Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ড্রাগন || Nihar Ranjan Gupta

ড্রাগন || Nihar Ranjan Gupta

বর্ষা-মেদুর সন্ধ্যা

চারিদিকে আবছা কালো অন্ধকারের যেন যবনিকা থিরথির করে কাঁপছে। কিরীটীর টালিগঞ্জের বাড়িতে তার বসবার ঘরে কৃষ্ণা চুপটি করে বসে কিরীটীর গল্প শুনছে। কিরীটীর পরিধানে গেরুয়া রঙের খদ্দরের ঢোলা পায়জামা ও গেরুয়া রঙের ঢোলা খদ্দরের পাঞ্জাবি।

মুখে পাইপ।

কিরীটী বলছিল : এই মিস্ত্রি, যাকে তোমরা রহস্য বল-এ কোন ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্যে পাওয়া যায় না। কত প্রকারের মিস্ট্রিই যে আমি দেখেছি ও শুনেছি-রাতের পর রাত তোমাদের বসে বসে আমি গল্প শোনাতে পারি। ক্রাইমের রহস্য আছে : কোন খুনের মামলার যখন আদালতে বিচার হয়, আদালতে প্রত্যেকটি দর্শক তখন উদগ্রীব ও উৎসুক হয়ে থাকে। ধর একটা খুন হল, কে খুন করলে? কেন খুন করলে? কেমন করে কোন অবস্থায় কখন খুন হল? একটার পর একটা চিন্তা আমাদের মনের মাঝে রহস্যের জাল বুনতে শুরু করে। এই এক ধরনের মিস্ত্রি। আবার হয়ত এমন হল, কোন লোক সহসা আশ্চর্য ভাবে অদৃশ্য হয়ে গেল। কোথায় গেল সে অদৃশ্য হয়ে? কেমন করে সে অদৃশ্য হল? তাকে কি কেউ চুরি বা গায়েব করে নিয়ে গেল? অথবা কেউ কি তাকে খুন করে পৃথিবী থেকে তার মৃতদেহ চিরতরে লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে ফেললে? কিংবা হয়ত কোন নিরালা মাঠের প্রান্তে পাওয়া গেল তার হিমশীতল প্রাণহীন দেহখানি কিংবা কোন এক প্রাসাদোপম অট্টালিকার কোন এক নির্জন সুসজ্জিত কক্ষে দেখা গেল পড়ে আছে তার মৃতদেহ। অথবা কোন নদীকিনারে এসে ঠেকে রয়েছে তার মৃত্যুশীতল প্রাণহীন দেহ।

আর তার কাছ থেকে জানা যাবে না কোনদিন কখন কে বা কারা কি ভাবে তাকে এমনি করে খুন করে ফেলে রেখে গেল!

ভাষা তার চিরদিনের জন্য মূক হয়ে গেছে।

আর সে কথা বলবে না, আর সে সাড়া দেবে না।

নিস্তব্ধ স্বল্পালোকিত কক্ষের মধ্যে কিরীটীর স্বপ্নাতুর কণ্ঠস্বর রিম্ ঝিম্ করতে লাগল। বাইরে তখন অশ্রান্ত বৃষ্টি শুরু হয়েছে।

সোঁ সোঁ করে প্রচণ্ড হাওয়া বন্ধ জানালার কাঁচের শার্সির গায়ে এসে আছাড়িপিছাড়ি করছে।

মাঝে মাঝে হিল-হিল করে উঠছে বিদ্যুতের অগ্নি-ইশারা। কড়কড় করে কোথায় যেন বাজ পড়ল।

পথের ধারের বড় কৃষ্ণচূড়ার গাছটা ঝড়জলে সোঁ-সোঁ সপসপ শব্দ তুলেছে।

পাইপের আগুনটা নিভে গিয়েছিল, কিরীটী আবার তাতে অগ্নিসংযোগ করে নিল।

আবার সে বলতে শুরু করল : এ ধরনের মিস্ত্রিও আছে- একটু অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়, অদ্ভুত সব দৃশ্য চোখে পড়ে-যখন কেউ কোথাও জেগে নেই; সব নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে। অদ্ভুত অশরীরী সব মৃদু চাপা পায়ের শব্দ কোন অন্ধকার শূন্য ঘর থেকে হয়ত শোনা যাচ্ছে। ছুটে হয়ত দেখতে গেলে সেখানে কিসের শব্দ, কিছু চোখে পড়ল না।

যেন মায়ায় গেছে সব মিলিয়ে।

সাত সমুদ্র তের নদীর পার থেকে স্বপ্নের ফাঁকে ভেসে আসা ঘুমন্ত রাজকন্যার স্মৃতির মত।

কেউ হয়ত দেখে, আবছা চাঁদের আলোয় কোন পোড়ো বাড়ির বারান্দায় নিঃশব্দে একাকী কে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।

কে সে?

কেন সে একাকী গভীর রাতে এমনি করে পোড়ো বাড়িতে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়?

কাকে সে খোঁজে?

সে কি কোন বিদেশী রাজপুত্র, হারিয়ে যাওয়া রাজকুমারীকে আজও এই পৃথিবীর ঘরে ঘরে নিশীথ রাতে খুঁজে খুঁজে ফেরে? মানুষ না ছায়া? না মিথ্যা দুঃস্বপ্ন?

শরীর সহসা রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে।

মিস্ত্রি! মিস্ত্রি! রহস্য!

কার চাপা ফিসফিস কণ্ঠস্বর? কার করুণ কান্নার সুর? মৃদু গানের আওয়াজ বা সঙ্গীতের মৃদু রেশ…রাতের নিঃশব্দে অন্ধকারে এমনি করে ভেসে আসে।

কে শব্দ করে? কে কথা বলে? কে গান গায়? কে বাজায় একা একা আপন মনে?

এ প্রশ্নের মীমাংসা কোথায়? কোথায় এ রহস্যের সমাধান? শুধু কী এই? মানুষের চরিত্রও কি অনেক সময় একটা প্রকাণ্ড রহস্য হয়ে আমাদের চোখের কোণে মায়া জাগায় না? এই পৃথিবীর ঘরে ঘরে কত বিভিন্ন চরিত্রের লোকই না আছে। কেউ কাদে পরের দুঃখে, কেউ দুঃখ দিয়ে আনন্দ পায়। কেউ ভালবেসে হয় সুখী, কেউ ঘৃণা করে আনন্দ পায়। কেউ আপনাকে বিলিয়ে দিয়েই ধন্য, কেউ অন্যকে বঞ্চিত করে নিজেকে মনে করে ধন্য!


বিচিত্র—সব বিচিত্র রহস্যময় বিচিত্র এই পৃথিবী! বিচিত্র এই পৃথিবীর মানুষ!

মানুষই মানুষকে করে খুন।

যে খুন করেছে সেও মানুষ—যাকে খুন করছে, সেও তারই মত একজন মানুষ!

কেউ উদ্দেশ্য নিয়ে খুন করে, আবার কেউ বিনা উদ্দেশ্যেই নিছক নেশায় খুন করে।

ডাক্তারী ভাষায় বলা হয় তাদের—হোমিওসাইড্যাল ম্যানিয়াক মানুষের।

.

সারাটি রাতের বর্ষণক্লান্ত প্রকৃতি প্রথম ভোরের আলোয় ঝিলমিল করছে। কিরীটী লম্বা টান-টান হয়ে একটা বড় সোফার উপরে গভীর আলস্যে শুয়ে চোখ বুজে নিঃশব্দে চুরুট টানছে।

চুরুটের পীতাভ ধোয়া মাথার উপরে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অদূরে আর একটা সোফায় বসে কৃষ্ণা সেদিনকার দৈনিক সংবাদপত্রটা ওলটাচ্ছে।

সহসা একসময় কৃষ্ণা বলে উঠল, আজকের সংবাদপত্রটা দেখেছ?

কিরীটী চোখ বুজেই জবাব দিল : না, কেন?

বিখ্যাত ডেনটিস্ট ডাঃ চৌধুরীকে কে বা কারা যেন নৃশংস ভাবে হত্যা করেছে তার সাজারী রুমে। ক্লিনিকে–

কি রকম?

এই দেখ না, কৃষ্ণা সংবাদপত্রটা কিরীটীর দিকে এগিয়ে দিল।

কিরীটী হাত বাড়িয়ে কৃষ্ণার হাত থেকে সেদিনকার দৈনিকখানা নিল। বললে, বল কি, চৌধুরী যে আমার বিশেষ বন্ধু!

বিখ্যাত দন্ত-চিকিৎসক
ডাঃ এন, এন, চৌধুরীর রহস্যময় মৃত্যু

গতকল্য বেলা সাতটার সময় বিখ্যাত দন্ত চিকিৎসক ডাঃ এন. এন. চৌধুরীকে ধর্মতলাস্থ তার শয়নকক্ষে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

অতীব নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক ভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে। গলার সামনের দিকে একটা তিন ইঞ্চি পরিমাণ ভয়ঙ্কর ক্ষত ও বাম দিককার বুকেতে একটি চার ইঞ্চি পরিমাণ ক্ষত। মনে হয় যেন কোন তীক্ষ্ণ নখরে গলার ও বুকের মাংস খুবলে নেওয়া হয়েছে। ডাঃ চৌধুরী মাত্র বছর-চোদ্দ আগে জার্মানী থেকে দন্ত চিকিৎসায় পারদর্শী হয়ে আসেন। শহরে দন্তচিকিৎসক হিসাবে তার যথেষ্ট সুনাম ও প্রতিপত্তি ছিল। ধনী পিতার তিনি একমাত্র পুত্র ছিলেন। নিজেও প্রভূত অর্থ উপায় করেছেন। তিনি অবিবাহিত ও সংযমী, অত্যন্ত বিনয়ী স্বাস্থ্যবান সুপুরষ ছিলেন। এই প্রসঙ্গে দিন পনের আগে চেতলার অবসরপ্রাপ্ত আলিপুর জেলের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট গণনাথ মিত্রের হত্যার কথা মনে পড়ল। তাকেও একদিন প্রাতে তার শয়নকক্ষে ঐরূপ নৃশংস অবস্থায় পাওয়া যায়। তারও গলায় ও বাম দিককার বক্ষে ঐরূপ নৃশংস ক্ষত ছিল। পুলিসের কর্তৃপক্ষ এ সম্পর্কে কী বলেন?

কিরীটী সংবাদপত্রটা কৃষ্ণার হাতে ফেরত দিতে দিতে বললে–

হবুচন্দ্র রাজা তার গবুচন্দ্র মন্ত্রী
পথেঘাটে সদা ঘোরে সশস্ত্র সান্ত্রী!
হঠাৎএকদা রাজা ডাকিলেন ‘গবু’!
রাজ্যে এত খুনোখুনি শুনিনি তো কভু!
কহিলেন গবু : তবে শোন মহারাজ,
নিশ্চয় ঘুমায় সান্ত্রী করেনাকো কাজ।
শুনি হবু বলে তবে চক্ষু করি লাল,
মাহিনা দিতেছি তবু একি হীন চাল!
আমি হবু, তবু রাজ্যে একি অনাচার
এখুনি মস্তকচ্যুত করহ সবার।
শুনি গবু বলে তবে, একি মহারাজ;
গরীবের শির লবে একি তব কাজ!

এমন সময় সুব্রত হাসতে হাসতে এসে ঘরে প্রবেশ করল। কার শির নিচ্ছ হে। কার আবার-তোমার?

অপরাধী জানিল না কি দোষ তাহার? বিচার হইয়া গেল তবু?

এসব কি শুনছি হে সুব্রতচন্দ্র? তোমার রাজ্যে কি আজকাল মানুষেই মানুষ খেতে শুরু করেছে?

হ্যাঁ, কন্ট্রোলের চালে মানুষের পেট ভরছে না, তাই মানুষের বুকের মাংস খুবলে খেতে হচ্ছে।

তা তো বুঝলাম, কিন্তু আসল ব্যাপারটা কী বল তো?

মাথামুণ্ডু এখনও কিছু বুঝে উঠতে পারছি না, তবে চেষ্টার ত্রুটি করছি না।

.

কয়েকদিন পরে গভীর রাত্রে। শীতের মধ্যরাত্রি। স্বল্প কুয়াশার মৃদু অস্বচ্ছ অবগুণ্ঠনতলে কলিকাতা শহর যেন তন্দ্রানত।

ব্ল্যাক আউটের নিস্তেজ বাতির ম্রিয়মাণ রশ্মিগুলি কুয়াশার মায়াজালে আটকা পড়ে যেন মুক্তির আশায় পীড়িত হয়ে উঠেছে।

কিরীটী শ্যামবাজারে এক বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করে বাড়ি ফিরছে।

ট্রাম ও বাস বন্ধ হয়ে গেছে, রাস্তায় লোকচলাচল একপ্রকার বন্ধ হয়ে গেছে বললেও চলে। শুধু হেথা-হোথা ফুটপাতের উপরে ও ঝোলানো বারান্দার আশ্রয়ে দু-একজন ভিক্ষুক নিঃসঙ্গ রাত্রির বুকে জীবনের স্পন্দনটুকু জাগিয়ে রেখেছে।

কিরীটী ইচ্ছা করেই গাড়ি ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল। হীরা সিংকে বলে দিয়েছিল সে হেঁটেই বাড়ি ফিরবে।

প্রভুর এ ধরনের অদ্ভুত খেয়ালের সঙ্গে হীরা বিশেষ করেই পরিচিত ছিল, তাই বিনা বাক্যব্যয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেছে।

কিরীটী গায়ে লংকোটটা চাপিয়ে পাইপটায় অগ্নিসংযোগ করে মৃদু মৃদু টান দিতে দিতে পথ চলছিল।

স্তব্ধ নির্জন রাত্রির একটা নিজস্ব রূপ আছে। প্রকৃতি সেখানে নিঃশেষে আপনাকে মুক্ত করে দেয়। দুহাতে নিঃস্ব করে আপনাকে বিলিয়ে দেয়।

মানুষের মন যেন সেখানে অনায়াসেই আপনাকে খুঁজে পায়, সেখানে কোন দম্ভ থাকে, কোন প্রশ্ন থাকে না, এইভাবে একাকী আপন মনে রাত্রির নিঃসঙ্গতায় পথ চলতে কিরীটীর বড় ভাল লাগে।

বৌবাজারের কাছাকাছি আমহার্স্ট স্ট্রীটের মোড়ে তখনও একটা পানের দোকানে দুএকজন খরিদ্দারের ভিড়। কিরীটী এগিয়ে চলে।

এত বড় জনকোলাহল-মুখরিত নগরী যেন কোন যাদুমন্ত্রের স্পর্শে ঘুমিয়ে পড়েছে।

রাত্রি তখন প্রায় দেড়টা হবে—কিরীটী রসা রোড ও লেক রোডের কাছাকাছি এসে আবার তার পাইপটায় নতুন করে তামাক ভরে অগ্নিসংযোগ করে নিল।

সবে কয়েক গজ এগিয়েছে এমন সময় একটা দীর্ণ আর্ত চিৎকার নৈশ রাত্রির স্তব্ধ নির্জনতাকে ছিন্নভিন্ন করে জেগে উঠল।

কিরীটী থমকে দাঁড়াল।

দীর্ণ চিৎকারটা যেন সহসা রাত্রির স্তব্ধ সমুদ্রে একটা আকস্মিক শব্দের ঢেউ তুলে সহসাই মিলিয়ে গেল।

কিরীটী ভাবলে, শুনতে ভুল হয়নি তো? অন্যমনস্ক ভাবে সে ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করতে লাগল।

আবার সেই চিৎকার।

না, ভুল নয়। এ যে কোন মানুষের বুক-ভাঙা দীর্ণ চিৎকার!

কিরীটী উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়াল। আবার সেই চিৎকার!

মনে হচ্ছে যেন ডান দিককার কোন একটা বাড়ি থেকে আসছে সেই চিৎকারের শব্দ।

ডানদিকে কতকগুলো একতলা, দোতলা, তিনতলা নানা আকারের বাড়ি। ব্ল্যাক আউটের স্তিমিত আলোকে কেমন ভৌতিক ছায়ার মতই প্রতীয়মান হয়।

কিরীটী দ্রুতপদে অনুমানে শব্দটা যেদিক থেকে আসছিল সেইদিক লক্ষ্য করে এগিয়ে চলল।

একটা বাড়ির কাছাকাছি আসতেই পাশের একটা সরু গলিপথ দিয়ে কে যেন ছায়ার মত দ্রুতপদে এগিয়ে এল।

লোকটার সর্বাঙ্গে কালো রঙের পোশাক। মাথায় একটা কালো রঙের ফেল্ট টুপি। একপাশে ঈষৎ নামানো। লোকটা এসে দ্রুতপদে পথের ধারে একটা গ্যাসপোস্টের নীচে দাঁড়াল। কিরীটী দু-তিন হাত দূরে একটা গাড়িবারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লোকটাকে দেখতে লাগল, অথচ লোকটা কিন্তু কিরীটীকে দেখতে পেল না। লোকটার সর্বাঙ্গ যেন একটা গভীর উত্তেজনায় কাঁপছে। গ্যাসপোস্টের খানিকটা আলো তির্যক গতিতে লোকটার মুখের ডানপাশে এসে পড়েছে।

সেই স্তিমিত আলোয় লোকটার চোখ দুটো যেন কী এক ভয়ঙ্কর ক্ষুধিত জিঘাংসায় আগুনের ভাটার মত জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। মাথার চুলগুলো ডান দিককার কপালে এসে পড়েছে।

একজোড়া পাকানো গোঁফ।

লোকটা পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে ঘন ঘন মুখ মুছতে শুরু করল।

এমন সময় পাশের একটা বাড়ি থেকে প্রচও একটা গোলমালের শব্দ শোনা গেল।

সঙ্গে সঙ্গে লোকটা চমকে রাস্তায় নেমে দ্রুতপদে চলতে লাগল এবং ঘন ঘন পিছনপানে তাকাতে লাগল। কিরীটীও নিঃশব্দ পদসঞ্চারে লোকটাকে অনুসরণ করল। লোকটা আরও দ্রুতবেগে রাস্তাটা পার হতে লাগল। কিরীটীও তার চলার বেগ বাড়িয়ে দিল।

কিন্তু কিরীটী লোকটার কাছাকাছি পৌঁছবার আগেই রাস্তার ধারে রক্ষিত একটা সাইকেলে চেপে লোকটা সোঁ সোঁ করে নিমেষে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।

কিরীটী যখন সেখানে এসে পৌঁছল, দেখলে সাইকেলটা যেখানে ছিল সেইখানে রাস্তার উপরে কী একটা কাপড়ের মত পড়ে আছে।

নীচু হয়ে কিরীটী জিনিসটা তুলে নিল হাতে।

নিশ্চয়ই লোকটা রুমালটা তাড়াতাড়িতে ফেলে গেছে।

কিরীটী রুমালটা হাতের মুঠোর মধ্যে চেপে ধরে রাস্তার ওপাশে যেখান থেকে তখনও গোলমাল আসছিল সেইদিকে এগিয়ে গেল।

গোলমালটা আসছিল একটা গেটওয়ালা দোতলা বাড়ি থেকে।

বাড়িটার কক্ষে কক্ষে তখন আলো জ্বলে উঠেছে। অনেক লোক চলাফেরা করছে।

কিরীটী গেট খুলে এগিয়ে গেল।

দরজার সামনে অল্পবয়স্ক একটি যুবককে দেখে কিরীটী তাকেই প্রশ্ন করলে, কী ব্যাপার মশাই?

কে আপনি? যুবক প্রশ্ন করলে।

একজন পথিক ভদ্রলোক, এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম, গোলমাল শুনে দেখতে এলাম, ব্যাপার কী?

কী আর বলব মশাই!…যুবকের কণ্ঠস্বর কাঁপতে লাগল।

কিরীটী স্পষ্টই বুঝতে পারলে কোন কারণে যুবক অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উঠেছে।

কী, ব্যাপার কী?

ব্যাপার যে কী তা কি আমিই বুঝতে পারছি! ভৌতিক কাণ্ড মশাই!

ভৌতিক কাণ্ড! বলেন কী?

তাছাড়া আর কী? মানুষ যে মানুষকে ওভাবে খুন করতে পারে, এ যে স্বপ্নেরও অতীত।

খুন?

হ্যাঁ, খুন।

পুলিসে সংবাদ দিয়েছেন?

না, দিইনি তো!

ফোন আছে বাড়িতে?

আছে।

চলুন শীগগির পুলিসে একটা ফোন করা যাক।

কিরীটী যুবকের সঙ্গে বৈঠকখানায় এসে ফোনের রিসিভার তুলে নিল, হ্যালো বড়বাজার…

ওপাশ থেকে জবাব এল, হ্যালো, কে?

কে, সুব্রত? কিরীটী প্রশ্ন করলে এপাশ থেকে।

হ্যাঁ, ব্যাপার কী? কিরীটী না?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। শীঘ্র এস। ..নং রসা রোডে একজন খুন হয়েছেন।

খুন? এত রাত্রে?

আরে ছাই, এসোই না!

তুমি থাকছ তো?

হ্যাঁ আছি, এস তাড়াতাড়ি। কিরীটী রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।

তারপর যুবকের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে বললে, চলুন, দেখি কোথায় খুন হয়েছে।

আসুন। নিস্তেজভাবে যুবক কিরীটীকে আহ্বান করল।

উপরের একটা ঘরে যুবকের পিছু পিছু কিরীটী এসে প্রবেশ করল।

.

বেশ প্রশস্ত সাজানো-গোছানো একখানা ঘর। মেঝেতে দামী পুরু কার্পেট বিছানো। ঘরের একপাশে একখানা দামী খাটে নিভাজ একটি শয্যা বিছানো।

একপাশে একটি টেবিল ও একটি বুকসেলফ, টেবিলের উপরে কাগজপত্র পাকার করা আছে।

একপাশে একটি লোহার সিন্দুক। টেবিলের সামনে একটি গদি-মোডা চেয়ার। টেবিলের উপরে সবুজ ঘেরাটোপে ঢাকা একটি টেবিল-ল্যাম্প জ্বলছে। তারই আলোয় ঘরটি আলোকিত।

মেঝেয় কাপেটের উপরে দামী স্লিপিং স্যুট পরা কে একজন উপুড় হয়ে পড়ে আছে।

পিঠের দিকে স্লিপিং স্যুটটা ছিন্নভিন্ন, রক্তে ভিজে লাল হয়ে উঠেছে।

কিরীটী এগিয়ে দেখল, পিঠের উপরে প্রকাণ্ড দু-তিনটি গভীর ক্ষত।

মনে হয় কোন এক হিংস্র রক্তপিপাসু জন্তু যেন তীক্ষ্ণ দন্তাঘাতে লোকটার পিঠের মাংস খুবলে নিয়েছে।

উঃ, কী ভয়ানক পৈশাচিক দৃশ্য!

কিরীটী পকেট থেকে টর্চ বের করে ভূপতিত ব্যক্তিকে আলোতে আরও ভাল করে দেখতে লাগল।

একবার নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখতে পেল, নাকমুখ দিয়ে রক্তাক্ত ফেনা গড়াচ্ছে।

চোখ দুটো খোলা, যেন ঠিকরে বের হয়ে আসতে চায় মুখে-চোখে একটা অস্বাভাবিক আতঙ্ক যেন প্রকট হয়ে উঠেছে।

কিরীটী লোকটার বুকে হাত দিয়ে দেখলে, না, লোকটার নিঃসন্দেহে মৃত্যু হয়েছে।

গলার উপরে ও কিসের নীল দাগ! ও যে আঙুলের দাগ বলেই মনে হয়! হ্যাঁ, লোকটাকে কণ্ঠনালী চেপে নিষ্ঠুরভাবে শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে।

কিন্তু কী ভয়ঙ্কর পৈশাচিকতা, কী দানবীয় নিষ্ঠুরতা!

কিরীটী একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াল এবং অদূরে স্থাণুর মত দণ্ডায়মান যুবকের মড়ার মত রক্তহীন ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকাল।

চলুন এ ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়া যাক।

কিরীটী মৃদুস্বরে যুবককে বললে।

দুজনে ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে পাশের ঘরে দুখানা চেয়ার অধিকার করে বসল।

বাইরে তখন চার-পাঁচজন ভৃত্য উঁকিঝুঁকি মারছে।

উনি আপনার কে হন? কিরীটীই প্রথমে নিস্তব্ধতা ভেঙে প্রশ্ন করলে।

আমার জ্যেঠামশাই। বিখ্যাত ডাঃ অমিয় মজুমদার।

উনিই ডাঃ অমিয় মজুমদার?

হ্যাঁ।

আপনার নাম?

সুশীল মজুমদার।

এ বাড়িতে আর কে আছেন?

জ্যেঠামশাই ব্রহ্মচারী, চিরকুমার। আমি ছোটবেলায় মা-বাপকে হারিয়েছি, জ্যেঠামশাইয়ের কাছেই মানুষ। যুবকের চোখদুটি ছলছল করে এল। কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এল।

এরা সব?

চাকরবাকর, ঠাকুর, সোফার।

ব্যাপারটা কখন জানতে পারলেন?

আমি জ্যেঠামশাইয়ের পাশের ঘরেই ঘুমোই। জ্যেঠামশাই রাত্রে সাধারণতঃ অনেক রাত্রি পর্যন্ত জেগে পড়াশুনা করেন। আজও বোধ হয় তাই করছিলেন। হঠাৎ একটা চিৎকার শুনে আমার ঘুম ভেঙে যায়। প্রথমটা বুঝতে পারিনি।

আবার চিৎকার শোনা গেল। তখন মনে হল যেন পাশের ঘর থেকেই আসছে, ছুটে ঘরের বাইরে চলে আসি। জ্যেঠামশাইয়ের ঘরের দরজা ঠেলতে গিয়ে দেখি দরজা ভিতর থেকে বন্ধ।

অনেক কষ্টে ঠেলাঠেলি করে ও চিৎকার করেও যখন দরজা খুলতে পারছি না, এমন সময় সহসা দরজাটা দড়াম করে খুলে গেল এবং কে যেন অন্ধকারে ঝড়ের মত আমাকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিয়েই ছুটে সিঁড়ির দিকে চলে গেল। ততক্ষণে চাকরবাকরেরাও গোলমাল শুনে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসছে। কিন্তু লোকটা সকলকে যেন ঝড়ের মতই ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে আচমকা অদৃশ্য হয়ে গেল।

দেখেছিলেন লোকটা দেখতে কেমন?

ভাল করে দেখতে পাইনি, তবে মনে হল যেন কালো পোশাক পরা।

কিরীটী একবার চমকে উঠল। তবে কি…

এমন সময় বাইরের রাস্তায় মোটর থামবার শব্দ শোনা গেল।

একটু পরেই সিঁড়িতে কার জুতোর শব্দ পাওয়া গেল।

সুপার সুব্রত রায় আসছেন। কিরীটী বললে।

সুব্রত এসে ঘরে প্রবেশ করল। হ্যালো কিরীটী! ব্যাপার কি?

কিরীটী হাত তুলে একটা চেয়ার দেখিয়ে বললে, বস সুব্রত।

ইনি শ্রীযুক্ত সুশীল মজুমদার।..কিরীটী একে একে সুব্রতকে সমস্ত ব্যাপার খুলে বললে।

সুব্রত খানিকক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে বললে, হুঁ। তারপর সুব্রত পাশের ঘরে গিয়ে মৃতদেহ পরীক্ষা করে দেখল। সমস্ত বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখল সিন্দুকটা পরীক্ষা করে দেখা গেল, বন্ধই আছে, কিছু চুরি যায়নি।

ততক্ষণে কয়েকজন লালপাগড়ীও এসে গেছে।

বাড়িটা বেশ প্রশস্ত।

উপরে নীচে সর্বসমেত আটখানি ঘর।

দেখা গেল বৈঠকখানায় একটা কাঁচের জানলা ভাঙা।

জানালার দুপাশে দুটো বাড়ির মাঝখানে একটা সরু গলিপথ।

আশেপাশের বাড়ির অনেকে তখন ঘুম ভেঙে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।

বোঝা গেল ওই জানালা-পথেই খুনী বাড়িতে প্রবেশ করেছিল।

বাড়ির ঠাকুর, চাকর, সোফারের জবানবন্দি নিয়ে মৃতদেহ ময়নাঘরে পাঠাবার বন্দোবস্ত করে, দুজন লালপাগড়ী বাড়িতে মোতায়েন রেখে কিরীটী ও প্রত যখন ডাঃ মজুমদারের বাড়ি ছেড়ে পথে বের হয়ে এল রাত্রি তখন পৌনে চারটে।

সুব্রত কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বললে, চল্ তোকে পৌঁছে দিয়ে যাই।

দুজনে গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি ছুটে চলল।

গাড়িতে আর কোন কথাবার্তা হল না।

গাড়ি এসে টালিগঞ্জে কিরীটীর বাড়ির সামনে দাঁড়াল। বাইরের ঘরে এসে দুজনে বসে জংলীকে দু কাপ চায়ের আদেশ দিল।

বাইরের ঘরে উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোয় কিরীটী পকেট থেকে রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া রুমালটা বের করতেই চমকে উঠল।

সমস্ত রুমালটাই চাপ চাপ রক্তের লাল দাগে ভর্তি।

সুব্রত বিস্মিত ভাবে কিরীটীর হস্তধৃত রুমালটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, কী ওটা?

কিরীটী চিন্তিতভাবে জবাব দিল, একটা রক্তমাখা রুমাল।

হুঁ, তা তো দেখতেই পাচ্ছি, কিন্তু কোথায় পেলি ওটা?

রাস্তায় কুড়িয়ে, একজন তাড়াতাড়িতে রাস্তায় ফেলে গেছে।

মানে?

কিরীটী তখন একে একে সমস্ত কথা খুলে বলল সুব্রতকে।

ধরতে পারলি না লোকটাকে?

না। কিন্তু আমি ভাবছি, এ কি সত্যই সম্ভব? মানুষে মানুষের মাংস খায়? মনে পড়ে দন্ত-চিকিৎসক ডাঃ চৌধুরীর রহস্যময় মৃত্যুর কথা?

কিরীটী বলতে লাগল, দুটো কেসই একেবারে হুবহু মিলে যাচ্ছে না কি?

কি বলতে চাস তুই? প্ৰত অধীরভাবে প্রশ্ন করলে।

ঠিক যা তুই ভাবছিস তাই বলতে চাই, তার চাইতে বেশী কি আর! এই বর্তমান সভ্যতার যুগেও ক্যানিবালিজিম চলে?

অ্যাঁ!

হ্যাঁ, তাছাড়া আর কী? আদিম যুগে মানুষ যখন ছিল বর্বর, তখন নাকি মানুষে মানুষ খেত। কিন্তু গুহা ছেড়ে তো অনেকদিন তারা লোকালয়ে এসে ঘর বেঁধেছে। হয়েছে সভ্য পরিপাটি। তবে এর অর্থ কি? আর তাছাড়া যদি বলি একটা হোমিসাইডাল ম্যানিয়া, এমনি করে খুনের নেশায় মানুষ খুন করে বেড়াচ্ছে!

তা কি সম্ভব?

অসম্ভব বলে এ দুনিয়াতে কিছুই নেই ভাই। স্পষ্ট আমি দেখেছি লোকটাকে এই রুমালটা দিয়ে মুখ মুছতে।

কিরীটী ভাল করে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে রুমালটা পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। সাধারণ ক্যালিকো মিলের একটা রুমাল সাদা রঙের।

রুমালের কোথাও কোন বোপর বাড়ির চিহ্ন নেই। বোধ হয় একেবারে নতুন। একবারও নিশ্চয়ই ধোপা-বাড়ি দেওয়া হয়নি।

তবে রুমালের এক কোণে লাল সুতোয় ছোট্ট করে ইংরাজী K অক্ষরটি তোলা।

লোকটা দেখতে কেমন কিরীটী? ব্রত প্রশ্ন করলে।

এমন সময় জংলী দুহাতে দুটো ধূমায়িত চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে এসে প্রবেশ করল।

সামনে একটা টিপয়ের উপরে কাপ দুটো নামিয়ে রেখে জংলী ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

একটা চায়ের কাপ তুলে নিয়ে কিরীটী চুমুক দিয়ে মৃদু একটা শব্দ করলে, আঃ!

কে বলে রে অমৃত সুদূর স্বর্গেতে,
চেয়ে দেখ ভরা এই চায়ের পাত্রেতে!

ভোরের আলো সবে ফুটি-ফুটি করছে। রাতের বিলীয়মান অন্ধকারের অস্বচ্ছ যবনিকাখানি একটু একটু করে নিঃশেষে মিলিয়ে যাচ্ছে।

একটা মৃদু শীতল হাওয়া ভোরের বারতা নিয়ে খোলা জানলা-পথে ঝিরঝির করে এসে প্রবেশ করল।

সুব্রত আবার প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, কিন্তু কিরীটী বাধা দিয়ে বলে উঠল, লোকটা লম্বায় প্রায় ছফুট মত হবে। বলিষ্ঠ পেশল গঠন। দ্রুত চলুন। পরিধানে কালো রঙের গরম সার্জের সুট ছিল। মাথায় কালো রঙের ফেল্ট টুপি। মুখে একজোড়া বড় পাকানো গোঁফ। সামনের দাঁত দুটো উঁচু, নীচের ঠোঁটের উপরে চেপে বসেছে।

তীক্ষ্ণ শিকারী বিড়ালের মত খর-অনুসন্ধানী হিংস্র গোল গোল দুটি চোখ।– মৃদু গ্যাসের আলোয় যেন ভয়ঙ্কর এক শয়তানের প্রতিমূর্তির মতো দেখাচ্ছিল। এখনও যেন তার ক্ষুধিত চোখের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি আমার চোখের উপর ভাসছে।

মানুষ-আমাদের মতই মানুষ? তবে?

হ্যাঁ মানুষ, তবে আমাদের মত কিনা জানি না। কিরীটী মৃদুস্বরে জবাব দিল।


বালিগঞ্জ রেল স্টেশনের ধারে কাঁকুলিয়া রোডে প্রকাণ্ড ইমারততুল্য তিনতলা সাদারঙের একখানা বাড়ি।

বাড়ির লৌহ-ফটকের একপাশে কালো পাথরের বুকে সোনালী জলে খোদাই করে লেখা মহানির্বাণ, অন্যপাশে নামফলকে লেখা মহীতোষ রায়চৌধুরী।

মাত্র বছর ছয়েক হল মহীতোষবাবু কলকাতার এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেছেন।

মহীতোষবাবুর পূর্ব ইতিহাস সম্পর্কে স্থানীয় অধিবাসীদের কৌতূহলের অন্ত ছিল না।

কিন্তু অগাধ ধনশালী, চিরকুমার, উচ্চশিক্ষিত, অত্যন্ত অমায়িক বৃদ্ধ মহীতোষ রায়চৌধুরীকে শ্রদ্ধা করত না শহরে এমন একটি লোক ছিল না।

অনাথ আতুর কাঙালের জন্য তাঁর প্রাসাদোপম অট্টালিকার লৌহদ্বার সর্বদাই খোলা থাকত।

প্রার্থীকে কখনও কেউ কোনদিন মহীতোষের দ্বার হতে রিক্তহস্তে ফিরতে দেখেনি।

স্কুলের চাঁদার খাতায়, স্থানীয় লাইব্রেরী, সর্বজনীন উৎসবাদি নানা প্রতিষ্ঠানে তাঁর চাঁদার অংশটা সকলকে ডিঙিয়ে যেত।

মুক্তহত উদার প্রকৃতির সদাহাস্যময় মহীতোষ সকলের বন্ধু। এই সব নানাবিধ গুণাবলীতেই শহরবাসীরা মুগ্ধ হয়ে তাঁর নামকরণ করেছিল রাজা মহীতোষ।

মহীতোষের আধিপত্যও ছিল যথেষ্ট।

স্থানীয় স্কুল সমিতির প্রেসিডেন্ট, লাইব্রেরীর প্রেসিডেন্ট, সভা-সমিতির প্রেসিডেন্ট।

কোন উৎসবই মহীতোষকে বাদ দিয়ে চলে না।

কর্পোরেশনের একজন প্রতিপত্তিশালী কাউনসিলার মহীতোষ। গুজব সামনের মেয়র নির্বাচনে তিনিও একজন প্রার্থী।

মহীতোষের বয়স যে ঠিক কত সেটা অনুমান করা একটু বেশ কঠিন।

দৈর্ঘ্যে প্রায় ছয় ফুট। পেশল বক্ষ, বলিষ্ঠ গঠন। গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। গোলগাল সদাচঞ্চল দুটি চোখ, দৃষ্টিতে বুদ্ধির প্রখ্য যেন ঠিকরে বের হয়। কপালের দুপাশে একটুখানি টাক দেখা দিয়েছে। ঘন কৃষ্ণকালো চুলের মধ্যে দু-চারটে পাকা চুলও দেখা যায়। দাড়ি-গোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো।

মুখের গঠন তীক্ষ্ণ।

নীচের ঠোঁটটা একটু বেশী পুরু ও ভারী। মুখে সর্বদাই যেন খুশীর একটুকরো হাসি জেগে আছে।

সংসারে তাঁর আপনার বলতে কেউ নেই। তবে অনাত্মীয় গোয্যের দল তাঁকে আপনার জনের মত সর্বদাই আঁকড়ে ধরে আছে।

মহীতোষ মিতাহারী, সংযমী ও মিতভাষী।

উপরের তলায় দুখানি ঘর তাঁর নিজস্ব ব্যবহারের জন্য, বাড়ির বাকি ঘরগুলিতে অনাত্মীয়ের দল ভিড় করে আছে।

ঠাকুর ও চাকর অনেকগুলি।

উপরে তাঁর নিজস্ব দখলে যে ঘর দুখানি, তার একখানি তাঁর শয়নঘর, অন্যখানি লাইব্রেরী। শয়নঘরখানি আকারে মাঝারি।

ঘরের এক কোণে একটা স্পিংয়ের খাটে নিভাঁজ শয্যা বিছানো। খাটের সামনেই একটি টিপয়ে একটা সুদৃশ্য নামী টাইমপিস ও টেলিফোন।

ঘরের মধ্যে প্রকাণ্ড একখানা এনলার্জড় ফটো। তাঁর পিতার।

ঘরে আর কোন আসবাবপত্র নেই। মেঝেতে দামী কাশ্মীরী কার্পেট বিছানো।

শয়নঘরের সংলগ্ন ছোট একটি ঘর আছে, তাতে মহীতোষের আবশ্যকীয় জামাকাপড় ও অন্যান্য আবশ্যকীয় জিনিসপত্রে বোঝাই।

ঘরটি সর্বদাই প্রায় তালা-বন্ধ থাকে।

শয়নঘরের সংলগ্ন বাথরুম আছে।

লাইব্রেরী ঘরখানি আকারে প্রশস্ত। মেঝেটায়ও দামী পুরু কার্পেট বিছানো। আধুনিক কেতাদুরন্ত ভাবে সুদৃশ্য সোফায় সজ্জিত। অদৃশ্য বৈদ্যুতিক বাতিদান থেকে ঘরখানি রাত্রে আলোকিত করার ব্যবস্থা। দু-তিনটি সিলিং ফ্যান। ঘরের চারপাশে সুদৃশ্য কাঁচের আলমারিতে নানা শাস্ত্রের সব বই।

ঘরের একপাশে একখানা সুদৃশ্য সেক্রেটারিয়েট টেবিল। তার উপরে কাগজপত্র, ফাইল প্রভৃতি সাজানো।

সামনে একখানা রিভলভিং গদী-আঁটা চেয়ার।

মহীতোষের বাড়িতে তাঁর দর্শনার্থীর ও দয়াপ্রার্থীর সদাই ভিড়।

কেউ এলে মহীতোষ তার সঙ্গে এই লাইব্রেরী ঘরে বসেই কথাবার্তা বলেন।

অতিথি-অভ্যাগতদের আদর-আপ্যায়নের কোন ত্রুটিই মহীতোষের বাড়িতে হয় না।

সাধারণতঃ সারাদিন ও সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত মহীতোয সকলের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করেন।

সাড়ে সাতটার পরে কেউ এলে হাজার প্রয়োজনীয় কাজ হলেও তিনি কারও সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করেন না।

বাড়ির লোকেরা বলে, মহীতোষ নাকি অনেক রাত্রি পর্যন্ত জেগে পড়াশুনা করেন।

মহীতোষের নিজস্ব কাজকর্ম যা কিছু তার প্রিয় পাহাড়িয়া ভৃত্য ঝুমনই করে।

কলকাতার পুলিসের কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও মহীতোষের যথেষ্ট হৃদ্যতা দেখা যায়।

বিখ্যাত গোয়েন্দা সুপার সুব্রত রায় মহীতোষের একজন পরম বন্ধু।

প্রায়ই সুব্রত মহীতোষের ওখানে আসে ও নানা গল্পগুজবে সময় কাটায়।

সেদিন সন্ধ্যার দিকে মহীতোষের লাইব্রেরী ঘরে বসে দুজনে-সুব্রত ও মহীতোষ গল্প করছিলেন। মহীতোষ বলছিলেন, মানুষের মন সত্যই বড় বিচিত্র সুব্রতবাবু। মানুষ যে ঠিক কী চায় ও কী চায় না তা হয়ত নিজেই সে অনেক সময় বুঝে উঠতে পারে না। আসলে মানুষের মনের মধ্যে দুটো সত্তা আছে, তার মধ্যে একটা থাকে জেগে, অন্যটা থাকে ঘুমিয়ে।

অথচ সবচাইতে আশ্চর্য এই যে, ঘুমন্ত সত্তাকে অবহেলা করবার মত তার মনের জাগরিত আর কোন ক্ষমতাই নেই। অলক্ষ্যে সেই ঘুমন্ত সত্তা প্রভাব বিস্তার করে মানুষের মনের উপরে। এই ঘুমন্ত সত্তাকে ভুলে থাকবার কি চেষ্টাই না আমরা করি!

সুব্রত জবাব দিল, অবিশ্যি যা আপনি বলছেন সবই স্বীকার করি কিন্তু তবু মানুষের সংযম শিক্ষা ও জম্মগত সংস্কার চিরদিনই কি সেই ঘুমন্ত সত্তার উপরে প্রভাব বিস্তার করে না মিঃ চৌধুরী?

স্বীকার করি করে, কিন্তু ঐ যে বললেন জম্মগত সংস্কার-ওটাকে আমি তত importance দিই না। সেটা প্রকৃতি ও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পারিপার্শ্বিক নিয়ে গড়ে ওঠে।

আসলে জম্মগত সংস্কার ওটা একটা মন ভুলানো কথা। মনের সত্যিকারের জোর থাকলে ওটাকে আমরা অনায়াসেই ইচ্ছামত গড়ে তুলতে পারি। তাছাড়া মানুষের জন্মের জন্য তো মানুষ দায়ী নয় সুব্রতবাবু। স্ট্যালিন মুচির ঘরে জম্মেও স্ট্যালিনই হয়েছে, হিটলার হিটলার হয়েছে, জন্ম তত তাদের চরিত্রকে ধরে রাখতে পারেনি।

সুব্রত হাসতে হাসতে বললে, পারেনি সত্যি বটে, তবু রক্তের ঋণকে কেউ কোনদিন অস্বীকার করতে পারেনি ও পারবে না। যে সংস্কার তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তার দেহের প্রতি রক্ত-বিন্দুতে সংক্রামিত হয়েছে তার কাছে ধরা সে দিতে বাধ্য-ইচ্ছায়ই হোক বা অনিচ্ছায়ই হোক।

সুব্রতর কথায় মহীতোষবাবু হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলেন। রক্তের ঋণ! বেশ কথাটা কিন্তু মিঃ রায়। হ্যাঁ ভাল কথা, আপনি একদিন বলেছিলেন আপনার বন্ধু কিরীটী রায়ের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেবেন, নিয়ে আসুন না তাঁকে একদিন এখানে। ক্রিমিনোলজি (অপরাধ-তত্ত্ব) সম্পর্কে চিরকালই আমার একটা উৎসাহ ও আগ্রহ আছে। অপরাধ-জগতের বিচিত্র ভাবধারা-তার সঙ্গে পরিচয় হবার মধ্যে বুঝি একটা ভয়ঙ্কর মাদকতা আছে।


রাত্রি দশটা পাঁচ মিনিটে একটা রাণাঘাট লোকাল ট্রেন আছে। যেসব অফিসফেরত বাবুর দল প্রথম দিককার লোকাল ট্রেনগুলোতে না গিয়ে এই শেষ ট্রেনে বাড়ি ফেরেন, তাঁদের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়।

প্রত্যহই এই ট্রেনটায় বিশেষ ভিড় হয়। অনেক খুচরো ও পাইকারী ব্যাপারী, যারা কলকাতার হাটে-বাজারে শাকসজী, দুধ, ছানা প্রভৃতির বেচা-কেনা করে তাদের সংখ্যাও কম নয়।

একে শীতের ধোঁয়ায় মলিন রাত্রি, তার উপরে সেই সন্ধ্যা থেকে সারাটা আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে ও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। শিয়ালদহের তিন নম্বর প্ল্যাটফরমে রাণাঘাট লোকাল দাঁড়িয়ে আছে।

ট্রেন ছাড়তে তখনও প্রায় বিশ মিনিট বাকি।

প্ল্যাটফরমের স্তিমিত আলোয়, নানাবিধ যাত্রী ও ফেরিওয়ালাদের গুঞ্জনে প্ল্যাটফরমটিতে অদ্ভুত এক অবস্থার সৃষ্টি করেছে।

চাই পান, পান ফ্রিগেট, গরম চা, সলটেড বাদাম…

ক্লান্ত অফিস-ফেরতা বাবুর দলের শ্লথ গতি, কারও হাতে ঝুলানো একটি ইলিশ মাছ, কারও হাতে আগরপাড়ার ক্যাম্বিসের ব্যাগে শিয়ালদহের বাজার থেকে কেনা তরিতরকারি, কারও বগলে ভাঁজ করা সেদিনকার দৈনিক পত্রিকাখানা, কারও হাতে রুমালে বাঁধা বাড়ির ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু খাবার।

ব্যাপারীদের কাঁধে শূন্য ঝাকা ও কলসী, মাতায় মলিন গামছা জড়ানো।

সকলেই ট্রেন ধরবার জন্য ব্যস্ত।

আলোহীন অন্ধকার বগাগুলোর মধ্যে ঠেঠেসি করে যাত্রীরা সব বসে, কেউ গল্প করছে, কেউ বিড়ি বা সিগারেট ফুঁকছে। কেউ বা পাশের যাত্রীর সঙ্গে যুদ্ধের খবর আলোচনা করছে।

যুদ্ধ লেগেছে সন্দেহ নেই।

যুদ্ধ। যুদ্ধ! যুদ্ধ!

একটা প্রবল বন্যা যেন ছুটে এসেছে ধনী, নিধন, সাধারণ গৃহস্থ প্রত্যেকের জীবনে।

ধ্বংসের আগুন জ্বলছে দিকে দিকে।

প্রত্যেকের ঘর ও বাহির সেই আগুনের শিখায় ঝলসে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে।

মানুষের নীরব আর্ত চিৎকার জগতের বাতাস ভারী করে তুলেছে।

ঘরে আহার নেই, পরিধানে বসন নেই, পাবলিশার্সদের কাগজ নেই। প্রেসম্যান বই ছাপতে পারে না, দপ্তরী বই বাঁধতে পায় না। যুদ্ধের গোগ্রাসী ক্ষুধার অনলে সব আহুতি দিচ্ছে কিন্তু তবু মানুষের দৈনন্দিন জীবনধারা চলছে বয়ে। আশা, আকাঙক্ষা, দুঃখ, শোক, হাসি সবই আছে। যুদ্ধ যদি আরও দশ বছর চলে এমনিই সব চলবে।


ট্রেন ছাড়বার আর মাত্র মিনিট দশেক বাকি আছে।

একখানি সেকেণ্ড ক্লাস কামরা। সেখানেও ভিড়ের অন্ত নেই।

সমগ্র দেহ কালো একটা ভারী ওভারকোটে ঢাকা, মাথায় কালো ফেল্ট হ্যাট একজান যাত্রী এসে কামরার সামনে দাঁড়াল।

দরজার উপরেই একটি কেতাদুরস্ত যুবক দাঁড়িয়েছিল, তিলমাত্র বসবার স্থান নেই, সাতআটজন মাঝখানের জায়গাটুকুতে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে।

যুবকটি বললে, এ গাড়িতে জায়গা নেই, স্যার।

আগন্তুক তার বলিষ্ঠ মুষ্টিতে গাড়ির হ্যাণ্ডেলটা চেপে ধরে কর্কশ গলায় বললে, কেন?

যুবক জবাব দিল, কেন আবার কী, দেখছেন না সব ঠেসাঠেসি করে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে, অন্য কামরা দেখুন।

দেখেছি, সব গাড়িই সমান। যেতে হবে আমাকেও। আগন্তুক জবাব দিল।

কামরার ভিতর থেকে কে একজন জবাব দিলেন, যাবেন তো, কিন্তু ঢুকবেন কোথায়? দেখছেন না তিলমাত্র জায়গা নেই?

আগন্তুক বললে, জায়গা করে নিতে হবে।

এবার একজন রুখে এল, আচ্ছা লোক তো মশাই আপনি, বলছি জায়গা নেই তবু ঝগড়া করবেন, দেখুন না অন্য কোন গাড়িতে!

এমন সময় গাড়ির শেষ ঘণ্টা বাজল, গার্ড সবুজ আলো দেখিয়ে হুইসেল বাজাল।

আগন্তুক বলিষ্ঠ হাতে সামনের দণ্ডায়মান ভদ্রলোককে একটু ঠেলে কোনমতে গাড়িতে উঠে দাঁড়াল।

গাড়ি তেমনি চলতে শুরু করেছে।

গাড়ি প্রত্যেক স্টেশনে দাঁড়াবে।

ক্রমে স্টেশনে স্টেশনে যাত্রীরা নেমে যেতে লাগল।

ব্যারাকপুরে এসে গাড়ি খালি হয়ে গেল প্রায়।

গাড়িতে তখন আগন্তুক ও যুবকটি।

অন্ধকার শীতের রাত্রি।

টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে।

যুবক আর আগন্তুক গাড়ির দুপাশে দুখানা সিট অধিকার করে বসে।

হঠাৎ একসময় আগন্তুক তার সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, মুখে তার জ্বলন্ত সিগারেট।

যুবক আনমনে খোলা জানলা-পথে অন্ধকার প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে নীরবে বসে।

আগন্তুক নিঃশব্দে এসে যুবকের সামনে দাঁড়াল ও ডান হাতখানি যুবকের কাঁধের উপরে রাখল।

কে? চমকে যুবক মুখ ফেরাল।

চাপা গম্ভীর গলায় আগন্তুক বললে, চুপ! আস্তে-কী নাম তোমার?

আগন্তুকের মুখে জ্বলন্ত সিগারেটের স্তিমিত আলোয় তার উদ্ভাসিত মুখের দিকে সভয়ে তাকালো যুবক।

লোহার মত শক্ত একখানা মুষ্টি যেন যুবকের কাঁধের মাংসপেশীকে সাঁড়াশীর মত আঁকড়ে ধরেছে।

উঃ, কী ভয়াবহ আগন্তুকের মুখখানা!

গোল-গোল দুটি চোখের দৃষ্টি সিগারেটের আগুনের আলোয় যেন কী এক অস্বাভাবিক মৃত্যুক্ষুধায় লকলক করছে। সামনের দিকে উপরের পাটির বড় বড় দুটো দাঁত নীচের পুরু ঠোঁটটার উপরে যেন চেপে বসেছে।

একজোড়া পাকানো গোঁফ।

মাথার টুপিটা একদিকে হেলানো।

মুখের খানিকটা অন্ধকারে অস্পষ্ট, খানিকটা স্তিমিত আলোয় ভয়ঙ্কর একটা নিষ্ঠুরতায় শক্ত কঠিন হয়ে উঠেছে।

যুবকের শরীরে স্নায়ু বেয়ে যেন তীব্র ভয়ের স্রোত সিরসির করে বয়ে গেল; সহসা সে একটা দীণ ভয়ার্ত চিৎকার করে উঠল।

আগন্তুক হাঃ হাঃ হাঃ করে তীব্র বাজের মত হেসে উঠল। সেই ভয়ঙ্কর হাসির শব্দ যেন অদ্ভুত একটা বিভীষিকায় চলন্ত গাড়ির শব্দকে ছাপিয়ে অন্ধকার কামরার মধ্যে প্রেতায়িত হয়ে উঠল।

আগন্তুক তখন দুহাত দিয়ে যুবকের কণ্ঠনালী চেপে ধরেছে। একটা গোঁ গোঁ শব্দ।…

যুবকের সমস্ত মুখখানা নীল হয়ে উঠেছে। চোখ দুটো যেন ঠিকরে আঁখিকোটর থেকে বের হয়ে আসতে চায়।

আগন্তুকের সমস্ত মুখাবয়বের উপরে একটা পাশবিক নিষ্ঠুরতার পৈশাচিক আনন্দের ছায়া ঘনিয়ে উঠেছে।

দেখতে দেখতে আগন্তুকের বলিষ্ঠ মুষ্টির নিষ্ঠুর লৌহপেষণে হতভাগ্য যুবক গাড়ির গদিতে এলিয়ে পড়ল।

আগন্তুক আবার খলখল করে পৈশাচিক হাসি হেসে উঠল, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! মরেছে! নিঃশেষে মরেছে!

সহসা হঠাৎ পাগলের মত যুবকের বুকের উপরে ঝাপিয়ে পড়ে তীক্ষ্ণ নখরাঘাতে যুবকের বুকের জামা ছিঁড়তে লাগল। গাড়ির গতি মন্থর হয়ে আসছে না!

পাগলের মতই আগন্তুক যুবকের পেশল উম্মুক্ত বক্ষের দিকে তাকাল।

চোখের দৃষ্টিতে একটা দানবীয় লালসা যেন হিলহিল করে উঠল।

যেমন সে নীচু হয়ে যুবকের বুকের মাংসে তার ধারাল দাঁত বসিয়েছে, খানিকটা তাজা রক্ত তার জিহ্বায় এসে লাগল।

যেন একটা ক্ষুধার্ত নেকড়ে শিকারের বুকে চেপে বসেছে! সহসা এমন সময় গাড়িটা থেমে গেল।

কিন্তু দানবের সেদিকে লক্ষ্য নেই।

আচমকা একটা টর্চের আলোর রক্তিম আভা দানবটার উপরে এসে পড়ল—সঙ্গে সঙ্গে একটা আর্ত চিৎকার-ভূত! ভূত!

চকিতে দানবটা পাশের দরজা খুলে অন্ধকারে লাফিয়ে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

এদিকে সেই চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে আশেপাশের কামরা থেকে লোক এসে জড়ো হয়েছে। ব্যাপার কী! ব্যাপার কী মশাই!

ঐ কামরার মধ্যে ভূতে মানুষ খাচ্ছে! কে একজন ভিড়ের মধ্যে থেকে বললে। আর একজন বললে, স্বপ্ন দেখছেন না তো মশাই!

একজন মন্তব্য করলে, গাঁজায় দম চড়িয়েছেন নাকি? কিন্তু সত্যি সত্যি যখন সকলে বাক-বিতণ্ডার পর গার্ডের সঙ্গে আলো নিয়ে কামরাটার মধ্যে এসে প্রবেশ করল তখন সেখানকার সেই ভৌতিক দানবীয় দৃশ্য দেখে সকলেই চমকে উঠল।

হতভাগ্য যুবকের মৃতদেহ তখনো কামরার গদীর উপরে লুটিয়ে পড়ে আছে। বুকের জামা ছিন্নভিন্ন, রক্তাক্ত। ডান দিককার বুকের মাংস কে যেন নিষ্ঠুরভাবে দাঁত দিয়ে বলে ছিড়ে নিয়ে গেছে।

G.I.P-র পুলিস এল, স্টেশন মাস্টার এলেন, লাশ স্টেশনে নামানো হল, গাড়ি আবার চলল।

পরের দিন সমস্ত দৈনিকে বড় বড় হরফে প্রকাশিত হয়েছে দেখা গেল–

ভয়ঙ্কর নরখাদক দানবের আবিভাব! এই শহরের বুকে এই সভ্য যুগে! হতভাগ্য যুবকের পৈশাচিক মৃত্যু! সেই অদৃশ্য ভয়ঙ্কর নরখাদকের হাতে এই তৃতীয় ব্যক্তির শোচনীয় মৃত্যু!

শহরবাসী অবগত আছেন কয়েক মাসের মধ্যে আলিপুরের অবসরপ্রাপ্ত সুপার ও ডা এন. এন. চৌধুরীর এইভাবে মৃত্যু হয়। তারপর আর একজন বিখ্যাত ডাক্তার অমিয় মজুমদারের মৃত্যু হয়। এই যে শহরের বুকে অবাধে নরহত্যালীলা চলেছে এর শেষ কোথায়? ঘটনাগুলি হতে স্পষ্টই মনে হয়, বুঝিবা কোন নরখাদক এই শহরের বুকে হত্যালীলা করে বেড়াচ্ছে। আবার কি সেই বন্য বর্বর যুগ ফিরে এল? পুলিসের কর্তৃপক্ষ কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছেন? সমগ্র শহরবাসী আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে। এইভাবে যদি নরখাদক আরও কিছুদিন এই শহরের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়, তবে যে শহরবাসীর মধ্যে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির উদ্ভব হবে তা কি পুলিসের কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারছেন না? ইত্যাদি ইত্যাদি।


কিরীটী, সুব্রত মহীতোষবাবু ও তাঁর এক বিশিষ্ট বন্ধু সমর বসু সকলে বিকেলের দিকে মহীতোষের লাইব্রেরী ঘরে বসে চা পান করতে করতে আলাপ-আলোচনা করছিল।

সমরবাবু বলছিলেন, উঃ, এ কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার শহরের বুকে চলেছে বলুন তো সুব্রতবাবু? প্রত্যেক শহরবাসীর মনে যে একটা ভয়ঙ্কর আতঙ্ক উপস্থিত হয়েছে তা কি বুঝতে পারছেন না?

বুঝেই বা কি করছি বলুন, মিঃ বসু! চেষ্টার তো ত্রুটি করছি না।

কিন্তু এও কি সম্ভব? মহীতোষ বলতে লাগলেন, মানুষ তো মানুষের মাংস খেতে পারে না! তবে কি সেই জনকথার কোন রাক্ষসেরই আবির্ভাব হল এই শহরে? ভয়ে রাত্রিতে আমার ভাল করে ঘুমই হয় না আজ দুদিন থেকে।

কিরীটী হাসতে হাসতে বললে, দরজায় খিল দিয়ে শোন তো?

মহীতোষ বললেন, তা আবার বলতে! কথায় বলে সাবধানের মার নেই!

কিন্তু সত্যি আপনার কী মত বলুন তো কিরীটীবাবু? সমরবাবু প্রশ্ন করলেন।

সেও একটা মানুষ, তবে abnormalবলতে পারেন। আমি স্বচক্ষে তাকে দেখেছি। কিরীটী বললে।

সকলে একসঙ্গে চিৎকার করে উঠলেন, সে কি!

হ্যাঁ! কিন্তু আজকের মত এসব আলোচনা থাক। চল সুব্রত। উঠলাম মিঃ চৌধুরী। নমস্কার।

কিরীটী সুব্রতকে নিয়ে ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। ঘরের মধ্যে মহীতোষ ও সমরবাবু বসে।

হঠাৎ মহীতোষবাবু বললেন, এই কিরীটী রায় নোকটা অসাধারণ বুদ্ধিমান বলে শুনেছি, তবে অহমিকা বড় বেশী।

সমরবাবু কোন জবাব দিলেন না, চুপ করে বসে রইলেন।


সেই রাত্রে।

কৃষ্ণা সুব্রতদের ওখানে নিমন্ত্রণ খেতে গেছে। আজ আর ফিরবে না রাত্রে।

কিরীটী একাকী নিজের শয়নঘরে একটা সোফায় হেলান দিয়ে টেবিল-ল্যাম্পের আলোয় গভীর মনোযোগের সঙ্গে ক্রিমিনোলজির একখানি বই পড়ছে। ঘরের দেওয়ালে টাঙানো বড় ঘড়িতে ঢং করে রাত্রি একটা ঘোষণা করলে।

কিরীটী সোফা হতে উঠে পাশের টেবিলে বইটা রেখে আড়মোড়া ভাঙল। উঃ, অনেক রাত্রি হয়ে গেছে! আলোটা নিভিয়ে দিয়ে ভোলা জানলার সামনে এসে দাঁড়াল।

বাইরে চন্দ্রালোকিত নিঃশব্দ রজনী যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। রাস্তার মোড়ে কৃষ্ণচূড়ার গাছের পাতায় পাতায় আলোছায়ার লুকোচুরি।

রাত্রির নিঃশব্দ হাওয়া ঝিরঝির করে বইছে।

সহসা পশ্চাতে কার ভারী গলার স্বরে কিরীটী বিদ্যুতের মত চমকে ফিরে দাঁড়াল।

কিরীটী রায়!

কে?

চাঁদের আলোর খানিকটা ঘরের মধ্যে এসে ঈষৎ আলোকিত করে তুলেছে।

অস্পষ্ট আলোছায়ায় ঘরের ওপাশের দেওয়াল ঘেঁষে কালো ওভারকোট গায়ে মাথার একপাশে হেলানো কালো ফেল্টের টুপি।

কে? কে ও দাঁড়িয়ে? কিরীটী রুদ্ধ নিঃশ্বাসে সামনের দিকে চেয়ে রইল।

চকিতে মনের কোণে ভেসে ওঠে রসা রোডের কিছুদিন আগেকার একটা মধ্যরাত্রির কথা।

বসতে পারি কিরীটীবাবু? আগন্তুক প্রশ্ন করল।

কিরীটী নির্বাক।

কথ বলবার সমগ্র শক্তিই যেন তার কণ্ঠ হতে লুপ্ত হয়েছে। আগন্তুক একটা সোফা টেনে নিয়ে বসল।-সত্যি মিঃ রায়, এই নিশুতি রাত ও বাইরের ঐ চাঁদের আলো-এর মধ্যে যেন একটা রহস্য লুকিয়ে আছে। বসুন, আপনি যে দাঁড়িয়েই রইলেন! কতদূর থেকে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম!

আমার বাড়িতে আপনি ঢুকলেন কি করে? কিরীটী রুদ্ধ বিস্ময়ে প্রশ্ন করল।

আগন্তুক এবারে হাঃ হাঃ করে প্রাণখোলা হাসি হেসে উঠল, কিরীটীবাবু, আপনি অপরাধতত্ত্বের একজন মস্তবড় পণ্ডিত শুনেছি। এককালে আপনার নেশা ছিল অপরাধীদের অপরাধতত্ত্ব বিশ্লেষণ করা। ঘরের দরজাটা একটা লোহার তালা এঁটে বন্ধ করলেই কি গৃহপ্রবেশ অসম্ভব হয়ে গেল? একটা তুচ্ছ লোহার তালাই হল বড় আর মানুষের বুদ্ধিটা একেবার মিথ্যা হয়ে যাবে! যাকগে সেকথা। তালা আটা থাকলেও দরজায় গৃহপ্রবেশের উপায় আমার জানা আছে।

কিরীটী নিঃশব্দে একখানি চেয়ারের উপরের উপবেশন করে গা এলিয়ে দিল।

হ্যাঁ, নিজেকে এমনি করে শিথিল না করতে পারলে কি গল্প জমে কখনও,-বিশেষ এমনি নিশুতি রাতে!…নিশুতি রাত। শুধু আবছা রহস্যময় চাঁদের আলো! কেউ কোথাও জেগে নেই, সবাই ঘুমিয়ে, কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই কেন? কেন-কেন আমি ঘুমোতে পারি। না? চোখ বুজলেই একটা ভয়ঙ্কর বিভীষিকা যেন আমায় অষ্টবাহু মেলে অক্টোপাশের মত আঁকড়ে ধরে! শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। আমি উঠে বসি শয্যার উপরে। শুধু রক্ত-তাজা লাল টকটকে রক্ত যেন অজস্র ঝরনার মত আমার সর্বাঙ্গে আগুন ছড়াতে থাকে। বুকের মধ্যে একটা শয়তান মোচড় দিয়ে ওঠে। একটা লালসা, একটা বন্য বর্বর ক্ষুধা দেহের রক্তবিন্দুতে যেন দানবীয় উল্লাসে নাচতে থাকে। আমি এই হাত দিয়ে গলা টিপে মানুষ খুন করি। এই যে দেখছেন তীক্ষ্ণ ধারালো উপরের দুটো দাঁত, এর সাহায্যে তাজা মানুষের মাংস আমি ছিড়ে খাই। আপনাদের বর্তমান রহস্যের মেঘনাদ, নরখাদক রাক্ষস আমিই। আমাকে ধরুন, আমায় খুন করুন!…আগন্তুক গভীর উত্তেজনায় হাঁপাতে লাগল।

কিরীটী নির্বাক হয়ে শুধু বসে রইল।

হঠাৎ আগন্তুক সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, পারলেন না, হেরে গেলেন। জানি কেউ আমায় ধরতে পারবে না। আমার এই রাক্ষসের মুখোশটা টেনে খুলে কেউ আমায় চিনতে পারবে না। কিন্তু আমি অপেক্ষা করব; তোমার জন্যই আমি অপেক্ষা করব কিরীটী! খুলে রাখব। আমার ঘরের দুয়ার বন্ধু। তুমি এসে প্রবেশ করবে বলে। তারপর দুটি হাত তোমার সামনে প্রসারিত করে দিয়ে বলব, বন্ধু! এই আমাকে ধর! হার মেনেছি!

ঝড়ের মতই আগন্তুক দরজা ঠেলে ঘরের বাইরে চলে গেল।

অন্ধকার ঘরের মধ্যে একা শুধু বসে রইল তীক্ষ্ণ বুদ্ধিশালী কিরীটী রায়।

ঘরের দেওয়াল-ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত্রি দুটো ঘোষণা করল।

কিরীটী চোখ দুটো একবার রগড়ে নিল। এতক্ষণ একটা স্বপ্ন দেখছিল না তো!


হঠাৎ সেদিন বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রীটে এক বিখ্যাত পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতার দোকানে। প্রায় দীর্ঘ নয় বৎসর বাদে সহপাঠী ডাঃ অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে কিরীটীর দেখা হয়ে গেল।

ডাঃ অমিয় চক্রবর্তী কলিকাতা ইউনিভারসিটির একজন নামকরা ছাত্র। বি. এসি পাস করে সে কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ থেকে এম. বি. পাস করে। পরে মনোবিজ্ঞানে এম. এ. পাস করে। বিলাতে তিন বৎসরকাল অধ্যয়ন করে সাইকাব্রিকস্ট হয়ে আসে। যুদ্ধ বাধবার মাত্র মাস ছয়েক আগে সে ফিরে আসে।

অত্যন্ত খেয়ালী প্রকৃতির। এতদিন বসেই ছিল, হঠাৎ আবার কী খেয়াল হওয়ায় কলকাতায় মাস দুই হল এসে একটা ক্লিনিকস্ খুলে প্র্যাকটিস শুরু করেছে। দুমাসেই বেশ নাম হয়েছে তার শহরে।

বহুকাল বাদে দুই বন্ধুর দেখা। দুজনে গিয়ে এক রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করল, চা খেতে খেতে নানা সুখ-দুঃখের গল্প চলতে লাগল।

কলেজ-লাইফে কিরীটী ছিল অত্যন্ত দুর্ধর্ষ। আর অমিয় ছিল শান্তশিষ্ট ভাবুক প্রকৃতির।

কিরীটীকে অমিয় কিরাত বলে ডাকত, আর কিরীটী অমিয়কে কুনো বলে সম্বোধন করত।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অমিয় বললে, তুই তো আজকাল মস্ত বড় একজন গোয়েন্দা হয়ে উঠেছিস কিরাত। কাগজে কাগজে তোর নাম।

কিরীটী জ্বলন্ত সিগারেটে একটা মৃদু টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে গম্ভীর স্বরে বললে, হ্যাঁ, গোয়েন্দা নয়, রহস্যভেদী। কিন্তু তোর খবর কি বল তো? সত্যিই ডাক্তারী করবি নাকি? চিরদিন তো রবি ঠাকুরের কবিতা আর যত রাজ্যের মনোবিজ্ঞানের বই পড়ে কাটালি!

ডাক্তারী করব মানে? রীতিমত শুরু করেছি। বিনি ফিসে একটা মাথা খারাপের গোষ্ঠী পাওয়া গেছে।

মানে?

মানে আর কি! বালিগঞ্জে আমাদের পাশের বাড়িতে তারা থাকে। সমস্ত ফ্যামিলিটাই পাগল, কতা থেকে শুরু করে ছেলেগুলো পর্যন্ত।

বলিস কী? কতা ক্ষ্যাপা, গিন্নী ক্ষ্যাপা, পাগল দুটো চেলা, সেথা সাত পাগলের মেলা!

আর বলছি কী! সামনের রবিবারে আয় না, আলাপ করিয়ে দেব ভদ্রলোক আবার শীঘ্রই পুরীতে হাওয়া বদলাতে যাচ্ছেন। ভদ্রলোকের নাম রায়বাহাদুর গগনেন্দ্রনাথ মল্লিক। জেল ডিপার্টমেন্টে মোটা মাহিনায় চাকরি করতেন। কিছুকাল আলিপুর জেলের ও পোর্টব্লেয়ারে সুপারিন্টেন্টে ছিলেন। গত মহাযুদ্ধে লোহালক্কড়ের ব্যবসা করে প্রচুর অর্থও জমিয়েছিলেন। অবিবাহিত। বয়স এখন বোধ করি ষাটের কাছাকাছি হবে। সংসারে পোষ্যের মধ্যে চারটে ভাইপো। এই ভাইপোদের শিশুবয়সে মা-বাপ মারা যায় এবং এরা এদের এই বুড়ো কাকার কাছেই মানুষ।

বড় রণধীর বি.এস-সি পাস করে বাড়িতেই বসে আছে। বছর দুই হল বিবাহও করেছে, ছেলেমেয়ে নেই। বয়স প্রায় ত্রিশের মত। মেজ সমীর আই. এ. পর্যন্ত পড়ে আর লেখাপড়া করেনি। বাড়িতে বসে আছে। বয়স প্রায় সাতাশ। সেজ অধীর, বয়স চব্বিশ-পঁচিশ হবে, বি. এ. পাস করে বসে আছে। সবার ছোট কিশোর, বছর চৌদ্দ বয়স, বাড়িতেই পড়াশুনা করে।

বুড়ো গগনেন্দ্রনাথ অসুস্থ, হার্টের ব্যারামে ভুগছেন। সর্বদাই বাড়িতে বসে থাকেন। অত্যন্ত খিটখিটে বদমেজাজী, অসাধারণ প্রতিপত্তি এই বুড়োর ভাইপোদের উপর।

ভাইপোরা বাড়ি থেকে এখনও এক পাও কোথাও বের হয় না। সর্বদাই বাড়ির মধ্যে বুড়োর দৃষ্টির ভিতরে আছে।

কারও বাড়িতে জোরে কথা বলবার উপায় নেই, হাসবার উপায় নেই। সবাই গম্ভীর চিন্তাযুক্ত। একটা কঠিন শাসন-শৃঙ্খলা যেন বাড়ির সব কটি প্রাণীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধন দিয়ে পঙ্গু নিশ্চল করে রেখেছে।

ভাইপোরা খাবেদাবে, ঘুরবে, বেড়াবে, দাঁড়াবে, চলবে, ঘুমুবে সব বুড়োর সৃষ্টিছাড়া বাঁধাধরা আইনে। এতটুকু কোন ব্যতিক্রম হবে না এমনি কঠোর শাসন বুডোর।

সবার ছোটটাই রীতিমত hallucination-এ ভুগছে।

বাড়ির মধ্যে কেবল একমাত্র বড় ছেলের বৌ নমিতা দেবী যেন ওদের গণ্ডির বাইরে।

এক বিচিত্র আবহাওয়া! বিচিত্র পরিস্থিতি!

বুড়ো হঠাৎ একদিন রাত্রে অসুস্থ হয়ে পড়ায় পাশেই থাকি বলে বাড়িতে আমার ডাক পড়েছিল। কী জানি কেন বুড়ো আমাকে যেন একটু স্নেহের চোখেই দেখে।

একমাত্র আমাকেই সকলের সঙ্গে মিশতে দেয়।

কিন্তু ছেলেগুলো দীর্ঘকাল ধরে ঐ অদ্ভুত শাসনগণ্ডির মধ্যে থেকে থেকে মানসিক এমন একটা সদা-সশঙ্কিত ভাব হয়েছে যে, কারও সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে বা দুদণ্ড আলাপ করতে পর্যন্ত ভয়ে শিউরে ওঠে।

কী করে যে অতগুলো প্রাণী একটা কুৎসিত গণ্ডির মধ্যে অমন ভাবে দিনের পর দিন আটকে রয়েছে ভাবলেও আশ্চর্য হয়ে যাই।

আশ্চর্য তো! কিরীটী বললে, এ যুগে এও সম্ভব?

Mentally সবকটা লোকই ও-বাড়ির unbalanced, সকলেই একটা মানসিক উত্তেজনার মধ্যে আছে অথচ বিদ্রোহ করবার মত কারও সাহস নেই।

কিরীটী বললে, আমিও বর্তমানে একটা হোমিসাইডাল ম্যানিয়াকের পিছনে ঘুরছি ভাই। দেখি আসছে রবিবার চেষ্টা করব যেতে।


কিন্তু কিরীটীর আর রবিবার যেতে হল না।
সহসা শনিবার সকালে বন্ধুর এক চিঠি পেল।

পুরী-স্বর্গধাম
১৩ ডিঃ, ৪৩

প্রিয় কিরাত,

হঠাৎ গগনবাবুর অনুরোধে পুরী চলে এলাম। সকলে স্বর্গধাম হোটেলে এসে উঠেছি। বেশ লাগছে। কলকাতার ধুলো বালি রোগের বাইরে প্রকৃতির এই গম্ভীর পরিস্থিতিতে মনের সব কটি দুয়ারই যেন খুলে গেছে। সকালে বিকালে শুধু সমুদ্রে বিরাট রূপ নয়নভরে দেখি। কখনও ভয়ঙ্কর, কখনও স্নিগ্ধ, কখনও শান্ত….সে এক অপূর্ব। আয় কটা দিন থেকে যাবি, আমি একটা আলাদা ঘর নিয়েছি, সেখানেই থাকতে পারবি। আসবি তো রে! ভালবাসা রইল।

তোর কুনো

Pages: 1 2 3 4
Pages ( 1 of 4 ): 1 234পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *