Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হৃৎকম্প || Sharadindu Bandyopadhyay

হৃৎকম্প || Sharadindu Bandyopadhyay

গত নভেম্বর মাসে মহামন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী যখন দেশবাসীকে বললেন, দেশে অন্নাভাব, আপনারা হপ্তায় এক বেলা চাল-গম খাওয়া বন্ধ করুন, তখন আমি ভাবলাম—ছেষট্টি বছর বয়স হল, দেশের কাজ তো কিছুই করলাম না, এখন অন্তত কম খেয়ে দেশের উপকার করি।

গিন্নী আমার সাধু সংকল্প সমর্থন করলেন; শুধু হপ্তায় এক বেলা নয়, আমরা দুজনে হপ্তায় দুবেলা–মঙ্গলবার এবং শুক্রবার রাত্রে—ভাত-রুটি-লুচি খাব না। মনে মনে বেশ একটু আত্মপ্রসাদ অনুভব করতে লাগলাম।

পুণার বাড়িতে আমরা দুজনেই থাকি, আর কেউ থাকে না। দুই ছেলে বোম্বায়ে থাকে, তারা মাসের মধ্যে বার দুই আমাদের কাছে week end যাপন করে যায়। আমরা দুজনে যথারীতি কৃচ্ছসাধন শুরু করে দিলাম। ব্যবস্থা হল, মঙ্গলবার এবং শুক্রবার রাত্রে আমরা খাব—মাছ কিংবা মাংস, শাকসজি সিদ্ধ, আলু গাজর টোমাটো ইত্যাদির তরকারি। রসনার দিক দিয়ে নূতনত্বটা মন্দ হবে না, এরকম মুখ বদল ভালই লাগে।

প্রথম দিন চাল-গম বর্জিত খাবার খেয়ে কিন্তু অপ্রস্তুত হতে হল। বেশ পেট ভরেই খেয়েছিলাম। কিন্তু রাত তিনটের সময় ক্ষিদের চোটে ঘুম ভেঙে গেল। শাকসজি এবং মাংস বেবাক হজম হয়ে গেছে। গিন্নী পাশের ঘরে শোন, তাঁর ঘুম ভাঙিয়ে এত রাত্রে নতুন করে পেট ভরাতে হল। খালি পেটে ঘুম হয় না।

তারপর থেকে মঙ্গলবার এবং শুক্রবার দিনে একটু চেপে খাই, রাত্রে ক্ষিদে পায় না। এইভাবে দুহপ্তা কাটল।

১৯ নভেম্বর শুক্রবার শরীর বেশ ভালই ছিল, রাত্রে যথারীতি মাংস আর শাকসজি খেয়ে শুলাম।

পরদিন সকালবেলা বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে দেখি, পেট গুলোচ্ছে, মাথা ঘুরছে। এত বেশী মাথা ঘুরছে যে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। আবার বিছানা নিলাম এবং ডাক্তারকে ডেকে পাঠালাম।

ডাক্তার ভিড়ে আমার বাড়ির ডাক্তার; কাছেই থাকেন, দু মিনিটের রাস্তা। অত্যন্ত সাদাসিধে শান্ত প্রকৃতির মানুষ। তিনি এলে তাঁকে রোগের কথা বললাম, মঙ্গলবার শুক্রবারের কথাও বয়ান করলাম। শুনে তিনি বললেন, বুড়ো বয়সে এ কী বখেয়ালী! আপনার প্রবল বদহজম হয়েছে। ওষুধ দিচ্ছি। আজ স্রেফ দই-ভাত খাবেন। ওসব বেয়াড়া খাবার বন্ধ করুন।

দেশের জন্যে কৃচ্ছ্রসাধন আমার সহ্য হল না। মনটা খারাপ হল, কিন্তু উপায় কি? মঙ্গলবার শুক্রবারের পালা শেষ করতে হবে।

ওষুধ এবং দই-ভাতের গুণে বিকেলবেলা নাগাদ শরীর বেশ স্বাভাবিক হল।

রাত্রি নটার সময় লঘু আহার করে শুনলাম। আমার অভ্যাস রাত্রে বিছানায় শুয়ে খানিকক্ষণ বই পড়ি, তারপর আলো নিভিয়ে ঘুমোই।

রাত্রি আন্দাজ দশটার সময় বই রেখে আলো নেভালাম। কিন্তু ঘুম এল না। শরীরে কোনও অস্বস্তি নেই, তবু ঘুম আসছে না।

এপাশ ওপাশ করে আধ ঘণ্টা কেটে যাবার পরও যখন ঘুম এল না তখন ভাবলাম উঠে দুটান সিগারেট টানি তাহলে হয়তো ঘুম আসবে।

বিছানায় উঠে বসে আলো জ্বেলেছি, হঠাৎ বুকটা দুর দুর করে উঠল।

এই আরম্ভ।

আমার শরীরে অনেক রোগ আছে, কিন্তু হৃদ্যন্ত্রটা নীরোগ বলেই জানতাম। এখন হৃদ্যন্ত্রটা থর থর করে কাঁপতে আরম্ভ করল। মনে হল যেন বুকের মধ্যে নিঃশব্দে একটা ডঙ্কা বাজছে; তার ছন্দ এত দ্রুত যে হৃদয়ের স্বাভাবিক ছন্দ তার সঙ্গে তাল রাখতে পারছে না। সমস্ত শরীর এই ছন্দের। তালে তালে দুলতে লাগল। বুকে ব্যথা বা যন্ত্রণা নেই, কেবল হৃদয় দ্রুত তালে নেচে চলেছে। হৃদয় আমার নাচেরে।

শরীরে যেমন যন্ত্রণা নেই, মনে তেমনি ভয়ও নেই। ভাবছি হৃদয়ের এই সাময়িক উল্লাস এখনি প্রশমিত হবে। দশ মিনিট কাটল, কুড়ি মিনিট কাটল, আধ ঘণ্টা কেটে গেল, তবু হৃদযন্ত্র সমান তালে নেচে চলেছে।

মনে চিন্তা এল কী করা যায়? এত রাত্রে গৃহিণী পাশের ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। বাইরের বারান্দায় আমার ঝি সরস্বতীর বাপ-মা শোয়, তারাও নিশ্চয় ঘুমিয়েছে। এগারোটা বেজে গেছে, এখন ডাক্তারকে ডাকতে পাঠালে তিনি কি আসবেন? এদেশে রাত্রে ডাক্তারেরা আসতে চায় না।

মনে হল হৃকম্পের বেগ যেন বাড়ছে। আর দেরি করলে হয়তো এক্তিয়ারের বাইরে চলে যাবে। উঠে পশের ঘরে গেলাম। গৃহিণীকে জাগিয়ে পরিস্থিতি বললাম। জানালাম ডাক্তার ডাকা দরকার।

একটা ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তাকে দুঃসংবাদ শোনালে তার কী রকম প্রতিক্রিয়া হবে কিছুই বলা যায় না। আমার গৃহিণী ঊর্ধ্বশ্বাসে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন এবং পাঁচ মিনিট পরে ডাক্তার ভিডেকে নিয়ে ফিরে এলেন।

আমি তখন বিছানায় শুয়ে বাঁ হাতে ডান হাতের নাড়ী দেখছি অবস্থা কেমন। নাড়ী চলছে যেন ট্রেনের ইঞ্জিনের মতো, এত দ্রুত যে গোনা যায় না। ভাবছি যে-কোনও মুহূর্তে ইঞ্জিন থেমে যেতে পারে। মৃত্যুর এত কাছাকাছি কখনো আসিনি।

ডাক্তার আমার নাড়ী দেখলেন, তারপর ক্ষিপ্রহস্তে ইঞ্জেকশন তৈরি করে আমার বাহুতে উঁচ ফোটালেন। আমি প্রশ্ন করলাম, কি ব্যাপার?

ডাক্তার বললেন, পেটে গ্যাস হয়েছে। গ্যাস হৃদযন্ত্রকে ঠেলা মারছে, তাই এই বিপত্তি। কিন্তু ভয় নেই, এখন সব ঠিক হয়ে যাবে।

তারপর প্রতীক্ষা। হৃদয়ের মৃদঙ্গ চৌদুনে বেজে চলেছে। দশ মিনিট। পনরো মিনিট। উপশমের কোনও লক্ষণ নেই। ডাক্তারের মুখে শঙ্কার ছায়া পড়ল। আমি ভাবছি—অদ্যই আমার শেষ রজনী।

কুড়ি মিনিট পরে বুকের স্পন্দন কমতে লাগল। পঁচিশ মিনিট পরে বুক একেবারে স্বাভাবিক। কোনও কালে যে আমার দারুণ হৃৎকম্প হয়েছিল তা বোঝাই যায় না। বললাম, ডাক্তার, একেবারে সেরে গেছি।

ডাক্তার মাথা নেড়ে বললেন, উঁহু, আজ ঘুমিয়ে পড়ন, কাল সকালে কার্ডিওলজিস্ট নিয়ে আসব।

রাত বারোটা বেজে গেছে, ডাক্তার চলে গেলেন। গিন্নী খুবই ব্যাকুল হয়ে পড়েছেন দেখলাম, কিন্তু আমার মনে হল সামান্য উপলক্ষ্য নিয়ে একটু বেশী বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে।

যাহোক, ডাক্তারের হুকুম অমান্য করার সাহস নেই। পরদিন হৃদয়-বিশেষজ্ঞ এলেন, যন্ত্রের সাহায্যে হৃদয়যন্ত্র পরীক্ষা করলেন। জানা গেল, হৃৎপিণ্ড সামান্য রকম জখম হয়েছে। সুতরাং ডজনখানেক ওষুধ নিয়মিত খেতে হবে এবং সিগারেট ছেড়ে দিতে হবে। সাত দিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে। সাত দিন পরে আবার E.C.G. পরীক্ষা।

বিছানায় শুয়ে থাকতে আমার কোনোই আপত্তি নেই, বস্তুত ও কাজটা আমার ভালই লাগে। কিন্তু জোর করে বিছানায় শুইয়ে রাখলে মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ইচ্ছে করে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে যাই, লাইব্রেরিতে গিয়ে বই নিয়ে আসি। শুয়ে থাকাটা সময়ের অপব্যয় বলে মনে হয়।

কিন্তু গৃহিণীর তীক্ষ্ণ শাসনে বেশী নড়াচড়া সম্ভব হল না। বড় জোর লেখার টেবিলে গিয়ে বসি, আবার শুয়ে পড়ি। বোম্বায়ে ছেলেদের একটা চিঠি লিখে দিলাম; যথাসম্ভব লঘু করে লিখলাম। নইলে তারা উদ্বিগ্ন হবে।

পরের হপ্তায় E.C.G. ডাক্তার এসে আবার পরীক্ষা করলেন। বললেন, অবস্থার উন্নতি হয়েছে কিন্তু আরো দুহপ্তা ঔষধ সেবন এবং শয়নে পদ্মনাভঞ্চ চলবে। তখন জানতাম না যে এটা ডাক্তারদের একটা প্যাঁচ। প্রথমেই যদি বলেন তিন মাস শুয়ে থাকতে হবে তাহলে রুগী ভড়কে যাবে, তাই সইয়ে সইয়ে কুকুরের ল্যাজ কাটেন।

ইতিমধ্যে আমার বড় ছেলে বম্বে থেকে এসেছে। সে ফিরে যাবার পর মেজ ছেলে এল। এইভাবে পালা করে তারা আমার ওপর নজর রেখেছে।

তাছাড়া মেজর অম্বরনাথ চ্যাটার্জী, ক্যান্টেন পিণাকী ব্যানার্জী প্রমুখ কয়েকজন মিলিটারি ডাক্তার আছেন; এঁরাও আমার ওপর কড়া নজর রেখেছেন।

পুণায় মিলিটারি হাসপাতাল ও কলেজ আছে; সেখানে যে কয়জন বাঙালী অফিসার আছেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজন এই বৃদ্ধের প্রতি প্রতিমান। মেজর অম্বরনাথ এবং ক্যাপ্টেন পিণাকী তাঁদের অন্যতম।

সকলেই আমাকে সারিয়ে তোলবার চেষ্টা করছেন, কিন্তু সব শেয়ালের এক রা; সিগারেট ছেড়ে দাও, ওষুধ খাও, আর শুয়ে থাকো।

ওষুধ খাওয়া এবং শুয়ে থাকা বরং সম্ভব, কিন্তু সিগারেট ছাড়া অসম্ভব। ১৯১৭ সাল থেকে সিগারেট খাচ্ছি, ৪৯ বছরের নেশা। এক কথায় ছেড়ে দেওয়া যায় না। তবু কমিয়ে সাত-আটটায় দাঁড় করলাম। কিন্তু ডাক্তারেরা তাতে সন্তুষ্ট নয়। একেবারে ছেড়ে দেওয়া চাই।

পুণায় আমার ক্রমে অসুবিধা হতে লাগল। সর্বদা দেখাশোনা করবার লোকের অভাব। বড় বৌমা এখানে এসে আছেন বটে, তিনি নিজের সংসার ছেড়ে কতদিন এখানে থাকতে পারেন? পারিবারিক পরামর্শে স্থির হল আমি গিয়ে বোম্বায়ে ছেলেদের কাছে থাকব। তাহলেই সব হাঙ্গামা চুকে যাবে।

পুণায় ডাক্তারেরা সাগ্রহে এই প্রস্তাবে সায় দিলেন। ২৬শে ডিসেম্বর আমি বোম্বাই গেলাম।

বোম্বায়ের উপকণ্ঠে আন্ধেরী নামক স্থানে আমার বড় এবং মেজ ছেলে থাকে। তাদের কাছে পরম নিশ্চিন্ত মনে দুমাস থাকলাম। শরীর প্রায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল। তখন আবার পুণার দিকে মন টানতে লাগল।

২৬শে ফেব্রুয়ারী পুণায় ফিরে এসেছি। এই রোগের ফলে আমার জীবনে একটা বড় রকম অবস্থান্তর হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ধুমপান ত্যাগ করতে হল। প্রথমটা খুবই কষ্ট হয়েছিল কিন্তু এখন সিগারেট বিরহ ব্যথা অনেকটা সামলে উঠেছি। মাসে গোটা পঞ্চাশ টাকা বেঁচে যাচ্ছে। এটাও কম লাভ নয়।

সামলে উঠেছি বটে, কিন্তু যতই সামলে উঠি একটা কথা বুঝেছি। মহাকাল হচ্ছেন বাড়িওয়ালা; তিনি নোটিশ দিলেন শীঘ্রই বাসা ছাড়তে হবে।

আমার যে আত্মজীবনী কোনও দিন লেখা হবে না, এই বিবরণীই তারই ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress