ভয় পেলে চলবে না
শীত তাহলে সত্যিই এবার বিদায় নিল। যাক বাবা বাঁচা গেল। রোজ সকালে গায়ে ঠান্ডা জল ঢাললেই পিলে চমকে যেত। কেমন একটা মৃত্যুর চিন্তা আসত। মনে হত কেউ যেন কফিনে পুরে। সাত হাত মাটির তলায় ধীরে ধীরে নামিয়ে দিচ্ছে। কানের কাছে অস্পষ্ট সুরে কেউ যেন বলে চলেছে, রাম নাম সৎ হয়। এই শহরের পক্ষে শীতই ভালো। আমরা মা ষষ্ঠীর কৃপায় সংখ্যায় মন্দ বাড়িনি। গিজগিজ করছি চারপাশে দ্বিপদ পোকার মতো। বাসে-ট্রামে মাখোমাখো জয়নগরের মোয়ার মতো নিত্য আসা-যাওয়া। সহনশীল বাঙালি। সাত চড়েও রা কাড়ি না। নাকে কাঁদি না। আমরা বড় হয়েছি না! এখন কি আর বাসের জন্যে, ট্রামের জন্যে ঘ্যান ঘ্যান করা সাজে? পরিবহন মন্ত্রী কী বলবেন? কী বলবেন পথমন্ত্রী, পরিবেশ মন্ত্রী, পুরমন্ত্রী? শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে ঝটাপটি লেগে যাবে। কী শেখালেন মশাই বুড়ো খোকাদের? এখনও প্রথমভাগোক্ত সুবোধ বালকটি হতে পারেনি। যাহা পায় তাহাতেই সন্তুষ্ট। ধেই ধেই নৃত্য।
গ্রীষ্মে বাস অথবা ট্রাম অথবা ট্রেনের ভেতর জঠরাভ্যন্তরের উত্তাপে মানুষ সেদ্ধ হয়ে যায়। শীতে মোটামুটি আরামেই থাকা যায়। রামের ঘাড়েশ্যাম, শ্যামের ঘাড়ে যদু। বহুকাল আগে একটা। গান শোনা যেত, মনে হয় ভবিষ্যৎ কলকাতার দিকে চেয়েই লেখা হয়েছিল ইচক দানা, বিচক দানা, লেড়কার উপার লেড়কি নাচে, কত্তা হ্যায় দিও না। মানে বলতে পারব না, তবে কেয়াবত গানা। আবার রিপিট ব্রডকাস্টের জন্যে রিপিটেড রিকোয়েস্ট রইল। বাস, মিনিবাস, ট্রাম, ট্রেন, স্টেশান—সর্বত্র ওই গানটি পুনরুদ্ধার করে বাজানো হোক। আজকাল একরকম বাস বেরিয়েছে যার নাম স্পেশ্যাল বাস। কীসে স্পেশ্যাল? না ডবল ভাড়া। আর কী স্পেশ্যাল? না ঝুলে ছোট। ফতুয়ার মতো। চালে চাঁদি ঠেকে যায়। আর? তার একটি কেরামতির দরজা আছে। সেই দরজার ফাংশান? বাড়তি উত্তেজনার খোরাক। প্রথমত, তার কাজ :হল, যে উঠছে তার পশ্চাদ্দেশে ক্যাঁত করে একটি লাথি মারা। কারণ ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই কেউ না কেউ, অতি সাবধানী দরজাটি বন্ধের জন্যে হয় সবেগে ঠেলে দেবেন, না হয় টেনে দেবেন। কিংবা অভ্যাসবশে নিজেই টেনে, বাপ বলে সামনে ঝুঁকে পড়ব। প্রায়শই পরিমাণের তুলনায় বেশি মানুষ ঢুকবেন, তখন ওই দরজা কাল হয়ে দাঁড়াবে। দরজা যখন বন্ধ করতেই হবে তখন রাস্তার লোক ঠেলতে থাকবে, আউর থোড়া হেঁইও, বয়লট ফাটে হেঁইও। যেন চেঞ্জ থেকে ফেরার সময় সুটকেসের ডালা বন্ধ হচ্ছে। যেন টিনের কৌটোয় বড়ি ঠাসা হচ্ছে। চাপের ধর্মই হল বস্তুকে ঊর্ধ্বে ঠেলে তুলে দেওয়া। দরজার কাছাকাছি কিছু মানুষ চাপের চোটে ওপরে উঠে গেলেন। পদতলে বাস নেই, বায়ু। ত্রিশঙ্কু যাত্রী অন্যের অঙ্গবাহী হয়ে প্রেমানন্দে চলেছেন। শ্রীচৈতন্যের দেশ। ব্যাটা, জগাই-মাধাই হয়ে থাকার জো আছে। চাপের চোটে প্রেম বেরোবে। ওই দরজা আবার খোঁতা মুখ ভোঁতা করে। নিয়ম হল, যাকে বলে রুল অফ দি গেম, নেমেই বন্ধের জন্যে দরজা পেছন দিকে দুম করে। ঠেলা। আর কেউ অন্যমনস্ক নামলে, দরজা সপাটে মুখে। এ দরজা হল আঙুল-সামাল-দরজা। একটু এদিক-ওদিক হলেই আঙুল দরজার কেরামতিতে পুঁটকিপাঁট। কত রঙ্গ জানো যাদু, কত রঙ্গ জানো। ল্যাঙোটের পকেট! তা নন-স্পেশ্যাল বাসের যদি স্পেশ্যাল দরজা থাকে, তা হলে। প্রেরণাদায়িনী ওই সংগীত কেন সর্বত্র বাজবে না! ভাড়া তাতে দু-চার পয়সা বাড়ে বাড়ুক। সব। রকম চাপ সহ্য করার অসীম ক্ষমতা আমাদের আছে। শুধু একটু মিউজিক চাই। হিন্দি সিনেমার নায়ক-নায়িকা খাবি খেতে খেতে গান গায়। পাহাড়ের মাথা থেকে আত্মহত্যার জন্যে ঝাঁপ মারে। পড়ছে তো পড়ছেই, আর সেই সঙ্গে চলেছে গান—এ দুনিয়া এ মহফেল, কুছু কামকা নেহি। ঝপাৎ। স্থলে অথবা জলে নয়, একেবারে নায়কের কোলে। সঙ্গে সঙ্গে ডুয়েট, প্যায়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া, পমপম পম। একেবারে কাশ্মীর গুলমার্গ, ফিলানমার্গ। ভূস্বর্গ তো সবেধন নীলমণি ওই একটাই।
নাঃ। শীত চলে গেল। আবার সেই আসছে বছর। তিনি আসবেন শিশিরের বিন্দুতে, অগ্রহায়ণের কুয়াশায়। তখন কে থাকে কে কেঁসে যায়! অ্যাডমিনিস্ট্রেশানের দাবি অবশ্য ডেথ-রেট কমে। গেছে। দশ, বিশ, তিরিশের দশকে মানুষ যত টাঁসত এখন আর তত টাঁসে না। তা ঠিক। নরম্যাল ডেথ আর কই। কদাচিৎ একটি-দুটি বলো হরি চোখে পড়ে। বেশির ভাগই তো অস্বাভাবিক। মৃত্যু। তাকে মৃত্যু বলে না। রকের ভাষায় বলে মায়ের ভোগে যাওয়া। তান্ত্রিকের ভাষায় নরবলি। সমাজতত্ববিদদের ব্যাখ্যায় প্রগতি। আমেরিকায় এইরকম হয়। ওয়ারেন বার্গারের রিপোর্ট বলছে ওয়াশিংটনের জনসংখ্যা ছ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার। ১৯৮০ সালের পরিসংখ্যান, সুইডেন। কিংবা ডেনমার্কের জনসংখ্যা ১৮ গুণ বেশি। তবু ওয়াশিংটনে খুনের হার অনেক বেশি। আমেরিকায় বছরে ২৪ হাজারের মতো মানুষ খুন হয়। এই ২৪ হাজারের মধ্যে বিশ হাজারের প্রাণ যায় গুলিতে। ৬০ মিলিয়ন পিস্তল, ২০৩ মিলিয়ন অন্যান্য ছোটখাটো আগ্নেয়াস্ত্র আমেরিকানদের হাতে হাতে ঘুরছে। আমরা যদি ওই রেকর্ড ম্লান করে দিতে না পারি তবে কীসের প্রগতি! যুক্তি-শাস্ত্র কী বলে? আমেরিকায় প্রতি তৃতীয় পরিবার সমাজবিরোধীদের শিকার। আমাদেরও ভাগ্যকে সেইদিকে নিয়ে গেলে আমরাও আমেরিকান। বয়েস বাড়লে যেমন গোঁফ বেরোয়, সেইরকম আমাদেরও দেশে চওড়া চওড়া রাস্তা বেরোবে। প্রত্যেকের বাড়ি, গাড়ি, ফ্রিজ হবে। চতুর্দিকে একেবারে জমজমাট। বিরাট বিরাট স্কাই-স্ক্র্যাপার আকাশে মাথা ঠেলবে। ময়দান থেকে রকেট উড়ে যাবে আকাশের ঠিকানা নিতে। ফুটপাথের সমস্ত মানুষ উঠে যাবে অট্টালিকায়। সুন্দর সুন্দর জামা-কাপড় পরে ফ্রিজ থেকে ফ্রোজন খাবার বের করে, জর্জ। ওয়াশিংটন যেরকম সোফায় বসতেন সেই রকম বাঘা সোফায় বসে, চুকচুক করে খেতে খেতে কালার টিভিতে হ্যান্ডবল দেখবে। মাঝে মাঝে ভেসে উঠবে দেশনেতাদের মুখ। তাঁদের জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শুনে আর মুখ বাঁকিয়ে হাসতে ইচ্ছে করবে না। সম্ভ্রমে মাথা নীচু হয়ে যাবে। পাশে থাকবে সুন্দরী বউ। পরিধানে বেনারসী। চুল ফুরফুরে। মাথায় একটিও উকুন নেই। অঙ্গে খুচলি নেই। ঘুনসি পরা উদোম শিশুর দল নিয়ত মনে করিয়ে দেবে না, কীসের তুমি পিতা! কোথায় আমার আহার, পুষ্টি আর শিক্ষা। মনুমেন্টের তলায় ঝান্ডা পুঁতে, গালগলা ফুলিয়ে শূন্যে ঘুষি ছুড়ে, বক্তৃতা দিয়ে যা হল না মাইলের পর মাইল মিছিলে মেড়ার মতো ঘুরে যা হল না, অনবরত দল ভেঙে, গড়ে, পালটে যা হল না; নরবলিতে তা অবশ্যই হবে। আমাদের শেষ পথ, এই হল আমাদের তুরুপের তাস। হাতের কাছে যাকে পাও, তাকেই মেরে যাও।
একে হত্যা বলা মনে হয় ঠিক হবে না। আমাদের ছেলেরা, স্বাধীন দেশের সোনার চাঁদ ছেলেরা, অ্যানাটমি অর্থাৎ দেহবিদ্যা শিখছে, অস্ত্রোপচার শিখছে। কচি কাটছে, বুড়ো কাটছে, জ্ঞান। বাড়ছে। তা ছাড়া যারা পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে, তাদের দিক থেকে যখন কোনও প্রতিবাদ নেই, তখন তাদের মানুষ ভাবাটা ঠিক হবে না। মানুষ হলে প্রতিবাদে রুখে দাঁড়াত। একজোট হয়ে তেড়ে যেত! রোজই তো শয়ে শয়ে ছাগল কাটা হয়। কই ছাগলরা তো প্রতিবাদ করে না। তাদের বংশৃদ্ধি তো বন্ধ হয় না। শয়ে শয়ে ব্যা ব্যাকরে পৃথিবীতে আসছে আর এক কোপে ভ্যা করে বিদায় নিচ্ছে।
যাক শীত তাহলে চলেই গেল। সোয়েটার-টোয়েটার এইবার ঘুমোতে যাবে। উলবোনা কাঁটা ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ তুলে পড়ে থাকবে কিছুকাল। কপি, পালং শাক, শুটি, টোম্যাটো বাজার থেকে যাই যাই করছে। আসছে কচু-ঘেঁচু, কুমড়ো, ভেণ্ডি। কারুর মনেই আর তেমন সুখ নেই। কখন কার ডাক আসবে জানা নেই। অপারেশান টেবিলে তুললেই হল। কাগজ খুললেই সারি সারি মুখ। সব নিরুদ্দেশ। খোঁজ মিলছে না। কে যে কোথায় চলে যাচ্ছে! এত বড় দেশ। নদী, নালা, বনজঙ্গলের অভাব নেই। তার ওপর তন্ত্রপীঠ। কাঁপালিকরা করাত হাতে ঘুরছে। সাধনার কি শেষ আছে রে ভাই। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছিলেন, সখা অর্জুন, ক্ষুদ্র হৃদয় দৌর্বল্যং ত্যক্তোত্তিষ্ঠ পরন্তপ। মারো, মেরে যাও। তুমি মারবে কী, আমি তো সব মেরেই রেখেছি। তুমি তো নিমিত্ত মাত্র। তারপর এতখানি একটা হাঁ করলেন। দ্যাখো সখা, বিশ্বরূপ দ্যাখো। সেই রূপ দেখে ভয়ে
অর্জুনের বুক কাঁপছে। মুখগহ্বরে করাল দন্ত। সেই দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে আটকে আছে ধৃতরাষ্ট্রের। ছেলেরা। তাদের পক্ষে যুদ্ধে সমবেত রাজমণ্ডলী—ভীষ্ম-দ্রোণ, কর্ণ। তাঁদের ধড়, মুণ্ড সব আলাদা আলাদা হয়ে পড়ছে। দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে দেহের অংশ আটকে আছে। অর্জুন তখন। বলছেন, সখা
যথা প্রদীপ্তং জ্বলনং পতঙ্গা
বিশন্তি নাশায় সমৃদ্ধবেগাঃ।
তথৈব নাশায় বিশন্তি লোকস্তবাপি
বকতরাণি সমৃদ্ধবেগাঃ।।
পতঙ্গ যেভাবে আগুনে ঝাঁপ মেরে পুড়ে মরে সেই রকম সমস্ত লোক তোমার ওই মুখে গিয়ে সবেগে ঢুকছে আর মৃত্যু বরণ করছে।
লেলিহ্যসে গ্রসমানঃ সমস্তাল্লোকান
সমগ্রান বদনৈর্জলদ্ভিঃ।
হে বিষ্ণু! সমস্ত লোককে গ্রাস করার অভিলাষে তুমি তোমার প্রদীপ্ত বদন বিস্তার করে রেখেছ।
এই তো বিশ্বের রূপ, বিশ্বরূপ। ভয় পেলে চলবে না। শীত গেল, গ্রীষ্ম আসছে। বর্ষা নামবে। লোডশেডিংবাড়বে। পথে পথে মিছিল ঘুরবে—চলছে চলবে। প্রশ্ন বৃথা, কী চলছে, কী চলবে? সোজা উত্তর, যা চলছে তাই চলবে। বেশি ভেন্তাড়া করলেই ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও।
এমনকী কোনও জায়গা নেই, যেখানে অন্তত দিন কয়েকের জন্যে পালিয়ে যাওয়া যায়? এক সময় শীতের বায়ুপরিবর্তনে যাওয়ার হিড়িক পড়ে যেত। রেলভ্রমণ তখন এত ভীতিপ্রদ ছিল না। মোজার ভেতর বা জুতার সুকতলায় টাকা ভরে, স্টেশানে রেল থামলেই ইষ্টনাম জপতে হত না।
কে উঠছে? ডাকাত নয় তো! বাবু চেঞ্জে গিয়ে ফিরে এলেন সর্বস্বান্ত হয়ে। চল্লিশ বছর আগে ভারত বলতে বুঝতুম এক অখণ্ড একটি দেশ। এখন আর তা নেই। ভাবতে ভালো লাগে না, কিন্তু সত্যকে তো অস্বীকার করা যায় না। যে বাঁধনে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশবাঁধা ছিল, সে বাঁধন খুলে গেছে। কী সে বাঁধন? মনে হয় বিদেশি শাসন। পরাধীনতার একটা বন্ধন আছে। যাকে কবিরা বলেছেন, দাসত্বের শৃঙ্খল। স্বাধীনতা মানে মুক্ত মানুষের উল্লাস। আমরা সবাই রাজা। আর কথাতেই আছে, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। এক-একটি প্রদেশ এক-একটি স্বাধীন রাজ্যের মর্যাদা পেতে চায়। এক হওয়ার সাধনা সে ছিল যখন আমরা পরাধীন ছিলাম। এখন আমাদের টুকরো টুকরো খণ্ড খণ্ড হওয়ার ব্যাকুলতা। এক ডজন প্রধানমন্ত্রী, দু-ডজন মন্ত্রী, অজস্র এমএলএ। কেন্দ্রটেন্দ্র সব মুছে দাও, যার যার হিস্যা বুঝে নাও।
বৃদ্ধ বললেন, গুড ওল্ড ডেজ আর গন। সে একটা সময় ছিল যখন রাত একটায় বসন্তের ফুরফুরে বাতাসে আমরা বেড়াতে বেরোতুম। রাতের পর রাত এই শীত আর বসন্তের মিলনক্ষণে রাস্তায় দাঁড়িয়ে উচ্চাঙ্গ সংগীত শুনতুম। বড় বড় ওস্তাদের গান! শেষ রাতে স্ত্রী-পুত্র সহ বিয়ের ভোজ খেয়ে আতরের গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে বাড়ি ফিরতুম। দূরে ছায়ামূর্তি দেখে আঁতকে উঠতুম না, ওই রে আসছে। শীতে বেশিরভাগ বাঙালিই যেত বাইরে, বায়ু পরিবর্তনে। এখন সব জায়গার বায়ুই দূষিত।