডান হাতের তর্জনী দিয়ে দাঁত খোঁচাতে লাগলেন৷ তারপর: ‘তর্কের খাতিরে ধরা যাক, সেদিন অফিসে বেরোনোর সময় আপনি আপনার ওয়াইফের মোবাইলটা হাতসাফাই করলেন৷ তারপর ওটাকে বাড়ির বাইরের ফুলগাছগুলোর আড়ালে বা কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে রেখে অফিসে চলে গেলেন৷ দুটো বাজতে পাঁচে আপনার প্রেমিকা—ধরা যাক, ম্যাডাম এক্স—এখানে চলে এলেন৷ ফোনটা কুড়িয়ে নিয়ে চট করে কাছেই কোথাও সটকে পড়লেন৷ সেখান থেকে এস. ও. এস. কলটা করে ফোনটা আবার লুকিয়ে রেখে গেলেন—আপনার জন্যে৷
‘মোবাইল ফোনটা কোথায়-কোথায় লুকোনো হবে সেটা আপনারা দুজনে আগেই ডিসকাস করে প্ল্যান করে নিয়েছিলেন…৷’
অসহ্য! মাথাটা গরম হয়ে গেল আমার৷ আর চুপ করে থাকা যায় না!
‘একমাস ধরে তদন্তের নাটক করে আপনি কি শেষমেশ আমাকে ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করতে চাইছেন? স্বর্ণার মোবাইল ফোনের উদ্ভট রুট ওভার মাইনাস ওয়ান গল্প শোনাতে এসেছেন আমাকে!’
হাসলেন পালবাবু৷ গোঁফের আড়ালে চাপা হাসি৷ ডায়েরি আর পেন টেবিলে নামিয়ে রেখে আপনমনেই বললেন, ‘উত্তেজনা, রাগ আর বিরক্তি৷ আমাদের তদন্তের তিনটে হেলপলাইন৷ সাসপেক্টরা যখন এই তিনটে ইমোশন শো করে তখন আমাদের তদন্তের অনেক সুবিধে হয়…৷’
কথা বলতে-বলতে ডায়েরিটা টেবিলে রেখে পকেট থেকে বিড়ির প্যাকেট আর লাইটার বের করলেন মোহনলাল৷ প্যাকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে নিয়ে আমার দিকে ইশারা করে জিগ্যেস করলেন, ‘চলবে না কি?’
আমি জানালাম যে, আমি স্মোক করি না৷
‘গুড৷ স্মোক না করাটা খুব ভালো৷ কিন্তু আমরা তো সবসময় খারাপ কাজই করি…’ লাইটার দিয়ে বিড়ি ধরালেন মোহনলাল৷ বিড়ির প্যাকেট এবং রঙিন প্লাস্টিকের লাইটারটাকে আবার পকেটে ফেরত পাঠালেন৷
চোখ বুজে বিড়িতে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন৷
বিড়ির গন্ধ আমার কাছে অসহ্য৷ কিন্তু অসহ্য অনেক কিছুই তো এতক্ষণ ধরে সহ্য করছি!
‘রীতেশবাবু, লাস্ট একমাস ধরে আমরা যা তদন্ত করার করে নিয়েছি৷ আমরা এখনও আপনার ওয়াইফের মার্ডারারকে অ্যারেস্ট করতে পারিনি৷ খুঁজেই পাইনি তো অ্যারেস্ট! এ জন্যে আপনি কয়েকশোবার আমাদের কাছে রাগ-টাগ দেখিয়েছেন৷ তার উত্তরে আমরা মিনমিন করে দায়সারা কিছু জবাব দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারিনি৷ বলতে পারেন, অফিশিয়ালি আমাদের কেস ক্লোজড—মানে, প্রায় ক্লোজড৷ আমি কিন্তু আজ আপনার সঙ্গে আন-অফিশিয়ালি দেখা করতে এসেছি৷ না, আপনাকে ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করতে আসিনি৷ শুধু আমার কতকগুলো আইডিয়ার কথা শোনাতে এসেছি৷ আইডিয়াগুলো রুট ওভার মাইনাস ওয়ান টাইপের হতে পারে…৷’
‘আপনি এগজ্যাক্টলি কী চান বলুন তো?’
ওঁর বিড়ির ধোঁয়ায় আমার গা গুলোচ্ছিল৷
গোঁফে কয়েকবার আলতো করে আঙুল বোলালেন৷ তারপর গোঁফটার এদিক-ওদিক আঙুল দিয়ে চাপলেন৷ যেন গোঁফটা নকল—চেপেচুপে ঠিকঠাক করে না বসালে এখুনি খুলে যাবে৷
‘কিছুই চাই না—শুধু কতকগুলো আইডিয়ার কথা শোনাতে এসেছি৷ যেমন ধরুন, বাড়িতে ঢুকে মার্ডারার আপনার ওয়াইফকে মার্ডার করার পর সম্ভবত সেই ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্ট দিয়েই আপনার ওয়াইফের মোবাইলটাকে থেঁতলে চুরচুর করে দিয়েছে৷
‘যদি মার্ডারার টাকাপয়সা গয়নাগাটি লুঠ করার জন্যেই বাড়িতে ঢুকে থাকে তাহলে আপনার বউয়ের মোবাইলটাকে সে খামোখা থেঁতো করতে যাবে কেন? এই কোশ্চেনটার উত্তর আমরা খুঁজে পাইনি৷
‘আবার মার্ডারার যদি স্বর্ণমালা ম্যাডামের চেনা কেউ হন—মানে, ধরুন, আপনি—তা হলেও তো ওই কোশ্চেনটার কোনও উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না৷ কারণ, মোবাইল থেঁতো করলেই তো আর কল রেকর্ডস উধাও হয়ে যাবে না!
‘তাহলে মোবাইলটা স্ম্যাশ করার কারণ কী হতে পারে?’ হাসলেন মোহনলাল পাল৷ চাপা খুকখুক শব্দ হল৷ তারপর গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘কারণটা হল, একটা পাজল তৈরি করে পুলিশকে মিসগাইড করা৷ আর…আর…মোবাইলটা ফুলগাছের আড়ালে বা অন্য কোথাও লুকিয়ে রাখার জন্যে যদি সেটার গায়ে ধুলো-মাটির কণা লেগে-টেগে থাকে সেসব যেন থেঁতলানো মোবাইলের ফোরেনসিক টেস্টে ট্রেস না করা যায়৷ তো সত্যি-সত্যিই আমরা সেরকম কোনও ট্রেস পাইনি৷’ মোহনলাল বিড়িতে ঘন-ঘন টান দিলেন৷
আমি মুখটা শক্ত করে চুপচাপ বসে রইলাম৷ স্বপ্নেও ভাবিনি যে, স্বর্ণা খুন হওয়ার একমাস পরেও আমি এভাবে হ্যারাসড হতে পারি৷ মোহনলাল লোকটার দেখছি সৌজন্য, সঙ্কোচ, ভদ্রতা, লাজ, লজ্জা কিছুই নেই!
‘এবারে আসা যাক আপনার এ-বাড়ির সদর দরজার ব্যাপারটায়…৷ এ-ব্যাপারে তেমন কোনও মিস্ট্রি নেই, কারণ, আপনি তদন্তের শুরুতেই আমাদের বলেছিলেন, খুনের ঘটনার মাসখানেক আগে আপনার সদর দরজার একটা চাবি হারিয়ে গিয়েছিল৷ অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সেটা পাননি বলে শেষ পর্যন্ত আপনি চাবিওয়ালা ডেকে একটা ডুপ্লিকেট চাবি তৈরি করান৷
‘প্রথমে আপনি আমাদের এ-বিষয়ে কিছু বলেননি৷ ইন ফ্যাক্ট চাবিওয়ালা ডেকে চাবি তৈরির ব্যাপারটা আমরা প্রথম জানতে পারি আপনার পাশের বাড়ির মিসেস মিনতি ব্যানার্জির কাছ থেকে৷ তারপর তো ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে যা-যা কোশ্চেন করার সেসব আমরা আপনাকে করেছি৷ আপনি অনেস্টলি সেসব কোশ্চেনের উত্তর আমাদের দিয়েছেন৷ আমরা…৷’
মোহনলাল আরও যেসব কথা বলছিলেন সেগুলো আমার মাথায় ঢুকছিল না৷ শার্লক হোমস মিসেস ব্যানার্জির কথা ভাবছিলাম৷ ভদ্রমহিলার মতো এত দায়িত্ববান এবং একনিষ্ঠ নোজি পার্কার সত্যিই রেয়ার৷ আসলে চাবি তৈরির ব্যাপারটা প্রায় মাসখানেকের পুরোনো ছিল বলে আমার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল৷ তা ছাড়া স্বর্ণমালার আচমকা খুন হওয়া! ওফ, আমার দুনিয়াটা পুরো টপসি-টারভি হয়ে গিয়েছিল৷ এখনও সেটা মাঝে-মাঝে টাল খাচ্ছে৷ মোহনলাল পাল সেসব জ্বালা-যন্ত্রণার কী বুঝবেন! আমার মনে হল, এই ছোটলোকটা বোধহয় কখনও যুবক ছিল না৷ আর থাকলেও কখনও কাউকে ভালোবাসেনি৷
ওঃ, চাবি হারানোর ব্যাপারটা নিয়ে মোহনলাল অ্যান্ড কোম্পানি আমাকে কম জ্বালিয়েছে!
স্বর্ণমালা একটা ছোট সফটওয়্যার কোম্পানিতে পার্টটাইম চাকরি করত৷ তাই আমাদের দুজনের কাছেই একটা করে চাবি থাকত৷ হারিয়ে গিয়েছিল ওর চাবিটাই৷ তখন আমি দরজার লকটা পালটানোর কথা বলেছিলাম, কিন্তু স্বর্ণা অত খরচ আর ঝঞ্ঝাট করতে রাজি হয়নি৷ তখন বলতে গেলে ওর চাপেই আমি চাবিওয়ালা ডেকে ডুপ্লিকেট চাবি তৈরির ব্যবস্থা করি৷ কিন্তু আমি কল্পনাও করিনি, সেই হারানো চাবি কোন জটিল প্রসেসে স্বর্ণার মার্ডারারের হাতে গিয়ে পড়বে, আর স্বর্ণার এরকম সর্বনাশ হবে৷ সেইসঙ্গে আমারও৷
মোহনলাল বিড়ি শেষ করে টুকরোটা নির্বিকারভাবে মেঝেতে ফেলে পা দিয়ে ঘষে দিলেন৷ তারপর ধীরে-ধীরে বললেন, ‘এবার ধরুন, মিস্টার মজুমদার, ওই চাবি- এপিসোডটা পুরোপুরি আপনার ম্যানিপুলেট করা…৷’
‘কী বলছেন আপনি?’ চেয়ার ছেড়ে এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে পড়েছি আমি, ‘চাবি হারানোর ব্যাপারটা আমার কারসাজি? নাটকবাজি? আপনি এই মুহূর্তে রাস্তা মাপুন—দয়া করে বেরিয়ে যান—এক্ষুনি!’
মোহনলাল বাচ্চা ছেলের মতো হেসে ফেললেন৷ বললেন, ‘আরে বসুন, বসুন, রীতেশবাবু৷ আপনাকে আলাদা করে আর বলা হয়নি যে, আমি খুব ঠ্যাঁটা টাইপের ডিটেকটিভ৷ অত সহজে আমি রাস্তা মাপি না৷ তা ছাড়া, আমি তো বলিনি, আপনি চাবি-এপিসোডটা ম্যানিপুলেট করেছেন৷ আমি বলেছি ‘‘ধরুন’’—মানে, মনে করুন৷ তাতেই এত চটে যাচ্ছেন কেন? এরকম চটে গেলে আপনার ওপরে সন্দেহ তো আরও বাড়বে…৷’
আমি একটা বড় শ্বাস ফেললাম৷ মোহনলাল কি আমাকে লেজে খেলাচ্ছেন? আমার ওপরে এইরকম মেন্টাল টরচার আর কতদিন চলবে?
চেয়ারে বসে পড়লাম আবার৷ এ কী বিরক্তিকর ইঁদুর-বেড়াল খেলা! যদি ওরা মনে করে আমিই মার্ডারার তা হলে আর দেরি কীসের! আমাকে বিচারের নাটক করে যাবজ্জীবনে ঢুকিয়ে দিক কিংবা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিক৷ এই লাইফ আর ভালো লাগছে না৷
ডায়েরিটা টেবিল থেকে হাতে তুলে নিলেন আবার৷ পাতা ওলটাতে লাগলেন৷ তারপর চোখ তুলে আমার দিকে তাকালেন: ‘চাবির ব্যাপারটা আপনি গোড়াতে আমাদের বলেননি৷ ইচ্ছে করেই বলেননি৷ আপনি চাইছিলেন আমরা খোঁজখবর করে ব্যাপারটা উৎঘাটন করি৷ তা হলে আপনাদের হারানো চাবি হাতিয়ে নিয়ে খুনি আপনার বাড়িতে ঢুকেছে এই থিয়োরিটা আমরাই তৈরি করে আপনার প্লেটে সার্ভ করব…৷’
‘মিস্টার পাল, এবারে আপনি আসুন৷ আমার শরীর বা মনের অবস্থা ভালো নয়৷ আমার মাথাটা অসম্ভব ব্যথা করছে৷ ভুরুর ওপরটা দপদপ করছে৷ সত্যিই আমি আর নিতে পারছি না…৷’
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন মোহনলাল৷ তারপর বেশ নরম গলায় বললেন, ‘রীতেশবাবু, প্রায় একমাস ধরে আমরা আপনার ওয়াইফের মার্ডারের তদন্ত-টদন্ত করেছি, কিন্তু সেরকম কিছু করে উঠতে পারিনি৷ আর, জুতসই কোনও প্রমাণ-টমানও পাইনি৷ আপনি প্রাইম সাসপেক্ট হলেও আমরা আপনার এগেইনস্টে কোনও স্টেপ নিতে পারিনি৷ তা ছাড়া, আমরা কীভাবে তদন্ত করেছি, কী-কী সন্দেহ করেছি, কী-কী থিয়োরি অ্যাপ্লাই করে মার্ডারটাকে রিকনস্ট্রাক্ট করেছি সেসব কিছুই আপনাকে বলিনি৷ আপনাকে সেসব খোলাখুলি বলব বলেই আজ আমার এই আন-অফিশিয়াল ভিজিট৷ সেজন্যেই এত মন খুলে আজ আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারছি৷ আপনি মনে কিছু করবেন না—৷’
যাক, শজারুটার বিবেক-টিবেক আছে তা হলে!
‘এবারে ধরুন, আপনাদের হারানো চাবি দিয়ে দরজা খুলে খুনি আপনার বাড়িতে ঢুকল৷ তার মোটিভ ছিল টাকাপয়সা সোনা-টোনা হাতানো৷ কিন্তু আপনার স্ত্রীকে দেখতে পেয়েই সে আর সময় নষ্ট করেনি৷ একটা ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্ট স্ট্রেট আপনার ওয়াইফের মাথায় বসিয়ে দিয়েছে৷ এই ধরনের ইনস্ট্রুমেন্ট বা ওয়েপন খুনিরা সঙ্গে নিয়ে ঘোরে না৷ ভিকটিমের বাড়িতে ঢুকে এমার্জেন্সি সিচুয়েশানে হাতের কাছে যেটাই পায়—যেমন ধরুন, টিভির পাশে ওই যে পেতলের ফুলদানিটা—’ আঙুল তুলে ফুলদানিটা পয়েন্ট করলেন মোহনলাল: ‘সেটা নিয়েই অ্যাটাক করে৷ কিন্তু আপনার ওয়াইফের মার্ডার ওয়েপনটা আমরা আজ পর্যন্ত ট্রেস করতে পারিনি৷ তা ছাড়া, আরও একটা প্রবলেম আমরা ফেস করেছি৷ সেটা হল…৷
‘সেটা হল, আপনার ওয়াইফের বডি পাওয়া গেছে দোতলায়, মানে, ছাদে যাওয়ার সিঁড়িতে৷ বাড়িতে ঢোকার সদর দরজা থেকে ওই জায়গাটা অনেকটা দূরে৷ তার মানে, মার্ডারারকে নোটিশ করার পর আপনার ওয়াইফ চিৎকার-চেঁচামেচি করবার প্রচুর সময় পেয়েছিলেন৷ তা হলে তিনি ‘‘রীতেশ! রীতেশ! হেলপ! বাঁচাও! বাড়িতে একটা লোক ঢুকে পড়েছে! শিগগির এসো—!’’ শুধু এইটুকু কথা বলে থামবেন কেন? তা ছাড়া আপনার কাছে এই হেলপ চাওয়ার ব্যাপারটা একটু পিকিউলিয়ারও বটে৷ এ-কথা আমরা আগেও আপনাকে বলেছি৷ ওইরকম একটা এমার্জেন্সির সময় আপনি অফিস থেকে ছুট্টে এসে বউকে হেলপ করবেন এটা কি একটু রুট ওভার মাইনাস ওয়ান টাইপের প্রত্যাশা নয়? বরং আপনার ওয়াইফ চিল-চিৎকার করে পাশের বাড়ির লোককে ডাকতে পারতেন…৷’
‘দেখুন, স্বর্ণা কেন ওইভাবে চিৎকার করে হেলপ চেয়েছে তা তো আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়—৷’
‘হ্যাঁ, এ-কথাই আপনি বারবার বলে এসেছেন৷ সত্যিই তো, আপনি কেমন করে জানবেন৷ কিন্তু ব্যাপারটা আমাদের—মানে, আমাকে খুব ভাবিয়েছে৷ একইসঙ্গে ভাবিয়েছে ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্টের ব্যাপারটা৷ আপনার ওয়াইফের স্কাল যেভাবে চুরমার হয়ে গেছে তাতে এটা শিয়োর যে, ওয়েপনটা খুব হেভি টাইপের৷ বডির পোস্টমর্টেম যিনি করেছেন সেই ডক্টর এবং ফোরেনসিক এক্সপার্টরা এ-ব্যাপারে একমত হয়েছেন৷ আপনার এই বাড়ি তন্নতন্ন করে সার্চ করে আমরা মাত্র দুটো হেভি টাইপের ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্ট পেয়েছি…৷’ মোহনলাল একটু থামলেন৷ ডায়েরিটা টেবিলে রাখলেন৷ মুখ মুছলেন৷ গোঁফে বারকয়েক চাপ দিলেন৷ চোখ থেকে চশমা খুলে নাকের গোড়ায় একটু মাসাজ করলেন৷ তারপর চশমাটা চোখে দিয়ে মুখ খুললেন, ‘হ্যাঁ—দুটো৷ একটা ওই ফ্লাওয়ার ভাস—আর দু-নম্বরটা হল আপনাদের রান্না করার প্রেশার কুকার৷ তিন লিটারের—হেভি মেটাল বেস…৷’
এসব কথা আমি প্রথম শুনছি৷
আমি কল্পনায় দেখতে পেলাম, খুনি ফুলদানিটা বাগিয়ে ধরে সেটার পেছনটা পাশবিক শক্তিতে বসিয়ে দিচ্ছে স্বর্ণার মাথায়৷ স্বর্ণা চিৎকার করার সময়টুকুও পেল না৷
তারপরই ফুটে উঠল দ্বিতীয় দৃশ্যটাঃ ব্যাপারটা প্রথম দৃশ্যের মতোই, তবে এবারের অস্ত্রটা প্রেশার কুকার—খুনি তার হাতলটা শক্ত মুঠোয় ধরে রয়েছে৷
‘আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, মার্ডার সিন ইনস্পেকশন করার সময় আমরা দেখেছিলাম, রান্নাঘরে বাসনপত্রগুলো—মানে, মেটালের বাসন-পত্রগুলো সব মেঝেতে ছড়ানো, আর মেঝেটা ভিজে৷ বাসনগুলোর গায়েও জল-টল লেগে ছিল৷ ওইসব বাসনের মধ্যে প্রেশার কুকারটাও ছিল৷ কুকারটা ল্যাবে পরীক্ষা করে দুটো জিনিস পাওয়া গেছে: ইন্টারেস্টিং জিনিস৷ এক, কুকারের তলাটা টোল খাওয়া—মানে একটু বসে গেছে—যেটা আপনি বলেছেন, কীভাবে কোথায় যেন গুঁতো খেয়ে ওই ডেন্টটা অনেক আগেই হয়েছিল৷ আর সেকেন্ড পয়েন্টটা হচ্ছে, কুকারের গায়ে সাবানের ফাইন পার্টিকলস পাওয়া গেছে৷ যেটা ইন্ডিকেট করছে, কুকারটা সেদিন সাবান দিয়ে ধোওয়া হয়েছিল৷’
আমি ধৈর্য ধরে মোহনলাল পালের কথা শুনছিলাম৷ এসব কথার উত্তরে কীই-বা বলব! খুনি কেন কী করেছে সেসব খুনিই জানে৷ আমি শুধু ভাবছিলাম, এই বিরক্তিকর শজারুটা কখন আমার বাড়ি থেকে বেরোবে৷
ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লেন মোহনলাল৷ ডায়েরিটা টেবিল থেকে আবার তুলে নিয়ে পাতা ওলটাতে শুরু করলেন৷ কয়েক সেকেন্ড পর থেমে-থেমে নীচু গলায় বললেন, ‘এত সব পয়েন্ট ছানবিন করে ক্রাইমটা বারবার থিয়োরিটিক্যালি রিকনস্ট্রাকট করে আমাদের স্ট্রংলি মনে হয়েছে এটা ইনসাইড জব৷ কারণ, অনেক ফাঁকফোকর খুঁজে পাচ্ছি—অনেক প্রশ্ন উঠছে৷ যেমন, বাইরের কোনও লোকের পক্ষে রান্নাঘর থেকে প্রেশার কুকারটা নিয়ে এসে ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করাটা খুবই অস্বাভাবিক এবং হাস্যকর৷ কিন্তু কী করব, আমাদের হাতে কোনও প্রমাণ নেই৷ আমরা শুধু আপনাকে সন্দেহ করতে পারি—ব্যস, এই পর্যন্ত৷ যদি সত্যি-সত্যিই মার্ডারটা আপনি করে থাকেন, রীতেশবাবু, তা হলে সেটা আপনি করেছেন সেদিন দুপুরে অফিস থেকে বাড়িতে আসার পর৷ তারপর খুনিকে খোঁজাখুঁজির নাম করে প্রচুর সময় নষ্ট করেছেন—সবশেষে থানায় খবর দিয়েছেন৷ যাতে খুনের এগজ্যাক্ট টাইমটা ঝাপসা হয়ে যায়…৷’
ডায়েরি বন্ধ করে পকেটে ঢোকালেন ডিটেকটিভ৷ পেটে হাত বোলালেন দু’বার৷ তারপর: ‘আমার হিসেব মতো এই খুনের ধাঁধায় একটা তিন নম্বর কোণ থাকার কথা…কিন্তু ব্যাড লাক, সেটাই খুঁজে পেলাম না৷ যদি খুঁজে পেতাম তা হলে এই কেসটা আর পারফেক্ট মার্ডারের চেহারা নিতে পারত না…৷’ উঠে দাঁড়ালেন মোহনলাল৷
যাক বাবা, ওঁর জ্ঞানের কচকচি শেষ হয়েছে তা হালে!
ইস, যদি সত্যিই একটা তিন নম্বর কোণ থাকত আমার! ধরা যাক, ওর নাম রোজালি—যার সারা শরীরে যৌবন মাখামাখি৷ যাকে শুধু চোখে দেখেই একটা পুরুষ জেগে ওঠে৷ যে স্বর্ণমালার মতো কামশীতল নয়, বরং উষ্ণকাম—উঁহু, তপ্তকাম৷ যার সঙ্গে বিছানায় হুড়োহুড়ি দাপাদাপির পর সব পুরুষই তপ্তকাম থেকে তৃপ্তকাম৷ যার কথা মনে পড়লেই শরীর আঁকুপাঁকু করে৷
সদর দরজা খুলে আমরা বাড়ির বাইরে এলাম৷
মোহনলাল আচমকা জিগ্যেস করলেন, ‘হারানো চাবিটা খুঁজে পেয়েছেন?’
আমি অবাক হয়ে ডিটেকটিভের দিকে তাকালাম৷ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ঠান্ডা গলায় বললাম, ‘না, পাইনি—পেলে সঙ্গে-সঙ্গে আপনাদের জানাতাম…৷’
হাসলেন মোহনলাল৷
আর ঠিক তখনই পাশের বাড়ির দরজা খুলে মিসেস ব্যানার্জি বেরিয়ে এলেন৷ হাতে নীল রঙের একটা প্লাস্টিকের বালতি আর মগ৷ রোজ সন্ধের মুখে উনি তুলসীমঞ্চে জল দিতে আসেন৷ তুলসীমঞ্চের পাশে খানিকটা ফাঁকা জমিতে কয়েকটা ফুলগাছ রয়েছে৷ তুলসী গাছের পর সেই গাছগুলোর গোড়াতেও জল দেন৷
আমার বাড়ি আর ওঁদের বাড়ির মাঝে খাটো পাঁচিল৷ তাই আমাকে দেখতে পেয়েই একগাল হাসলেন৷ তখনই বোঝা গেল মিসেস ব্যানার্জি এককালে যথেষ্ট সুন্দরী ছিলেন৷
‘রীতেশ, কেমন আছ এখন? তোমাকে তো দেখতেই পাই না—৷’
ভদ্রমহিলা মাঝে-মাঝে বড় ভাট বকেন৷ গায়ে পড়ে পাড়ার এর-তার গল্প শুরু করে দেন৷ মোহনলাল পালের সামনে উনি আবার কী বলতে কী বলবেন এই ভেবে আমি ওঁকে কাটাতে চাইলাম৷ বললাম, ‘আছি একরকম৷ মন-টন ভালো নেই…৷’
‘কী করে ভালো থাকবে! তোমার ওপর দিয়ে যে-ঝড়টা গেল…৷’ মিসেস ব্যানার্জি এরপর মোহনলালের দিকে তাকালেন৷ ওঁকে বিলক্ষণ চিনতে পারলেন৷ হেসে বললেন, ‘আপনি ভালো আছেন?’
মোহনলাল সৌজন্যের হাসি হাসলেনঃ ‘চলে যাচ্ছে, মিসেস ব্যানার্জি৷ আপনারা ভালো আছেন তো?’
শেষ প্রশ্নটা যেন শুনতেই পেলেন না মিনতি৷ নিজের কথা বলে চললেন৷
‘আপনি আবার এসেছেন—তদন্তের কাজ কি মেটেনি না কি? মার্ডারারকে ধরতে পারলেন?’ মিসেস ব্যানার্জির কপালে ভাঁজ, চোখে কৌতূহল৷
এই নাকগলানে বুড়ির প্রশ্নমালা শুনে আমার বিরক্ত লাগছিল৷
বালতি আর মগ হাতে নিয়েই বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে চলে এলেন৷ আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, রীতেশ, তুমি সেই মেয়েটার কথা পুলিশকে বলেছিলে তো?’
‘কোন মেয়েটার কথা বলছেন বলুন তো?’
‘ওই যে…যে-মেয়েটার কথা আমি ওঁদের একজন কনস্টেবলকে রিপোর্ট করেছিলাম—বড়কর্তাদের আর বলা হয়নি৷ ওই কনস্টেবলটা একটু মাতব্বর টাইপের ছিল—সাহেবদের বলেছে কি বলেনি৷ সেজন্যে তোমাকেও তো বলেছিলাম—মনে নেই?’
মোহনলাল ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন৷
আমি এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লামঃ ‘আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না, মিসেস ব্যানার্জি…৷’
‘মনে পড়ছে না?’ হাতের বালতি আর মগ তড়িঘড়ি মেঝেতে নামিয়ে চোখ একেবারে কপালে তুললেন: ‘সেই যে, তোমার বউয়ের মার্ডারের দিন দুপুরবেলা একটা মেয়ে আমাদের বাড়ির ওপাশটায় মল্লিকদের ফাঁকা জমিটায় দাঁড়িয়ে ফোন করছিল৷ আমি তখন খাওয়াদাওয়া সেরে ওইদিকের জানলার কাছে দাঁড়িয়েছিলাম…’ মোহনলালের দিকে তাকিয়ে একটু দুষ্টুমির হাসি হেসে বললেন, ‘জানেন তো, স্যার, আমার সব ব্যাপারে ইন্টারেস্ট৷ রোজ দুপুরে একটা ছেলে আর মেয়ে ওই জমিতে একটা গাছতলায় প্রেম করতে আসে৷ তার মধ্যে মাঝে-মাঝে অ্যাডাল্ট সিনও থাকে৷ সেদিন ওরা আসার আগেই এই মেয়েটা এল৷ দারুণ দেখতে৷ ডাঁসা চেহারা৷ কাকে যেন ফোন করছিল৷ মেয়েটা ফোনে বলছিল, ‘‘রীতেশ! রীতেশ! হেলপ! বাঁচাও! বাড়িতে একটা লোক ঢুকে পড়েছে! শিগগির এসো—!’’ রীতেশকে আমি এই পিকিউলিয়ার ব্যাপারটা বলেছিলাম৷ কিন্তু ও ঝড়ঝাপটা আর টেনশানে সেসব আপনাদের বলতে ভুলে গেছে…৷’
মোহনলালের দিকে চোখ গেল আমার৷
তিনি তখন আমারই দিকে তাকিয়ে৷ মিটিমিটি হাসছেন৷
যেন বলতে চাইছেন, পারফেক্ট মার্ডার বলে কিছু হয় না৷ ওটা পুরোপুরি থিওরিটিক্যাল৷ ইম্যাজিনারি৷ রুট ওভার মাইনাস ওয়ান…৷