Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রহস্য || Sanjib Chattopadhyay

রহস্য || Sanjib Chattopadhyay

রহস্য

বাস এসে গেছে টার্মিনাসে। সবাই নেমে যাচ্ছেন। আমি আর আমার বন্ধু একেবারে পেছনের সিটে জায়গা পেয়েছিলুম। আমি নামার জন্যে হুড়োহুড়ি করছিলুম, আমার বন্ধু বলাই বললে, ‘চুপ করে বোস, অত হুটোপাটির কী আছে। সবাই নেমে গেলে ধীরেসুস্থে নামব।’ আমরা দু প্যাকেট চিনেবাদাম কিনেছিলুম। এখনও কিছুটা আছে। তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছি। মেজাজ খুব ভালো। সবে পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পরীক্ষা ভালোই দিয়েছি। বলাই একটু বেশি ভালো দিয়েছে, আমি একটু কম ভালো।

করুণাময়ীতে বলাইয়ের পিসিমা থাকেন, আমরা সেইখানে যাছি কয়েকদিন ছুটি কাটাতে। বড় পুকুর আছে, মাছ কিলবিল। বাগান বিশাল। আম, জাম, পেয়ারা, কাঁঠাল। ফুল! সে দেখার মতো। এত বড় ছাত যে ফুটবল খেলা যায়, ধাঁই ধাঁই। তিনখানা পিসতুতো ভাই। ঘুড়ি-লাটাই আছে। একেবারে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি একটা বাড়ি। পিসেমশাইয়ের জবরদস্ত একটা লাইব্রেরি আছে ডিটেকটিভ বইয়ে ঠাসা। আমরা খাব, বেড়াব, খেলব, পড়ব, গল্প করব, ঘুড়ি ওড়াব। আমরা রাজা হয়ে যাব ক’দিনের জন্যে।

সবাই নেমে গেছে। বাস একেবার ফাঁকা।

বলাই বললে, ‘চল এইবার আমরা নামি। গুঁতোগুতি করবি কেন, আমরা ছাগল না গরু? আমরা মানুষ। তোকে বলেছি, মানুষের তিন গুণ স্থৈর্য, বীর্য, ধৈর্য। একথা আমাকে আমার দাদু বলেছেন। আমি সেই মতো চলার চেষ্টা করি।’

যেই আমরা উঠে দাঁড়িয়েছি, কী দেখছি, সামনের সিটের জানলার দিকে সুন্দর দেখতে একটা হাতব্যাগ পড়ে আছে। আমরা থমকে গেলুম। বলাই বললে, ‘কী হবে? ব্যাগ ফেলে মালিক নেমে গেছে।

আমি বললুম, ‘কী হবে? আমাকে আমার দাদু বলেছেন, পরদ্রব্যেষু লোষ্ট্রবৎ।’

‘মানেটা করে দে?’

‘পরের জিনিসকে ইট-পাটকেল জ্ঞান করবে।’

বলাই খপ করে ব্যাগটা তুলে নিয়ে বললে, ‘চল।’

বাসস্ট্যান্ড থেকে পিসিমার বাড়ি অনেকটা। আমরা একটা সাইকেল রিকশায় উঠে বসলুম। বদ্রীবাবুর বাড়ি যাব শুনে রিকশাচালক দুহাত তুলে নমস্কার করে বললে, ‘মানুষ তো নয়, নরনারায়ণ। ভাড়াটা আগেই ঠিক করে নেওয়া ভালো। তোমরা সব একালের ছেলে, বিশ্বাস নেই, ভাড়া দেওয়ার সময় ঝগড়া করবে।’

বলাই বললে ‘ভাড়া কত?’

‘পাক্কা পাঁচ টাকা।’

‘এ কী, গত মাসের আগের মাসে চার টাকায় গেছি!’

‘কথা একটা বললে বটে! পেট্রোল আর ডিজেলের দামটা যে ঝট করে বেড়ে গেল। কাগজ-টাগজ পড়ো না, না কি! দেবতা গৌরাঙ্গ সব বাড়িয়ে দিয়েছে। সব জিনিসের দাম বেড়ে গেল। মানুষের দাম কমে গেল।’

বলাই বললে, ‘দেবতা গৌরাঙ্গ নয়, দেবগৌড়া।’

‘ওই হল।’

রিকশা চলতে শুরু করল। কিছুদূর গিয়ে বললে, ‘অনেক খেয়েছি, আর খাব না।’

‘কী খাবে না?

‘বদ্রীবাবুদের অনেক খেয়েছি পালাপার্বণে, উৎসবে; আর খাব না।’

‘কেন খাবে না, পেটে সহ্য হবে না?’

‘তোমরা আমার কথাটা বুঝলে না। লুচি-মণ্ডার কথা হচ্ছে না। সে যদি না খাই তাহলে বাঁচব কী করে! এই তো গুরু পূর্ণিমা আসছে। উৎসবটা কেমন জমবে একবার ভাবো।’

‘সেই জন্যেই তো এলুম আমরা।’

‘সে এসো, তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই। আমার কথা হল, তোমাদের কাছ থেকে ভাড়া নেব না। ও তরফে অনেক খেয়েছি, এখনও খাব, এ তরফে চার টাকা ভাড়া নিয়ে ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করব না।’

‘সে বললে আমরা শুনব কেন! তুমি এতটা পথ বিনা পয়সায় আনবে কেন? যা ভাড়া তা দেবই। চার টাকা। পাঁচ টাকা কিছুতেই না।’

‘সে যদি রোক করো তাহলে আমাকে নিতেই হবে। তোমরাও তো ভগবান। ভগবানের দান না নিলে ভগবান রাগ করবেন। আমি মানুষকে ভয় পাই না, ভয় ভগবানকে। ভগবানের মার দুনিয়ার বার।’

রিকশা চলেছে। উঁচু-নীচু পথ। মাঝে মাঝে পেছন দিকটা সিট থেকে উঠে পড়ছে।

বলাই আমার কানে ফিশফিশ করে বললে, ‘ব্যাগটায় মালকড়ি বেশ মোটারকম আছে।’

‘কী করে বুঝলি?

‘টিপে টিপে দেখছিলুম এতক্ষণ।’

‘চট করে একবার খুলে দেখে নে না।’

‘না, দেখলেই লোভ হবে।’

‘তাহলে কী করবি? ধরে বসে থাকবি?’

‘তিন রকম ভেবেছি, বাসগুমটির অফিসে জমা দেব, থানায় জমা দেব, গরিবদের দান করব।’

‘তাহলে এই রিকশাচালককে দিয়ে দে।’

‘না, তিনটেই ক্যানসেল।’

‘কেন?’

‘গুমটি, পুলিশ, মালিক পাবে না, এ লোকটা গরিব হলেও ধার্মিক, নেবে না।’

‘তাহলে?’

‘চতুর্থ পথ শ্রেষ্ঠ পথ।’

‘সেটা কী?’

‘লোষ্ট্রবৎ জলে ফেলে দেব। কেউ পাবে না।’

জোড়া পুকুরের ধারে রিকশা থেকে নামলুম। মাঝখান দিয়ে পায়ে চলা পথ এগিয়ে গেছে বদ্রীভবনে। বাঁকা খেজুরের মোড়। এসব নাম আমরা রেখেছি। বাঁকা খেজুর মানে, একটা খেজুর গাছ বেঁকে পুকুরের জল ছুঁয়ে সোজা আকাশের দিকে উঠে গেছে।

আমরা সেই জায়গাটায় পরামর্শ করার জন্যে থেমে পড়লুম। বাঁক ঘুরলেই পিসিমার বাড়ি। জায়গাটা বেশ নির্জন। পরামর্শটা জমবে ভালো। বাঁকা খেজুর গাছটায় বসতে গিয়েও বসলুম না।

বলাই বললে, ‘আমার মামা বলেছেন, খেজুরে বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি সাপ থাকে।’

আমরা তখন শীতলা মন্দিরের চাতাল পেরিয়ে, পেছনের পুকুরধারে বাঁধানো ঘাটে বসলুম। কেউ কোথাও নেই। পরিষ্কার জল। টুপুর-টাপুর কতক পাতিহাঁস সাঁতার কাটছে। মাথা ডুবিয়ে ডুবিয়ে চান করছে। অকারণে প্যাঁক প্যাঁক করে ডেকে উঠছে, যেন কেউ পেটে চাপ মারছে।

বলাই বললে, ‘দেখ সন্তু, ভীষণ লোভ হচ্ছে, তোর হচ্ছে না?’

‘হচ্ছে না মানে, ভীষণ হচ্ছে। কত কী কেনা যায় বলপেন, স্পোর্টস শার্ট। ফুটবল খেলার বুম, ঘুড়ি-লাটাই, রিস্টওয়াচ, একটা এফ এম রেডিও।’

‘এই লোভ খুব খারাপ। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।’

‘আমি ইংরেজিটা বলি, অ্যাভারিস বিগেটস সিন, সিন বিগেটস ডেথ।’

‘তাহলে দেখছিস, বাংলাতেও যা বলছে, ইংরেজিতেও তাই বলছে। আমার বাবা সেই কারণে শিক্ষা দিয়েছিলেন, রাস্তাঘাটে কিছু পড়ে থাকলে একেবারে তাকাবে না। তাকালেই তুলতে ইচ্ছে করবে। মনে করবে তুমি দেখতেই পাওনি।’

‘আমার বাবাও সেই কথা বলেছেন।’

‘তাহলে এটাকে এই পুণ্যিপুকুরে বিসর্জন দিই।’

‘একবার খুলে দেখবি না?’

‘দেখলেই লোভ হবে।’

আমি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলুম, তার আগেই মাঝপুকুরে ঝপাং। গোল গোল ঢেউ উঠল। হাঁসগুলো দোল খেল। আমরা পা বাড়ালুম পিসিমার বাড়ির দিকে।

বলাই বললে, ‘এখন বেশ হালকা লাগছে না?

‘বেশ শান্তি!’

পিসিমার বাড়ির উঠোনে পা দিয়েই শুনলুম, একতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে পিসেমশাই এক মধ্যবয়সি মহিলাকে বলছেন, ‘ব্যাগটা তুমি বাসেই ফেলেছ বুঝলে কী করে? কত টাকা ছিল?’

‘হাজার টাকা। একশোটা দশ টাকার নোটের একটা বান্ডিল। ব্যাঙ্ক থেকে তুলে বাসে উঠলুম।’

‘ব্যাগ তো মেজদি, লোকের হাতে থাকে।’

‘হাতেই ছিল। একটুক্ষণের জন্যে পাশে রেখে পানমশলা খাচ্ছিলুম, তারপর ভুলে গেছি তো ভুলেই গেছি। বেমালুম ভুল। জানিস তো আমার ভুলো মন! এখন কী হবে ভাই, অতগুলো টাকা!’

‘চলো একবার বাসগুমটিতে গিয়ে দেখি।’

আমি আর বলাই বাড়ির ভেতর না গিয়ে পেছনের বাগানে চলে গেলুম। বেশ কিছুটা হেঁটে পুকুরপাড়ে। আবার পরামর্শ।

বলাই বললে, ‘এইবার কী হবে?’

‘চল সোজাসুজি বলে দিই, ব্যাগ পুণ্যিপুকুরে।’

‘পাগল হয়েছিস। বলবে আমরা পকেটমার।’

‘বলতে পারে, তাই না?’

‘বলবেই। আর ও ব্যাগ তো জাল ফেলতে উঠবে না। ডুবুরি নামাতে হবে।’

‘তাহলে?

‘তুই তো ডুবসাঁতার জানিস?’

‘সে জানি, ভালোই জানি।’

‘তাহলে চল ব্যাগটাকে উদ্ধার করি।’

‘করে?’

‘করে, গুমটিতে জমা দিয়ে বাড়ি ফিরে যাই।’

‘এইবার ওরা যদি বলে, এতক্ষণ ছিলে কোথায়, ব্যাগটা ভিজে কেন?’

‘সেটা একটা কথা বটে। তাহলে ব্যাপারটা ভুলে যা।’

আমরা গরম লুচি আর আলুভাজা খাচ্ছি, বারান্দায় বেতের চেয়ার-টেবিলে বসে। মনটা বিষণ্ণ এমন সময় পিশেমশাই মেজদিকে নিয়ে হাসতে হাসতে, নাচতে নাচতে ফিরলেন, ব্যাগ পাওয়া গেছে টাকা সমেত। বলাই আর আমি হাঁ হয়ে গেছি। ওটা তাহলে কার ব্যাগ!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *