অভিশপ্ত ফুলশয্যা
প্রায় সারারাত জেগেই বসেছিল ফুলটুসী।আজ কোথা থেকে ঝাঁকে,ঝাঁকে স্বপ্ন এসে তার দুইচোখে ভিড় করে। মনে হয় প্রকৃতি যেন তার জানালা,দরজা সব উন্মুক্ত করে দিয়েছে আর তার গবাক্ষ্ দিয়ে আছড়ে পড়ে ফাগুনের দক্ষিণা বাতাস ।দুই কানে সামনেই বেজে চলেছে কোকিলের কুহু-কুহু অমৃতবাণী। হৃদঙ্গনে ভালো লাগার এক যেনঅদ্ভুত শিহরণ –
” আকাশে বহিছে প্রেম,নয়নে লাগিল নেশা,
কারা যেন ডাকিলো পিছু, বসন্ত এসে গেছে …..” ।
ফুলটুসীর অন্ধকার ঘরে জ্যোৎস্নার আলো এসে এখন নিত্য শুয়ে থাকে বিছানায় । এ মধুমাখা রাতে পরম ভালোলাগাকে বুকে নিয়ে আজ সে শবরীর প্রতীক্ষায়। যেকোন মুহূর্তে তিনি আজ এসে পড়বেন, তার অপূর্ণ,অতৃপ্ত ,অসম্পূর্ণ জীবনকে সব পাওয়ার পূর্ণতায় ভরিয়ে দেওয়ার জন্যে। ফুলটুসী এইটুকু পাওয়ার অপেক্ষাতেই এতগুলো বছর বসে আছে। তার প্রেমময় পরমপুরুষ,কথা দিয়েছেন আজ তিনি আসছেন তার হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে ফুলটুসীকে পূর্ণতায় রাঙিয়ে দিয়ে তাকে গ্রহণ করবেন।
রাত যখন নিশীভোরের কোলে ঢলে পড়লো, বাইরের পেটা ঘড়িতে ঘোষিত হলো চারটে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার কান্না থেমে গেছে,পাশের গলিতে মাতালের কোলাহল স্তব্দ, তখন ফুলটুসী বুঝলো যার জন্যে এত আয়োজন,এত অধীর প্রতীক্ষা সে আর আসবে না।কল্পনায় সানাইয়ের সুর যেন শুধুই বলে – সে নাই, আঙিনায়। মাসি সন্ধ্যাবেলায় কয়েকবার এসে বলেছিল এভাবে খদ্দেরদের ফিরিয়ে দিস না লো। ঘরের লক্ষী পায়ে ঠেলতে নেই মা। এই রূপ,যৌবন ক্ষণস্থায়ী। তোর রূপসুধা পান করতে অনেক নাগর আসবে, ভালোবাসার অভিনয় করবে,প্রলোভনের সুরমায় রাঙিয়ে দেবে দুচোখে কিন্তু মা বিশ্বাস করলেই মরবি। বেশ্যাকে নিয়ে সবাই ফুর্তি করবে কিন্তু বিয়ে করে কেউ ঘরের বউ করবে না। ফুলটুসী মাসির কথা কানে তোলেনি। সেই মানুষটাকে আর তাঁর চোখদুটোকে চিনতে তার কোন ভুল হয়নি। বড় অসহায় আর নিঃসঙ্গ যে তাঁকে।একাকিত্বের যন্ত্রনায় মানুষটা ছটফট করছে মুখের দিকে তাকালেই বোঝাযায়। তিনি প্রথম দিন এসে একটাই কথা বলেছিলেন তুমি আমার সঙ্গে নতুন জীবনের সন্ধানে যাবে? চিন্তা নেই ভালোবাসতে না পারো ,ভালোবাসার অভিনয় তো করতে পারবে । রোজ দুটো রান্না করে খেতে দিও। দরজায় পা রাখলে দুটো সুখ-দুঃখের কথা বলো। তাতেই আমি খুশি হবো।আমার কথা বিশ্বাস না হয় এই নাও বলে …… একটা দুহাজার টাকাটা বান্ডিল তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। এইটা তোমায় সিকিউরিটি হিসাবে দিলাম।না ভালো লাগে যখন খুশি চলে এসো।ফুলটুসী ভয়ে না না করেছিল।কিন্তু মানুষটা হেসে উঠে বলেছিলেন – এ পৃথিবীতে আমার সব আছে জানো শুধু আমার নিজের বলতে কোন মানুষ নেই । আমি বড় একা,স্বজনহীন,নিঃসঙ্গ অথচ আমার মান,সম্মান, প্রভাব ,প্রতিপত্তি, ঘরবাড়ি,প্রচুর টাকাকড়ি সব,সব আছে ,কিন্তু মনে শান্তি নেই। আমার জন্যে এমন কোন কোল নেই, এমন কোন বুক নেই যেখানে পরম নিশ্চিন্তে মাথা রেখে একটু কাঁদবো অথবা কোন নিশীথে নিশ্চিন্তে ঘুমাবো আর স্বপ্ন দেখবো। তুমি যদি রাজি থাকো তোমায় আমি স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েই নিয়ে যাবো এমন জায়গায় যেখানে তোমাকে,আমাকে কেউ চেনেনা,দেখেনি। আর কেউ কোনদিন খুঁজেও পাবে না ।আসলে আমি আর যেকটা দিন বাঁচবো একটু মনভরে কাউকে ভালোবাসতে চাই। জীবনের বাকি কটাদিন একান্ত জনের ভালোবাসা পেয়ে বাঁচতে চাই। বলোনা তুমি কি হবে আমার সেই একান্ত আপনজন? আমার এই মধ্য বয়সে একমাত্র তুমিই পারো….. ।
মানুষটার কথায় যেন জাদু ছিল,কেমন যেন আকর্ষণ ছিল, একদিন,দুইদিন,ক্রমান্বয়ে …… আস্তে-আস্তে বিবস হয়ে হৃদয়ের অতলের চাপা দেওয়া অতৃপ্তির খিদেটা প্রচন্ড ভাবে বেড়ে উঠেছিল গুলটুসীর। তারপর পঁয়ত্রিশ বছরের রূপের ভারে ক্লান্ত ফুলটুসী গভীর প্রত্যাশায় তার একান্ত নিজের ঘর,সংসার পাওয়ার আশায় সেই মধ্যবয়স্ক মানুষটির কাছে একবুক প্রত্যাশা নিয়ে আত্মসমর্পণ করে গভীরভাবে তৃপ্ত হয়েছিল।
সেই রাতের পর থেকেই ফুলটুসীর পরিবর্তনের শুরু। সারাটি দিন যেন বসন্তের ছোঁয়া আর জ্যোৎস্না মধু মেখে মেখে ঘুরে বেড়ায় সবার অজান্তে নিজের ঘরময়। লক্ষীরপট কেনা,শঙ্খধ্বনি,দোর গোড়ায় গঙ্গাজলের ছিটা , আর সেই মানুষটার মঙ্গল কামনায় , নিত্য নতুন শুরু হলো স্বপ্ন দেখা।জানালায় দাঁড়িয়ে,দাঁড়িয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষা প্রিয়তমর জন্যে। আয়নায় প্রতিচ্ছবির সাথে কথা বলতে,বলতে অনাস্বাদিত মুহূর্ত্বের কল্পনায় রাঙা হয়ে উঠত মুখমন্ডল। কখনো কখনো আনন্দটুকু অশ্রুধারায় গড়িয়ে পড়তো দুই গন্ডবেয়ে ।অহর্নিশি শুধু প্রিয় মানুষটির হাত ধরে অচেনা নতুন ঘরে যাবার দিনগোনা, উদ্বেগ,দীর্ঘ প্রতীক্ষা।
আজই ছিল সেই শুভদিন, তিনি কথা দিয়েছিলেন আজ রাতে এসে ফুলটুসীকে তাঁর দুবাহুর বেষ্টনীতে বুকের মাঝে নিয়ে চিরদুখিনীর ধূসর,পাণ্ডুর সিঁথিকে সিঁদুরে,সিঁদুরে রাঙিয়ে তারপর সোহাগে,স্বপনে ফুলশয্যা যাপন করবেন। সেইক্ষণে একান্ত ভাবে তাকে নিজের করে কাছে নিয়ে সারাটি রাত স্বর্গসুখে কাটাবেন মধুচন্দ্রিমায়। পুলকিত,শিহরিত ,পলকে,পলকে চমকিত অনন্য স্বাদ আস্বাদনের প্রত্যাশায় ফুলটুসী। সন্ধ্যে থেকেই ফুলটুসী অনেক দিন বাদে মনের মতো করে নিজেকে সাজিয়ে তুললো।। বাক্স থেকে বহুদিন আগের অভিশপ্ত বিবাহের সেই শাপগ্রস্ত বেনারসী টা জড়িয়ে নিয়েছিল তার কাঁচা হলুদ বর্ণের অঙ্গে। অনেক গোপনে রেখে দেওয়া মায়ের দেওয়া বিছেহার,কানের ঝুমকো পাশা আর ছয়গাছা সোনার চুরি যেটার হদিস কেউ কখনো পায়নি সেগুলো বের করে আজ ঘরের দরজা বন্ধ করে নিজেকে মনের মতো করে সাজিয়ে পরমাসুন্দরী করে তুলেছিল শুধুমাত্র তার প্রিয়তমর নৈবেদ্দ্যের উপযোগী করে।
স্তব্দ রাত্রির নিরবতাকে খান, খান করে কোথায় যেন বেজে উঠলো করুন সুরের বংশীধ্বনি । তবে কি অনাথের নাথ এলেন? এসো প্রভু,উদ্ধার করো আমায়,নিষ্কৃতি দাও এ বিরহ জ্বালা থেকে। মুক্তি দাও এ অভিশপ্ত জীবন থেকে।” আমি সুখেরো লাগিয়া এঘর বাঁধিনু, অনলে পুড়িয়া যায় ……” ।নিশীথের অন্ধকারে ফুলটুসীর দুইচোখের স্বপ্নগুলো একে একে ভাঙতে,ভাঙতে খরকুটোর মতো কান্নার প্রবল স্রোতে ভেসে যেতে লাগলো।একসময়ে নিশি যাপনের দুরূহ ক্লান্তিতে ভোরের স্নিগ্ধ,নির্মল ঠান্ডা হওয়ায় কখন যে ফুলটুসী ঘুমিয়ে পড়লো….।
একটু বেলায় তার দরজায় খুব জোরে ধাক্কাধাক্কির আওয়াজে ধরফড়িয়ে উঠে ফুলটুসী দরজা খুলতেই দেখলো দুজন পুলিশ আর তাদের ঘিরে মাসি,শবরী,সুন্দরী,মনিমালা,মালিনী ও কয়েকজন দালাল দাঁড়িয়ে আছে। সবার চোখেই অশেষ কৌতূহল। বুকটা অজানা ভয়ে ছ্যাত করে ওঠে ফুলটুসীর। একজন পুলিশ অফিসার এগিয়ে এসে বললো – দেখতো এঁকে চিনিস কিনা? তোর ঘরে আসতো ? কাল রাত বারোটায় বিডন স্ট্রিট মোড়ে কলকাতার নামকরা প্রমোটার ঘনশ্যাম হালদারের গাড়িটি লরি এক্সিডেন্ট করে এবং ঘনশ্যাম বাবু শোচনীয় ভাবে রাস্তাতেই মারা গেছেন । ওর পকেটে তোর ঘরের ঠিকানা আর ফোন নং পাওয়া গেছে। আর মোবাইলে তোর ছবিও পাওয়া গেছে।তাই তোর কাছে কাছে এসেছি ওঁকে সনাক্ত করার জন্যে।
ফুলটুসীর পায়ের নিচটা দুলে উঠলো। চারিদিকে যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। দুচোখে অন্ধকার এসে ঘিরে ধরছে। চারিদিকের জানালা, দরজা দড়াম,দড়াম করে বারি খাচ্ছে ,কাঁচভাঙার ঝনঝনানি। মাতালের মতো দুলছে এদিক,ওদিক ফুলটুসীর দেহটা। অসার, ভারসাম্যহীন হঠাৎ তার সারা শরীরটা থর থর করে কেঁপে উঠলো। তারপর কাটা কলাগাছের মতো মাটিতে মুখ থুপরে পড়ে গেলো। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে আর সেই রক্তেই সিঁদুর রাঙা উঠছে ফুলটুসীর ধূসর,পাণ্ডুর সাদা সিঁথি। সবাই দৌড়ে গেল ,চিৎকার,চেঁচামেচি কত ডাকাডাকি কিন্তু ফুলটুসী আর সারা দিলোনা।
তিনদিন বাদে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারবাবু ডেথসার্টিফিকেট লিখতে,লিখতে মাসিকে বললেন – এ কেস অফ করোনারি থোম্বোসিস ….।
নিমতলা শ্মশানঘাটের লেলিহান চিতার আগুন বেশ্যা ফুলটুসীকে কোলে নিয়ে যখন শেষ সান্তনায় আদর করছে আর নীচে গঙ্গার ঘাটে প্রেমে ব্যর্থ পাগল বিশু গেয়ে চলেছে –
” আমি সুখের লাগিয়া, এঘর বাঁধিনু
অনলে পুড়িয়া যায় …..”