পর্ব – ১
০১.
মিনি বাসের জানলা দিয়ে দৃশ্যটা দেখতে পেলেন ভবদেব। অবিশ্বাস্য মনে হল। নীরা এ সময় এখানে কী করতে আসবে? দৃষ্টির ক্ষমতাকে বাড়াবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু ভবদেব নামের বিস্ময়াবিষ্ট ভদ্রলোকটিকে নিরীক্ষণ করে দেখবার জন্যে বাস তো আর ঢিমে চাল ধরবে না।
বিশেষ করে মিনিবাস। ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যাবার জন্যে যেন সর্বদা লডুয়ে মনোভাব নিয়েই কারবার চালায়।
একবার ভাবলেন বাস থামিয়ে নেমে পড়ে দেখবেন না কি? ভেবে লজ্জা পেলেন। চোখের ভুলও তো হতে পারে! খামোকা নেমে পড়ে আবার একটা বাস পাওয়া তো খুব সহজ নয়। ভাবতে ভয় করে।
হাঁটাপথের সীমার মধ্যে বরং ভবদেব অনেক স্বস্তিবোধ করেন। দূরের ব্যাপার হলেই যেন হৃৎকম্প হয়। বাস-ট্রাম শব্দ দুটোই ভয়াবহ।
বন্দনা বলেন, এটা তোমার বাড়াবাড়ি! আজন্ম তো বাসে ট্রামে চড়েই পয়লট্ট করেছ। এই তেরো চোদ্দটা বছর না হয় গাড়ির সুখ জুটেছিল। তাও তো নিজের গাড়ি নয়, কোম্পানির দাক্ষিণ্যের। এতেই এত অব্যেস খারাপ হয়ে গেল?
বন্দনার ধিক্কারে তিক্ততা না থাক, টক ঝালের স্বাদ থাকে।
শান্তিপ্রিয় ভবদেব বাদ-প্রতিবাদ করেন না। না হলে বললে বলতে পারেন, তেরো-চোদ্দ বছর আগে আমার বয়েসটা ছিল তেরো-চোদ্দ বছর কম, আর শহরের রাস্তা আর তার যানবাহন এতটা নারকীয় ছিল না। বলেন না। কথা বাড়াতে ভালবাসেন না ভবদেব। যদিও বন্দনা তেমন কিছু ঝগড়াটে মেয়ে নয়।
সত্যি, আগের সেই দিনগুলি ছিল বড় আরামের। যখন অফিস থেকে যাতায়াতের জন্যে গাড়ির ব্যবস্থা ছিল। দিনগুলো ছিল শুধু আরামেরই নয়, যেন বেশ গৌরবেরও।
ভবদেবের এই পুরনো পাড়ায় শরিকি বাড়ির ধারে কাছে, কারুরই এ গৌরব ছিল না। বড় ছাপোষা পরিবেশ। কাজেই প্রতিদিন ঘড়ির কাঁটা ধরে যখন ভবদেবের বাড়ির সামনে চকচকে ঝকঝকে গাড়িখানা এসে দাঁড়াত, আর সুটে বুটে ভবদেব সেন নিঃশব্দে গেট খুলে বেরিয়ে আসতেন, তখন ভারী একটা আত্মস্থ আর চাপা গর্বিত ভাব ফুটে উঠত তাঁর ভঙ্গিতে। কাজের ছেলেটা ব্রিফকেসটা নিয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকত।
গাড়ির দরজার কাছে এসে হ্যাংলার মতো নিজে হ্যাঁন্ডেলে পাক দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করতেন না ভবদেব, দাঁড়াতেন কয়েক সেকেন্ড। অবশ্য মাত্র কয়েক সেকেন্ডই, ততক্ষণেই ড্রাইভার এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিত, ভবদেব দেবুর হাত থেকে ব্রিফকেসটা নিয়ে ধীর শান্ত ভঙ্গিতেই গাড়িতে উঠে বসতেন।
কিন্তু সেই সুখ সূর্য অস্ত গেছে।
সেই স্মৃতিও ক্রমশ বিগত কথা হয়ে আসছে।
পুরুষের জীবনে অবসর গ্রহণ, নারী জীবনে বৈধব্যেরই সমতুল্য।
তেমনি একটা নিরালম্ব গভীর শূন্যতা সৃষ্টি হয় অন্তরলোকে। আর এটা হয় বেশির ভাগই কর্মজীবনে বিশেষ পদস্থ ব্যক্তিদের।
যাক–
সব শূন্যতাই আস্তে আস্তে অন্য বাতাসে ভরে ওঠে। ভবদেব এতদিন যেদিকে খুব একটা তাকিয়ে দেখেননি, এখন মাঝে মাঝে সে সব দিক দেখেন-টেখেন। সেই বাবদই আজ গিয়েছিলেন শেয়ালদায় ছোট ভায়রাভাইয়ের বাড়ি। ভায়রাভাইয়ের কনট্রাক্টরির ব্যবসা। নতুন বাড়ি যত করুক না করুক, পুরনো বাড়ি মেরামতি, আর কেনা-বেচার দালালিই প্রধান। ভবদেবের পুরনো পৈতৃক বাড়ির ছাদে জল বসে বসে বাড়ি জখম করে আনছে, বন্দনা কদিনই বলছেন, সুকুমারকে একটা খবর দিলে হয়! পাড়ার ঠিকে মিস্ত্রিদের যা অহংকার, ডাকলে আসে না। এলেও কথাবার্তা কয়ে এস্টিমেট-ফেট দিয়েও হাওয়া হয়ে যায়। সুকুমার তবু দেখেশুনে করে দিতে পারে।
খবর দেবার কথাই বলেছিলেন, ভবদেব নিজে যাবেন এমন দুঃসাহসিক প্রস্তাব করেননি বন্দনা। কিন্তু বিনা খাটুনিতে যোগাযোগের প্রধান বাহন টেলিফোন তো এখন টেবিলে ফুলদানির শামিল, আর ছেলেরা কেউ যাবে এমন কথাও ভাবা যায় না। অতএব ভবদেব হঠাৎ বললেন, যাই আমিই একটু ঘুরে আসি।
.
০২.
শালি আর ভায়রাভাইদুজনেই অবশ্য এ আবির্ভাবে বিগলিত হল। সুকুমার বারবার বলতে লাগল, আপনি নিজে কষ্ট করে এলেন কেন দাদা? একটু হুকুম করলেই চলে যেতাম।
চন্দনা চোখ পাকিয়ে বলল, থাক, আর মেঠো সৌজন্য করতে হবে না। কতই যেন যাও। হুকুমটা করবেন কী উপায়ে? মাসখানেক ধরে তো টেলিফোন খারাপ করে রেখেছ?
আমি খারাপ করে রেখেছি?
তা প্রায় তাই। উঠেপড়ে লেগে তাগাদা দিলে এতদিনে কেবল-ফল্ট সেরে যেত।
আমার দ্বারা অত তাগাদা-ফাগাদা হয় না। যেটা ন্যায্য প্রাপ্য, সেটার জন্যে পায়ে ধরাধরি!
অসহ্য! চন্দনা বলল, আজকের এই নতুন পৃথিবীতে অসহ্য নিয়েই তো কারবার। কোনটা অসহ্য নয়? মহাকাশযান থেকে আলোকগতিতে খবর এসে যাচ্ছে, অথচ দিল্লি থেকে কলকাতায় একটা টেলিগ্রাম আসতে তিন দিন লাগে, অথবা তার বেশি। লোক্যাল চিঠিপত্তর পৌঁছতে পাঁচ-সাত দিনও লাগতে পারে। আদৌ না পৌঁছতেও পারে। কোনটা সহ্য যোগ্য?
এই হল আরম্ভ, আপনার এই শালিটির দাদা, বর্তমান পৃথিবী নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। যতই বলি আমাদের এই দেশটাই পৃথিবীর প্রতীক নয়, এটা একটা অক্ষমতার নমুনা মাত্র, তা কে মানছে! কিন্তু দেখুন এক হিসেবে আমাদের বেশ কিছু সুবিধেও এনে দিয়েছে, তাই নয় কি? কী বলুন দাদা!
ভবদেব অবাক হয়ে তাকালেন, সুবিধেটা কী?
সুকুমার হেসে উঠল, নয়? সমাজজীবনে আমাদের কত ত্রুটি মাপ হয়ে যাচ্ছে ওই সব অক্ষমতার জন্যে। খুব উচিত কর্তব্যগুলো ঠিকমতো না করেও এই সব অক্ষমতা অব্যবস্থার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে সাফাই হওয়া যায়। কী আশ্চর্য! চিঠি পাননি? আমি তো সেই তখুনি চিঠি দিয়েছি। উঃ ডাক বিভাগের যা অবস্থা হয়েছে ভাই। হ্যাঁ শুনেছি বইকী খবরটা, কিন্তু তারপর আর যোগাযোগ করতে পারলাম কই? টেলিফোনের যা হাল হয়েছে আজকাল, আর বলবেন না। আরে তোমার বাড়ি যাব বলে দু-তিন দিন চেষ্টা করেছি। কী বলব ভাই, যানবাহনের যা অবস্থা! তার ওপর সন্ধে হতেই তো লোডশেডিং! হা হা হা! সুবিধে নয়?
ঝড়ের বেগে কথা কয় সুকুমার, প্রায় মিনিবাসের মতোই গতি ওর বাক্য-প্রয়োগের।
চন্দনা রেগে বলল, হ্যাঁ, তোমাদের মতো ফাঁকিবাজদের সুবিধে বটে! এই যেমন টেলিফোন কোম্পানির ফাঁকিবাজ কর্মচারীরা। আসবেও না দেখবেও না, কেল ফক্ট বলে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে নেবে।
ভবদেব হাসলেন।
সারাদিন তোমরা দুজনে কহাজার কথা বলো?
সুকুমার বলল, হাজার দিয়ে কি আর গোনা যাবে দাদা? তা কী আর করা, এই একটা ব্যাপার, যাতে পয়সা খরচ করতে হয় না। বিনা পয়সায় আনন্দ কেনা যায়। শুধু আমরা কেন দাদা, দেশ রাজ্য জুড়ে দেখে যান না? আপনার মতো আর কজন? কিন্তু চন্দনা, কেবল কথাই বলে চলেছ যে, দাদার জন্যে একটু চা-টা
চন্দনা জিভ কাটল।
ইস! জামাইবাবুকে দেখে এত খুশি লাগল।
ছুটে চলে গেল।
ভবদেব বললেন, থাক, থাক, এই তো চা খেয়ে এসেছি, বোসো না—
শুনল না অবশ্য।
ভবদেব সুকুমারের দিকে তাকিয়ে হাসলেন, তা বেশ ভালই আছ, কেমন?
সুকুমার ঘাড়টা চুলকে নিয়ে লাজুক হাসি হাসল, একটা বড় অভাবের ভার যা হোক করে কমিয়ে রাখা এই আর কি!
ভবদেব চুপ করে গেলেন।
চন্দনাদের ছেলেমেয়ে হয়নি।
প্রথম প্রথম বোধহয় চেষ্টা-চরিত্র করেছিল কিছু বন্দনার মুখে যেন শুনেছেন মাঝে মাঝে ডাক্তার, অপারেশান, মাদুলি কবচ, দৈব,কত কী সব যেন।
আর শোনেন না।
তার মানে মেনে নিয়েছে শেষ পর্যন্ত।
কই, কী হল তোমার?
তাড়া লাগাতে গেল সুকুমার। লোকটা বেজায় ছটফটে।
ভবদেব এই খালি ঘরটার দিকে এখন তাকিয়ে দেখলেন। সব কিছু ছবির মতো সাজানো। ফ্ল্যাটটাও যেমন সুন্দর ছবির মতো, সাজসজ্জাও তেমনি। যেন যেখানে যা সাজে তার নমুনা। বাহুল্যের ভারে ভারাক্রান্ত নয়। মনে মনে একটু হাসলেন ভবদেব, যা কিছু বলা বাহুল্য বাকবিন্যাসে।
আর একবার ভাবলেন অগোছালো করে দেবার তো কেউ নেই এদের, যেখানে যা রেখেছে আছে। তা ছাড়া বাড়তি বস্তুর বোঝা আমদানি করবে কার জন্যে? নিজের বাড়ির চেহারাটা একবার চোখে ভেসে উঠল ভবদেবের। ভবদেব ভাবপ্রবণ নন, কাজেই এদের অভাবের কথা ভেবে নিশ্বাস ফেলবেন এমন নয়, তবু হঠাৎ একটা অদ্ভুত কথা মনে এসে গেল তাঁর। আচ্ছা, আমাদের তো ছজন ছেলেমেয়ে, বন্দনা তার ছোটবোনকে এত ভালবাসে, ছোটবোনের এই দুঃখটার জন্যে মাঝে মাঝে হা-হুঁতাশও করতে দেখা যায়। কই একথা তো ভাবেনি কখনও, ছজনের থেকে একটিকে না হয় দিয়ে দিই বেচারি চন্দনাকে। ওর নিঃস্বতার দুঃখ ঘুচুক, নাঃ ভাবিনি, কারণ আমরা স্বার্থপর।
হঠাৎ চমকে উঠলেন ভবদেব, কী ভয়ংকর, এ আমি কী ভাবছি? কাকে দিয়ে দিতাম আমরা? খোকাকে? বাপীকে? টিপুকে? রীতাকে? অমৃতাকে? শানুকে?
.
০৩.
চন্দনার হাত থেকে রেহাই পেয়ে ভবদেব যখন চলে আসতে পারলেন, তখন অনেকটা বেলা হয়ে গেছে। রোদ চড়ে উঠেছে।
সুকুমার বাসে তুলে দিয়ে গেল।
তখন বাসটা হালকা ছিল, জানলার ধারটা পেয়ে গিয়েছিলেন, ক্রমেই ভিড় জমছে। শেষতক ঘাড় গুঁজে দাঁড়িয়ে যাবার দল। এদের মধ্যেই একজন বলে উঠল, শহরে এখন স্পন্ডিলাইটিস রোগটা কেন বেড়ে চলেছে বুঝছেন? উঃ কী সুখের রাজ্যেই বাস করছি আমরা!
বাস! সঙ্গে সঙ্গে যেন নদীর বাঁধ ভেঙে গেল।
যেন সবাই সুখরাজ্যের সমালোচনার জন্যে মুখিয়ে ছিল। মুখর হয়ে উঠল, ভরন্ত আর চলন্ত বাসটা। পরিবহণ সংস্থা থেকে পৌর প্রতিষ্ঠান, পৌর প্রতিষ্ঠান থেকে বিদ্যুৎ দপ্তর, বিদ্যুৎ দপ্তর থেকে প্রশাসন বিভাগ, দুর্নীতি, ব্যাঙ্ক ডাকাতি, ট্রেন ডাকাতি, খুন ছিনতাই, প্রশাসকদের নাম করে করে, সমালোচনা থেকে শ্রাদ্ধ কার্য!
চলমান বাসের মধ্যে এরকম উদ্দাম সস্তা রাজনীতি চর্চা ভবদেবকে যেন বিরক্তির শেষ সীমায় ঠেলে দিচ্ছিল। অথচ জানেন, এই বিরক্তির কণিকামাত্রও প্রকাশ করে ফেললে, ওই বাঁধ ভাঙা স্রোতের বেগ সবটা তাঁর ওপরই এসে আছড়ে পড়বে।
ভাগ্যিস জানলার ধারটা পেয়েছিলেন, তাই রক্ষে। সমানেই ঘাড় ঘুরিয়ে জানলার বাইরে চোখ ফেলে বসে ছিলেন। দৃষ্টি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল চলমান দৃশ্যগুলোকে। এই ছুঁয়ে যাওয়ার অবকাশেই হঠাৎ চোখটা যেন স্থির হয়ে গেল; বাসস্টপে দাঁড়িয়ে নীরা! আর? আর নীরার খুব কাছাকাছি ঘনিষ্ঠ ভাবে দাঁড়িয়ে একজন হাত নেড়ে কিছু যেন বোঝাচ্ছে।
চকিতের মধ্যেই দৃশ্যটা দৃষ্টির সীমানার বাইরে চলে গেল। তবু ছবিটা যেন চেতনার মধ্যে আটকে গেল। হাঁ লোকটা বা ছেলেটা ওকে কিছু বোঝাচ্ছে। অথবা কোনও কিছু বিবৃত করছে।
কে ও? ওকে কি কখনও দেখেছি আমি?
আর নীরা এই ভরদুপুরে পার্কসার্কাসের মোড়ে দাঁড়িয়ে কেন? কী জন্যে? এখানে কে আছে নীরার?
একবার ভেবেছিলেন বটে নেমে পড়লে হয়, কিন্তু সে ভাবনাটা অবাস্তবই মনে হল। হয়তো ও নীরা নয়, অন্য মেয়ে। নীরার ধরনের মেয়ে। মেয়েরা তো হয়ও এক ধরনের। অন্তত ভবদেবের তাই মনে হয়।
কিন্তু নীরা ঠিক ওইরকম টকটকে লাল একটা শাড়ি পরে না? যা দেখে ভবদেবের মনে হয় ওর মতো একটা মিষ্টি মেয়ে এরকম চড়া লাল রং গায়ে জড়ায় কী করে?
অথচ সব সময় দেখা যায় যত সব চড়া রং-ই ওর পছন্দ। লালটাই বেশি। যেটা নাকি ভবদেবের চোখকে শূলবিদ্ধ করে। যার জন্যে বন্দনা কখনও খুব চওড়া লালপাড় শাড়ি পরতে পান না।
ভবদেব কি বারণ করেছেন? তা নয়, তবে তাঁর পছন্দ অপছন্দটা তো বোঝেন? বন্দনার মতো আর কে বোঝে সেটা? আত্মজরাই কি? বুঝলেও, গুরুত্ব দেয় কি? অথচ বন্দনা চিরজীবন নিঃশব্দে নিরুচ্চারে কত কীই মেনে চলে আসছেন, ভবদেবও জানেন না।
দেখার ভুল ভেবেও দৃশ্যটাকে মন থেকে সরাতে পারছেন না ভবদেব। যদিও বারবারই ভাবতে চেষ্টা করছেন, একই রকমের শাড়ি বাজারে অজস্র থাকতে পারে। আর পরনে একরকম বয়েসের আর গড়নের দুটো মেয়েকে এক বলে ভুল হতেই পারে।
নীরা এ সময় এখানে আসতে যাবে কেন? একটা অচেনা ছেলেই বা আসবে কোথা থেকে?
কিন্তু নীরার বাপের বাড়ির দিকের কজনকেই বা চিনি আমি?
নীরা ভবদেবের পুত্রবধূ।
বছর দুই হল বিয়ে হয়েছে।
.
০৪.
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দারুণ অস্বস্তি অনুভব করছেন বন্দনা। নীরা এখনও চলে আসছে না কেন? ভবদেব ফেরার আগেই তো ফিরলে ভাল হয়। এটুকু বুদ্ধি অন্তত থাকা উচিত একটা বিদুষী মেয়ের। সব ব্যাপারেরই তো একটা সীমারেখা থাকা উচিত, আর সেটা মেনে চলা উচিত।
ভবদেব কি রাগ করবেন? করলে সে রাগ প্রকাশ করবেন? তা অবশ্যই নয়, তবু বন্দনা ঠাকুরকে ডাকছিলেন নীরা যেন তার শ্বশুরের বাড়ি ফেরার আগেই ফিরে আসে। দু মিনিট আগেও। তাতে যেন বন্দনারই মুখ থাকে।
ভবদেব যতদিন পর্যন্ত চাকরিতে ছিলেন বন্দনা অনেকটা নিশ্চিন্ত ছিলেন। কারণ ছেলেমেয়েদের গতিবিধিও তো অনিয়ন্ত্রিতই। তারা কখন কোথায় যায় জানা থাকে না বন্দনার, জানা থাকে না কখন ফিরবে। জিজ্ঞেস করলে রেগে যায়, চড়া-চড়া উত্তর দেয়, তারা হাজতের আটক আসামি কিনা প্রশ্ন করে।
প্রথম দিকের তিনটে তবু তত নয়, খোকা, রীতা আর অমৃতা, এদের জন্যে তত বেগ পেতে হয়নি বন্দনার। এখন বিয়ে-টিয়েও হয়ে গেছে। মেয়ে দুটো তো কোন সুদূরে, মন কেমন করে উঠলে একবার দেখে আসার প্রশ্ন নেই। কৃতী জামাই খুঁজলেই মেয়ে ভারত ছাড়া হবে, এটাই তো রীতি দাঁড়িয়ে গেছে।
বন্দনা ছেলেবেলায় তাঁদের বাড়িতে একটা পুরনো বই দেখেছিলেন, পৃথিবীর ওপিঠ, কার লেখা কী বৃত্তান্ত মনে নেই, তবে মনে আছে মলাটে একটা গ্লোব আঁকা ছিল, এবং তাতে আলো অন্ধকার ফেলে বোঝানো ছিল, আমাদের পরিচিত পৃথিবী ভারতবর্ষের ওপিঠটা হচ্ছে আমেরিকা।
আশ্চর্য। বন্দনার দু-দুটো মেয়েই সেই ওপিঠে গিয়ে পড়েছে, পড়ে আছে। লোকের কাছে বলতে গৌরব কিন্তু মনের কাছে তেমন কোনও মূল্যবোধ নেই। বরং সেখানে যেন একটা গভীর শূন্যতা।
বন্দনার ছেলেরাও যদি কৃতী হতে পারত, হয়তো সেই পৃথিবীর ওপিঠে গিয়েই ভিড় জমাতো। যেমন ঘটেছে বন্দনার সেজ বোনের ব্যাপারে। নন্দনার তিনটে ছেলেমেয়ে, তিনটেই আমেরিকায়। এদিক ওদিক ছড়িয়ে।
একা মেজদি কেন, কতজনারই তো।
বসুধৈব কুটুম্বকং কথাটা এ যুগে খুব সার্থক।
বন্দনার ছেলেরা কৃতী নয়।
বন্দনার বড় ছেলে অবশ্য এখনও মাঝে মাঝে খোঁটা দেয় মেয়েদের বিয়েতে গাদাগুচ্ছের খরচ করে ফেলার জন্যে বাবা তাকে হায়ারস্টাডির জন্যে বিদেশ পাঠাতে পারেনি।…শেষ অবধি বিয়ে-ফিয়ে দিয়ে–
(বিয়ের জন্যে যে তুমি বাছা হেদিয়ে মরছিলে–এ কথা তো বলা যায় না।)
কিন্তু আর কে কৃতী হবে?
বাপী?
যে ছেলেটা চাকরি আবার মানুষে করে? চাকরি থেকে কি উন্নতি হয়? বলে কুড়ি বছর বয়েস থেকে বিজনেস করছে। বাপের কাছে খাটো হয়ে মূলধনের জন্যে এক পয়সাও চাইতে আসেনি, ভগবান জানেন বিনা মূলধনে কীসের বিজনেস করছে সে। ভাবগতিক দেখলে মনে হয় ফাঁপছে, কিন্তু সেটাই বন্দনার কাছে ভীতিকর। হঠাৎ হঠাৎ এমন এক-একটা বিচ্ছিরি মতো লোক বাপীর খোঁজ করতে আসে, বন্দনা ঘাবড়ে যান। এরা কোন সমাজের? কোন শ্রেণীর? বন্দনার ছেলের ধারেকাছে এরা কেন, বন্দনার যে ছেলেটার মুখ সব ভাইবোনেদের থেকে সুকুমার, রং সব থেকে ফরসা, আর হাসিটা সকলের থেকে সুন্দর, সেই ছেলের কাছে? দেবদূতের মতো নির্মল সেই হাসি। ও কেন ওদের সঙ্গে মিশতে যায়? কে জানে কার খপ্পরে পড়ে যাবে।
বন্দনার ছোট মেয়ে শানু, যার রংটা সকলের থেকে নীরস, আর বাচ্চাতুর্য সকলের থেকে সরেস, সে বলে, কী? তোমার মধ্যমপুত্তুর? ওর জন্যে ভেবে মরছ? ও আর কারুর খৰ্পরে পড়তে যাচ্ছে না মা, ওর খপরেই পড়ে বসে আছে সবাই। ওই গুণ্ডা মস্তানরা, যাদের দেখে ভয় পাচ্ছ, ওর সাকরেদ। শুনো কোনওদিন, ওকে সবাই গুরু বলে।
বন্দনা বলে, তুই তো সবজান্তা, তা জানিস তুই বাপী কীসের ব্যবসা করে?
শানু সংক্ষেপে বলে, জানি! এ যুগে যেটা সব থেকে লাভজনক।
ওর কথা শুনে ভয় ভয় করে বন্দনার, বেশি জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় না এমনভাবে কথা বলে কেন ও?
ভয় তো সব সময়ে।
এ যুগে আর কোন মায়ের ভয়ের বাসার মধ্যে বাস নয়?
বারো ক্লাসে পড়া টিপু, তার জন্যেও যেন আজকাল ভয় দেখা দিচ্ছে। অমন হাসিখুশি ছেলে, হঠাৎ কী যে হয়েছে, গুম হয়ে বসে থাকে। ঘরের কোণ থেকে বেরোতে চায় না, সকলের সঙ্গে খেতে বসতে আসে না, ছলছুতোয় দেরি করে পরে আসে। ঘাড় গুঁজে খেয়ে চলে যায়।
বয়ঃসন্ধি? তা বলে এরকম হবে কেন? বয়ঃসন্ধির বৈলক্ষণ্য কি আর বন্দনার অদেখা? মাঝে মাঝে বড্ড ভাবনা হয়। কতরকমই শোনা যায় আজকাল, খবরের কাগজে কত কী লেখে। তবু চট করে এই সব ভাবনার ভার ভবদেবকে দিতে পারেন না বন্দনা। এমনিতে কথায় যতই দাপট থাকুক, ভিতরে ভিতরে মানুষটাকে ভয় করেন। বিশেষ করে ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে খোলাখুলি হয়ে তাদের নিয়ে এসে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারেন না। যেমন পারে তার দেয়ালের ওপারের খুড়তুতো জা বিভা। তার দেবের চোখের সামনে বিভার হিহি হিহি হানা খাওয়া কাজই হচ্ছে স্বামী কর্ম অন্তে বাড়ি ফিরলেই ছেলেমেয়েদের সারাদিনব্যাপী অপরাধের ফিরিস্তি দাখিল করা। ফলে প্রতিদিনই প্রায় ও বাড়িতে একটি খণ্ডযুদ্ধের ব্যাপার চলে।
সবই শুনতে পাওয়া যায়। কী জানি কেমন করে আবার কিছুক্ষণ পরেই সহজ কথার চাষ হতে থাকে। বাজার দর নিয়ে আক্ষেপ, পাড়াপড়শির সমালোচনা, তার মধ্যে কিছুক্ষণ আগে লাঞ্ছনা খাওয়া ছেলের টেবিল ঠুকে তবলা বাজানো, রেডিয়োর গান আর তার সঙ্গে বিভার হিহি হিহি হাসি।
বন্দনা এরকম ভাবতে পারে না। বন্দনা ভবদেবের চোখের সামনে একখানি মিথ্যার মায়াজাল রচনা করে করে চলে আসছেন। অবশ্য ভবদেবের অন্যমনস্ক প্রকৃতি আর বিশ্বাসী মন এই মায়াজালের সাফল্যের সহায়ক। তবে লোকটা রিটায়ার করা পর্যন্ত এই সাত-আট মাস একটু অসুবিধেয় পড়া গেছে, বেশি তো বেরনো অভ্যাস নেই। এর উপর আবার নতুন সংযোজন নীরা। এ আবার একটা নতুন দায়।
এখনকার মেয়েরা যে বিয়ে হয়ে নতুন একটা বাড়িতে এসে বউমানুষ হয়ে থাকে না। একটা পুরো মানুষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চায়, সে সত্য বন্দনা জানলেও ভবদেবকে যেন জানাতে চান না, মমতাবোধ করেন।
ভবদেব কি গোঁড়া সেকেলে পন্থী?
তা নিশ্চয়, তবু বন্দনা জানেন ভবদেবের মধ্যে অনেকগুলি পুরনো মূল্যবোধ রক্ষিত আছে। তাতে আঘাত পড়লে মর্মাহত হতে পারেন। তাই সাবধানতা।
হয়তো বন্দনার সারাজীবনের এই মায়াজাল রচনার গভীরে কাজ করছে ওই মমতাবোধ!
আপন সন্তানদের দোষ ঢেকে ঢেকে বেড়িয়েছেন তাদের বাপের রোষ থেকে রক্ষা করতে নয়, সেই মানুষটাকে দুঃখ পাওয়া থেকে রক্ষা করতে!
.
০৫.
বন্দনার ঠাকুর বন্দনার প্রার্থনায় কর্ণপাত করলেন না, নীরা আসার আগেই ভবদেব এসে পড়লেন।
ঘনঘনই ঘড়ি দেখছিলেন বন্দনা, সাড়ে বারোটা বেজে গেল দেখলেন, তখন ভবদেব এলেন।
ভবদেব কিছু বলবার আগেই তাড়াতাড়ি বলতে এলেন, কী গো, শালি বুঝি আর ছাড়তে চাইছিল না? আহা সুন্দরী শালি!
কিন্তু ভবদেব এই সরস আবহাওয়া সৃষ্টি করার সুযোগ দিলেন না, আগেই বলে উঠলেন, নীরা কোথায়?
বন্দনা পুত্রবধূকে বউমা বলাই পছন্দ করেন। নিজেও তাই বলেন। প্রথম বিয়ে হয়ে আসার সময় ভবদেবকেও বলেছিলেন, নাম করে তো ডাকা হয় বাসনমাজুনি মেয়েটাকে পর্যন্ত। কিন্তু বউমা ডাকে তুমি যাকে তাকে ডাকতে পারো? ওটা হচ্ছে দামি ডাক।
বলেছিলেন বটে, কিন্তু তথাপি ভবদেব বলেছিলেন, তা হোক, নীরা নামটি বড় সুন্দর। বেশ ঠাণ্ডা স্নিগ্ধ। ডাকতে ভাল লাগবে।
অতএব নীরা! ঘরে বাইরে সবাই তো নামটাই বলে। বন্দনা একাই শুধু ওই দামি ডাকটায় ডাকেন।
প্রথম মুহূর্তেই ভবদেবের এই প্রশ্নে বন্দনা কোনওমতে বললেন, বউমা? সেই তো তখন একটু বেরুচ্ছি বলে কোথায় যেন বেরুল। দেরি হচ্ছে বলে ভাবনা করছি। এদিকে তোমারও দেরি হচ্ছে
আমার কথা একটা ব্যাপার নয়। গিয়েছি সেই শ্যামবাজারে। কোথায় যেন গেল বলছ কেন? তুমি জানো না কোথায় গেল?
অভিযুক্ত বন্দনা এই অভিযোগে বলে উঠতে পারতেন, আমি কী করে জানব, আমায় কি বলে যায় কোথায় যাচ্ছে! সে প্রত্যাশাও করি না। সৌজন্য করে যে যাত্রাকালে একটু বলে যায় তাতেই আমি কৃতার্থ!
কিন্তু বললেন না। উচিত জবাব দেওয়াটা তো অভ্যাস নয় বন্দনার। যা কিছু কথার চাষ মনের মধ্যে।
তাই বললেন, কী জানি ন্যাশনাল লাইব্রেরি না কী একটা বলেছিল বোধহয়। যায় তো।
ন্যাশনাল লাইব্রেরি!
ভবদেব ভাবতে চেষ্টা করলেন, ঢাকুরিয়া থেকে ন্যাশনাল লাইব্রেরি যাতায়াতে কোন সূত্রে পার্ক সার্কাসের মোড়ের বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকতে হতে পারে। তারপর ভাবলেন, যায় তো।
আস্তে বললেন, নীরা কি আবার কিছু পড়াশুনো করছে?
কী করে জানব?
বাঃ, তুমি জানবে না? মাঝে মাঝে যায় বলছ!
বন্দনা পাখার স্পিডটা বাড়িয়ে দিয়ে এলেন, ভবদেবের এখুনি গা থেকে ছাড়া পাঞ্জাবিটাকে হ্যাঁঙারে আটকে ঘরের সামনের বারান্দার দিকের দরজার ছিটকিনিতে ঝুলিয়ে রাখলেন, যায় সেটাই জানি। মুখমানুষের বেশি জানতে যাবার চেষ্টা ভাল নয়।
ভবদেব বন্দনার এই গা ছাড়া কথায় একটু অসন্তুষ্ট হলেন। বললেন, মুখ বলে দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টাও ভাল নয়। বাড়ির গিন্নির এটুকু তো জানা দরকার বাড়ির মেয়ে বউরা কী করছে, কী পড়ছে, কোথায় যেতে হচ্ছে তাদের।
বন্দনা একবার চোখ তুলে তাকালেন।
বোধহয় একটু হেসেই বললেন, কোন যুগে রয়েছ এখনও? খবর রাখো না, এ যুগের অভিধান থেকে কর্তা-গিন্নি শব্দ দুটো বাতিল হয়ে গেছে।
বাঃ চমৎকার। তা হলে এ সংসারে তুমি আমি কে?
কে? সেই শব্দটা বোধহয় এখনও সঠিক আবিষ্কার হয়নি। যাক, রোদে এলে, একটু শরবত খাবে? লেবু রয়েছে, করে দিই?
না থাক। চন্দনা জোর-জবরদস্তি অনেক খাইয়ে দিয়েছে। শুধু ঠাণ্ডা জলই দাও একটু।
বন্দনা জল নিয়ে এলেন।
ভবদেব জলটা হাতে নিয়ে হঠাৎ বলে ফেললেন, পার্ক সার্কাসের মোড়ে নীরার মতো একটি মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম বাস থেকে।
নীরার মতো! ভুরুটা একটু উঠে গেল বন্দনার।
বন্দনা একটু থমকালেন। হাত বাড়িয়ে খালি গ্লাসটাকে নিলেন, ভুরুটা নামিয়ে বললেন, ওখানে বাস চেঞ্জ করতে হয় বুঝি?
না তো! বললে তো ন্যাশনাল লাইব্রেরি?
বন্দনা মুশকিলে পড়লেন, আসলে ওটা তো তাঁর অনুমান মাত্র। যাচ্ছিই বলেছে শুধু, কোথায় যাচ্ছি অবশ্যই নয়। অতএব বলতে হল, কী জানি বাপু, তবে হয়তো গিটার ক্লাসে গেছে। তাও তো যায় সপ্তাহে কদিন যেন।
গিটার ক্লাস!
ভবদেবের মনে পড়ল, বিয়ের সময় শুনেছিলেন যেন বউ গিটার বাজাতে জানে। সেটাতে তিনি তেমন আগ্রহ অনুভব করেননি, এম.এ. পাস, এতেই খুশি ছিলেন।
ভবদেবের একবার মনে হল এ নিয়ে আবারও কিছু জিজ্ঞেস করা যেন জেরার মতো লাগবে, তবুও বলেই ফেললেন, ওঃ। তা সেটা কোথায়?
শানু তো বলে টালিগঞ্জে।
টালিগঞ্জ থেকে ঢাকুরিয়া।
অতএব এখানেও আলো পাওয়া গেল না।
ভবদেব চুপ করে গেলেন।
বন্দনা একটু তাকিয়ে দেখলেন। ভাবলেন, ছেলেমেয়ে বউ, কারুর গতিবিধি সম্পর্কেই তো মনস্ক হতে দেখা যায় না ভবদেবকে, চিরদিনের অন্যমনস্ক আর আত্মস্থগোছের মানুষ, আজই বা হঠাৎ এটা নিয়ে চিন্তিত দেখা যাচ্ছে কেন?
আস্তে বললেন, তুমি হয়তো কাকে না কাকে দেখেছ। এক ধরনের চেহারা।
তা হবে।
রোদে তেতে পুড়ে এলে, খাবার আগে হাত-মুখটা ধুয়ে নেবে তো?
এক্ষুনি খাওয়া হচ্ছে না কি?
এক্ষুনি আর কী করে হবে। বউমা আসুক। এমনি হাতমুখটা ধুতে বলছিলাম।
ভবদেব সকালের শুধু চোখ বুলিয়ে রেখে যাওয়া খবরের কাগজটা হাতে তুলে নিলেন।
খুব বেশি পরে নয়, কিছুক্ষণ পরেই ফিরল নীরা।
এসেই অবশ্য নিজের ঘরে ঢুকে যেত, শানু এসে বলল, মহারানি ফিরলেন।
বন্দনা বললেন, সব সময় অমন ঠেশ দিয়ে কথা বলিস কেন? শুনলে লোকের ভাল লাগে?
এ বাড়িতে কে কার ভাল লাগা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে মা?
এ বাড়িতে! ও! কবে যে তোকেও তোর দিদিদের মতো সাগরপার করে দিতে পারব!…যাকগে, বউমাকে বল ওঁর কাছে একবার যেতে। কী যেন বলছিলেন তখন।
.
০৬.
সুন্দরী মেয়েদের সব অবস্থাতেই ভাল দেখতে লাগে। রূপকথার রূপসীদের মতো হাসলে মানিক, কাঁদলে মুক্তো না হলেও, নীরাও রূপসী। রোদে ঝলসানো চেহারাতেও ভালই দেখাচ্ছিল নীরাকে।
বাবা আমায় ডাকছিলেন?
পরদা সরিয়ে ঘরের মধ্যে চলে এল নীরা–সেই ঝলসানো সুন্দর মুখটা নিয়ে।
ভবদেবের কাগজ পড়া হয়ে গিয়েছিল, তবু হাতে নিয়ে তন্নতন্ন করছিলেন, এখন সেটা চোখের কাছ থেকে নামিয়ে তাকিয়ে দেখলেন। এখনও সাজসজ্জা বদল হয়নি। সুন্দর শান্ত নিরুদ্বিগ্ন মুখ।
স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে আস্তে বললেন ভবদেব, না ডাকিনি ঠিক। দেরি হচ্ছিল, ভাবনা হচ্ছিল। কোথায় গেছ, সেটাও তো তোমার শাশুড়ি বলতে পারলেন না। পার্ক সার্কাসে কিছু কাজ ছিল বুঝি?
পার্ক সার্কাসে!
আকাশ থেকে পড়ল নীরা। পার্ক সার্কাসে কী কাজ থাকবে?
ভবদেব একটু হাসলেন, কী থাকবে সেটা আর আমি কী জানব?…বাসে আসতে আসতে পার্ক সার্কাসের মোড়ের ওখানে বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম মনে হল
ওখানে? বাস স্টপেজে? আমাকে?
নীরা খুব মিষ্টি করে হেসে উঠল, নিশ্চয় আমার মতো বিচ্ছিরি দেখতে আর কোনও একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
কৌতুকটা তেমন কাজে লাগল না, ভবদেবের চোখ সাদা দেয়ালের উপর! যেন সেখানে কিছু একটা দেখতে চেষ্টা করছেন। অন্যমনস্কভাবে বললেন, তাই হবে।
পড়া কাগজটা আবার হাতে তুলে নিলেন।
নীরা কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর ঘুরে দাঁড়াল, স্বগতোক্তির মতো বলল, যাই চানটা করে নিইগে। উঃ যা গরম।
চলে গেল ঘর থেকে। চওড়া সোনালি পাড়ের লাল টকটকে শাড়ির আঁচলটা খবরের কাগজের ফাঁক থেকেও চোখের কোণে ঝলসে উঠল।
.
০৭.
এ সময় ঘরের মধ্যে খুঁজে শুয়ে আছিস যে?
শানু এসে টিপুর লম্বা চুলের মাঝখানটা মুঠোয় চেপে ধরে বলে উঠল, হয়েছে কী তোর?
টিপু ওর হাতটা জোরে ঠেলে দিয়ে বলল, আঃ!
দ্যাখ টিপু, ভাল হবে না বলছি। হাতটা এত জোরে ঠেলে দিলি যে বড়? আর একটু হলে মচকে যেত।
টিপু উত্তর দিল না। ওপাশ ফিরে শুল।
শানু ওর বিছানার ধারে চেপে বসল।
গম্ভীরভাবে বলল, তোর কী হয়েছে বল তো?
টিপু নীরব।
কিন্তু, কেন!
শানু ওকে ঠেলা দিল, এই টিপু, বল বলছি কী হয়েছে তোর? আজ আমি না শুনে ছাড়ব না।
টিপু গোঁজ হয়ে বলল, হবে আবার কী?
হয়েছে নিশ্চয় কিছু, না হলে বলছি কেন?…নিজেই ভেবে দ্যাখ আগের মতো আছিস কিনা। ক্লাবের খেলাফেলা ছেড়ে দিয়েছিস, বাইরে বেরোস না, সব সময় ঘরের মধ্যে গুঁজে বসে থাকিস, এইরকম ছিলি তুই?
ফ্যাচ ফ্যাচ করিস না, যা। আমার শরীর ভাল নেই।
প্রায় ঠেলাই দিল শানুকে টিপু।
অসতর্ক থাকলে হয়তো পড়েই যেত শানু। শক্ত হয়ে বসে আছে, তাই। বলল, শরীর ভাল নেই তো ওষুধ খা? ডাক্তার দেখা? মাকে বলি
এই ছোড়দি ভাল হবে না বলছি। খবরদার কিছু বলতে যাবি না মাকে।
টিপু! এই টিপু! এই লক্ষ্মীছাড়া টিপু! ঘাড় তোল বলছি। তোর সঙ্গে কথা আছে।
আমার সঙ্গে কারুর কোনও কথা নেই!
কেন থাকবে না? তুই কি ত্যাজ্যপুত্তুর হয়েছিস? তোকে যে একবারও পড়তে বসতে দেখি না, তোর এটা পরীক্ষার বছর তা মনে আছে?
পরীক্ষা কে দিচ্ছে?
শানুও মার মতো মনে মনে কথার চাষ করতে শিখছে, তাই শানু মনে মনে বলল, হুঁ, সেটা আমি অনুমান করেই বসে আছি। তবে মুখে যেন আকাশ থেকে পড়ল।
পরীক্ষা দিবি না?
না।
(টিপু তুমি উচ্ছন্নে যেতে বসেছ মনে হচ্ছে)
কেন? পরীক্ষা দিবি না মানে?
পড়া তৈরি হয়নি।
হঠাৎ এমন কী বাধাবিঘ্ন এল যে, পড়া তৈরি হল না?
আঃ! বলছি তো আমার শরীর খারাপ।
শরীর খারাপ! এত খারাপ যে, পড়া তৈরি হয়নি। অথচ ডাক্তার ডাকা যাবে না, ওষুধ খাওয়া হবে না, ব্যাপারটা কী, আমার ভীষণ একটা সন্দেহ হচ্ছে টিপু।
শানু ভেবেছিল টিপু তেড়ে উঠবে।
উঠল না! বালিশটাকে মাথার তলা থেকে টেনে নিয়ে চোখের উপর চাপা দিল।
শানু এবার কড়া গলা ধরল।
বলল, আমার খুব সন্দেহ হচ্ছে, বাজে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে–ড্রাগ-ফাগ খেতে শিখছিস না তো?
এখন হঠাৎ টিপু তার ঝিমোনোর কবর থেকে স্প্রিঙের পুতুলের মতো লাফিয়ে উঠল।
বলল, কে? কে বলেছে এ কথা? শালা পেনো বুঝি?
ছেলেকে এত ঘাঁটাবার সাহস বন্দনার হয় না।
কারণ বন্দনার মানসম্মানের প্রশ্ন আছে।
শানুর সে বালাই নেই, টিপু খিঁচিয়ে উঠলে সেও খিঁচিয়ে উঠবে। টিপু এক ঘা মেরে বসলে, সেও দু ঘা বসিয়ে দিতে পারবে। তাই শানুর সাহস।
শানু বলল, হঠাৎ এরকম মারমুখী হলি যে? এখানে আবার পেনো আসছে কোথা থেকে? আমিই তো বলছি।
টিপু লাল লাল চোখে তাকাল, বলল, বিশ্বাস করি না। শালা রাস্কেল শুয়োর নিজে ইয়ে করে, এখন ভালমানুষ সাজছে।
আবার শুয়ে পড়ল।
শানু গভীর দুঃখের মতো গলায় বলল, তুই এমন মুখ খারাপ করলি টিপু? এ বাড়িতে কখনও এসব কথা উচ্চারণ হয়েছে?…পিনুকে তুই খারাপ গাল দিচ্ছিস! ও তোর দাদা হয় তা জানিস না?
জাহান্নমে যেতে দাও ওই সব কাকা দাদাকে! পেনো একটা হাড়বজ্জাত। ছোটলোক!
শানুর এখন গলার স্বর তীব্র হল। বলল, তবু তো পেনোর চামচা হয়ে ঘুরেছিস এতদিন। তো শুনতে চাই ওর সঙ্গে মিশে নেশা-ফেশা ধরেছিস কিনা।
টিপু আবার উঠে বসল।
কড়া গলায় বলল, যদি ধরেই থাকি, কিছু করতে পারবি?
নাঃ!..করতে আবার কী পারব।
শানু দাঁড়িয়ে উঠল। বলল, করার কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে না। এতটা ভাবিনি। মার জন্যে দুঃখ হচ্ছে।
চলে এল ঘর থেকে। এল রান্নাঘরের দিকে।
আমি জানতাম! আমি জানতাম!
মেয়ের দিকে তাকিয়ে বন্দনা মনে মনে বললেন, আমি প্রস্তুত ছিলাম একদিন এই কথা শুনতে হবে।
কিন্তু মুখে তা বললেন না।
বরং বাতাস দিয়ে মাছি উড়িয়ে দেবার মতো বললেন, তোরও যেমন খোঁচানো স্বভাব। যা তা বলতে গেলি কেন? রাগ করে বলেছে, হ্যাঁ করি নেশা!..শরীর ঠিক নেই সেটাই আসল কথা।
উটপাখির ভূমিকায় আর কতকাল থাকবে মা? ওতেই তো গেলে!
শানু জ্বলন্ত এই মন্তব্যটি করে রান্নাঘরের কাছ থেকে সরে এল।
নিজের উপর বেশ একটা আস্থা ছিল শানুর, ভাবছিল ওই হঠাৎ বদলে যেতে বসা টিপুটাকে ধরে জেরায় জেরবার করে পেড়ে ফেলে শায়েস্তা করে ফেলতে হবে। ভেবেছিল তার কাছে কাজটা এমন কিছু শক্ত হবে না।…যেন দেয়ালের ফাটল থেকে উঁকিমারা দুখানা কচি কোমল অশ্বত্থপাতা হাওয়ায় দুলছে নাচছে, নাচুক, একবার মুঠোয় চেপে ধরে উপড়ে ফেলে দেওয়ার ওয়াস্তা।…কিন্তু এখন হঠাৎ মনে হল, ওই উপড়ে ফেলাটা আর হাতের মুঠোয় নেই, শেকড়টা বোধহয় অনেক গভীরে।
.
০৮.
সুকুমার এল কদিন পরে একেবারে মালমশলা এবং মিস্ত্রি সঙ্গে নিয়ে। ভবদেব তিনতলার ছাদের যেই ঘরখানা খালি করানোর তত্ত্বাবধান করাচ্ছিলেন, যে ঘরটা একদা ভবদেবের বাবা সত্যদেবের অধিকারে ছিল, আর তিনি অধিকার ত্যাগ করে চলে যাবার পর, বাড়ির যত আলতুফালতু বাজে জিনিস এসে অধিকার করে বসে আছে।
এই ঘরের ছাদটাই বেশি খারাপ হয়ে গেছে। এটাই আগে করার দরকার। দোতলার তিনখানা ঘরের মাথা তো এই ঘরটার সামনে খোলা ছাদ হয়ে পড়ে আছে। জায়গায় জায়গায় ফাট ধরেছে দেখা যাচ্ছে। তবু পুরনো কালের জলছবি, কংক্রিটের ঢালাইয়ের মতো, গেল তো গেলই নয়।
ঘর খালি করার ব্যাপারে ভবদেবের চোখ লাগাবার কথা নয়, এসব তো চিরদিন বন্দনারই এলাকা, কিন্তু খালি করতে হবে শুনেই ভবদেবের হঠাৎ মনে পড়ল জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত বাবা ওই ঘরটায় থেকেছেন, শেষের দিকে বেশ কিছুটা কাল তো শুয়েই।…
ভবদেব অফিস যাবার আগে একবার সিঁড়ি ভেঙে এসে বলে যেতেন, বাবা বেরোচ্ছি, আর অফিস থেকে ফিরে চা-টা খাবার পর উঠে এসে বলতেন, আজ কেমন আছেন? ওষুধটষুধ খাচ্ছেন তো ঠিকমতো! খিদে হচ্ছে? ঘুম ভাল হয়?
খুব মামুলি সব প্রশ্ন, যা দীর্ঘদিন ধরে প্রতিদিন উচ্চারিত হতে হতে হৃদয়ের উত্তাপ হারায়। তবু সেই মামুলি কথাগুলোই বলতে হত। নতুন আর কী কথা থাকতে পারত?…তবু সত্যদেব তাতেই বিগলিত হতেন। স্নেহঝরা গলায় বলতেন, তেতেপুড়ে এসেই এক্ষুনি রুগির ঘরে এসে বসা কেন বাবা? যা বিশ্রাম করগে।
বাবাকে দাহ করতে নিয়ে যাবার সময় হঠাৎ সেই স্নেহসিক্ত কথাটা কানে ভেসে উঠেছিল ভবদেবের, মনে হয়েছিল, বাবা কি বুঝতে পারতেন রোগীর ঘরে গিয়ে বসাটা আমার ক্রমশই যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছিল।
অথচ বন্দনার বা ছেলেমেয়েদের ব্যবহারে বাবার সম্বন্ধে গাছাড়া ভাব দেখলেও ক্ষুগ্নও তো হতেন।…মুখে কোনও অভিযোগ না করলেও, মনে হত, বন্দনার তত নিখুঁত সেবার মধ্যে প্রাণের স্পর্শটা তেমন খুঁজে পাওয়া যায় না কেন?
যাক, সে তো অনেকদিনের ব্যাপার হয়ে গেল। ভবদেব ভেবেছিলেন ওই ঘরটায় নিজে একবার গিয়ে দেখে আসবেন বাবার কোনও কিছু বিশেষ প্রিয় জিনিসটিনিস আছে কিনা। বিছানার ধারে সব সময়ই কিছু বই থাকতে দেখেছেন, বইগুলো নামিয়ে এনে যত্ন করে রেখে দেবেন।…কিন্তু করব করব করতে কোন ফাঁকে ভুলেও গেছেন।…
ভবদেবের চোখের আড়ালে কখন ধীরে ধীরে ঘরটা বাজে আবর্জনার ঘর হয়ে উঠেছে।..হবেই। গেরস্তবাড়িতে কোথাও কোনওখানে একটু খালি জায়গা দেখা দিলেই, সেখানে আস্তে আস্তে জমে ওঠে অপ্রয়োজনীয়ের স্তূপ। যা ব্যবহারে লাগে না, অথচ মধ্যবিত্তের ভাবপ্রবণতায় প্রাণ ধরে ফেলে দিতেও পারা যায় না।
ভবদেব সকালে শুনতে পেয়েছিলেন, উপরের ঘরের ওই জঞ্জালগুলো স্রেফ ঝেটিয়ে সাফ করে ফেলাও মা। একটা ভাল ঘর বরবাদ পড়ে আছে।…
কিছুদিন যাবৎ লক্ষ করা যাচ্ছে বাড়ির শোভা সৌন্দর্য, আসবাবপত্র নিয়ে খুব মাথা ঘামাচ্ছে। বাবু।…এটা আনছে, ওটা আনছে, এটাকে বাতিল করে দিতে চাইছে।….
শানু বলে, এটা হচ্ছে নতুন পয়সা হবার মহিমা। পুরনো পরিবেশের সব কিছুই দৃষ্টিশূল হচ্ছে।…
বন্দনা রেগে বলেন, তাতে তোদের কিছু ক্ষতি হচ্ছে? এই যে বসবার ঘরের চেয়ার-ফেয়ারগুলো বদলে, সোফা-সেটটা নিয়ে এল, খারাপ দেখাচ্ছে?
তা নয়। তবে টাকাটা কোন পথ দিয়ে আসছে সেটাই চিন্তা।
বন্দনাও কি চিন্তা করেন না? বিশেষ করে ছেলের বন্ধুদের চেহারা দেখলে।… কিন্তু বন্দনা সত্যিই বোধহয় উটপাখির জীবনদর্শনে বিশ্বাসী।…তা ছাড়া বাবুর ওই দেবদূতের মতো মুখের দেবদুর্লভ হাসিটি! সব ভাবনা চিন্তা উড়ে যায়।…
মাকে বাচ্চা মেয়ের মতো পিঠে ঠুকে আদর করে বলে, ডোন্ট ওয়ারি মাদার, ঘাবড়াও মত্, সব ঠিক হ্যায়।
সকালবেলা ওই ঝেটিয়ে সাফ করা শব্দটা কানে আসতেই ভবদেব ছাদের ঘরে উঠে এসেছেন।
.
০৯.
দেবু সব টানাটানি করছে।
কী আছে আর কী নেই ঘরে।
এই সবের মধ্যে থেকেই ধুলো ঝেড়ে ঝেড়ে কয়েকটা বই সরিয়ে রাখলেন ভবদেব। বিবেকানন্দের কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, মলিন বিবর্ণ মলাট, মলাট ছিঁড়ে যাওয়া একখানা অনুশীলন সমিতির ইতিহাস, বসুমতী সিরিজের দু খণ্ড বঙ্কিম গ্রন্থাবলী, একখানা ভারতসাধক রামমোহন। তার সঙ্গে আরও একটা জিনিস পেলেন, যেটা অপ্রত্যাশিত। ব্রাউন পেপারে মোড়া একখানা হাতে বাঁধাই মোটা খাতা।
খাতাটা যে সত্যদেবের নিজের হাতের বাঁধানো, তা বোঝা যাচ্ছে খাতার মাঝখানের সেলাইটা লাল সুতোর সেলাই দেখে।
সত্যদেবের হাতের লেখা খারাপ ছিল না, তবে সেকালের ছাঁদ, একটু বেশি টানা। শুধু পাতা ওলটালেই বোঝা যাবে না, সময় নিয়ে পড়তে হবে। এত কী লিখতেন বাবা? কোনওদিন তো দেখিনি। ডায়েরি? না ধর্মীয় কোনও ব্যাপার? কী জানি!
ভবদেব দেখলেন একটা কালি শুকনো কাচের দোয়াত, দুটো নিব পরানো কলম। এসব যে এখনও পাওয়া যায় জানতেন না ভবদেব। ফাউন্টেন পেন-এর যুগও তো পার হয়ে গেছে, এখন তো শুধুই ডটপেন-এর যুগ। আশ্চর্য, বাবাকে তো কোনওদিন এ ধরনের জিনিস উপহার দেবার কথা ভাবিওনি।
আসলে বাবা যে লিখতেন কিছু, তাই তো জানা ছিল না। এই তিন-চার বছর পরে নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হচ্ছে।
আস্তে বললেন, এইগুলো নিয়ে গিয়ে আমার ঘরে রেখে আয় তো।
আমার ঘর বলতে অবশ্যই যুগল অধিকারীর ব্যাপার, তবে বন্দনা কখনও আমার ঘর বা আমাদের ঘর বলেন না, বলেন বাবুর ঘর। লোকজনকেও তাই বলতে শিখিয়েছেন।
খাতাটা দেখতে হবে!
ঠিক এই মুহূর্তে ভবদেবের মনে হল, সত্যিকার নিজের একটা ঘর মানুষের দরকার।
অন্তত ইচ্ছেমতো পড়াশুনোর জন্যে।
কর্মজীবনে ভেবেছেন রিটায়ারের পর কিছু পড়ব-টড়ব। সারাজীবন তত ফাইল ছাড়া আর কিছু তাকিয়ে দেখিনি। কিন্তু এই তো আট মাস হয়ে গেল, কই? কীই বা করলাম?
নাঃ, দিনগুলোকে এবার একটা নিয়মের মধ্যে বেঁধে ফেলে কিছু কিছু করা দরকার।
এই সংকল্পমুহূর্তে সুকুমার উঠে এল হইহই করতে করতে।
দাদা আপনি এখানে? এই ধুলোর মধ্যে? কেন? বাড়িতে আর লোক নেই এসব করবার?
ভবদেব হাসলেন, আহা অত অস্থির হচ্ছ কেন? আমায় কি কেউ মজুরের চাকরিতে লাগিয়েছে? দেখছিলাম। বাবার কিছু বইটই ছিল, ফেলেটেলে দেবে হয়তো। তা তুমি একা নাকি? আসল লোকটির তো গলা পাচ্ছি না।
নাঃ! দিদিও এই কথাটি বললেন। বললেন কি, বকলেন দস্তুরমতো। তার মানে এ হতভাগা একেবারেই নকল, ফালতু।
ভবদেব মৃদু হাসলেন, তা নয়। তিনি একা এলেও এই বকুনিটি শুনতেন। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে জুতো জোড়ার মতো, শুধু একপাটি সব সময়ই মূল্যহীন।
হাহা করে হেসে উঠল সুকুমার।
বলল, ওঃ দাদা, দারুণ দিলেন তো। জুতোর জোড়া। হো হো হো। তা এখন আপাতত আমার একপাটির নন-কোঅপারেশান। কথা বন্ধ। কাজেই কী করে আসবে।
অ্যাঁ! কথা বন্ধ? চন্দনা কথা বন্ধ করে বসে আছে? বল কী? অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তা, অবস্থা এমন তুঙ্গে ওঠার কারণ কী?
সুকুমার মাথা চুলকে বলল, দিদিও ওই প্রশ্ন করে একচোট গঞ্জনা দিলেন। স্বভাবতই ধরে নিয়েছেন আমিই আসামি।
ভবদেব এই ছেলেটাকে বেশ ভালবাসেন। এই যে খোলা হাসি, এটা স্বল্পভাষী ভবদেবকেও যেন খোলামেলা করে দেয়।
হেসে বললেন, কী যেন একটা বই-ই আছে না স্বামী মানেই আসামী! দেখেছি কার যেন হাতে। তা সেটাই মেনে নেওয়া উচিত। যাক এমন ব্যাপার ঘটালে যে, চন্দনা তার দিদির বাড়িতে আসতেও নারাজ হল?
ওই তো।
সুকুমার মাথাটা চুলকে বলল, আপনি গুরুজন, কী আর বলি। আমি কিছুই ঘটাইনি দাদা, কখন কোথায় কী শুনেছে কী পড়েছে খোদা জানে, হঠাৎ সেদিন জিজ্ঞেস করে বসল, টেস্টটিউব বেবির ব্যবস্থা এদেশে চালু হয়েছে কিনা। শুনে তো আমি থ। বলতেই হল জানি না। খুব খানিকটা গঞ্জনা খেতে হল জগতে চুন বালি সিমেন্ট পাথরকুচি ছাড়া জানি না বলে। তারপর বলল, খোঁজ নিতে। এই কলকাতা শহরেই নাকি এ ঘটনা ঘটেছে কিছুকাল আগে। দোষের মধ্যে বলে ফেলেছিলাম, বেশ তো দুজনে নিঝঞ্ঝাটে কাটাচ্ছি বাবা, আবার সুখে থাকতে ভূতের কিলের সন্ধান কেন?
ওঃ নির্ঝঞ্ঝাট! বুঝেছি।বলেই ব্যস মুখে তালাচাবি। তদবধি এই তিন দিন তিন রাত! ওই নির্ঞ্ঝাট কথাটা বলে ফেলাই হয়েছে মহা মুখামি। সেদিন তো ভয় হল, আত্মহত্যা-টত্যা না করে বসে। পরদিন দেখলাম ঘর মোছা খারাপ নিয়ে কাজ করা মেয়েটাকে বকাবকি করছে, ভয়টা কাটল। বোঝা গেল ফর্মে এসে গেছে। তবে আমার উপর যা খাপ্পা হয়ে আছে, উঃ!
ভবদেব অবশ্য একে তত গুরুত্ব দিলেন না। শুধু বললেন, বোকার মতো ওই কথাটা বলতে গেলে কেন?
কী জানি দাদা। এতটা যে হবে–আমি তো ভাবি ভগবান যখন দিলেনই না তখন ওই নিয়ে হা হুতাশ করে কী হবে? অবস্থাটা যে নিদারুণ একটা দুঃখের অবস্থা, তা কই ভাবি না তো! বেশ তো আছি।
ভবদেব বললেন, মেয়েদের মনের গড়ন আলাদা। তারা বোধহয় এটাকে বড় রকমের ব্যর্থতা মনে করে। আমার তো তাই মনে হয়। যেন খেলার মাঠে নেমে হেরে যাওয়া! বলটা হাতে পাচ্ছে না। আমার এক পিসিকে দেখেছি ছেলেবেলায়, তাঁকে আমরা মাদুলিপিসিমা বলতাম। সর্বাঙ্গেই বোধহয় মাদুলি। তথাপি তাঁর কাজই ছিল, প্রতি ছুটির দিনে পিসেমশাইকে টানতে টানতে কোনও না কোনও দৈব কি অলৌকিকের ধান্ধায় নিয়ে যাওয়া।
সুকুমার বলল, তার মানে সেকালে একালে, বিদুষী আর নিরক্ষরা নারী চরিত্র এক ও অভিন্ন। কী বলুন?
ভবদেব কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, সিঁড়ি থেকে শানুর গলা পাওয়া গেল, ছোট মেসো ওখানে ধুলোর মধ্যে কী করছেন এতক্ষণ? চলে আসুন চা ঢালছি।
সুকুমার বলল, সত্যি বলব দাদা, সেকাল আর একাল, বিদুষী আর নিরক্ষরা, নারী চরিত্র এক ও অভিন্ন। আদি ও অকৃত্রিম, কোনও ফারাক নেই।
ভবদেব কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, সিঁড়ি থেকে শানুর শানানো গলা শোনা গেল, ছোটমেসো, ওই ধুলোর মধ্যে কী করছেন এতক্ষণ? চা ঢালছি, চলে আসুন চটপট!
দাঁড়ান একটু খ্যাপাই।
সুকুমারও গলা বাড়াল, গলা তুলল, আরে ছোটমেসো তো ধুলোবালিরই মানুষ। তো তোর বউদি তো বাড়ি নেই, চা বানাচ্ছিস তুই তো! যা হবে বুঝতেই পারছি। আজ কপালে নিমের পাঁচন!
বলে দরজার দিকে এগোল।
ভবদেব একটু থমকালেন, বললেন, বউদি বাড়ি নেই? কে বলল?
ওহো আপনাকে বলা হয়নি। দিদিকে বললাম। আসার সময় বাসে দেখতে পেলাম। একই বাসে এলাম, অথচ কথা বলা গেল না, যা ভিড়। উঃ। মানুষের প্রাচীর।
ভবদেব এ কথার সমর্থনে কথা বাড়ালেন না, শুধু আস্তে বললেন, কোনখানে দেখলে নীরাকে?
ঠিক মনে পড়ছে না। তবে দেখেছি ঠিকই। বাসের মধ্যে তো ডেকে উঠতে পারি না। আপনি চা খেতে আসবেন না?
যাচ্ছি, তুমি নামো।
নেমে গেল সুকুমার!
ভবদেব একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন।
ভাবলেন, এ বিষয়ে আমার কি কিছু কর্তব্য আছে? অন্তত খোকাকে একবার জিজ্ঞেস করবার?
.
১০.
আজ পার্থর ইন্টারভিউ ছিল, শানু তাই বিকেল থেকেই উসখুস করছে, কোন ছুতোয় একবার বেরিয়ে পড়া যায়।
ইন্টারভিউ কেমন হল, সে প্রশ্নটা জরুরি নয়, পার্থ বলেছে ওটা হচ্ছে ফর শো, চাকরিটা হয়ে যাবে। হানড্রেড পার্সেন্ট সিওর।
শুনে শানুর মনটা সুখের নৌকোয় ভেসেছে।
পার্থর এত নিশ্চিন্ততার কারণ, চাকরিদাতার ওপর নাকি পার্থর মামার দারুণ ইনফ্লুয়েন্স আছে।
শেষ পর্যন্ত সেই খুঁটির জোরে?
হেসেছিল শানু, সেই মামা দাদাকে ধরাধরি? খুব যে বলতে
পার্থ ওর কাঁধটা চেপে ধরে বলেছিল, এই তোর জন্যে! তুই যে একেবারে হেদিয়ে মরছিস।
অপমান! অপমান! পার্থদা, মনে রেখো যে, মেয়েরা গলায় দড়ি দিতে ভয় পায় না।
পার্থ বলল, দোহাই তোমার! সুন্দরী তরুণীদের গলায় ফুলের মালাই মানায়, গোরুর দড়ি নয়।
সুন্দরী। ঠাট্টা হচ্ছে?
ঠাট্টা ভাবো ঠাট্টা। আমার নিজের বিশ্বাসমতো কথা বলছি।
তা এসব কথা তো হচ্ছে দিন দুই আগের। আজ ইন্টারভিউর দিন।
পার্থর বোন ভদ্রা পাড়ার বান্ধবী, স্কুলে কলেজে শানুর সহপাঠিনী ছিল। ও বাড়িতে যাবার অবাধ স্বাধীনতা ছিল। বিয়ে হয়ে গেছে, কাজেই শানুরও সুবিধে গেছে।
তবে আপাতত একটু আশার আলো, ভদ্রা নাকি বাপের বাড়ি এসেছে দুর্গাপুর থেকে।