অঙ্গনার জন্য
অনেকগুলি গ্রোসারী ঠোঙ্গা বুকে সাপটে ধরে সাবধানে পা ফেলে রাইফেলস্ স্কোয়ারের উঁচু সিঁড়ি ভেঙ্গে তিনি সোজা রিফাতের দিকেই আসছেন। হ্যাঁ, ইনি সেই মহিলাই। মনে আছে রিফাতের। কিছু মানুষ আছে যাদের একবার দেখলে অনেকদিন মনে থাকে। এখন তিনি একেবারে মুখোমুখি, এবং খুব কাছে। রিফাত অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দ্রæত পাশ কাটতে চেষ্টা করলো।কাজ হলো না।
– এই যে শোন। মহিলার ডাকে থেমে পড়তেই হলো রিফাতকে।
– তুমিইনা সেদিন আগোরার সামনে আড্ডা দিচ্ছিলে বন্ধুদের সাথে ?
মহিলার অনুমান সঠিক। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তা স্বীকার করে নেয়া কী বুদ্ধিমানের কাজ হবে? এমন কিছু বলা যায় না, না ম্যাডাম! আপনি বোধহয় অন্য কাউকে দেখেছিলেন। কিংবা আরও একটু উজানে গিয়ে বলা যায় না, কী সব বলছেন আপনি? দোষারোপের জন্য আর কাউকে খুঁজে পেলেন না বুঝি? কিন্তু মোক্ষম মুহূর্তে এসবের কিছুই মুখে এলো না। সাহসি হতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত গুটিয়েই গেল রিফাত। অবলীলায় মিথ্যে বলা একটা অভ্যাসের ব্যাপার। রিফাতের সেই অভ্যাসটা নেই, বরং সত্যি কথাটাই খুব স্বচ্ছন্দে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো।
– ঠিকই ধরেছেন ম্যাডাম! সেদিন আমিই ছিলাম ওখানে। স্যরি! সেদিনের জন্য ক্ষমা চাইছি।
এই সময় পাশে অপেক্ষমান একটি কাল রঙের নিশান পাথ ফাইন্ডার থেকে মোটাসোটা এক ভদ্রলোক হেলে দুলে নেমে এলেন।
– কি ব্যাপার অর্পি! চেনো নাকি একে?
– সেই যে তোমাকে বললাম না সেদিন? আগোরায় এক রংবাজ ছেলে আমাকে দেখে শীষ বাজালো? ইনিই সেই তিনি!
ভদ্রলোক স্মিত হাসলেন।
– ভেরি ইন্টারেস্টিং!
ভদ্রলোকের কাছে ব্যাপারটি যখন ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে রিফাত অনেকটা আশ্বস্ত বোধ করলো। অন্তত এর দিক থেকে আক্রান্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আপাতত নেই। তবুও উদ্ভূত পরিস্থিতির গুরু ভাবটা একটু তরল করে দেয়া দরকার। ভাবলো রিফাত।
– দেখুন ম্যাডাম, ইট ওয়াজ আ মিসটেক। এ্যান্ড আই এ্যাম স্যরি ফর দ্যাট। এবার আমি যেতে পারি, স্যার?
স্যার কিছু বললেন না। কিন্তু তীক্ষ্ণ শরটি এবার ধেয়ে এলো ম্যাডামের দিকে।
– মিসটেক, তাইনা?
রাস্তাঘাটে সুন্দরী মহিলা দেখলেই মন প্রান ধেই ধেই করে নেচে ওঠে তাইনা? ধরুন এগুলো!
অর্পি নামের মহিলা যিনি আসলেও ভীষণ সুন্দরী, ভারী গ্রোসারীর ঠোঙ্গাগুলো রিফাতের হাতে ধপাস করে ফেলে দিয়ে প্রায় হুকুমের স্বরে বললেন –
– চলুন আমাদের সাথে! গাড়িতে উঠুন!
ভারী ঠোঙ্গাগুলো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েই রইলো রিফাত। আর ভদ্রলোকটিও দেখ কেমন নির্বিকার, এক রহস্যময় পুলকিতবোধে মিটিমিটি হাসছেন তিনি। ভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন তিনি তার এই বখে যাওয়া আদুরে বউটিকে সর্বত্র সব ধরনের পাগলামী করার একটা এককালীন ছাড়পত্র দিয়েই রেখেছেন।
– কই, আসুন! তাড়া দিল অর্পি। গরজটা এমনি যেন এখনই এই গাড়িতে করে ওদের সাথে কোথাও যাওয়ার কথা ওর।
দেখাই যাক না কি হয়! পেছনের সীটে বসে পড়ল রিফাত।
জাহানারা গার্ডেনের প্রশস্ত লোহার গেট গলিয়ে পাথ ফাইন্ডার এসে থামল ছিমছাম সুন্দর একটি ফ্ল্যাট বাড়ির সামনে। মহিলার কণ্ঠ থেকে এখন সেই নিকষ নিঠুর ভাবটি সমূলে তিরোহিত। অন্তরঙ্গ হেসে রিফাতকে বল লেন –
– এটা আমাদের বাসা। আসুন।
দোতলার দরজায় বেল টিপতেই দরজা খুলে দিল ভীষণ মিষ্টি একটি শ্যামলা মেয়ে।
– এই দ্যাখ্ অঙ্গনা, বলেছিলাম না তোকে, আগোরার সেই রংবাজ ছেলেটা দারুণ হ্যান্ডসাম আর মুখ জুড়ে বুদ্ধির ছাপ? দেখলে যে কেউই বলবে শিক্ষিত, ভদ্র, মার্জিত। এমন ছেলেরা মহিলাদের দেখে শীস বাজায় কেমন করে রে? প্রশ্নটা অঙ্গনার প্রতি।
রিফাতের বলতে ইচ্ছে হলো, আপনার মত আগুন সুন্দরের মুখোমুখি হলে শুধু শিস বাজানো কেন, যেকোন পুরুষের তাৎক্ষণিক ভূপাতনও অনিবার্য ভদ্রে! রিফাত মনে মনে বলল, হ্যান্ডসাম আর বুদ্ধিমান বলার কমপ্লিমেন্টটির জন্য আপনার প্রতি আমি সবিশেষ কৃতজ্ঞ মহাশয়া! কিন্তু অঙ্গনা নামের এই মোমস্নিগ্ধ তরুণীটির সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার স্টাইলটি কিন্তু আমার এতটুকু পছন্দ হলো না। ঠিক তখনই অঙ্গনা বলে উঠলো তুমি যে কী আপু! এরকম ঘটনা তো আজকাল কতই ঘটে। তাই বলে এমন পাকড়াও করে কাউকে বাসায় নিয়ে আসতে হয় নাকি? তারপর রিফাতের দিকে ফিরে বলল,
– আপনি কিছু মনে করবেন না। আমার আপুটা একটু পাগল টাইপের। আপনার মত কেস পেলে খুব মজা করতে ভালবাসে। বুঝতে পারছি বেকায়দায় পড়েছেন বেশ। আপনি বসুন। এক্ষুণই আপনার মুক্তির ব্যবস্থা করছি।
বলেই ভিতরের দিকে একটি ঘরে যেখানে এই একটু আগে অর্পিতা গিয়েছে সেখানে গিয়ে ঢুকল। রিফাত লক্ষ্য করল, অঙ্গনা একটি পা টেনে টেনে হাটে। এমন দারুণ মিষ্টি মেয়ে! অথচ! একটু পরেই ফিরে এলো অঙ্গনা।
– স্যরি! সরকার পক্ষের উকিলের কাছে দাঁড়াতেই পারলুম না! সব অবজেকশন ওভার রুলড্ হয়ে গেল। মুক্তিতো দূর অস্ত, জামিনের ব্যবস্থাও হলো না আপনার। বরং আরও কয়েক ঘণ্টার রিমান্ডে পড়ে গেলেন। আপু বলেছে ডিনার করে যেতে হবে আপনাকে। অবশ্য তার আগে নাকি আমাদের লিভিং রুমের এজলাসে আপনার বিচার কার্য সম্পন্ন হবে। মেয়েদের দেখলে কেন যে সিটি বাজান আপনারা!
অঙ্গনার চোখে মুখে কপট বিরক্তি আর কৌতুক। ওর শব্দ ব্যবহারের ধরন দেখে রিফাতের মনে হলো নিশ্চয়ই এই মেয়েটি আইন বিষয়ে পড়াশোনা করে। কিন্তু এত মিষ্টি একজন মানুষকে তো উকিল হিসাবে মোটেও মানাবে না। আজকের সন্ধ্যাবেলার এই উপাখ্যান যেখানে এসে থিতু হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে বড় ধরনের কোন বিপদের আশঙ্কা আর নেই। তবে এরা যেমন আন্প্রেডিকটেব্ল্ এই নাটকের পরের অঙ্কে কোন্ দৃশ্য আসছে কিছুই বলা যায় না। একটা থ্রিলের মধ্যে পড়ে গেল রিফাত। এই সময় ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন শোবার ঘর থেকে ধোপ দূরন্ত দফতরী লেবাসে। পেছনে অর্পিতা। ইউনিফর্মের বুক পকেটে আঁটা তকমা আর কাঁধে লেপটে থাকা এক সারি তারকার বহর থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান ইনি পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কেউকেটা ধরনের কেউ একজন হবেন। তার বিশাল কোমরের বেস্টনী থেকে ঝুলছে চামড়ার কেসবন্দী পিস্তল আর হাতে একটি চকচকে হ্যান্ডকাফ। রিফাতের দিকেই এগোচ্ছেন। হ্যান্ডকাফ কেন আবার! নিজের অজান্তেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যায় রিফাত। হেসে ফেলেন অঙ্গনার দুলাভাই।
– আরে বসুন বসুন! এ্যরেস্ট করছি না আপনাকে। অফিসে একটা জরুরি মিটিং আছে। মিটিংটা সেরে ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ফিরছি। সে পর্যন্ত আপনারা গল্প করুন। বলেই বেরিয়ে গেলেন তিনি। অঙ্গনাদের লিভিং রুমে সবাই গোল হয়ে বসল। রিফাতের দিকে চেয়ে হেসে ফেলল অর্পিতা।
– কি, খুব বিপাকে পড়েছেন, তাই না? মেয়েদের দেখে আর কোনদিন সিটি বাজাবেন?
– সিটি বাজানোর সুবাদে যদি আপনাদের মত একগুচ্ছ সুন্দর মানুষের সান্নিধ্যে এসে পড়া যায় তাহলে আর কখনো যে সিটি বাজাইবোই না এমন প্রমিস কিন্তু দিতে পারছি না। প্রগলভ্ হয়ে ওঠে রিফাত।
– বাব্বাহ্! খুব কথা জানেন দেখছি। কি নাম আপনার?
– রিফাত হায়দার। আপনার পরবর্তী সম্ভাব্য কিছু প্রশ্নেরও আগাম জবাব দিয়ে রাখছি। আমি সদ্য ভার্সিটি থেকে বেরিয়েছি। বেকার, এবং অবিবাহিত। বাসা লালমাটিয়ায়। বাড়িতে আছে আম্মু আর ছোট বোন রিয়া। আম্মু মেঘবার্তা মহিলা কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপিকা। রিয়া কলেজে যায়। ইদানিং আম্মুর কাছ থেকে ওয়ার্নিং খেয়েছে পড়াশোনায় মন না বসালে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে তাকে। দম দেওয়া গ্রামোফোনের রেকর্ড বাজিয়ে দিয়ে এক সময় থেমে যায় রিফাত। অর্পিতারা সমস্বরে হেসে ওঠে।
– হাউ উইয়ার্ড! একটি মেয়ের পড়াশোনায় ভাল খারাপের সাথে বিয়ের কী সম্পর্ক!
রিফাত তো রীতিমত অবাক! অঙ্গনার মত মিষ্টি মৃদু নরম মেয়েরাও এমন সার্কাষ্টিক হয় নাকি!
অঙ্গনার পায়ের অসুস্থতার ভাবনাটি আজকাল প্রায়শই রিফাতের অনেকখানি সময় দখল করে রাখে। রিফাত ভাবে শারীরিক বৈকল্য কি অঙ্গনাকে কখনো ম্রিয়মান করে দেয়? যাদের এই ধরনের বিকলাঙ্গতা থাকে তারা কি নিয়ত কিছু দুঃখবোধের মধ্যে বসবাস করে? স্বাভাবিক সচল মানুষদের থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্নবোধ করে তারা? অঙ্গনার কি এ জন্যে কখনো খুব মন খারাপ করে? রিফাত ভাবল একদিন সে অঙ্গনাকে বলবে, অঙ্গনা, তুমি তোমার পায়ের জন্য কখনোও মন খারাপ করবে না। এটা কোনো ব্যাপারই নয়। একদিন সে অঙ্গনাকে বলবে ওর সাথে বাইরে বেড়াতে যেতে। বেড়াবার সময় অঙ্গনা যদি হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় রিফাত খুব স্নেহের সাথে ওকে সাপটে ধরে দাঁড় করিয়ে দেবে। তখন অঙ্গনার মনে হবে এইভাবে সাপটে ধরে দাঁড় করিয়ে দেবার একজন কেউ ওর আছে।
রিফাতের এই ভাবনার সূত্র ধরেই একদিন ঘটে গেল এক বশিাল বিড়ম্বনার উপাখ্যান। নিজের কান টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হলো রিফাতের। কী যে বোকার মত মাঝে মাঝে এক একটা কাণ্ড করে বসে! অঙ্গনাকে হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিক ওভাবে বলার কী দরকার ছিল –
– আপনার এই পা নিয়ে আপনি একটুও ভাববেন না অঙ্গনা! এটা কোন ব্যাপারই নয়। আজকাল কত ভাল ভাল চিকিৎসা বেরিয়েছে!
অঙ্গনা খুব ঠাণ্ডা দৃষ্টি দিয়ে ফিরে তাকালো রিফাতের দিকে। ওর কপালে অস্বস্তি আর বিরক্তির রেখা ফুটে উঠল।
– আমি আমার পা নিয়ে খুব ভাবি এটা আপনাকে কে বলেছে?
রিফাত ভাবতে পারেনি অঙ্গনা এভাবে প্রতিবাদী হয়ে ঘুরে দাঁড়াবে। বলার মত কিছু খুঁজতে গিয়ে শেষে তোতলাতে লাগল সে।
– না মানে আমি তো…
– কৌশলে বুঝিয়ে দিলেন আমি একটি বিকলাঙ্গ মানুষ। আমার একটি পা খোঁড়া। তাইতো?
মাই গড! অঙ্গনা তো সাংঘাতিক ভুল বুঝে ফেলল! এভাবে রিঅ্যাক্ট করবে কে জানতো! ভীষণ ভড়কে গেল রিফাত। এখন সে কী করবে? কিছু একটা বলা দরকার। কী বলা যায়?
– আই এ্যাম স্যরি অঙ্গনা। বিশ্বাস করুন আমি কিন্তু তেমন কিছু মিন করে কথাটা বলিনি। আপনি এভাবে রিএ্যাক্ট করবেন জানলে আমি কখনোই এমন কিছু বলতাম না।
– কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবো ভেবেছিলেন? আপনারা এক একজন অনুকম্পার অবতার সেজে আমার এই অসুস্থ পা’টি নিয়ে উহ্ আহ্ করবেন। আর আমি দুঃখী দুঃখী মুখ করে বসে থাকবো, এইতো ভেবেছিলেন?
নাহ্! টাইমিংটা একেবারেই ঠিক হয়নি। কারা কী বলে অঙ্গনাকে কোন্ আঘাত দিয়ে বসে আছে কে জানে! নইলে এই শান্ত পরিশীলিত মেয়েটির কিছুতেই এমন প্রতিক্রিয়া দেখাবার কথা নয়। কখনো দেখায় না। অঙ্গনা সেই তখন থেকে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আছে। রিফাতের দিকে আর তাকাচ্ছেই না। অঙ্গনা কি কাঁদছে? আর কিছু বলার সাহস নেই রিফাতের। অঙ্গনাকে রিফাত নিজেই একটা প্রচন্ড হোঁচট খাইয়ে দিয়েছে। সেখান থেকে ওকে সস্নেহে সাপটে ধরে দাঁড় করিয়ে দেবার কোন শক্তিই আর অবশিষ্ট নেই রিফাতের। ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ায় সে। একটা তীব্র অপরাধবোধে নিপীড়িত হতে হতে চুপিসারে দরজা গলিয়ে বেরিয়ে যায় অঙ্গনাদের ফ্ল্যাট ছেড়ে।
চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন মিসেস হাফিজ।
– আরে আম্মু তুমি!
– কী হয়েছে তোর, রিফাত? মা জানতে চাইলেন।
– কেন, কী হবে? কিছু হয়নি তো আম্মু! মাকে পাশ কাটাতে চাইল রিফাত।
– মিথ্যা বলিসনে রিফাত। মন খারাপ কেন?
রিফাত ভাবল কথাটা আম্মুকে বলে দেয়াই ভাল।
– না বুঝে একটি মেয়ের মনে ভীষণ কষ্ট দিয়ে ফেলেছি আম্মু!
– কোন্ মেয়ে? নাম কী? কোথায় থাকে? কী করে?
– এত প্রশ্নের জবাব একসাথে দেবো কেমন করে আম্মু? হেসে ফেলেন মিসেস হাফিজ।
– ঠিক আছে। একটা একটা করে দে।
– নাম অঙ্গনা। থাকে উত্তরায় বোনের সাথে। গবেষণা করে।
– গবেষণা? বিজ্ঞানী নাকি? কিসের গবেষণা?
– তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে গবেষণা।
– সমাজ বিজ্ঞান?
– ঢাকা ভার্সিটি, ফাইনাল ইয়ার।
– দেখতে কেমন?
– একেবারে তোমার মত মিষ্টি আম্মু!
সাথে সাথে ঘুরে বসে আম্মুকে বত্রিশ দন্ত উপহার। আর সাথে সাথেই মাথায় গাট্টা খেল মায়ের।
– অঙ্গনার সাথে পরিচয় হলো কেমন করে তোর?
প্রমাদ শুনলো রিফাত। এবারতো সব খবর বেরিয়ে যাবে!
– আগোরার সামনে একদিন ওর বড় বোনকে দেখে একটু সিটি বাজিয়েছিলাম। পরে একদিন রাইফেলস্ স্কোয়ারে দেখা হতেই উনি আমাকে প্রায় গ্রেফতারের ভঙ্গীতে বাসায় নিয়ে যান। তখন থেকেই পরিচয়। পুলিশ কমিশনার রাজীব হাসান অঙ্গনার দুলাভাই ।
মিসেস হাফিজ অনেক কষ্টে হাসি দমন করে তার কপট গাম্ভীর্যটুকু বজায় রাখলেন। ছেলের মাথায় বিলি কাটতে কাটতে শান্ত কণ্ঠে বললেন,
– মেয়েদের দেখে সিটি বাজাস কবে থেকে রে রিফাত?
– স্যরি আম্মু! বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে হয়ে গিয়েছিল। ঐ একবারই আম্মু!
– আম্মুনি!
– আহ্লাদি করিসনে। কী বলবি বল।
– একটা সমস্যা আছে আম্মু !
– কী সমস্যা?
– অঙ্গনার একটা পা ডিফেকটিভ। টেনে টেনে হাঁটে। ছোট বেলায় পোলিও হয়েছিল।
– এ নিয়ে তোর নিজের কোন সমস্যা নেই তো?
– না আম্মু!
– অঙ্গনার বাবা মা বোন দুলাভাই ওদের মত আছে তো?
– মনে তো হয়। আমাকে খুব স্নেহ করেন ওরা।
– ঠিক আছে। একদিন নিয়ে যাস ওদের বাসায়। তোর দাদীর বালা দুটো অঙ্গনার হাতে পরিয়ে দিয়ে আসবোনে।
– ইউ আর সো সুইট আম্মু!
অর্পিতাকে কথাটা বলার জন্যই আজ ওদের বাসায় এসেছে রিফাত। অঙ্গনা ভার্সিটিতে। রাজীব ভাই ঘুমুচ্ছেন। গল্প করতে করতে এক সময় বলেই ফেলল রিফাত।
– অর্পি আপু! আমার আম্মু একদিন আপনাদের বাসায় আসতে চান।
– অবশ্যই। স্যরি রিফাত! তোমার সাথে এতদিনের পরিচয় অথচ একবারও খালাম্মাকে আমাদের বাসায় আসতে বলিনি। নিয়ে এসো একদিন।
– পরশুদিন নিয়ে আসি?
– পরশুতো আমরা রাজীবদের গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছি।
– তাহলে কাল?
– এত তাড়া কিসের রিফাত? আমরা ঘুরে আসি। তারপর আমি নিজে গিয়ে একদিন খালাম্মাকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসবো।
– অর্পি আপু! আমার আম্মু খুব শীঘ্রি একদিন এসে অঙ্গনাকে দেখে যেতে চান।
বিস্ময়ে অর্পিতার ভ্রূ কুচকে যায়।
– তোমার আম্মা অঙ্গনাকে একদিন দেখে যেতে চান মানে? এসব তুমি কী বলছ রিফাত? ও মাই গড!
উদ্ভ্রান্তের মত উঠে দাঁড়ায় অর্পিতা। দ্রুত সে তার নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকে। রিফাত হঠাৎ টের পায় কোথাও একটা বিশাল ভুল হয়ে গেছে। ইউ ষ্টুপিড! অঙ্গনাদের লিভিং রুমে মাথা নিচু করে বসে থাকে রিফাত। একটুও নড়ার শক্তি নেই ওর। অর্পিতা আর ফিরে আসে না। একটু পর বেরিয়ে এলেন অঙ্গনার দুলাভাই। ঘুম ভেঙ্গে তাড়াহুড়োয় বাইরে যাবার পোশাক পরে নিয়েছেন।
– রিফাত উই নিড টু টক! এসো আমার সাথে।
মন্ত্রমুগ্ধের মত উঠে দাঁড়ায় রিফাত। এই সময় কাঁধে ভারী বই খাতার ব্যাগ চাপিয়ে বেঁকে চুরে পা টেনে টেনে ক্লাশ থেকে ফিরল অঙ্গনা। খুব ক্লান্ত লাগছিল ওকে। রিফাতকে দেখেই বলল, আরে রিফাত! কখন এসেছিলেন? আর একটু বসে যান না। এক্ষুনি আসছি। আমার রিসার্চের দারুণ একটা গল্প আছে। বলেই ঘরের ভেতর চলে গেল অঙ্গনা।
– এসো রিফাত! তাড়া দিল রাজীব ভাই।
ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো ওরা। ধীর পায়ে বিশাল উঠোন পেরিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসল। জানালা দিয়ে পেছনে ফিরে চাইল রিফাত। অর্পিতা আর অঙ্গনা পাশাপাশি দরজায় দাঁড়িয়ে। ব্যথিত মলিন হাসি হাসি মুখ ওদের। হাত নাড়ছে ওরা। একটি জনাকীর্ণ রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে গাড়ি। রাজীব ভাইয়ের কাল রংয়ের পাথ ফাইন্ডারটিকে এখন রিফাতের কাছে মনে হচ্ছে একটি প্রিজন ভ্যান। কোন বধ্যভূমিতে নিয়ে যাচ্ছেন রাজীব ভাই রিফাতকে! শহরের একটি সভ্রান্ত রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসল ওরা। এক সময় রাজীব ভাই তাঁর ভারী রোমশ হাতটি সস্নেহে রিফাতের কাঁধে স্থাপন করলেন। নীরব প্রার্থনায় বিলীন হোল রিফাত।
আই প্লীড গিল্টি ইয়োর অনার! এবার রায় দিন ধর্মবতার! জেল জরিমানা ফাঁসি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, যা কিছু!
– আই এ্যাম স্যরি রিফাত! তোমার কোন দোষ নেই। কমিউনিকেশনে আমাদের সবারই একটা বিশাল ফাঁক থেকে গিয়েছিল। আসলে অঙ্গনা একজনের বাগদত্তা। ছেলেটি আমেরিকায় থাকে। সামনের মাসেই ওদের বিয়ে!
কয়েকদিন ধরেই মিসেস হাফিজ লক্ষ্য করছেন ইদানিং ছেলের ভাবসাব কেমন যেন বিবাগী বিবাগী। নাওয়া খাওয়ায় অনিয়ম। সারাদিন ঘরে বসে থাকে। বাইরে তেমন বেরোয়ইনা। আগে অঙ্গনার কথা নিয়ে সারাদিন বকবক করতো। আজ ক’দিন অঙ্গনার নামটিও মুখে আনছে না। মান-অভিমান নাকি? ছেলেকে তিনি এ নিয়ে ঘাটাতে চাইলেন না। বয়সের ক্রাইসিস। নিজেরাই মোকাবেলা করুক। এরই মাঝে একদিন বাইরে থেকে এসেই সোজা মায়ের ঘরে চলে এলো রিফাত।
– আম্মু! তোমার কাছে টাকা পয়সা কেমন আছে? বিদেশে গিয়ে এবার পিএইচডিটা করে ফেলতে চাই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে চমৎকার রিজাল্ট রিফাতের। এর আগে শত ঠেলেও এই ছেলেকে বিদেশমুখী করা যায়নি। বলেছে ওসব রাখতো আম্মু। তোমাকে রেখে দূরে কোথাও যাবো না আমি। মিসেস হাফিজ নিশ্চিত হলেন বিবাগীপনা নিঃসন্দেহে অঙ্গনাজনিত। তিনি ভাবলেন প্রথমে ছেলেকে আশ্বস্ত করা যাক। পরে অঙ্গনার প্রসঙ্গে যাওয়া যাবে।
– তোর আব্বু তো তোর পড়াশুনার জন্য ব্যাংকে অনেক গুলো টাকা রেখে গেছেন। সবটাই পড়ে আছে। পিএইচডি করেও অনেক টাকা বেঁচে যাবে।
– থ্যাংকস্ আম্মু!
– অঙ্গনার সাথে ঝগড়া করেছিস, না?
– স্যরি আম্মু! আমি এসবের কিছুই জানতাম না। অনেক আগে থেকেই অঙ্গনার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। ছেলেটি আমেরিকায় থাকে। সামনের মাসেই ওদের বিয়ে!
মিসেস হাফিজ সস্নেহে ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন। বড় পরিচ্ছন্ন সুন্দর মনের ছেলে তার এই রিফাত। নেহাত বোকামীর পরিণতি। নইলে এই কষ্টটুকু ওর মোটেও প্রাপ্য ছিল না। এমনিতেই মিসেস হাফিজ খুব শক্ত মনের মানুষ। ভাবাবেগকে তিনি কখনোই তেমন আমল দেন না। আজকের এই মুহূর্তে কেমন করে যেন তার সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ল। ছেলেকে বুঝতে না দিয়ে তিনি অবাধ্য অশ্রুটুকু ত্রস্তে আঁচলে লুকিয়ে ফেললেন।
দেখতে দেখতে রিফাতের পিএইচডির বছরগুলো শেষ হয়ে গেল। থিসিস তৈরির কাজও শেষ পর্যায়ে। এবার কী করবে রিফাত? দেশে ফিরতেও মন চাইছে না। এরই মধ্যে একদিন রিয়ার চিঠিটা এলো। চিঠি পড়ে এক অতলান্তিক বিষণ্ণতায় ডুবে গেল রিফাত। রিয়া লিখেছে, ভাইয়া তুমি কিন্তু মন খারাপ কোরবে না। অনেকগুলো দুঃসংবাদ দিতে হচ্ছে তোমাকে। অঙ্গনা আপু হঠাৎ ঢাকায় ফিরে এসেছে। ডিভোর্স হয়ে গেছে ওর। কিছুদিন আগে অর্পি আপুর হাজব্যান্ড সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। অর্পি আপুরা এখন মোহাম্মদপুরে একটি ছোট্ট বাসা ভাড়া করে থাকে । অর্পি আপুরা আমাদের বাসায় বেড়িয়ে গেছে দু’দিন। অঙ্গনা আপু টেলিফোন নাম্বার দিয়েছে, তোমাকে ফোন করতে বলেছে।
অঙ্গনাই তুলল রিসিভার এবং রিফাতের কণ্ঠটাও চিনে ফেলল কোন ভুল না করেই। কুশলাদি বিনিময়ের গণ্ডী পার হয়ে স্বভাবতই কথোপকথন গড়িয়ে গেল ব্যক্তিগত চত্বরে। অঙ্গনার ডিভোর্সের ব্যাপারে জানার ঔৎসুক্য লুকোতে পারল না রিফাত। অঙ্গনাও নির্দ্বিধায় বলে গেল নিজের কথা।
– পিয়াল সাহেবের আচরণে মনে হতো একটি প্রতিবন্ধী অনাথ মেয়েকে বিয়ে ক’রে না জানি কী এক বিশাল দয়া করে ফেলেছিলেন। প্রতিদিনের অবজ্ঞা অবহেলা সবকিছু এক সময় সয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শারীরিক নির্যাতন মেনে নেওয়ার মত শক্তি ও মনন আমার ছিল না। ইউনিভার্সিটি অব ডালাসের একদার চৌকষ বেস বল চ্যাম্পিয়ন পিয়াল চৌধুরী যেদিন তার কালেকশনের সবচেয়ে প্রিয় ব্যাটটি দিয়ে পিটিয়ে আমার অসুস্থ পা’টি ফ্র্যাকচার করে দিল সেদিনই ঠিক করলাম, অনেক হয়েছে, আর নয়। এসব কথা আর কেউ জানে না রিফাত। শুধু আপনাকে বললাম। অর্পি আপুকেও এতটা বলিনি কখনো।
– সব কথা সবাইকে বলাও যায় না অঙ্গনা। ঢাকায় ফিরে কেমন যাচ্ছে সময়?
– খুব ভাল। মেয়েদের কলেজে মাস্টারি। নিজের দেশটাকে কী যে ভাল লাগে!
– নপুংসকদের নিয়ে সেই গবেষণাটি শেষ করেছিলেন?
– থিসিসটা ডিপার্টমেন্টের হেডের খুব পছন্দ হয়েছিল। সেই সুবাদেই বুঝি স্থানটি চতুর্থ হলেও প্রথম শ্রেণীটি কপালে জুটে গিয়েছিল।
– কংগ্রাচুলেশনস! ইউ ডিজার্ভড ইট অল, অঙ্গনা!
– ধন্যবাদ। কিন্তু অভিনন্দনটা কি একটু দেরীতে হয়ে গেল না?
টেলিফোনের ফোকর দিয়ে অঙ্গনার সেই পুরনো ফিচফিচে হাসিটি লিক হয়ে বেরিয়ে এলো। এই ফিচফিচে হাসিটি অঙ্গনার ট্রেডমার্ক। কাউকে ঠকিয়ে মজা পেলে এমনি সে হাসে, এবং অনেকক্ষণ ধ’রে ।
– প্রতিবারই তো তাই-ই হয় আমার। আপনার কাছে পৌঁছুতেও তো অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল!
ঝোপ বুঝে কোপ। আজকের কথাগুলো কিন্তু ওর বেশ পরিপাটি গুছিয়ে বেরোলো। টেলিফোনের অপর প্রান্তে অঙ্গনা। একেবারে চুপ হয়ে গেছে। কোন সাড়া নেই। নিঃশব্দে কেটে যায় অনেকগুলো মুহূর্ত। কী ভাবছে অঙ্গনা? এই এক সমস্যা রিফাতের। বোকার মত কী সব বলে ফেলে! আবারও কোন ভুল হয়ে গেল না তো?
ওদিকে অঙ্গনা ভাবছে, এবার তো তোমার হাতে অফুরন্ত সময় রিফাত। এবার আর দেরী করে ফেলার ভয় নেই তোমার।
– কবে ফিরছেন ঢাকায়?
অঙ্গনার অন্তরঙ্গ সবাক প্রত্যাবর্তনে উৎকণ্ঠা কেটে যায় রিফাতের। মনে মনে বলল, তোমার কাছে ফিরে যেতে যে মরে যাচ্ছি অঙ্গনা! দুষ্টুমি ভর করল মাথায়। ভাবল আপাতত একটু টেনশন দিলে কেমন হয়? পরে নাহয় হঠাৎ সশরীরে হাজির হয়ে সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে।
– কবে যে ফিরি! পিএইচডিটা শেষ করার আগে কি আর ফেরা হবে! মাঝে অনেকগুলো মাসের ব্যাপার!
টেনশনের শরটা একেবারেই বেপথু গেল রিফাতের! অঙ্গনা অতঃপর নির্বিকারে বলে গেল,
– সেদিন অর্পি আপু আর আমি আপনাদের বাসায় গিয়েছিলাম। খালাম্মা বললেন থিসিস সাবমিশনের একটা এক্সটেনশন নিয়ে শীঘ্রি ঢাকায় আসার জন্য আপনাকে জরুরী শমন পাঠানো হবে।
– আম্মুর মাথা খারাপ!
আবারও সেই অসহ্য ফিচফিচে হাসি! অঙ্গনা টেলিফোনের রিসিভারে আলতো করে মুখ রাখলো। যেন খুব কাছ থেকে গোপন কিছু বলছে এমনি, রিফাতের অনুভবের শিরা উপশিরায় এক দুর্বহ অনুরণন ছড়িয়ে দিয়ে অঙ্গনা বলল,
– আপনার দাদীর বালা দুটো কিন্তু এখন আমার কাছে। সেদিন খালাম্মার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে এসেছি!