Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কাঁকড়াবিছে || Narayan Gangopadhyay

কাঁকড়াবিছে || Narayan Gangopadhyay

চাটুজ্জেদের রকে আমি, টেনিদা আর হাবুল সেন বসে মোড়ের বুড়ো হিন্দুস্থানীর কাছ থেকে কিনে-আনা তিনটে ভুট্টাপোড়া খুব তরিবত করে খাচ্ছিলুম। হঠাৎ কোত্থেকে লাফাতে লাফাতে ক্যাবলা এসে হাজির।

–ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস। মেরেছি একটাকে।

কচরকচর করে ভুট্টার দানা চিবুতে চিবুতে টেনিদা বললে, হঠাৎ এত লম্ফঝম্ফ যে? কী মেরেছিস? মাছি, না ছারপোকা?

একটা মস্ত কাঁকড়াবিছে। দেওয়ালের ফুটো থেকে বেরিয়ে দিব্যি ল্যাজ তুলে আমাদের ছেদিলালকে কামড়াতে যাচ্ছিল। ছেদিলাল আপন মনে গান গাইতে গাইতে গোরু দোয়াচ্ছে, কিচ্ছু টের পায়নি। আমি দেখেই একটা ইট তুলে ঝাঁ করে মেরে দিলুম-ব্যস-ঠাণ্ডা।

টেনিদা মুখটাকে কুচোচিংড়ির মত সরু আর বিচ্ছিরি করে বললে, ফুঃ।

ফুঃ মানে? ক্যাবলা চটে গেল; কাঁকড়াবিছের সঙ্গে চালাকি নাকি? একবার কামড়ালেই বুঝতে পারবে।

কাঁকড়াবিছের সঙ্গে চালাকি কে করতে যাচ্ছে? কিন্তু কলকাতায় কাঁকড়াবিছে? রাম রাম! ওরা তো ডেয়ো পিঁপড়ের বড়দা ছাড়া কিছু নয়। আসল কাঁকড়াবিছের কথা জানতে চাস তো আমার পচামামার গল্প শুনতে হবে।

গল্পের আরম্ভে ক্যাবলা তড়াক করে রকে উঠে বসল।

হাবুল বললে, পচামামা? এই নামটা এইবারে য্যান নূতন শুনত্যা আছি।

কাল শুনবি আরও, এখুনি হয়েছে কী!–ভুট্টার দানাগুলো শেষ করে টেনিদা এবার সবটা বেশ করে চেটে নিলে : আর যত শুনবি ততই চমকে যাবি।

আমি একবার মাথাটা চুলকে নিয়ে বললুম, একটা কথা জিজ্ঞেস করব টেনিদা?

ভুট্টার গোঁজটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে টেনিদা মোটা গলায় বললে, ইয়েস, পারমিশন দিচ্ছি।

–তোমার কটি মামা আছে সবসুদ্ধ?

টেনিদা বললে, ফাইভ ফিফটিফাইভ। মানে পাঁচশো পঞ্চান্ন জন।

আমি কাকের মতো হাঁ করে বসে রইলুম, ক্যাবলা একটা খাবি খেল, আর হাবুল সেন ডুকরে উঠল : খাইছে!

ইউ শাট আপ হাবলা, চিল্লাসনি। মামা কী রকম জানিস? ঠিক রেকারিং ডেসিমেলের মতো-মানে, শেষ নেই। মনে কর মার পিসতুতো ভাইয়ের বড় শালার মেজ ভায়রা-তাকে কী বলে ডাকব?

আমরা একবাক্যে বললুম, মামা।

কিংবা মনে কর, আমার কাকিমার মাসতুতো বোনের খুড়তুতো ভাইয়ের

ক্যাবলা বললে, থাক, আর বলতে হবে না। মানে, মামা। বিশ্বময় মামা।

রাইট। পচামামা সেই বিশ্বময় মামার একজন।

আমি অধৈর্য হয়ে বললাম, সে তো হল। কিন্তু কাঁকড়াবিছে

টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, দাঁড়া না ঘোড়াড্ডিম। আগে সব জিনিসটা ক্লিয়ার করে নিতে হবে না? কুরুবকের মতো বেশি বকবক করবি তো তোর কানের ওপর এখুনি একটা কাঁকড়াবিছে ছেড়ে দেব।

হাবুল বললে, ছাইড়া দাও–প্যালার কথা ছাইড়া দাও! ওইটা একটা দুগ্ধপোইষ্য শিশু।

কী আমার ঠাকুর্দা এলেন রে–আমি হাবুলকে ভেংচি কাটলুম।

টেনিদা আমার মাথায় টাং করে একটা টোকা মেরে বললে, ইউ স্টপ! নাউ নো ঝগড়া। তাহলে দুই থাপ্পড় দিয়ে দুটোকেই তাড়িয়ে দেব এখান থেকে। এখন পচামামার গল্প শুনে যা। খবরদার, ডিসটার্ব করবিনে।

আমরা একবাক্যে বললুম, না–না।

–পচামামা, বুঝলি–একটা গলাখাঁকারি দিয়ে টেনিদা শুরু করলে : স্কুলে সাতবার ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ফেল করেছিল। আটবারের বার টেস্টেও যখন অ্যালাও হতে পারল না, তখন দাদু-মানে পচামামার বাবা তাকে পেল্লায় একটা চড় মেরে বলল, নিকালে আমার বাড়ি থেকে হতভাগা মুখ, কুপুত্তুর, বোম্বেটে, অকালকুষ্মাণ্ড কোথাকার।

একসঙ্গে চার-চারটে ওইরকম জবরদস্ত গাল, আর গালের ওপর অমনি একখানা, কী বলে–জাড্যাপহ চাঁটি–

আমি জিজ্ঞাসা করলুম : জাড্যাপহ মানে কী?

–আমি কোত্থেকে জানব? শুনতে বেশ জাঁদরেল লাগে, তাই বললুম।

ক্যাবলা বলতে গেল : জাড্যাপহ, অর্থাৎ কিনা, যা জড়তা অপহরণ

-চুপ কর ক্যাবল-টেনিদা খেঁকিয়ে উঠল : তুই আর পণ্ডিতের মতো টিকটিক করিসনি! ফের যদি বিদ্যে ফলাবি–আমি আর গল্প বলবই না। মুখে বল্টু এঁটে বসে থাকব।

আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, না–না, আমরা আর কথা বলব না। গল্পটাই চলুক।

টেনিদা আবার শুরু করল : সেই জাড্যাপহ চাঁটি খেয়ে পচামামার মন উদাস হল। ম্যাট্রিক পরীক্ষার নিকুচি করেছে–এমন অপমান সহ্য করা যায়। পচামামা সেই রাতেই দেশান্তরী হল।

মানে বিদেশে আর যাবে কোথায়, তখনও পাকিস্তান হয়নি-সোজা দার্জিলিং মেলে উঠে পড়ল। নামল গিয়ে শিলিগুড়িতে। সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে পাহাড় জঙ্গল ভেঙে, বাঙলা দেশের চৌহদ্দি পেরিয়ে একেবারে চলে গেল ভুটানে।

ইচ্ছে ছিল তিব্বতে গিয়ে অতীশ দীপঙ্কর-টর হবে, কিন্তু একে বেজায় শীত, তায় ভুটান তখন লালে লাল।

লালে লাল?-ক্যাবলা জিজ্ঞেস করলে; ভূটানীরা খুব দোল খেলে বুঝি?

–তোর মুণ্ডু! লেবু–লেবু, কমলালেবু। ভূটানী কমলা বিখ্যাত, জানিস তো? আর পাহাড় আলো করে সব বাগান, তাতে হাজারে হাজারে ফল পেকে টুক-টুক করছে ঝরে পড়ছে গাছতলায়। যত খুশি কুড়িয়ে খাও, কেউ কিচ্ছুটি বলবে না। এমনকি এদিক-ওদিক তাকিয়ে দুটো-চারটে ছিঁড়ে নিতে পারো–কে আর অত লক্ষ করতে যাচ্ছে!

মোদ্দা, ওই কমলালেবুর টানেই পচামামা ভূটানে আটকে গেল। যেখানে-সেখানে পড়ে থাকে আর পেটভরতি লেবু খায়। দেখতে দেখতে পচামামার ছিবড়ে বাদুড়চোষা চেহারাই পালটে গেল একদম। দাদু কিপটে লোক, তাঁর বাড়িতে পুঁইডাঁটা চচ্চড়ি, কড়াইয়ের ডাল আর খলসে মাছের ঝাল খেয়ে পচামামার বুদ্ধিটুদ্ধিগুলোতে মরচে পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু কমলালেবুর রসে হঠাৎ সেগুলো চাঙা হয়ে উঠল।

ওদিকে সবচাইতে বড় বাগানের মালিক হল পেম্বাদোরজী শিরিং। নামটা, কী বলে-একটু ইয়ে হলেও লোকটি বেশ ভালোমানুষ। গোলগাল চেহারা, গায়ে ওদের সেই কালো আলখাল্লা, মাথায় কাঁচাপাকা চুলের লম্বা বিনুনি। মুখে পাঁচ-সাত গাছা দাড়ি, সব সময় মিঠে-মিঠে হাসি, আর রাতদিন চমরী গাইয়ের জমাট দুধের টুকরো চুষছে। পচামামা তাকে গিয়ে মস্ত একটা সেলাম ঠুকে বললে, শিরিং সাহেব, আমি একজন বিদেশী।

শিরিং হেসে বললে, সে জানি। আজ পনেরো দিন ধরে তুমি আমার বাগানের লেবু খেয়ে আধাসাট করছ। কিন্তু আমরা অতিথিবৎসল বলে তোমায় কিছু বলিনি। ভুটিয়া হলে আমার এই কুকরি দিয়ে মুণ্ডটি কচাৎ করে কেটে নিতুম।

শুনে পচামামার রক্ত জল হয়ে গেল। বললে, সাহেব, আমি খুব হাংগ্রি বলেই

শিরিং চমরী গাইয়ের দুধের টুকরো মুখে পুরে বললে, ঠিক আছে, আমি কিছু মাইণ্ড করিনি। ওই তো তোমার বাঙালীর পেট, কীই বা তুমি খেতে পারো। এখন বলল, কী চাও?

–শিরিং সাহেব–পচামামা হাত কচলাতে কচলাতে বললে, শুধু কমলালেবু চালান দিয়ে কীই বা লাভ হয় আপনার?

কম কী? লাখ খানেক।

আজ্ঞে, এই লাখ টাকা যদি পাঁচ লাখ হয়?

শুনে শিরিং সাহেব নড়ে বসল : তা কী করে হতে পারে?

–আপনি অরেঞ্জ স্কোয়াশ, অর্থাৎ বোতল-ভরতি করে কমলালেবুর রস বিক্রি করুন। তাতে লাভ অনেক বেশি হবে।

শিরিং হাসল : এ আর নতুন কথা কী? এই তো মাইল-পাঁচেক দূরে ডিক্রুজ বলে এক সায়েব একটা কারখানা করেছে। সে তো জুত করতে পারছে না। বাজারে দারুণ কম্পিটিশন-কলকাতা ও বোম্বাইতে অনেক বড় কোম্পানি, আমরা সুবিধে করতে পারব কেন?

পচামামা আবার একটা লম্বা সেলাম ঠুকল : যদি এমন অরেঞ্জ স্কোয়াশ তৈরি করতে পারি যা স্বাদে গন্ধে, যাকে বলে অতুলনীয়? মানে যা খেলে লোকে আর ভুলতে পারে না, একবার খেলে বারবার খেতে চায়?

–সে জিনিস তৈরি করবে কে? তুমি?

–চেষ্টা করে দেখতে পারি।

–তুমি কি কেমিস্ট?

–আমি এম. এস-সি।

পচামামা চাল মারল, বুঝতেই পারছিস। কিন্তু বিদেশ-বিভুয়ে এক-আধটু ওসব করতেই হয়, নইলে কাজ চলে না। পচামামা ভাবল, হুঁ-হুঁ–বাঙালীর ব্রেন–একটা কিছু করে ফেলবই।

শিরিং খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে কী ভাবল। তারপর বললে, বেশ, চেষ্টা করে দেখো।

–কিন্তু দিন পনেরো সময় দিতে হবে।

–পনেরো দিন কেন?–শিরিং উৎসাহ দিয়ে বললে, এক মাস সময় দিচ্ছি। তুমি আমার আউট-হাউসে থাকো। এক্সপেরিমেন্টের জন্যে যা যা চাও সব দেব। যদি সাকসেসফুল হতে পারো, তোমাকে কারখানার চিফ কেমিস্ট করে দেব, আর মাসে দুহাজার টাকা করে মাইনে।

পচামামা এসে শিরিং সাহেবের আউট-হাউসে উঠল। সে কী রাজকীয় আয়োজন। এমন গদি-আঁটা বিছানায় পচামামাদের কেউ সাত জন্মে শোয়নি। দুবেলা এমন ভালো-ভালো খাবার খেতে লাগল যে তিন দিন পরে একবার করে পেটের অসুখে ভুগতে লাগল। আর সেইসঙ্গে চলল তার এক্সপেরিমেন্ট।

কখনও কমলালেবুর রসে আদা মেশাচ্ছে, কখনও মধু, কখনও চায়ের লিকার, কখনও ঝোলা গুড়, কখনও বা এক-আধ শিশি হোমিওপ্যাথিক ওষুধই ঢেলে দিচ্ছে–মানে, প্রাণে যা চায়। আর খেয়ে-খেয়ে দেখছে। কোনওদিন বা এক চামচে খেয়েই বমি করে ফেলল, কোনওদিন মুখে দিতে না দিতেই তিড়িং-তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল, কোনওদিন নেহাত মন্দ লাগল না, আর কোনওদিন মুখ এমন টকে গেল যে, ঝাড়া আটচল্লিশ ঘন্টা কিছু আর দাঁতে কাটতে পারে না।

এদিকে এক মাস যায়-যায়। শিরিং সাহেব মাঝে মাঝে খবর নেয়, কদ্দূর হল। পচামামা বুঝতে পারল, এবারে পরস্মৈপদী রাজভোগ আর বেশিদিন চলবে না। এক মাসের ভেতর কিছু করতে না পারলে এই খাওয়ার সুখ সুদে-আসলে আদায় করে নেবে; পিটিয়ে তক্তা তো করে দেবেই, চাই কি কচাং করে মুণ্ডটিও কেটে নিতে পারে।

পচামামা রাত জেগে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে, আর এক্সপেরিমেন্ট চালায়। তারপর একদিন মধু, আদা, হোমিওপ্যাথিক ওষুধ আর পিঁপড়ের ডিম মিশিয়ে যেই এক্সপেরিমেন্ট করেছে।

ওঃ, কী বলব তোদের, কী তার স্বাদ, কী সুতার। এক-চামচে খেয়ে মনে হল যেন পোলাও, পায়েস, ছানার ডালনা, আলুকাবলি, বেলের মোর, দরবেশ, রাবড়ি-মানে যত ভালো-ভালো খাবার জিনিস রয়েছে, সব যেন কে একসঙ্গে তার মুখে পুরে দিলে। এমন অপূর্ব, এমন আশচর্য অরেজ্ঞ স্কোয়াশ পৃথিবীতে কেউ কখনও খায়নি।

–পচামামা তখনই গিয়ে শিরিং সাহেবকে সেলাম ঠুকল। বললে, আমি রেডি।–

-এক্সপেরিমেন্ট সাকসেসফুল?

শিরিং সাহেব খুশি হয়ে বললে, বেশ, তা হলে কালকে আমি ও আমার স্ত্রী, আমার ছেলে, আমার ম্যানেজার, আর আমার তিনজন বন্ধু আমরা তোমার অরেঞ্জ স্কোয়াশ খেয়ে দেখব। যদি ভালো লাগে, কালই কলকাতায় মেশিনের অর্ডার দেব, আর তুমি হবে আমার কারখানার চিফ কেমিস্ট, মাসে দুহাজার টাকা মাইনে।

কেল্লা ফতে। পচামামা নাচতে নাচতে চলে এল। সারা রাত ধরে স্বপ্ন দেখল, সে একটা মস্ত মোটরগাড়ি চেপে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে আর দুধারের লোক তাকে সেলাম ঠুকছে।

কিন্তু বরাত কি আর অত সহজেই খোলে রে? তাহলে কি আর আজ পচামামাকে লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে গাঁয়ে মুদিখানার দোকান করতে হয়? না–পেঁয়াজ আর মুসুরির ডালের ওজন নিয়ে খদ্দেরের সঙ্গে ঝগড়া করতে হয়?

যা হল, তা বলি।

পচামামা বুঝতে পেরেছিল, নিশ্চয় পিঁপড়ের ডিমের গুণেই তার তৈরি অরেঞ্জ স্কোয়াশ তখন স্বর্গের সুধা হয়ে উঠেছে। প্রাণ খুলে সে আট বোতল সুধা তৈরি করল তারপর নিশ্চিন্তে ঘুমুতে গেল। আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কী সুখের স্বপ্ন যে দেখল সে তো আগেই বলেছি।

পরের দিন শিরিং সাহেব তো দলবল নিয়ে পচামামার এক্সপেরিমেন্ট চাখতে বসেছে। সবটা মিলে বেশ একটা চমৎকার মোচ্ছবের আবহাওয়া। মস্ত টেবিলে দামী টেবিল ক্লথ পেতে দেওয়া হয়েছে, ফুলদানিতে ফুল সাজানো হয়েছে, গ্রামোফোনে নাচের রেকর্ড বাজছে, আর সাতজনের সামনে সাতটি রুপোর গ্লাস চকচক করছে।

পচামাম আহ্লাদে-আহ্লাদে মুখ করে গেলাসে তার এক্সপেরিমেন্ট ঢেলে দিলে। প্রথমে শিরিং সাহেব একটা চুমুক দিল, তারপরেই আর সবাই। তোদের বলব কী তক্ষুনি যেন বিপর্যয় ব্যাপার ঘটে গেল। প্রথমেই আঁক করে শিরিং সাহেব চেয়ারসুদ্ধ উলটে পড়ে গেল, শিরিং সাহেবের গিন্নি টেবিলে বমি করে ফেলল, তাদের ছেলে আই করে একটা আওয়াজ তুলে সেই-যে ঘর থেকে দৌড় লাগাল–পাক্কা তিন মাইল গিয়ে তারপরে বোধহয় সে থামল। ম্যানেজার হাত-পা ছুঁড়ে পাগলের মতো নাচতে লাগল–একজন অতিথি আর-একজনকে জড়িয়ে ধরে ঘরের মেঝেয় কুস্তি লড়তে লাগল, আর তিন নম্বর অতিথি হঠাৎ তেড়ে গিয়ে শিরিং সাহেবের কুকুরটার ল্যাজে ঘ্যাঁক করে কামড়ে দিলে!

পচামামা বুঝতে পারল, গতিক সুবিধের নয়। তার সুধা যেমনই হোক–খেয়ে এদের আরাম লাগেনি। আর মনে পড়ল, শিরিং সাহেবের কুকরিটাও নেহাত চালাকি নয়। কাজেই

থাকিতে চরণ, মরণে কি ভয়, নিমেষে যোজন ফরসা পচামামা দে-দৌড়। সারাদিন দৌড়ল, তারপর সন্ধেবেলা এক গভীর বনের ভেতর একটা ভাঙা মন্দিরে বসে হাঁপাতে লাগল। ভাবল, খুব বেঁচে গেছি এ-যাত্রা।

ওদিকে ঘণ্টাতিনেক বাদে মাথা-ফাথা একটু ঠাণ্ডা হলে শিরিং সাহেব হাঁক ছাড়ল : কোথায় সেই জোচ্চোর কেমিস্ট? বিষ খাইয়ে আমাদের মেরে ফেলবার জোগাড় করেছিল। শিগগির তার কান ধরে টেনে নিয়ে আয় এখানে, আমি নিজের হাতে তার মুণ্ডু কাটব।

তক্ষুনি লোক ছুটল চারদিকে।

ওদিকে পচামামা মন্দিরে বসে ভাবতে লাগল, ব্যাপারটা কী হল। সে নিজে বারবার তার আবিষ্কার চোখে দেখেছে, কী তার সোয়াদ-কী তার গন্ধ! রাতারাতি অমন করে সব বদলে গেল কী করে?

হয়েছিল কী, জানিস? পচামামার বাবুর্চিটা ছিল ভীষণ লোভী। সে এক ফাঁকে একটা বোতল থেকে একটু খেয়ে এমন মজে গেছে যে চুপি-চুপি আটটা বোতলই সাফ করে ফেলেছে। তারপরেই তার খেয়াল হয়েছে, সকালে তো শিরিং সাহেব তার গর্দান নেবে। তখন করেছে কী, পচামামার এক্সপেরিমেন্ট টেবিলে যা ছিল–মানে লেবুর রস, চাল-ধোয়া জল, টিংচার আইডিন, এক শিশি লাল কালি, খানিক ঝোলা গুড় আর বেশ কিছু গঁদের আঠা ঢেলে আটটি বোতল আবার তৈরি করে রেখেছে। আর তাই খেয়েই

পচামামা আর কিছু বুঝতে পারছে না। সামনে সেই ভাঙা মন্দিরটার ভেতরে বসে মশার কামড় খাচ্ছে, ভয়ে আর শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে। ভাবছে, রাত্তিরটা কোনওমতে কাটলে হয়, তারপর আবার এক দৌড়, মাইল-দশেক পেরুতে পারলেই ভূটান বর্ডার ছাড়িয়ে লঙ্কাপাড়া চা বাগান–তখন আর তাকে কে পায়।

পচামামা যেখানে বসে আছে তার দু পাশে ভাঙা মেঝেতে বিস্তর ফুটোফাটা। সেই ফুটো দিয়ে ধীরে ধীরে কয়েকটি প্রাণী মুখ বের করল। কালো কটকটে তাদের রঙ, লম্বা লম্বা ল্যাজের আগা বঁড়শির মতো বাঁকানো চোখে সন্ধানী দৃষ্টি। শীতের দিন, ভালো খাওয়া-দাওয়া জোটে না–পেটে বেশ খিদে ছিল তাদের। ওদিকে পচামামার কোটের পকেট থেকে কেক, ডিমভাজা–এসবের বেশ মনোরম গন্ধ বেরুচ্ছে। পালাবার সময় পচামামা টেবিল থেকে যা পেয়েছে দু-পকেটে বোঝাই করে নিয়েছিল বুঝেছিল পরে এসব কাজে লাগবে।

সুড়সুড় করে দু-দিকের পকেটে তারা একে একে ঢুকে পড়ল। খাবারের ধ্বংসাবশেষ কিছু ছিল, তাই খেতে লাগল একমনে। পচামামা উদাস হয়ে বসে ছিল, এসব ব্যাপার কিছুই সে টের পেল না।

হঠাৎ তার মুখের ওপর টর্চের আলো। আর সঙ্গে সঙ্গে ভুটিয়া ভাষায় কে যেন বললে, এই যে, পাওয়া গেছে!

আর-একজন বললে, এবার কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে চল। সকালে শিরিং সাহেব ওর মুণ্ডু কাটবে।

পচামামার রক্ত জল হয়ে গেল! সামনে দৈত্যের মতো জোয়ান দুই ভুটিয়া। কোমরে চকচকে কুকরির খাপ। অন্ধকারেও পচামামা দেখল, তার মুখের ওপর টর্চ ফেলে ঝকঝকে দাঁতে হাসতে হাসতে তারা তারই দিকে এগিয়ে আসছে।

পচামামা দাঁড়িয়ে পড়ল। পালাবার পথ বন্ধ। তবু মরিয়া হয়ে ভাঙা গলায় পেঁচিয়ে উঠল : সাবধান–এগিয়ো না, আমার দুই পকেটেই রিভলভার আছে।

-হাঃ–হাঃ–রিভলভার।–দুই মূর্তি ঝাঁপিয়ে পড়ল পচামামার ওপর। পচামামা কিছু বলবার আগেই দুজনের দুটো হাত তাকে জাপটে ধরল, আর দুটো বাঁ-হাত তার দু-পকেটে রিভলভার খুঁজতে লাগল। আর তক্ষুনি দুই জোয়ানের গগনভেদী আর্তনাদ! পচামামাকে ছেড়ে দিয়ে তারা সোজা মেঝের ওপর গড়াতে লাগল : ওরে বাপরে, মেরে ফেলেছে রে–গেলুম–গেলুম। ঠিক তখন বনের ভেতর দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদের আলো পড়ল, সেই আলোয় পচামামা দেখল, দুজনের হাতেই এক এক জোড়া করে কালো কদাকার পাহাড়ি কাঁকড়াবিছে লটকে আছে, আর তার নিজের পকেটের ভেতরে সমানে আওয়াজ উঠছে খড়র, খড়র।

–উরিঃ দাদা। পচামামা একটানা গায়ের কোটটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর ওদের পড়ে-থাকা টর্চটা কুড়িয়ে নিয়ে দৌড়দৌড় রাম দৌড়। সকালের জন্যেও অপেক্ষা করতে হল না, একটা চিতাবাঘের পিঠের ওপর হাই জাম্প দিয়ে, একটা পাইথনের ল্যাজ মাড়িয়ে, ডজন পাঁচেক শেয়ালকে আঁতকে দিয়ে রাত নটার সময় যখন লঙ্কাপাড়া চা বাগানে এসে আছাড় খেয়ে পড়ল, তখন তার মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠছে। বুঝলি ক্যাবলা, এই হল আসল পাহাড়ি কাঁকড়াবিছের গল্প। দুটো অমন বাঘা জোয়ানকে ধাঁ করে শুইয়ে দিলে। তোর কলকাতার কাঁকড়াবিছে ওদের কিছু করতে পারত? রামোরামো! টেনিদা থামল।

ক্যাবলা মাথা চুলকোতে লাগল। হাবুল বললে, একটা কথা জিগাইমু টেনিদা?

টেনিদা হাবুলের কথা নকল করে বললে, হ, জিগাও।

কাঁকড়াবিছায় কেক-বিস্কুট-ডিমভাজা খায়?

–এ তো আর তোর কলকাত্তিয়া নয়, পাহাড়ি কাঁকড়াবিছে। ওদের মেজাজই আলাদা। আমার কথা বিশ্বাস না হয় পচামামাকে জিজ্ঞেস কর।

–তেনারে পামু কই?

টেনিদা বললে, ধ্যাধ্যেড়ে কালীকেষ্টপুরে।

আমি জানতে চাইলুম : সে কোথায়?

টেনিদা বললে, খুব সোজা রাস্তা। প্রথমে আমতা চলে যাবি। সেখান থেকে দশ মাইল দামোদরে সাঁতার কাটবি। তারপর ডাঙায় উঠে চল্লিশ মাইল পঁচাত্তর গজ সাড়ে এগারো ইঞ্চি হাঁটলেই ধ্যাধ্যেড়ে কালীকেষ্টপুরে পৌঁছে যাবি। আচ্ছা তোরা তা হলে সেখানে রওনা হয়ে যা, আমি এখন একবার পিসিমার বাড়িতে চললুম। টা টা–

বলেই হাত নেড়ে লাফিয়ে পড়ল রক থেকে, ধাঁ করে হাওয়া হয়ে গেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress