গুরুদেবের স্নেহধন্যা মৈত্রেয়ী
মৈত্রেয়ী দেবী ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহধন্যা তথা ভাবশিষ্যা। তাঁর লেখা আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস “ন-হন্যতে” তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায় এবং তিনি ১৯৭৬ সালে সাহিত্য একাডেমি পুরষ্কার লাভ করেন। মৈত্রেয়ী দেবী তাঁর এই উপন্যাসে তুলে ধরেছেন ১৯৩০ সালের প্রেক্ষাপট। তাঁর গুরু, অর্থাৎ রবিঠাকুর- যাঁর আলোকে তিনি উদ্ভাসিত, যিনি ওঁর জীবনে ধ্রুবতারার জ্যোতির মতো, কখনো পথভ্রষ্ট হতে দেন না।
মৈত্রেয়ী দেবীর পিতা সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন একজন স্বনামধন্য দার্শনিক ও প্রবন্ধকার। কলকাতার ভবানীপুরের দাশগুপ্ত পরিবারে দার্শনিক পিতার আদর্শ এবং তৎকালীন কলকাতার এলিট সম্প্রদায়ের সাহচর্য তাঁর কিশোরী মনের অলিন্দে দার্শনিকতার গভীর ছাপ ফেলে।
মাত্র ষোল বছর বয়েসে প্রকাশিত (১৯৩০) হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “উদিত”। কবিগুরু স্বয়ং এই বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন।
এই সময় ওঁদের বাড়িতে আসা ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রের জ্ঞানপিপাসু ইউরোপীয়ান শ্বেতাঙ্গ মির্চা এলিয়াদের সাথে ষোড়শী অমৃতার (মৈত্রেয়ী দেবীর ডাক নাম) একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কথাটা বাবার কানে পৌঁছতেই তিনি মির্চাকে বিতাড়িত করেন। ঘটনার আকস্মিকতায় সদ্য যুবতী অমৃতার কোমল হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ওই সময় তাঁর গুরু রবিঠাকুর তাঁর ভগ্ন হৃদয়ে মলমের প্রলেপ বুলিয়ে দেন, অন্তরে শান্ত হওয়ার মন্ত্র দিয়ে। বাইরের জগতের উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই, কিন্তু প্রতিটা মানুষের একটা অন্তর্জগৎ থাকে। সেই অন্তর্জগৎকে আমরাই পারি নিয়ন্ত্রণ করতে। অমৃতাকেও তিনি সেই দীক্ষা দেন। এরপর ১৯৩৪ সালে ড: মনমোহন সেনের সাথে বিবাহের পর তিনি স্বামীর সাথে মংপুতে চলে আসেন। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে মৈত্রেয়ী দেবীর আমন্ত্রণে কবি চারবার মংপুতে তাঁর আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। কবিগুরু এখানে থাকাকালীন তাঁর সাথে কবির কথোপকথন নিয়ে মৈত্রেয়ী দেবীর অসামান্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয় “মংপুতে রবীন্দ্রনাথ” (১৯৪২)। আসলে এ’টি একটি ডায়েরী। তাঁর সাথে কবির সাধারণ কথোপকথন, হাস্য-কৌতুক সে’গুলোই তিনি যতটা সম্ভব লিপিবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছেন। এ’কথা কবি নিজেও জানতেন। একদিন সস্নেহে বলেছিলেন “জীবনে কত স্মৃতিমন্দির বানাবে? তা হয় না, জানো না জীবনটা মরণেরই যজ্ঞ।” মৈত্রেয়ী দেবী ওঁনার কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধর মতো শুনতেন, আর নতজানু হয়ে কবির পায়ের কাছে বসে থাকতেন।
বিয়াল্লিশ বছর তাঁর জীবন একটা অন্য খাতে বয়েছে। আজ আবার ১৯৭২ সালে তাঁর ফেলে আসা অতীত সামনে এসে দাঁড়িয়ে বর্তমানের ভিত টলিয়ে দিতে উদ্যত! মির্চা এলিয়াদ একটি বই লেখেন “লা নুই বেঙ্গালি” নামে। যার অর্থ বাংলার রাত। কিন্তু এই গ্রন্থে যে’ ভাবে তাদের সম্পর্ক বর্ণিত হয়েছে তা তো সত্য নয়। ১৯৭২ সালে আধুনিক কলকাতায় দাঁড়িয়ে তিনি ১৯৩০ সালের মতোই তাঁর গুরুকে (রবিঠাকুর) স্মরণ করছেন “প্রভু আমায় পরিত্যাগ করো না। নাথ হে ফিরে এসো – আমার সব সুখ দুখ মন্থন ধন অন্তরে ফিরে এসো। আমার সমস্ত অতীত, বর্তমান ভবিষ্যৎ জুড়ে তোমার গানে গানে এক জ্যোতিবিকীর্ণ মহোৎসব। এতদিন পরে কি ধ্রুবতারকার জ্যোতি নিভে যাবে? আমি পথভ্রষ্ট হব?”
এখানে বলে রাখি, মির্চা ভবানীপুরের বাড়ি থেকে চলে যাবার পর অমৃতার কোমল হৃদয়ে তীব্র দহনে চন্দনের প্রলেপ লাগাতে তিনি গুরুদেবের শরণাপন্ন হন। গুরুদেবকে লেখা একটা চিঠিতে তাঁর মনের অবস্থা জানান। উত্তরে তিনি যা লেখেন তা সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হল- “কল্যাণীয়াসু্,
তোমার চিঠিতে যে বেদনা প্রকাশ পেয়েছে তাতে আমি অত্যন্ত পীড়া বোধ করলুম। তোমাকে কী পরামর্শ দেব ভেবে পাইনে। জীবনের পরিণতি একান্ত বিস্মৃিতির ভিতর দিয়ে নয়, দিনে দিনে বেদনাকে বোধনার মধ্যে নিয়ে গিয়ে কঠোরকে ললিতে, অম্লতাকে মাধুর্যে পরিপক্ব করে তোলাই হচ্ছে পরিণতি। অবস্থার হাতে নিষ্ক্রিয়ভাবে নিজেকে সমর্পণ করে তুমি থাকতে পারবে না – নিজেকে পূর্ণতর করে তুমি সৃষ্টি করতে পারবে। হতাশ হয়ো না, নিজের উপর শ্রদ্ধা রেখো, চারিদিক থেকে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে সেই গভীর নিভৃতে নিজেকে স্তব্ধ করো- যেখানে তোমার মহিমা তোমার ভাগ্যকে অতিক্রম করে।”
গুরুদেবর কথাগুলো আবার তাঁর মনে শক্তি জোগায়।
তিনি লেখেন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ আত্মজীবনী মূলক উপন্যাস “ন-হন্যতে”।