শীতের নলেন গুড়ে
শীতের দিনে নস্টালজিক বাঙালির বিশেষ প্রিয় নলেন গুড়। ভোরের বেলা খেজুর গাছ থেকে পেড়ে আনা টাটকা খেজুর রসের চাহিদা মেটাতে শিউলি তথা গাছিদের ব্যস্ততার অন্তত নেই।
খেজুর রসের থেকে তৈরি গুড় ‘নলেন গুড়’ নাম হওয়ার কারণ হিসেবে বিভিন্ন মতবাদ আছে। এই গুড় খেতে এতো সুস্বাদু যে লোভে জিভে জল আসে অর্থাৎ নোলা ভিজে যায়। কেউ বলে নোলা থেকেই নলেন শব্দ আসে। আবার অনেকের মতে, খেজুর গাছের কান্ড চেঁচে যে নলি দিয়ে রসে বের হয়ে হাঁড়িতে পড়ে, সেই নলির নাম অনুসারে নলেন নাম এসেছে।
আবার বলা হয়, নব বা নতুন কে গ্ৰামে নওল বলে । এই নওল থেকে ক্রমে শব্দের অপভ্রংশ হতে হতে নলেন হয়েছে । অর্থাৎ , নতুন ওঠা খেজুর গুড়।
হেমন্তের আগমনে , নভেম্বর মাসের শেষ থেকেই নলেন গুড় পাওয়া যায়। গ্ৰামে সারি সারি খেজুর গাছ চাষ হয়। শীতকালে খেজুর গাছে প্রচুর রস হয়। খেতে খুবই মিষ্টি। বেশি ঠাণ্ডায় রস সুস্বাদু হয় এবং সুগন্ধ ছড়ায়। গন্ধে চারিদিক মো মো করে।
গাছি বা শিউলিরা সেইসময় গাছের মাথার দিকের কান্ড ধারালো দা দিয়ে মাছের আঁশের মতো কেটে রাখে ।চার – পাঁচ দিন পর পুনরায় চাঁচা হয়। এরপর তার মাঝে চ্যানেল তৈরি করা হয়। তারপর খেজুরের পাতলা নরম কান্ডের অংশ নিয়ে নলের মতো বানিয়ে চ্যানেলে বসিয়ে হাঁড়ির মুখে দিয়ে হাঁড়ি দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। চ্যানেলের মাধ্যমে নল দিয়ে সেই রস হাঁড়িতে চুইয়ে পড়ে।
সকালে খেজুর রস খালি পেটে অনেকে খায়। এতে লিভার ভালো থাকে, রক্ত পরিস্কার হয়। শীতের ভোরে খেজুর রস যেমন সুস্বাদু, মিষ্টি , উপকারী তেমনি একটু বেলা হলে সেটা গেঁজে ফেনা উঠে তাড়ি হয়ে যায়। সেই রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হয়।
গুড় জ্বাল দিয়ে বানানো হয়ে যাওয়ার পরে তলায় যে দানা থাকে তা নিস্কাশিত করে কেমিকেল মিশিয়ে তৈরি করা হয় চিনি। গুড়ের তৈরি এই চিনিকেই বলা হয় ব্রাউন সুগার।
আসল নলেন গুড় নরম মানের হয়। সাধারণত ছোট ছোট গোলাকার নরম গুড় বাজারে বিক্রি হয়। সুন্দর নরম পাটালি গুড়। আবার ভেজাল গুড়ও হয়। ভেজাল পাটালি গুড় বেশি হয়ে থাকে।
সেই গুড়ের কিণারায় হাত দিয়ে ভাঙতে গেলে খুব শক্ত লাগে, সহজে ভাঙা যায় না।
আর গুড় যদি চকচক করে তাহলে বুঝতে হবে চিনি মশানো আছে। রস জ্বাল দেওয়া গুড়ের রঙ সাধারণত বাদামি হয়, কিন্তু যদি গুড় হলুদ রঙের ,হয় তাহলে বুঝতে হবে রাসায়নিক দ্রব্য বেশি দেওয়া আছে।রস জ্বাল দিয়ে দু- চার ঘন্টা সময় লাগে গুড় তৈরি করতে। জ্বাল দেওয়ার পর গুড়ের উপরের পাতলা ঝোলা অংশ ঢেলে ছাঁচে ফেলে পাটালি গুড় তৈরি হয়। ছাঁচে ফেলা গুড়ের উপর মাঝখানে কিছুটা শক্ত গুড়ের পাকানো গোলা বসিয়ে দেওয়া হয়। দশ মিনিটেই গুড় জমে পাটালি তৈরি হয়।একে মধু জ্বালি বলা হয়। কড়া রঙের গুড় হলে আসল পাটালি। আর সাদা রঙের পাটালি মানেই অ্যাসিড দেওয়া।
সকল বাঙালির খুব প্রিয় খাবার নলেন গুড়। এই সময় ঘরে ঘরে গুড়ের পায়েস, পিঠে, পুলি, মিষ্টি তৈরি হয়। মোয়া বিক্রি হয়। এই নলেন গুড় দিয়ে গরম গরম রুটি, পরোটা খাওয়ার মজাই আলাদা। বাঙালি এই গুড়ের জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে।
এই গুড়ের বিশেষ উপকারিতা আছে। এক টেবিল চামচ গুড়ে থাকে মানুষের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ক্যালশিয়ামের ১০শতাংশ। এই গুড় খেলে উচ্চমাত্রার ক্যালশিয়াম সহ প্রাপ্তবয়স্কদের হাড়ের ঘনত্ব ভালো থাকে, হাড় মজবুত হয়।অস্টিওপোরেসিস হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।