Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কাগজে রক্তের দাগ || Syed Mustafa Siraj

কাগজে রক্তের দাগ || Syed Mustafa Siraj

মেয়েটি বারে গান গাইত

মেয়েটি বারে গান গাইত। হাতের মুঠোয় স্পিকার। হাল্কা-পলকা মেয়েটি ফুলের ওজন। গলায় স্টার গায়িকার প্রতিধ্বনি। বারটিও ছিল ছোট্ট। ছিমছাম, রঙচঙে, গোছানো। মিঠে, নরম আলোয় সিগারেটের ধোঁয়া কুয়াশার মতো দুলত। এখানে যারা আসত, তারা কেউ জাত-মাতাল নয়। নেহাত পাতি, ছিচকে। কোনও মাঝারি কারবারি কি তার তরুণ প্রজন্ম। দৈবাৎ কোনও একলা হয়ে-পড়া বুড়ো। একঝক ছাত্র কি কোন পাড়ার মস্তান। কদাচিৎ একরোখা প্রেমিকের টানে কোনও এরিয়া প্রেমিকা, এক চুমুকের পরই যাকে সামলানো কঠিন হতো প্রেমিকের। একলা বুড়ো মাতাল কোনার দিকে বসে আপন মনে শব্দহীন হাসত।

ছোট্ট ডায়াসে বাজত স্প্যানিস গিটার, অ্যাকর্ডিয়ান, জিপসিদের ঝুমঝুমি। মেয়েটি একটু নাচের ভঙ্গি করত। জমাটির সময় শোনা যেত মাতালদের তীক্ষ্ণ শিস, হুই, হই। তবে সামলানোর জন্য একটি লোক ছিল। তাগড়াই ): না। মস্ত গোঁফ। নতুন মাতাল বেগড়বাই করলে সে ইঁদুরছানার মতো তুলে ফুটপাতে ফেলে দিত।

রাত দশটায় মেয়েটিকে নিতে আসত তার বাবা। সত্যিই কি বাবা? বার মালিকের সন্দেহ ছিল। কিন্তু কে কার বাবা, এ নিয়ে তার মাথা ঘামানোর মানে হয় না। কম টাকায় তিন ঘণ্টার গান, এই তো যথেষ্ট। সে জানত, তাকে মানুষদের গার্জেনগিরি ফলাতে দেওয়া হয়নি। সে কোনও মরালিটির জিম্মাদার নয়। রাষ্ট্র তাকে নাগরিকদের মাতাল করার অধিকার দিয়েছে। মদ খাওয়া ইমমরাল হলে যত বেশি ইমমরালিটি ছড়ায়, তত তার লাভ। তবে মদ খাওয়া সে ইমমরাল মনে করে না। যত দিন যাচ্ছে, সমস্যা বাড়ছে। মানুষজন যদি কিছুক্ষণ সমস্যা ভুলে থাকতে চায়, মন্দ কী? মদের সঙ্গে অপরাধের কোনও সম্পর্ক নেই, এই তার শক্ত লজিক। ওই গাইয়ে মেয়েটি যদি খারাপ হয়ে যায়, তার সঙ্গেও এই বারের সম্পর্ক সে স্বীকার করে না। কারণ বারে গান করে না, এমন মেয়েরাও তো খারাপ হয়ে যায়।

মেয়েটি বুঝতে পারছিল, বারের মালিক তাকে কম টাকা দেয়। সে নিজের দামও বুঝতে পারছিল। তাই অনেক সেধে ইদানীং যাতায়াতের ট্যাক্সিভাড়াও আদায় করত। দৈত্যের মতো দেখতে সেই প্রহরী যাওয়ার সময় ট্যাক্সি ধরে দিত। হাত নেড়ে বলত, যাই।

মেয়েটি থাকত এঁদো শহরতলিতে। টালির বাড়িগুলো ছিল অসম্বন্ধ, ঘন। তার ভেতর জরাজীর্ণ একতলা কিছু দালান। একটু দূরে ভাঙা গির্জা আর কবরখানা। তারপর রেলইয়ার্ড। মেয়েটি থাকত একটা দালানে। কার্নিশে অশ্বথচারা, দেয়ালের বাইরে ফাটল, নগ্ন ইট। মেয়েটি ভেতরটা সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর করতে পেরেছিল।

আর বার-মালিক ঠিকই ধরেছিল, প্রৌঢ় ঢ্যাঙা লোকটি তার বাবা নয়। সে তার বাবার এক বন্ধু। ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। পাশের ঘরের ভাড়াটে। মেয়েটির পরিবারে ছিল শুধু তার মা। মায়ের অনুরোধেই মিস্ত্রি লোকটি এসকর্ট হতো এবং পাঁচটা করে টাকা পেত। মন্দ কী!

এমন এক মেয়ে, তার প্রেমিক থাকবে না, তা হয় না। বস্তি এলাকার সব উঠতি তরুণ তার কাছে প্রেম দাবি করত। তারা জানতে পেরেছিল, মেয়েটি বারে গান গাইতে যায়। প্রেম না পেয়ে তারা কেউ কেউ টাকা ধার চাইত অর্থাৎ দাবি করত। মেয়েটি স্বপ্ন দেখত, সে একদিন উঠে যাবে ভদ্র এলাকার কোনও ফ্ল্যাটে। আয়নায় নিজেকে সে দেখত উজ্জ্বল সুন্দর। মুগ্ধ হয়ে ভাবত, তাকে এখানে মানায় না। কেন সে এখানে পড়ে আছে? আর কতকাল তাকে এই আবর্জনার গাদায় পচে মরতে হবে? বার-মালিক জানে না, সে যে-সব গান গায়, তা আসলে তার নিজস্ব প্রার্থনা! যে পরিচ্ছন্ন, শোভন, পেলব স্তরে সে পৌঁছতে চায়, ওইসব গান দিয়ে সেই স্তরকে সে ছুঁত। আর গান জিনিসটাও তত জীবনের ওইরকম একটা দিকে টুকরো-টাকরা অংশ।

আবার জীবনেরই আরও একটা দিক আছে। সেই দিকেরও টুকরো-টাকরা অংশ আছে, যা কুর, ভয়াল। ভুল পা ফেলে দৈবাৎ সেখানে পৌঁছুলেই সর্বনাশ। জীবনটা মৃত্যু হয়ে যায়।

মেয়েটি সেই ভুল করে বসল। তার মৃত্যু হলো। ক্রুর ভয়াল মৃত্যু। প্রচুর রক্তে সবুজ ঘাস লাল হয়ে গেল!……….

.

০১.

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার কাগজটির ওপর আতস কাচ রেখে হরফগুলো দেখতে দেখতে বললেন, প্রত্যেকটি শব্দ যত্ন করে লেখা। বাছাই করা শব্দ। বাক্যগুলোর মধ্যে ছন্দ আছে। একসময় হয়তো কবিতা লেখার অভ্যাসও ছিল। ডার্লিং! এই লেখাটির লেখক খাঁটি দার্শনিক।

ডিটেকটিভ ডিপার্টের ডেপুটি কমিশনার অরিজিৎ লাহিড়ী হাসলেন। আপনার দর্শন-টশনে আগ্রহ আছে, জানি। বাট দিজ ইজ আ মার্ডার!…

কোনও-কোনও মার্ডারে দার্শনিকতা থাকে, অরিজিৎ! কর্নেল টেবিলে কাগজটির ওপর আতস কাচ চাপা দিয়ে বললেন। মুখে গাম্ভীর্য। যাই হোক, এই কাগজটা কোথায় পেলে?

গৌরীর ব্লাউসের ভেতর রাখা পার্সে! তাই বৃষ্টিতে ভেজেনি।

গৌরী?

মেয়েটির নাম। নিক নেম টিনি। বস্তি এরিয়ায় টিনি নামেই ওকে সবাই জানত।

কর্নেল সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, বডি কী অবস্থায় ছিল?

উপুড় হয়ে। একটা হাত কবরের ওপর। কবরটা ব্রিটিশ আমলের। ক্রসটা ভাঙা। ক্রসে এবং কবরে রক্তের আভাস আছে। বৃষ্টি হলেও বোঝা যায়।

ঘাস ছিল বডির নিচে?

ইয়া। অরিজিৎ পাইপ বের করলেন। মর্গের রিপোর্ট অনুসারে মৃত্যু হয়েছে। রাত এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে। ডান কাঁধের হাড় কেটে গলা অব্দি একটা আঘাতের চিহ্ন। আরেকটা গলার পেছনে। তবে মাথাটা বডির সঙ্গে……… হাত তুলে কর্নেল দ্রুত বললেন, এনাফ ডার্লি! সত্যিই ক্র ভয়াল মৃত্যু।

অরিজিৎ পাইপে তামাক ঢুকিয়ে জোরে হাসলেন। অবজেক্টিভ ডেসক্রিপশন, কর্নেল। বুঝতে পারছি, শূন্যোদ্যানের মালী ভদ্রলোক এবার তার ফুলগুলোর মতোই কোমল হয়ে উঠেছে!

তোমার এই চমৎকার কবিত্ব সত্ত্বেও তুমি পুলিশে চাকরি করো! কর্নেল চুরুট ধরালেন লাইটার জ্বেলে। অরিজিতের পাইপেও তামাক ধরিয়ে দিলেন। অবজেক্টিভ ডেসক্রিপশন বললে! অর্থাৎ যা যেমনটি, তা তেমনটি করে বর্ণনা, ওকে। তা হলে ভোজালির আঘাত?

ইয়া! না হলে হাড় কাটত না। ভোরের দিকে ঝিরঝিরে বৃষ্টিটাই অনেক ক্লু নষ্ট করে দিয়েছে।

কর্নেল ধোঁয়ার রিং পাকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে বললেন, যে লোকটি ওকে বার থেকে আনতে যেত…….

গত রাতে সে যায়নি। টিনির মা বলেছেন, যুধিষ্ঠিরের সারাদিন জ্বর। টিনি তার মাকে বলে গিয়েছিল, কারও যাওয়ার দরকার নেই। সে ঠিকই চলে আসতে পারবে। কিন্তু এল না। সকাল সাড়ে সাতটায় কবরখানার কেয়ারটেকার মিঃ গোমেশ টিনির বডি দেখতে পান। তিনি থানায় খবর দেন।

যুধিষ্ঠিরের সত্যিই জ্বর হয়েছিল কি না! টিনির মা কী বলেছেন, সেটা কথা নয়।

ঠিক। তাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। একদিনের জ্বর বলে নাকি ডাক্তারের কাছে যায়নি। অরিজিৎ একটু হাসলেন। আজ অবশ্য তার জ্বরটর নেই।

জেরার মুখে কিছু জানতে পেরেছ?

তেমন কিছু না। শুধু বলেছে, পাড়ার মস্তানদের কাজ। এদিকে সোকলড মস্তানগুলো পাড়া ছেড়ে বেপাত্তা। খোঁজা হচ্ছে। পেয়ে যাবখন। কিন্তু………

কর্নেল তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, বারের মালিক কী বলছেন?

টিনি গত রাতে যায়নি বারে। তিন ঘণ্টায় ওর মজুরি ছিল মাত্র তিরিশ টাকা আর ট্যাক্সিভাড়া কুড়ি টাকা।

বাড়ি থেকে কখন বেরিয়েছিল?

পাঁচটায়। রোজই ওই সময় বেরুত সেজেগুঁজে। অরিজিৎ একটু গম্ভীর হলেন। সাধারণ মার্ডার কেস বলা যেত। কিন্তু ওই কাগজটা সব জট পাকিয়ে তুলেছে।

কর্নেল হাসলেন। কাগজটা যেন টিনির জীবনী! যেন জ্যোতিষীর কোষ্ঠীবিচার! বলে একটু নড়ে বসলেন। কাগজটাতে আঙুলের ছাপ থাকা উচিত। তোমরা…

বাধা দিলেন অরিজিৎ। উই আর নট সো ফুল, কর্নেল! ফরেনসিক ল্যাবে ছাপ তুলে রাখা হয়েছে। আমরা ওতে হাত দিইনি দেখামাত্র।

কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন। ভৃত্য ষষ্ঠীচরণ পর্দার ফাঁকে উঁকি দিল। বাবামশাইয়ের এমন হাসি শুনলেই সে টের পায়, একটা সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে বা ঘটতে চলেছে। পুলিশি আঁতে ঘা লেগেছে, ডার্লিং! বলে ষষ্ঠীর দিকে চোখ কটমটিয়ে তাকালেন। ষষ্ঠীচরণ অদৃশ্য হলো। কর্নেল হাঁকলেন, কফি!

অরিজিৎ কপট স্মার্টনেস দেখিয়ে বললেন, লাগবে না। আপনার কাছে যাচ্ছি শুনেই ডিপার্টমেন্টের পাকা পাকা মুখে বাঁকা হাসি ফুটেছে।

কাগজটাতে আসা করি টিনির আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি?

ডি সি ডি ডি লাহিড়ীসায়েবের চোখে একটু বিস্ময় ঝিলিক দিল। যায়নি। ওটা প্ল্যান্টেড। পার্সের ভেতর কেউ ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে।

যে ঢুকিয়েছে, আশা করি, তাকেই খুনী ভাবছ না?

ভাবছি। সেটাই তো স্বাভাবিক।

কাগজে রক্তের দাগ……মাই গুডনেস! কর্নেল হঠাৎ টেবিলে ঝুঁকে গেলেন। আতস কাচের সাহায্যে আবার কাগজটা পরীক্ষা করতে করতে বললেন, কাগজটা নিউজপ্রিন্ট। গোটানো অবস্থায় নিউজপ্রিন্ট কিনতে পাওয়া যায়। আজকাল বিয়েবাড়িতে টেবিলে লম্বা করে নিউজপ্রিন্ট বিছিয়ে দেওয়া হয় দেখেছি। তার ওপর সুখাদ্যের প্লেট। যাই হোক, নিউজপ্রিন্টে ডটপেনে লেখা। ওপরের দিকটা চমৎকার ভাঁজ করে ছেঁড়া হয়েছে। কিন্তু নিচের দিকটা টেনে ছেঁড়া। বেঁকে গেছে। রক্তের দাগ ছিল কি?

অরিজিৎ সহাস্যে বললেন, বৃদ্ধ ঘুঘু মহাশয়! আপনার খুরে খুরে দণ্ডবৎ। ইউ আর ড্যাম রাইট। ছেঁড়াটা অবশ্য ফরেনসিক ল্যাবের ডঃ মহাপাত্রের উত্তেজিত হাতের কীর্তি! আপনি তো জানেন আপনার বন্ধুকে। রক্ত দেখলেই কেমন একসাইটেড হয়ে ওঠেন। একেবারে বাঘের মতো!

ষষ্ঠীচরণ চুপচাপ কফির ট্রে রেখে গেল। কর্নেল তাকে বললেন, ছাদে কিছু ঘটেছে। দেখে আয়!

যষ্ঠী দাঁত বের করে বলল, কাকের ঝগড়া বাবামশাই! কখন থেকে শুনছি।

কর্নেল তেড়ে উঠলেন। শুনছিস আর চুপ করে আছিস হতভাগা?

ষষ্ঠী সিঁড়ির ওপর উধাও হয়ে গেল। অরিজিৎ বললেন, আপনার সেই অ্যারিজোনার ক্যাকটাসটির কী অবস্থা? ফুল ধরাতে পেরেছেন তো?

না ডার্লিং! কলকাতা বড় সাংঘাতিক হয়ে উঠেছে দিনে-দিনে। বাতাসে বিষ…….

এবং ঘাসেও রক্ত!

এবং কাগজেও!

অরিজিৎ কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, হু, কাগজেও। এবং সেটাই প্রবলেম। এই লেখা যে লিখেছে, আমার ধারণ সে সাহিত্যিক-টাহিত্যিক না হয়ে যায় না!

টাহিত্যিকটি কী ডার্লিং?

জাস্ট কথার কথা।

ও নো নো! কর্নেল তার টেকো মাথাটি জোরে নেড়ে বললেন, কথার কথা নয়। মনে হচ্ছে, এই কেসটিকে জটিল করে ফেলেছে ওই টাহিত্যিক জিনিসটাই। এনিওয়ে! এটার একটা জেরক্স কপি আমার চাই। আর… হুঁ, বারটির নামধাম?

মুনলাইট।

চিনি। মালিক ভদ্রলোককেও চিনি।

বলেন কী!

কর্নেল হাসলেন! তোমার কথার সুরে মনে হচ্ছে আমি এই বুড়ো বয়সে আবার ড্রিংক ধরেছি। অরিজিৎ, তুমি গোয়েন্দা অফিসার। তোমার মাথায় আসা উচিত ছিল মুনলাইটের কাছেই দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিস। এবং……..

অরিজিৎ দ্রুত বললেন, আই নো, আই নো। দা রিপোর্টার জয়ন্ত চৌধুরি! আপনার প্রতেজে!

জয়ন্ত পাঞ্জাবে আছে। ও এখানে থাকলে ভাল হতো।

অরিজিৎ লাহিড়ী ঘড়ি দেখে দ্রুত কফি শেষ করলেন। চলি! সি পির ঘরে কনফারেন্স। চারটে বেজে গেল।

.

কবরখানার জরাজীর্ণ ফটকের সামনে লাল রঙের ল্যান্ডরোভার গাড়িটি দেখে আংলো-ইন্ডিয়ান খ্রিস্টান কেয়ারটেকার গোমেশ একটু ভড়কে গিয়েছিলেন। সকাল থেকে পুলিশের জেরায় জেরবার তিনি। গাড়ি থেকে কর্নেল নামলে তিনি স্মার্ট হয়ে সেলাম ঠুকলেন। ফরেনার ভেবেই।

।কর্নেল এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে ইংরেজিতে বললেন, হ্যাল্লো মিঃ গোমেশ!

অন্তরঙ্গ করমর্দনে খুশি কেয়ারটেকার বললেন, মহাশয় কি বিদেশী?

কখনই না মিঃ গোমেশ! খাঁটি স্বদেশী।

আপনাকে বিদেশী দেখায়। গোমেশ একটু অবাক হয়ে বললেন, আপনি আমার নাম জানেন! দুঃখিত মহাশয়। আমার এটা আগেই ভাবা উচিত ছিল, গোমেশ জেভিয়ার এই কবরখানার ভূত বলে পরিচিত। হাঃ হাঃ হাঃ! তবে কি জানেন, আর আমার মাথার ঠিক নেই। এই কবরখানা ক্রমশ শয়তানের আড্ডা হয়ে গেছে। বছরে গড়ে তিনটে করে খুনখারাপি। মহাশয়, এই কবরখানা ছিল নন্দনকানন। আপনি লক্ষ্য করুন! কত গাছ! কত ফুল! অথচ হয়ে গেছে একটা জঙ্গল! সব দামী মার্বেল পাথরের ফলক উপড়ে নিয়ে গেছে। সমস্ত দামী কাঠের ক্রস পর্যন্ত! পুলিশ কিছু করে না।

কর্নেল ভেতরে ঢুকে বললেন, আপনি কি এখানেই থাকেন?

হ্যাঁ, স্যার। গির্জার পাশে এই ঘরটাতে। ভাবতে পারেন? একা একজন লোক এই কবরখনায় বাস করে। আমার স্ত্রীর কবর ওইটে। আমার দুই ছেলে তিন মেয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে গেল। আমি যেতে পারলাম না। গোমেশ করুণ মুখে একটু হাসলেন। ওরা আমাকে ডাকে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি ডাকে মৃতেরা! ব্যাপারটা কল্পনা করুন মহাশয়! মৃতেরা আমাকে ডাকে। আমি……

কর্নেল তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ভাই গোমেশ! বলছিলে, আজ মাথার ঠিক নেই। কিছু কি ঘটেছে? তারপর একটি দামী চুরুটও উপহার দিলেন।

ভাই সম্বোধনে এবং চুরুটটি পেয়ে বিগলিত কেয়ারটেকার বললেন, খুন মহাশয়! সাংঘাতিক খুন!

নিজে চুরুট ধরিয়ে এবং গোমেশেরটি ধরিয়ে দিয়ে কর্নেল বললেন, বলেন কী! কোথায়? কে খুন হলো?

উত্তেজিত কেয়ারটেকার তার হাত ধরে টানলেন। আসুন, আসুন! দেখাচ্ছি। হতভাগিনী মেয়েটা! আমি জানতাম, ওকে এই কবরখানার মৃতেরা ডেকেছে। রোজ বিকেলে কবরে ফুল দেবার ছলে ওখানে এসে বসে থাকত। আমার চোখ, মহাশয়! বুঝতে পেরেছিলাম, ও কখনই খ্রিস্টান নয়।

এবড়ে-খেবড়ো সংকীর্ণ পথ। দুধারে গাছ, ঝোপঝাড় আর কবর। শুধু কবর। পাখি ডাকছে। ফুলের ঝোপে বসে আছে প্রজাপতি। বিকেলের রোদ ফিকে হয়ে এসেছে। অক্টোবরের দিনশেষে আকাশে ঘন মেঘ। হয়তো একটু পরেই বৃষ্টি এসে যাবে। কর্নেল প্রজাপতিটার দিকে তাকিয়ে আনমনে বললেন, রোজ বিকেলে এখানে আসত মেয়েটি–মানে, যে খুন হয়েছে?

আবার কে? গোমেশ উৎসাহে হাঁটতে হাঁটতে বললেন। ওদিকটায় ব্রিটিশ আমলের অনেক বিখ্যাত মানুষের কবর আছে। মেয়েটা যে কবরে বসত, সেটা কার জানেন? ক্রিস্টিনা ম্যাকবেরির। লর্ড কার্জনের আত্মীয়া। তখনকার এক মেয়েকবি। ব্রিটেনের পত্রিকায় তাঁর কবিতা ছাপা হতো। কল্পনা করুন, মহাশয়!

মেয়েটি কি একা বসে থাকত?

গোমেশ চাপাস্বরে বললেন, আপনাকে বলা চলে। আপনি ভদ্রলোক। পুলিশকে বলিনি। আপনি তো জানেন মহাশয়, পুলিশকে কিছু বলা মানেই ফাঁদে পা দেওয়া। আপনাকেই ওরা খুনী সাজাবে। কেন? তার উত্তরে বলব, যেভাবে হোক, পুলিশ কাউকে খুনী সাব্যস্ত করতে পারলেই ওপরওলার কাছে প্রশংসিত হবে।

কর্নেলও চাপা স্বরে বললেন, ঠিক ঠিক। পুলিশকে বলেননি, ভাল করেছেন।

কেয়ারটেকার ফিস ফিস করে বলেন, ওই ভাঙা পাঁচিল গলিয়ে ওর প্রেমিক আসত।

ওদিকটায় তো রেলইয়ার্ড?

হ্যাঁ, কেয়ারটেকার হঠাৎ থেমে বললেন, এই কবর। মার্বেল ফলকটা নেই। ওই দেখুন, ঘাসের ভেতর রক্তের ছাপ। গত রাতে মেঘ সরে জ্যোৎস্না উঠল। আপনাকে আগেই বলেছি, মৃতেরা আমাকে ডাকে। আমি ঘুমোতে পারি না। অস্থির হয়ে কবরখানার ভেতর ঘুরে বেড়াই। মৃত আত্মাদের সঙ্গে কথা বলি। বিশ্বাস করুন।

কর্নেল বুঝতে পারছিলেন, লোকটি ছিটগ্রস্ত। সেটা স্বাভাবিক। বহু বছর ধরে কবরখানায় থাকলে এ বয়সে মাথার ঠিক না থাকারই কথা। কর্নেল সায় দিলেন। না, না। বিশ্বাস করছি। আমি জানি মৃতেরা জীবিতদের সঙ্গে কথা বলতে চায়। দরকার শুধু দীর্ঘকাল ঘনিষ্ঠতার।

সুন্দর বলেছেন মহাশয়! আপনি জ্ঞানী।

কাল রাতে জ্যোৎস্নায় এখানে দুজনকে দেখেছিলেন?

হ্যাঁ!

আপনি কী করলেন?

কী করব? কেয়ারটেকার ম্লান হাসলেন। আমার হাতে অবশ্য টর্চ ছিল। কিন্তু আমার পক্ষে কি প্রভু যীশুর অনভিপ্রেত পাপ কাজ দেখা উচিত হবে? তা ছাড়া এ অবস্থায় পুরুষটির মস্তান হওয়াই স্বাভাবিক। সাধারণ যুবকদের এ সাহস হবে না। কাজেই আমাকে সে ভোজালির কোপ মারতই, যেভাবে মেয়েটিকে মেরেছিল।

তারপর আপনি কী করলেন?

আমি দূরে সরে এলাম।

তখন সময় কত?

প্রায় রাত বারোটা। ঘড়ি দেখিনি।

কোনও আর্তনাদ শুনেছিলেন?

নাঃ! আমি ওই জীর্ণ গির্জার সামনে প্রার্থনা করছিলাম। প্রভু! পাপীদের হাত থেকে এই পবিত্র স্থানকে রক্ষা করুন!

আলো কমে এসেছে আরও। পুবের আকাশে মেঘ আরও গাঢ় হয়েছে। কর্নেল কবরটির দিকে ঝুঁকে পড়লেন।

ছিটগ্রস্ত কেয়ারটেকার এতক্ষণে একটু চমকে উঠে বললেন, কী দেখছেন আপনি?

মানুষের রক্ত, গোমেশভাই!

আপনি কি খ্রিস্টান?

কেন?

আমি তাই ভেবেছিলাম। আপনাকে…ঈশ্বর! ঈশ্বর! আপনি পুলিশের গোয়ন্দা নন তো?

না ভাই গোমশ!

বৃদ্ধ কেয়ারটেকার সন্দিগ্ধ দৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। চুরুট থেকে একদলা ছাই ঝরে পড়ল।

কর্নেল কবরটার চারপাশে ঘুরে ভাঙা দেয়ালটার দিকে এগিয়ে গেলেন। গোমেশ এবার তার পেছনে গিয়ে প্রায় আর্তনাদের ভঙ্গিতে বললেন, ঈশ্বরের দোহাই! আপনি কে?

আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

আপনি কী দেখে বেড়াচ্ছেন?

রেলইয়ার্ডটা দেখতে ইচ্ছে করছে। আপনার ভাবনার কারণ নেই। ভাঙা অংশটা কোমরসমান উঁচু। সেখানে দাঁড়িয়ে কর্নেল জ্যাকেটের পকেট থেকে বাইনোকুলার বের করলেন। রেলইয়ার্ড দেখতে থাকলেন।

গোমেশ আরও অবাক হয়ে কাছে গিয়ে বললেন, বাইনোকুলারে কী দেখছেন মহাশয়?

পাখি! পাখি দেখা আমার নেশা, গোমেশভাই!

অনিচ্ছাসত্ত্বেও কেয়ারটেকার খিকখিক করে হেসে উঠলেন। ওদিকে পাখি নেই! শকুন আছে। মহাশয়, পাখি দেখতে হলে এদিকে ঘুরুন। দেখুন, দেখুন! গাছে-গাছে কত পাখি! চিড়িয়াখানা মহাশয়!

গোমেশভাই! এক মিনিট! সিগন্যাল-পোস্টের মাথায় একটা অদ্ভুত জাতের শকুন দেখতে পাচ্ছি! আপনি দয়া করে আমার গাড়িটার কাছে যান। আপনাকে পুরস্কৃত করা হবে। আজকাল বড্ড গাড়িচোরের উপদ্রব?

পুরস্কারের লোভেই কেয়ারটেকার হন্তদন্ত হয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন।

কর্নেল ভাঙা পাঁচিল ডিঙিয়ে ওধারে নামলেন। ঝোপঝাড়, খানাখন্দ, ঘন ঘাস। তারপর রেলইয়ার্ডের কাঁটাতারের ঘেঁড়াখোঁড়া বেড়া। এখানে ওখানে ওয়াগন দাঁড়িয়ে আছে। কাছে একটা ওয়াগন লাইনছাড়া হয়ে মাটিতে আটকে গেছে। প্রকৃতি তাকে যথেচ্ছ শাস্তি দিচ্ছে। তবে ওয়াগানব্রেকারদের উপযুক্ত ঘাঁটি বলা চলে।

একটু দূরে একটি শান্টিং ইঞ্জিন হুই দিতে দিতে চলাফেরা করছে। তার ওদিকে দুজন সশস্ত্র সেন্ট্রি সিগারেট ফুকুতে ফুঁকতে সারিবদ্ধ ওয়াগনের আড়ালে অদৃশ্য হলো। তখন কর্নেল বেড়া গলিয়ে রেলইয়ার্ডে ঢুকলেন। কর্নেল বাইনোকুলারে একটা লাইনের ওপর একপাটি জুতো দেখতে পেয়েছিলেন। সাধারণ স্যান্ডেল মাত্র।

রেলইয়ার্ডে এমন অনেক কিছুই পড়ে থাকে। তবু দেখা দরকার। কাছে গিয়ে দেখলেন, ফিতে ছেঁড়া পুরনো স্যান্ডেল। স্যান্ডেলটা বাঁ হাতে আলতোভাবে কুড়িয়ে নিলেন।

আর তখনই দড়দড় করে তার আশেপাশে পাথরকুচি এসে পড়তে থাকল। একটা পাথরকুচি তাঁর জুতোয় এসে পড়ল। মুহূর্তে গতি আঁচ করে টের পেলেন কেউ ওই ভাঙা ওয়াগনটার দিক থেকে এই কাজটি করছে। তার চেয়ে বড় কথা, কর্নেলের কাজটিও তার মনঃপুত নয়। দ্রুত পকেট থেকে রিভলবার বের করে তেড়ে গেলেন ওয়াগানটার দিকে। এই সময় ঝিরঝিরে বৃষ্টি এসে গেল।

ছেঁড়া চটিটা জ্যাকেটের পাশ-পকেটে ঢুকিয়ে ছোট্ট টর্চ বের করে ভাঙা ওয়াগনের ভেতরটা দেখলেন কর্ণেল।

চাপচাপ পাথরকুচি, মাটির চাবড়া, গুল্ম। কোনার দিকটা পরিষ্কার। সেখানে প্রকাণ্ড ফোকর। ফোকরে উঁকি দিতেই ধূসর বৃষ্টির ভেতর খানিকটা দূরে এইমাত্র কেউ সারবদ্ধ ওয়াগনের আড়ালে চলে গেল। পরনে প্যান্ট-শার্ট। রোগা চেহারা। কয়েক সেকেন্ডের দেখা একটা মানুষ এবং দিনশেষের বৃষ্টির ধূসরতায় দেখা একটা আবছা মূর্তি মাত্র।

সে এই স্যান্ডেলটাই নিতে এসেছিল, এতে কোনও ভুল নেই। এও ঠিক, সে ভেবেছিল, ভূতের ঢিল পড়া দেখে এই দাড়িওলা বুড়ো সায়েব লোকটি ভয় পেয়ে পালাবে!

ঝকঝকে জায়গাটিতে সিগারেটের টুকরো পড়ে আছে। একটা ছেঁড়া তাসের জোকারও। কারা এখানে তাস খেলত। সিগারেট ফুঁকত। সম্ভবত তারা ওয়াগনব্রেকার অথবা নেহাত নেশাখোর ভবঘুরের দল।

বৃষ্টির মধ্যে কর্নেল সাবধানে পায়ের কাছে টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে কবরখানায় ফিরে এলেন। সেন্ট্রিদের চোখে পড়লেই গুলি ছুড়ত। খুব ঝুঁকি নিয়েছিলেন কর্নেল।

গেটের ছাউনির তলায় হাসিমুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেয়ারটেকার। বাও করে বললেন, ওই আপনার গাড়ি, মহাশয়! দেখুন, যেমন ছিল তেমনই আছে। আসলে এই শয়তানের আখড়ার দিকে সচরাচর কেউ আসে না। আমার জ্ঞান মতে, যারা গাড়িচোর, তারা ছিচকে মস্তান নয়। যাই হোক, আশা করি সেই অদ্ভুত শকুনটি কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে?

না গোমেশভাই! বৃষ্টি সব গণ্ডগোল করে দিল।

গোমেশ তার আপাদমস্তক লক্ষ্য করে বললেন, ভিজে গেছেন দেখছি। যদি এ গরিবের ডেরায় ঢোকেন, কড়া চা খাওয়াতে পারি। আসুন, আসুন! আমার ঘরের জানালা থেকে আপনার গাড়ির ওপর নজর রাখা চলে।

গির্জার কাছ ঘেঁষে একতলা জীর্ণ কয়েকটি ঘর। দুটি ঘর যেকোনও সময় ভেঙে পড়তে পারে। বাকি ঘরটি মোটমুটি মেরামত করা হয়েছে। বারান্দার একপাশে কিচেন। ছোট্ট একটা ডাইনিং টেবিল। সবই ব্রিটিশ যুগের। ঘরের ভেতর চল্লিশ ওয়াটের বাল্ব। লোহার খাটে সাদাসিধে একটা বিছানা পাতা। নড়বড়ে তিনটে চেয়ার। দেয়ালের আয়নাটা ডিমালো এবং সুদৃশ্য! গোমেশ কিচেনে কেরোসিন কুকার জ্বেলে কেটলি চাপিয়ে এসে দেখলেন, কর্নেল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। গোমেশ উৎফুল্ল মুখে বললেন, খাঁটি বেলজিয়ামী আয়না মহাশয়! আজকাল দুষ্প্রাপ্য। দুঃখের কথা কী বলব টাকার অভাবে এমন কত দামী জিনিস বেচে দিতে হয়েছে। মাত্র দুশো টাকা মাইনে আর কফিনে নতুন লাশ এলে কিছু বখশিস। এ বাজারে একজন মানুষের পক্ষে কোনও রকমে বেঁচে থাকা। তবে এই কবরখানায় খুব কম লাশ আসে। শহরতলি এলাকা। কাছাকাছি খ্রিস্টানবসতি নেই।

কর্নেল একটা চেয়ারে বসে বললেন, কবরখানায় ওয়াগনব্রেকারদের খুব দৌরাত্ম্য মনে হয়?

সাংঘাতিক। তারা এই গেট দিয়ে মাল পাচার করে। গেটের সামনে ট্রাক অপেক্ষা করে। ভয়ে পুলিশকে জানাতে পারি না, মহাশয়!

কর্নেল একটু হেসে বললেন, আপনি কিছু বখশিস দাবি করতেই পারেন।

গোমেশ জোরে মাথা নেড়ে বললেন, কখনই না। সেটা পাপ। আমাকে একবার দশটা টাকা দিতে এসেছিল। নিইনি। বলেছিলাম, তোমাদের কাজ তোমরা করো। আমি তো বাধা দিচ্ছি না। মুখ বুজে আছি। থাকব।

কেয়ারটেকার টেবিলের বাইবেল স্পর্শ করলেন। তারপর কিচেনে গেলেন।

টেবিলের তলায় কর্নেলের জুতোয় কিছু ঠেকল। কাত হয়ে দেখলেন একটা ওয়েস্টপেপার বাস্কেট। ছোট টর্চটা জ্বেলে দেখলেন ছেঁড়া কাগজে ঠাসা। কর্নেল উঠে গেলেন জানালার কাছে। তারপর চেঁচিয়ে উঠলেন, এই! এই! কী হচ্ছে?

গোমেশ সাড়া দিলেন বাইরে থেকে। কী হয়েছে? কী হয়েছে?

ভাই গোমেশ! দেখুন তো গাড়ির কাছে কে কী করছে!

গোমেশ দ্রুত ঘরে ঢুকে দেয়ালের হুক থেকে ছাতি আর টেবিলের ড্রয়ার থেকে টর্চ বের করে হন্তদন্ত হয়ে বেরুলেন। আবছা অন্ধকারে বৃষ্টি পড়ছে ঝিরঝির করে। গেটের মাথায় আলো নেই কেন? কর্নেল ওয়েস্টপেপার বাস্কেটটা টেনে নিলেন। ছেঁড়া ঠোঙা, খ্রিস্টান সোসাইটির ইস্তাহার, এইসব কাগজ।

একটা কুচিতে বাংলা হরফ চোখে পড়েছিল কর্নেলের। ডটপেনে লেখা। সেজন্যই গোমেশকে বাইরে পাঠানো।

ঝটপট অনেকগুলো কুচি কাগজ কুড়িয়ে পকেটে ঢোকালেন। তারপর জিনিসটা টেবিলের তলায় চালান করে বারান্দায় গেলেন। গেটের বাক্টা জ্বলে উঠল।

গোমেশ ফিরলেন। মুখে হাসি। পালিয়েছে। গেটের আলোটা জ্বালতে ভুল হয়েছিল, তাই এত সাহস।

একটু পরে চা খেয়ে ব্রাদার গোমেশকে কুড়িটা টাকা বখশিস দিয়ে কর্নেল বেরুলেন। গোমেশ ছাতা ধরে তাকে গাড়িতে পৌঁছে দিলেন। বললেন, ইউ আর ভেরি গুড জেন্টলম্যান, স্যার! ইউ আর আ বার্ড-ওয়াচার। ওয়েল, কাম স্যার ইন দা মর্নিং, অর হোয়েন ইউ লাইক! মেনি মেনি বার্ডস ইন দা সিমেট্রি! গুড বাই স্যার! মে আওয়ার লর্ড দা সেভিয়ার ব্লেস ইউ! বাই বাই!

কবরখানার কেয়ারটেকার হাত নাড়তে থাকলেন।……

.

রাত দশটায় ষষ্ঠীচরণ হাই তুলতে তুলতে পর্দার ফাঁকে মুখ বের করল। বাবামশাই টেবিলে একপাটি ছেঁড়া জুতো নিয়ে কী যেন করছেন। দ্য ছ ছ্যা! নাক কুঁচকে গেল ষষ্ঠীর। সব থাকতে ঘেঁড়া জুতো ঘাঁটা। সে খুক করে কাশল।

কর্নেল মুখ না তুলেই বললেন, তোকে না বলেছি খাবার ঢাকা দিয়ে শুয়ে। পড়গে?

ষষ্ঠী বেজার মুখে বলল, ভাল করে হাত দুটো যেন ধুয়ে লেবেন।

কর্নেল স্যান্ডেল তুলে কপট প্রহারের ভঙ্গি করলে ষষ্ঠীচরণ অদৃশ্য হলো।

কর্নেলের সামনে কাগজের কুচিগুলো মোটামুটি সাজানো। কতক্ষণ ধরে তাস মেলানোর মতো পরিশ্রম চলেছে। বুঝতে পারছেন না সাজানো ঠিক হয়েছে কি না। গোমেশ যেন খুব খাপ্পা হয়েই কাগজটা ছিঁড়েছিলেন। দলা-পাকানো কাগজের কুচি। ওর চিহ্নটুকু কোথাও স্পষ্ট, কোথাও অস্পষ্ট। একটিও পুরো শব্দ নেই। এটাই সমস্যা।

কিন্তু দুটো জিনিস বিস্ময়কর। এ কাগজটাও নিউজপ্রিন্ট এবং সেই একই হস্তাক্ষর। অন্তত কর্নেলের যতটা স্মরণ হচ্ছে। জেরক্স কপিটা পেলে মেলানো যাবে।

আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, গোমেশ এটা পেলেন কোথায়? ছিঁড়ে ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেটে ফেললেন কেন? এখনও বেশ কিছু কুচি গোমেশের ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেটে পড়ে আছে। পুলিশকে বললে এখনই ওটা নিয়ে আসবে। ওটা আনা– দরকার। কাগজের এই কুচিগুলো মিলিয়ে মোটামুটি একটা ছোট্ট চিঠি দাঁড়িয়েছে। এটাই ভাবিয়ে তুলেছে কর্নেলকে। টিনিকে লেখা চিঠিই বটে! সেটার মোটামুটি এবং আনুমানিক চেহারা এইরকম :

টিনি, আজ তুমি ক্রিস্টিনার কবরের ওখানে যাবে। ওখানে তোমার জন্য ফুলগুলি ফুটে আছে। সুন্দর বিষাক্ত লাল ফুল। আজ রাতে বৃষ্টি না হলে জ্যোৎস্নায় তোমাকে পরী দেখাবে। তুমি আকাশকন্যা। মৃতদের মধ্যে জীবন জাগাবে। তুমি ক্রিস্টিনা হয়ে উঠবে। কবির আত্মা। কিন্তু সাবধান। বেশিক্ষণ নয়। গোমেশ তোমাকে সব কথা বলবে।……।

ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল কর্নেলের ঠোঁটের কোনায়। টাকে হাত বোলালেন। যা লিখেছেন, তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বলতে গেলে শব্দ ও বাক্যের অনেকটাই তারই আরোপিত। কিন্তু ন্যায়শাস্ত্রে আনুমানও যুক্তিসিদ্ধ।

হ্যাঁ, চিঠিটা এরকমই ছিল। কাব্যিক, আবেগময়।

হাত বাড়িয়ে ফোন তুলে ডায়াল করতে থাকলেন কর্নেল। অরিজিৎ লাহিড়ীর ফ্ল্যাটের ফোন, সাড়া এল, লাহিড়ী!

ডার্লিং! আশা করি গোদারের চিত্রনাট্য পড়ছ?

হেরে গেলেন, অন্তর্যামী!

ভূতের গল্প নয় তো?

হুঁ। প্রায় কাছাকাছি। বইটার নাম কবরখানার সাহিত্য।

রোজার গারোদি!

ধন্যবাদ! আপনি সর্বঘটের কঁঠালী কলা। তবে কমিউনিস্ট গাররাদি–সার্ত্র, পাউন্ড কাউকে রেয়াৎ করেননি। কবরে পাঠিয়ে ছেড়েছেন!

ডার্লিং! গাবোদিকেই পরে কমিউনিস্টরা কবরে পাঠিয়েছিল।

আপনাকেও আজ কবরে দেখা গেছে!

খুশি হলাম শুনে। তবে ডার্লিং, ওই কবরখানায় এখনই কাউকে পাঠানো দরকার।

মাই গুডনেস! কী ব্যাপার? আবার কি……..

না। কেয়ারটেকার মিঃ গোমেশের ঘরে টেবিলের তলায় একটা ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট আছে। সেটা খুবই জরুরি। আর…মিঃ গোমেশকে আটক করে জেরা করো–তিনি কিছু জানেন। একটু পরে অরিজিতের সাড়া এল, আর ইউ দেয়ার, ওল্ড বস?

ইয়া! মেক হে ডার্লিং! দিস্ ইজ ভেরি ইমপর্ট্যান্ট।

ফোন ছেড়ে দিলেন কর্নেল। কাগজের কুচিগুলো একটা খামে ঢুকিয়ে নিজের লেখাটা ভাঁজ করে ড্রয়ারে রাখলেন। বৃষ্টি আবার শুরু হয়েছে। বাইরে আবহাওয়া স্নিগ্ধ ছিল। কিন্তু এতক্ষণে গরম টের পেলেন। কাগজের কুচি উড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় জানালা বন্ধ করেছিলেন। ফ্যানও বন্ধ ছিল। জানালা খুলে ফ্যান চালিয়ে দিলেন। তারপর টেবিল থেকে স্যান্ডেলটা তুলে নিয়ে ইজিচেয়ারে বসলেন।

বাঁ পায়ের স্যান্ডেল। দুপাশেরই ফিতে উপড়ে গেছে। রবারসোল চিড় খেয়েছে। ছুটে পালিয়ে যাওয়ার স্পষ্ট চিহ্ন। কিন্তু ছুটে পালাতে হলো কেন? ওই জনহীন জায়গায় ধীরে-সুস্থে যেতে পারত কাজ শেষ করে–অবশ্য যদি সে খুনী হয়!

রেলইয়ার্ডের সেন্ট্রি তাড়া করেছিল কি?

ওরা তাড়া করে না। চার্জ করে। না থামলে গুলি ছোঁড়ে। খোঁজ নেওয়া দরকার গত রাতে তেমন কিছু ঘটেছিল কি না।

কিন্তু এমন পুরনো স্যান্ডেল, আর সেলাইয়ের চিহ্ন…….কোনও বেকার যুবক?

স্যান্ডেলের চেহারায় রুচির পরিচয় না থাক, সামান্য বিলাসিতা…….নাঃ! বিলাসিতা নয়। সে গতানুগতিকতার পক্ষপাতী নয়। সবাই যে স্টাইল পছন্দ করে, সে তা করে না।

কর্নেল হাত বাড়িয়ে টর্চটা নিলেন। আবার খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে থাকলেন। বুড়ো আঙুলের জোড়ের জায়গাটা ফাঁক করেই চমকে উঠলেন। জোড়ের জমাট অংশে কী ছোপ। বৃষ্টিতেও ধুয়ে যায়নি। দ্রুত একটা আলপিন এনে জোড়ের ভেতর চালিয়ে একটা কাগজে আলপিনের ডগা ঘষে দিলেন। কালচে রক্তের রেখা!

স্যান্ডেলে রক্ত মেখে গিয়েছিল। ধুয়ে গেছে বৃষ্টিতে। আজ সুযোগমতো এটা খুঁজতে এসেছিল। কর্নেল গিয়ে পড়ায় ব্যর্থ হয়েছে।

কাগজে স্যান্ডেলটা মুড়ে ড্রয়ারে ঢুকিয়ে বাথরুমে গেলেন কর্নেল। সাবান দিয়ে রগড়ে দুটো হাত ধুয়ে ফেললেন। ডাইনিং রুমে ঢুকে দেখেন, ষষ্ঠীচরণ বসে ঢুলছে। তার চুল টেনে দিয়ে থাপ্পড় তুলতেই ষষ্ঠী ফিক করে হেসে বলল, বেড়াল, বাবামশাই! বেড়াল?

তারপর নিজের ঘরে চলে গেল। কর্নেল হাসতে হাসতে তার উদ্দেশে বললেন, বেড়াল তোর মাথার ভেতর, ষষ্ঠী! খেয়াল করে শোন, মাও এ্যাও করে ডাকছে।

ষষ্ঠী তার ঘর থেকে বলল, আর ডাকছে না বাবামশাই!

পাইলে গেছে?

ষষ্ঠীকে নকল করায় ষষ্ঠীর অভিমান হওয়া স্বাভাবিক। আর তার সাড়া পাওয়া গেল না।

খাওয়ার পর কর্নেল ড্রইংরুমে এসে ইজিচেয়ারে বসে সবে চুরুট জ্বেলেছেন, ফোন বাজল। সাড়া দিলেন।

হাই ওল্ড বস! চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে।

বাস্কেটটা নেই?

আছে। তবে খালি। কিচেনে ছাইয়ের গাদা। মিঃ গোমেশ উধাও।

সে কী! কর্নেল সোজা হয়ে বসলেন। অরিজিৎ! ওঁর কোনও বিপদ হয়নি তো?

তেমন কোনও লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঘরের দরজায় তালা আটা ছিল। ভাঙতে হয়েছে।

ঘরে তালা আটা! জিনিসপত্র? দেয়ালে একটা ওভাল মিরর ছিল…

নেই। ইন্সপেক্টর আর মিটারকে তো চেনেন! খুবই দক্ষ অফিসার আমার ডিপার্টে। কেয়ারটেকার সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ রিকশো চেপে কোথায় গেছেন, সো মাচ ইনফরমেশন হি গট।

তুমি সকালে একবার এস, ডার্লিং! একপাটি জুতো…….

জুতো মারবেন? আমার অপরাধ?

তুমি যে খাঁটি বারেন্দ্র বামুন, বোঝা গেল। একটুতেই উত্তেজনা!

জুতোটুতো শুনলে ভূতেও উত্তেজিত হয় কর্নেল!

আরও উত্তেজিত হও, ডার্লিং! কাগজে রক্তের দাগ ছিল। এবার জুতোয় রক্তের দাগ।

ব্যস! এনাফ! আজ ঘুমের ট্যাবলেট খেতে হবে। গুড নাইট!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8
Pages ( 1 of 8 ): 1 23 ... 8পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress