সত্যের মুখোমুখি (Satyer Mukhomukhi)
দোতলার প্রশস্ত বারান্দায় একটা ইজিচেয়ারে শরীরটা পেছন দিকে অনেকখানি হেলিয়ে দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন অধ্যাপক অনির্বাণ সান্যাল। তিনি পড়ান ইংরেজি, গল্প-উপন্যাস লেখেন বাংলায়। অধ্যাপক হিসেবে তার যথেষ্ট সুনাম, লেখক হিসেবে তাঁর খ্যাতি আরও বেশি।
কলকাতা থেকে দেড়শো কিলোমিটার দূরের এই শান্ত, নিরিবিলি শহরে কলকাতার মর্নিং এডিশনের কাগজগুলো ট্রেনে নটার আগে পৌঁছায় না। তাই ছুটির দিন ছাড়া সকালের দিকে কাগজ পড়ার সময় পান না অনির্বাণ। তখন কলেজে যাবার তাড়া থাকে। আজ রবিবার। তাই কাগজ খুলে আয়েশ করে বসতে পেরেছেন।
মাস তিনেক হল অনির্বাণ এই শহরের একটা সরকারি কলেজে বদলি হয়ে এসেছেন। যেখানে তিনি বসে আছেন, দোতলার সেই আস্ত ফ্লোরটা ভাড়া নিয়ে একাই থাকেন। একতলার ভাড়াটেরা হল একজোড়া কপোত-কপোতী। স্বামী এবং স্ত্রী। বয়স বেশি নয়, তিরিশের নীচে। দুজনেই ব্যাঙ্ক এমপ্লয়ি, তবে আলাদা আলাদা ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চে। ওদেরও ট্রান্সফারের চাকরি। বাড়িওয়ালা থাকেন শহরের অন্য এলাকায়।
নীচের তলায় ভাড়াটেরা এখন নেই। ছুটি নিয়ে কোথায় যেন বেড়াতে গেছে। মাসখানেক আগে ফিরবে না। তাই বাড়িটা একেবারে নিঝুম।
অনির্বাণের বয়স চুয়াল্লিশ পয়তাল্লিশ। রং ময়লা হলেও মোটামুটি সুপুরুষ। কোনও অদৃশ্য মেক আপ ম্যান এলোমেলো ব্রাশ চালিয়ে তার মাথায় সাদা সাদা কিছু ছোপ ধরিয়ে দিয়েছে।
বারান্দার কোনাকুনি ডান দিকে কিচেন। সেখান থেকে ঠুং ঠাং আওয়াজ আসছে। খুব সম্ভব নিতাইয়ের মা রান্না চাপিয়েছে।
হঠাৎ সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। খবরের কাগজে ডুবে ছিলেন অনির্বাণ। চমকে উঠে হাতের কাগজ নামিয়ে রেখে সামনের দিকে তাকালেন। নিতাইয়ের মা ছাড়াও অন্য একটি কাজের লোক আছে তার, শিবু। সে সারা মাসের চাল ডাল তেল মশলা-টশলা কেনার জন্য বাজারের একটা মুদিখানায় গেছে। তার তত এত তাড়াতাড়ি ফেরার কথা নয়। নীচের তলার ভাড়াটেদের কাছে ছুটির দিনে অনেকে আসেন কিন্তু তারা তো এখন নেই। তাই কারও আসার সম্ভবনা খুবই কম। অনির্বাণ নিজে আদৌ মিশুকে নন। কলেজের সহকর্মীরা আছেন ঠিকই, তবে তাঁদের সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি যে, না জানিয়ে হুট করে এসে হাজির হবেন। অনির্বাণ কারওকে আসতেও বলেন না। তা হলে?
কড়া নাড়াটা চলছেই। গলার স্বর একটু উঁচুতে তুলে অনির্বাণ বললেন, নিতাইয়ের মা, দেখো তো কারা এল
রান্নাঘর থেকে যে বেরিয়ে এল তার বয়স ষাটের কাছাকাছি। পরনে নীল-পাড় সাদা শাড়ি। পিঠটা সামান্য বেঁকে গেলেও এই বয়সে বেশ চটপটে, কাজকর্মে দড়। দৌড়ে তরতর সিঁড়ি দিয়ে সে নেমে গেল।
অনির্বাণ সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন। নীচে অনেকটা জায়গা জুড়ে সিমেন্টে বাঁধানো উঠোন। তারপর সদর দরজা। শিবু বেরিয়ে যাবার পর নিতাইয়ের মা খিল লাগিয়ে দিয়েছিল। এখন সেটা খুলতেই দুটি সালোয়ার-কমিজ পরা মেয়েকে দেখা গেল। বয়স কত হবে? খুব বেশি হলে আঠারো কি উনিশ। সদ্য তরুণীই বলা যায়।
অনির্বাণ রীতিমতো অবাক। তিনি ইজিচেয়ার থেকে উঠে বারান্দার রেলিংয়ের কাছে এসে দাঁড়ালেন। নিতাইয়ের মা তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঘুরে আঙুল বাড়িয়ে তাকে দেখিয়ে দিল।
মেয়ে দুটি এবার অনির্বাণকে দেখতে পেয়েছে। তাদের একজন বলল, স্যার, আমরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। ভেতরে আসব?
একটু বিরক্ত হলেন অনির্বাণ। ভেবেছিলেন খবরের কাগজ দেখা হলে লেখার টেবিলে গিয়ে বসবেন। একটা নামকরা মাসিক পত্রিকার সম্পাদক অনবরত তাড়া দিচ্ছেন, দিন পনেরোর মধ্যে নভেলেট লিখে দিতে হবে।
নাঃ, এবেলাটা মাটিই হবে। একবার ভাবলেন এখন আমি ব্যস্ত আছি বলে ওদের চলে যেতে বলবেন। আবার একটু কৌতূহলও হচ্ছিল। দোনোমনো করে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললেন, আচ্ছা এসো।
মেয়ে দুটি উঠোন পেরিয়ে ওপরে উঠে এল। দোতলার বারান্দার দেওয়াল ঘেঁষে তিন চারটি বেতের মোড়া রয়েছে। ওখান থেকে দুটো নিয়ে এসে এখানে বোসো বলে ইজিচেয়ারটায় বসলেন অনির্বাণ। মেয়ে দুটি তাঁকে প্রণাম করে মোড়া টেনে এনে সামনা সামনি, তবে একটু দূরে ধীরে ধীরে বসে পড়ল।
অনির্বাণ লক্ষ করছিলেন। একটি মেয়ে খুবই সুশ্রী, টকটকে রং। অন্যটির গায়ের রং চাপা হলেও দেখতে ভালোই। বললেন, তোমরা কারা? চিনতে পারলাম না তো।
সুশ্রী মেয়েটি বেশ সপ্রতিভ। বলল, আমার নাম সর্বাণী আর ও আমার বন্ধু, ওর নাম মল্লিকা। আমরা এই শহরেই থাকি।
অনির্বাণদের কলেজটা কো-এড। হাজারখানেকের মতো ছাত্ৰ-ছাত্ৰী। মাত্র তিন মাস তিনি এখানে এসেছেন। সব স্টুডেন্ট তো নয়ই, তার সাবজেক্টের ছেলেমেয়েদের মুখও তার স্পষ্ট মনে থাকে না। জিগ্যেস করলেন, তোমরা কি আমার কলেজে পড়ো?
সর্বাণী বলল, না স্যার। এখানে একটা গার্লস কলেজ আছে। আমরা সেই কলেজের স্টুডেন্ট। আমার পলিটিক্যাল সায়েন্সে অনার্স, মল্লিকার সোশিয়লজিতে। দুজনেই ফার্স্ট ইয়ার।
অনির্বাণের কোনও ব্যাপারেই তেমন আগ্রহ নেই। নির্বিকার ধরনের মানুষ। কম কথা বলেন। যেটুকু বা বলেন, অন্যমনস্কর মতো।
আচমকা দুই সদ্য তরুণী এসে পড়ায় তিনি খুশি হননি ঠিকই, তবে বিরক্তি প্রকাশ করাটা অশোভন। জিগ্যেস করলেন, তোমরা যে এলে, কোনও দরকার আছে কি?
সর্বাণী উজ্জ্বল চোখে তাকাল। আপনার লেখা গল্প-উপন্যাস আমাদের খুব ভালো লাগে। আপনি বেগমপুর গভর্নমেন্ট কলেজে আসার পর থেকে ভীষণ দেখা করতে ইচ্ছে করছিল। শুনেছি আপনি খুব গম্ভীর। তাই ভয় ভয় করছিল। শেষ পর্যন্ত সাহস করে চলে এলাম।
সুদূর এই মফস্সল শহরে তার লেখার দুজন অনুরাগিণী পাওয়া যাবে, ভাবা যায়নি। ছুটির দিনে হঠাৎ এসে লেখালেখি পণ্ড করায় মনে যে বিরক্তি জমা হয়েছিল, তার ঝঝ কমে এল। অনির্বাণ বললেন, শুনতে পাই, আজকালকার ছেলেমেয়েরা বাংলা-টাংলা পড়ে না। বেঙ্গলি লিটারেচারের নামে তাদের জ্বর আসে।
স্যার, কলকাতার ব্যাপারটা বলতে পারব না। আমাদের এই মফসসল শহরে কলেজ কি স্কুল লাইব্রেরিগুলো ছাড়াও তিনটে বিরাট বিরাট পাবলিক লাইব্রেরি আছে। তার প্রত্যেকটায় পনেরো-ষোলো হাজার করে বই। বয়স্ক মানুষেরা তো বটেই, আমাদের বয়সি কি আমাদের চেয়ে ছোট অনেকেই সেগুলোর মেম্বার। সুধাকর বাগচি, নীরেন্দ্র ঘোষ আর আপনার লেখার কত যে ভক্ত এখানে রয়েছে, ভাবতে পারবেন না স্যার।
কলকাতায় থাকলে নানা হতাশাজনক কথা কানে আসে। বাঙালি বাংলা বই পড়ছে না, বাংলা বই বিক্রি হচ্ছে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সর্বাণীর কথাগুলো শুনতে শুনতে বেশ ভালোই লাগল। অনির্বাণ একটু হাসলেন।
সর্বাণী থামেনি। সে বলতে লাগল, আমাদের এই বেগমপুরের চল্লিশ-পঞ্চাশ কিলোমিটারের মধ্যে আরও তিন-চারটে ছোট শহর আছে। সেই শহরগুলোতেও বড় বড় অনেক লাইব্রেরি রয়েছে। প্রত্যেকটা টাউনের নাইনটি পারসেন্ট মানুষ বাংলা বই পড়ে।
কোনও ব্যাপারেই যিনি উৎসুক নন, এবার তার চোখেমুখে আগ্রহ ফুটে ওঠে, তাই?
হ্যাঁ স্যার।
তা হলে তো দেখা যাচ্ছে, কলকাতা নয়, মফসল শহর আর গ্রাম-ট্রামগুলো বাংলা সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বলতে বলতে অনির্বাণ সর্বাণীর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন। আগেই চোখে পড়েছিল মেয়ে দুটির মধ্যে সর্বাণী খুবই সুন্দরী, অন্য মেয়েটি অর্থাৎ মল্লিকা তেমনটা নয়। সে চুপচাপ, লাজুক ধরনের। এখন পর্যন্ত একটি কথাও বলেনি। আর সর্বাণী অবিরল কথা বলে চলেছে।
অনির্বাণের যা স্বভাব, কাছে বসে থাকলেও অন্যমনস্কর মতো তাকে দেখেন। কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম ঘটল। সর্বাণীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন চেনা চেনা লাগল। কার একটা হালকা আদল যেন তার চেহারায় বসানো? কার? ঠিক মনে পড়ছে না। হুবহু না হলেও এই ধরনের মুখ আগে কোথাও দেখেছেন।
যেভাবে তিনি তাকিয়ে আছেন সেটা অশোভন। ধীরে ধীরে চোখ সরিয়ে নিলেন অনির্বাণ।
কিছুক্ষণ গল্প-টল্প করে সর্বাণী বলল, স্যার, আপনার অনেকটা সময় নষ্ট করলাম। এবার আমরা যাই।
ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অনির্বাণ, না না, আরেকটু বোসো গলার স্বর উঁচুতে তুলে ডাকলেন, নিতাইয়ের মা, দেখ তো মিষ্টি-টিষ্টি আছে কিনা, থাকলে দুজনের মতো নিয়ে এসো, তারপর চা করে দিয়ো। আমিও খাব।
সর্বাণী হাত নেড়ে অস্বস্তির সুরে বলতে লাগল, আনতে বারণ করুন স্যার।
অনির্বাণ বললেন, প্রথম দিন এলে। একটু কিছু না খেলে আমার খারাপ লাগবে।
চা মিষ্টি-টিষ্টি এসে গেল। খাওয়া শেষ হলে সর্বাণী বলল, এবার যাই স্যার। আবার কিন্তু আসব।
এসো।
মেয়ে দুটি চলে যাবার পরও ইজিচেয়ারে বসেই রইলেন অনির্বাণ। এবেলা আর লেখা-টেখা হবে না, আগেই বোঝা গেছে। সেই চিন্তাটা মাথায় ফিরে এল। বেগমপুর শহরে এই তার প্রথম আসা। সর্বাণীকেও প্রথম দেখলেন। তার মুখের সঙ্গে কার মুখের আবছা মিল?
বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে একরকম চেহারার দুজন মানুষ দেখা যে যায়নি, তা তো নয়। তাদের রক্তের সম্পর্ক নেই। একজন হয়তো জন্মেছে বিহারে, অন্যজন রাজস্থানে। সর্বাণীর চিন্তাটা খারিজ করে দিতে চাইলেন অনির্বাণ কিন্তু মেয়েটা যেন তাঁর মাথায় চেপে বসে আছে।
চুয়াল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের জীবনে কম মানুষ তো দেখেননি অনির্বাণ। তাদের অনেককেই ভুলে গেছেন। কেউ কেউ একেবারে ঝাপসা হয়ে গেছে। স্মৃতি খুঁড়ে খুড়ে যাদের তুলে আনা গেল তাদের কারও সঙ্গেই সর্বাণীর মিল নেই। কী যে অস্বস্তি! মনটা কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে রইল।
.
সেই যে সর্বাণী আর মল্লিকা এসেছিল তারপর বেশ কয়েকটা দিন পেরিয়ে গেল। এর মধ্যে অনির্বাণ সামান্য লেখালেখি করেছেন, কলেজে গিয়ে ক্লাস নিয়েছেন। মনের অশান্ত ভাবটা অনেকখানি কেটে গেলেও পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি। নীচের তলায় ভাড়াটেরা ফিরে এসেছে। তাদের সঙ্গে দেখা হলে কেমন আছেন স্যার, আপনারা ভালো তো সম্পর্কটা এর বেশি এগোয়নি। অনির্বাণ যতদিন বেগমপুরে আছেন, এমনটি চলছে।
তিন সপ্তাহ পর এক রবিবার আবার এল সর্বাণী! সে একাই এসেছে। সঙ্গে তার বন্ধুটি নেই। হাসি মুখে বলল, আগেই আসতাম। মাঝখানে কটা দিন জ্বরে ভুগলাম। তাই।
বুকের ভেতর যে অস্বস্তিটা কমে এসেছিল সেটা ফের বেড়ে গেল। অনির্বাণ চাপা স্বভাবের মানুষ। ভেতরে যা চলে তা বাইরে বেরিয়ে আসতে দেন না। সর্বাণীকে বসতে বলে জিগ্যেস করলেন, এখন কেমন আছ?
ভালো স্যার। কদিন বাড়িতে আটকে ছিলাম। জ্বরটা ছাড়ছিল না। এক উইক হল রেগুলার ক্লাস করছি। আপনি ভালো আছেন তো?
ওই চলে যাচ্ছে।
এলোমেলো কিছু কথা হল। তারপর সর্বাণী বলল, আপনার অসমাপ্ত উপন্যাসের শেষটা ট্র্যাজিক হল কেন? বিকাশ আর শিপ্রাকে মিলিয়ে দিলে কিন্তু অনেক ভালো লাগত।
তাই বুঝি? অনির্বাণ একটু হাসলেন। কোনও উত্তর দিলেন না।
আপনার সমান্তরাল, পটভূমি, ধূসর পৃথিবী উপন্যাসগুলোতেও নায়ক নায়িকার মিলন ঘটাননি। আপনার লেখায় দুঃখ, কষ্ট-টষ্ট বড্ড বেশি।
অনির্বাণ বললেন, মানুষের জীবনে দুঃখ কষ্ট নেই?
তা আছে তাই বলে এত? একটু কম কম করে এসব দিয়ে পাঠক যাতে আনন্দ পায় এবার থেকে সেই রকম লিখুন না।
অস্বস্তি থাকলেও মজা লাগছিল অনির্বাণের। লঘু সুরে বললেন, তোমার কথাগুলো ভেবে দেখতে হবে।
আরও কিছুক্ষণ কাটিয়ে সর্বাণী চলে গেল।
আবার এল পরের রবিবার। এবারও একা। স্যার কেমন আছেন, তুমি ভালো আছ তো-ইত্যাদির পর সর্বাণী বলল, একটা কথা ভাবলে আমার খুব অবাক লাগে।
উৎসুক দৃষ্টিতে সর্বাণীর দিকে তাকালেন অনির্বাণ। কোনও প্রশ্ন করলেন না।
সর্বাণী বলতে লাগল, আপনি কতগুলো গল্প উপন্যাস লিখেছেন?
তুমি তো আমার একজন দুর্দান্ত পাঠিকা। তুমিই বলো না
চোখ কুঁচকে একটু ভাবল সর্বাণী। তারপর বলল, একত্রিশটা উপন্যাস। গল্প অনেক; কতগুলো বলতে পারব না।
উপন্যাসের নাম্বারটা ঠিক বলেছ। গল্প কত লিখেছি, আমারই মনে নেই। দেড়শো তো হবেই।
আচ্ছা
আবার কী?
এত সব যে লিখেছেন, আরও লিখছেন; আইডিয়া, গল্পের প্লট পান কীভাবে?
মেয়েটির অনন্ত কৌতূহল। অনির্বাণ বললেন, চারপাশের মানুষজনকে দেখে।
যেমনটা দেখেন অবিকল তাই লেখেন?
শুধু অভিজ্ঞতার ওপর লেখা হয় না। তার সঙ্গে কল্পনা মেশাতে হয়। তবেই কিছু সৃষ্টি হয়।
খুব ডিফিকাল্ট ব্যাপার।
সর্বাণীর মুখচোখের ভাবভঙ্গি দেখে হাসিই পাচ্ছিল অনির্বাণের। তিনি অবশ্য কিছু বললেন না।
সর্বাণী বলল, আপনার অতল জল উপন্যাসটা নিয়ে আমার কিছু জানার আছে।
কী জানতে চাও, বলে ফেলো।
আজ নয়, বইটা আরেকবার পড়ে নিই। তারপর বলল।
ঠিক আছে।
ফি রবিবার সর্বাণীর আসাটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গেল। যে অনির্বাণ নির্বিকার, সমস্ত ব্যাপারেই যাঁর চরম উদাসীনতা সেই তিনিই রবিবার সকাল থেকেই আশ্চর্য এই মেয়েটির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন।
একদিন এসে সর্বাণী বলল, স্যার, রাগ না করলে একটা কথা জিগ্যেস করতাম।
কেন রাগ করব? বলো না
আমি তো দু-আড়াই মাস ধরে আসছি। দুজন কাজের লোক বাদ দিলে আপনাকে ছাড়া অন্য কারওকে তো দেখি না।
আমি এখানে একাই থাকি।
অন্য সবাই?
অন্য সবাই বলতে আমার মা, ছোট এক ভাই আর ভাইয়ের স্ত্রী। তারা সব শ্যামবাজারে আমাদের পৈতৃক বাড়িতে থাকে।
কিন্তু ম্যাডাম?
পলকহীন কয়েক সেকেন্ড সর্বাণীর দিকে তাকিয়ে রইলেন অনির্বাণ। তারপর নীরস গলায় বললেন, তুমি কার সম্বন্ধে জানতে চাইছ, বুঝেছি। কিন্তু তেমন কেউ আমার লাইফে নেই।
সর্বাণী চুপ করে রইল।
আরও মাস দেড়-দুই এভাবেই কেটে গেল। দু-একটা রবিবার বাদ দিলে বাকি সব ছুটির দিনই সে এসেছে। যখনই আসে, তাকে বাইরের বারান্দায় বসিয়ে গল্প করেন অনির্বাণ।
এক রবিবার এসে সর্বাণী নানা কথার ফাঁকে বলল, স্যার, আপনি কোথায় বসে লেখেন দেখতে ইচ্ছে করছে।
দেখবার মতো কিছু নেই। অনির্বাণ হাসলেন–তবু যখন তোমার ইচ্ছে, এসো।
দোতলায় তিনটে বড় বড় ঘর একটা হল অনির্বাণের স্টাডি। এখানে মস্ত একটা টেবিলের ওপর কম্পিউটার, পাঁচ-ছটা ডিকশনারি, টেলিফোন, আট-দশটা পেন, আঠার টিউব ইত্যাদি। দুধারের দেওয়াল জোড়া র্যাকে গাদাগাদি করে রাখা অজস্র ইংরেজি এবং বাংলা বই। একপাশে ডিভান এবং দুটো সোফাতেও ভঁই করা বই এবং ম্যাগাজিন। সব ছত্রখান হয়ে রয়েছে।
অনির্বাণ বললেন, এটাই আমার লেখা আর পড়ার ঘর। বুঝতেই পারছ আমি কেমন মানুষ। অগোছালো, ছন্নছাড়া। বেডরুমটা দেখলে বোধ হয় ভিরমি খাবে। চলো, সেটাও দেখাই।
লেখার ঘরের চাইতেও বেডরুমের হাল অনেক বেশি করুণ। ময়লা জামা প্যান্ট, বিছানার চাদর, যেদিকে তাকানো যায়, সব লন্ডভন্ড। যেন সারা ঘর জুড়ে ঝড় বয়ে গেছে। সর্বাণী বলল, লেখকরা সব ব্যাপারেই খুব উদাসীন হয় দেখছি। আমি ঘর দুটো গুছিয়ে-টুছিয়ে দেব?
না না, সে কী কথা ভীষণ বিব্রত হয়ে পড়েন অনির্বাণ। এসব তোমাকে ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে না।
কিন্তু সর্বাণী শুনল না। রবিবার এসে গল্প-টল্প তো করেই, ফাঁকে ফাঁকে ঘর দুটো গোছগাছও করে দেয়। পড়ার ঘর আর বেডরুমের চেহারাই পালটে গেল। এক রবিবার সর্বাণী এসে দেখল, সেদিনই সকালে বাথরুমে পড়ে গিয়ে হাতে চোট পেয়েছেন অনির্বাণ। শিবু ছুটি নিয়ে তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। নীচের ভাড়াটেদের যে ডেকে আনা হবে তারও উপায় নেই। তারা ভোরবেলা বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে কোথায় যেন পিকনিকে গেছে।
সারা বাড়িতে নিতাইয়ের মা ছাড়া আর কেউ নেই। সে কাপড় গরম করে সেঁক-টেক দিয়েছে ঠিকই কিন্তু তাতে যন্ত্রণা খুব একটা কমেনি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনির্বাণ উঃ আঃ করছেন। এই সময় সর্বাণী এল। সব শুনে তক্ষুনি বেরিয়ে গিয়ে ডাক্তার ডেকে এনে প্লাস্টারের ব্যবস্থা করল। এই রকম নানা ব্যাপারে ক্রমশ সর্বাণীর ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছেন অনির্বাণ, হয়তো নিজের অজান্তেই। কোনও কারণে সে আসতে পারলে মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু কার সঙ্গে সর্বাণীর চেহারার মিল সেই ধন্দটা এখনও কাটেনি।
এক ছুটির দিনে চা খেতে খেতে অনির্বাণ বললেন, আমার কথা তো সবই শুনেছ। তোমার সম্বন্ধে আমি কিন্তু বিশেষ কিছুই জানি না।
সর্বাণী হাসল–আমাদের কথা বলার মতো নয়। বাড়িতে শুধু আমি আর আমার মা।
বাবা?
নেই।
মানে?
তিনি ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। সাত-আট বছর আগে এখানকার নদীর ওপর বাঁধ তৈরি হচ্ছিল। বাবা ইন্সপেকশনে গিয়েছিলেন। আচমকা ওপর থেকে লোহার একটা বিম এসে পড়ে তার ওপর। স্পষ্ট ডেড। আমাদের বাড়ি কলকাতায়। বাবার মৃত্যুর পরে আমরা সেখানে যাইনি। তার কোম্পানিই আমাদের জন্যে এই শহরে একটা বাড়ি করে দিয়েছে। প্রত্যেক মাসে পঁচিশ হাজার টাকা করে দেয়। একটা প্রাণের বদলে আমরা কমপেনসেশন পাচ্ছি।
ভেরি স্যাড- অনির্বাণের সারা মুখ বিষাদে ভরে গেল।
অনেকক্ষণ নীরবতা।
তারপর একেবারে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল সর্বাণী।–স্যার, এক-দেড় মাস আগে বলেছিলাম আপনার অতল জল উপন্যাসটা সম্পর্কে আমার কিছু প্রশ্ন আছে। আরও বলেছিলাম, বইটা আরেকবার পড়ে নেব। তারপর আপনার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলব। এর মধ্যে পড়া হয়েও গেছে।
ভুলেই গিয়েছিলেন অনির্বাণ। মনে পড়ে গেল। বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, বলেছিলে। তা হঠাৎ অতল জলকে টেনে নিয়ে এলে!
তিনি বেশ অবাকই হয়েছেন।
বাড়ির সমস্ত কিছুই তো জানিয়ে দিয়েছি। এবার অতল জল নিয়ে আমার কৌতূহলটা মিটিয়ে নিই। না বলবেন না স্যার।
ঠিক আছে।
উপন্যাসের তিনটে প্রধান ক্যারেক্টার। শান্তনু, সুদীপ্তা আর বিক্রম। শান্তনু শান্ত, ভদ্র, নিস্পৃহ ধরনের মানুষ। উচ্চ শিক্ষিত। পড়াশোনা নিয়ে থাকতে পছন্দ করে। ভালো চাকরি করে, তবে তা বদলির চাকরি। তিন-চার বছর পর পর তাকে নানা জায়গায় পাঠানো হয়। শান্তনুর স্ত্রী সুদীপ্তা সুন্দরী। এমন রূপ যে তার দিকে তাকালে চোখ ঝলসে যায়। ঘরের কোণে ভ্যাদভেদে গৃহলক্ষ্মী হয়ে পড়ে থাকতে তার দমবন্ধ হয়ে আসে। সে চায় ঘরের দেওয়াল ভেঙে উড়ে বেড়াতে। তার এটা চাই, সেটা চাই, চাহিদার শেষ নেই। তা ছাড়া এখানে নিয়ে যাও, সেখানে নিয়ে যাও। উপন্যাসের তিন নম্বর লিডিং ক্যারেক্টার হল বিক্রম। সে শান্তনুর বন্ধু; একটা মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানির টপ একজিকিউটিভ। আজ ইউরোপে যাচ্ছে, কাল আমেরিকায়। বিক্রম প্রবল শক্তিমান পুরুষ। যা সে চায় তা ছিনিয়ে নেয়। ক্লাব, পার্টি, মদ এবং বান্ধবীদের তো তার কাম্য ছিল। একদিন বিক্রমের সঙ্গে সে স্বামী সংসার ফেলে চলে গেল। বলে সোজাসুজি অনির্বাণের দিকে তাকাল–আপনার উপন্যাসে এরকমই রয়েছে। আপনি বলেছিলেন, চারপাশের চেনা জানা মানুষ এবং ঘটনা নিয়ে গল্প-উপন্যাস লেখেন। শান্তনু, সুদীপ্তা আর বিক্রম নিশ্চয়ই বাস্তব চরিত্র।
অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন অনির্বাণ তারপর চাপা গলায় বললেন, হ্যাঁ, মানে
অনির্বাণের কথা যেন শুনতেই পেল না সর্বাণী। বলতে লাগল, আপনার কাছে আগেই শুনেছি বাস্তব চরিত্রের নামটাম বদলে তার সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে গল্প-উপন্যাস লেখেন। অন্য গল্প-টল্প কাদের নিয়ে লিখেছেন বলতে পারব না। তবে অতল জল-এর তিনটে ক্যারেক্টারের আসল নাম-টাম আমি জানি। তারা শান্তনু, সুদীপ্তা আর বিক্রম নন।
সামনের দিকে অনেকখানি ঝুঁকে, জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে গলার স্বরটা ঝপ করে নামিয়ে দিয়ে বলল, তারা হলেন, অনির্বাণ, দীপিকা আর প্রতাপ।
শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ খেলে গেল অনির্বাণের। তার গলা চিরে দুটি শব্দ বেরিয়ে এল–তুমি কে?
আমার মায়ের নাম দীপিকা, আপনার অতল জল-এ যিনি সুদীপ্তা আর বাবা হলেন প্রতাপ উপন্যাসে যিনি বিক্রম।
এতদিনে সেই ধন্দটা কেটে গেল অনির্বাণের। সর্বাণীর মুখে কার আদলটি আবছাভাবে বসানো, সেটা স্পষ্ট হয়ে গেল।
সারা শরীর উথাল পাথাল হয়ে যাচ্ছে। বিহুলের মতো তাকিয়ে রইলেন অনির্বাণ। মাথার ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।
সর্বাণী উঠে পড়েছিল। বলল, স্যার, আজ আমার একটু তাড়া আছে। যাচ্ছি। সে চলে গেল।
অনেকটা সময় স্তব্ধ হয়ে বসে থাকার পর অনির্বাণের অস্থির অস্থির ভাবটা কমে এল।
সর্বাণী কেন তাঁর কাছে প্রায় প্রতিটি ছুটির দিনে এসেছে? সে যে তার ভক্ত পাঠিকা সেটা বোঝাতে; নাকি অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল? সে যে আসে দীপিকা কি তা জানে? জেনে শুনেও কি যে পুরুষটির সঙ্গে সম্পর্কের গিট ছিঁড়ে একদিন প্রতাপের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল, তার কাছে নিজের মেয়েকে বারবার পাঠিয়েছে? সর্বাণী তার মা-বাবার সঙ্গে তার সম্পর্কটা জানল কী করে? নানা প্রশ্ন চারদিক থেকে ধেয়ে আসতে লাগল।
না না, এসব ভেবে নিজেকে ভারাক্রান্ত করার মানে হয় না। অনির্বাণ একটা সিদ্ধান্ত নিলেন।
পরদিন কলেজে গিয়ে লম্বা ছুটি পেয়ে প্রিন্সিপালকে দরখাস্ত দিয়ে সোজা একটা এজেন্সির অফিসে চলে এলেন। এরা নানা লটবহর এক শহর থেকে আরেক শহরে নিয়ে যায়। দুদিন বাদে একটা ট্রাক এসে বইপত্র, ব্যাগ স্যুটকেস-টুটকেস গুছিয়ে নিয়ে কলকাতায় চলে গেল। সেখানে অনির্বাণদের বাড়িতে সেসব পৌঁছে দেবে।
ফার্নিচারগুলো ভাড়া করা। আরও তিনদিনের মধ্যে বাড়ি ভাড়া, আসবাবের ভাড়া, শিবু এবং নিতাইয়ের মায়ের মাইনে চুকিয়ে দিয়ে ট্রেনে উঠলেন অনির্বাণ। জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবলেন, কলকাতায় গিয়ে কটা দিন নিজেদের বাড়িতে চুপচাপ শুয়ে থাকবেন। তারপর সটান চলে যাবেন হায়ার এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের অফিসে। এই অফিসের অনেক সিনিয়র আধিকারিক তাকে পছন্দ করেন। তাদের অনুরোধ করলে অন্য কোনও শহরে ট্রান্সফার হয়ে যাবেন। বেগমপুরে ফিরে গেলে রবিবার রবিবার সর্বাণী যেমন আসে হয়তো তেমনই আসবে। তার সঙ্গে কোনও একদিন দীপিকাও চলে আসতে পারে। না এলেও রাস্তায় কখনও দেখা হয়ে যেতে পারে। বহু বছর আগে দীপিকা প্রতাপের সঙ্গে পালিয়ে যাবার পর ভেঙে-চুরে খান খান হয়ে গিয়েছিলেন অনির্বাণ। সময়ের হাতে বোধ হয় আশ্চর্য কোনও ম্যাজিক থাকে। ধীরে ধীরে সব ক্ষত শুকিয়ে গেছে, নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। লেখালেখি, কলেজের পড়ানো ছাড়া অন্য কোনও দিকে আর তাকাবেন না। বাকি দিনগুলো এভাবেই কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু দীপিকা? না। জীবনটাকে নতুন করে জটিল করে তোলার লেশমাত্র ইচ্ছা নেই অনির্বাণের।
ইলেকট্রিক ট্রেন দুরন্ত গতিতে বেগমপুরের সীমানা ছাড়িয়ে কলকাতার দিকে দৌড় শুরু করল।