অভ্যাস
বেশ কয়েকজন সনামধন্য সাহিত্যিকের কিছু অদ্ভূত অভ্যাসের গল্প বলব এখানে।
শুরু করি আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়েই।
তিনি কখনও এক জায়গায় বেশিদিন লিখতে পারতেন না। কখনও শ্যামলী, কখনও উদয়ন, কখনও নৌকায়, কখনও ঝুল-বারান্দায়।
শোনা যায়,তিনি নাকি গাছের ওপরও একটি বাড়ি বানিয়েছিলেন,সেখানে বসে লিখবার জন্য।
শরৎচন্দ্র নাকি বিভিন্ন কলমে লিখতে পছন্দ করতেন। এবং বিভিন্ন ধরণের চটি জুতো পড়ে সভাসমিতিতে যাওয়া পছন্দ করতেন বলে শোনা যায়।
গ্রিক সুবক্তা, রাজনীতিবিদ এবং বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ লেখক –
ডেমোসথিনিস (৩৮৪ বি সি_৩২২ বি সি)।
তিনি ছোটবেলায় ভালো করে কথা বলতে পারতেন না। জিভে জড়তা ছিল।
সে কারণে মুখে ছোট ছোট পাথর দিয়ে কথা বলতে বলতে বলাটা খানিকটা ভালো হয় এবং পরে তিনি একজন অসাধারণ সুবক্তা হন। তার একটি অভ্যাস এমন ছিল, কোনো একটি সিরিয়াস বিষয়ে লিখতে বসার আগে মাথার আধেক চুল কামিয়ে ফেলতেন। তারপর যতদিন সেই আধেক চুল বড় না হতো তিনি লেখা থেকে উঠতেন না
এবং বাইরে বের হতেন না।
আলেকজান্দার দ্যুমা
রঙের ব্যাপারে খুব শুচিবাই ছিল আলেকজান্দার দ্যুমারের। তিনি তাঁর সব উপন্যাস নীল রঙের, সব কবিতা হলুদ রঙের আর সব প্রবন্ধ গোলাপি রঙের কাগজে লিখেছেন। বিচিত্র স্বভাব নয় কি?
ভিক্টর হিউগো (১৮০২-১৮৫৫)
ভিক্টর হুগো তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস হাঞ্চব্যাক অফ নটর-ডেম লিখেছিলেন উলঙ্গ হয়ে। জামাকাপড় আলমারিতে তুলে রেখে তালা দিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে বাইরে বেরোতে না পারেন। উপন্যাসটা কয়েক সপ্তাহে লিখে দেবেন বলে প্রকাশককে কথা দিয়ে ফেলায় এভাবে নিজেকে একটানা লিখতে বাধ্য করেন তিনি।
‘হাঞ্চব্যাক অফ নোটরডামের’ লিখতে বসার আগেও তিনি শরীরের সব কাপড় খুলে তার পরিচারককে বলতেন, এগুলো লুকিয়ে রাখো যতক্ষণ না আমার লেখা শেষ না হয় এগুলো আমাকে দেবে না।
যখন খুব শীত লাগল গায়ের চারপাশে একটা কম্বল জড়িয়ে বসে লিখতেন।
‘লা মিজারেবল’ লেখার সময় তিনি দীর্ঘদিন কাপড় পরেননি। কারণ ভালো কাপড় চোপড় পরলেই তার বাইরে যেতে ইচ্ছা করত, বই লেখা আর শেষ হতো না। কাজেই সেগুলো লুকিয়ে রাখার নির্দেশ দিতেন,এবং লেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত, তিনি চাইলেও যাতে না দেওয়া হয় এমন
নির্দেশ, কঠোর ভাবে পালন করার কথা পরিচারককে বলা থাকত।
বালজাক (১৭৯৯১৮৫০) এবং ভলটেয়র (১৬৯৪১৭৭৮)_ ওরা ছিলেন ভয়ানক কফিখোর। দিনে পঞ্চাশ কাপ কফি না খেলে তারা নাকি লিখতে পারতেন না। এভাবেই বালজাক নাটক, অপেরা, উপন্যাসের জন্ম দিয়েছেন। ভলটেয়ারের ‘কানদিদাও’ এই কফি পানের ভেতরে সৃষ্টি হয়েছে।
দিনরাত একটানা লিখতেন ফরাসি লেখক ওনোরে দু বালজাক। অনরবত কফি খেতেন। একবার টানা ৪৮ ঘণ্টা লিখেছিলেন তিনি।
টুর্গেনিভ(রাসিয়ান গল্প লেখকও উপন্যাসিক) খোলা জানলার দিকে মুখ করে,আর টেবিলের তলায় গরম জলের বালতিতে পা ডুবিয়ে বসে লিখতে পছন্দ করতেন।তিনি মনে করতেন, এই ভাবে বসাটাই লেখকদের পক্ষে ঠিক উপযুক্ত।
গরম জলের বালতিটি হচ্ছে প্রেরণা,সৃষ্টির উৎসের প্রতীক,আর খোলা জানলাটি হচ্ছে বাইরের পৃথিবী,যেখান থেকে স্রষ্টা তার সৃষ্টির মালমসলা সংগ্রহ করবেন।
ভ্লাদিমির নবোকভ ও গারট্রুড স্টেইন লিখতে পছন্দ করতেন পার্ক করা গাড়ির ভেতরে বসে।
জার্মান কবি শিলারের (১৭৫৯১৮০৫) ছিল ভয়ানক এক অদ্ভুত অভ্যাস। একবার জার্মান কবি গ্যেটে গেছেন তার বাড়িতে, তখন শিলার বাড়িতে ছিলেন না। বসে আছেন শিলারের লেখার ঘরে। হঠাৎ একটা বাজে তীব্র গন্ধে তিনি ভাবতে লাগলেন, এ গন্ধ আসছে কোথায় থেকে। হঠাৎ শিলারের লেখার টেবিলের ড্রয়ার খুলে দেখেন, সেখানে এক ড্রয়ার পচা আপেল। তিনি শিলারের স্ত্রীকে ডাক দিয়ে বললেন আপনি দেখছি আপনার স্বামীর দিকে খেয়াল করেন না। এক ড্রয়ার পচা আপেল ওর ড্রয়ারে। স্ত্রী হেসে বললেন_ পচা আপেলের গন্ধ না পেলে শিলার লিখতে পারেন না। গ্যেটে তো অবাক!
এডগার অ্যালান পো প্রিয় বিড়াল ক্যাটেরিনাকে মনে করতেন তাঁর লেখার অনুপ্রেরণা। মাঝেমধ্যে তার কাছ থেকে তিনি নাকি ‘মতামত’ও নিতেন।
মার্ক টোয়াইন (১৮৩৫১৯১০)
সবসময় বিছানায় শুয়ে লিখতেন। এ ছাড়া তিনি লিখতে পারতেন না।আমাদের বাংলার লেখক সন্তোষ ঘোষেরও এই একই অভ্যাস ছিল।বুকে বালিশ চেপে উপুর হয়ে শুয়ে তিনি লিখতেন। ব্রিটেনের শিশুসাহিত্যিক মাইকেল মোরপারগোর (১৯৪৩_)
একই অভ্যাস আছে । বিছানায় বসে পেছনে বালিশের পাহাড় বানিয়ে সেখানে হেলান দিয়ে লেখেন তিনি। আজকের দিনের লেখক হয়েও তিনি কম্পিউটার বা ল্যাপটপ ব্যবহার করেন না। কলমে লেখেন।
শোনা যায় স্যার ওয়াল্টার স্কট কবিতা লিখতেন ঘোড়ার পিঠে চেপে।
ব্রিটেনের বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক রোয়াল্ড ডাল (১৯১৬- ১৯৯০) লেখেন বাগানের শেডে। সেই ঘরে একটি সোফায় বসেন। কোলের ওপর বোর্ড রাখেন। সেই বোর্ডের ওপর কাগজ রেখে মোটা কলমে লেখেন। পাতাটা শেষ হলেই নিচে ফেলে দেন। এভাবে পাতার পর পাতা বড় বড় অক্ষরে লেখেন। সেই শেডে কেউ যেতে পারেন না, তার সঙ্গে কথা বলতে বা ডাকতে পারেন না। সেখানে চা-কফির ব্যবস্থা আছে। প্রয়োজন হলে সেই চা-কফি তিনি একাই বানিয়ে নিতেন ।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (১৮৯৯১৯৬১)
ভোরবেলায় উঠে একটা উঁচু ডেস্কে টাইপরাইট রেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লিখতেন। একটা করে পাতা টাইপ করা হলে সেটা মেঝেতে ছড়িয়ে দিতেন। দুপুর পর্যন্ত এভাবে টানা লিখতেন তিনি।
এভাবেই তার অসংখ্য উপন্যাস লিখেছেন এবং লিখে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন।
জেমস জয়েস
তিনি লিখতেন বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে। সাদা রঙের কোট পরে একটা বড় নীল কালির পেনসিল দিয়ে লিখতেন তিনি। জয়েসের চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ ছিল বলে এভাবে লেখা।
শোনা যায়, সন্তোষ কুমার ঘোষও বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে,বুকের নীচে বালিশ দিয়ে লিখতে সাচ্ছন্দ বোধ করতেন।
হুমায়ূন আহমেদ
কম্পিউটারের যুগেও হুমায়ূন আহমেদ হাতে লিখতেন। এর কারণ হিসেবে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, তাঁর চিন্তা এগোতো কম্পিউটার কিবোর্ডে টাইপ করারও আগে। মেঝেতে পদ্মাসনে বসে ব্যবসায়ীদের ক্যাশবাক্সের মতো কাঠের ছোট্ট ঢালু টেবিলে বসে লিখতেন হুমায়ূন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও চেয়ার টেবিলে বসে, কলম দিয়ে কাগজে লেখতেন। কম্পিউটার ব্যবহার করতেন না।
আলেক্সজান্ডার ডুমাস (১৮০২১৮৭৯) লেখেন বিভিন্ন রঙের কলম দিয়ে। নীল রঙ দিয়ে যখন লেখেন সেটা হলো উপন্যাস বা গল্প, গোলাপি রঙের কলমে বিভিন্ন প্রবন্ধ এবং হলুদ কলমে নানা রকম কবিতা। এভাবেই তিনি লিখেছেন ‘দি থ্রি মাসকেটিয়ার্স’, ‘দি কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো’ নামের বিখ্যাত বইগুলো।
ডান ব্রাউন (১৯৬৪)_ তিনি লেখেন বাড়ির ছাদঘরে। যাকে ইংরেজিতে বলে লফ্ট। সেখানে এক ঘণ্টা পর পর বাজে এমন একটা ঘড়ি আছে, যা তাকে বলে দেয় এক ঘণ্টা হয়ে গেছে। তখন তিনি ওঠেন, শরীর টানটান করেন। সিট আপ এবং পুশ আপস করেন। এরপর ছাদে দুই পা দিয়ে উল্টো হয়ে নিচে ঝোলেন। এতে নাকি শরীরের রক্ত চলাচল ভালো হয়। ছাদ থেকে ঝুলবার জন্য তিনি দুই পায়ে স্পেশাল বুট পরেন, যা দিয়ে তার পা ছাদে আটকে থাকে। তারপর আবার লিখতে শুরু করেন। ‘দ্য ভিনচি কোড’ এবং আর সব বই এভাবেই লিখেছেন। ‘দেয়ার আর সো মেনি থিংগস ইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ হোরেশিও’।
হারুকি মুরাকামির (১৯৪৯)
গল্প অনেকটা ডান ব্রাউনের মতো।
তিনিও ভোর চারটায় ওঠেন। যখন কোনো বড় উপন্যাস লেখেন তখন এই ভোর চারটাতে ওঠা তার নিয়ম। পাঁচ-ছয় ঘণ্টা একটানা লেখেন। এরপর বিকেলে দশ কিলোমিটার দৌড়ান এবং অনেকক্ষণ সাঁতার কাটেন। এরপর ধ্যানমগ্ন হন। যাকে তিনি বলেন_ আমি নিজে নিজেকে সম্মোহিত করি এবং একেবারে অন্তরের গভীরে প্রবেশ করি। লেখার জন্য আমার এ আত্মমগ্নতা প্রয়োজন।
মায়া অ্যাঞ্জেলো (১৯২৪২০১৪)
সকালে ঘুম থেকে উঠে তার অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বাইরে চলে যান। যান একটি হোটেলের ছোট ঘরে। যান সকাল ৭টায়। ৭টা থেকে বেলা ২টো পর্যন্ত একটানা লেখেন। যাওয়ার সময় সঙ্গে নেন একটি বাইবেল, একটা প্যাকেট তাস (মাঝে মধ্যে পেশেন্স বা সলিটেয়ার খেলেন) আর এক বোতল শেরি। এই নেন তার লেখার সময়। এভাবেই তিনি মুঠো মুঠো লেখার জন্ম দেন। তার একটি বিখ্যাত কোটেশনের সঙ্গে আমি এক মত ‘সবচেয়ে যন্ত্রণাময় সময় সেটি, যখন ভেতরে একটা অজাত গল্প ছটফট করতে থাকে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত সেই গল্পকে লেখায় আকার দেওয়া না যায়।’
জেন অস্টেন (১৭৭৫১৮১৭)
একটি কাগজে নানা সব শব্দ লেখেন।
যা তার মনে আসে তাই। যেমন ডার্সি । বারবার লেখেন ডার্সি ডার্সি ডার্সি। একসময় ওই ডার্সি একটা মানুষের রূপ নেয় এবং সে হয়ে যায় ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিসের’ নায়ক। কেবল যে মানুষের নাম লেখেন তা নয়। লেখেন আরও নানা শব্দ। তারপর সেসব শব্দ থেকে তৈরি হয় বাক্য। এরপর হয়ে যায় বই।
আগাথা ক্রিস্টি (১৮৭৬১৯৭৬)
তার লেখার টেবিলের দুই পাশে বইয়ের দেয়াল করেন। একটি বইয়ের ওপরে আর একটি বই। এরপর লেখেন ওই দুই বইয়ের দেয়ালের মাঝখানে। কখনও স্নান করতে করতেও নোট দেন সেক্রেটারিকে। আবার খেতে খেতেও একই কাজ করেন।
শোনা যায়, আগাথা ক্রিস্টি তাঁর রহস্যকাহিনির প্লট সাজাতেন বাথটাবে শুয়ে আপেল খেতে খেতে।
চার্লস ডিকেন্স (১৮১২১৯৭৬) প্রতিদিন দশ মাইল হাঁটতেন। হাঁটতে গিয়ে ইচ্ছা করেই হারিয়ে যেতেন। যখন হারিয়ে যান তখন নাকি তার লেখার ‘স্পার্ক’ চলে আসত। এরপর বাড়িতে ফিরে আসতেন। লিখতে বসে যেতেন। অসংখ্য বই তিনি এই ‘স্পার্ক’ থেকে সৃষ্টি করেছেন। আবার লিখতে লিখতে কখনও সে লেখা নিজের কানকে শোনাতেন। নিজের কাছে ভালো না লাগলে ছিঁড়ে ফেলতেন। তারপর আবার লিখতে বসতেন।
কবি ওয়ার্ডস ওয়ার্থ (১৭৭০১৮৫০) একটা কুকুর নিয়ে হাঁটতে বেরোন। জোরে জোরে আবৃত্তি করেন তার কবিতাগুলো। যখন কুকুর চুপ করে সে কবিতা শোনে তিনি বুঝতে পারেন, তার কবিতা ঠিক হয়েছে। যখন কুকুর খুব ঘেউ ঘেউ করে তিনি বুঝতে পারেন, কবিতা কুকুরের পছন্দ হয়নি। বাড়িতে এসে সেই কবিতাকে বদলান। আবার নতুন করে লেখেন।
ট্রুম্যান ক্যাপোটির কুসংস্কার ছিল। তিনি শুক্রবার কোনো লেখা শুরু বা শেষ করতেন না। কোন ধারাবাহিক লেখার মধ্যবর্তী অংশ লিখতেন।
জন স্টেইনবেক (১৯০২১৯৬৮) সব লেখা লেখেন পেন্সিলে। ‘গ্রেপস অফ রথ’ নামের বিখ্যাত উপন্যাসটি লিখতে তার ক্ষয় হয়েছিল প্রায় তিনশোটি মোটাসোটা বড় পেন্সিল। তার ‘ইস্ট অফ ইডেন’ লিখতেও ক্ষয় হয়েছিল ওই পরিমাণ পেন্সিল।
ব্রন্টি বোনেরাশার্লোট, এমিলি ও অ্যান (১৮১৬১৮৫৫, ১৮১৮১৮৪৮, ১৮২০১৮৪৯)_
একটা বড় ফায়ার প্লেসের সামনে বসে তিন বোন একটা টেবিলে লিখতেন। শার্লোটের চারখানা, এমিলির একটি বড় উপন্যাস, অ্যানের তিনখানা উপন্যাস সেই টেবিলে বসে লেখা।
শিশুসাহিত্যিক এনিড ব্লাইটন (১৮৯৭১৯৬৭) সকালে লিখতে বসেন, সঙ্গে থাকে তার লাল রঙের একখানা মরোক্কান শাল। এই রঙ নাকি তাকে লেখায় উদ্দীপ্ত করে। একটা টাইপরাইটারে লিখে যান একটানা। দুপুরে খেয়ে আবার লেখেন। দিনে তিনি ছয় হাজার শব্দ লিখতে পারতেন। একবার কেউ কেউ বলেছিল, তার নাকি কিছু ‘ঘোস্ট রাইটার’ ( ভূত লেখক) আছে,
যারা তাকে লিখে দেন। তিনি এই সব নিন্দুকদের নামে কেস করেন এবং জিতে যান।