Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » স্বপ্ন দেখা মানা || Rana Chatterjee

স্বপ্ন দেখা মানা || Rana Chatterjee

স্বপ্ন দেখা মানা

কারখানায় শ্রমিকের হাড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে সন্ধ্যা ছ’টায় সমর বিধ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরলে পায়ের শিরাগুলো টান ধরে বিদ্রোহ করলেও উপায় নেই।বাড়ি বলতে  সামান্য ভাড়ায় রেলপারের গা ঘিনঘিনে বস্তির  ঝুপড়ি। কাজের সন্ধানে অনেক ঘাত প্রতিঘাতে হাজির এত বড়ো  কলকাতা শহরে সে।এই দুনিয়ায় একদম একা সমর তবু একটু ভালো থাকার স্বপ্ন দেখতে ভয় পায়।

জল স্যাঁতস্যাঁতে মাটির মেঝে, না কোন খাটিয়া, না তোষক, কম্বল খানিক ছেঁড়া বস্তা পাতা।সমর, কাজ থেকে ফিরে ওতেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে, বন্ধুহীন পাংশুটে জীবনে।সকাল হলেই কাজে দৌড়ায় রাতের কিনে আনা রুটি চিবাতে চিবাতে!
কারখানায় সাইরেন পড়ে গেলেই হাজিরা খাতায় লাল দাগ!ঘণ্টা দুই কাজ করে চা দোকানে যৎসামান্য টিফিন। কোনোদিন ব্রেড অমলেট বা ব্রেড বাটার কিনলে নিজেকে মানুষ মনে হয়, তারপর সারাদিন গাধার খাটনি।

বয়স উনিশের সমর ছোট্ট থেকে চায়ের দোকানে কাজ করতো।তার যে একটা লক্ষ্য আছে, আরও উপার্জন দরকার সেটা মাথা থেকেই বেরিয়ে গেছিলো।আসলে জন্ম থেকে এই রতনপুর জনপদে এত গাল মন্দ কুকথা, বেজন্মা ডাক সে শুনেছে নরকের কীট ভাবতো নিজেকে।তার নাকি মা বাবার ঠিক নেই। কোনো এক  ভিখারি চম্পা মাসি, পুত্রস্নেহে মানুষ করেছিলো।তিনি মারা যেতে  একদিন কলকাতার ট্রেন চড়ে বসে সমর। হাওড়া স্টেশনে লোকজন ভিড়ে চমকে যায়। সবাই কাজে ছুটছে অথচ তার চাল চুলো নেই!কে কাজ দেবে, কোথায় যাবে চিন্তায় রাস্তায় ঘুরে, ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলো দুদিন।

জীবনে মা-বাবার স্নেহ না পেলেও চম্পামাসির সান্নিধ্যে উপলব্ধি করেছিল কিন্তু আজতো কেউ নেই!শুন্যতায় মন হু হু করে উঠলো।একদিন চা দোকানে দুটো লোক কিসব বলাবলি করছিল ফ্যাক্টরিতে লেবার লাগবে।ওদের হাতে পায়ে ধরে একটা হিল্লে করে ফেলল অনাথ ছেলেটা।

হপ্তা পেলেই অনেক শ্রমিক ছুটতো বেশ্যা পাড়ায়।ইচ্ছে না থাকলেও শরীরী খিদে আর ফ্যাক্টরির বাবলু, পিন্টুদের জোরাজুরিতে একটু ফূর্তি, মদ, আর ভিডিও পার্লারে গিয়ে শরীর সেঁকে আসাতে  অভ্যস্ত হয় সমর।

সেদিন সন্ধ্যায় ঝুপড়ির দরজা ঠেলে ঘর ঢুকে  অবাক! কি আশ্চর্য্য কে একজন দিব্যি তার ছেঁড়া বস্তা বিছানায় আরামে ঘুমাচ্ছে!এক মাথা ঘন চুল, পায়ে নুপুর, ফুল ছাপা শাড়ির বছর কুড়ির এক মেয়ে, কিন্তু এখানে! চরম খাটনিতে ক্লান্ত আজ সমর।অগত্যা গামছা পেতে খানিক তফাতে ঘুমিয়ে গেল।

ঠান্ডা হাওয়া আর খিদের অনুভূতিতে ঘুম  ভাঙতেই ভাবলো এই মেয়েটি তার চেনা কিনা!এদিকে বসে হাই তুলছে কালকের অতিথি।সমরকে দেখে সঙ্কুচিত হয়ে কাঁচুমাঁচু স্বরে বলল, “এভাবে ঘরে ঢোকা ছাড়া উপায় ছিল না বাবু, বিশ্বাস করুন গা ঢাকা না দিলে, ওরা আমাকে ছিঁড়ে খেতো” এমন বিপদের কথায় সমর ঝেড়ে মেরে উঠে আশ্বাস দিলো, “কেউ কিচ্ছু করবে না আপনার, নিশ্চিন্তে বসুন, কিন্তু আপনি কে?” “..আমি মিলি, আপনাকে চিনি, ওই নোংরা পাড়ায় দেখেছি।সব খদ্দের আমার খোঁজ নিতে ওরা আমায় বের করে দিয়েছে!বাকিদের খদ্দের কমে যাচ্ছে আমি থাকলে, কিন্তু আমি কি করবো বলুন তো!

ঘরের আলো আঁধারিতে দিব্যি বোঝা যাচ্ছে শরীরের সু গঠন, ছোট খাটো লক্ষী প্রতিমার মতো ফর্সা গোল মুখ।পরনে রাজস্থানি ঘাগড়া আরো মোহময়ী করে তুলেছে মিলিকে।সমর অতিথিকে ভদ্রতা দেখিয়ে বললো, “ঠিক আছে আলোচনা পরে হবে, রেস্ট নাও, আমি কাজে বেরুবো”।

মন খুব উচাটন আজ সমরের।ঘরে উঠতি বয়সের মেয়েটা বিপদে আশ্রয়, অথচ ঘরে দানাপানিও নেই ভেবেই নিজেকে  দায়িত্বজ্ঞানহীন লাগছিল। চা দোকানে মিনিট কুড়ির টিফিনে পেটে লাগছে বলে  সরে পায়ের গতি বাড়ালো সমর। কিছুটা ছাতু, চিড়ে, গুড় একটা থালা কিনে ঘর গিয়ে দেখে কেউ কোথাও নেই! অবাক হয়ে ভাবলো কাল রাতে স্বপ্ন দেখেনি তো!আচমকা নুপুরের ধ্বনিতে সম্বিত ফিরতে দেখে পাশে ঘেরা জায়গায় বালতিতে জল নিয়ে গিয়ে হাত পা ধুচ্ছে সে।”সূর্য্যের আলোয় ঠিকরে পড়ছে কাঁচা হলুদের মতো রং, সুডৌল বক্ষ! আড়ষ্টতায় থমকে সমর, দূর থেকে বলে চলে আসে, “খাবার রইল, সময়ে খেয়ে নেবেন”!

আজ কাজ করে ফিরতে  প্রায়  সাতটা হলো সমরের তবু যেন একটু বেশিই চনমনে। মিলি কি করছে, তারও রুটি কিনে ফিরবে কিনা এসব ভেবে ফিরতেই দেখে ঘরে তালা! আশ্চর্য্য তো প্রতিদিন ভেজিয়ে যাওয়া ঝুপড়ি দরমা দরজা কিনা আজ এভাবে! পরক্ষনেই একটুকরো কাগজ নজরে এলো তালার সাথে!

কাগজে লেখা, “কোনো দায়িত্ব নেই আপনার, ঘর খুলে এভাবে রাখে!আমি লক করে গেলাম, টিনের চালে চাবিকাঠি আছে”।চাবির স্পর্শ পেতেই  মন আনন্দে নেচে উঠলো সমরের।আজকাল  পরস্পরের সাক্ষাৎ খুব কম হচ্ছে! হয়তো সমর ভোরে বেরিয়ে যাচ্ছে, সেই কিছুক্ষন আগেই ঢুকছে মিলি। “কোথায় যায়, কেন যায়, আমি তো আছি”এই ভরসার কথা গুলো মনে বুদ্বুদের মতো ভাসলেও বলে উঠতে পারে নি সমর।সেদিন সন্ধ্যাতে  ভিজে চুপসে বাড়ি ফিরে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলো সমরের।মিলি ততক্ষণ বেণীতে বেলি ফুল গুঁজে রেডি হচ্ছিল! বাইরে যত বিদ্যুৎ ঝলকানি সমর যেন কাহিল হয়ে ঝুপড়িতে অপ্সরা দেখছে।

“উফ, বেশ তো ঠান্ডা লাগিয়েছেন, বলে ব্যাগ থেকে একটা এন্টিএলার্জি ওষুধ হাতে গুঁজে ছাতা মাথায় বেরুলো মেয়েটি।”এই নিন গরম দুধ, খেয়ে নিন আনলাম”- মাটির ভাঁড় এগিয়ে দিতেই ওর যত্নশীল ডাক চম্পা মাসিকে মনে পড়ালো সমরের।অনাথ সমরকে এভাবেই আগলে রাখতো, যত্ন করে খাবার, দুধের গ্লাস মুখের সামনে ধরতো! মুহূর্তে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো।

“আজ কি কাজে না গেলেই নয় , থাকুন না একটু”, হাত ধরে টান দিলো মিলিকে! এক মিষ্টি পবিত্র প্রেমের গন্ধ যেন সমরকে আচ্ছন্ন করছে।যদিও কদিন ওদের এক ঘরে থাকা তবু কেউ কাউকে অযাচিত ভাবে স্পর্শ করে নি! একটা বাধভাঙা উচ্ছ্বাস , অঘোষিত বোঝাপড়া উভয়ের মধ্যে তবু ছিল এক সম্মান বোধের লক্ষণ রেখা।

এভাবে প্রায় আট মাস পার। ইতিমধ্যে সহকর্মীরা জেনেছে সমরের প্রেম কাহিনী, কিন্তু আড়ালেই আছে মিলি।কারখানায়  মালিক, সহকর্মীরা সমরের দায়িত্ব ও সরলতায় ওকে সমীহ করে। বেতনের সাথে বেড়েছে সমরের প্রত্যাশাও।সৎ বাবা মিলিকে লুকিয়ে পতিতালয়ে বিক্রি করায় যে দম বন্ধ কালো দুনিয়ার সমুদ্রে ভেসে গেছিলো মিলি, সমরকে পাশে পেয়ে একটা অদ্ভুত শান্তি তার মনে।

একদিন সমর তার স্মৃতিমাখা রতনপুরের হনুমান মন্দিরে মিলিকে বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করে।পাশে থাকার মন্ত্রে নতুন জীবনে চলার সংকল্পে স্বপ্ন সন্ধানী স্বামী স্ত্রীর পথ শুরু।বিয়ের পর মিলি বাইরে যাওয়া বন্ধ করলেও বেশ কিছু পয়সাওয়ালা বাবু  সমরের কাছে মিলির খোঁজ করেছে। প্রতিবারেই সমর জানিয়েছে, মিলি তার সহধর্মিনী, ওর খোঁজ করবেন না।তবুও উৎপাত এড়াতে সমর ভদ্র পরিবেশে বাড়ি ভাড়া নিয়েছে।

সেদিন ছিল দেওয়ালির রাত।কারখানায় লাড্ডুর প্যাকেট, বোনাস পেয়ে খুশিতে সবাই বাড়ির জন্য আতশবাজি কিনতে বাজার গেছিলো।সমরও প্রচুর রং মশাল, রকেট , তুবড়ি কিনে ফিরছিল। সন্ধ্যা নামতে তিলোত্তমা কলকাতা আলোতে সেজে অভ্যর্থনা করছে ।দু তিনটে কুকুর এক নাগাড়ে  বিকট চিৎকার করতে কেমন যেন কু গাইলো সমরের মন। মিলি নিশ্চয়ই মোমবাতি সাজাচ্ছে ভেবে পটকা, ঢাকের বাদ্যি, মাইক, ঠাকুর দেখার ভিড় ঠেলে বাড়ি ঢুকতেই চমকে ওঠে সমর!

একি, লোকে র ভিড়, পুলিশ, মেঝেতে চাপ চাপ রক্ত, উফ অসহ্য! কারা যেন সমরের নাম ধরে ডেকে বদ মতলবে সরাসরি ঘর ঢুকে ভারী কিছু দিয়ে থেঁতলে খুন করেছে মিলি কে, সমরের স্বপ্ন সন্ধানী স্বত্ত্বা। সমর একটু ভাল জীবন দিতে চেয়েছিল, কিন্তু মিলির গায়ে লেগে থাকা পাঁক, অপরুপা সৌন্দর্য্য ওকে এভাবে শেষ করে দিলো!

খবর কাগজে শিরোনাম বেরুলো, “, এক যৌন কর্মীর স্বপ্নভঙ্গ”। দীর্ঘশ্বাস, বাঁধ ভাঙা কান্নায় এ যেন অনাথ ছেলেটারও অপমৃত্যু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress