নারীমুক্তি আন্দোলনে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর
উনবিংশ শতাব্দীর ভারতবর্ষে চারিদিকে তখন কুসংস্কারের আঁধার। সংকীর্ণতা আর কুপমন্ডুকতার বেড়াজালে ভারতবাসী আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। এর সঙ্গে শাপে বর হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী ,অত্যাচারী ইংরেজ শাসকদের ছিনিয়ে নেওয়া স্বাধীনতা।
এরই মাঝে একটু একটু করে নবজাগরণ দেখছে বাংলা। সমাজে হোক বা সাহিত্যে— সব জায়গায় আধুনিকতার হাওয়া আসতে শুরু করেছিল। আর সেই ঢেউয়েরই অংশ হয়ে হাজির জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার। কিন্তু… হ্যাঁ, এখানেও ‘কিন্তু’। ধীরে ধীরে সমাজে বদল এলেও বাঙালি নারীদের স্বাধীনতার দিকে খেয়াল ছিল না সংখ্যাগরিষ্ঠের। ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলেও মেয়েদের জীবন ছিল খাঁচায় বন্দি পাখির মতো। এমন অবস্থাতেই বিলেত থেকে ফিরে আসলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় সন্তান, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ততদিনে ইতিহাসও তৈরি করে ফেলেছেন তিনি। বিলেতে গিয়ে প্রথম ভারতীয় হিসেবে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পাশ করে ফিরে এসেছেন সত্যেন্দ্রনাথ।
দেশীয় সমাজে নারীদের ঘরবন্দী অবস্থা তথা অশিক্ষার অভিশাপ এই দুইয়ের খপ্পরে পড়ে নানান কষ্টে জর্জরিত ছিলেন, তৎকালীন নারীজাতি। এই অত্যাচারিত নারীদের শৃঙ্খল মোচন করতে রাজা রামমোহন রায় এবং পরবর্তীতে বিদ্যাসাগর এগিয়ে এসেছিলেন। তৎকালীন সমাজ সভ্যতার অন্ধকার দূর করতে এগিয়ে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগদানকারী প্রথম ভারতীয়, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরও।
১৮৪২ সালের ১ লা জুন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন জন্মগ্রহণ করেন, তার ঠিক দেড় দশক আগেই রাজা রামমোহন রায়ের তত্বাবধানে দেশ থেকে রদ হয়েছিল নৃশংস সতীদাহ প্রথা। নারীমুক্তি আন্দোলনের সূচনাকারী রাজা রামমোহন রায় দেখেছিলেন ,সেযুগের হিন্দু নারীরা ছিলেন অশিক্ষিত ও নিরক্ষর। তাদের না ছিল কোনো সামাজিক অধিকার,না ছিল অর্থনৈতিক অধিকার। তারা সম্পত্তির অধিকার থেকেও বঞ্চিতা হতেন। বাড়ির ভিতরে অন্তরালে থেকে সবকিছু সহ্য করা ছিল তাদের ভবিতব্য। বাল্যকালেই তাদের বিবাহ হয়ে যেত, তারপর সারা জীবন পর্দার আড়ালে কাটাতেন । আর ঠিক এই দিকটাই পরবর্তীতে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। বাইরের জগতের সঙ্গে তৎকালীন হিন্দু মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের নারীদের কোনো যোগাযোগ থাকতো না। এর বিরুদ্ধেই আজীবন লড়াই করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুর বহু পরেও ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় বিশেষ করে হিন্দু সমাজের নারীদের অবস্থার তেমন বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। বর্ধিষ্ণু ধনী পরিবারের সন্তান সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষিত বিবেক নাড়া দিয়েছিল নারীদের অবমাননা দেখে। তিনি হিন্দু নারীদের মধ্যে প্রচলিত তৎকালীন পর্দা প্রথার ঘোর বিরোধী ছিলেন। দীর্ঘদিন ব্রিটেনে পড়াশোনা করার ফলে তিনি দেখেছিলেন ওখানকার সমাজে নারী স্বাধীনতা। তিনি তার সঙ্গে ভারতের নারীদের এই বৈপরীত্য মানতে পারেননি।
নারীদের অধিকার বিষয়ক আন্দোলনের পাশাপাশি তাঁর মধ্যে সক্রিয় ছিল দেশাত্মবোধ। তিনি ইংরেজদের অত্যাচারের সমালোচনার পাশাপাশি তাদের ভালো দিকগুলো যাতে সমাজে কাজে লাগে, তার চেষ্টাও করেছিলেন। সমস্ত সংস্কার মূলক কাজ তিনি শুরু করেন একেবারে ওনার বাড়ি থেকে। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী তার আদর্শ জীবনসঙ্গিনী ছিলেন। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন ওদের সমাজে সত্যেন্দ্রনাথ যে নারী স্বাধীনতা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, ব্রিটেনে নারীরা যেমন পুরুষদের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে সমান মর্যাদার অধিকারী ,তা তিনি স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীর মাধ্যমে এই দেশেও শুরু করার পক্ষপাতী ছিলেন। নিজের সহধর্মিণীর মাধ্যমে তিনি এই সংস্কার শুরুর পাশাপাশি সমস্ত হিন্দু সমাজের নারীদের মধ্যে তা সঞ্চালন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আপত্তি তাঁর চলার পথে বাধা সৃষ্টি করে। তিনি তাই ইচ্ছা থাকলেও সস্ত্রীক না গিয়ে একাই যান ইংল্যান্ডে।
পরবর্তীতে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি আবার সংস্কারের কাজে মনোনিবেশ করেন। শুরু হয় নারী অধিকার খর্ব করা দেশাচারের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই। তিনি স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীকে তৎকালীন বোম্বাই নিয়ে যান। সত্যেন্দ্রনাথ তখন আই সি এস হিসেবে বোম্বাইয়ের ইংরেজ অফিসারদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতেন। বুদ্ধিমতী জ্ঞানদানন্দিনী ইংরেজদের সঙ্গে থাকাকালীন খুব সহজেই ইংরেজ রীতি নীতি আয়ত্ত করে নেন। পরবর্তীতে শোনা যায় কলকাতার বরলাট ভবনে এক ঐতিহাসিক ভোজসভায় তিনি সস্ত্রীক হাজির হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। এইভাবেই তিনি প্রচলিত দেশাচার আর পর্দা প্রথার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন।
১৮৭৭ সালে তিনি স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীকে সন্তান সমেত বিদেশে (ইংল্যান্ড) প্রেরণ করেন, তাও এক ইংরেজ দম্পতির সঙ্গে। এই ঘটনা তৎকালীন হিন্দু সমাজে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। পরবর্তীতে তিনি ভাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিলেন। এখানে উল্লেখযোগ্য এই পর্দা প্রথা দূর করার জন্য তিনি তাঁর বোন সৌদামিনী দেবীর সাহায্য পেয়েছিলেন।
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অসীম সাহসী ও নিজ কর্তব্যে অবিচল একজন সত্যিকারের গুণী ব্যক্তি। সাহিত্য অনুরাগী সত্যেন্দ্রনাথ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ওনার ভ্রাতা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায়-
” আমাদের শিক্ষার মধ্যে এমন একটি সম্পদ থাকা চাই যা কেবল আমাদের তথ্য দেয় না, সত্য দেয়;যা কেবল ইন্ধন দেয় না, অগ্নি
দেয়। “
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন এরূপ শিক্ষায় শিক্ষিত। একইভাবে ওনার স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সাহসও ছিল অতুলনীয়। তিনি হিন্দু নারীদের শাড়ি পড়ার নতুন পদ্ধতি সৃষ্টি করেছিলেন, তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম প্রবাহিত হয়ে আজও হিন্দু নারীদের মধ্যে সঞ্চালিত। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা তৎকালীন হিন্দু নারীদের পর্দা প্রথার বাইরে আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। আর এজন্য তিনি ভারতের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।।