ডরোথী -1
আজ ডরোথী আঙ্কেল ব্যানার্জির দেওয়া এই হলুদ শাড়িটা পড়েছে । সঙ্গে মানানসই ব্লাউজ ,সামনে ভি গলা আর পেছনে হাই নেক্। দারুণ ফিটিং ব্লাউজটা। রেভারেন্ড ওরফে রেভ্,দেখলে বলতো,”ইউ আর লুকিং সো গর্জিয়াস”। আঙ্কেল ব্যানার্জির ছেলে রেভারেন্ড।সেই ছেলে কে দেখলে ডরোথীর মা পামেলার হাসিটা চুইয়ে চুইয়ে পড়ে। আর পড়বে না ই বা কেন এমন লোভনীয় পাত্র কি কেউ হাত ছাড়া করে?
মাসটা সেপ্টেম্বর তাই হিমেল হাওয়া বইছে। ছাতিম ফুলের গন্ধে ম ম করছে চার দিক। প্রতিদিনের মতো আজও বিকেল চারটেতে বেড়িয়ে পড়েছে ডরোথী। মিঠে রোদ গায়ে নরম পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। শিশু কাল থেকেই বাবার সাথে এসেছে। কখনো আঙ্কেল আর রেভারেন্ড এর সাথে ও এসেছে। সে সময় রেভ্ আর ডরোথী কম্পিটিশন করে দৌড়তো। তবে সব সময় রেভ্ এর কাছে হেরেছে ডরোথী।
জায়গাটার নাম বঙ্গাই। মায়ের কাছে শোনা। একটা ছোট্ট হল্ট স্টেশন। ঘাস আর মাটির প্ল্যাটফর্ম । বাঁধাই করা হয়েছে। বৃটিশ আমলে এই অঞ্চলে রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্ক শপ্ এর পত্তন হয় । আরো কতো গুলো রেলওয়ে অফিস নিয়ে গড়ে উঠেছে শহরটা। এছাড়া ও সাবান ফ্যাক্টরি,শক্তি বিড়ি কোম্পানি,মলয় বিড়ি কোম্পানি,বাটা কোম্পানি এই সব। নামে মাত্র একখানা সিনেমা হল। চারদিকে টিনের বেড়া দেওয়া। ফাঁক ফোকর দিয়ে বাইরের আলো হাওয়া সব ঢুকে পড়ছে। কাঠের গুড়ির পিলার তাতে ওপরে ছাউনি টিনের। সিনেমা শুরুর আগে থেকেই সিনেমা হল এর বাইরে মাইক এ গান বাজানো হয় ।
মায়ের কাছে শোনা সে সব দিনের কথা।সে কথায় পরে আসছি।প্রথম প্রথম ভারতীয়দের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে অসুবিধা হতো কিন্তু ডরোথীর মা পামেলা ও বাবা ডেভিড যখন বঙ্গাইগাঁও আসেন তখন থেকেই এদের সাথে মিলে মিশে যান।আঠাশের যুবক ডেভিড আর পামেলা ছাব্বিশ এ পড়েছে। বিরঝোড়া টি এস্টেট এর দায়িত্ব নিয়ে আসে ডেভিড। পামেলা চা বাগানে স্কুল খুলে দেন।
এ ছাড়া অসমীয়াদেরও বিরঝোড়া হাইস্কুল ছিল। ওখানে ই সবাই কে বৃত্তি পরীক্ষা দিতে হয়। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিতে যেতে হতো ধুবড়িতে। পরে রেল ওয়ে ওল্ড কলোনীতে রেলওয়ে হাইস্কুল হয়। একখানা বিশাল চা বাগান নাম বিরঝোড়া টি এস্টেট। একখানা সাবান ফ্যাক্টরি ছিল। সেখান থেকে গাড়িতে করে সাবান গোলা বাড়ি বাড়ি বিলানো হতো। তার সাথে চলতো মাইক্রোফোনের অ্যানাউন্সমেন্ট। সে যুগে ও ভাবেই বিজ্ঞাপন হতো ।খুব ভালো পন্থা। গাড়ি বলতে সাবান ফ্যাক্টরির নিজস্ব গাড়ি। তখন ওখানে রিক্সার ও চল হয়নি ।একজায়গা থেকে আর একজায়গায় হাঁটা ছাড়া উপায় ছিল না। রেল স্টেশনের ওভার ব্রিজ পার হয়ে ডান হাতে বঙ্গাইগাঁও রেলওয়ে হাইস্কুল। চোখ বুজেই ডরোথী দেখতে পায় সব এই টি গার্ডেন এ থাকে ডরোথী। বন্ধুদের সাথে এখন মাঝে মাঝে দেখা হয় ছুটী হলে। রোজ ভোরে না হলে বিকালে বাগেশ্বরী পাহাড়ে যাওয়া চাই ডরোথীর। বাগেশ্বরী যাওয়াটা একটা নেশা। সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে সূর্য কে বাই বাই করা ও অভ্যাস। আবার বাগেশ্বরী মন্দিরে ও গেছে দল বেঁধে । বিশেষ করে পরীক্ষার ফল বের হওয়ার আগে বাগেশ্বরী মন্দিরে যাওয়া চাই। ঐখাঁড়া রূপী দেবীকে প্রতিদিন পুজো করা ও সেই খাঁড়া দিয়েই পাঁঠা বলি দেওয়া হয়। কোন জাঁক নেই সে মন্দিরের। আটচালার মাটির নিকোন মন্দিরের বুনো পরিবেশে কলা পাতায় ফল মুল সাজিয়ে ঠাকুরকে ভোগ নিবেদন করা হয়।চোখের সামনে পাঁঠাকে স্নান করিয়ে কপালে তেল সিঁদূরের ফোঁটা এঁকে,হাঁড়িকাঠে পাঁঠার মাথা ঢুকিয়ে বলি দেওয়া হয়। এই বলি প্রথাটা ডরোথী মেনে নিতে পারে না। ধর্মের নামে এ কী ঘোর অন্যায়। পামেলার কাছে নানা ধর্মের নানা অনুষ্ঠান শুধু মাত্র আনন্দ করার একটা উপলক্ষ মাত্র। পামেলা সনাতন হিন্দু ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলেই হয়তো ডরোথীর কোন বাঁধা নিষেধ ছিল না। বাগেশ্বরী মন্দির ছাড়িয়ে বিদ্যা মন্দির স্কুল পার হয়ে ডান হাতে টি –গার্ডেন এর দিকে পা চালালো ডরোথী। এতক্ষণে ডরোথীর বাবা হয়তো বাড়ি ফিরেছেন। স্ট্রিট লাইট জ্বলে উঠেছে। এখানে সকলেই হাঁটা চলায় অভ্যস্ত। কারণ সাইকেল ছাড়া “নো আদার ভেহিকল অ্যাভেলেবল্”। চা বাগানের দু একখানা গাড়ি আছে। তা ও বিশেষ দরকারে বার করা হয়। বিকেলে ডরোথী হাঁটতেই বের হয়। তাই সাইকেল নেবার কথা ভাবে না। তাছাড়া গৌহাটীতে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তে যাবার পর থেকে ‘সাইকেল ‘এ হাত পড়েনি। অব্যাবহারেই বিকল হয়ে পড়ে আছে। সাড়াই করলেই চাঁঙা হয়ে উঠবে । সাইকেল এর পরিচর্যা ছোট থেকেই নিজে করেছে।মায়ের কাছে শেখা ‘টু বি সেল্ফ ইন্ডিপেনডেন্ট’।ওখানকার লোকের হাঁটা কোন ব্যাপার ছিল না। ডরোথীরা স্কুলে,পাদ্রির বাংলোয় হেঁটেই যাতায়াত করেছে। টি গার্ডেন এর গাড়ি কখনো পারসোনাল ইউজের জন্য ভাবেননি পামেলা,ডরোথীর মা।
পাদ্রির বাংলার দিকে না গিয়ে সোজা শাল বাগানের পথ।একটা ছোট্ট সাঁকো পার হতে হতো শাল বাগানে যেতে। বিশাল বিশাল গাছের গুড়ির ওপরে গাঢ়ো সবজে রংয়ের গাছের পাতার ছাউনি। ছোট্ট বেলায় ওপরের গাছের পাতা নজরে পড়তো না। শুধু গাছের গুড়িটাই নজরে পড়তো। আর মাথা উঁচু করলে গাছের পাতার সবুজের সমারোহের ফাঁকে ফাঁকে আকাশের নীলের আমেজ ।
পামেলার মুখে শোনা,রেল এর স্কুলের যখন পত্তন হয়নি তখন মাঠেও ইঁট পেতে বসেছে ছাত্ররা। তারপর দুখানা ঘরের স্কুল হলো। একটু একটু করে পরিধি বেড়েছে স্কুলের। সামনে বিশাল মাঠ। তাতে কৃষ্ণ চূড়া আর রাধাচূড়া গাছের ফুল হোলী খেলতো মাঠের ধারে। পড়ন্ত ফুলে ছেয়ে যেত মাঠের ধার। কালো কৃষ্ণের মতো ঝাড়ুদার নাথনী, তার কালো কুচকুচে চেহারা নিয়ে মাঠের এপার থেকে ওপারে লম্বা ঝাড়ু হাতে নিয়ে মাঠ ঝাড় দিতো। আর বড়ো মেয়েদের দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে গান গাইতো। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে গাইতো”,ইয়ে মেরে দিল কঁহি অর চল।'”,নাথনী কি মনে করে অমন মিষ্টি সুরেলা গান স্কুলের মাঠে ছড়িয়ে বেড়াতো তা বড়োরা বুঝলেও ছোটদের মনে কিন্তু অন্য আনন্দের সৃষ্টি করতো নাথনীরঐ গান। ছোটদের দলে ছিল মলি ,সুছন্দা,আর ডরোথী। ডরোথীরা একটু উঁচু ক্লাসে উঠতেই নাথনীকে আর দেখা যায় নি। কারণ জানার উৎসাহ না হলেও নাথনী বিহীন স্কুলের মাঠ খাঁ খাঁ করেছে। ফাঁকা হয়ে গেছে মাঠটা। যে সুরের রেশ স্কুলের মাঠের এ পার থেকে ওপারে ভেসে বেড়াতো , ডরোথীর মনের আকাশে নাথনী বিহীন মাঠ খাঁ খাঁ করেছে । এ মাঠে অনেক ভেল্কি হতো। এ.কে.আনসারি তিন দিন ধরে সাইকেল চালিয়েছিল। তাঁর সার্টের সংগে পিন্ দিয়ে আটা এক টাকা,দু টাকার নোট। কলের গানের সাথে সাইকেল চলেছে। কতো মেয়ে সাইকেল চালকের প্রেমে পড়ল তার খবর কে রাখে । আবার কয়েক বছর পর বঙ্গাইগাঁওএ রটে গেল এ.কে.আনসারি মারা গেছেন। শোকে মুহ্যমান সারা বঙ্গাইগাঁও ।
প্রতিদিনের মতো আজও ভাবনা গুলো আঁকড়ে
ধরছে ডরোথীকে। বিকেলের মিঠে রোদ গায়ে নরম পরশ বুলিয়ে দিতে থাকে। পাহাড় থেকে লাল সূর্যকে দিগন্তে মিলিয়ে যেতে দেখে মন খারাপ হয়ে যায় ডরোথীর। চোখে ভেসে উঠেছে অন্য একটা দেশের ছবি যেখানে তখন ও সূর্যোদয় হয়নি। সূর্যের পশ্চিম দিগন্তে মিলিয়ে যাবার আগ মুহূর্তের সেই শেষ লাল এক চিলতে ফালি,বা আগুন রাঙা শেষ সূর্য না দেখে নড়ে না ডরোথী। ডরোথী পাহাড়ে না উঠলে যেন ,সূর্য উঠবে না আবার অস্তও যাবে না। ইন্ডিয়ানরা সূর্যকে মামা বলে। মামা বড়ো আপন তাই বুঝি সূর্যিমামাকে ‘বা ই ,সি ইউ’ বলতে আসে প্রতিদিন। যেমন স্কুলে যাওয়ার সময় মাকে কিস্ করে’ বাই’ বলা। কোনোটাই ফর্মাল নয় তবু ও করে। বড়ো হয়ে পাহাড়ে ওঠাটা মনের তাগিদে। কখনো কখনও বাগেশ্বরী বাড়িতে গেছে দল বেঁধে। পাহাড় থেকে সূর্যকে দিগন্তে মিলিয়ে যেতে দেখে ডরোথী পা চালালো বাড়ির দিকে। ঘরে পৌঁছতে ডেভিড বললেন——- ডরোথী,কাল ভোর বেলা আমাকে ডেকে দিস তো। হরিসাধন ব্যানার্জির ওখানে একটা কাগজ দিতে হবে । ডরোথী বললো- তুমি চিন্তা করো না ।আমি দিয়ে আসবো ।
খুব ভোরে উঠেছে ডেভিড ,ডরোথীর বাবা । – এতো বৃষ্টিতে যাবে কি করে”?পামেলা বলে ।ডেভিড বলেন- “যেতে হবেই।এনি হাউ আই হ্যাভ্ টু রিচ্ দেয়ার।”
পামেলা তাড়াতাড়ি টিপট থেকে চা টা ছেঁকে কাপ এ ঢেলে এগিয়ে দেন ডেভিডের দিকে। চায়ে চুমক দিতে দিতে ডেভিড বলেন- “জানো এই ‘স্ট্রাকচারাল প্ল্যান ‘টা কালকের মধ্যে ‘স্যাংশন’ না করাতে পারলে প্রচুর টাকা লোকসান হয়ে যাবে। হরিসাধন ব্যানার্জি শুধু এই কাজে গৌহাটী যাচ্ছে। ন’টার আগে কাগজটা পৌঁছে দিতে হবে ।’
ডরোথী ভোরের পাখি। ভোরের সূর্যকে স্বাগত জানাতে প্রতিদিন ছুটে যায় বাগেশ্বরী পাহাড়ে। রোজকার নিয়মে আজও চোখ মেলেছে ডরোথী। অনুভব করেছে বৃষ্টির আকুলতা। নাঃ আজ আর মর্নিং ওয়াক এ যাওয়া যাবে না। বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো কাল রাতে বাবার বলা কথাটা মনে পড়ে যায় ।
তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে বিছানা থেকে। কাল রাতে বাবা ভোর বেলা তুলে দিতে বলেছেন ডরোথীকে। বাবার ঘরে যাবার সময় নজরে পড়লো বাবা আর মা বসবার ঘরে বসে আছে। পাশে চায়ের পেয়ালা। তার মানে বাবা অনেক ক্ষন আগে উঠেছে। বৃষ্টির আমেজে হয়তো ডরোথীর ঘুম গাঢ়ো হয়েছিল। দেখলো বাবা একেবারে তৈরী। জুতো অবধি পড়া হয়ে গেছে। কিন্তু ডরোথী ডেভিডকে বলে —– একটু বসো ড্যাড,এক মিনিট,এখুনি আসছি। —বলে ,ছুটে গেল নিজের ঘরে। চট করে ব্রাশ করে তৈরি হয়ে বাইরের ঘরে চলে এলো। পকেট চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে পকেটে ঢুকিয়ে বললো—–ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু গো,ড্যাড।এই বৃষ্টিতে তোমায় যেতে হবে না। তোমার আগেই আমি পৌঁছে যাবো। তাছাড়া “ইফ নেসেসারি আই ক্যান রান।” পায়ে গাম্বুট,হাতে ছাতা নিয়ে দরকারি কাগজটা নিয়ে নিলো বাবার হাত থেকে। পামেলা রেইন কোট নিতে বললেও কান দিল না সে কথায়। রেইন কোট ডরোথীর পছন্দের না।তাই রেইন কোট নিলো না।কারণ সেটার বদ্ধ গন্ধ। ঐ গন্ধ ডরোথীর সহ্যের বাইরে ।
চা বাগানে সকালের কাজে রত যেসব মেয়ে তারা পিঠে চা পাতার ঝুড়ি নিয়ে কাজে লেগে গেছে। ক্ষীপ্রগতিতে চা পাতা ছিঁড়ে ফেলছে পিঠের ঝুড়িতে। এতো বৃষ্টিতেও ওদের কাজ বন্ধ হয় না। কাজ করলে তো টাকা পাবে। তাই ছাতার তলে চলেছে চা পাতা তোলা। পিঠের ঝুড়ির সাথে অপূর্ব এক আর্ট এ ছাতা বাঁধা। আসামের বংগাইগাও এ প্রায় সব কালেই বৃষ্টি হয়। আর বর্ষা কালে হয় এক নাগাড়ে। চা গাছের সারি দূর থেকে মনে হয় সবুজের ঢেউ। সমতল হতে ওপরে উঠে গেছে সেই সবুজের মেলা। মন মুগ্ধকর দৃশ্য। চা বাগানের গেট্ এর কাছে এসে তাড়াতাড়ি পা চালায় ডরোথী। টি গার্ডেন এর সদর দরজ কাছে একটা ডিচ্ আছে। কানায় কানায় ভরে গেছে জলে। ছোট্ট স্কুল বাড়িটা পার হলো। মনে হলো বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেল। কান ছাপানো শব্দ বৃষ্টির। ওটা আসলে টিনের ছাউনিতে বৃষ্টি পড়ার শব্দ। ছোট বেলায় বৃষ্টি হলেই চিৎকার করে গান শুরু করতো ডরোথী,”হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মতো নাচেরে”। গলা খুলে গান গেয়ে মনের আনন্দ প্রকাশ করতো। পেখম মেলতো নাচের ভঙ্গিতে হাত মেলে। অপূর্ব লাগছে ডিচ্ টা। এর কাছে এক বিন্দু সময় না দিলে বুঝি জীবনটা অপূর্ণ রয়ে যাবে। আজ এটাকে বিশাল ঝিল মনে হচ্ছে। চার ধারে কলাগাছের বেড়া। ছোট বড়ো নানা ঢংয়ের গাছ। কোনোটা আবার থনথনে পাতা গজিয়েছে। এক থেকে আর একে বংশবৃদ্ধি করেছে। এ যেন সন্তান সন্ততি নিয়ে আগলে রেখেছে ডিচ্ টাকে। তারই মাঝে মাঝে সুপুরি গাছের সারি। অহমিয়াদের ভাষায়” গুয়া।”থোকাথোকা সুপুরি ঝুলে আছে। কে বলে কলাগাছ অন্য গাছকে বাড়তে দেয় না ?ধুলো ভরে ছিল যে পাতায় তা বৃষ্টি ধারায় সজীবতা,পেলবতা ফিরে পেয়েছে। এখানে কোন পুকুর বা নদী নেই। তাই ডিচ্ টাকে পুকুর বা ঝিল ভেবে ডরোথীর মন আনন্দে ভরে উঠেছে। তীরের ফলার মতো বৃষ্টি পড়ছে। তীব্র গতিতে জলরাশিকে ভেদ করে মিলিয়ে যাচ্ছে তরঙ্গ তুলে। এখন শিলা বৃষ্টি হচ্ছে না।ম তবে বৃষ্টির শুরুতে শিলা বৃষ্টি হয় । ছোট বেলায় রেভ্ বৃষ্টি হলে শিল কুড়োতো ডরোথীর জন্য। রাতে শিলাবৃষ্টির অপূর্ব অনুভূতি। ব্রিটিশ আমলের বাংলো অ্যাসব্যস্টার্স এর ছাউনিতে অসংখ্য টাপুর টুপুর শিলার শব্দে আরামে নিদ্রায় তলিয়ে যাওয়া। হাতে তুলে নেয় একটা লাল খয়েরি -মেশানো কলাবতী ফুল। কলা বাগানের ফাঁকে ফাঁকে লাল, খয়েরি,হলুদ কলাবতীর ঢেউ। কোথাও বা লালে হলুদ ছিটে। তারই নিচে দরুন ফুল,দোপাটি, নয়নতারা,বেল ফুলের ঝাড়। কে বলবে যে এই নয়নাভিরাম দৃশ্য প্রকৃতির সৃষ্টি। ডরোথী এক গোছা বেল ফুল তুলে নাকের কাছে নিলো। না বৃষ্টিতে বেল ফুলের গন্ধ ফিকে হয়ে গেছে । চলতে চলতে সৌন্দর্যে মন ডুবিয়ে নিচ্ছে । ওয়ার্ডসওয়ার্থ মনে করতেন শ্যাওলা ধরা পাথরেও ঈশ্বরের অনুভূতি আছে। ডরোথীর মনে হয় প্রকৃতির সৌন্দর্য কি এতো সুন্দর হতো যদি না তাতে গড্ এর করুনা থাকতো! তাই বুঝি প্রজাপতির নানা রং এর মেল বন্ধন চোখে পড়ে। বনে নুপুরের নিক্কন তোলে শুকনো পাতা। আকাশের রামধনু এতো সুন্দর । প্রকৃতিতে মন ও চোখ ডুবিয়ে নিলে মনের ক্লান্তি দূর হয়। রোজ খয়েরি রংয়ের এক দেড় ইন্চি মাপের জেল্লাধরা পাখি খয়েরি রংয়ের কলাবতী ফুলে বসে। খয়েরি রংয়ের কলাবতী ফুলে বসে মধু খেয়েই বুঝি ওরা অমন মন কাড়া রং পেয়েছে। ওরা ডরোথীর বড়োই প্রিয় ।
হাঁটতে হাঁটতে হাত ঘড়িটা দেখে নেয়। আঙ্কেল যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। তাড়াতাড়ি পা চালালো। সকাল সাড়ে দশটায় অযোধ্যা ত্রিহুত মেইলএর ছাড়ার সময়। চলার গতি বাড়িয়ে দিলো। চা বাগানের বাঁয়ের রাস্তায় গেলে বাগেশ্বরী পাহাড়ের দিকে গেছে। একটু নেমে গেলে ডান হাতে ঝর্ণা ।রাতে র বৃষ্টিতে শিলংয়ের বিডন,বিশপ্ এর মতো লাগছে । সাদা ফেননিভ জলরাশি পাথরে পড়ে হীরের মতো জলকণা চার দিকে ছড়িয়ে পড়ছে ।এতো জলরাশি কোথা থেকে আসছে?আসামের ম্যাপ টা মনে হয় । উৎস ‘গাঢ়ো হিল’। এ বৃষ্টি তে কেউ পাহাড়ে ওঠে না। ওঠার দরকার হয় না। ওপারে লোক বসতি থাকলে অবশ্যই বৃষ্টি হলেও উঠতে হতো। ডরোথী রেলওয়ে ওভার ব্রিজ পার হয়ে ডান হাতে এগিয়ে গেল। বাঁয়ে ক্যারেজ ওয়র্কশপ ,ডিস্ট্রিক্ট –ইঞ্জিনিয়ারিং অফিস। আরো কিছু টা বাঁয়ে এগিয়ে গেলে রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্ক শপ্। পাগলাস্থান ছাড়িয়ে সোজা এগিয়ে চললো ডরোথী। মায়ের মুখে শোনা এ জায়গার আদিবাসীরা এ জায়গাকে ব্ঙ্গাই বলে। ছোট্ট স্টেশনে কেরোসিন বাতি জ্বলতো তখন। রাস্তায় ল্যাম্প পোস্ট এও চার কোনা চিমনির মাঝে কেরোসিন বাতি জ্বলতো। ডরোথী ছোট বেলা থেকেই দেখছে ষ্টেশন বিল্ডিং। তার ওপরে কাঠের পাটাতনের রেলওয়ে ওভার ব্রিজ। দুপাশে তারের জালে ঘেরা। কেউ নিচে পড়ে না যায় তাই বুঝি ঐ মজবুত ব্যবস্থা্। রেলওয়ে এরিয়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বিশাল রেল কলোনী। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এক এক দিকে এক একটা কলোনী । বৃটিশরা এই রেলওয়ে কলোনী গুলো ঢেলে সাজিয়ে –ছিল। সে কালের বঙ্গাইগাাও এর তিন ভাগ ছিল রেলওয়ে এরিয়া। বাকি চত্বরে ওখানকার অধিবাসীরা ছিল। পরে অবশ্য উল্টোটাই হয়েছে ।
কোয়ার্টার গুলোর দেয়ালে মুলী বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বেড়া বানিয়ে তাতে চুন বালির পলেস্তারা। ছাউনি অ্যাসব্যস্টার্স এর। কিন্তু পাকাপোক্ত ছাউনির নিচে কাঠের ফ্রেম করে সাদা ত্রিপলের সিলিং। কাঠের ফ্রেম এ কালো রং করা। সাদা রং এ কালো কাঠের বাটামে অপূর্ব সমন্বয় । একটা সিমপ্লিসিটির ছোঁওয়া ঐ বাড়ি গুলোয়। মায়ের কাছে শোনা ভূমিকম্পের ভয়ে নাকি অমন বাড়ি হতো। দোতলায় কংক্রিটের মেঝের বদলে কাঠের মেঝে হতো। ওসব কাঠ অবশ্য আজকের মোজেকের মোম পালিশকে হার খাওয়াবে। ইন্ডিয়ান রেলওয়ে বৃটিশ আমলে রেল কোম্পানি বলা হতো । সেসব তামাদি হয়ে গেছে ।
ভাবতে ভাবতেই ট্যাংগাইগাঁও পৌঁছে গেল ডরোথী।আর কিছু টা গেলে ই হরিসাধন ব্যানার্জির বাড়ি ।আবার পুরোনো কথায় ফিরে যাই । মায়ের মুখে শোনা ট্যাংগাইগাঁও। ডরোথীর মা ও বাবা বৃটিশ। সেই আমলের অথচ এ দেশকে ভালোবেসে থেকে গেছেন এ দেশে। পামেলা সমাজ সেবা করেন । এখানকার লোকেরা ও ওদের ছাড়তে চায়নি ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির পতনের পর।ইংরেজ হটাও শ্লোগান হলে ও ওদের ব্যবহারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সকলকে হটালেও ডেভিড ও তাঁর স্ত্রী র অমায়িক ব্যবহার ই ওদের আটকে রেখেছে ভারতে। চা বাগানের দায়ভার নিতে হয় ডেভিডকে। পামেলা বহু দিন ধরে ই টি গার্ডেন এ মেয়েদের শিক্ষার জন্য স্কুল করেছিলেন বহু আগেই ।তাই তাঁরা এই বঙ্গাইগাও এ থেকে গেছেন ।অবশ্য একটু উঁচু ক্লাস এ উঠলে বঙ্গাইগাও রেলওয়ে হাইস্কুলে যেতে হতো ।
বাস্তবে ফিরে এলো ডরোথী। চোখে পড়ছে পাহাড়ের সবুজের মোহময় রূপ। হয়তোবা বৃষ্টিতে সবুজের প্রলেপটা গাঢ়ো হয়েছে। কোকিলের ডাক শুনতে শুনতে মনে হলো যেন কোন কুহকিনীর দেশে পৌঁছে যাচ্ছে । অবশ্য আজ বৃষ্টির দাপটে কুহু তান অন্য দিনের থেকে কম। রাস্তা বলে কিছু নেই পায়ের চাপে দূর্বা মরে গিয়ে আঁকা বাঁকা পথ তৈরি হয়েছে। ঘাসে আর মাটিতে পা আটকে ধরছে। হনহনিয়ে সুকুমার উল্টো দিক থেকে আসছে। হাতে একটা পাঁঠা। ডরোথীকে দেখে বলে- মিসি বাবা,ইমান্ বৃষ্টিত্ কোত্ গৈছা?
ডরোথী উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন করে- হুকুমার (সুকুমার)পঠা লই কোত্ গৈছা? সুকুমার বলে- মোর পোয়ালীটোর অহুখ হৈছিল।হেই কারনে অ্যা টা মানৎ করিছিলু ।বলির কারণে মন্দিরত গৈছু। অর্থাৎ ছেলে র মানসিক ছিল বাগেশ্বরী মন্দিরে পাঁঠা বলি দিতে চলেছি।ডরোথীও এগিয়ে যায়।সুকুমার গেছে ভালো লেগেছে কিন্তু এই বলী টা ভালো লাগেনি ।বলির বিরুদ্ধে মন জেহাদ ঘোষণা করেছে। বলী দেখতো না ডরোথী। হিন্দুমতে ওর কোনো রোশ নেই । পুজোর শুদ্ধতায় ওর মনটা ভরে গেছে। দেবী পূজার সাথে এই বলী প্রথা ওর মনে অন্য অর্থের আভাস দিয়েছে । পুরোহিতের মতে,দেবীরসৃষ্টি দেবীই নিচ্ছেন বলি হিসাবে ।ডরোথী বুঝেছে ওদের লোভী মনের কদর্যতাকে লালন করতে,ওঁরা দেবীর নামাবলী চড়িয়েছে গায়ে। দেবীর পূজার ঘেরাটোপের আড়ালে প্রতিদিন মাংস ভক্ষণের জন্য জারি করেছে বলী প্রথা ।
বাইর মন্দিরে ই বলী হয়। সেখান কার কাজ অন্য পুরোহিতের। আসামের তাঁতের বোনা গেরুয়া বসন পড়ে পাঁঠাকে স্নান করানোর পর সকলের সামনে বলি দেওয়া হয়। পাঁঠার বোধ শক্তি বলে যে কিছু একটা হতে চলেছে। ম্যাঁ ম্যাঁ করে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা চালায়। এরপর ওর কপালে তেল সিঁদূরের তিলক এঁকে দেওয়া হয়। হাঁড়িকাঠে পাঁঠার গলা ঢুকিয়ে ওপরে একটা কাঠ দিয়ে আটকানোর পর ঐ মাতৃ রূপী খাঁড়া দিয়ে বলী হয় পাঁঠার। ডরোথী চোখ বন্ধ করে ফেলতো। মনে মনে এটার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতো । ওর মনের কথা জানতে পেতো না কেউ। হিন্দুধর্মের ওপরে ওর কোনো রোশ নেই। পূজোর সময় পূজো দেখেছে,প্রসাদ খেয়েছে। পূজোর শুদ্ধতায় মনটা অপার আনন্দে ভরে গেছে। দেবী পূজোর সাথে বলী প্রথায় অন্য কথা মনে এসেছে। দেবী পূজোর ঘেরাটোপের আড়ালে জারি করেছে বলী প্রথা অদম্য মাংস ভক্ষণের ইচ্ছা পূরণ করতে । ডরোথীর মায়ের ধর্মের ব্যাপারে বাধা নিষেধ নেই । হয়তোবা ভারতের নানা ধর্মের সমন্বয়ের রূপটাতে প্রথমে আশ্চর্য হলেও পরে অভ্যাস হয়ে গেছে । ওদের কাছে ওটা ধর্মের নামে একত্রিত হয়ে আনন্দ পাওয়া।
ভাবতে ভাবতে কখন যে নিউ কলোনী পৌঁছেছে টের পায়নি । সাড় ফিরল কালী মন্দিরের শংখ ধ্বনিতে। একেবারে ভিজে গেছে। হাওয়ায় ছাতা উড়ে যায় আর কি। হাওয়ার বেগ আরো বাড়ছে। ছাতা সামাল দিতে পারছে না। বুক ভিজে আরো উন্নত হয়ে উঠেছে। বিইং এ বৃটিশ গার্ল ডরোথী এসব কেয়ার করাই উচিত নয়। ছোট থেকে ভারতীয় ভাবধারার প্রভাব ফেলেছে ওর ওপরে। আশেপাশের কিছু লোভাতুর দৃষ্টি ওর বুকের দিকে দৃষ্টি দিতে বাধ্য করেছে। তাই একটু” আনইজি “লাগছে। এখন মনে হয় মায়ের কথা শুনে রেনকোট টা আনলেই ভালো হতো । মায়ের কথায়–সুন্দর শরীর নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। বরং বুক ফুলিয়ে গর্ব করে হাঁটতে হয়।তাহলে ঐ সব হ্যাংলা দৃষ্টি গুলো” রিবাউন্ড ” হয়ে ফিরে যায়। পামেলার কথায়, ডরোথীর সলজ্জ ভাবকে ওরা “অ্যাকসেপ্টেন্স “বলে ধরে নেয়। ডরোথী বড়ো হয়ে ঐ অ্যাকসেপ্টেন্স এর ব্যাপারটা একটু আধটু উপলব্ধি করতে পারে। কারণ লজ্জা পেলে যে ‘ব্লাশিং ‘ হয় তাতে যে কোন পুরুষের কাছে তা আকর্ষণীয় হতে পারে। “অ্যান্ড দ্যাট্ মে বি টেকেন অ্যাজ অ্যাকসেপ্টেন্স”। সেই কারণেই ডরোথী নিজেকে শাসন করে- ডোন্ট ব্লাশ। আর দে ফিট ফর দ্যা প্রেজেন্টেশন অফ্ ইওর বিউটিফুল ব্লাশ’?
ছাতাটা একেবারে উল্টে যেতেই চিন্তায় ছেদ পড়ল। যাঃ একেবারে স্নান হয়ে গেল। ডরোথী দৌড়তে শুরু করলো। গেট এর কাছে ছাতা নিয়ে ছুটে এলেন মিস্টার ব্যানার্জি। ভেতরে নিয়ে গেলেন ডরোথীকে। বললেন—–কি দুর্যোগ বলোতো! রেডি হয়ে বসে আছি। দাও,দেখি প্ল্যানটা ।
সেলুলয়েডে মোরা প্ল্যানটা নিয়ে নিলেন মিস্টার ব্যানার্জি । আবার বললেন- “শোনো,বৃষ্টি না কমলে বাড়ি যেও না। কুসুম লাল আর রিনা আছে। রেভ্ এর কিছু জামা কাপড় পাবে। ভিজে জামা কাপড় চেঞ্জ করে নাও। ও কে ডিয়ার,বাই।” কুসুম লাল ও বীণা কে কিছু নির্দেশ দিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিলেন মিঃ ব্যানার্জি ।
ছোট থেকেই ডরোথীর বড়ো কাছের এই আঙ্কেল । আঙ্কেল এর হাসি মুখে ডরোথীর এলো মেলো চুল গুলো কানের দুপাশে সুবিন্যস্ত করা। তার পর হাল্কা করে কপালে ঠোঁট ছোঁওয়ানো। শিশু মন ও ভালোবাসার কদর বোঝে। বাবা মায়ের কর্মব্যস্ত জীবনে কখনো কিস্ করতে দেখেনি। যেটা ছিল সেটা,”বাইং কিস ” বা “গুড্ নাইট কিস।” ” ফর্মাল কিস্ ” ও” ইমোশনাল কিস” এর পার্থক্যটা ধরা পড়তো ডরোথীর কাছে। আঙ্কেল ইন্ডিয়ান বলেই হয়তো” টু সেন্টিমেন্টাল”। এই ভাবেই ডরোথীর কাছের হয়ে গিয়েছিল আঙ্কেল ।
মায়ের মুখে শোনা আঙ্কেল ও আন্ট এর বিয়ের গল্প । চমকপ্রদ সব জায়গায় বেড়ানোর কথা। ছবি দেখেই লোভ হয়েছিল সেখানে যাওয়ার। আঙ্কেল সুদর্শন পুরুষ ছিলেন। এডিথ আন্ট অবশ্য আঙ্কেল এর রূপে মুগ্ধ হয়ে বিয়ে করেননি। তখন ব্রিটিশ ম্যান সকলেই বিবাহিত ছিলেন। তাই ইজিলি অ্যাভেলেবল ছিলেন হরিসাধন ব্যানার্জি। এডিথ বুঝেছিল যে এ দেশে থাকতে হলে হরিসাধনকেই বিয়ে করতে হবে। পামেলার সাহায্যে এডিথ এর বিয়ে হয়েছে। এডিথ পামেলার নিকটাত্মীয়া। পামেলার থেকে বেশ কয়েক বছরের বড়ো এডিথ। হানিমুন এর দায়ভার ও নিতে হয়েছিল পামেলাকে। মিস্টার ব্যানার্জি অবশ্য এডিথ কে ভালোবেসে ছিলেন। অভয়াপুর কোর্ট এ ওদের ম্যারেজ রেজিস্ট্রি হয়েছিল। বিজনী রাজবাড়ীতে নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন ওঁরা। বঙ্গাইগাঁও এর বাগেশ্বরী বাড়িতে হিন্দুমতেই বিয়ে করেন ।
এডিথ আন্ট কে মনে নেই ডরোথীর । গল্পের নায়িকার মতোই তার কথা শুনেছে। সেই সব ছবি ও মায়ের অ্যালবাম এ ছবি দেখেছে। সুন্দর সুন্দর বহু জায়গায় ওরা বজরায় করে গিয়েছিল। গৌরীপুরের রাজপ্রাসাদে ওরা সকলেই নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন। অহমের সব চেয়ে বড়ো রাজা ছিলেন গৌরীপুরে রাজ প্রাসাদে সম্রাট শেরসাহের,’কনস্ট্যানটিনোপলের ‘ শৈয়দ আহমেদ এর নির্মিত একটা তোপ ছিল ।
গদাধর নদের তীরের এই সুন্দর শহর। বজরা করেই ওঁরা জলপথে গিয়েছিলেন গৌরীপুর। পামেলা পা ঝুলিয়ে বসেছিলেন বজরায়। পামেলার পায়ের নাগরাই ভেসে গিয়েছিল গদাধরের জলে। পামেলা নাকি ভাসমান নাগরাই এর রূপ বর্ণনা করে কবিতা লিখে ফেলেছিলেন। কবিতা লিখলেও নাগরাই এর শোক ভুলতে পারেন নি। সেই গল্প শুনে ডরোথীর মনে হয়েছে সেও বুঝি তার মায়ের পাশে বসে ছিল। খুব ইচ্ছে করেছে গৌরী পুরে টিলার ওপরের প্রাসাদ মতীবাগ দেখার ।যেখানে আঙ্কেল ও আন্ট এর বিয়ের দিন ওঁরা রাত্রি বাস করেছিলেন। ওখান থেকে ছয় মাইল দূরে মোঘল আমলের সপ্তদশ শতাব্দীর তৈরি মসজিদ ও দেখার মতো। রাজার আতিথেয়তা মনে রাখার মতো।
পরদিন ওঁরা বজরা করেই ব্রহ্মপুত্র নদী পথেই ধুবড়িতে আসেন। বেহুলা লক্ষীন্দর এর ব্যাপারটা নাকি ধুবড়িতেই ঘটেছিল। সব ধর্মের মিলন স্থান ঐ ধুবড়িতেই। শিখদের দমদম গুরু দ্বার রয়েছে ওখানে। তেজ বাহাদুর এর আদেশে ১৬৬৫খ্রিস্টাব্দে দমদম গুরুদ্বার হয়। এটা পড়েই বুঝেছে যে তার মা ভারতের সনাতন ধর্মের প্রতি কতোটা শ্রদ্ধাশীল । আরো একটা সুন্দর জায়গায় তাঁরা গিয়েছিলেন সেটা গোয়াল পাড়া । চোখ জুড়িয়ে যাওয়া সৌন্দর্য সব ছবিতে। ভাবলে ডরোথীর কষ্ট হয় । ওর কালে সেই দেশ টুকরো টুকরো হয়ে গেল। ইংরেজরা নাকি দেশ ভাগ করেছে। ফুল,পাতা মাটি আকাশ নদী পাহাড়ি ঝর্ণা গাছে গাছে ফুল বাবুই পাখির বাসা। কোকিলের ডাক বুনো পথে ঘাসের চলার পথ। এ সবই তো ওর রক্তে মিলে মিশে আছে। এদের ছেড়ে ডরোথী তো অসম্পূর্ণ। তাই বুঝি ভারত ভাগের ব্যথা,বিচ্ছিন্ন মানুষের শোকের ভাবনায় শেল বেঁধে ওর বুকে একটু বেশি ।
হিন্দুদের ভারত আর পাকিস্তানের মাটির না হয় কোন রকমে ভাগ হলো,কিন্তু তাও পুরো পুরি সম্ভব নয় কারণ দুর্গম গিরিরাজ আর তারই কোলে স্রতস্বিনী সলিল। তাকে কি ভাগ করা যায়?মানুষ ভাগ কি করা যায়?মানুষ ভাগ কি করে সম্ভব? এ যেন চাল ডাল মিশিয়ে আলাদা করার মতো। এঁরা কি ধর্ম অনুযায়ী আলাদা বাসভূমি গড়েছিল? তাই এদের আলাদা করাও বৃথা চেষ্টা করা। তাই যারা বুদ্ধিমান তারা চাল ডাল আলাদা না করে খিচুড়ি খেয়ে নেন। কতো ধর্মই তো আছে এ দেশে।বিদ্বেষ তো দেখিনা!তবে কি সবকিছুর মধ্যে ভূমি বিভাজন জড়িয়ে রয়েছে?