Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তুলসী || Moti Nandi

তুলসী || Moti Nandi

দুটি মানুষের কথা

এই কাহিনীতে বলা হয়েছে দুটি মানুষের কথা। তাঁদের একজন পুরুষ ও অন্যজন মেয়ে। পুরুষটির বয়স ষাটের কাছাকাছি। মেয়েটির বয়স প্রায় কুড়ি।

প্রথমে পুরুষটির কথা বলি। ওঁর দৈহিক উচ্চতা পাঁচ ফুট। দেহের পেশিগুলো একটু ভারী। ঘাড় ও গলা ছোট হওয়ায় তাঁকে ঘাড়ে-গর্দানে দেখায়। মনে হয় অল্প বয়সে ব্যায়াম করেছেন এবং হয়তো এখনও চর্চাটা রেখেছেন। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম। চোখে পড়ার মতো বিশেষ কিছুই ওঁর চেহারায় নেই, শুধু উচ্চতাটুকু ছাড়া। তবে বেঁটে মানুষ আমাদের দেশে লক্ষ লক্ষ আছে, সুতরাং এটা কোনও বিশেষত্ব হিসেবে গণ্য হতে পারে না। ওঁর যে মসৃণ টাকটি, সেটাও বহু লক্ষ লোকের মাথায় দেখা যায়। তবে মাথার খুলির গড়ন গোলাকার হওয়ায় টাকটি দুনম্বর ফুটবলের কথা মনে পড়ায়।

এই লোকটির বিশেষত্ব বলে যদি কিছু থাকে তা হলে সেটি হল, ওঁর হাঁটা। হাঁটেন অতি দ্রুত। সাধারণ মানুষ জগ করে যে গতিতে, ইনি হাঁটেন সেই গতিতে। ওঁর উচ্চতার সঙ্গে হাঁটার বেগ, দুটো মিলিয়ে দাঁড়ায় একটা বেমানান দৃশ্য। যেটা হাসি পাইয়ে দেওয়ার জন্য খুবই কার্যকর হয়। যারা ওঁকে প্রথম দেখে, তারা আড়ালে হাসাহাসি করে। তবে প্রতিদিন দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার পর তারা আর হাসে না।

কিন্তু বাজারের কাছের রামপ্রসাদ কলেজ হস্টেলের কোনও কোনও ছেলের হাসির ইচ্ছেটা একটু বেশিই। সকালে বাজার করে থলি হাতে ফেরার সময় যখন তিনি হস্টেলের কাছাকাছি হন, তখন দোতলার বারান্দা থেকে ইদানীং কে একজন মাঝেমধ্যে সুর করে গেয়ে ওঠে:

মাথার ঊর্ধ্বে আছে মাদল
নিম্নে উতল পদযুগল
গড়গড়িয়ে চলিছে বল।
চল চল চল।

শেষের চল চল চল-এর সময় আরও দুটো গলা যোগ দেয়। গানের সঙ্গে টিনের কৌটোয় দুটো কাঠি দিয়ে ড্রাম বাজানোর শব্দ হয়। গায়ক ও বাদককে রাস্তা থেকে দেখা যায় না। আমাদের এই লোকটির নাম বলরাম গড়গড়ি। যেভাবেই হোক হস্টেলের ছেলেরা নামটা জোগাড় করে ফেলেছে।

প্রথমদিকে বলরাম গানটিকে আমলই দিতেন না। ছেলেপুলেরা নতুন কোনও গণসঙ্গীত চর্চা করছে ধরে নিয়ে আপন মনে তিনি হস্টেলের সামনে দিয়ে চলে যেতেন। একদিন তাঁর প্রতিবেশী পান্নালাল বাজার করে ফেরার সময় তাঁকে দাঁড় করিয়ে বলল, শুনেছেন বলুদা, ছেলেরা কেমন প্যারডি বেঁধেছে আপনাকে নিয়ে।

আমাকে নিয়ে। কই, শুনিনি তো! বলরাম খুব অবাক হয়েই বলেন, কেন, কী জন্য?

শুনুন ভাল করে, তা হলেই বুঝবেন। পান্নালাল মুখ টিপে হেসে চলে যায়।

বলরাম হস্টেলের দিকে মুখ তুলে তাকাতেই গানটা শুরু হয়ে গেল। দুবার। শোনার পর তিনি গম্ভীর হয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলেন। ঊর্ধ্বে মাথায় বাজা মাদলটি যে তাঁরই টাক, এবং গড়গড়িয়ে যাওয়া বলটি যে বলরাম গড়গড়ি, এটা বোঝার মতো বুদ্ধি তাঁর আছে। ক্লাস এইট পর্যন্ত বিদ্যের পানু অর্থাৎ পান্নালাল যখন বুঝতে পেরেছে, তখন তাঁর মতো বাংলায় অনার্স গ্র্যাজুয়েটের না বুঝতে পারার মতো। কঠিন ব্যাপার তো এটা নয়। অনার্সে নজরুলের কবিতা তাঁকে পড়তে হয়েছে।

প্রথমেই বলরামের মাথা গরম হয়ে উঠল। ভাবলেন হস্টেলে ঢুকে ছেলেগুলোকে কান ধরে ওঠবোস করাবেন। তারপর মনে হল, এই বয়সে উঠতি জোয়ানদের কান ধরা তাঁর পক্ষে কি সম্ভব হবে? গায়ে ততটা জোর নিশ্চয়ই নেই। আগে নিজের শক্তি যাচাই করে তবেই কান ধরার মতো কাজে নামা উচিত।

কী ভাবে গায়ের জোর যাচাই করা যায়। বলরাম খুবই ফাঁপরে পড়ে গেলেন। তিনি চাকরি করেন বিধাননগরে সরকারি অফিসে। বিদ্যানগর থেকে, যদি ঠিকমতো ট্রেন চলে তা হলে আধঘণ্টা ট্রেনে কাটিয়ে নামেন বিধাননগর স্টেশনে। সেখান থেকে বাসে অফিসে। তাঁর সহকর্মী মনোজ সামন্ত খুবই বিজ্ঞ লোক। বলরাম তাঁকেই জিজ্ঞেস করলেন, সামন্ত বলতে পারো, গায়ের জোর পরীক্ষার উপায় কী?

মনোজ সামন্তর এরকম প্রশ্ন শুনে অবাক হওয়ারই কথা, কিন্তু তিনি হলেন না। শুধু বললেন, কোনও ভারতশ্রীর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে বসুন।

তাতে তো হেরে যাব। বলরামকে হতাশ দেখাল।

তা তো হারবেনই, কিন্তু কতক্ষণে হারবেন সেটা দিয়ে পরিমাপ হবে আপনার গায়ে কতটা জোর রয়েছে।

ধরুন এক সেকেন্ডে হারলাম।

গড়পড়তা সবাই ওই এক সেকেন্ডেই হারবে। সুতরাং আপনার গায়ের জোরও ওই গড়পড়তা সবার মতোই ধরে নেবেন।

এটা তুমি কী বললে! বলরাম অখুশি হলেন। এইভাবে পাঞ্জা লড়ে কি শক্তি মাপা যায়?

তা হলে কীভাবে মাপতে চান? আর মাপতে চাওয়ার উদ্দেশ্যটাই বা কী?

বলরাম একটু বিব্রত হলেন। উদ্দেশ্য তো কটা ছেলেকে কান ধরে ওঠবোস করানো। কিন্তু কেন করাতে চান, সেটা কি সামন্তকে বলা ঠিক হবে?

তবে ঘুরিয়ে অন্যভাবে অবশ্য ব্যাপারটা বলা যায়। এই ভেবে বলরাম বললেন, আমাদের বিদ্যানগরে একটা কলেজ হস্টেল আছে, সেখানে কিছু অ্যান্টিসোশ্যাল ছেলে ঢুকেছে। ওদের জন্য লোকজন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে পারে না।

কেন পারে না?

নানারকম কথাবার্তা বলে, ফিল্মের গান গায়, রাস্তার মাঝে অসভ্যতা করে।

হস্টেল সুপারকে গিয়ে বলুন। তিনি কিছু না করলে থানায় গিয়ে বলুন। মনোজ সামন্ত ঈষৎ বিরক্ত স্বরে বললেন, আপনি কি এজন্য মারপিট করবেন?

মারপিট! কে বলল? বলরাম সচকিত হয়ে উঠলেন।

তা হলে গায়ের জোর পরীক্ষা করে দেখতে চান কেন? গড়গড়িদা সাবধান করে দিচ্ছি, খবরদার ছেলেছোকরাদের সঙ্গে লাগতে যাবেন না। একটা টিঙটিঙে ছোকরা দূর থেকে যদি বোমা ছেড়ে কি পাইপগান চালায় তা হলে কী করবেন? গায়ের জোরের দিন আর নেই, সুতরাং— মনোজ সামন্ত একটা মোটা ফাইলের ফিতে খোলার কাজে ব্যস্ত হয়ে কথাটা শেষ করতে পারলেন না।

বলরাম তাকিয়ে রইলেন সামন্তর দিকে। সুতরাং বলে থেমে গেল কেন? আড়চোখে বলরামের মুখ দেখে নিয়ে সামন্ত আবার বললেন, বুড়োবয়সে গায়ের জোর পরীক্ষা করে লাভ কী?

বুড়োবয়স মানে? আমি কি বুড়ো হয়ে গেছি? বলরাম অবাক হয়ে সামন্তকে যেন চ্যালেঞ্জ জানালেন।

চোখ কুঁচকে মনোজ সামন্ত সেকেন্ড দশেক বলরামের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর মুচকি হেসে বললেন, না, বুড়ো হননি, ছোকরাই আছেন। বয়স কত হল?

সেইদিন বিকেলে ট্রেন ধরার জন্য প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বলরামের মনে হল, সামন্ত বোধ হয় ঠিক কথাই বলেছে। বুড়োবয়সে কেউ কি গায়ের জোর পরীক্ষা করে? কিন্তু একটা কথা তাঁর মনে কাঁটার মতো খচখচ শুরু করল। বিদ্রুপ করেই অবশ্য সামন্ত বলল, ছোকরাই আছেন—কিন্তু থাকব নাই বা কেন?

এই থাকব নাই বা কেন কথাটা বলরামের মাথার মধ্যে এমনভাবে গেঁথে গেল যে তিনি ট্রেনে উঠে মনে করতে শুরু করলেন তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে ছোকরা বয়সে কী কী করতেন। তিনি ফুটবল-ক্রিকেট খেলেননি। কবাডিও নয়। কোনও দলগত খেলার দলে ঢুকতে পারতেন না শুধু এই দৈহিক উচ্চতার জন্য, তাই ওইসব খেলার দিকে যাননি। যে খেলা একা খেলা যায় এবং নিখরচায়, তিনি সেই খেলার দিকেই ঝোঁকেন।

তিনি গঙ্গায় সাঁতার কাটতেন। হাটখোলায় তাঁদের ভাড়াবাড়ি থেকে আহিরিটোলা লঞ্চ ঘাট ছিল মিনিট তিনেকের পথ। সেখানে বেলা এগারোটা নাগাদ তাঁরা জনা সাত-আট ছেলে সাঁতার কাটতে যেতেন। ওপারে সালকিয়ার বাঁধাঘাটগামী ফেরি লঞ্চে উঠে মাঝগঙ্গা পর্যন্ত গিয়ে তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়তেন জলে, সাঁতরে ফিরে আসতেন আহিরিটোলা ঘাটে। বলরাম পিছিয়ে পড়তেন না, কিন্তু সবার আগেও থাকতেন না। মাঝারি ধরনের সাঁতারু ছিলেন। পরপর তিন বছর তিনি বালি ব্রিজ থেকে আহিরিটোলা ঘাট পর্যন্ত সাঁতার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। শেষবারে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিলেন একত্রিশজনের মধ্যে। যে কাপটা পান সেটা ছিল আসল রুপোর। ছোটকাকা স্যাকরার দোকানে দাম যাচাই করে এসে বলেছিলেন, কম করে দেড়শো টাকা তো হবেই।

কাপটা এখন আর নেই। বিদ্যানগরে জমি কিনে, কোনওরকমে একটা দুঘরের বাড়ি তৈরি করে হাটখোলা থেকে দশ বছর আগে উঠে আসার সময় কাপটা হারিয়ে যায়। ট্রেনের কামরায় গাদাগাদি ভিড়ের মধ্যে চিড়েচ্যাপটা অবস্থাতেই বলরাম তাঁর হারানো কাপের কথা ভাবলেন।

মুঠোয় ধরার জন্য ঝোলানো হাতলগুলোয় বলরামের হাত পৌঁছয় না। তাই তিনি চেষ্টা করেন দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়াতে। কিন্তু সবদিন এই সুবিধেটা তিনি পান না, যেমন আজও পাননি। এক একটা স্টেশন এলে হুড়মুড়িয়ে ট্রেনে ওঠার যাত্রীরা কামরার মধ্যে যে ধাক্কা তৈরি করে, তাতে বলরাম সিধে হয়ে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। তখন শরীর বেঁকে যায় এবং বাঁকানো শরীরটাকে সিধে করার জন্য দুপায়ে চাপ দিয়ে পিঠ, কোমর ও কাঁধের পেশি শক্ত করে নিজেকে নিয়ে ধস্তাধস্তি করতে হয়। বলরামকে আজও তাই করতে হল। এবং এই কথার মধ্যেই তাঁর মনে হল, এটা কি গায়ের জোরের একটা পরীক্ষা নয়। রোজই তো এই পরীক্ষাটা দিচ্ছি। আর পাশও করছি, তা হলে কি এটাকে ছোকরা থাকা বলা যেতে পারে না?

বিদ্যানগরের আগের স্টেশন ঠাকুরপাড়ায় ট্রেন পৌঁছবার আগেই বিদ্যানগরে নামার যাত্রীরা দরজার দিকে এগোতে থাকে। ট্রেন থামলেই হুড়মুড়িয়ে নামতে হবে, নয়তো দুড়দাঁড়িয়ে ওঠা বিপরীত স্রোতের বিরুদ্ধে ট্রেন থেকে নামাটা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে যায়। বলরাম আজ চিন্তার মধ্যে ডুবে গিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাওয়ার কাজটা ভুলে গেলেন। যখন খেয়াল হল তখন কয়েক সেকেন্ড দেরি হয়ে গেছে। মরিয়া হয়ে তিনি দরজা দিয়ে ঢোকা যাত্রী-স্রোতের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি শুরু করলেন। তখন কে যেন তাঁর মাথায় একটা চাঁটি দিল। ট্রেনের বাইরে সবে পা রাখতে যাবেন তখন কাঁধে একটা জোর ঠেলা খেয়ে প্ল্যাটফর্মে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গড়াগড়ি গেলেন। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াচ্ছেন, তখন আর একটা ধাক্কায় আবার পড়োপড়ো হয়ে তিনি পেছন থেকে দুহাতে প্রায় জড়িয়ে ধরলেন যাকে, সে একটি মেয়ে।

হলুদ শালোয়ার ও খয়েরি-সবুজ নকশার কামিজ পরা মেয়েটি চমকে ঘুরে দাঁড়াল। একজন বয়স্ক লোককে কাঁচুমাচু হয়ে হাতজোড় করতে দেখে সে সঙ্গে সঙ্গে মুখে হাসি ফুটিয়ে, বলরামকে আশ্বস্ত করে ভিড়ের সঙ্গে চলতে শুরু করে দিল। ট্রেন থেকে নামা লোকের প্ল্যাটফর্মে পড়ে যাওয়া খুবই সাধারণ ব্যাপার। কেউ ফিরে তাকায় না। কিন্তু বলরামের জীবনে এটা প্রথমবার ঘটল। তিনি লজ্জিতভাবে দুপাশে তাকালেন এবং দেখলেন রামপ্রসাদ হস্টেলের দুটি ছেলে, তাদের হাতে ধরা প্লেটে ঘুগনি এবং তারা খাওয়া ভুলে তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তাদের চাউনির মধ্য দিয়ে যে খবরটা বলরাম পড়তে পারলেন, তাতে তাঁর বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল। হয়তো আবার শুরু হবে, গড়গড়িয়ে চলিছে বল।

প্ল্যাটফর্মে পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছোকরা থাকার পক্ষে যেসব যুক্তি খাড়া করেছিলেন সেগুলো তো চুরমার হয়েই গেছিল। এখন ছেলে দুটি ব্যাপারটাকে হস্টেলে কীভাবে চাউর করবে সেটাই বলরামকে অস্বস্তির মধ্যে রাখল।

প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে চার জোড়া রেললাইন পার হয়ে স্টেশনের পুবদিকে এসে বলরাম কলা কেনার জন্য দাঁড়ালেন। তখন দেখলেন সামনের মা তারা সাইকেল গ্যারেজ থেকে সাইকেল নিয়ে সেই মেয়েটি বেরিয়ে এল। সাইকেলটি মেয়েদের জন্য নয়। কলাওয়ালার পাশেই শশাওয়ালা। মেয়েটি শশা কেনার জন্য বলরামের পাশে দাঁড়াল এবং তার দিকে তাকিয়ে সহানুভূতি জানাবার মতো করে হাসল। তুমি কিছু মনে করোনি তো, মা? বলরামের স্বরে ক্ষমাপ্রার্থনার সুর।

তাঁর মনে হয়েছে মেয়েটি বিবেচক এবং বোধ-বুদ্ধিটাও আছে। হালকা টাইপের নয়। সারা মুখ ক্লান্তিতে শুকনো, দুই গাল বসে গিয়েছে। ছিপছিপে লম্বা, কিন্তু দৃঢ় শরীর। শরীর ঘিরে কঠিন জীবনের ছাপ। কোনও প্রসাধন নেই, গহনা বলতে শুধু কানে নকল দুটি সাদা পাথরের ফুল আর হাতে রিস্টওয়াচ। মেয়েটির রং, বোঝা যায় একসময় গৌরই ছিল, এখন রোদে পোড়া, তামাটে। ওর বগলে যে ব্যাগটা, দেখতে চামড়ার মতো হলেও ওটা কমদামি নকল চামড়ার। হাতে ধরা সাইকেলটা খুবই পুরনো, কেরিয়ারে পাকিয়ে রাখা আছে একটা বাজারের থলি।

কাহিনীর শুরুতে যে পুরুষ ও মেয়েটির কথা বলা হয়েছে সেই পুরুষটি বলরাম গড়গড়ি, আর মেয়েটি হল—এখন তিনি যাকে বললেন, কিছু মনে করোনি তো, মা?

না, না, এতে মনে করার কী আছে। নম্র স্বরে সে আশ্বস্ত করল বলরামকে। একজন মানুষ পড়ে যাচ্ছিলেন, তিনি অন্য একজন মানুষকে ধরে সেটা সামলালেন, এটাই তো স্বাভাবিক…ওই শশাটা, ওইটে, ওইটে, ছাড়িয়ে দিন। শশাওয়ালাকে নির্দেশ দিয়ে মেয়েটি মুহূর্তের জন্য ইতস্তত করে বলল, মেসোমশাই, আপনি একটা খাবেন?

না, না, তুমি খাও। বড্ড পেট ভার করে। আমি এই সময় কিছু খাই না।

পেট ভরিয়ে রাখে বলেই তো খাই। বড্ড খিদে পায় এই সময়টায়। বলেই মেয়েটি হেসে উঠল। বলরাম দেখলেন দাঁতগুলো ঝকঝকে কিন্তু অসমান, আর গলার স্বরটি সুমিষ্ট নয় অর্থাৎ কম মেয়েলি।

আমি কলা কিনব, তুমি একটা খাবে?

খাব।

সঙ্গে সঙ্গে জবাব এল। বলরাম খুব খুশি হলেন। মেয়েটির মধ্যে ভান নেই। এমন মানুষের সঙ্গে কথা বলতে তাঁর ভাল লাগে।

লম্বা চার ফালি করা খোসা ছাড়ানো শশাটায় নুন ঢুকিয়ে এক টুকরো কাগজে রেখে, লোকটি তুলে দিল মেয়েটির হাতে। একটা পঞ্চাশ পয়সা লোকটির হাতে দিয়ে সে একটা ফালি তুলে কামড় দিল এবং আড়চোখে কলা কেনায় ব্যস্ত বলরামের দিকে তাকাল।

বলরাম একছড়া কলা কিনে তার থেকে দুটি কলা ছিঁড়ে বাড়িয়ে ধরলেন। মেয়েটি তাড়াতাড়ি শশার টুকরো মুখে পুরে কলা দুটো নিয়ে বলল, একটা দিলেই তো হত।

খিদে পেয়েছে বললে। এইটুকু কলা একটা খেয়ে কি কিছু হয়?

চেইন খুলে ব্যাগের মধ্যে কলা দুটো রেখে মেয়েটি হাসল, পরে খাব, আগে কাগজটা কিনে নিই।

স্টেশন রোডের দুধারে সারি দিয়ে নানারকমের দোকান। সাইকেল রিকশা, অটো রিকশা আর শুধুই সাইকেল রাস্তাটাকে বিশৃঙ্খল করে রাখে। সেইসঙ্গে মানুষের ভিড়ে পথচলা দায়। বাজার কিছু দূরে। ওরা ভিড় ঠেলে হাঁটতে শুরু করল।

কাগজ, মানে খবরের কাগজ? বলরাম জানতে চাইলেন।

হ্যাঁ।

বলরাম বুঝলেন, সন্ধেবেলায় খবরের কাগজ কম দামে বিক্রি হয়, তাই সকালে না কিনে অনেকেই অফিস থেকে ফেরার পথে কেনে। এই মেয়েটিও তাই কেনে। কিন্তু খবরের স্টল তো তারা ফেলে এসেছে, তা হলে যাচ্ছে কোথায়!

তুমি এদিকে খবরের কাগজের দোকান তো পাবে না? বলরাম ভুল ধরিয়ে। দেওয়ার মতো স্বরে বললেন।

মেয়েটি দাঁড়িয়ে পড়ল এবং হেসে ঠিক সামনেই পুরনো খবরের কাগজ ও শিশি-বোতলের দোকানটার দিকে আঙুল তুলে দেখাল।

আমি পুরনো কাগজ কিনব, ঠোঙা বানানো হবে।

বলরাম মনে মনে অপ্রতিভ হলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সামলে উঠে বললেন, ঠোঙা বানানোটা কুটিরশিল্প। তুমি নিজে বানাও?

মা বানান। আমিও হাত লাগাই, মাঝে মাঝে ছোট ভাইও বসে। এর পর ইতস্তত করে বলল, মেসোমশাই, সাইকেলটা একটু ধরবেন, আমি কাগজগুলো আনি।

নিশ্চয়, নিশ্চয়।

বলরাম সাইকেলটা ধরে দাঁড়ালেন। বোধহয় আগেই বলা ছিল, ওজন করে পুরনো বাংলা খবরের কাগজ ডাঁই করে রাখা। সাইকেলের কেরিয়ারে যে বাজারের থলিটা ছিল সেটি আকারে যে কত বড়, বলরাম সেটা আগে বুঝতে পারেননি। এখন মেয়েটি দোকানির কাছে থলির মুখ খুলে ফাঁক করে ধরতে বলরাম সেটা দেখে অবাক হয়ে গেলেন। এ তো বাজারের ছোট থলি নয়, হাতে ধরে চাল বওয়ার জন্য অন্তত পনেরো কেজির থলি। তবে খবরের কাগজের পরিমাণ দেখে তাঁর মনে হল, পনেরো কেজি-র অনেক কমই হবে।

মাস্টারমশাই এখন আছেন কেমন? দোকানি জানতে চাইলেন মেয়েটির কাছে।

সকালে তো জ্বর দেখে বেরিয়েছি। তবে পেটের যন্ত্রণাটা কমেনি। মেয়েটি থলিটা মেঝে থেকে দুহাতে তুলে ভেতরের কাগজগুলো ঝাঁকাল।

ডাক্তারবাবু কী বলেন?

কী আর বলবেন, সেই এক কথা…অপারেশন না করলে…আমি এখন আসি গোপালদা।

আয়।

মেয়েটি এক হাতে থলিটা তুলে সাইকেলের কাছে এল। শরীরটা একটু বাঁকিয়ে, দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট টিপে ধরা।

মেসোমশাই, সাইকেলটা একটু ধরবেন, এটা হাতলে ঝুলিয়ে দিই।

ওজন কত?

দশ কেজি।

যাবে কদ্দুর?

কুলডাঙা।

সেটা কোথায়?

এই তো, মাজাভাঙা, তারপর হোতর তারপর কুলডাঙা..মাইলচারেক।

জবাব দিতে দিতে সাইকেলের হাতলের রডে থলিটা ঝুলিয়ে দিল।

চাআর মাইইল যাবে এই দশ কেজি সাইকেলে ঝুলিয়ে! বলরাম এবার যথেষ্ট অবাক হলেন।

মেয়েটিও অবাক এইরকম একটা কথা শুনে। কেন, আমি তো কতবার কাগজ নিয়ে গেছি! সাইকেল হাতে ধরে সে হাঁটতে শুরু করল, তার পাশে বলরাম। আরও কিছুটা গিয়ে ডান দিকের রাস্তায় তার বাড়ি।

রাস্তার অবস্থা যা! গর্তে ভরা, দশগজ রাস্তাও সমান নয়, তার ওপর অন্ধকার। এই রাস্তায় হ্যান্ডেলে অত ওজন নিয়ে চালাতে গেলে তো পড়ে যাবে! বলরামের উদ্বেগ তাঁর স্বরে ফুটে উঠল।

এখনও তো পড়িনি। হালকা স্বরে মেয়েটি বলল।

কাজটা তো দাদা, কাকা বা বাড়ির কোনও পুরুষ করতে পারে, তুমি একটা মেয়ে।

বলরাম চুপ করে গেলেন। তাঁর মনে হল একটু বেশিই যেন গায়েপড়া হয়ে যাচ্ছে।

আমার দাদা নেই, আমিই বড়, কাকাও নেই, শুধু একটা তেরো বছরের ভাই, স্কুলে পড়ে। বাবা স্কুলমাস্টার ছিলেন। তিন বছর রিটায়ার করেছেন, কিন্তু এখনও পেনশন পাননি। ওই যে গোপালদা বললাম যাঁকে, উনি বাবারই এক ছাত্র। কাগজের দাম নিলেন না। ঠোঙা তৈরি করে গোপালদাকে দিয়ে যাব। বিক্রি করে কাগজের দাম কেটে রেখে বাকিটা আমাকে দেবেন। বাবার আরও ছাত্র আছেন, নানাভাবে সাহায্য করেন।

খবরের কাগজে প্রায়ই তো দেখি, রিটায়ার করে শিক্ষকরা কেউ আট, কেউ দশ বছর পেনশন পাচ্ছেন না। বললাম সহানুভূতি জানিয়ে বললেন, তোমার বাবা নিশ্চয় ভাল শিক্ষক ছিলেন, তাই ছাত্রেরা সাহায্য করছে।

বাবা এখন ঘরভাড়া করে কোচিং খুলেছেন। স্কুলের ছেলেমেয়েদের পড়ান, তাতেই সংসার চলে। আগে কখনও করেননি, এখন করতে হচ্ছে বলে খুব কষ্ট পান।

তুমি করো কী?

কাজের চেষ্টা করছি। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ, চাইলেই কি চাকরি পাওয়া যায়? অনেককে বলে রেখেছি,…মেসোমশাই আপনাকেও কিন্তু বলে রাখলাম। মেয়েটির স্বরে এবার লঘুতার কোনও আভাস নেই।

আমি খোঁজ পেলে তোমায় জানাব। বলরামের গলায় আন্তরিকতা।

মেয়েটি এবার দাঁড়িয়ে পড়ল। আর দাঁড়াল ঠিক রামপ্রসাদ কলেজ হস্টেলের সামনেই। বলরাম মুখ না তুলেই দেখতে পেলেন দোতলার বারান্দায় গুটিতিনেক মুখ নীচের দিকে তাকিয়ে।

এক হাত উঁচু কংক্রিটের একটা চাঙড়া বহুদিনই রাস্তার ধারে পড়ে আছে। মেয়েটি তার ওপর দাঁড়িয়ে সাইকেলের সিটে বসল। লাজুক হেসে বলল, যখন কাগজ নিয়ে যাই তখন এইখানে এসে এইভাবেই উঠি। এমনি উঠতে গেলে ব্যালান্স রাখা যায় না, একবার পড়ে গেছলুম।..আসি তা হলে মেসোমশাই, খোঁজ পেলে বলবেন।

বলরাম কিছু বলার আগেই মেয়েটি সাইকেল চালিয়ে দিল। প্রথম দশ-পনেরো মিটার টালমাটাল হয়ে সাইকেলটা সোজা হল এবং দূরের আলোবিহীন রাস্তার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।

থাকে কুলডাঙায়, কিন্তু মেয়েটির নামটা তো জানা হল না। বলরাম নিজের বুদ্ধিহীনতায় নিজের ওপর বিরক্ত হলেন। যদি কোনও কাজের সন্ধান পান, অবশ্য না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, তা হলে ওকে খবর দেবেন কী করে? একটা উপায় অবশ্য আছে, পুরনো কাগজের দোকানি গোপালকে বলে দিলে মেয়েটি খবর পেয়ে যাবে।

বেশ ভাল মেয়ে, কত সহজে মেসোমশাই ডাকল, ঠিক নিজের মেয়ের মতোই কথা বলল।

বলরাম আরও কিছুটা হেঁটে ডান দিকে বাড়ির পথ ধরার সময় মুখ ফিরিয়ে হস্টেলের বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখলেন মুখগুলো তাঁকে লক্ষ করছে।

বাড়ি ফিরে বলরাম তাঁর স্ত্রী বিমলাকে বললেন, আজ একটি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হল। বড় ভাল মেয়ে। বয়স খুব কম, বলুর থেকেও ছোট। খুব পরিশ্রমী।

বলু অর্থাৎ বলাই, তাঁদের একমাত্র সন্তান। বছর দুই সে খঙ্গপুর আই আই টি-তে ভূ-বিদ্যার ছাত্র। বলরাম-বিমলার সংসারে একটি কাজের মেয়ে ছাড়া আর কোনও লোক নেই। ট্রেনে নামার সময়ের ঘটনা থেকে শুরু করে দশ কেজি কাগজ হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে সাইকেল চালিয়ে কুলডাঙা রওনা হওয়া পর্যন্ত, মেয়েটির আচরণ ও কথাবার্তার সবকিছুর বিবরণ স্ত্রীকে দিলেন বলরাম। বিমলা সব শুনে জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটির নামটা তো বললে না?

বলরাম মাথা অর্থাৎ টাক চুলকে বললেন,ওটা জিজ্ঞেস করার সময় আর পাইনি।

সময় কখনওই তোমার হবে না।

যে সময়ে বিমলা এই কথা বলছিলেন ঠিক তখনই কুলডাঙায় একতলা দুঘরের একটি বাড়ির সামনে মেয়েটি সাইকেল থেকে নামল।

মা, দিদি এসেছে। ভেতর থেকে একটি ছেলে চেঁচিয়ে তার মাকে জানিয়ে দিল।

ব্যস্ত হয়ে টালির চালার রান্নাঘর থেকে মা বেরিয়ে এলেন। ওরে খুকি, জগন্নাথকাকা খবর পাঠিয়েছেন, আজই তোকে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন।

হ্যান্ডেল থেকে কাগজের থলিটা নামাবার জন্য সে ডাকল, বাবু এদিকে আয়। তারপর ক্লান্ত স্বরে সে মাকে বলল, কাল সকালে গেলে হয় না?

বলেছেন আজই দেখা করতে। ওঁর আপিসে বোধ হয় লোক নেবে। মায়ের স্বরে ব্যস্ততা আর ক্ষীণ একটা আশা।

মেয়েটি থলিটা ভাইয়ের হাতে দিয়ে সাইকেলটা ঘোরাল। অন্ধকার রাস্তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে একবার তাকিয়ে নিয়ে সে সাইকেলে উঠল। জগন্নাথ সেন কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসে উচ্চপদে চাকুরে, তাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। থাকেন। বিদ্যানগর স্টেশনের পশ্চিম দিকে।

এখন তাকে চার মাইল সাইকেল চালিয়ে আবার যেতে এবং ফিরতে হবে।

.

মেয়েটি যখন জগন্নাথ সেনের বাড়িতে পৌঁছল, তখন তিনি ছেলের বিয়ের ব্যাপারে ভাবী কুটুমদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। সাইকেলটা বারান্দার ধারে দেয়ালে হেলান দিয়ে রেখে সে সিঁড়ি দিয়ে দুধাপ উঠে বারান্দা থেকে বসার ঘরে উঁকি দিল।

কে? কে ওখানে? ঘরের ভেতর থেকে জগন্নাথবাবু হাঁক পাড়লেন।

আমি তুলসী।

মেয়েটি কুণ্ঠিত পায়ে ঘরে ঢুকল। ঘরে সোফায় দুটি লোক, তাদের মুখোমুখি আর একটি সোফায় জগন্নাথবাবু। মাঝে নিচু টেবিলে দুটি প্লেটে কিছু মিষ্টি আর চা।

ডেকেছিলেন, জগন্নাথকাকা?

হ্যাঁ। দিল্লি থেকে জেনারেল ম্যানেজারের কাছে একটা চিঠি এসেছে। আমরা এবার খেলার ব্যাপারে উৎসাহ দিতে কিছু খেলোয়াড়কে চাকরি দেব। জগন্নাথবাবু এর পর সামনের লোক দুটির দিকে তাকিয়ে বললেন, কিছু মনে করবেন না, আমি এর সঙ্গে একটু কথা বলে নিই।

না, না, মনে করার কী আছে। ওদের একজন ব্যস্তভাবে বলে উঠলেন। আপনি কথা বলে নিন।

আমাদের মিনিস্টার তো খেলাধুলো খুবই ভালবাসেন। গতবছর ফুটবল টিম আমরা করেছি, টেবল টেনিস আর ভলিবলেও টিম হয়েছে কিন্তু সবই ছেলেদের। মিনিস্টার চান মেয়ে খেলোয়াড়দের চাকরি দিতে। বিদেশ থেকে সোনাটোনা তো ওরাই আনে। জগন্নাথবাবু সামনের লোক দুটির দিকে তাকিয়ে শেষের কথাটি বললেন।

পি টি উষা, সাইনি আব্রাহাম। অপেক্ষাকৃত কমবয়সি লোকটি নাম দুটি মনে করিয়ে দিলেন।

আমাদের ছেলেগুলো তো কোনও কম্মের নয়, তাই স্পোর্টস বোর্ড ঠিক করেছে, ছেলেদের নয়, এবার শুধু মেয়েদেরই চাকরি দেবে। বারোজনের কোটা ঠিক করে দিয়েছে ইস্টার্ন সার্কেলের জন্য। আমরা পেয়েছি পাঁচজনের চাকরির কোটা। দুটো ক্লাস থ্রি, তিনটে ক্লাস ফোর-এর চাকরি। কিন্তু পাঁচজন দিয়ে কোনও খেলার টিম তো আর করা যায় না। কাল আমাদের স্পোর্টস ক্লাবের মিটিংয়ে এই নিয়ে আলোচনা হয়েছে, আমি আবার ক্লাবের প্রেসিডেন্ট।

জগন্নাথবাবু সামনের দুই অতিথির দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলেন। তাঁরা দুজন খুব অবাক হলেন।

আপনি স্পোর্টসেও আছেন! কই, এটা তো আমাদের বলেননি? বয়স্কজন। বললেন ঈষৎ সমীহভরে।

এ আর বলার মতো কথা নাকি! এককালে খেলতুম টেলকুম, ফার্স্ট ডিভিশনে ফুটবল খেলেছি, ভলিটাও খারাপ খেলতুম না। তারপর যা হয়, চাকরিতে মন দিলুম, মাঠে যাওয়াও ছাড়লুম। এখন দেখছেন তো শরীরের অবস্থা। জগন্নাথবাবু নিজের বিশাল ভুড়িটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে তৃপ্তমুখে হাসলেন।

তুলসী হাসল না। সে ঠায় দাঁড়িয়েই আছে। জগন্নাথবাবু তাকে বসতে বলতে ভুলে গেছেন। তার নিজেরও কুণ্ঠা লাগছে খাবারের প্লেটের সামনে নিজের থেকে বসতে। তার মুখে ক্লান্তিমাখা উদ্বেগ। জগন্নাথবাবুর কথাগুলো থেকে সে এইটুকু বুঝেছে, পাঁচটা চাকরি ওঁর অফিসে পাঁচজন মেয়ে পাবে, কিন্তু তাদের খেলোয়াড় হতে হবে। কোন খেলার খেলোয়াড়দের জন্য চাকরিগুলো, সেটা এখনও জগন্নাথবাবু বলেননি। তবে স্বাভাবিক বুদ্ধিবিবেচনা থেকে সে ধরে নিয়েছে, রাজ্য পর্যায়ের খেলোয়াড় না হলে সরকারি চাকরি মেলে না।

কাল মিটিংয়ে আমরা ঠিক করলাম, ওলিম্পিকে যেসব খেলা আছে তার মধ্যে থেকে ইনডিভিজুয়াল খেলার একটা-দুটো বেছে তাতেই চাকরি দেব। তুই আর্চারি কি রাইফেল শুটিং কি ব্যাডমিন্টন, এসব খেলা খেলেছিস? স্টেট মিটে চ্যাম্পিয়ান না হলেও অসুবিধে হবে না। সেকেন্ড, থার্ড পজিশন পেলেও আমরা স্পোর্টস বোর্ডে সুপারিশ করে বলব, ভবিষ্যতে এই মেয়েটির উন্নতি করার মতো সম্ভাবনা আছে। তুই এইসব খেলা— জগন্নাথবাবু কথা অসমাপ্ত রেখে তুলসীর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

চোখ নামিয়ে তুলসী শুনে যচ্ছিল। তার মনে হচ্ছে, কী এক অবাস্তব জগতে তার এই জগন্নাথকাকা বাস করছেন! কুলডাঙার মতো জায়গায় বাস করে যে মেয়ে, সে তিরধনুক, রাইফেল, ব্যাডমিন্টন পাবে কী করে? সে শুনেছে মাত্র এইসব খেলার কথা, পাশের বাড়ির টিভি-তে মাত্র একবার দেখেছে। শুনেছে হাজার হাজার টাকা লাগে একটা ধনুক বা রাইফেল কিনতে। ব্যাডমিন্টন খেলার কোনও ব্যবস্থাই নেই। তাদের দশ বর্গ মাইলের মধ্যে।

না কাকা, আমি এসব খেলা কখনও খেলিনি।

তাই তো। জগন্নাথবাবু হতাশ হয়ে যেন ঝিমিয়ে পড়লেন। তা হলে আর কী খেলা জানিস?

সাঁতার জানি, সাইক্লিং জানি তবে কম্পিটিশনে কখনও নামিনি। তুলসী আশাভরে তাকাল। কিন্তু জগন্নাথবাবুর মুখের ভাব বদলাল না দেখে সে দমে গেল।

আমাদের অল ইন্ডিয়া ইন্টার সার্কেল স্পোর্টসে যে-যে বিষয়ে কম্পিটিশন হয়, শুধু সেই খেলাগুলোতেই প্লেয়ার নিয়ে থাকি। তার মধ্যে মেয়েদের সাইক্লিং নেই, সাঁতার অবশ্য আছে। কিন্তু সুইমার নিতে হলে তো আমরা নামী সুইমারই নেব।

নামী মানে, কীরকম নামী? তুলসী জানতে চাইল।

নামী মানে রেকর্ড টেকর্ড করেছে, ন্যাশনালে গোল্ড কি সিলভার পেয়েছে।

তুলসী অপ্রতিভ হয়ে মাথা নাড়ল। সে বুঝতে পারছে জগন্নাথকাকা যা চাইছেন, তা পূরণ করা তার দ্বারা সম্ভব নয়। তবু মরিয়া হয়ে বলল, অ্যাথলেটিকসে তো নিতে পারেন।

জগন্নাথ কিছুক্ষণ তুলসীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কী যেন ভেবে নিয়ে বললেন, অ্যাথলেটিক্স অবশ্য ইনডিভিজুয়াল ব্যাপার, এতে আমরা মেয়ে নিতে পারি। তুই কম্পিটিশানে নেমেছিস কখনও? স্ট্যান্ড করেছিস? এর পর তিনি অতিথি দুজনের প্রতি মনোযোগ করলেন। এ কী, আপনারা এখনও শুরু করেননি? আমাদের এখানকার ক্ষীরের চমচম খুব বিখ্যাত, শুরু করুন।

তুলসী স্কুলে পড়ার সময় বাৎসরিক স্পোর্টসে নেমে পরপর চার বছর প্রথম হয়েছে, একশো, দুশো, চারশো মিটারে। স্পোর্টসের দিন দশেক আগে, মাইলখানেক দূরের হোতরের ফুটবল মাঠে সে কিছুক্ষণ ছোটাছুটি করে নিত। আর তাতেই প্রথম হয়ে যেত। সে এটুকু অন্তত বোঝে, স্কুলের স্পোর্টসের রেজাল্ট দেখিয়ে এইসধ চাকরি চাওয়া যায় না।

কিন্তু এখন সে মরিয়া একটা চাকরি পাওয়ার জন্য। তাই একটা মিথ্যা কথা বলে ভাগ্যপরীক্ষা করতেও রাজি। সূর্য সঙ্ঘের উদ্যোগে প্রতি বছর দৌড়ের রোড রেস হয়। মেয়ে-পুরুষ তাতে দৌড়য়। পথের ধারে ভিড় করে লোকে দেখে, তুলসীও দেখেছে কিন্তু দৌড়ে কখনও নামেনি। কিন্তু এখন সে বলল, পাঁচ মাইল রোড রেসে মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়েছি।

আমাদের ইন্টার সার্কেলে রোড রেস হয় না, আর যা হয় না তাতে চাকরি দিই। তবে মেয়েদের পাঁচ হাজার কি দশ হাজার কিলোমিটার দৌড় হয় কি না বলতে পারছি না। খোঁজ নিয়ে দেখি, যদি হয় তোকে খবর দেব। তবে দৌড়ের থেকে ফিল্ড ইভেন্টে, মানে জাম্পিং-এ থ্রোয়িং-ঐ পয়েন্ট পাওয়ার চান্স বেশি। তাই, নিলে, এইসবেতেই আমরা মেয়ে নেব। তুই ডিসকাসে কি শটপাটে কোনও মিট-এ নেমেছিস?

ফাঁপরে পড়ল তুলসী। কোনওটাতেই সে জীবনে নামেনি। ট্রেনে যেতে যেতে ঠাকুরপাড়া স্টেশনের পাশের মাঠে সে কয়েকটি ছেলে আর মেয়েকে দৌড়, লং জাম্প, ডিসকাস প্র্যাকটিস করতে দেখেছে। ওখানে যুব সম্মিলনী নামে অ্যাথলেটিকসের একটা ক্লাব আছে। একদিন সে একটি মেয়েকে একটা নারকেলের সাইজের লোহার বল ছুড়তে দেখেছে। এই ছোড়াকেই বলা হয় শটপাট। তার মনে হয়েছিল গায়ে জোর না থাকলে লোহার বল ছোড়া যায় না এবং ছবিতে দেখেছে। যেসব মেয়ে ছোড়ে, তাদের তাগড়াই ভারী চেহারা, অথচ সে ছিপছিপে, হালকা। সুতরাং সে শটপাটার এ কথা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। তা ছাড়া চাকরি দেওয়ার আগে সার্টিফিকেট তো অবশ্যই দেখতে চাইবে। তখন সে কী দেখাবে?

তুলসী মাথা নেড়ে জানিয়ে দিল, সে ডিসকাসে বা শটপাটে নামেনি। কিন্তু কাকাবাবু, আমি যদি শিখে নিতে পারি?

এবার ঘরের তিনজনেই বিস্মিত চোখে তার দিকে তাকালেন। বলে কী মেয়েটা! লোহার গোলাটাকে কি হাতের মোয়া বা ডিসকাসের চাকতিটাকে কি গুড়ের পাটালি ভেবেছে নাকি? শিখে নেব বললেই কি শেখা যায়? বছরের পর বছর প্র্যাকটিস তা হলে দরকার হয় কেন?

জগন্নাথবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, তুই এখন যা, এঁদের সঙ্গে এবার কথা বলব। কিছু হলে তোকে খবর পাঠাব।

ঘর থেকে বেরিয়ে সাইকেল হাতে ধরে রাস্তায় আসার সময় সে ভাবল, জগন্নাথকাকা গম্ভীর হয়ে গেলেন কেন? শিখে নিতে পারি শুনে ধরে নিয়েছেন নিশ্চয় মাথায় গোলমাল আছে। সত্যিই হয়তো আছে, নইলে এমন একটা অবান্তর কথা তার মুখ দিয়ে বেরোবে কেন!

সাইকেল চড়ে সে বিদ্যানগর স্টেশনে পৌঁছে সাইকেল থেকে লেভেল ক্রসিংয়ে নামল রেললাইনগুলো পার হওয়ার জন্য। ট্রেন আসছে তাই গেটটা বন্ধ। কিন্তু ধৈর্য হারানো কিছু লোক সাইকেল হাতে ধরে নিচু হয়ে, আড়াআড়ি-থাকা কাঠের খুঁটির তলা দিয়ে বেরিয়ে চলে যাচ্ছে। তুলসীও তাই করল।

ডাউন দুনম্বর রেলের ট্রাকে লোকাল ট্রেনের হুটার শোনা গেল। তুলসী সাইকেল দু-হাতে ধরে উঁচু লাইনগুলো আর পাথরকুচির ওপর দিয়ে ছুট দিল। আপ এক নম্বর ট্র্যাক পেরিয়েছে। দুনম্বরটা পার হতেই একটা গর্ত। বহুদিন ধরেই রয়েছে এই গর্তটা। কিন্তু লম্বা লম্বা ঘাসে আর ফলওয়ালাদের ফেলে দেওয়া ফলের পাতায় ঢেকে থাকায় বোঝা যায় না ওখানে একটা গর্ত রয়েছে। যারা নিয়মিত যাতায়াত করে, তারা জায়গাটাকে চেনে, তাই এড়িয়ে যায়। তুলসীও গর্তটাকে জানে। কিন্তু এখন ট্রেনটাকে সামলাতে গিয়ে তার সরে যাওয়ার মতো সময় ছিল না। গর্তে পড়ল সাইকেলের সামনের চাকা। সেটা টেনে তুলে তিন নম্বর ট্র্যাকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনটা ঢুকল বিদ্যানগর স্টেশনে।

কিছু লোক যারা তুলসীকে এইভাবে লাইন পার হতে দেখল, তারা তার দিকে ভৎসনা-ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে। একজন বলল, একটু ধৈর্য ধরতে পারো না?

আর একজন বলল, এখন মানুষের যেন আর তর সয় না, আধ মিনিটও সবুর করতে পারে না। এত ব্যস্ততা কীসের?

তুলসী মাথা নামিয়ে কথাগুলো শুনতে শুনতে চার নম্বর ট্র্যাক পেরিয়ে স্টেশন রোডে এল। তার মনে হল, সত্যিই তার ধৈর্যটা কম। কিন্তু এই লোকগুলো কি জানে, এখনিই তার একটা চাকরি দরকার। আলসারে বাবা ধুকছেন, আর তিনি সংসার টানতে পারছেন না। তেরো বছরের ক্লাস সেভেনে পড়া ভাই ট্রেনে চিনেবাদাম ফেরি করার কাজ নেবে বলছে। হ্যাঁ, সে খুবই ব্যস্ত।

সাইকেলে উঠল তুলসী। জলতেষ্টা পেয়েছে। খিদেটা এখন হুহু করে বাড়ছে। এখানে ধারেকাছে টিউবওয়েল নেই। শশাটাও যে কখন হজম হয়ে গেছে! আর সেই টাকওলা ভদ্রলোক বললেন কিনা বড্ড পেট ভার করে। এখন তো লোহা খেয়ে সে হজম করে ফেলতে পারে। এত খিদে

আৱ ঠিক এই সময়ই সাইকেলের সামনের চাকার টিউব পাংচার হয়ে চাকাটা বসে গেল। ব্রেক কষে তুলসী সাইকেল থেকে নামল। টায়ারটা আঙুল দিয়ে টিপে সে মাথা নাড়ল। দুমাস আগে একবার সে এই অবস্থায় পড়েছিল। তবু রক্ষা, পাংচারটা হয়েছিল বাড়ির কাছেই, কিন্তু এখন?

তার কাছে পাঁচটা পয়সাও নেই। টিউবটা সারিয়ে নিতে হলে তাকে ধার রাখতে হবে। বিপদের কথা বলে ধরাধরি করলে, জটাধারী সাইকেল রিপেয়ারিং শপ-এর বুড়ো মালিক জটাধারী হালদার হয়তো দয়া দেখাতে পারে। এই ভেবে তুলসী আবার ফিরে এল স্টেশনের দিকে।

হায় কপাল! দোকানটা যে বন্ধ! তুলসী ফ্যালফ্যাল করে বন্ধ ঝাঁপের দিকে তাকিয়ে রইল। সেই সময় পাশের রেডিমেড পোশাকের দোকানের মালিক বলল, আজ দুদিন হল জটুদার দোকান বন্ধ। বোধ হয় অসুখবিসুখ করেছে।

এবার তা হলে সাইকেল হাতে ধরে চার মাইল হেঁটে কুলডাঙায় ফিরে যাওয়া! আজ সারাদিন একটা কাজও তার সফল হল না। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখেছিল বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া প্রসাধনসামগ্রী বিক্রয়ের জন্য কয়েকজন সেলসগার্ল আবশ্যক। সত্বর দেখা করুন। এবং সে আজ কলকাতায় দেখা করতে গিয়ে শুনল পাঁচজন। মেয়ে নেওয়া হয়ে গেছে। পরে আবার নেওয়া হতে পারে। মাঝে মাঝে এসে খবর নেবেন। তারপর জগন্নাথকাকার কাছ থেকেও হতাশ হয়ে ফিরে আসা। এমন সব খেলার জন্য চাকরি, যার একটাও সে খেলেনি। কবাডি, খো খো সে ভালই খেলে। এক বছর সে সূর্য সঙ্ঘের হয়ে কলকাতায় কবাডি লিগে খেলেছে। একবার তার মনে হয়েছিল জগন্নাথকাকাকে বলে আপনারা মেয়েদের কবাডি টিম করুন না! কিন্তু উনি যখন বললেন মাত্র পাঁচজনকে চাকরি দেওয়ার কোটা পেয়েছেন, তখনই সে মনে মনে চুপসে যায়। একটা কবাডি টিম করতে কমপক্ষে বারোজন প্লেয়ার চাই। সাতজন খেলে, পাঁচজন রিজার্ভে থাকে।

সাইকেল হাতে ধরে স্টেশন রোড দিয়ে ইটতে হাঁটতে তুলসীর আর একটা কথা মনে হওয়ায় তার সারাদিনের ব্যর্থতার কষ্টটা যেন আরও বেড়ে গেল। সে একটা মিথ্যা কথা বলেছে। পাঁচ মাইল দৌড়ে সে কখনও নামেনি। অথচ চাকরি পাওয়ার আশায় সে জগন্নাথকাকাকে বলে দিল, মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়েছে! একেই কি বলে অভাবে স্বভাব নষ্ট? ছি ছি ছি, তুলসী মাথা নাড়ল। বাবা, মা, কি ছোটভাইটা শুনলে তার সম্পর্কে কী ভাববে?

লোকটা ঠিকই বলেছে, এত ব্যস্ততা কীসের? আর এই জন্যই তো সে বোকার মতো বলে বসল, আমি যদি শিখে নিতে পারি? গাছে না উঠতেই এককাঁদি! খেলাধুলোয় ওপরদিকে উঠতে গেলে কত ধৈর্যের আর খাটুনির দরকার। আর সে কিনা বলে বসল। তুলসী মাথা নাড়ল। লোকটা ঠিকই বলেছে, একটু কি ধৈর্য ধরতে পারো না? পি টি ঊষা, সাইনি আব্রাহাম কত বছর পরিশ্রম করেছে বলেই না ওপরে উঠেছে। আর আমি, কুলডাঙার তুলসী রায়, আমি কিনা দু-দিনেই শটপাট, ডিসকাস শিখে নিয়ে চাকরি পাব আশা করছি!

স্টেশন রোড শেয় হয়ে গেল। এবার রাস্তায় আর আলো নেই। মাজাভাঙা, হোতর, কুলডাঙা। সামনে ঘুটঘুটে অন্ধকারের দিকে তুলসী তাকাল। আজ সে মোট বারো মাইল সাইকেল চালিয়েছে। পেটে আগুন জ্বলছে। এখনও চার মাইল তাকে। হাঁটতে হবে।

ঠিক আছে। তুলসী হাঁটা শুরু করল।

.

সকালে বাজার থেকে ফিরছেন বলরাম। হস্টেলের কাছাকাছি হতেই শুরু হল অদৃশ্য গায়কদের কোরাস:

ট্রেনের এই খোলা কপাট,
নামে লোক ঝপাত ঝপাত
চিত পটাত
প্ল্যাটফরমের পাষাণ পরে।

বলরাম থমকে দাঁড়ালেন। হঠাৎ তাঁর দেহের সব রক্ত যেন মাথার দিকে উঠতে শুরু করল, ফলে মাথাটা গরম হয়ে উঠল। দাঁতে দাঁত ঘষে অস্ফুটে বললেন, অসভ্যতা এবার বন্ধ করা দরকার। দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে।

চশমা-পরা একটি মুখ মুহূর্তের জন্য বারান্দায় উঁকি দিয়েই সরে গেল। তারপরই আবার শুরু হল:

ওরে ও তরুণ বুড়ো,
গড়াগড়ি দিসনে আরও
লম্ফ মারো।
উঠবে রে চুল টাক উপরে ॥

টাক উপরে যখন শেষ হচ্ছে, বলরাম তখন বাজারের থলি হাতে সিঁড়ি দিয়ে দোতলার বারান্দায় উঠে এসেছেন। দুটি ছেলে রাস্তার দিকে মুখ করে গেয়ে চলেছে। মেঝেয় বসে একজন দুটো কাঠি দিয়ে বনস্পতির একটা গোল টিনে ড্রাম বাজাচ্ছে।

পাজি, হতভাগা, নচ্ছার। চিৎকার করে উঠে বলরাম থলিটা নামিয়ে রেখে চড় কষালেন চশমাপরা, ফরসা, টিঙটিঙে রোগা ছেলেটির গালে।

চশমাটা ছিটকে পড়ামাত্র একটা কাচ ভেঙে গেল। এর পর দ্বিতীয়টির গেঞ্জি ধরে এমন টান দিলেন যে, সে সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল এবং গেঞ্জি ছিঁড়ে গেল। ড্রামবাদক ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। বলরাম টিনের কৌটোয় জোরে লাথি মারতেই সেটা দেয়ালে গিয়ে লাগল।

হতভম্ব অবস্থাটা কাটিয়ে উঠে ওরা তিনজনে একসঙ্গে চেঁচাতে শুরু করল। বলরামের মুখে শুধু একটাই কথা, দাঁড়া, আজ তোদের মজা বার করছি।… ওরে ও তরুণ বুড়ো?… দ্যাখ তবে বুড়োটা কে?

বলতে বলতে বলরাম দু-হাতে অন্ধের মতো ঘুসি ছুড়তে লাগলেন, যার একটাও কিন্তু লাফিয়ে লাফিয়ে সরে যাওয়া ওদের গায়ে লাগল না। এর মধ্যেই ড্রামবাদক, যে রীতিমতো বলিষ্ঠ এবং চটপটে, বলরামকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ল্যাং মেরে মেঝেয় ফেলে দিল। বাকি দু-জন ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁর ওপর।

গোলমালের আওয়াজে হস্টেলের অন্যান্য ছাত্ররা ছুটে এসেছে। কাচভাঙা চশমাটা হাতে নিয়ে টিঙটিঙে যুবক তখন চিৎকার করে যাচ্ছে, বাঁচাও, বাঁচাও। আমরা আক্রান্ত। উপুড় হয়ে পড়া বলরামের পিঠের ওপর চেপে বসে, ছেড়া গেঞ্জি গায়ে ছেলেটি দু-হাতে তাঁর মাথায় চাঁটি মেরে চলেছে আর টিনের ড্রাম বাজাতে। বাজাতে অন্যজন গেয়ে যাচ্ছে, মাথার ঊর্ধ্বে আছে মাদল, নিম্ন উতলা পদযুগল, গড়গড়িয়ে চলিছে বল, চল চল চল।

ব্যাপারটা যদিও বিদঘুটে হাস্যকর, কিন্তু বলরামের কাছে সেটা মর্মান্তিক। হস্টেলের বয়স্ক ছাত্ররা এমন একটা দৃশ্য দেখে প্রথমে থতমত খেয়ে যায়। তারপর ছুটে গিয়ে একজন বলরামের পিঠের ওপর থেকে ড্রামবাদককে টেনে নামাল।

হচ্ছে কী? একজন বুড়ো লোককে এইভাবে হেনস্থা করে?

এই বুড়ো লোক আমাদের কী করেছে, অনিলদা তুমি কি সেটা দেখেছ? তুমি শুধু ওকে হেনস্থা করাটাই দেখলে। হেনস্থা নয়, এটা হল আত্মরক্ষা। ড্রামবাদক বাজনা থামিয়ে কথাটা বলেই আবার তার বাদন শুরু করল।

উঠে আয়, ওঠ ওঠ। অনিলদা নামের ছাত্রটি বলরামের পিঠ থেকে টেনে তুলল ছেড়া গেঞ্জিপরা ছেলেটিকে।

বলরাম উপুড় হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তিনি কিছুই ভাবছেন না। মাথার মধ্যে শুধু অন্ধকার আর ঝোড়ো বাতাসের মতো শোঁশোঁ শব্দ। প্রচণ্ড রাগে জ্বলে ওঠার বদলে এখন তিনি গভীর লজ্জায় ডুবে যাচ্ছেন। কেন, কেন, এমন একটা বোকামি করতে গেলাম? এই কথাটাই এখন তাঁকে ছোবলাতে শুরু করেছে।

তিনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। কপালে, নাকে ধুলো লেগে। বাহু তুলে পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে ধুলো মুছলেন। বারান্দার এককোণে বাজারের থলিটা কাত হয়ে রয়েছে। দুটো পেঁয়াজ মেঝেয় পড়ে। বলরাম নিচু হয়ে পেঁয়াজ দুটো তুলে থলির মধ্যে রেখে, মাথা নিচু করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলেন।

এতক্ষণ ওরা কেউ নড়েনি, শুধু চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল। বলরাম নীচে নেমে যেতেই ওরা বারান্দার পাঁচিলে এসে নীচের দিকে তাকাল। থলি হাতে পাঁচ ফুট এক ইঞ্চির একটি মানুষ মাথা নামিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, হাঁটছেন ধীরগতিতে। কী যেন তিনি ভাবছেন।

আর যদি একবারও তোরা গান ধরিস, তা হলে এই রামপ্রসাদ হস্টেলে তোদের। আর।

অনিলদা, আমরা তো ওঁর নাম করে গান—

চওওপ। বিশাল একটা দাবড়ানিতে, ওরা তিনজন মিইয়ে গেল।

তিনটে ছোকরা মিলে একজন বুড়ো মানুষকে মারছিস, লজ্জা করে না। তোরা কি ইয়াংম্যান? উনি কী অন্যায় করেছেন তা আমার জানার দরকার নেই। আমি শুধু দেখলাম তিনটে অল্পবয়সি ছেলে একজন বুড়ো মানুষের গায়ে হাত তুলেছে। উনি বিনা দোষে যদি মারেনও, দাঁড়িয়ে মার খাবি, তাতে লজ্জার কিছু নেই। গায়ে জোর থাকলেই ইয়াং হয় না, বুঝলি, ম্যান বলেও একটা কথা আছে। আগে ম্যান হওয়ার চেষ্টা কর…এই বলে রাখলাম, হস্টেলের বদনাম হয় এমন কাজ আর যেন না ঘটে।

অনিল ঘরে ফিরে যাওয়ার সময় জলন্ত চোখে তিনজনের দিকে তাকিয়ে গেল।

বলরাম বাড়ি ফেরার পথে ভাবছিলেন, সত্যিই তিনি বোধ হয় বুড়ো হয়ে গেছেন। তাঁর ধৈর্যশক্তি কমে গেছে, সহিষ্ণুতা লোপ পেয়েছে। তা না হলে এমন করে রেগে উঠবেন কেন? ওরা প্যারডি বেঁধেছে তো কী হয়েছে? মজা করতে চেয়েছে তো মজা। করুক। ওদের সঙ্গে আমারও তো মজা পাওয়া উচিত ছিল। ভগবান আমাকে এমনই। একটা চেহারা দিয়েছেন, এতে আমার তো কোনও হাত নেই। হাঁটাটা অবশ্য আমার নিজস্ব। এটা বদলাবার চেষ্টা করা উচিত ছিল, কিন্তু আমি তা করিনি। লোকে আমার হাঁটা দেখে হাসে। হাসবেই তো! যা ঘটে গেল, নিশ্চয় এটা জানাজানি হয়ে যাবে। রসিয়ে রসিয়ে লোকে বলাবলি করবে আর হাসবে। ইসস্…।

বলরামের চোখে জল এসে গেল। পাঞ্জাবির হাতায় চোখ ঘষলেন। আর ধীরে ধীরে তখন তাঁর মনের মধ্যে একটা লোহার মতো কঠিন ইচ্ছা দানা বাঁধতে শুরু করল। বাড়িতে ঢোকার আগে সদর দরজায় কয়েক সেকেন্ড দাঁড়ালেন। ফিসফিস করে নিজেকে শুনিয়ে তিনি বললেন, আমাকে বুড়ো না হওয়ার পরীক্ষা দিতে হবে।

Pages: 1 2 3 4
Pages ( 1 of 4 ): 1 234পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress