খুলি যদি বদলে যায়
এই অদ্ভুত ঘটনাটা আমার ছোটবেলায় ঘটেছিল। তখন আমার বয়স মোটে দশ বছর। আমাদের গ্রামের হাইস্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ি।
আমাদের গ্রামে আষাঢ় মাসে রথযাত্রা উপলক্ষে খুব ধুমধাম হতো। ঠাকরুনতলার খোলামেলা বিশাল চত্বরে মেলা বসত। আশেপাশের সব গ্রাম থেকে মানুষজন এসে ভিড় জমাত।
সেবার রথের মেলার সময় দিদিমা এসেছিলেন। তিনি রথের মেলা দেখতে যাবেন শুনে মায়ের প্রচণ্ড আপত্তি। না, না! মেলায় বড় ভিড় হয়। এদিকে বিষ্টিবাদলায় ঠাকরুনতলার চত্বরে বিচ্ছিরি কাদা। তা ছাড়া তোমার রোগা শরীর। দৈবাৎ পা পিছলে আছাড় খেলে কী হবে ভেবেছ?
দিদিমা মায়ের আপত্তি গ্রাহ্য করলেন না। আমার কাঁধে হাত রেখে হাসিমুখে বললেন,–এই পুঁটুদাদা আমার সঙ্গী হবে। তুমি কিচ্ছু ভেব না।
বেগতিক দেখে মা ডাকলেন,–ছোটকু! ও ছোটকু!
ছোটকু মানে আমার ছোটমামা। ছোটমামা আমাদের বাড়িতে থেকে মহকুমাশহরের কলেজে পড়তে যেতেন। আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে রেললাইন গেছে। স্টেশনও আছে। ছোটমামা ট্রেনে চেপে কলেজ যেত।
মায়ের ডাকাডাকিতে ছোটমামার সাড়া পাওয়া গেল না। যাবে কী করে? ছোটমামাকে দুপুরে খাওয়ার পর সেজেগুজে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলুম। মাকে কথাটা জানিয়ে দিলুম। মা খাপ্পা হয়ে বললেন,–আসুক ছোটকু। দেখাচ্ছি মজা। ও থাকলে তোমাকে নিয়ে যেত।
দিদিমা বললেন,–আমার পুঁটুদাদামণিই যথেষ্ট। চলো ভাই!
মা আমার দিকে চোখ কটমটিয়ে বললেন, দিদার সঙ্গী হয়ে তুমি যেন ভিড়ে হারিয়ে যেও না। দিদার একটা হাত শক্ত করে ধরে থাকবে।
আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, আমার মায়ের সাড়া পেলুম। দিদিমার কাছে এসে তিনি বললেন,–এই ছাতিটা নিয়ে যাও মা! বৃষ্টিতে ভিজলে রোগা শরীরে আবার কী রোগ বাধিয়ে বসবে।
এবার দিদিমা চটে গেলেন। রথযাত্রার মেলায় ছাতি মাথায় যাব? তুই জানিস? রথের পরবে বিষ্টিতে ভিজলে পুণ্যি হয়!
মা গম্ভীরমুখে বাড়ি ঢুকে গেলেন। দিদিমার একটা হাত ধরে আমি বললুম,– তুমি ঠিক বলেছ দিদা। বিষ্টিতে ভিজতে আমার খুব ভালো লাগে।
শর্টকাটে ঠাকরুনতলা আমাদের বাড়ি থেকে তত কিছু দূর নয়। সিঙ্গিমশাইয়ের আমবাগানের পাশ দিয়ে একটা ঘাসে ঢাকা পোড়ো জমি পেরিয়ে আমরা শিগগির রথের মেলায় পৌঁছে গেলুম। তারপরই পাঁপড়ভাজার গন্ধে জিভে জল এসে গেল। বললুম,–ও দিদা! আগে পাঁপড়ভাজা খাব।
দিদিমা বললেন, খাবে বইকী। তুমি-আমি দুজনেই খাব। আগে রথদর্শন করি। তারপর অন্য কিছু।
এই মেলায় রথদর্শন ও প্রণাম ছিল মূল আকর্ষণ। জমিদারবাড়িতে একটা পেতলের রথ ছিল। সেটা রথযাত্রার দিন টেনে এনে ঠাকুরতলার শেষপ্রান্তে রাখা হতো। মাথায় লাল কাপড়ের ফেট্টিবাঁধা পাইকরা লাঠি উচিয়ে সেই রথ পাহারা দিত। ভক্ত মানুষজন দূর থেকে প্রণাম করত।
কিন্তু সেই রথের দিকে দিদিমা এগোতেই পারলেন না। মা যেমন বলেছিলেন,–বিচ্ছিরি কাদা! বড্ড বেশি ভিড়!
অগত্যা দিদিমা বললেন, আয় পুঁটুদাদা! ভিড় কমুক। তখন রথদর্শন করব।
আমি জেদ ধরলুম। তাহলে ততক্ষণ পাঁপড়ভাজা খাওয়াও দিদা! নইলে আমি তোমাকে একা রেখে দৌড়ে বাড়ি চলে যাব।
দিদিমা তখন আর কী করেন! ভিড় এড়িয়ে একটা পাঁপড়ভাজার দোকানে গেলেন। আমাকে একখানা পাঁপভাজা কিনে দিয়ে সম্ভবত লোভ সম্বরণ করতে, পারলেন না। নিজেও একখানা পাঁপড়ভাজা কিনে ফেললেন। আর সেই সময় টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ মেলার মানুষজন সেই বৃষ্টিকে পাত্তা দেয়নি। ক্রমে বৃষ্টি বাড়তে থাকলে হইহট্টগোল শুরু হয়ে গেল। দিদিমা আমার হাত ধরে টানতে টানতে ভাগ্যিস মেলার একপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন। তা না হলে দুজনেই ভিড়ের চাপে দলা পাকিয়ে কাদায় পড়ে থাকতুম।
বৃষ্টি যত বাড়ছিল, তত মেঘ গর্জে উঠছিল। বিদ্যুতের ঝিলিক এবং মুহুর্মুহু কানে তালাধারানো মেঘগর্জন। এদিকে দুজনেই ভিজে কাকভেজা হয়ে যাচ্ছি। দিদিমা ব্যস্তভাবে বললেন,–ও পুঁটু! বাড়ি ফিরে চলো।
আবার সিঙ্গিমশাইয়ের বাগানের পাশ গিয়ে দুজনে ফিরে আসছিলুম। হঠাৎ দিদিমা বললেন,–এখানে গাছতলায় একটুখানি দাঁড়াও পুঁটু! আমি যে আর হাঁটতে পারছিনে।
বলে তিনি বসে পড়লেন। ততক্ষণে চারদিক কালো হয়ে এসেছে। একটু দূরে মেলার আলোগুলো জুগজুগ করছে। আমার অবস্থা তখন ভ্যা করে কেঁদে ওঠার মতো। বললুম,–দিদা! এবার ওঠো!
দিদিমা কান্নাজড়ানো গলায় বললেন,–ও পুটু! আমি যে উঠতে পারছিনে। কোমরের পেছনে কে যেন কামড়ে ধরেছে।
শুনেই আমি প্রচণ্ড ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলুম,–ছোটমামা! ও ছোটমামা!
ছোটমামা কোথায় আছেন, তা জানতুম না। কিন্তু আমার গলা দিয়ে ওই কথাই বেরিয়ে গেল। দিদিমা যতবার ব্যথায় ককিয়ে উঠছিলেন, ততবার আমি ছোটমামাকে ডাকছিলুম।…
এরপর কীভাবে দিদিমা আর আমি বাড়ি ফিরেছিলুম, তা সবিস্তারে বলছি না। আমাদের ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে মা ছোটমামা আর বাবাকে ঠাকরুনতলায় পাঠিয়েছিলেন। মেলায় আমাদের খুঁজে না পেয়ে তারা শর্টকাটে সিঙ্গিমশাইয়ের বাগানের পাশ দিয়ে আসছিলেন। তারপর টর্চের আলোয় আমাদের দেখতে পান।
বাড়ি ফিরে ছোটমামা হাসতে-হাসতে মাকে বলেছিলেন,–জানো দিদি? টর্চের আলো ফেলে দেখি, পুঁটু তখনও পাঁপড়ভাজা খাচ্ছে আর আমাকে ডাকাডাকি করছে। এদিকে মা-ও কিন্তু হাত থেকে পাঁপভাজা ফেলে দেয়নি।
এই নিয়ে সে-রাত্রে বাড়িতে খুব হাসিতামাশা হল। কিন্তু পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি, দিদিমা যে ঘরে শুয়েছিলেন, সেই ঘরের দরজার সামনে পাড়ার মহিলাদের ভিড়। বাবা গম্ভীরমুখে বারান্দায় বসে চা খাচ্ছেন। দিদিমার ঘর থেকে চাপা আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। বাবাকে কিছু জিগ্যেস করতে সাহস হল না।
একটু পরে ছোটমামার সঙ্গে আমাদের গ্রামের ডাক্তার নাডুবাবু বাড়ি ঢুকলেন। ছোটমামার হাতে তাঁর ডাক্তারি বাকসো। নাড়ুবাবুকে দেখে পাড়ার মহিলারা দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন। সেই সুযোগে আমি গিয়ে দরজায় উঁকি দিলুম। দেখলুম, দিদিমা বিছানায় শুয়ে আছেন এবং মাঝে-মাঝে আর্তস্বরে বলছেন, উঁহুহুহু! ও ঠাকুর! এ কী হল? কে আমার কোমরে কামড়ে দিল?
নাড়ডাক্তার দিদিমাকে পরীক্ষা করে দেখে বললেন,–পুরোনো বাত। সারতে একটু দেরি হবে।…..
যাই হোক, দিদিমা সেই যে শয্যাশায়িনী হলেন তো হলেন। নাড়ডাক্তারের মোক্ষম সব ইঞ্জেকশন আর ওষুধে কাজ হল না। এরপর শহরের ডাক্তার নিয়ে এসেছিলেন বাবা। তিনিও দিদিমাকে বিছানা থেকে ওঠাতে পারলেন না। কোমরের যন্ত্রণাও কমল না। শেষে এলাকার নামকরা কবিরাজমশাইকে আনা হল। লোকে তাকে সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী বলত। কিন্তু তাঁর ওষুধেও কাজ হল না। আমার মনে পড়ে, প্রতিদিন ভোরবেলা হামানদিস্তার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যেত। দেখতুম, মা বারান্দায় বসে ছোট্ট গোলাকার লোহার পাত্রে একটা ছোট্ট লোহার ডাণ্ডা দিয়ে কিছু পিষছেন। ছোটমামার কাছে শুনেছিলুম, ধন্বন্তরী কবিরাজমশাইয়ের দেওয়া ওষুধ তৈরি করা হচ্ছে। সেই ওষুধ দিদিমার কোমরে প্রলেপ দেওয়া হবে।
কিছুদিন পরে এক রবিবার সিঙ্গিবাড়ির কাকিমা দিদিমাকে দেখতে এলেন। তিনিই মাকে পরামর্শ দিলেন, সবরকম চিকিৎসা তো করা হল। কিন্তু কাজ হল না। এবার টোটকা ওষুধ বা তুকতাক, মন্তরতন্তরে যদি বাত সারে, চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?
মা বললেন,–আমিও তা-ই ভাবছিলুম। কিন্তু তেমন কাকেও পাচ্ছি কোথায়?
সিঙ্গিবাড়ির কাকিমা বললেন,–কেন? তেমন লোক তো হাতের কাছেই আছে। কথায় বলে, গেঁয়ো যোগী ভিক্ষে পায় না।
–কে সে?
–মোনা-ওঝা। আবার কে? ওই যে তোমার মা বারবার বলেন, কোমরে কে কামড়ে ধরে আছে, তাতেই তো আমার প্রথমেই সন্দেহ হয়েছিল। তোমরা কী ভাববে বলে কথাটা বলিনি। আমাদের আমবাগানে একটা গাছ আছে। সেই গাছের তলায় বৃষ্টির সময় তোমার মা-থাকগে ওসব কথা। মোনাকেই ডাকো!
কথাটা শুনে আমি আঁতকে উঠেছিলুম। আমার মনে পড়েছিল, সিঙ্গিমশাইয়ের আমবাগানে দুলেপাড়ার একটা মেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। কী ভুল! কী ভুল! রথের মেলায় যাওয়ার দিন সেই কথাটা একেবারে মনে ছিল না! নির্ঘাত আমরা সেই গাছটারই তলায় বৃষ্টির সময় আশ্রয় নিয়েছিলুম।
ছোটমামা বিকেলে মোনা-ওঝাকে ডেকে নিয়ে এলে ওর প্রমাণ মিলল। মোনা ওঝার মাথায় জটা, মুখে গোঁফদাড়ি। কপালে লাল ত্রিপুক আঁকা। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। কাঁধের তাপ্লিমারা গেরুয়া রঙের ঝোলা থেকে সে একটা মড়ার খুলি বের করে দিদিমার ঘরে ঢুকল। তারপর মেঝেয় বসে মড়ার খুলিটা রেখে সে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে ডাকল, ওগো মা! ও জননী! বলুন তো আপনার কোথায় ব্যথা?
দিদিমা ক্ষীণ কণ্ঠস্বরে বললেন,–কোমরের পেছনে।
–ব্যথাটা কীরকম বলুন তো মা?
দিদিমা একটু ককিয়ে উঠে বললেন,–কে যেন কামড়ে ধরে আছে।
মোনা-ওঝা হি-হি করে হেসে বলল,-বুঝেছি! বুঝেছি! এবার বলুন তো মা জননী, কবে কখন ব্যথাটা শুরু হয়েছিল?
মা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। মোনা তাঁকে চোখের ইশারায় চুপ করাল। দিদিমা অতিকষ্টে বললেন, পুঁটুর সঙ্গে রথের মেলায় গিয়েছিলুম। হঠাৎ বিষ্টি এল। আমরা সিঙ্গিমশাইয়ের আমবাগানে এসে–
মোনা-ওঝা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,–থাক, থাক। আর বলতে হবে না। বলে সে মড়ার খুলিটার দিকে রাঙা চোখে তাকাল। –শুনলি তো বাবা মা-জননীর কথাটা? এবার তুই আমার কানে কানে বলে দে, কী করে ওই হতচ্ছাড়ি পেতনিটাকে তাড়ানো যায়?
সে মড়ার খুলিটা কানের কাছে কিছুক্ষণ ধরে ফোঁস করে সশব্দে শ্বাস ছাড়ল। তারপর বলল,–হুঁ। গলায় দড়ি দিয়ে মরা আত্মা। পেতনি হয়ে গেছে। মা-জননীর কোমর কামড়ে ধরে জ্যান্ত মানুষদের ওপর রাগ দেখাচ্ছে।
বলে মোনা-ওঝা মায়ের দিকে তাকাল,–দিদি! খুলেই বলছি। এ পেতনিকে তাড়ানো আমার কম্ম নয়। কালিকাপুরে বাবা কন্ধকাটার থান আছে। সেই থানের খানিকটা মাটি তুলে এনে মা-জননীর কোমরে মাখিয়ে দিলেই পেতনিটা পালিয়ে যাবে।
ছোটমামা এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এবার বললেন, কালিকাপুর আমি চিনি। গতবার ফুটবল খেলতে গিয়ে একটা রাজবাড়ির ধ্বংসস্তূপ দেখেছিলুম। জায়গাটা একেবারে জঙ্গল হয়ে আছে।
মোনা-ওঝা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,–বাবা কন্ধকাটার থান সেই জঙ্গলের মধ্যিখানে। একটা ভাঙা দেউড়ি এখনও উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে একটা বটগাছ। বটগাছের তলায় বাবা কন্ধকাটার থান।
ছোটমামা বললেন, কুছ পরোয়া নেই। এখনই বেরিয়ে পড়ছি। সওয়া চারটের ট্রেনটা পেয়ে যাব। মোটে তিনটে স্টেশন।
মোনা জিভ কেটে বলল,–ওঁ হুঁ হুঁ হুঁ! কন্ধকাটা কথাটা দাদাবাবু কি বুঝতে পেরেছেন? মুন্ডু নেই। বুকের দুপাশে দুটো চোখ। সাংঘাতিক ব্যাপার! আপনাকে থানে দেখতে পেলেই সর্বনাশ। তিনি বটগাছে লুকিয়ে থাকেন।
মা করুণমুখে বললেন, তা হলে তুমি নিজেই সেই থানের মাটি এনে দাও না মোনা!
মোনা হাসল।-ওরে বাবা! আমাকে থানের ত্রিসীমানায় দেখলে বাবা কন্ধকাটা রে-রে করে তেড়ে আসবেন। তবে তাঁর থানের মাটি আনার সহজ উপায় আছে। বাবা কন্ধকাটা ছোটদের খুব ভালোবাসেন। এই খোকাবাবু থানে গিয়ে এক খাবলা মাটি তুলে রুমালে বেঁধে আনে, বাবা মোটেও রাগ করবেন না।
কথাটা শুনে আমি আঁতকে উঠে বললুম, আমি একা ওখানে যেতে পারব না।
ছোটমামা বললেন,–কী বোকার মতো কথা বলছিস পুটু? আমি তোর সঙ্গে যাব। তারপর আমি ঝোঁপের আড়ালে বসে থাকব। তুই থানের মাটি নিয়ে আসবি। কিচ্ছু ভাবিস নে! কন্ধকাটা হোক, আর যে ব্যাটাচ্ছেলেই হোক, আমার সামনে এলে অ্যায়সা একখানা ঝাড়ব না–কথা শেষ না করে ছোটমামা ফুটবলে কিক করার ভঙ্গি তে শূন্যে লাথি ছুড়লেন।
তারপর ছোটমামা আমার একটা হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে বারান্দায় গেলেন। বললেন,-এক মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নে। আমি রেডি হয়েই আছি। চারটে বাজে। স্টেশনে পৌঁছতে এখনও প্রচুর সময় আছে। এই ট্রেনটা দৈবাৎ লেট করলে তো ভালোই হবে।…
তখনকার দিনে ট্রেনে বা বাসে মোটেও ভিড় হতো না। লোকেরা পায়ে হেঁটেই যাতায়াত পছন্দ করত। ট্রেনে যে কামরায় আমরা উঠেছিলুম, তাতে মোটে জনাতিনেক যাত্রী। তারা পরস্পর দুরে জানালার কাছে বসে ছিল। ছোটমামা নিজে একটা জানালার ধারে বসে বললেন, তুই আমার পাশে বোস পুটু! জানালার ধারে বসলে কয়লার গুড়ো এসে চোখে ঢুকে যাবে।
একটু তফাতে এক ভদ্রলোক জানালার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে বসে ছিলেন। তাঁর মাথায় সিঁথিকরা লম্বা ঘাড় ছুঁই-ছুঁই কঁচাপাকা চুল। পরনে ধুতি আর ছাইরঙা পাঞ্জাবি। তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর নাকের পাশে মোটা একটা জডুল। কাঁধের ব্যাগটা পাশে সিটের ওপর রেখে তিনি চিবুকে একটা হাত এবং মাথায় একটা হাত চেপে মাথাটা নড়িয়ে দিলেন।
ব্যাপারটা ছোটমামারও চোখে পড়েছিল। ফিসফিস করে বললেন,-পাগল নাকি রে?
আশ্চর্য ব্যাপার! ট্রেনের তুলকালাম শব্দের মধ্যেও কথাটা কি ভদ্রলোকের কানে গেল? তিনি একটু হেসে বললেন, পাগল হইনি এখনও! তবে পাগল হতে বেশি দেরি নেই!
ছোটমামা বললেন, কিছু মনে করবেন না। আপনি নিজের মুন্ডুটা ধরে অমন করে নাড়ানাড়ি করছেন কিনা? তাই মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেছে।
ভদ্রলোক এবার দুটো হাত দুই গালে চেপে মাথাটা কিছুক্ষণ নাড়ানাড়ি করে বললেন,–এই এক বিপদ হয়েছে আমার। মুন্ডুটা কিছুতেই ঘাড়ের সঙ্গে ফিট করছে না।
ছোটমামা জিগ্যেস করল, আপনার ঘাড়ে কি বাত হয়েছে?
–কেন? কেন?
–মানে আমার মায়ের কোমরে বাত হয়েছে তো! সাংঘাতিক বাত। মা দিদিকে বলেন, তার কোমর ধরে আপনার মতো নাড়ানাড়ি করো। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। তাই আমরা যাচ্ছি কালিকাপুরে বাবা কন্ধকাটার থানে।
ভদ্রলোক এবার খিকখিক করে হেসে বললেন, আরে! আমিও তো সেখানেই যাচ্ছি।
ছোটমামা গম্ভীরমুখে বললেন,–বাবা কন্ধকাটা তার থানে বড়দের দেখতে পেলেই রে-রে করে তেড়ে আসেন। তাই এই যে দেখছেন ভাগনে পুটু। একে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। বাবা কন্ধকাটা ছোটদের খুব ভালোবাসেন।
–তাই বুঝি? তা তোমার ভাগ্নে সেখানে গিয়ে কী করবে?
–থানের মাটি খাবলে তুলবে। রুমালে বেঁধে নিয়ে আসবে। সেই মাটি গুলে মায়ের কোমরে মাখিয়ে রাখলে বাত সেরে যাবে, বুঝলেন?
ভদ্রলোক আবার দু-হাত দিয়ে তার মুন্ডুটা নাড়ানাড়ি শুরু করলেন। তারপর বললেন, উঃ! বড্ড জ্বালায় পড়া গেল দেখছি। মনে হচ্ছে যেন আমার মুভুটা ঘাড় থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
ছোটমামা বললেন, আপনি কিছু ভাববেন না। বাবা কন্ধকাটার থানে যাওয়া পর্যন্ত মুন্ডুটাকে চেপে ঘাড়ে বসিয়ে রাখুন। তারপর আপনি আর আমি ঝোঁপের আড়ালে বসে থাকব। আর পুঁটু আপনার জন্যও খানিকটা মাটি এনে দেবে। ওখানে একটা ঝিল আছে দেখেছি। আপনি মাটিগুলো তুলে কাদা করে মুন্ডুর পেছনদিকে ঘাড় অব্দি মাখিয়ে রাখবেন। ব্যস!
ভদ্রলোক শুধু বললেন,–দেখা যাক।…
কালিকাপুর স্টেশনে নামবার পর একদল বরযাত্রী বরকনে নিয়ে হইহই করে ট্রেনে উঠছিল। সেই ভিড়ে ভদ্রলোককে আর দেখতে পেলুম না।
কথাটা ছোটমামাকে বললুম। ছোটমামা বিরক্ত হয়ে বললেন,–ছেড়ে দে তো পাগলের কথা। দেখেই বুঝেছিলুম বদ্ধপাগল। পা চালিয়ে চল। সাড়ে ছটার ট্রেনে আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে।
কিছুক্ষণ পরে ছোটমামা হাঁটার গতি কমালেন। সামনেই ধ্বংসস্তূপ আর ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের ভেতরে উঁচু ভাঙা পাঁচিল দেখা যাচ্ছিল। সেটা লক্ষ করে দুজনে জঙ্গলে ঢুলুম। তারপর বটগাছটাও চোখে পড়ল। ছোটমামা একটা ঝোঁপের আড়ালে বসে ফিসফিস করে বললেন, কুইক পুঁটু! মাটিটা বৃষ্টিতে নরম হয়ে আছে। এই রুমালটা নে। যতটা পারবি, খাবলে মাটি তুলে নিবি। চলে যা।
ভয়ে-ভয়ে এগিয়ে গেলুম। উঁচু ভাঙা পাঁচিলের পাশে বটগাছটার কাছে গিয়ে দেখলুম, গুঁড়ির নিচে একটা প্রকাণ্ড ইটের চাঙড়। তার ওপর একটা মড়ার খুলি।
খুলিটা দেখামাত্র আঁতকে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে এলুম। কিন্তু দিদিমার বাতের কষ্টের কথা মনে পড়ল। তখন সেখানেই গুঁড়ি মেরে বসে রুমাল বিছিয়ে কয়েক খাবলা মাটি তুলে নিলুম। তারপর মাটিগুলো রুমালে বেঁধে সবে উঠে দাঁড়িয়েছি, তখনই দেখলুম ট্রেনের সেই ভদ্রলোক পাঁচিলের পাশ দিয়ে চুপিচুপি আসছেন। তাঁর দৃষ্টিটা মড়ার খুলির দিকে।
তারপর দেখলুম, ভদ্রলোক তার কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা মড়ার খুলি বের করলেন এবং ইটের চাঙড়ে সেই খুলিটা রেখে থানের মড়ার খুলিটা তুলে নিয়ে পাঁচিলের আড়ালে উধাও হয়ে গেলেন।
ছোটমামা ঝোঁপের আড়ালে থেকে ব্যাপারটা দেখছিলেন। এবার ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এসে বললেন,–আয় তো পুঁটু! ব্যাপারটা দেখি।
ছোটমামা তখন বেপরোয়া। বাবা কন্ধকাটার কথা ভুলে ভাঙা পাঁচিলের পাশ দিয়ে দৌড়ে গেলেন। আমিও ছোটমামাকে অনুসরণ করলুম। কিছুটা দৌড়ে গিয়েই ভদ্রলোককে দেখা গেল। তিনি সামনের দিকে হনহন করে এগিয়ে চলেছেন। ছোটমামা চেঁচিয়ে উঠলেন,–ও মশাই! ও মশাই! শুনুন! শুনুন!
ভদ্রলোক মুখটা ঘোরালেন। দেখে চমকে উঠলুম। এ মুখ তো সেই মুখ নয়। লম্বা চুল নেই। প্রকাণ্ড গোঁফ আছে। ট্রেনের তিনি ছিলেন ফরসা। ইনি কুচকুচে কালো। অথচ সেই ছাইরঙা পাঞ্জাবি, পরনে ধুতি।
ছোটমামার একরোখা জেদি স্বভাব আমার জানা। দৌড়ে তার কাছাকাছি গিয়ে আবার যেই বলেছেন,–ও মশাই। ব্যাপারটা কী? অমনি ভদ্রলোক আবার মুখ ঘোরালেন। বিকেলের রোদ পড়েছিল সেখানে। আতঙ্কে হতবুদ্ধি হয়ে দেখলুম, এবার আর মানুষের মুখ নয়। আস্ত মড়ার খুলি।
ছোটমামা থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। আর তারপরই ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। আমার পাশ দিয়ে কী একটা ছুটে গেল। আমি আতঙ্কে প্রায় কেঁদে উঠে ডাকলুম,– ছোটমামা! ছোটমামা!
ছোটমামাও যেন হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমার ডাক শুনে দৌড়ে চলে এলেন। তারপর দেখলুম, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা সেই কঙ্কালের সঙ্গে গেরুয়া খাটো লুঙ্গিপরা আর একটা কঙ্কালের ঘুষোঘুষি চলেছে। ছোটমামা হাঁফাতে-হাঁফাতে বললেন, কী বিচ্ছিরি ব্যাপার! ছ্যা-ছ্যা! মরে গিয়েও কি মারামারি করা উচিত? বল তো পুঁটু!
কান্নাজড়ানো গলায় বললুম,–ছোটমামা! আমরা পালিয়ে যাই।
ছোটমামা আমার হাত থেকে রুমালে বাঁধা মাটিগুলো নিয়ে বললেন,–পালাব কেন রে? আস্তেসুস্থে যাব। মরুক ব্যাটাচ্ছেলেরা মারামারি করে! ছ্যা-ছা! এ কি ভদ্রলোকের কাজ? বাবা কন্ধকাটা হয়তো মজা দেখছেন।
চলে আসবার আগে দেখলুম, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা কঙ্কাল আর গেরুয়া খাটো লুঙ্গিপরা কঙ্কাল পরস্পরকে জাপটে ধরে একটা ঝোঁপের মধ্যে প্রচণ্ড লড়ে যাচ্ছে। আর ঝোঁপটা খুব নড়ছে।…
এসবের চেয়েও অদ্ভুত ব্যাপার, বাবা কন্ধকাটার থানের মাটি দিদিমার কোমরে মাখিয়ে রাখার পরদিনই তিনি বিছানা ছেড়ে উঠতে পেরেছিলেন। মোনা-ওঝা এসে ছোটমামার মুখে সব ঘটনা শুনে বলেছিল, লড়াইটা খুলি বদলের। বুঝলেন ছোটবাবু? গত বছর অনেক জায়গায় খুব বানবন্যা হয়েছিল। অনেক মানুষ জলে ডুবে মারা পড়েছিল। সে-ও তো অপঘাতে মরণ। আর অপঘাতে মরলেই মানুষ ভূত হয়ে যায়। কিন্তু ভূত হলে কী হবে? দেহের ওপর মায়া কি সহজে যায়? কিন্তু দেহ তো তখন কঙ্কাল! আমার মনে হচ্ছে, ওই দুই ভূতের মধ্যে খুলি বদল হয়ে গিয়ে গণ্ডগোল বেধেছিল।
ছোটমামা বলেছিলেন,–ঠিক বলেছ মোনাদা! একজন ছিলেন সাদাসিধে ভদ্রলোক। অন্যজন ছিলেন কোনও সাধুবাবা।
দিদিমা বলেছিলেন, তা না হয় বুঝলুম। কিন্তু যে যার নিজের খুলি ফেরত পেয়ে মারামারি বাধাল কেন?
ছোটমামার অমনি জবাব, মনে হচ্ছে, সাধুবাবার ভূতের জন্য সেই ভূত ভদ্রলোক যে খুলিটা থানে রেখেছিলেন, সেটা সাধুবাবার খুলিই নয়। মাথায় ফিট করেনি বলেই দৌড়ে গিয়ে সাধুবাবা খটাখট ঘুষি মারছিল ভূত-ভদ্রলোককে।
মোনা-ওঝা খিকখিক করে হেসে বলেছিল,–ওসব কথা থাক। মা-জননীর কোমর থেকে পেতনিটা পালিয়ে গেছে। তবে জোরে কামড়ে ধরেছিল তো? তাই ব্যথা পুরোপুরি সারতে আর দিনতিনেক লাগবে।
হ্যাঁ। মোনা ঠিকই বলেছিল। তিনদিন পরে দিদিমা দিব্যি হাঁটাচলা করতে পেরেছিলেন।