দই ক্ষী
অনুগল্পের জীবিকা পর্বে উঠে এলো ছোট্ট বেলার জীবন স্মৃতি- দর্পনের আর এক ছবি । শব্দটা কাণে আসত ” দই ক্ষী”। পরবর্তীতে বুঝেছিলাম ওটা ছিল দই ক্ষীর। হ্যাঁ, এও এক ফেরিওয়ালা । কেমন সে ফেরিওয়ালা? সেই মাথায় আলপনা আঁকা রাজবাড়ির হাতি চলে যাওয়ার পথে থাকত সব বাড়ি, না শহর না গ্রাম , যেখানে আমার ছোটবেলা লুকিয়ে আছে । প্রায় সব বাড়িগুলিতেই ছিল দুটো উঠোন — একটা বারবাড়ির আর একটা ভেতর বাড়ির । মাঝে মাঝেই এক এক দিন, না সকাল না দুপুর সময়ে , কালর্ভাটের গেট খুলে বার অঙ্গন পেঁড়িয়ে সটান ভেতর বাড়িতে মাঝ উঠোনে এসে দাঁড়াত “দই-ক্ষী”। হ্যাঁ, সেই নামেই সে পরিচিত। হাক দিতো সহাস্যমুখে —“দই-ক্ষী ই ই ই ই” কাঁধের থেকে বাঁক নামিয়ে নিয়ে বাতাস খেতো লাল গামছা দিয়ে। গায়ে পিরান ও সাদা ধূতি মালকোচা করে পরা। তার মুখের হাসির জন্যই তাঁকে মনে ছবি করে রাখা সহজ । ঠিক যেন সুকুমার রায়ের “নেড়া”র মুখের আকর্ণ হাসি , দাঁতগুলো দেখা যেতো– ঠিক কালো ও মেরুন খোয়া পাথর। তখন যেন কোন এক অলিখিত আইন ছিল, ফেরিওয়ালা এলে কিছু কিনতেই হবে, ফিরিয়ে দেবার পদ্ধতি আমি দেখি নি। অর্থাৎ “চয়েস” ছিল বিক্রেতার, ক্রেতার নয়। মায়ের (দিদিমা) সাথে আমিও ,ঝুমকো চুলে ঝুম ঝুম করে নেমে যেতাম উঠোনে। সব হাঁড়িতে ভারি সর পাতা দই, আর একটা নীচে থাকত সেটা ক্ষীর, বড়ো লোভনীয় । মায়ের দুধে বঞ্চিত হলে বোধহয় শিশুরা দুধজাত দ্রব্যের প্রতি বেশি আসক্ত হয়, এ আমার নিছক অনুমান , মাত্র দুটি চরিত্র বিশ্লেষণে— এক ,আমার ছোটকাকা, দুই, সেই বাচ্চা মেয়েটি। শোনা কথিকা —ছোটকাকা (একমাস বয়সে মাতৃহারা)এত দুধ খেতে ভালবাসতেন যে, কথা ফুটতেই চীৎকার করতেন “দুদু” “দুদু” করে, তার নাম হয়েছিল “দুদু”, পরবর্তীতে বিখ্যাত ইউরোলজিস্ট ডঃ একেন্দ্রনাথ নাথ ঘোষ।সংক্ষেপে “একেন “। আমি প্রতিবার ঘ্যানঘ্যান করতাম ক্ষীর রাখবার জন্য, খুব কম , মা সে কথা রাখতেন, কারণ !!!!হ্যাঁ সে কথাও বলি, বির বির করে বলতেন “ক্ষীর ত বাড়িতে করি—” বাড়িতে পাতা দই একটুও ভালো হতো না। “দই ক্ষী”এর ভেজালহীন দই ও ক্ষীরের স্বাদ ছিল অসাধারণ । মায়ের কালো মস্ত এক বড়ো পাথরবাটিতে ওজন করে দিতো দই, কোনদিন আধসের বা কোনদিন এক পোয়া। দই কাটবার চামচটিও ছিল আমার কাছে আকর্ষণীয় , আধখানা নারকোল মালা, ব্যবহারের ফলেই হয়ত কালো কুচকুচে ও তেলতেলে। দই য়ের সের “দুটাকা ” আর ক্ষীরের “আট টাকা”। ক্ষীর না রাখবার তাগিদ বুঝতে কয়েক বছর করলার জল বয়ে গিয়েছিল । আমার দিদিমা বহু সম্পত্তির মালকিন হলেও স্বচ্ছলতা ছিল না, হ্যাঁ সত্যিই ,না না থাক্ ….. সে তো অন্য কাহিনী ।