অরূপরতন
বাসস্ট্যান্ডের সামনের ছোট্ট চা-স্টলে এঁটো কাপ-প্লেট ধুচ্ছিল অনাথ।,হঠাৎ- ‘গেলো গেলো’চিৎকার কানে যেতেই বিদ্যুতের মতন ছুটে যায়। হ্যাঁচকা টানে নিরাপদ স্থানে নিয়ে এলো ভয়ে-বিবর্ণ আধমরা এক অল্পবয়সী বিধবাকে।
বিধবাটির হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা ছিলো একটি বাচ্চা ছেলে।
ক্ষুধার্ত ছেলের জন্য বুঝিবা কিছু কিনতে যাচ্ছিলো ,আর তখুনি দৈত্যের মতো মাল বোঝাই ট্রাকটা—
অনাথ বেদনাবোধ করে ,যখন দেখে- বিধবাটি অন্ধ,ভারী মায়া হয় তার।
জানতে পারলো- কাঁচাকান্তিমায়ের
মন্দিরে পূজো দিয়ে ফেরার পথেই বাস আ্যাকসিডেন্টে স্বামীকে হারান।নিজেও অন্ধ হয়ে যান, শুধু দৈববলেই বেঁচে যায় ছোট্ট শিশু তপু।সেই থেকে ভিক্ষে বৃত্তিই সম্বল ।
শৈশবে পিতৃমাতৃহীন অনাথ আজ আবার মা,ভাইকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে নিয়ে এলো বস্তীর ছোট্ট ঘরে।মায়ের সেবা করে ,ভাইকে যত্নকরে,রেঁধে খাওয়ায়।প্রতিরাতে মায়ের পা টিপে দেয়,নিষেধ করলেও শোনেনা।
মা যে কতো স্নেহময়ী, ‘মা ‘ডাকের মধ্যে যে এতো শান্তি,তৃপ্তি লুকিয়ে থাকতে পারে তাই আগে জানার,বোঝার ভাগ্য তো হয়নি হতভাগ্য অনাথের।
সময়ের স্রোতে তপু বড়ো হতেই তাকে পাঠশালাতে ভর্তিকরে ,ব ই,খাতা, পেন্সিল,পোষাক কিনে দেয়।
মা বলেন,ও বাবা,পড়াশোনার যে অনেক খরচ,এতোসব চালাবি কি করে?
অনাথ একগাল হেসে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে,সব তোমার আশীর্বাদে হয়ে যাবে গো ।জানো মা,আমি বিস্কুট কোম্পানীতে চাকরি পেয়েছি,কিচ্ছুটি ভেবোনা,ভাইকে আমি অনেক পড়াবো,শিক্ষিত করবো,তখন আমাদের কোন দুঃখ থাকবেনা।
মা কেঁদে ভাসছেন অনাথের কথাশুনে,জানিস বাবা,বড়ো ইচ্ছে করে,যদি একটিবার তোর মুখটা দেখতে পেতাম রে!
মায়ের আকুলতায় ডুকড়ে ওঠে অনাথের মনটা।ধূপ-দীপ জ্বেলে আর্তি জানায় ঠাকুরের কাছে,তুমি তো ইচ্ছে করলে অসাধ্য সাধন করতে পারো, আমার মায়ের চোখ তুমি ভালো করে দাওনাগো’—
তপু এতোদিনে দাদাকে অক্ষর চিনতে,বানান করে পড়তে শিখিয়েছে।
একদিন, পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন অনাথের নজরে পড়ে,–*অপূর্ব সুযোগ! বিনামূল্যে চক্ষু চিকিৎসা!*
নীচে ফোননম্বর ছিলো।অনাথের তিলমাত্র দেরী হয় না, যোগাযোগ করে সব ব্যবস্থা পাকা করে ফেলে মা-বাবাকে জানায়। নির্দিষ্ট দিনে অপারেশন হয়ে যেতে অনাথের মন আনন্দে ভরে গেলো।সাতদিন পর,চোখের ব্যান্ডেজ খুলতেই প্রথমে সব ঝাপসা্,চোখ বন্ধ করে আস্তে আস্তে আবার খুলতেই দেখতে পান,তপুর হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা অতি সরলতা মাখানো উৎকণ্ঠা ভরা একটি মুখ!
মায়ের চোখে উজ্জ্বল আভা,এই বুঝি তার –অরূপ–অরূপরতন!