Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সাধু ও চলিত ভাষা || Rajshekhar Basu

সাধু ও চলিত ভাষা || Rajshekhar Basu

কিছুকাল পূর্বে সাধু ও চলিত ভাষা নিয়ে যে বিতর্ক চলছিল এখন তা বড় একটা শোনা যায় না। যারা সাধু অথবা চলিত ভাষার গোড়া, তারা নিজ নিজ নিষ্ঠা বজায় রেখেছেন, কেউ কেউ অপক্ষপাতে দুই রীতিই চালাচ্ছেন। পাঠকমণ্ডলী বিনা দ্বিধায় মেনে নিয়েছেন–বাংলা সাহিত্যের ভাষা পূর্বে এক রকম ছিল, এখন দু রকম হয়েছে।

আমরা শিশুকাল থেকে বিদ্যালয়ে যে বাংলা শিখি তা সাধু বাংলা, সেজন্য তার রীতি সহজেই আমাদের আয়ত্ত হয়। খবরের কাগজে মাসিক পত্রিকায় অধিকাংশ পুস্তকে প্রধানত এই ভাষাই দেখতে পাই। বহুকাল বহুপ্রচারের ফলে সাধু ভাষা এদেশের সকল অঞ্চলে শিক্ষিতজনের অধিগম্য হয়েছে। কিন্তু চলিতভাষা শেখবার সুযোগ অতি অল্প। এর জন্য বিদ্যালয়ে কোনও সাহায্য পাওয়া যায় না, বহুপ্রচলিত সংবাদ পত্রাদিতেও এর প্রয়োগ বিরল। এই তথাকথিত চলিতভাষা সমগ্র বঙ্গের প্রচলিত ভাষা নয়, এ ভাষার সঙ্গে ভাগীরথী তীরবর্তী কয়েকটি জেলার মৌখিকভাষার কিছু মিল আছে মাত্র। এই কারণে কোনও কোনও তাঞ্চলের লোক চলিত ভাষা সহজে আয়ত্ত করতে পারে, কিন্তু অন্য অঞ্চলের লোকের পক্ষে তা দুরূহ।

যোগেশচন্দ্র-প্রবর্তিত দুটি পরিভাষা এই প্রবন্ধে প্রয়োগ করছি—মৌখিক ও লৈখিক। আমার একটা অযত্নলব্ধ মৌখিক ভাষা আছে তা রাঢ়ের বা পূর্ববঙ্গের বা অন্য অঞ্চলের। চেষ্টা করলে এই ভাষাকে অম্লাধিক বদলে কলকাতার মৌখিক ভাষার অনুরূপ করে নিতে পারি, না পারলেও বিশেষ অসুবিধা হয় না। কিন্তু আমার মুখের ভাষা যেমনই হোক, আমাকে একটা লৈখিক বা লেখাপড়ার ভাষা শিখতেই হবে— যা সর্বসম্মত, সর্বাঞ্চলবাসী বাঙালীর বোধ্য, অর্থাৎ সাহিত্যের উপযুক্ত। এই লৈখিকভাষা সাধু হতে পারে কিংবা চলিত হতে পারে। কিন্তু যদি দুটিই কষ্ট করে শিখতে হয় তবে আমার উপর অনর্থক জুলুম হবে। যদি চলিতভাষাই যোগ্যতর হয় তবে সাধুভাষার লোপ হ’লে হানি কি? সাধুভাষায় রচিত যেসব সগ্রন্থ আছে তা নাহয় যত্ন করে তুলে রাখব। কিন্তু যে ভাষা অবাঞ্ছনীয় এখন আর তার বৃদ্ধির প্রয়োজন কি? পক্ষান্তরে, যদি সাধুভাষাতেই সকল উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় তবে এই সুপ্রতিষ্ঠিত বহুবিদিত ভাষার পাশে আবার একটা অনভ্যস্ত ভাবা খাড়া করবার চেষ্টা কেন?

যাঁরা সাধু আর চলিত উভয় ভাষারই ভক্ত তাঁরা বলবেন কোনওটাই ছাড়তে পারি না। সাধুভাষার প্রকাশশক্তি একরকম, চলিতভাষার অন্যরকম। দুই ভাষাই আমাদের চাই, নতুবা সাহিত্য অঙ্গহীন হবে। ভাষার দুই ধারা স্বত ফুর্ত হয়েছে, সুবিধা-অসুবিধার হিসাব করে তার একটিকে গলা টিপে মারতে পারি না।

কোনও ব্যক্তি বা বিদ্বৎসংঘের ফরমাশে ভাষার সৃষ্টি স্থিতি লয় হতে পারে না। শক্তিশালী লেখকদের প্রভাবে ও সাধারণের রুচি অনুসারে ভাষার পরিবর্তন কালক্রমে ধীরে ধীরে ঘটে। কিন্তু প্রকৃতির উপরেও মানুষের হাত চলে। সাধারণের উপেক্ষার ফলে যদি একটা বিষয় কালোপযোগী হয়ে গড়ে না ওঠে, তথাপি প্রতিষ্ঠাশালী কয়েকজনের চেষ্টায় অল্পকালেই তার প্রতিকার হতে পারে। অতএব সাধু আর চলিত ভাষার সমস্যায় হাল ছেড়ে দেবার কারণ নেই।

একটা ভ্রান্ত ধারণা অনেকের আছে যে চলিতভাবা আর পশ্চিম বঙ্গের মৌখিকভাষা সর্বাংশে সমান। এর ফলে বিস্তর অনর্থক বিতণ্ডা হয়েছে। মৌখিকভাষা যে অঞ্চলেরই হোক, মুখের ধ্বনি মাত্র, তা শুনে বুঝতে হয়। লৈখিকভাষা দেখে অর্থাৎ পড়ে বুঝতে হয়। মৌখিকভাষার উচ্চারণই তার সর্বস্ব। লৈখিকভাষার চেহারাটাই আসল, উচ্চারণ সকলে একরকমে না করলেও ক্ষতি নেই, মানে বুঝতে পারলেই যথেষ্ট। লৈখিকভাষা সর্বসাধারণের ভাষা, সেজন্য বানানে মিল থাকা দরকার, উচ্চারণ যাই হোক।

‘ভাষা’ শব্দটি আমরা নানা অর্থে প্রয়োগ করি। জাতিবিশেষের কথা ও লেখার সামান্য লক্ষণসমূহের নাম ভাষা, যথা-বাংলা ভাষা। আবার, শব্দাবলীর প্রকার (form)—অর্থাৎ কোন শব্দ বা শব্দের কোন রূপ প্রয়োজ্য বা বর্জনীয় তার রীতিও ভাষা, যথা—সাধুভাষা। আবার, প্রকার এক হ’লেও ভঙ্গী(style)র ভেদও ভাষা, যথা—আলালী, বিদ্যাসাগরী বা বঙ্কিমী ভাষা।

আলালী আর বঙ্কিমী ভাষা যতই ভিন্ন হোক, দুইটিই যে সাধুভাষা তাতে সন্দেহ নেই। ভেদ যা আছে তা প্রকারের নয়, ভঙ্গীর। হুতোম পাচার নক্‌শা আর রবীন্দ্রনাথের লিপিকার ভাষায় আকাশ-পাতাল ব্যবধান, কিন্তু দুটিই চলিত ভাষায় লেখা; প্রকার এক, ভঙ্গী ভিন্ন। আজকাল সাধু ও চলিত ভাষায় যে সাহিত্য রচনা হচ্ছে তার লক্ষণাবলী তুলনা করলে এইসকল ভেদাভেদ দেখা যায়–

(১) দুই ভাষার প্রকারভেদ প্রধানত সর্বনাম আর ক্রিয়ার রূপের জন্য। তাহারা বলিলেন, তারা বললেন।

(২) সাধুভাষার কয়েকটি সর্বনাম কালক্রমে পশ্চিমবঙ্গীয় মৌখিক রূপের কাছাকাছি এসে পড়েছে। রামমোহন রায় লিখতেন ‘তাহারদিগের’, তাথেকে ক্রমে ‘তাহাদিগের, তাহাদের’ হয়েছে। এখন অনেকে সাধুভাষাতেও ‘তাদের’ লিখছেন। ক্রিয়াপদেও মৌখিকের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। লিখা, শিখা, শুনা, ঘুরা’ স্থানে অনেকে সাধুভাষাতেও ‘লেখা, শেখা, শোনা, ঘোরা’ লিখছেন।

(৩) সর্বনাম আর ক্রিয়াপদ ছাড়াও কতকগুলি অ-সংস্কৃত ও সংস্কৃত শব্দে পার্থক্য দেখা যায়। সাধুতে উঠান, উনান, মিছা, কুয়া, সুতা, চলিতে ‘উঠন, উনন, মিছে, কুয়ো, সুতো’। কিন্তু এইরকম বহু শব্দের চলিত রূপই এখন সাধুভাষায় স্থান পেয়েছে। ‘আজিকালি, চাউল, একচেটিয়া, লতানিয়া’ স্থানে ‘আজকাল, চাল, একচেটে, লতানে’ চলছে।

(৪) সংস্কৃত শব্দের প্রয়োগ উভয় ভাষাতেই অবাধ। কিন্তু সাধারণত চলিতভাষায় কিছু কম দেখা যায়। এই প্রভেদ উভয় ভাষার প্রকারগত নয়, লেখকের ভঙ্গীগত, অথবা বিষয়ের লঘুগুরুত্বগত।

(৫) আরবী ফারসী প্রভৃতি বিদেশাগত শব্দের প্রয়োগ উভয় ভাষাতেই অবাধ, কিন্তু চলিতভাষায় কিছু বেশী দেখা যায়। এই ভেদও ভঙ্গীগত, প্রকারগত নয়।

(৬) অনেক লেখক কতকগুলি সংস্কৃত শব্দের মৌখিকরূপ চলিতভাষায় চালাতে ভালবাসেন, যদিও সেসকল শল্পে মূল রূপ চলিতভাষার প্রকৃতিবিরুদ্ধ নয়। যথা—সত্য, মিথ্যা, নূতন, অবশ্য’ না লিখে সত্যি, মিথ্যে, নতুন, অবিশি। এও ভঙ্গী মাত্র।

উল্লিখিত লক্ষণগুলি বিচার করলে বোঝা যাবে যে সাধুভাষা অতি ধীরে ধীরে মৌখিক শব্দ গ্রহণ করছে, কিন্তু চলিতভাষা কিঞ্চিৎ ব্যগ্রভাবে তা আত্মসাৎ করতে চায়। সাধুভাষার এই মন্থর পরিবর্তনের কারণ তার বহুদিনের নিরূপিত পদ্ধতি। চলিতভাষার যদৃচ্ছা বিস্তারের কারণ— নিরূপিত পদ্ধতির অভাব। একের শৃঙ্খলার ভার এবং অন্যের বিশৃঙ্খলা উভয়ের মিলনের অন্তরায় হয়ে আছে। যদি লৈখিক ভাষাকে কালোপযোগী লঘু শৃঙ্খলায় নিরূপিত করতে পারা যায় তবে সাধু ও চলিতের প্রকারভেদ দূর হবে, একই লৈখিক ভাষায় দর্শন বিজ্ঞান পুরাণ ইতিহাস থেকে লঘুতম সাহিত্য পর্যন্ত স্বচ্ছন্দে লেখা যেতে পারবে, বিষয়ের গুরুত্ব বা লঘুত্ব অনুসারে ভাষার ভঙ্গীর অদলবদল হবে মাত্র।

লৈখিক ও মৌখিক ভাষার ভঙ্গীগত ভেদ অনিবার্য, কারণ, লেখবার সময় লোকে যতটা সাবধান হয় কথাবার্তায় ততটা হতে পারে না। কিন্তু দুই ভাষার প্রকারগত ভেদ অস্বাভাবিক। কোনও এক অঞ্চলের মৌখিকভাষার প্রকার আশ্রয় করেই লৈখিকভাষা গড়তে হবে। এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের মৌখিক ভাষারই যোগ্যতা বেশী, কারণ, এ ভাষার পীঠস্থান কলকাতা সকল সাহিত্যিকের মিলনক্ষেত্র, রাজধানীও বটে।

কিন্তু যদি পশ্চিমবঙ্গের মৌখিকভাষার উচ্চারণের উপর অতিমাত্র পক্ষপাত করা হয় তবে উদ্যম পণ্ড হবে। শতচেষ্টা সত্ত্বেও বানান আর উচ্চারণের সংগতি সর্বত্র বজায় রাখা সম্ভবপর নয়। মত, ছিলো, কৗল, করে ইত্যাদি কয়েকটি রূপ নাহয় উচ্চারণসূচক (?) করা গেল, কিন্তু আরও শত শত শব্দের গতি কি হবে? বিভিন্ন টাইপের ভারে আমাদের ছাপাখানা নিপীড়িত, তার উপর যদি ও-কারের বাহুল্য আর নূতন নূতন চিহ্ন আসে তবে লেখা আর ছাপার শ্রম বাড়বে মাত্র। কাল’ অর্থে কল্য বা সময় বা কৃষ্ণ, করে’ অর্থে does কি having done, তার নির্ধারণ পাঠকের সহজবুদ্ধির উপর ছেড়ে দেওয়াই ভাল, অর্থবোধ থেকেই উচ্চারণ আসবে—অবশ্য নিতান্ত আবশ্যক হলে বিশেষ ব্যবস্থা করা যেতে পারে। উচ্চারণের উপর বেশী ঝোঁক দেওয়া অনাবশ্যক। কলকাতার লোক যদি পড়ে রমণীর মোন’, আর বরিশালবাসী যদি পড়ে ‘নোমোণীর মঅন’, তাতে সর্বনাশ হবে না, পাঠকের অর্থবোধ হ’লেই যথেষ্ট। লৈখিকভাষাকে স্থানবিশেষের উচ্চারণের অনুলেখ করা অসম্ভব। লৈখিক বা সাহিত্যের ভাষার রূপ ও প্রকার সংযত নিরূপিত ও সহজে অধিগম্য হওয়া আবশ্যক, নতুবা তা সর্বজনীন হয় না, শিক্ষারও বাধা হয়। সুতরাং একটু রফা ও কৃত্রিমতা—অর্থাৎ সকল মৌখিকভাষা হতে অল্পাধিক প্রভেদ–অনিবার্য।

মোট কথা, চলিতভাষাই একমাত্ৰ লৈখিকভাষা হতে পারে যদি তাতে নিয়মের বন্ধন পড়ে এবং সাধুভাষার সঙ্গে রফা করা হয়। বহু লেখক যে আধুনিক চলিতভাষাকে দূর থেকে নমস্কার করেন তার কারণ কেবল অনভ্যাসের কুণ্ঠা নয়, তারা এ ভাষার নমুনা দেখে পথহারা হয়ে যান। বিভিন্ন লেখকের মর্জি অনুসারে একই শব্দের বানান বদলায়, একই রূপের বিভক্তি বদলায়, কভু বা বিশেষ সর্বনামের আগে অকারণে ক্রিয়াপদ এসে বসে, বাংলা শব্দাবলীর অদ্ভুত সমাস কানে পীড় দেয়, ইংরেজী ইডিয়মের সজ্জায় মাতৃভাষা চেনা যায় না। সাধুভাষার প্রাচীন গণ্ডি ছেড়ে চলিতভাষায় এলেই অনেক লেখক একটু অসামাল হয়ে পড়েন।

এমন লৈখিকভাষা চাই যাতে প্রচলিত সাধুভাষা আর মার্জিতজনের মৌখিকভাষা দুইএরই সদ্গুণ বজায় থাকে। সংস্কৃত সমাসবদ্ধ পদের দ্বারা যে বাক্সংকোচ লাভ হয় তা আমরা চাই, আবার মৌখিকভাষার সহজ প্রকাশশক্তিও হারাতে চাই না। চলিতভাষার লেখকরা একটু অবহিত হ’লেই সর্বগ্রাহ সর্বপ্রকাশক লৈখিকভাষা প্রতিষ্ঠালাভ করবে। বলা বাহুল্য, গল্পদি লঘু সাহিত্যে পাত্রপাত্রীর মুখে সব রকম ভাষারই স্থান আছে, মায় তোতলামি পর্যন্ত।

এখন আমার প্রস্তাব সংক্ষেপে নিবেদন করি।–

(১) প্রচলিত সাধুভাষার কাঠামো অর্থাৎ অন্বয়পদ্ধতি বা syntax বজায় থাকুক। ইংরেজী ভঙ্গীর অনুকরণ সাধারণে বরদাস্ত করবে না, তাতে কিছুমাত্র লাভও নেই।

(২) ক্রিয়াপদ ও সর্বনামের সাধুরূপের বদলে চলিতরূপ গৃহীত হোক।

(৩) অন্যান্য অ-সংস্কৃত ও সংস্কৃত শব্দের চলিতরূপ গৃহীত হোক। যদি অনভ্যাসের জন্য বাধা হয়, তবে কতকগুলির সাধুরূপ কতকগুলির চলিতরূপ নেওয়া হোক। যে শব্দের সাধু ও মৌখিক রূপের ভেদ আদ্য অক্ষরে, তার সাধুরূপই বজায় থাকুক, যথা—“ওপর, পেছন, পেতল, ভেতর’ না লিখে ‘উপর, পিছন, পিতল, ভিতর। যার ভেদ মধ্য বা অন্ত্য অক্ষরে, তার মৌখিকরূপই নেওয়া হোক, যথা-কুয়া, মিছা, সুতা, উঠান, পুরানো’ স্থানে কুয়ো, মিছে, সুতো, উঠন, পুরননা।

(৪) যে সংস্কৃত শব্দ চলিত ভাষায় অচল নয়—অর্থাৎ বিখ্যাত লেখকগণ যা চলিতভাষায় লিখতে দ্বিধা করেন না, তা যেন বিকৃত করা না হয়। ‘সত্য, মিথ্যা, নূতন, অবশ্য প্রভৃতি বজায় থাকুক।

(৫) এ ভাষায় অনুবাদ করলে রামায়ণাদি সংস্কৃত রচনার ওজোগুণ নষ্ট হবে, অথবা এ ভাষায় দর্শন বিজ্ঞান লেখা যাবে না—এমন আশঙ্কা ভিত্তিহীন। দুরূহ সংস্কৃত শব্দে আর সমাসে সাধুভাষার একচেটে অধিকার নেই। বাত্যাবিক্ষোভিত মহোদধি উদ্বেল হইয়া উঠিল’ না লিখে ‘…হয়ে উঠল’ লিখলেই গুরুচণ্ডাল দোষ হবে না। দু দিনে অভ্যাস হয়ে যাবে। শুনতে পাই ধুতির সঙ্গে কোট পরতে নেই, পঞ্জাবি পরতে হয়। এইরকম একটা ফ্যাশনের অনুশাসন বাংলা ভাষাকে অভিভূত করেছে। ধারণা দাঁড়িয়েছেচলিতভাষা একটা তরল পদার্থ, তাতে হাত-পা ছড়িয়ে সাঁতার কাটা যায়, কিন্তু ভারী জিনিস নিয়ে নয়। ভার বইতে হলে শক্ত জমি চাই, অর্থাৎ সাধুভাষা। এই ধারণার উচ্ছেদ দরকার। চলিতভাষাকে বিষয় অনুসারে তরল বা কঠিন করতে কোনও বাধা নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আদেশে নবরচিত পাঠ্যপুস্তকে যদি এই ভাষা চলে তবে তা কয়েক বৎসরের মধ্যেই সাধারণের আয়ত্ত হবে। ব্যাকরণ আর অভিধানে এই ভাষার শব্দাবলীর বিবৃতি দিতে হবে, অবশ্য সাধুভাষাকেও উপেক্ষা করা চলবে না, কারণ, সে ভাষার বহু পুস্তক বিদ্যালয়ে পাঠ্য থাকবে। কালক্রমে যখন সাধুভাষা প্র হয়ে পড়বে তখনও তা স্পেনসার শেকস্পিয়রের ভাষার তুল্য সমাদরে অধীত হবে। নূতন লৈখিকভাষাও চিরকাল একরকম থাকবে না। শক্তিশালী লেখকগণের প্রভাবে পরিবর্তন আসবেই, এবং কালে কালে যেমন পঞ্জিকাসংস্কার আবশ্যক হয়, তেমনি যোগ্যজনের চেষ্টায় লৈখিক ভাষারও নিয়মসংস্কার আবশ্যক হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress