টেলিফোন তুলে নিয়ে ব্যোমকেশ বলল
টেলিফোন তুলে নিয়ে ব্যোমকেশ বলল–’হ্যালো?
ইন্সপেক্টর রাখালবাবুর গলা শোনা গেল— ‘ব্যোমকেশদা, আমি রাখাল। নেতাজী হাসপাতাল থেকে কথা বলছি। একবার আসবেন?’
‘কি ব্যাপার?’
‘খুনের চেষ্টা। একটা লোককে কেউ গুলি করে মারবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু মারতে পারেনি। আহত লোকটাকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। সে এক বিচিত্র গল্প বলছে।’
‘তাই নাকি? আচ্ছা, আমি যাচ্ছি।’
কেয়াতলায় ব্যোমকেশের বাড়ি থেকে নেতাজী হাসপাতাল বেশি দূর নয়। আধা ঘণ্টা পরে বিকেল আন্দাজ পাঁচটার সময় ব্যোমকেশ সেখানে পৌঁছে দেখল, এমার্জেন্সি ওয়ার্ডের সামনে দারোগা রাখাল সরকার দাঁড়িয়ে আছেন।
এইখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই তিনি আরো কিছু তথ্য উদঘাটন করলেন। আহত লোকটির নাম গঙ্গাপদ চৌধুরী, ভদ্রশ্রেণীর লোক। ফ্রেজার রোড থেকে একটা ছোট রাস্তা বেরিয়েছে, সেই রাস্তায় একটা বাড়ির দোতলার ঘরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল। বাড়ির ঠিকে চাকর বেলা তিনটের সময় কাজ করতে এসে গঙ্গাপদকে আবিষ্কার করে। তারপর হাসপাতাল পুলিস ইত্যাদি। গঙ্গাপদর জ্ঞান হয়েছে, কিন্তু প্রচুর রক্তপাতের ফলে এখনো ভারি দুর্বল।
গঙ্গাপদ আজ বিকেলবেলা তার দোতলার ঘরে রাস্তার দিকে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎ সামনের দিক থেকে বন্দুকের গুলি এসে তার চুলের মধ্যে দিয়ে লাঙল চষে চলে যায়। খুলির ওপর গভীর টানা দাগ পড়েছে, কিন্তু গুলি খুলি ফুটো করে ভিতরে ঢুকতে পারেনি, হাড়ের ওপর দিয়ে পিছলে বেরিয়ে গেছে।
বন্দুকের গুলিটা ঘরের মধ্যেই পাওয়া গিয়েছে, দেখে মনে হলো পিস্তল কিংবা রিভলবারের গুলি। পরীক্ষার জন্যে পাঠিয়েছে।
এবার চলুন গঙ্গাপদর বয়ান শুনবেন। তাকে খানিকটা রক্ত দেওয়া হয়েছে, এতক্ষণে সে বোধ হয় বেশ চনমনে হয়েছে।
গঙ্গাপদ চৌধুরী একটি ছোট ঘরে সঙ্কীর্ণ লোহার খাটের ওপর শুয়ে ছিল। মাথার ওপর পাগড়ির মত ব্যান্ডেজ, তার নীচে শীর্ণ লম্বাটে ধরনের একটি মুখ। মুখের রঙ বোধ করি রক্তপাতের ফলে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বয়স আন্দাজ পঁয়ত্ৰিশ। ভাবভঙ্গীতে ভালমানুষীর ছাপ।
ব্যোমকেশ ও রাখালবাবু খাটের দু’পাশে চেয়ার টেনে বসলেন। গঙ্গাপদ একবার এর দিকে একবার ওর দিকে তাকাল; তার পাংশু অধরে একটুখানি ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল। লোকটি মৃত্যুর সিংদরজা থেকে ফিরে এসেছে, কিন্তু তার মুখে চোখে ত্ৰাসের কোনো চিহ্ন নেই।
রাখালবাবু বললেন–‘এঁর নাম ব্যোমকেশ বক্সী। ইনি আপনার গল্প শুনতে এসেছেন।’
গঙ্গাপদর চক্ষু হষোৎফুল্ল হয়ে উঠল, সে ধড়মড় করে উঠে বসবার চেষ্টা করলে ব্যোমকেশ তার বুকে হাত রেখে আবার শুইয়ে দিল, বলল—’উঠবেন না, শুয়ে থাকুন।’
গঙ্গাপদ বুকের ওপর দু’হাত জোড় করে সংহত সুরে বলল–’আপনি সত্যান্বেষী ব্যোমকেশবাবু! কী সৌভাগ্য। আমার কলকাতা আসা সার্থক হলো।’
রাখালবাবু বললেন–‘আপনি যদি শরীরে যথেষ্ট বল পেয়ে থাকেন তাহলে ব্যোমকেশবাবুকে আপনার গল্প শোনান। আর যদি এখনো দুর্বল মনে হয় তাহলে থাক, আমরা পরে আবার আসব।’
গঙ্গাপদ বলল— ‘না না, আমার আর কোনো দুর্বলতা নেই। খুব খানিকটা রক্ত নাড়ির মধ্যে ঠুসে দিয়েছে কিনা।’ বলে হেসে উঠল।
‘তাহলে বলুন।’
খাটের পাশে টিপাইয়ের ওপর এক গ্লাস জল রাখা ছিল, গঙ্গাপদ বালিশের ওপর উচু হয়ে শুয়ে এক চুমুক জল খেলো, তারপর হাসি-হাসি মুখে গল্প বলতে আরম্ভ করল :
আমার নাম কিন্তু গঙ্গাপদ চৌধুরী নয়, অশোক মাইতি। কলকাতায় এসে আমি কেমন করে গঙ্গাপদ চৌধুরী বনে গেলাম সে ভারি মজার গল্প। বলি শুনুন।
আমার বাড়ি মীরাটে। সিপাহী যুদ্ধেরও আগে আমার পূর্বপুরুষ মীরাটে গিয়ে বাসা বেঁধেছিলেন। সেই থেকে আমরা মীরাটের বাসিন্দা, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক খুব বেশি নেই।
আমি মীরাটে সামান্য চাকরি করি। বাড়িতে বিধবা মা আছেন; আর একটি আইবুড়ো বোন। আমি বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু বছর পাঁচেক আগে বিপত্নীক হয়েছি। আর বিয়ে করিনি। বোনটাকে পাত্রস্থ না করা পর্যন্ত
কিন্তু সে যাক। অফিসে এক মাস ছুটি পাওনা হয়েছিল, ভাবলাম কলকাতা বেড়িয়ে আসি। কলকাতায় আমার আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কেউ নেই; আমি ছেলেবেলায় একবার কলকাতায় এসেছিলাম, তারপর আর আসিনি। ভাবলাম স্বদেশ দেখাও হবে, আর সেই সঙ্গে বোনটার জন্যে যদি একটি পাত্র পাই—
হাওড়ায় এসে নোমলাম। মীরাট থেকে এক হিন্দুস্থানী ধর্মশালার ঠিকানা এনেছিলাম, ঠিক ছিল সেখানেই উঠিব। ট্রেন থেকে নেমে ফটকের দিকে চলেছি, দেখি একটা দাড়িওয়ালা লোক আমার পাশে পাশে চলেছে, আর ঘাড় ফিরিয়ে ফিরিয়ে আমার পানে তাকাচ্ছে। একবার মনে হলো কিছু বলবে, কিন্তু মুখ খুলে কিছু না বলে আবার মুখ বন্ধ করল। আমি ভাবলাম, এ আবার কে? হয়তো হোটেলের দালাল।
ধৰ্মশালায় পৌঁছে কিন্তু মুশকিলে পড়ে গেলাম। সেখানে একটি কুঠুরিও খালি নেই, সব ভর্তি, এখন হোটেলে যেতে হয়; কিন্তু হোটেলে অনেক খরচ, অতি খরচ আমার পোষাবে না। কি করব ভাবছি, এমন সময় সেই দাড়িওয়ালা লোকটি এসে উপস্থিত। চোখে নীল চশমা। লাগিয়েছে। বলল–’জায়গা পেলেন না?’
বললাম-‘না। আপনি কে?’
সে বলল–’আমার নাম গঙ্গাপদ চৌধুরী। আপনি কোথা থেকে আসছেন?’
বললাম— ‘মীরাট থেকে। আমার নাম অশোক মাইতি। আপনি কি হোটেলের এজেন্ট?’
সে বলল— ‘না। হাওড়া স্টেশনে আপনাকে দেখেছিলাম, দেখেই চমক লেগেছিল। কেন চমক লেগেছিল। সে কথা পরে বলছি। এখন বলুন দেখি, কলকাতায় কি আপনার থাকবার জায়গা নেই?’
বললাম।—’থাকলে কি ধর্মশালায় আসি? কিন্তু এখানেও দেখছি জায়গা নেই। হোটেলের খরচ দিতে পারব না। তাই ভাবছি কী করি।’
গঙ্গাপদ বলল–‘দেখুন, আমার একটা প্রস্তাব আছে। কলকাতায় আমি থাকি, দক্ষিণ কলকাতায় আমার বাসা আছে। আমি মাসখানেকের জন্যে বাইরে যাচ্ছি, বাসাটা খালি পড়ে থাকবে। তা আপনি যদি আমার বাসায় থাকেন আপনারও সুবিধে আমারও সুবিধে। আমার একটা ঠিকে চাকর আছে, সে আপনার দেখাশোনা করবে, কোনো কষ্ট হবে না।’
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম।—’আমার মত একজন অচেনা লোকের হাতে আপনি বাসা ছেড়ে দেবেন!’
গঙ্গাপদ একটু হেসে বলল–‘তাহলে চমক লাগার কথাটা বলি। স্টেশনে আপনাকে দেখে মনে হয়েছিল। আপনি আমার ভাই দুগাপদ। তারপর ভুল বুঝতে পারলাম। দুগাপদ দু’ বছর আগে নিরুদেশ হয়ে গিয়েছিল, বোধ হয় সন্ন্যাসী হয়ে গেছে। আপনার সঙ্গে তার চেহারার খুব মিল আছে। তাই-মানে—আপনার প্রতি আমার একটু-ইয়ে—। আপনি যদি আমার বাসায় থাকেন আমি খুব নিশ্চিন্ত হব।’
আমার ভাগ্যে এমন যোগাযোগ ঘটবে স্বপ্নেও ভাবিনি। খুশি হয়ে রাজী হয়ে গেলাম।
গঙ্গাপদ আমাকে ট্যাক্সিতে তুলে তার বাসায় নিয়ে গেল। ছোট রাস্তায় ছোট বাড়ির দোতলায় একটি মাঝারি গোছের ঘর, ঘরে তক্তপোশের ওপর বিছানা, দেয়ালে আলমারি, দু’ একটা বাক্স সুটকেস। আর কিছু নেই।
হিন্দুস্থানী চাকরাটা উপস্থিত ছিল। তার নাম রামচতুর। গঙ্গাপদ তাকে পয়সা দিল দোকান থেকে চা জলখাবার আনতে। সে চলে গেলে গঙ্গাপদ রাস্তার দিকের জানলাটা খুলে দিয়ে তক্তপোশে এসে বসল, বলল–‘বসুন, আপনার সঙ্গে আরো কিছু কথা আছে।’
আমিও তক্তপোশে বসলাম। গঙ্গাপদ বলল—’আমার বাড়িওয়ালা কাশীপুরে থাকে, লোকটা ভাল নয়। সে যদি জানতে পারে। আমি অন্য কাউকে ঘরে বসিয়ে একমাসের জন্য বাইরে গেছি। তাহলে হাঙ্গামা বাধাতে পারে। তাই আপনাকে একটি কাজ করতে হবে। যদি কেউ আপনার নাম জিজ্ঞেস করে, আপনি বলবেন–গঙ্গাপদ চৌধুরী। লোকে ভাববে। আমি দাড়ি কামিয়ে ফেলেছি।’
শুনে আমার খুব মজা লাগল, বললাম–’বেশ তো, এ আর বেশি কথা কি?’
তারপর রামচতুর চা জলখাবার নিয়ে এল; গঙ্গাপদ আমাকে জলযোগ করিয়ে উঠে পড়ল, বলল— আচ্ছা, এবার তাহলে আমি চলি। আমার জিনিসপত্র ঘরে রইল। নিশ্চিন্ত মনে বাস করুন! নমস্কার।’
দোর পর্যন্ত গিয়ে গঙ্গাপদ ফিরে এল, বলল–’একটা কথা বলা হয়নি। যখন ঘরে থাকবেন, মাঝে মাঝে জানলা খুলে রাস্তার দিকে তাকাবেন; লক্ষ্য করবেন রাস্তা দিয়ে লাল কোট পরা কোনো লোক যায় কিনা। যদি দেখতে পান, তারিখ আর সময়টা লিখে রাখবেন। কেমন?
‘আচ্ছা।’
গঙ্গাপদ চলে গেল। আমার সন্দেহ হলো তার মাথায় ছিট আছে। কিন্তু থাকুক ছিট, লোকটা ভাল। আমি বেশ আরামে রইলাম। রামচতুর আমার সেবা করে। আমি সকাল বিকেল এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াই, দুপুরে আর রাত্রে ঘরে থাকি। মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখি, রাস্তা দিয়ে লাল কোট পরা কেউ যাচ্ছে কিনা। লাল কোট পরে কলকাতার রাস্তায় কেউ ঘুরে বেড়াবে এ যেন ভাবাই যায় না। তবু গঙ্গাপদ যখন বলেছে, হবেও বা।
হগুপ্তাখানেক বেশ আরামে কেটে গেল।
আজ সকালে খবরের কাগজের অফিসে গেছলাম বোনের পাত্র সম্বন্ধে একটা বিজ্ঞাপন দিতে। ফিরে এসে খাওয়া-দাওয়া সেরে তক্তপোশে শুলাম। রামচতুর চলে গেল।
ঘুম ভাঙল আন্দাজ পৌঁনে তিনটের সময়। বিছানা থেকে উঠে জানলা খুলে দিলাম। জানলার সামনে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়েছি, হঠাৎ মাথাটা ঝনঝনি করে উঠল, উলটে মেঝের ওপর পড়ে গেলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই, অসহ্য যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে পড়লাম।
হাসপাতালে জ্ঞান হলো। মাথায় পাগড়ি বেঁধে শুয়ে আছি! কে নাকি আমার মাথা লক্ষ্য করে বন্দুক ছুঁড়েছিল, বন্দুকের গুলি আমার খুলির ওপর আঁচড় কেটে চলে গেছে।–‘কী ব্যাপার বলুন দেখি ব্যোমকেশবাবু?’
‘সেটা বুঝতে সময় লাগবে। আপনি এখন বিশ্রাম করুন।’ ব্যোমকেশ উঠে দাঁড়াল।
পরদিন বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ রাখালবাবু ব্যোমকেশের বাড়িতে এলেন। ব্যোমকেশ তার অফিস ঘরে বসে। অলসভাবে খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন পড়ছিল, রাখালবাবুকে একটি সিগারেট দিয়ে বলল— ‘নতুন খবর কিছু আছে নাকি?’
রাখালবাবু সিগারেট ধরিয়ে বললেন–’রামচতুর পালিয়েছে।’
‘রামচতুর! ও—সেই চাকরাটা।’
‘হাঁ। কাল বিকেলবেল পুলিসকে খবর দিয়ে সেই যে গা-ঢাকা দিয়েছে তাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘সত্যিই রাম-চতুর। পুলিসের হাঙ্গামায় থাকতে চায় না। এতক্ষণ বোধ হয় বেহার প্রদেশে ফিরে গিয়ে ভুট্টা পুড়িয়ে খাচ্ছে। আর কিছু?’
‘বাড়িওয়ালাকে কাশীপুর থেকে খুঁজে বার করেছি। আজ সকালে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। অশোক মাইতিকে দেখে বলল, এই গঙ্গাপদ চৌধুরী; তারপর গলার আওয়াজ শুনে বলল, না গঙ্গাপদ নয়, কিন্তু চেহারার খুব মিল আছে।’
এই পর্যন্ত শুনে ব্যোমকেশ বলল— ‘গঙ্গাপদ চৌধুরীর সঙ্গে অশোক মাইতির চেহারার মিল আছে?’
রাখালবাবু বললেন–’হ্যাঁ, গঙ্গাপদ বলেছিল তার ভায়ের সঙ্গে মিল আছে, গঙ্গাপদ এবং তার ভায়ের চেহারা যদি এক রকম হয়–‘
‘গঙ্গাপদর দাড়িটা মেকি মনে হচ্ছে।’
‘আমারও তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু তার উদ্দেশ্য ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অশোক মাইতিকে এনে নিজের বাসায় ভুলল কেন? নিজের নামটাই বা তাকে দান করুল কেন? আসল কারণটা কী?’
ব্যোমকেশ কি-একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, তারপর অলস কণ্ঠে বলল— ‘চিন্তার কথা বটে। আসল গঙ্গাপদ বোধ করি এখনো নিরুদেশ।’
‘হ্যাঁ। তার ঘরের আলমারি থেকে কিছু কাগজপত্র পাওয়া গেছে, তা থেকে জানা যায়। সে কলকাতায় এক লোহার কারখানায় কাজ করে, সম্প্রতি একমাসের ছুটি নিয়ে অদৃশ্য হয়েছে।’
‘গুলিটা কোথা থেকে এসেছিল জানা গেছে?’
‘সামনের বাড়ি থেকে। রাস্তার ওপারে একটা পোড়ো বাড়ি কিছুদিন থেকে খালি পড়ে আছে, তার দোতলার জানলা থেকে কেউ গুলি ছুড়েছিল। পোড়ো বাড়ির ঘরের মধ্যে কয়েকটা তাজা আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে, কিন্তু করি আঙুলের ছাপ তা সনাক্ত করার উপায় নেই।’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ সংবাদগুলিকে একত্র করে মনের মধ্যে রোমন্থন করল, তারপর বলল—‘রহস্যটা কিছু পরিষ্কার হলো?’
রাখালবাবু সিগারেটে দুটো লম্বা টান দিয়ে সেটাকে অ্যাশ-ট্রের ওপর নিবিয়ে দিলেন, আস্তে আস্তে ধোঁয়া ছেড়ে বলতে আরম্ভ করলেন–‘গঙ্গাপদ চৌধুরীর দাড়ি যে নকল দাড়ি তার একটা জোরালো প্রমাণ, তার বাড়িওয়ালা তার মুখে কখনো দাড়ি-গোঁফ দেখেনি; আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তাহলে প্রশ্ন উঠছে, গঙ্গাপদ ছদ্মবেশে বেড়ায় কেন। একটা কারণ এই হতে পারে যে, সে ছদ্মবেশে কোনো গুরুতর অপরাধ করতে চায়। তারপর একদিন হাওড়া স্টেশনে সে অশোক মাইতিকে দেখতে পায়, নিজের চেহারার সঙ্গে সাদৃশ্য দেখে তাকে ভুলিয়ে নিজের বাসায় এনে বসায়, তারপর নিজে গা-ঢাকা দেয়। হয়তো সে নিজেই সামনের বাড়ি থেকে অশোককে খুন করার চেষ্টা করেছিল, যাতে লোকে মনে করে যে, গঙ্গাপদই মরেছে। হয়তো এইভাবে সে জীবনবীমার টাকা সংগ্রহ করতে চেয়েছিল। যাই হোক, এখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে এই যে, তার পরিচয় এবং বর্তমান ঠিকানা আমরা জানি না; সে অশোক মাইতিকে খুন করবার চেষ্টা করেছিল কিনা তা নিশ্চয়ভাবে জানি না, কারণ তার কাগজপত্রের মধ্যে জীবনবীমার পলিসি পাওয়া যায়নি। এখন কর্তব্য কি?’
ব্যোমকেশ একটু ভেবে বলল— ‘মীরাটে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে?’
রাখালবাবু বললেন–‘অশোক মাইতিকে দিয়ে মীরাটে তার মা’র নামে টেলিগ্রাম করিয়েছি। এখনো জবাব আসেনি। কেন, আপনি কি অশোক মাইতিকে সন্দেহ করেন?’
‘অশোক মাইতিকে বড় বেশি ভাল মানুষ বলে মনে হয়। সে হয়তো সত্যি কথাই বলছে, কিন্তু তার কোনো সমর্থন নেই। রামচতুর সমর্থন করতে পারত, কিন্তু সে পালিয়েছে। —যাক, গঙ্গাপদ কোথায় কাজ করে?’
‘কলকাতার উপকণ্ঠে একটা লোহার কারখানা আছে সেইখানে।’ রাখালবাবু পকেট থেকে নোটবুক বার করেপ পড়লেন–‘Scrap Iron & Steel Factory Ltd.’
‘সেখানে খোঁজ নিলে কিছু খবর পাওয়া যেতে পারে।’
‘সেখানে যাব বলেই বেরিয়েছি। আপনি আসবেন সঙ্গে?’
‘যাব। বাড়িতে বেকার বসে থাকার চেয়ে ঘুরে বেড়ালে স্বাস্থ্য ভাল থাকে।’
কলকাতার দক্ষিণ সীমানার বাইরে বিঘে দুই জমির ওপর লোহার কারখানা। জমির এধারে ওধারে কয়েকটা করোগেট টিনের উঁচু ছাউনি, তাদের ফাঁকে ফাঁকে এখানে ওখানে স্তুপীকৃত জং-ধরা ঝুনো পুরনো লোহা। চারিদিকে কমীদের তৎপরতা দেখে মনে হয় কারখানার কাজ চালু আছে। ফটকের পাশে একটি ছোট পাকা বাড়ি, এটি কোম্পানির অফিস।
রতনলাল কাপড়িয়া অফিস ঘরে ছিলেন। রতনলাল মাড়োয়ারী হলেও তিন পুরুষ ধরে বাংলাদেশে আছেন, প্রায় বাঙালী হয়ে গেছেন; পরিষ্কার বাংলা বলেন। দু’জনকে সামনে বসিয়ে পান সিগারেট দিলেন, বললেন—‘হুকুম করুন।’
রাখালবাবু একবার ব্যোমকেশের পানে তাকিয়ে প্রশ্ন আরম্ভ করলেন, ব্যোমকেশ চুপ করে বসে শুনতে লাগল।–
‘গঙ্গাপদ চৌধুরী এখানে কাজ করে?’
‘হ্যাঁ। উপস্থিত ছুটিতে আছে।’
‘সে কী কাজ করে?
ইলেকট্রিক ফার্নেসের মেল্টার।’
‘সে কাকে বলে?’
‘আজকাল ইলেকট্রিক আগুনে লোহা গলানো হয়। যে লোক এই কাজ জানে তাকে মেল্টার বলে। গঙ্গাপদ আমার সর্দার মেল্টার। সে ছুটিতে গেছে বলে আমার একটু অসুবিধে হয়েছে। তার অ্যাসিস্টেন্ট দু’জন আছে বটে, কোনো মতে কাজ চালিয়ে নিচ্ছে। আমাদের দেশে ভাল মেল্টার বেশি নেই, যে দু’চারজন আছে, গঙ্গাপদ তাদের একজন।’
‘তাই নাকি! সে ছুটি নিল কেন?’
‘তার একমাস ছুটি পাওনা হয়েছিল। মনে হচ্ছে যেন বলেছিল ভারত ভ্বমণে যাবে; আজকাল সব স্পেশাল ট্রেন হয়েছে সারা দেশ ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ায়।’
‘হ্যাঁ। ওর আত্মীয়স্বজন কেউ আছে?’
‘বোধ হয়না। একলা থাকত।’
‘ওর স্বভাব-চরিত্র কেমন?’
‘খুব কাজের লোক। বুদ্ধিসুদ্ধি আছে। হাঁশিয়ার।’
রাখালবাবু ব্যোমকেশের পানে তাকালেন। ব্যোমকেশ যেন ঝিমিয়ে পড়েছিল, একটু সজাগ হয়ে বলল— ‘গঙ্গাপদর কোনো শত্ৰু আছে কিনা। আপনি জানেন?’
রতনলাল ভুরু তুললেন-‘শত্রু! কই, গঙ্গাপদর শক্র আছে এমন কথা তো কখনো শুনিনি-ওঃ!’
তিনি হঠাৎ হেসে উঠলেন–’একজনের সঙ্গে গঙ্গাপদর শক্রতা হয়েছিল, সে এখন জেলে।’
‘তিনি কে?’
‘তার নাম নরেশ মণ্ডল। তিন বছর আমার সর্দার মেল্টার ছিল, গঙ্গাপদ ছিল তার অ্যাসিস্টেন্ট। দু’জনের মধ্যে খিটিমিটি লেগে থাকত। নরেশ ছিল রাগী, আর গঙ্গাপদ মিটমিট বজ্জাত। কিন্তু দু’জনেই সমান কাজের লোক। আমি মজা দেখতাম। তারপর হঠাৎ একদিন নরেশ একজনকে খুন করে বসল। গঙ্গাপদ তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিল। নরেশের জেল হয়ে গেল।’
‘খুনের জন্যে জেল! কতদিনের মেয়াদ জানেন?’
‘ঠিক জানি না। চার পাঁচ বছর হবে। নরেশ জেলে যাবার পর গঙ্গাপদ সদার মেল্টার হয়ে বসল।’ বলে রতনলাল হো হো শব্দে হাসলেন।
ব্যোমকেশ হাসিমুখে উঠে দাঁড়াল–’আপনাকে অনেক বিরক্ত করেছি, এবার উঠি। একটা কথা–গঙ্গাপদকে আপনি শেষবার দেখেছেন কবে?’
‘দিন বারো-চোদ্দ আগে।’
‘তখন তার মুখে দাড়ি ছিল?’
‘দাড়ি! গঙ্গাপদর কস্মিনকালেও দাড়ি ছিল না।’
‘ধন্যবাদ।’
রাস্তায় বেরিয়ে রাখালবাবু প্রশ্ন করলেন–‘অতঃপর?’
ব্যোমকেশ বলল–’অতঃপর অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানো ছাড়া আর তো কোনো রাস্তা দেখছি না।–এক কাজ করা যেতে পারে। চার পাঁচ বছর আগে নরেশ মণ্ডল খুন করে জেলে গিয়েছিল; তার বিচারের দলিলপত্র আদালতের দপ্তর থেকে তুমি নিশ্চয় যোগাড় করতে পারবে। অন্তত হাকিমের রায়টা যোগাড় কর। সেটা পড়ে দেখলে হয়তো কিছু হদিস পাওয়া যাবে।’
রাখালবাবু বললেন–’বেশ, রায় যোগাড় করব। নেই কাজ তো খাই ভাজ। কাল সকালে আপনি খবর পাবেন।’