তিস্তার বিশাল চর
তিস্তার বিশাল চর জুড়ে কাশের বন, একেবারে উলটোদিকে বার্নিশের গা ঘেঁষে হাঁটু অবধি জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে। নৌকা চলে না যখন, যারা ওপারে যায় তারা হেঁটেই পারাপার করে। তিস্তার চরে মিহি সাদা বালি দুধের সরের মতো পড়ে থাকে, জোরে বাতাস বইলে মনে হয় গোটা চর সাদা মশারির তলায় চলে গেছে। সেই সময় আচমকা বৃষ্টি নামে কয়েক ঘণ্টার জন্য। অমনি বালি শক্ত হয়ে যায়। তার কিছু পরেই সেখানে বসে ছটপুজোর মেলা। দুপুরে শুরু হয়, শেষ হয় পরের ভোরে, সূর্য ওঠার পরে।
মেলাটা মূলত শুরু হয়েছিল বিহার থেকে জলপাইগুড়িতে এসে কাজেকর্মে থেকে যাওয়া হিন্দিভাষী মানুষগুলোর উদ্যোগে। তারা সূর্যের উপাসক। নদীর চরে সারারাত পুজো করে ভোরবেলায় সুর্যপ্রণাম সেরে বাড়ি ফিরত। সেই রাতটা যাতে আনন্দে কাটে তাই হ্যাঁজাক জ্বেলে মেলা বসত। নানান পসরা নিয়ে বাহির হত, খাবারের দোকান থাকত অনেকগুলো। সেইসঙ্গে প্রায় গোটা রাত ধরে মাইকে গান বাজত মানুষদের চাঙ্গা রাখতে। প্রথমদিকে হিন্দিভাষী মানুষেরাই ওই বাৎসরিক এক রাতের মেলায় ভিড় জমাত। তারপর একে একে পাহাড়ি, ভুটানি এমনকী নাগাল্যান্ডের মানুষ ওই একটা রাতের মেলায় তাদের পসরা নিয়ে আসা শুরু করেছিল। বাঙালিরা, তাদের শহরের নদীর চরে এমন একটা মেলা নিয়ে প্রথমদিকে উদাসীন থাকলেও শেষ পর্যন্ত কেউ কেউ কৌতূহলী হয়ে উঠল। তিন মাস আগে ওই মেলাতেই ঘটনাটা ঘটে গেল।
ইদানীং ভোরবেলা হাঁটতে বের হচ্ছে অর্জুন। গেঞ্জি শার্ট বারমুডা আর স্নিকার পরে তিস্তার বাঁধ ধরে আড়াই মাইল চলে যায় হাঁটার বদলে জগিং করে। সূর্য উঠলে ফিরে আসে হেঁটে। এটা করায় শরীরমন বেশ তাজা থাকে। সেদিনও বাড়ি থেকে বেরিয়ে থানার পাশ দিয়ে করলা নদীর ধার দিয়ে হাকিমপাড়ার দিকে এগোতেই গাড়ির আওয়াজ পেয়ে সে মুখ ঘুরিয়ে দেখল একটা পুলিশের জিপ এবং তার পেছনে কালো রঙের ভ্যান এগিয়ে আসছে। সাধারণত ধরপাকড়ের অভিযানেই ওই কালো ভ্যানটাকে ব্যবহার করা হয়। জিপ তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে যেতে সে ড্রাইভারের পাশে দারোগাবাবুকে দেখতে পেল। এই ভদ্রলোক সম্প্রতি জলপাইগুড়িতে বদলি হয়ে এসেছেন। আগের দারোগার বিদায় অনুষ্ঠানে এঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ভদ্রলোকের নাম আবীর ইসলাম।
অর্জুন চেঁচিয়ে বলল, গুডমর্নিং।
গুডমর্নিং। তবে কতটা ভাল থাকবে জানি না। আপনি কোনদিকে? আবীর ইসলাম জিজ্ঞাসা করলেন।
তিস্তার বাঁধে। আপনি এই ভোরে কোথায় চললেন?
আর বলবেন না। শেষ রাত্রে শান্তিতে ঘুমোব তাও ভাগ্যে নেই। জোড়া খুন হয়েছে তিস্তার চরে। ওই ছটপুজোর মেলার পাশে। আসবেন নাকি?
একটা নয়, দুটো মানুষ খুন হয়েছে শুনে একটু অবাক হল অর্জুন। সে জিজ্ঞাসা করল, নিজেদের মধ্যে মারপিট হয়েছে নাকি?
না না। যা খবর পেলাম তাতে এটুকু বুঝলাম রাত্রে চরের মেলায় কোনও গোলমাল হয়নি। যে সেপাইরা ডিউটিতে ছিল তারা থানায় খবরটা দিয়েছে। একটা খুনও যা অপরাধ দুটো খুনে তার মাত্রা যে অনেক বেড়ে যায় তা এসপি সাহেবের ফোনে বুঝতে পারলাম। চলে আসুন, এটা তো আপনার সাবজেক্ট হতে পারে। আবীর ইসলাম ড্রাইভারের দিকে একটু সরে বসলেন।
আপত্তি করল না অর্জুন। তিস্তার বাঁধ অবধি গাড়িতে গিয়ে হাঁটা শুরু করতে হবে।
গাড়ি চললে আবীর বললেন, জলপাইগুড়িতে আসার পর এই প্রথম খুনের খবর পেলাম। তাও জোড়া খুন। শুনেছিলাম এই শহরে খুনখারাবি খুব কম হয়।
অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, যারা খুন হয়েছে তারা নিশ্চয়ই পুজো দিতে মেলায় এসেছিল?
কিছুই জানি না। কুড়ি মিনিট আগে খবরটা পেয়েছি। তার পরেই এসপি সাহেবের ফোন। যারা খুন হয়েছে তাদের একজন পুরুষ অন্যজন নারী।
অর্জুন এবার অবাক হল। দু’জন পুরুষ পরস্পরের সঙ্গে মারপিট করে শেষ পর্যন্ত মারা যেতে পারে কিন্তু পুরুষ-নারীর লড়াই হলে ওরকম সচরাচর ঘটে না। এদের ক্ষেত্রে হত্যাকারী অবশ্য তৃতীয় একাধিক ব্যক্তি, গুলি না চালিয়ে একজনের পক্ষে দু’জন মানুষকে খুন করা একটু অস্বাভাবিক ব্যাপার।
তিস্তার বাঁধে গাড়ি উঠলে আবীর ইসলাম বললেন, একবার স্পটে যাবেন নাকি!
কৌতূহল হচ্ছিল। অর্জুন ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। এত সকালে জগিং না করলে কী এমন ক্ষতি হবে। বাঁধ থেকে নেমে গাড়ি দুটো চরের ওপর দিয়ে চলতে শুরু করল। মেলাটা দেখা যাচ্ছে। পুরো চর পেরিয়ে বার্নিশের দিকে যেখানে জলের ধারা রয়েছে সেখানে স্নান শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। মাইকে ভক্তিগীতি বাজছে। সেই সঙ্গে ঢাক-ঢোলের আওয়াজ। কাছাকাছি যেতেই একজন সেপাই ছুটে এসে স্যালুট করে দাঁড়াল। আবীর জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে?
খুন হো গিয়া সাব। দো দো খুন। সেপাইটি জানাল।
লাশ কোথায়?
উধার। সেপাই হাঁটতে শুরু করলে গাড়ি তাকে অনুসরণ করল। ভিড় থেকে বেশ কিছুটা দূরে কাশবনের মধ্যে তিনজন পুরুষ উবু হয়ে বসে ছিল। গাড়ি দেখে তারা উঠে দাঁড়াল। তিনজনেই পাহাড়ের দরিদ্র মানুষ। গাড়ি থেকে নেমে আবীর এবং অর্জুন এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল দুটো শরীর বালির ওপর পড়ে আছে। দু’জনই পাহাড়ি। আবীর দাঁড়িয়ে থাকা তিনটি লোকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, এদের তোমরা চেনো?
তিনজনেই একসঙ্গে মাথা নাড়ল। জিজ্ঞাসা করে আবীর একজনকে কথা বলাল। ওরা কালিম্পংয়ের নীচে একটা গ্রামে থাকে। চাষ করে যা পায় তাতে কোনওমতে ছয় মাস চলে। তাই রাস্তা সারানোর কাজে সেবকের কাছে এসেছিল। সেখানেই এই মেলার কথা শুনে তামাক বিক্রি করতে চলে এসেছিল। ওদের ওখানে তামাকপাতা খুব সস্তায় পাওয়া যায়। কাল বিকেল থেকে তিনটি দোকান করে পাঁচজন তামাক বিক্রি করছিল। খুব ভাল বিক্রি হচ্ছিল। মাঝরাত্রে একটা ভুটানি লোক সব তামাক কিনতে চায় ওই দু’জনের কাছে। দরাদরি করে দাম ঠিক হলে বলে ওর সঙ্গে গিয়ে টাকা নিয়ে আসতে। তিনজন ব্যস্ত থাকায় ঠিক খেয়াল করেনি লোকটাকে। যাওয়ার আগে ওরা তাদের বলে যায় টাকা নিয়ে আসতে যাচ্ছে। সেই যে গেল আর ফিরছে না দেখে এক ঘণ্টা পরে ওরা খোঁজ করতে এদিকে এসে দেখে ওদের লাশ বালিতে পড়ে আছে।
আবীর জিজ্ঞাসা করলেন, ওরা স্বামী-স্ত্রী?
হ্যাঁ। তিনটে বাচ্চা আছে। আর একজন জানাল।
আবীর এগিয়ে গিয়ে মৃতদেহ দুটি দেখতে লাগলেন। তারপর লোকগুলোকে বললেন দুটো শরীরকে উলটিয়ে দেওয়ার জন্য। কিছুক্ষণ দেখার পর আবীর অর্জুনের কাছে এসে বললেন, আশ্চর্য ব্যাপার! ওদের শরীরে কোনও ক্ষতচিহ্ন নেই। রক্তের দাগও দেখা যাচ্ছে না, তা হলে ওরা মারা গেল কী করে!
আপনি তো নিশ্চয়ই ওদের পোস্টমর্টেমে পাঠাবেন। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
অবশ্যই।
তা হলেই জানা যাবে। আপনার যদি আপত্তি না থাকে তা হলে আমি একটু দেখতে পারি? শুধু একটু অভিজ্ঞতার জন্য–। অর্জুন তাকাল।
কী বলছেন? নিশ্চয়ই দেখবেন।
অর্জুন এগিয়ে গিয়ে মৃতদেহ দুটোকে ভাল করে দেখল। আবীর ঠিকই বলেছেন। ক্ষতচিহ্ন দূরের কথা কোথাও রক্তের দাগ নেই। পুরুষটির পরনে গেঞ্জি এবং খাকি হাফপ্যান্ট, নারীর পরনে ব্লাউজ এবং মোটা সায়ার মতো পোশাক। আশপাশের বালির ওপর অনেক পায়ের ছাপ। এগুলো থেকে কিছু বোঝা যাবে না, কারণ ওই তিনজনের পায়ের ছাপও মিশে থাকা স্বাভাবিক।
অর্জুন উলটোদিকে খানিকটা হাঁটতেই কাশবনের মধ্যে গর্ত তৈরি করা পায়ের ছাপ দেখতে পেল। শরীরের ওজন খুব বেশি হলে অথবা ভারী কিছু বয়ে আনলে পা বালিতে বসে যাবে এবং সেইসব পায়ে জুতো ছিল। বাবু হয়ে বসে অর্জুন দেখল যারা হেঁটে এসেছে তাদের একজনের জুতোর বা গোড়ালির ছাপ স্পষ্ট নয়। অর্থাৎ লোকটার ওই গোড়ালির জুতো খয়ে গিয়েছিল। পদচিহ্ন অনুসরণ করে খানিকটা হেঁটেই থমকে গেল অর্জুন। আচমকা বালির ওপর থেকে পায়ের চিহ্ন উধাও হয়ে গিয়েছে। সে ভাল করে লক্ষ করে বুঝতে পারল খুব সন্তর্পণে বালির ওপর থেকে দাগগুলো মুছে দেওয়া হয়েছে। যারা এটা করেছে তাদের ধৈর্য কম ছিল বলে বাকিটুকু অর্জুনের চোখে পড়েছে। এগিয়ে গেলেও আর পায়ের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যাবে না।
অমল সোম, যিনি অর্জুনের গুরু, বলতেন, কখনও শেষ না দেখে ছাড়বে না। ছাই দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না, তার ভেতরেও অমূল্য রতন পড়ে থাকতে পারে।
কথাটা মনে আসতেই অর্জুন এগোল কাশবনের ভেতর দিয়ে। বন যেখানে ঘন সেখানে পৌঁছে দুটো জিনিস চোখে পড়ল। একটা হল, দামি সিগারেটের খালি প্যাকেট। এত দামি সিগারেট খাওয়ার ক্ষমতা এই মেলায় আসা মানুষের আছে কিনা সন্দেহ। জলপাইগুড়ি শহরের সিগারেটের দোকানেও এই প্যাকেট বিক্রি হয় না।
প্যাকেটটা সন্তর্পণে খুলল অর্জুন। চেহারা এবং গন্ধ থেকে প্রমাণ হচ্ছে। ওটা আদৌ পুরনো নয়। দ্বিতীয়টি হল একটা লম্বা সেলোফেন, যা কোনও কিছুর মোড়ক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। লম্বায় অন্তত আট ইঞ্চি, চওড়ায় ছোট এই বস্তুটি কোনও প্যাকেট খোলার সময় ছোঁড়া হয়েছিল। অর্জুন দুটো বস্তুই পকেটে ভরে ফিরে এল। ততক্ষণে মৃতদেহ দুটিকে ভ্যানে তুলে দেওয়া হয়েছে। অর্জুনকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে গিয়ে আবীর বললেন, আমি ওই তিনটে লোককে থানায় নিয়ে যাচ্ছি। ওদের ভাল করে জেরা করা দরকার।
কিছু সন্দেহ করছেন?
অবশ্যই। যারা যারা গিয়েছে তাদের সঙ্গে এদের শত্রুতা ছিল কি না তা জানা দরকার। পাহাড়ি মানুষরা এমনিতে সরল কিন্তু উত্তেজিত হলে সীমা ছাড়িয়ে যায়। ওই মৃত দু’জনের সব তামাক বিক্রি হয়ে গেল অথচ ওদের হল না, এটাও হত্যার কারণ হতে পারে। এমনভাবে জেরা করা হবে যে ওরা মুখ। খুলতে বাধ্য হবে। আবীর ইসলাম হাসলেন, ওরা যদি স্বীকার করে নেয়, তা হলে আমি ঝামেলামুক্ত।
অর্জুন হাসল, যদি স্বীকার না করে?
মানে?
এমনও তো হতে পারে ওরা খুনটা করেনি।
হকচকিয়ে গেলেন আবীর, তা হলে কে করল?
সেটাই তো জানতে হবে। আর ধরুন, মার খেয়ে খেয়ে ওরা বাঁচার জন্য যদি খুনের কথা স্বীকার করে নেয় তা হলেও আদালতে গিয়ে অস্বীকার করতে পারে। তখন প্রমাণ করতে পারবেন? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
আপনি কী বলতে চাইছেন? আবীরের চোখ ছোট হল।
ব্যাপারটা এত সহজ নয় মিস্টার ইসলাম। আমার মনে হচ্ছে এই খুনের সঙ্গে এই তিনটে লোকের কোনও সম্পর্ক নেই। অজুর্ন বলল।
বেশ। তা হলে কাকে আপনি সন্দেহ করছেন?
সবাইকে। কারণ আমি জানি না কে খুনি, শুধু অনুমান করছি, এরা নয়?
আবীর বললেন, আপনি মশাই আমার সমস্যা বাড়িয়ে দিলেন। ঠিক আছে, ওদের অ্যারেস্ট করছি না কিন্তু আমি না বলা পর্যন্ত শহর ছাড়তে নিষেধ করছি। যে-কোনও সময় ওদের প্রয়োজন হতে পারে।
কিন্তু বেচারারা খাবে কী, থাকবে কোথায়? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
ঠিক আছে, থানা চত্বরেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আবীরের কথার মধ্যে অর্জুন দেখল দূরের কাশবনের মধ্য দিয়ে একটা লোক দৌড়ে যাচ্ছে। সে সেপাইদের বলল, লোকটাকে ধরুন তো। জলদি।
বেশিরভাগ সেপাইয়ের এত বড় ভুড়ি থাকে যে দৌড়োতে পারে না। কিন্তু এরা ছিপছিপে হওয়ায় মিনিট তিনেকের মধ্যে লোকটাকে ধরে টানতে টানতে নিয়ে এল। লোকটা একটা অবাঙালি। অর্জুন চিনতে পারল, কদমতলায় রিকশা চালায়। লোকটার হাতে একটা চটের থলে। দারোগাবাবু কড়া গলায় জানতে চাইলেন, তুই কে? কী নিয়ে পালাচ্ছিস?
লোকটা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। ভয়ে কাঁপছিল সে। কথা বলতে পারছিল না। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, তুমি তো রিকশা চালাও, তাই না?
হ্যাঁ বাবু, হাম গরিব আমি হ্যায়। কুছ নেহি জানতা। লোকটা হাতজোড় করল। আবীর জিজ্ঞাসা করলেন, একে চেনেন?
অর্জুন বলল, রিকশা চালাতে দেখেছি। এই যে, তুমি দৌড়োচ্ছিলে কেন?
ডরমে। পুলিশকে দেখা!
লোকটিকে জেরা করে জানা গেল সে সারা রাত ছটপুজোর এই মেলায় ছিল। শেষরাতের দিকে তার পেট কামড়ায়। মেলার মধ্যে প্রাকৃতিক কর্ম করা সম্ভব নয় বলে সে এদিকের কাশবনের ভেতরে চলে এসেছিল। কর্ম শেষ করে তিস্তার জলে পরিষ্কার হয়ে সে দেখতে পায় কাশবনের মধ্যে একটা চটের থলি পড়ে আছে। সে অবাক হয়ে ওটা খুলে অনেকটা তামাক দেখতে পায়। ওরকম জায়গায় থলিতে তামাক পড়ে থাকতে দেখে তার লোভ হয়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন সে দেখল মালিক ফিরে আসছে না তখন থলিটাকে তুলে নিয়ে সে এগোতে গিয়ে দুরে পুলিশের গাড়ি দেখতে পায়। দেখে সে এমন ভয় পেয়ে যায় যে দৌড়ে পালাতে থাকে। লোকটি বারবার বলে এই থলি নেওয়া ছাড়া সে অন্য কোনও অন্যায় করেনি।
অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, এখানে অন্য কোনও লোকদের তুমি দেখেছ।
নেহি বাবু, কোই নেহি থা। লোকটা মাথা নাড়ল।
অর্জুন আবীরকে বলল, আমার মনে হচ্ছে ও মিথ্যা বলছে না।
মৃতদেহ দুটি ভ্যানে তুলে দিয়ে আবীর বললেন, আমার কপালে স্বস্তি নেই। কে ওদের খুন করল তাই বুঝতে পারছি না। আমার এখনও বিশ্বাস ওই সঙ্গীগুলোই দায়ী।
ওরা দায়ী কি না জানি না, তবে একটা ব্যাপারে ওরা সাহায্য করতে চায়।
কীরকম?
যে লোকটা দরদাম করে প্রলোভন দেখিয়ে হতভাগ্য দু’জনকে এখানে নিয়ে এসেছিল তার চেহারার বর্ণনা আপনি এদের কাছ থেকে পেতে পারেন।
দারুণ বলেছেন। আপনি কি এখন বাড়ির দিকে যাবেন?
না। একটু হাঁটব। অর্জুন বলল।
সরি, আপনাকে বোধহয় কষ্ট দিলাম! নমস্কার।
পুলিশের গাড়ি দুটো, মৃতদেহ দুটো এবং লোকগুলোকে নিয়ে চলে গেল। অর্জুন হেঁটে মেলার দিকে চলে আসতে আসতে থমকে দাঁড়াল। আবার সেই জুতোর দাগ দেখা যাচ্ছে, যার গোড়ালি খয়ে গিয়েছে। লোকটা যখন মেলার দিকে যাচ্ছিল তখনকার জুতোর ছাপ। অর্থাৎ খুনিরা কাশবনের আড়ালে বসে প্ল্যান করে যাদের খুন করবে তাদের ডেকে এনেছে।
.
ঠেলাগাড়িতে জিনিসপত্র চাপিয়ে পুজো শেষ করে ফিরে যাচ্ছে ভক্তরা কাসর ঘণ্টা বাজিয়ে। সদ্য ওঠা সূর্যের আলোয় এখনও কেউ কেউ তিস্তার জলে ডুব দিচ্ছে। একটা রাতের জন্য সাজানো দোকানগুলো এখন বন্ধ হতে হতেও কেনাবেচা চলছে তাড়াহুড়ো করে। ঘুরতে ঘুরতে অর্জুনের চোখ পড়ল যে মানুষটার ওপর সে ভারতীয় নয়। পোশাকই বলে দিচ্ছে লোকটা এসেছে ভুটান থেকে। কিন্তু কোনও ভুটানি বিদেশি মেলায় এসে একা দাঁড়িয়ে থাকবে না। অখচ এই লোকটা আছে। তিস্তার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে লোকটা কী লক্ষ করছে তা অৰ্জুন বুঝতে পারল না।
মুখ ঘোরাতেই সেই রিকশাওয়ালাটাকে দেখতে পেল অর্জুন। বেশ দ্রুত হেঁটে চলেছে ভিড়ের মধ্য দিয়ে। লোকটাকে ডাকতে গিয়েও থেমে গেল অর্জুন। কারণ ততক্ষণে ভুটানির সামনে পৌঁছে বেশ উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা বলতে শুরু করেছে রিকশাওয়ালা। পূর্বপরিচয় ছাড়া এই ভঙ্গিতে কথা বলা যায় না। ভুটানিও একটুও উত্তেজিত না হয়ে মাথা নাড়তে লাগল। কথা বলার পর উত্তেজনা কমে এলে রিকশাওয়ালা ভুটানিকে নিয়ে হাঁটতে লাগল। মেলার বাইরে তিস্তার বালির চরে অনেকগুলো রিকশা-সাইকেল দাঁড় করিয়ে রাখা আছে। রিকশাওয়ালা সেখানে গিয়ে একটা রিকশার তালা খুলে এগিয়ে এলে ভুটানি তাতে উঠে বসল। এখন বালি শক্ত হয়েছে, বাড়তি জোর দিয়ে চালাতে হচ্ছিল রিকশাওয়ালাকে। ওটা বাঁধের দিকে চলে গেল। অর্জুনের মনে হল এই লোকটাকে যতটা সরল ভেবেছিল ও তা নয়। নইলে একজন ভুটানির সঙ্গে ঝগড়া করবে কেন? করার পরে তাকে রিকশায় বহন করল কী কারণে?
.
পুরোটা পথ হেঁটে এল অর্জুন। ভোরের না হঁটাটা পুষিয়ে নিতে চাইছিল সে। কদমতলায় পৌঁছে মনে হল বাড়িতে চা না খেয়ে মোড়ের দোকান থেকে চা খাওয়া যাক। যে-কোনও চায়ের দোকানে ভোরের চা ভাল হয়।
চায়ের দোকানের সামনে পৌঁছে চোখে পড়ল উলটোদিকের চৌধুরী মেডিকেল স্টোর্সের ঝাঁপ খুলছেন রামদা। এই মানুষটি তাকে খুব স্নেহ করেন। কিন্তু সকাল আটটায় তো এই দোকান খোলা হয় না। সে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার। আজ সাততাড়াতাড়ি চলে এসেছেন?
ও অর্জুন!’ সাততাড়াতাড়ি কোথায়। ন’টাই তো বাজে। রামদা দোকানে ঢুকে ডাস্টার হাতে ধুলো পরিষ্কার করতে লাগলেন, এসো।
আপনার হাতের ঘড়ি এক ঘণ্টা এগিয়ে গেছে। অর্জুন হাসল।
একবার হাতঘড়ি, অন্যবার দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে রামদা জিভ বের করলেন, দেখেছ কাণ্ড! কাল রাত ন’টায় হাতঘড়ি যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তা নজর করিনি। ঘড়িতে চাবি দিতে দিতে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তা তুমি এই অসময়ে এখানে?
চা খেতে এসেছিলাম। অর্জুন চেঁচিয়ে চা-ওয়ালাকে বলল, রতনদা দুটো চা।
দোকানের মধ্যে অর্জুনের জন্য একটা আলাদা চেয়ার আছে। সেটায় বসে অর্জুন বলল, আজ ভোরে ছটমেলায় গিয়েছিলাম। গিয়েছিলাম, কারণ থানার নতুন দারোগাবাবু অনুরোধ করলেন যেতে, দুটো খুন হয়েছে সেখানে।
মাথা নাড়লেন রামদা, ব্যস, দুটো খুন হয়েছে শুনেই তুমি ছুটলে ওখানে। আচ্ছা অর্জুন, তুমি কবে একটু নিজের ব্যাপারে প্র্যাকটিক্যাল হবে বলো তো? কোথাকার কোন দুটো লোক খুন হয়েছে, তুমি যদি এর সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে খুনিকে ধরে দাও তা হলে তুমি কী পাবে? কে টাকা দেবে তোমাকে? এটা তো তোমার প্রফেশন!
অর্জুন হাসল, ঠিকই বলেছেন, কিন্তু খবরটা কানে এলে মন উসখুস করল।
রামদা বললেন, তোমাকে বলি, কলকাতায় না যাও, অন্তত শিলিগুড়িতে গিয়ে একটা চেম্বার খোলো। বড়লোক হয়ে যাবে রহস্যের সমাধান করতে করতে।
চা দিয়ে গেল রতনের দোকানের ছেলেটা। পকেটে হাত ঢুকিয়ে টাকা বের করতে গিয়ে সেলোফেনের খাপটা বেরিয়ে এল। রামদা ততক্ষণে চায়ের দাম দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করলেন, ওটা কী?
তিস্তার চরে যেখানে মৃতদেহ দুটো পড়ে ছিল তার কিছুটা দূরে কাশবনের ভেতর থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিলাম। এখানে এটা থাকার কথা নয়। অর্জুন বলল।
দেখি। রামদা হাত বাড়িয়ে লম্বাটে সেলোফেনের কভার নিয়ে উলটেপালটে দেখে বললেন, সর্বনাশ! আমার যা সন্দেহ হচ্ছে সেটা হলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে!
কী সন্দেহ করছেন আপনি? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
দাঁড়াও। রামদা হাত বাড়িয়ে একটা নতুন ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ বের করে পাশাপাশি রাখলেন। বললেন, অর্জুন, মনে হচ্ছে সন্দেহটা ঠিক হতে পারে। ব্যবহার করা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ নষ্ট করে দেওয়াই নিয়ম, যাতে সংক্রামক রোগ না ছড়ায়। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা সেগুলো সেলোফেনের নতুন মোড়কে ভরে আবার বিক্রি করছে। আমার দোকানেও ওই জাল ইঞ্জেকশনের খোঁজে লোক আসে কারণ তার দাম অনেক কম।
কিন্তু ব্যবসায়ীরা ব্যবহৃত ইঞ্জেকশন কোথায় পায়? অর্জুন তাকাল।
হাসপাতাল থেকে সংগ্রহ করে। ওখানেও তো অসাধু লোক কাজ করে।
.
রামদা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন খদ্দের চলে আসায়। অর্জুন চোখ বন্ধ করল। ওই কাশবনের মধ্যে সেলোফেন ছিঁড়ে ইঞ্জেকশন বের করার কী প্রয়োজন। হয়েছিল? দেখেই বোঝা যায় এটা কাশবনে কয়েক ঘণ্টা আগেও ছিল না। কারও শরীরে ওষুধ দেওয়ার জন্য ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জের দরকার হয়। ওখানে সেই দরকার তো থাকার কথা নয়।
মাথামুন্ডু বুঝতে পারছিল না অর্জুন। বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে শুনতে পেল অমল সোমের কাজের লোক হাবু এসেছিল। একটা চিরকুট দিয়ে গেছে। তাতে লেখা, অর্জুন, চলে এসো। অমলদা।
মা জিজ্ঞাসা করলেন, অমল ঠাকুরপো এসেছেন, আমাকে বলিসনি তো।
আমিই জানতাম না। হয়তো কাল রাত্রে এসেছেন। হাবু আর কিছু বলেছে?
অদ্ভুত ব্যাপার! হাবু কি কথা বলতে পারে যে বলবে?
একটু কিছু খেতে দাও, অমলদার বাড়িতে যাব।
.
এবার বাইক নিয়ে বের হল অর্জুন। অমল সোম তার গুরু। তিনি একসময় সত্যসন্ধানী হিসেবে সক্রিয় ছিলেন। হঠাৎ কী হল, জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়ার বাড়ি তার দীর্ঘকালের বোবা পরিচারক হাবুর দায়িত্বে রেখে দেশ দেখতে বেরিয়ে পড়েন। প্রথমে মনে হয়েছিল তিনি সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করবেন। কিন্তু মাঝে মাঝেই ফিরে আসেন এবং জানান, তিনি ঘুরে বেড়ান মানুষের বিচিত্র জীবন দেখতে।
হাকিমপাড়ার প্রান্তে অমল সোমের বাড়ির বাগানে গেট খুলে বাইকটাকে ঢুকিয়ে অর্জুন দেখল বাড়ির বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে আছেন তিনি। কোলে বই। গলা তুলে বললেন, চলে এসো অর্জুন, তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।
কাছে গিয়ে অমল সোমের পা ছুঁয়ে হাত মাথায় ঠেকিয়ে অর্জুন হাসল।
কীরকম?
আগে বসো। কেমন আছ তা বলো। অমল সোম সোজা হলেন।
মোটামুটি। অনেকদিন কোনও কেস পাইনি। অর্জুন বলল, কেউ কেউ বলছে আমি যদি শিলিগুড়িতে গিয়ে চেম্বার করি, তা হলে অনেক কেস পাব।
গুড। যাচ্ছ না কেন?
আপনি বলছেন?
দ্যাখো, শান না দিয়ে ফেলে রাখলে অস্ত্রের ধার ভোঁতা হয়ে যায়। সত্যসন্ধান করতে গেলে মগজের ব্যবহার জরুরি আর সেটা নিত্যব্যবহারে ধারালো হয়ে ওঠে। তোমার শিলিগুড়িতেই চেম্বার খোলা উচিত। অমল সোম বললেন।
অর্জুন কথা ঘোরাল, আপনি এবার অনেকদিন পরে এলেন।
ডালহৌসিতে ছিলাম। চমৎকার জায়গা। হঠাৎ নিউইয়র্ক থেকে মেজর সাহেবের ফোন এল। তিনি ভারতে আসছেন এবং তাঁর প্রিয় জায়গা হল জলপাইগুড়ির এই বাড়ি। এর আগেরবার আমি ছিলাম না বলে তার খারাপ লেগেছিল এবার আমাকে থাকতে হবে। ফলে চলে এলাম। অমল সোম বললেন।
অর্জুনের চোখ বড় হল, তার মানে মেজর আসছেন?
অমল সোম মাথা নাড়লেন, অর্জুন, সত্য শুধু চোখ দিয়ে সন্ধান করলেই পাওয়া যায় না, কান দিয়েও জানতে হয়। তুমি কানের ব্যবহার এখনও করতে পারছ না। চুপচাপ কান পেতে শোনো, কিছু শুনতে পাচ্ছ কি না ভাবো।
অর্জুন যাকে বলে কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল। বহুদূরে যেন মৌমাছিরা চাক ঘিরে গুনগুন করছে। সে হাসল, আপনার বাড়িতে মৌমাছিরা মৌচাক তৈরি করেছে?
অনেকটা সেইরকম বটে। তবে মৌমাছিরা নয়, যাও ভেতরে গিয়ে দেখে এসো শব্দটার উৎপত্তি কোথায়!’ অমল সোম হাসলেন।
অর্জুন ভেতরে ঢুকল। উঠানের ওপাশের ঘরের দরজা হাট করে খোলা। সেখানে পৌঁছে হতভম্ব হয়ে গেল সে। বিছানায় চিত হয়ে বিশাল শরীর ছড়িয়ে শুয়ে আছেন মেজর। শব্দটা বের হচ্ছে তার নাক-মুখ থেকে। মেজরকে দীর্ঘকাল চেনে সে। আগে ঘুমিয়ে পড়লে মেজরের নাক থেকে বাঘ-সিংহের গর্জন বের হত। কিন্তু সেটা যে এভাবে বদলে যাবে তা কল্পনাও করা যায় না। এখন অনেকগুলো মৌমাছির গুনগুনানি ওঁর নাক মুখ থেকে বের হয়ে আসছে।
অর্জুন কাছে গিয়ে নিচু গলায় ডাকল, মেজর!
গুডমর্নিং মেজর। গভীর ঘুমে ডুবে থাকা মেজরের কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। তার নাক-মুখ থেকে নির্গত হওয়া শুধু গোঁফ এবং দাড়ির জঙ্গলে মৃদু আলোড়ন তুলে যাচ্ছিল। অর্জুন মানুষটাকে আর বিরক্ত না করে বাইরে বারান্দায় ফিরে গিয়ে দেখল অমল সোম আবার বই পড়ছেন। মুখ তুলে বললেন, ঘুম ভাঙাতে পারোনি তো?
না। কিন্তু–!
ওঁর নাক ডাকার আওয়াজ বদলে গেছে, তাই তো?
হ্যাঁ।
বয়স বেড়ে গেলে মানুষের ঘুম কমে যায় বলে একটা ধারণা চালু আছে। শরীরের বিভিন্ন অসুবিধা তার একটা কারণ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে মেজরের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়। তিনি ধূমপান এবং মদ খাওয়া ত্যাগ করেছেন। এর ফলে তাঁর যেমন ওজন বৃদ্ধি হয়েছে তেমনি ঘুমও বেড়ে গেছে। ওইসব যখন খেতেন তখন ওঁর নাসিকা বাঘের মতো গর্জন করত আর ছেড়ে দেওয়ার পর মৌমাছির মতো গুনগুন করছে। লক্ষ করছি ওঁর মন থেকে সেই আগের আগ্রহ-উৎসাহ ভাবটা প্রায় চলে গেছে, অথচ উনি এ দেশে এসেছেন একটি কাজের দায়িত্ব নিয়ে। যাকগে, তোমার মা ভাল আছেন তো? অমল সোম জিজ্ঞাসা করলেন।
হ্যাঁ। মা ভাল আছেন। আপনি কিছুদিন থাকছেন তো?
দেখি।
আজ তিস্তার চরে গিয়েছিলাম। থানার বড়বাবু নিয়ে গিয়েছিলেন–।
অমল সোম কৌতূহলী হয়ে তাকাতে অর্জুন ব্যাপারটা তাকে জানাল।
সব শুনে অমল সোম বললেন, যেখানে সেলোফেনের মোড়ক পেয়েছিলে তার আশপাশের জায়গাটা খুঁজে দেখেছিলে?
দেখেছিলাম কিন্তু নজরে পড়েনি।
দ্যাখো, যদি ওর ভেতরে ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ থাকত তা হলে তা ব্যবহার করার পর ফেলে দেওয়াই তো স্বাভাবিক হত। ওটা ব্যবহার করার পর তো কেউ বাড়িতে নিয়ে যায় না। আচ্ছা, তিস্তার নির্জন কাশবনে বসে কেউ ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ ব্যবহার করবে কেন? অমল সোম তাকালেন।
প্রশ্নটা মাথায় আসেনি অর্জুনের। সে মাথা নাড়লে অমল সোম বললেন, এই প্রশ্নের উত্তর ওই সিরিঞ্জটা পাওয়া গেলে জানা যেত।
অর্জুন উঠে দাঁড়াল, আমি আর একবার ভাল করে দেখে আসছি। অমল সোম বইয়ের দিকে চোখ ফেরালে অর্জুন বেরিয়ে এসে তার বাইকে উঠে বসল।
এখন তিস্তার চর একদম ফাঁকা। কে বলবে কাল সারারাত এখানে প্রচুর মানুষ ভিড় করে মেলা জমিয়েছিল। এক রাতের দোকানপাট তুলে নিয়ে গিয়েছে ব্যাপারীরা। বার্নিশের কাছে তিস্তার সামান্য জল বয়ে চলেছে চুপচাপ। অর্জুন বাইক চালিয়ে চলে এল অনেকটা চর পেরিয়ে সেই কাশবনের জঙ্গলের কাছে। বাইকটাকে দাঁড় করিয়ে সতর্ক চোখে বালি এবং কাশবনের গোড়া দেখতে দেখতে সে এগোতে লাগল জলের ধারার দিকে। প্রায় কুড়ি মিনিট তল্লাশি চালিয়ে যখন কিছুই পাওয়া গেল না ঠিক তখনই একটা বড় চেহারার দাঁড়কাক কর্কশ চিৎকার করল। কাল রাতে মেলায় ফেলে যাওয়া খাবারের লোভে ভিড় জমিয়েছে কাকগুলো। তাদের একটা এসে বালি থেকে কিছু তোলার চেষ্টা করছে। সেদিকে পা বাড়াতেই কাকটা উড়ে গেল অন্যদিকে। কাছে গিয়ে অর্জুন সিরিঞ্জটাকে দেখতে পেল। একটা নয়, দু দুটো। দ্বিতীয়টির মোড়ক ধারেকাছে নেই। দ্বিতীয়টি আকৃতিতে বেশ বড়। দুটোর ভেতর কালচে লাল দাগ রয়েছে। অর্জুন পকেট থেকে রুমাল বের করে তার মধ্যে সিরিঞ্জ দুটো তুলে বাইকের কাছে ফিরে গেল।
বাইকে বসে সে হাসল আপন মনে। কথাটা ঠিক, পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। অমল সোমের কাছে তার সত্যসন্ধানের হাতেখড়ি। অমল সোম আধ্যাত্মিক জীবনে আকৃষ্ট হওয়ার পর থেকে সে একাই কাজটা করে যাচ্ছে। এবং এখন পর্যন্ত সে ব্যর্থ হয়নি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তার মাথায় যেটা আসেনি সেটা অমল সোম না ভেবেই বলে দিলেন। ডিসপোজাল সিরিঞ্জের খাপ পড়ে থাকলে আশপাশেই যে সিরিঞ্জটাকেও পাওয়া যেতে পারে এই ভাবনাটা তার মাথায় কেন আসেনি? অভিজ্ঞতার অভাবে? অর্জুন নিজেকে ভর্ৎসনা করল, তাকে আরও সতর্ক হতে হবে। অমল সোমের বাড়ির বারান্দায় হাবু চা পরিবেশন করছিল। গেট খুলে অমল সোমের পাশে বসা মেজরকে দেখতে পেয়ে অর্জুন গলা তুলল, গুডমর্নিং। কেমন আছেন মেজর?
মেজর মাথা নাড়লেন। আগেরবার যখন এসেছিলেন তখন প্রথম দেখা হওয়ার সময় আনন্দে চিৎকার করে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এক বছরেই এমন পরিবর্তন কী করে হল।
বারান্দায় তৃতীয় চেয়ারে বসে অর্জুন মেজরকে জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছেন।
প্রায় মিনমিনে গলায় মেজর বললেন, আমি কি আদৌ আছি? এটাকে কি থাকা বলে? ডাক্তাররা আমার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে হে।
মেজরকে কখনওই এই গলায় কথা বলতে শোনেনি অর্জুন। হাবুর বাড়িয়ে দেওয়া চায়ের কাপ নিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, ডাক্তার? আপনি কি অসুস্থ হয়েছিলেন? যদি হয়েও থাকেন তা হলে ডাক্তার তো সুস্থ করবে।
ছাই করবে। আমার শরীর মোটেই খারাপ ছিল না। এবার ওই ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির ডাক্তারি পরীক্ষা করতে বলায় ডাক্তার হুকুম দিল ধূমপান ছাড়তে হবে। এমনকী পান করাও চলবে না। শরীরে কোনও রোগ না থাকলেও এই বয়সে নাকি এগুলো ক্ষতিকর। ছেড়েছুঁড়ে ওজন বেড়ে যাচ্ছে, দুর্বল হয়ে পড়ছি দিন দিন। শব্দ করে শ্বাস ফেললেন মেজর।
মানুষটার অবস্থা একটুও পছন্দ হল না অর্জুনের। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে। সেটা নামিয়ে পকেট থেকে রুমালে জড়ানো সিরিঞ্জ দুটো বের করে অর্জুন অমল সোমের দিকে এগিয়ে দিল, এই দুটো পেয়েছি।
হাত বাড়িয়ে সিরিঞ্জ দুটো নিয়ে আলোর দিকে তুলে দেখলেন অমল সোম। তারপর চিন্তিত গলায় বললেন, এই দুটো কোনও ল্যাবে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করিয়ে দ্যাখো তো, মনে হচ্ছে রক্ত শুকিয়ে আছে।
রক্ত? অর্জুন অবাক হল।
যদি আমি ভুল করি। অমল সোেম পেছনে চাপ দিয়ে সুচ আঙুলের ওপর রাখলেন, কিছুই বের হল না কারণ কালচে লাল বস্তুটি তরল অবস্থায় নেই।
মেজর সোজা হয়ে বসলেন, স্বাভাবিক। দু-দুটো ডিসপোজাল সিরিঞ্জের ভেতরে রক্ত থাকা মানে পরীক্ষার জন্য রক্ত নেওয়া হয়েছিল।
পরীক্ষার জন্য যে রক্ত নেওয়া হয় তা সিরিঞ্জের সামান্য অংশে থাকে, পুরোটা ভরতি করা হয় না। তুমি একটা ল্যাবে এই দুটো নিয়ে যাও। সিরিঞ্জ দুটো ফেরত দিয়ে অমল সোম বললেন, পেপাস্টমর্টেম রিপোর্ট যদি জানতে পারো তা হলে আমাকে জানিয়ো। ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং।
অর্জুন ঘড়ি দেখল। দিনবাজারে অসীমের বাবার প্যাথলজি সেন্টারের খ্যাতি আছে। বাড়ি ফেরার পথে সিরিঞ্জ দুটো ওখানে দিয়ে গেলেই হবে। অর্জুন মেজরের দিকে তাকাল, আপনি নিশ্চয়ই কিছুদিন থাকবেন।
ইট ডিপেন্ডস। দাড়িতে আঙুল বোলালেন মেজর। অর্জুন হেসে গদগদ। প্রায় সত্তরে পৌঁছেও কালো-সাদা দাড়ির ওপর মেজরের মমতা চলে যায়নি। অনেক পরিবর্তন হলেও এই দাড়িতে আঙুল বোলানোর অভ্যাসটা থেকে গেছে।
কীসের ওপর নির্ভর করছে? সে জিজ্ঞাসা করল।
নিউইয়র্কে আমাদের সোসাইটির হয়ে একজনের আগামীকাল এখানে আসার কথা। দিল্লি হয়ে বাগডোগরায় নামবে। তারপর বাইরোড ফুন্টশলিং হয়ে থিম্পু যাবে। আমাকেও সঙ্গী হতে হবে। ফেরার পথে আমি কয়েকদিন এখানে থেকে যাব বলে ভেবেছি। কথা শেষ করতেই সামনের পেয়ারা গাছের মগডালে বসে একটা পাখি চিৎকার করে উঠল। মেজর তৎক্ষণাৎ কানের পাশে হাত নিয়ে গিয়ে দ্বিতীয়বারের চিৎকারটা শুনলেন। তারপর হেসে বললেন, মিস্টার সোম, ইনি এখানে এলেন কী করে?
অমল সোম বই থেকে মুখ তুললেন, পাখিটা আপনার পরিচিত?
অফকোর্স। ওর থাকা উচিত সাত থেকে বারো হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ে। পেয়ারা পাতার আড়ালে বসে আছে বলে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ওর গায়ের রং হওয়া উচিত হলুদ, মাথা কালো। একটা দাঁড়কাকের সাইজ হবে পাখিটার। অর্জুন–’ মেজর কথা শেষ করতে পারলেন না। কারণ পাখিটা উড়ে গিয়ে দূরের নারকেল গাছের ওপর বসল এবং দেখা গেল মেজরের দেওয়া বর্ণনা সঠিক।
অমল সোম বললেন, সম্ভবত পাহাড়ে খাবারের অভাব দেখা দেওয়ায় ওটা নীচে নেমে এসেছে। তবে স্বীকার করতেই হবে আপনি পক্ষীবিশারদ। তারপর অর্জুনের দিকে তাকালেন তিনি। তুমি যদি ফ্রি থাকো তা হলে কাল মেজরকে নিয়ে বাগডোগরা এয়ারপোর্ট যেতে পারবে?
মেজর মাথা নাড়লেন, আমার যাওয়ার তো দরকার নেই। অর্জুন যদি ওদের রিসিভ করে এখানে নিয়ে আসে তা হলেই ভাল হয়।
অর্জুন বুঝতে পারল তাকে বাগডোগরাতে যেতেই হবে। সে জিজ্ঞাসা করল, কারা আসছেন?
মেজর বললেন, নাতাশা, নাতাশা স্মিথ। রুমানিয়ার মেয়ে ওর মা, বিয়ে করেছিলেন আমেরিকার খুব বড় ব্যবসায়ী উইলিয়াম স্মিথকে। কিন্তু নাতাশা ও দেশের তরুণ বিজ্ঞানীদের মধ্যে খুব নাম করেছে। জমে যাওয়া রক্তকে কী করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া যায় তা নিয়ে গবেষণা করে অনেকটা এগিয়ে নিয়েছে।
অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, উনি কি বেড়াতে আসছেন?
না হে। ও ভুটানে যাবে। ওর গবেষণার কাজে ডিটেলসটা আমাকে বলেনি। যেহেতু আমি বারবার এদিকে আসি, তাই আমাদের সোসাইটি থেকে অনুরোধ করেছে ওকে সাহায্য করতে। বাচ্চা মেয়ে, ভাল কাজ করছে, তাই রাজি হয়ে গেলাম। তুমি যদি ওকে রিসিভ করে নিয়ে আসো তা হলে আমি হাবুর সঙ্গে কাল তিস্তায় মাছ ধরতে যেতে পারি। মেজর খুব শান্ত গলায় কথাগুলো বললেন।
অমল সোম তাকালেন, কোথায় মাছ ধরবেন? তিস্তা না করলায়?
কী যে বলেন! করলা তো এখন মজে যাওয়া খাল। তিস্তায় যাব।
বাঃ। যদি মাছ ধরতে পারেন তা হলে জানবেন ওটা পাহাড়ি মাছ।
তার মানে? চোখ ছোট করলেন মেজর।
তিস্তার উৎস সিকিমে। অমল সোম উঠে দাঁড়ালেন।
.
অসীমের বাবার প্যাথলজি সেন্টারে সিরিঞ্জ দুটো দিতেই তিনি একটু অপেক্ষা করতে বললেন। বেশ ভিড় হয় এখানে। অর্জুন দেখছিল কত মানুষ শরীরের অসুখ নির্ধারণ করতে মল-মূত্র-রক্ত পরীক্ষা করাতে এখানে এসেছে। অথচ বাইরের চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই যে তারা অসুস্থ। মিনিট কুড়ি পরে অসীমের বাবা তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই দুটো কোথায় পেলে তুমি? অদ্ভুত তো।
কেন?
দুটো সিরিঞ্জেই রক্ত ছিল। একটা ও প্লাস, দ্বিতীয়টা এ প্লাস।
আপনি নিশ্চিত? হাসলেন ভদ্রলোক, এই নিয়েই তো গত তিরিশ বছর আছি। কিন্তু কেউ যদি রক্ত পরীক্ষা করতে সিরিঞ্জে টানে সে কখনওই পুরোটা ভরাবে না। তা ছাড়া সিরিঞ্জে রক্ত ঢুকেছে গত বারো ঘণ্টার মধ্যে। আমরা ছাড়া আরও দুটো প্যাথলজি সেন্টার শহরে আছে। আমাদের এখানে তো কেউ বাইরে থেকে এই গ্রুপের রক্ত জমা দেয়নি। একটু দাঁড়াও। অসীমের বাবা ঘরের ওপাশে টেবিলের ওপর রাখা টেলিফোনের রিসিভার তুলে কথা বলতে লাগলেন। মিনিট তিনেক পরে কাছে এসে বললেন, ব্যাপারটা রহস্যজনক। ফোন করে জানলাম বাকিরাও একই কথা বলছে। কেউ এরকম রক্ত পরীক্ষার জন্য ওদের কাছে নিয়ে যায়নি।
অসীমের বাবাকে এই পরীক্ষার জন্য কত দিতে হবে জিজ্ঞাসা করাতে অর্জুনকে ছোট্ট ধমক খেতে হল। সিরিঞ্জ দুটো সঙ্গে নিয়ে সে বাড়ি ফিরে এল।
দুটো ব্যাপার তাকে অস্বস্তিতে ফেলছিল।
এক, মৃতদেহ দুটো পাওয়া গেছে যেখানে তার কাছাকাছি কেন এই সিরিঞ্জ দুটো পাওয়া গেল যার ভেতরে রক্ত ছিল? ওই মৃতদেহের কোথাও ক্ষতচিহ্ন নেই বলে মনে হয়েছিল তখন, তা হলে কি ওদের মৃত্যুর পেছনে সিরিঞ্জ দুটোর ভূমিকা ছিল। ধরে নেওয়া যাক, ছিল। তা হলে কেন ব্যবহার করার পর ওরা সিরিঞ্জ দুটো ফেলে যাবে। অর্জুনের মনে হল ওই দেহ দুটির পোস্টমর্টেম হলেই মৃত্যুর কারণ বোঝা যাবে। ততক্ষণ অপেক্ষা করাই উচিত। তারপরেই মনে হল, সে কেন এই ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে? যদি এর পেছনে কোনও রহস্য থাকে তা হলে সেটার সমাধান করতে পারলে তাকে তো কেউ পারিশ্রমিক দেবে না।
দুই, মেজরের এই ব্যাপক পরিবর্তন মেনে নিতে পারছিল না অর্জুন। সবসময় হইহই করে কথা বলা, হাঁকডাক করা মানুষটা এত মিইয়ে গেলেন কী করে। যে মানুষটা বেয়াদব পাখিদের বিদঘুঁটে ভাষায় চিৎকার করে গালাগাল দিতেন তিনি আজ ভয়ংকর শান্ত। কেন? মেজরের এই পরিবর্তন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না অর্জুন। কয়েক ডজন রহস্য সন্ধানে মেজর তার স্বভাবসুলভ আচরণ নিয়ে সঙ্গী হয়েছেন। কিন্তু তার সঙ্গে আজ ওঁর কোনও মিল নেই।
.
দুপুরের পর থানা থেকে ফোন এল। অ্যাসিস্টেন্ট সাব-ইনসপেক্টর বললেন, বড়সাহেব একটু আগে জরুরি কাজে কলকাতায় চলে গিয়েছেন। আমাকে বলেছেন, আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। আমি অসিত বসু।
দারোগাবাবু চলে যেতেই পারেন। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার বলুন?
পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছে। ওই যে আজ যে দু’জনের ডেডবডি পাওয়া গেল–।
আমি আসছি।
থানায় পৌঁছে অসিত বসুকে দেখল অর্জুন। ইনিও এই থানায় নতুন। মধ্যবয়সি, দেখেই মনে হয় ওঁর কোনও উচ্চাশা নেই।
অসিত বসু বললেন, পোস্টমর্টেমে কিছুই পাওয়া যায়নি। ছুরিগুলোর কোনও দাগ নেই। পেটে বিষও পাওয়া যায়নি। দুটো লোক একসঙ্গে হার্টফেল করতে পারে না। তাই এদের মৃত্যু একটু রহস্যজনক হলেও কাউকে সন্দেহ করা যাচ্ছে না।
লোক দুটোর পরিচয় জানতে পারা গেছে? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
একদম না। তবে ব্যাপারটা স্বাভাবিক। রহস্যজনকভাবে কেউ মরলে লোকে এড়িয়ে যায়, চিনতেও পারে না। আপনাকে বড়সাহেব ব্যাপারটা জানাতে বলে গেছেন। জানিয়ে দিলাম। আমরা কয়েকদিন ডেডবডি মর্গে রেখে দিয়ে পুড়িয়ে দেব। এইসব আইডেন্টিফাই করতে না পারা বডি আনক্লেইন্ড থাকে। অসিত বসু বলল।
ও। অর্জুন মাথা নাড়ল কিন্তু চেয়ার ছেড়ে উঠল না।
একটা কথা। বড়সাহেব কেন আপনাকে খবরটা দিতে বললেন তা বুঝতে পারছি না।
সেটা ওঁকেই জিজ্ঞাসা করলে পারতেন।
তাড়াহুড়োর মধ্যে ছিলেন তো–, আপনি ডিপার্টমেন্টের কেউ নন, তাই?
একদম না। আপনি আপনার কাজ সঠিকভাবে করেছেন। কিন্তু এখন আমি কয়েকটি তথ্য আপনার কাছ থেকে জানতে চাইব। লোক দুটো কি বাঙালি না এলাকার আদিবাসী? ছটপুজোয় এসেছিল বলে বিহারি হলেও হতে পারে। ঠিক কোনটা?
এই রে। দাঁড়ান পাঁড়েজিকে ডাকছি। ও সবসময় সঙ্গে ছিল। অসিত বসু উঠলেন।
পাঁড়েজি এলেন। এই থানার সেপাই। ঘরে ঢুকে অর্জুনকে নমস্কার জানালেন তিনি। বলুন স্যার।
অসিত বসু সেটা লক্ষ করে গম্ভীর হলেন।
প্রশ্নটা অর্জুন আবার করলে পাঁড়েজি বললেন, এরা এখানকার লোকই না। পাহাড়ের গরিব মানুষ। টাউনের সবাই জেনে গেছে কিন্তু কেউ এসে বডি সেই কারণে দেখতে চায়নি।
পাহাড়ের লোক মানে ঠিক কী? নেপালি, সিকিমিজ, ভুটানি?
ভুটানি না। নেপালি বলেও মনে হয় না। আর সিকিমের লোক ছটপুজোয় আসবে না।
তা হলে কোন পাহাড়ের লোক?
স্যার, আমি বুঝতে পারছি না। তবে ওর পাশের দোকানদার, যাদের বড়সাহেব ধরে এনেছেন তারা লেপচা। ওরা বলছে ওদের নাকি আগে দ্যাখেনি। পাহাড়ের রাস্তা সারাইয়ের কাজ করে ওরা। রোজগার বাড়াবার ধান্দায় ছটপুজোয় তামাক নিয়ে আসছিল। পাঁড়েজি বললেন।
অর্জুন এবার অসিতবাবুকে বলল, আপনি পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা পড়েছেন?
মুখস্থ।
রিপোর্টে কি ওদের শরীরের রক্ত নিয়ে কোনও কথা বলা হয়েছে?
চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করলেন ভদ্রলোক। তারপর উঠে একটি বিশেষ ফাইল বের করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই পড়লেন, খানিকটা। তারপর বললেন, হা। এটা অবশ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট নয় বলে আমি ইগনোর করেছিলাম। বলা হয়েছে মৃত্যুর আগেই দু’জনের শরীর রক্তশূন্য হয়ে গিয়েছিল। আরে মশাই, ভয়ে মানুষের রক্ত জল হয়ে যায়। যায় তো!
ওদের ব্লাড গ্রুপ কী তা লেখা আছে?
নো। মৃত মানুষের ব্লাড গ্রুপ নিয়ে কী হবে?
কখন কী কাজে লাগে কে বলতে পারে। অর্জুন উঠে দাঁড়াল। তারপর হেসে বলল, আমি কি আপনাদের এসপি সাহেবকে ফোন করতে পারি?
সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন অসিত বসু। শিয়োর শিয়োর, আপনি–।
রিসিভার তুলে এসপির নাম্বার ডায়াল করল অর্জুন। তৎক্ষণাৎ রিং শুনতে পেল। তার পরেই ওসির গলা, হ্যালো।
অর্জুন বলল, আমি অর্জুন।
এসপি বললেন, নমস্কার। আমি শুনেছি আপনি ওসির সঙ্গে তিস্তার চরে গিয়ে ডেডবডি দেখেছেন। ভদ্রলোককে আজই কলকাতায় যেতে হয়েছে। অফিসের কাজে। আমি ওকে বলেছিলাম আপনাকে পোস্টমর্টেম রিপোর্টের ব্যাপারটা জানাতে। জেনেছেন?
হ্যাঁ, জেনেছি। আমি সব ফোনে জেনে বলছি লোক দুটোকে কোনওভাবে অজ্ঞান করে ওদের শরীর থেকে সব রক্ত বের করে নেওয়া হয়েছিল বলে ওরা মারা গিয়েছে। অর্জুন বলল।
মাই গড।
যে সিরিঞ্জ দুটো দিয়ে কাজটা করা হয়েছিল সেগুলো পড়ে ছিল পাশের কাশবনে। আমি প্যাথলজিস্টকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে থানায় জমা দিয়ে যাচ্ছি। অর্জুন সেগুলো বের করল।
এসপি বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ। অর্জুনবাবু আপনি আমাদের হেল্প করুন। ক্রিমিনালদের ধরতেই হবে।
স্যার, আমার ভূমিকা এই পর্যন্ত। বাকিটা মনোজবাবুরা করবেন!
তার মানে–!
আমি প্রফেশনাল সত্যসন্ধ্যানী। আচ্ছা, রাখছি।
.
বিকালে অমল সোমকে যখন অর্জুন প্যাথলজির খবরটা জানাল তখন ভেবেছিল তিনি খুশি হবেন। খবরটার শেষে একটু স্তুতি জুড়ে দিয়েছিল তাই।
কিন্তু প্রৌঢ় অমল সোমের মুখে সেটা উপভোগ করার কোনও চিহ্ন দেখা গেল না। অর্জুন তখন পোস্টমর্টেম রিপোর্টের কথা বলল। অমল সোম নড়েচড়ে বসলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, লোকটা নেপালি, ভুটিয়া, সিকিমের মানুষ নয়? কিন্তু লোকটা যে লেপচা তা ওই সেপাই বুঝল কী করে? কোনও পাহাড়ি মানুষের মুখ-চোখে লেপচা শব্দটা লেখা থাকে না।
মেজর খানিকটা দূরে বসে শেষ বিকালের আলোয় গাছগাছালি দেখছিলেন। এবার মুখ ফিরিয়ে বললেন, দু-দুটো মানুষের শরীর থেকে যদি খুনিরা রক্ত বের করে নেয়, তা হলে সেই রক্ত দিয়ে তারা কী করতে পারে? কোনও এক্সপেরিমেন্ট?
অমল সোম মাথা নাড়লেন, সেটাই ভাবছি।
অর্জুন এসপির সঙ্গে তার কথাবার্তা যা হয়েছিল তা বলল।
অমল সোম হাসলেন, যাক, এতদিনে তুমি সত্যি প্রফেশনাল হয়েছ। সেই ডাক্তারের কথা মনে পড়ছে। খুব নামডাক, অপারেশন যা করেন তা কখনওই ব্যর্থ হয় না। কিন্তু লোকে বলে লোকটা চামার। টাকাপয়সা না পেলে ছুরিতে হাত দেয় না। তা একবার ওর নিজের পায়ে বিশাল ফোঁড়া হল, ওষুধ দিয়েও কাজ হল না। অন্য ডাক্তাররা বললেন, এখনই অপারেশন করুন। তিনি বললেন, সেটাই তো সমস্যা, অপারেশনের ফি দেবে কে?
মেজর নিঃশব্দে হাসলেন। আগে হলে এমন হো হো করে হাসতেন যে কানে তালা লেগে যেত। কিন্তু অর্জুন বলল, ব্যাপারটা আমি কীভাবে নেব বুঝতে পারছি না।
সহজ ব্যাপার। লোক দুটো পাহাড়ি, এই শহরের নয়। তাদের মৃত্যুরহস্য সমাধান করতে কেউ তোমাকে প্রফেশনাল দক্ষিণা দিতে আসবে না। কিন্তু তোমার শহরে এইভাবে একটা ঘৃণ্য অপরাধ করেও ঘাতকরা পার পেয়ে যাবে আর তুমি নিষ্ক্রিয় হয়ে তা দেখবে, এটা তো মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। আচ্ছা ওই লোকটা যে তামাক নিয়ে পালাচ্ছিল, যাকে তুমি রিকশাওয়ালা বলে চিনতে পেরেছিলে, সে ওই তামাকগুলো কোথায় বিক্রি করল? রিকশাওয়ালার তো তামাকের ব্যাবসা জানার কথা নয়। ঠিক তখনই মনে পড়ল লোকটার কথা। ছটমেলায় খানিক দূরে রাখা তালা দেওয়া রিকশা। খুলে যাকে নিয়ে শহরে চলে গিয়েছিল সেও পাহাড়ি। এখন মনে হচ্ছে ওই লোকটাকে জেরা করার দরকার ছিল। ঠিক আছে, দক্ষিণা পাবে না জেনেই শুধু কৌতূহলের কারণে লোকটার সঙ্গে কথা বলবে সে।
.
বাগডোগরা বিমানবন্দরের চেহারা এখন অনেক আধুনিক হয়েছে। ভেতরে যাওয়া-আসার ব্যাপারেও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিয়ম অনুযায়ী বিধি নিষেধ জারি হয়েছে। অর্জুন দিল্লির বিমানের জন্য অপেক্ষা করছিল।
সেই বিমান এল। যাত্রীরা বের হলেন। তাদের মধ্যে একটি সাদা চামড়ার যুবতাঁকে দেখতে পেয়ে অর্জুন বুঝল এরই নাম নাতাশা স্মিথ। একটা চাকাওয়ালা সুটকেসকে টেনে নিয়ে বাইরে বের হওয়ামাত্র ট্যাক্সি এবং প্রাইভেট গাড়ির ড্রাইভাররা তাকে ঘিরে ধরল। সবাই তাকে গন্তব্যস্থলে নিয়ে যেতে চাইছে। নাতাশা বিব্রত হয়ে এপাশ ওপাশে তাকাচ্ছে। অতএব অর্জুন এগিয়ে গেল।
আপনি নাতাশা স্মিথ?
নাতাশার চোখ ছোট হল, আপনার নামটা বলুন।
অর্জুন।
ওঃ! আপনার সঙ্গে কি আইডেন্টিটি কার্ড আছে? নাতাশার গলায় সন্দেহ। অর্জুন হেসে ফেলল। তারপর পার্সের ভেতরে রাখা কার্ড বের করে দেখাল।
দ্যাটস ওকে। আমাকে বলা হয়েছে সবসময় ভেরিফাই করে নিতে। তারপর নাতাশা হাসল, দেন ইউ মোর আরজুন। দি টুথ ফাইন্ডার!
তা হলে মেজরের সঙ্গে আপনার কথা হয়েছে দিল্লিতে এসে।
হ্যাঁ। আমরা এখন তো ফুন্টশলিং যাব। মেজর ওখানে চলে গিয়েছেন?
না। আজ আপনাকে জলপাইগুড়িতে নিয়ে যেতে বলেছেন মেজর। দাঁড়ান। মোবাইল বের করে অমল সোমকে ফোন করল অর্জুন। তার গলা শুনে বলল, অমলদা, নাতাশা এসেছেন, মেজরের সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন।
তারপরেই মেজরের নির্জীব গলা কানে এল, হ্যালো নাতাশা। ওয়েলকাম ইন ইন্ডিয়া। অর্জুন তাড়াতাড়ি যন্ত্রটা নাতাশাকে ধরিয়ে দিল। কথা বলতে বলতে নাতাশা হাসল। অর্জুন লক্ষ করল মেয়েটির একটি গজাত আছে। তা ছাড়া গালেও টোল পড়ে। লম্বায় অন্তত পাঁচ ফুট সাত। নাতাশা বলছিল, তা হলে বলছ একটা দিন নষ্ট হবে না! ওকে!
জলপাইগুড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে গিয়েছিল অর্জুন। অতএব ঘিরে দাঁড়ানো অন্য ড্রাইভারদের হতাশ করে সে নাতাশার সঙ্গে গাড়িতে উঠে বসল।
গাড়ি চললে নাতাশা বলল, এখন ইন্ডিয়াতে তেমন গরম নেই। আমাকে কাজের জন্য প্রায়ই ক্যালিফোর্নিয়াতে যেতে হয়। ভয়ংকর গরম সেখানে।
গাড়িতে এসি চলছিল। অর্জুন কোনও মন্তব্য করল না। বাগডোগরা থেকে বেরিয়ে শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি রোড ধরতেই গাড়ি প্রায়ই লাফাতে লাগল। গতিও কমে গেল। নাতাশা বলল, এ কী! এ কেমন রাস্তা!
অর্জুন হাসল, এমন রাস্তায় কিছুক্ষণ চললে সব খাবার হজম হয়ে যাবে।
আমি এমনিতেই হাংগ্রি। হজম হওয়ার মতো পেটে কিছু নেই।
সে কী! প্লেনে কিছু খাননি?
ডোমেস্টিক্যাল ফ্লাইটে তো খেতে দেয় না। নাতাশা বলল।
অর্জুন ড্রাইভারকে বাংলায় বলল, চমচমের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ির হাইওয়েতে একটি নির্জন জায়গায় যে চমচমের দোকান আছে তার খ্যাতি খুব। সেখানে গাড়ি দাঁড় করালে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, তোমার কি মিষ্টি খেতে আপত্তি আছে? না থাকলে খেয়ে দ্যাখো, জীবনে খাওনি।
চমচম খেয়ে মেমসাহেব মুগ্ধ। পরপর চারটে খাওয়ার পর বোতলের জল কিনে গলায় ঢেলে বলল, আঃ। অনেক ধন্যবাদ আরজুন। এই দোকানদার যদি আমেরিকায় ব্রাঞ্চ খুলত তা হলে এক বছরে মিলিওনিয়ার হয়ে যেত।
এবার রাস্তা কিছুটা মসৃণ। গাড়ি চললে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, মেজর বলছিলেন তুমি নাকি গবেষণার কাজে এদেশে এসেছ।
ঠিক তাই। আমি দিল্লি থেকে সরাসরি থিম্পু যেতে পারতাম। কিন্তু মেজর আমাকে অ্যাডভাইস করলেন ফুন্টশলিং থেকে বাই রোড সেখানে যেতে। তাই এদিকে আসতে হল। না হলে এই চমচমের স্বাদ পেতাম না। হাসল নাতাশা।
মেজর বলেছেন, তরুণ বিজ্ঞানীদের মধ্যে নাতাশা বেশ নাম করেছে। কিন্তু একজন বিজ্ঞানী সামান্য চমচম খেয়ে এমন ছেলেমানুষ হয়ে যাবে তা কে জানত।
অর্জুন বলল, আমি অবশ্য বিজ্ঞানের ছাত্র নই। তাই তোমার গবেষণার বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করব না। কারণ কিছুই বুঝব না।
খুব সহজ ব্যাপার। ধরো তুমি শরীরের কোথাও আচমকা আঘাত পেলে। চামড়া ফাটল না কিন্তু জায়গাটা ক্রমশ কালো হয়ে গেল। কেন? কারণ সেখানে আঘাত পাওয়া রক্ত জমে গেল। সাধারণত শরীরের সিস্টেম কয়েক দিনের মধ্যে জমে যাওয়া রক্ত আবার তরল করে নেয়। কিন্তু অসাধারণ ক্ষেত্রে সেটা না হলে অপারেশন করে বের করতে হয়। যে কোনও প্রাণীর রক্ত বাতাসের স্পর্শে জমে যেতে থাকে। তার বৈজ্ঞানিক কারণগুলো তোমাকে ব্যাখ্যা করছি না। কারও রক্ত দ্রুত জমে যায়, কারও কিছুটা সময় লাগে। জমে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে তার রক্ত কালচে হয়ে যায়। আমরা লক্ষ করেছি, গরম দেশের মানুষের রক্ত যত তাড়াতাড়ি জমে গিয়ে কালচে হয়, অতিরিক্ত শীত যেখানে সেখানকার মানুষের রক্ত সেই অবস্থায় যেতে বেশ কিছুটা সময় নেয়। নর্থ বা সাউথ পোলের মানুষদের ওপর পরীক্ষা করে এ তথ্য পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু যেখানে শীত ভয়ংকর প্রবল নয় আবার গরমও পড়ে না সেখানকার মানুষের ক্ষেত্রে ওই দুই শ্রেণির মানুষের মাঝামাঝি সময় লাগা উচিত। আমার গবেষণার বিষয় জমে যাওয়া রক্তকে আবার কীভাবে তরল অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া যায় তার পথ খোঁজা। দ্রুত জমে যাওয়া রক্তের ক্ষেত্রে এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আবার অতিরিক্ত শীতের জায়গার মানুষের রক্ত তরল করতে গিয়ে দেখেছি। সেটা এত বেশি তরল হয়ে যাচ্ছে যে কোনও কাজে লাগছে না। ভুটানের ভৌগোলিক অবস্থান এমন যে আমার আশা হচ্ছে, সেখানে একটা সাফল্য পাব। নাতাশা খুব আন্তরিকভাবে ব্যাখ্যা করল।
অর্জুন বুঝল, ধরা যাক, আপনি সফল হলেন। কিন্তু তারপর?
আপনি কী বলছেন আরজুন! এই গবেষণার সাফল্য একটা বৈপ্লবিক ঘটনা বলে স্বীকৃত হবে। পৃথিবীর মানুষের প্রয়োজনে রক্তের অভাব আর প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে না। প্রতি বছর কত মানুষ রক্তের অভাবে মারা যায় তা জানেন। নাতাশা উত্তেজিত হল।
হঠাৎ অর্জুনের মনে হল কথাটা। সে বলল, ব্ল্যাড ডোনেশন ক্যাম্পে মানুষের শরীর থেকে রক্ত নিয়ে প্রিজার্ভ করা হয় যাতে অসুস্থ মানুষের প্রয়োজনে লাগে। সেই রক্ত যাতে জমাট না বাঁধে তার ব্যবস্থাও করা হয়।
ঠিক। কিন্তু তার পরিমাণ কতটা? যাঁরা ডোনেট করেন তাদের শরীর থেকে ঠিক ততটাই রক্ত নেওয়া হয় যা তাকে অসুস্থ করে না। কিন্তু দুর্ঘটনা বা হার্ট অ্যাটাকে মৃত মানুষের রক্ত যদি অল্প সময়ের মধ্যে পাওয়া যায়, যখন তার শরীরের রক্ত সবে নষ্ট হতে চলেছে তা হলে তার প্লাজমা সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করতে পারলে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, অতিরিক্ত গরম বা শীতের জায়গার মানুষের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। নাতাশা শ্বাস ফেলল, আমরা বোধহয় একটা শহরে ঢুকছি।
হ্যাঁ। এই শহরটার নাম জলপাইগুড়ি। অর্জুন বলল।
আজ কি ফুন্টশলিং যাওয়া যেতে পারে?
বোধহয় না। দূরত্ব অনেকটা, রাস্তাও ভাল নয়।
তা হলে আমি কোথায় থাকব? এখানে ভাল হোটেল আছে?
তেমন ভাল হোটেল নেই তবে সুন্দর ট্যুরিস্ট লজ আছে। আমরা প্রথমে অমলদার বাড়িতে যাব। ওখানেই মেজর আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। অর্জুন বলল।
গাড়ি শহরে ঢুকল। নাতাশা কৌতূহলী হয়ে দু’পাশে তাকাচ্ছিল। সাইকেল রিকশা দেখে হেসে বলল, নিউইয়র্কের দু’ঘণ্টা দুরে অ্যাটালান্টিক সিটিকে বলে ক্যাসিনো টাউন। অ্যাটালান্টিক সমুদ্রের গায়ে শহরটা। সেখানে সমুদ্রের ধার ঘেঁষে যে রাস্তাটা আছে এইরকম তিন চাকার সাইকেলে ট্যুরিস্টদের ঘোরানো হয়। খুব কস্টলি। আচ্ছা, এই শহরের মানুষেরা কি খুব গরিব?
অর্জুন হেসে ফেলল, গরিব মানুষ তো ভারতবর্ষেই শুধু থাকে না। আমি আমেরিকার ফুটপাতে হোমলেস মানুষকেও ভিক্ষে করতে দেখেছি। এই শহরের বাড়িঘরের প্যাটার্নটা এইরকম। গরিব বড়লোক পাশাপাশি বাস করে।
গাড়ি থেকে নামমাত্র ওরা অমল সোম এবং মেজরকে দেখতে পেল। নাতাশা এগিয়ে গিয়ে মেজরকে জড়িয়ে ধরল। অর্জুন অবাক হয়ে দেখল মেজর আগের মতো আবেগে উত্তেজিত হলেন না। শান্ত গলায় অমল সোমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
নাতাশা তাকে বলল, মেজর আপনার কথা বলেছেন। নাউ ইউ আর এ টুথ ডিসকভারার। উনি আপনার খুব প্রশংসা করেছেন।
অমল সোম ওদের নিয়ে বারান্দায় বসলেন। মেজর বললেন, নাতাশা আমরা কাল সকালে এখান থেকে রওনা হব। তাই আজকের রাতটা তোমাকে এখানেই থাকতে হবে। তুমি ইচ্ছে করলে ট্যুরিস্ট লজে থাকতে পারো।
আপনি?
আমি তো জলপাইগুড়িতে এলে এই বাড়িতেই থাকতে পছন্দ করি।
এই সময় হাবু চা আর বিস্কুট নিয়ে এল। অর্জুন দেখল এখন হাবু দুধ এবং চিনি আলাদা পাত্রে নিয়ে এসেছে। বিদেশিনিকে দেখেই বোধহয় এই ব্যবস্থা।
নাতাশা চা খেল দুধ চিনি ছাড়া। চুমুক দিয়ে বলল, ফাইন। আচ্ছা, আমি যদি এই বাড়িতে থাকি তা হলে আপনাদের কি খুব অসুবিধা হবে?
অমল সোম বললেন, আপনি যেসব কমফর্টে এতদিন অভ্যস্ত ছিলেন এখানে তা হয়তো পাবেন না তবে সভ্য মানুষ যেভাবে থাকলে স্বস্তি পায় তা অবশ্যই পাবেন। এটা মেনে নিয়ে থাকতে চাইলে আমরা আপনাকে অতিথি। হিসেবে পেলে খুশি হব।
মেজর বললেন, নাতাশা, তুমি এখানে নিজের মতো থাকতে পারবে।
নাতাশা বলল, দেন, আমি ট্যুরিস্ট লজে যাচ্ছি না।
চা শেষ করে অর্জুন উঠে দাঁড়াল, চলি।
অমল সোম বললেন, তোমার ভাড়ার গাড়ির ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করো কাল সে ফুন্টশলিং নিয়ে যেতে পারবে কি না! আজ বাগডোগরা যাওয়া আসাতে কত দিতে হবে ওকে?
বারোশো চাইছিল, হাজার দেব বলেছি। অর্জুন বলল।
মেজর সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে পার্স বের করে দুটো পাঁচশো টাকার নোট এগিয়ে ধরলেন। অর্জুন টাকাটা নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কখন রওনা হবেন?
সকাল সাড়ে ছ’টায়। তা হলে দশটার মধ্যে ফুন্টশলিং পৌঁছে যাব। তুমি তার আগেই গাড়িটাকে নিয়ে চলে এসো। মেজর বললেন।
আমাকে আসতে হবে? অর্জুন অবাক।
কী আশ্চর্য! প্রশ্ন করছ? তোমাকে ছাড়া নর্থ বেঙ্গলের কোথাও কি কখনও গিয়েছি। আমি তো মিস্টার সোমকেও অনুরোধ করেছি সঙ্গী হওয়ার জন্য। মেজর নিজের দুটো হাত ধরলেন।
অমল সোম বললেন, অনেকদিন ওদিকে যাইনি। তা ছাড়া এবার তো কোনও কেস নিয়ে যাচ্ছি না, খুশিমতো ঘুরতে পারব। তোমার তো হাতখালি, চলো ঘুরে আসি।
.
সন্ধের মুখে বাড়িতে ফেরার পথে বাইক দাঁড় করাল অর্জুন। টাউন ক্লাবের মোড়ে দুটো রিকশা পঁড়িয়ে আছে যার একটায় বসে আছে কালকের সেই রিকশাওয়ালা। তার পায়ে আজ নতুন জুতো, নতুন জামা। রিকশাওয়ালা
অর্জুনকে দেখে দাঁত বের করে হাসল।
অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, তামাকগুলো কী করলে?
বেচে দিয়েছি। ঘাড় কাত করল লোকটা।
কাকে?
একজন লোককে।
কে সেই লোক? নাম বলো। অর্জুন গম্ভীর হল।
আজ্ঞে।
তখন আমি না থাকলে তোমাকে জেলের ভাত দশ বছর খেতে হত।
হ্যাঁ বাবু, আপনি আমাকে রক্ষা করেছেন?
কাকে বিক্রি করেছ?
একটা লোককে। সে-ই ভাল দাম দিয়ে কিনে নিল।
তাকে তুমি চেনো না?
না বাবু। বিশ্বাস করুন, কখনও দেখিনি আগে। ছটপুজোর মেলায় প্রথম দেখলাম। এদেশের লোক তো নয়, দেখব কী করে!
যাকে রিকশায় বসিয়ে তিস্তার চর থেকে নিয়ে গিয়েছিলে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে।
তামাক দিয়ে লোকটাকে কোথায় নামালে?
হাসপাতালের সামনে। সেখানে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল, লোকটা তাতে উঠে চলে গেল।
কী ভাষায় কথা বলছিল সে?
হিন্দিতে। ভুটানি তো, ভাল হিন্দি বলতে পারে না।
গাড়িতে আর কেউ ছিল?
তিনজন ছিল। সবাই ভুটানি।
গাড়ির নাম্বার জানতে চাইলে কোনও লাভ হবে না। রিকশাওয়ালার মনে ওই কৌতূহল আসার কথাও না।
অর্জুন বাইক চালু করল। রিকশাওয়ালার কাছ থেকে নতুন তথ্য পাওয়া যাবে না। কিন্তু এটা অনুমান করাই যায় যে যাকে সে হাসপাতালের সামনে পৌঁছে দিয়েছিল সেই ভুটানি লোকটা এই জোড়া খুনের সঙ্গে জড়িত। গাড়িতে ওর জন্য যারা অপেক্ষা করছিল তারাও কি তিস্তার কাশবনে থেকে কাজটা সেরে আগেভাগে বেরিয়ে এসে হাসপাতালের সামনে সঙ্গীর জন্য অপেক্ষা করছিল? হঠাৎ অর্জুনের হাসি পেল। অমল সোমের অনুরোধে কাল নাতাশার সঙ্গে যেতে হচ্ছে ভুটানে। আর ভুটান থেকে কয়েকজন এসে খুনপর্ব সেরে গেল। ব্যাপারটাকে কাকতালীয় বলাই উচিত। কিন্তু জীবনে এরকম ঘটনা মাঝে মাঝেই হয়ে থাকে।