টেলিফোন বেজে উঠল ঝনঝন শব্দে
সকালবেলা হোটেলের ঘরে টেলিফোন বেজে উঠল ঝনঝন শব্দে। বাথরুমেও টেলিফোন আছে, দুটো ফোন একসঙ্গে বাজলে বেশি শব্দ হয়। কাকাবাবু বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাড়ি কামাতে কামাতে গুগুন করে একটা গান গাইছিলেন, বেশ চমকে উঠলেন টেলিফোনের আওয়াজ শুনে।
এই হোটেলের অনেক কর্মচারীই বাঙালি। প্রথম দিন রিসেপশান কাউন্টারে এসে কাকাবাবু নিজের নাম বলার আগেই একটি মেয়ে তাঁকে চিনতে পেরেছিল। হাসিমুখে হাতজোড় করে বাংলায় বলেছিল, নমস্কার সার, আপনি নিশ্চয়ই মিস্টার রাজা রায়চৌধুরী? আসুন, আসুন, আমাদের হোটেলের কী সৌভাগ্য!
সেই মেয়েটির নাম মণিকা দাশগুপ্ত। সে সঙ্গে-সঙ্গে একটা অটোগ্রাফ খাতা বার করে কাকাবাবুর সই নিয়েছিল।
এখন কাকাবাবু ফোনের রিসিভার তুলে হ্যালো বলতেই সেই মণিকা নামের মেয়েটিই বলল, গুড মর্নিং সার। দুজন ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। ওপরে আপনার ঘরে পাঠিয়ে দেব?
কাকাবাবু ঘড়িতে দেখলেন, সাতটা পঁচিশ বাজে। এরকম সকালে কারা দেখা করতে এল? কারও তো আসবার কথা নেই। তিনি যে ভাইজাগ এসেছেন, তাও বিশেষ কেউ জানে না। কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে রইলেন। সকালবেলা যে-কোনও লোকের সঙ্গে তাঁর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে তিনি অনেকক্ষণ সমুদ্রের ধারে পায়চারি করেছেন, এখন দাড়ি কামিয়ে স্নানটান করবেন, তারপর ব্রেকফাস্ট খাবেন। দশটার সময় তাঁর এক জায়গায় যাওয়ার কথা আছে।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কারা এসেছেন, মণিকা? ওঁদের কি আমার সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল?
মণিকা বলল, না সার। সেটা আমি আগেই জিজ্ঞেস করেছি। এঁদের কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই। কিন্তু এঁরা বলছেন, আপনার সঙ্গে জরুরি দরকার।
কাকাবাবু বললেন, দুঃখিত। ওঁদের বলে দাও, এখন দেখা করতে পারছি না। আমি এখনও তৈরি হইনি।
কাকাবাবু ফোনটা রেখে দিয়ে গালে আবার সাবান ঘষতে লাগলেন।
আবার বেজে উঠল ফোন।
কাকাবাবু এবার একটু কড়া গলায় বললেন, মণিকা, আমি চাই না কেউ এখন আমাকে বিরক্ত করুক। আমি এখন স্নান করতে যাচ্ছি। সকাল নটার আগে আমাকে আর টেলিফোনে ডেকো না।
মণিকা আড়ষ্টভাবে বলল, দুঃখিত সার, আমি আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি সার, কিন্তু এঁরা বলছেন, এঁরা পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে এসেছেন, আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। আপনি ফোনে কথা বলবেন?
কাকাবাবু বললেন, পুলিশের সঙ্গেও আমার কোনও জরুরি কথা থাকতে পারে না। আমি এখানে বেড়াতে এসেছি, কোনও কাজের কথা শুনতে চাই না!
ফোনটা কেটে দিয়ে কাকাবাবু আবার দাড়ি কামানোতে মন দিলেন। কিন্তু একটু আগে যে গানটা গাইছিলেন, সেটা আর মনে এল না।
দাড়ি কামিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে তিনি সুটকেস খুলে জামা কাপড় বার করতে লাগলেন।
হোটেলের ঘরের এক দিকের দেওয়াল সম্পূর্ণ কাচের। পরদা সরালেই। দেখা যায় সমুদ্র। এই শহরটার নাম কেউ বলে বিশাখাপত্তনম, কেউ বলে ভাইজাগ। এখানকার সমুদ্র ভারী সুন্দর। পাহাড় আর সমুদ্র একসঙ্গে দেখা যায়। কাকাবাবুর ঘর থেকে ডান দিকে তাকালে দেখা যায়, একটা পাহাড় যেন সমুদ্র থেকে খানিকটা মাথা উঁচু করে আছে। ওই পাহাড়টার নাম ডলফি নোজ, শুশুঁকের নাক, ঠিক সেইরকমই দেখতে লাগে।
দরজায় দুবার টোকা পড়ল। কাকাবাবু ভাবলেন, ভোরবেলা একটি বেয়ারা বেড-টি দিয়ে গিয়েছিল, সে বোধ হয় কাপ-প্লেট নিতে এসেছে। কাকাবাবু বললেন, কাম-ইন!
আবার দুবার টকটক শব্দ হল দরজায়।
দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। কাকাবাবু এগিয়ে গিয়ে খুলে দিলেন।
বাইরে দাঁড়িয়ে আছে দুটি মাঝবয়েসী লোক। একজন সাদা শার্ট-প্যান্ট পরা, অন্যজনের একেবারে পুরোদস্তুর পুলিশের খাকি পোশাক, কোমরে রিভলভার, মাথায় টুপি পর্যন্ত। কাকাবাবু এদের আগে কখনও দেখেননি।
কাকাবাবু রীতিমতন বিরক্ত হয়ে বললেন, কী ব্যাপার? আমি এখন কারও সঙ্গে দেখা করতে চাইনি।
সাদা পোশাক পরা ব্যক্তিটি বলল, দুঃখিত, মিঃ রায়চৌধুরী। আমরা ডিউটি করতে এসেছি। আপনার সঙ্গে আমাদের কিছু কথা আছে।
কাকাবাবু বললেন, কথা বলার তো একটা সময়-অসময় থাকে? আপনাদের কে পাঠিয়েছে? অনেক সময় পুলিশের লোকেরা নানা ব্যাপারে আমার পরামর্শ চায়।
এখানকার পুলিশের কোনও বড়কর্তাকে তো আমি চিনি না। আপনাদের যে-ই পাঠাক, তাঁকে গিয়ে বলুন, এখানে আমি পুলিশের কোনও ব্যাপারে মাথা ঘামাতে রাজি নই। আমি একটু শান্তিতে থাকতে চাই।
পুলিশ দুজন পরস্পরের দিকে চোখাচোখি করল। খাকি পেপাশাক পরা পুলিশটি রুক্ষভাবে বলল, দরজার কাছ থেকে সরে দাঁড়ান, আমরা ভেতরে ঢুকে কথা বলব।
সাদা পোশাক পরা লোকটি হাত তুলে তাকে থামতে ইঙ্গিত করে বিনীতভাবে বলল, মিঃ রায়চৌধুরী, আমাদের কেউ পাঠায়নি। আমরা স্পেশ্যাল স্কোয়াড থেকে আসছি। আমার নাম রঙ্গরাজ, আমার সঙ্গীর নাম রামা রাও।
একটা কেসের ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা বলা দরকার। আপনাকে সব খুলে বললে আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন। আমরা কি ভেতরে গিয়ে বসতে পারি?
রঙ্গরাজ তার জামার ভেতরের দিকের পকেট থেকে পরিচয়পত্র বার করে দেখাল।
কাকাবাবু দরজার কাছ থেকে সরে এলেন।
পুলিশ দুজন দুটি চেয়ারে বসল।
কাকাবাবু ক্রাচ দুটো নামিয়ে রেখে আর-একটা চেয়ার টেনে নিলেন।
রঙ্গরাজ একটা নোটবুক আর কলম হাতে নিয়ে বলল, আপনার নাম রাজা রায়চৌধুরী, আপনি কলকাতা থেকে এসেছেন, ঠিক?
কাকাবাবু বললেন, আপনারা আমার নাম জেনেশুনেই তো এসেছেন। আবার জিজ্ঞেস করছেন কেন?
রঙ্গরাজ বলল, এসব হচ্ছে রুটিন প্রশ্ন।
কাকাবাবু বিদ্রুপের সুরে বললেন, তার মানে, শুধু কথা বলতে নয়, আপনারা এই সকালবেলা আমাকে জেরা করতে এসেছেন?
রঙ্গরাজ বলল, তা একরকম বলতে পারেন। জানতে পারি কি, আপনি হঠাৎ এই সময় ভাইজাগ এসেছেন কেন?
কাকাবাবু খুব বিস্ময়ের ভান করে ভুরু তুলে বললেন, সে কী কথা? আমি স্বাধীন ভারতের একজন নাগরিক। কাশ্মির থেকে কন্যাকুমারিকা, যে-কোনও জায়গায় যখন খুশি যেতে পারি। এটা তো আমাদের নাগরিক অধিকার, তাই না?
রঙ্গরাজ বলল, তা ঠিক। তবে, আরও অনেক জায়গা থাকতে আপনি হঠাৎ ভাইজাগ এলেন কেন, সেটাই জানতে চাইছি।
কাকাবাবু বললেন, হঠাৎ আবার কী? ইচ্ছে হয়েছে, তাই এসেছি।
রঙ্গরাজ বলল, অর্থাৎ, কেন এসেছেন, তা আপনি জানাতে চান।
কাকাবাবু বললেন, জানাতে আমি বাধ্য নই!
রামা রাও এর মধ্যে পকেট থেকে একটা চুরুট বার করে ধরাতেই কাকাবাবু সেদিকে ফিরে বললেন, যদি চুরুট টানতে চান, আপনাকে বাইরে যেতে হবে। আমি চুরুটের গন্ধ সহ্য করতে পারি না।
রামা রাও তাড়াতাড়ি চুরুটটা অ্যাশট্রেতে টুকে-টুকে নিভিয়ে ফেলল।
তারপর কাকাবাবুর একটা ক্রাচ তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে-দেখতে বলল, আপনি কি সবসময় ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটেন? না কি এর ভেতরটা ফাঁপা?
কাকাবাবু বুঝলেন, এই লোকদুটি তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানে না।
সারা ভারতের বড়-বড় শহরের পুলিশের বড়কর্তারা তাঁকে চেনে। অন্য কোথাও এই ধরনের মাঝারি পুলিশরা তাঁকে জেরা করতে সাহস করত না।
ভাইজাগ শহরের পুলিশের ওপর মহলের কোনও অফিসার সম্পর্কে তিনি খোঁজখবর নিয়ে আসেননি। ভেবেছিলেন সেরকম কোনও দরকারও হবে না।
এই লোক দুটো শুধু-শুধু কিছুক্ষণ তাঁর সময় নষ্ট করে যাবে। শুধু সময় নষ্ট নয়, মেজাজ নষ্ট।
রঙ্গরাজ একটা ফোটোগ্রাফ বার করে কাকাবাবুর চোখের সামনে দেখিয়ে বলল, এই লোকটিকে চিনতে পারেন?
পুরো চেহারা নয়, শুধু একটা মুখের ছবি। মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, মাথায় অর্ধেক টাক, চোখ দুটো কোঁচকানো, ঠোঁটের ভঙ্গি নিষ্ঠুর ধরনের। সাধারণ চোর-ডাকাতের মতন।
কাকাবাবু একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, না, চিনি না। কখনও দেখিনি।
রঙ্গরাজ বলল, ভাল করে ভেবে দেখুন। চেনেন না?
কাকাবাবু বললেন, আমার স্মৃতিশক্তি ভাল। আমি মানুষের মুখ কখনও ভুলি না।
রঙ্গরাজ বলল, এই লোকটি কিন্তু আপনাকে চেনে। এর কাছ থেকেই আপনার ঠিকানা পেয়েছি।
কাকাবাবু বললেন, আমাকে যদি কেউ চেনে, আমিও তাকে চিনব, এ তো বড় অদ্ভুত যুক্তি! মনে করুন, একটা চোর আপনার বাড়িতে চুরি করার জন্য রোজ লুকিয়ে-লুকিয়ে আপনার ওপর নজর রাখে, আপনার নাড়ি-নক্ষত্র সব জেনে নেয়, তা বলে কি আপনিও চোরটাকে চিনবেন?
একটু হেসে তিনি আবার বললেন, আমি নিজের সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলতে চাই না। শুধু এইটুকু বলি, এমন অনেকেই আমাকে চেনে, যাদের আমি চিনি না।
রামা রাও বলল, অত বেশি কথার দরকার কী? রঙ্গরাজ, এই লোকটাকে এখন থানায় নিয়ে গেলেই তো হয়!
রঙ্গরাজ বলল, আগে আমি খানিকটা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিচ্ছি।
মিঃ রায়চৌধুরী, এই লোকটা একটা দাগি স্মাগলার। ভাইজাগ পোর্টের কাছে কাল রাত্তিরে পুলিশ ওকে তাড়া করে, শেষপর্যন্ত গুলি চালিয়ে আহত করে। লোকটার কাছে শুধু আপনার নাম-ঠিকানা নয়, এমন আরও প্রমাণ পাওয়া গেছে, যাতে বোঝা যায়, লোকটা আপনার সঙ্গেই দেখা করতে আসছিল। শুধু তাই-ই নয়, কয়েকবার কোঁতকা খাওয়ার পর লোকটা স্বীকার করেছে, এর আগে অন্তত একুশবার সে আপনার কাছে চোরাই জিনিস পৌঁছে দিয়েছে।
রামা রাও বলল, একুশবার! কোকেন স্মাগলিং, প্রায় কোটি টাকার কারবার।
রঙ্গরাজ বলল, লোকটি সব কথা স্বীকার করেছে। সুতরাং আপনাকে একবার থানায় যেতে হবে, এখনই। আপনি পোশাক-টোশাক পরে তৈরি হয়ে নিন।
কাকাবাবু লোক দুটির মুখের দিকে তাকালেন। একটু-একটু হাসতে লাগলেন। তারপর হা-হা শব্দে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন!
পুলিশ দুজন নিরেট মুখ করে বসে আছে। তারা যেন হাসতে জানেই!
কাকাবাবু হাসি থামিয়ে বললেন, ইজ দিস সাম কাইন্ড অব আ জোক? আজ পয়লা এপ্রিল নাকি? সকালবেলা আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করতে এসেছেন? আপনাদের কে পাঠিয়েছে সত্যি করে বলুন তো!
রামা রাও আবার চুরুটটা ধরিয়ে ফেলেছে এর মধ্যে। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট! স্বেচ্ছায় যেতে না চান, আপনাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাব।
রঙ্গরাজ বলল, আরে না, না। জোর করতে হবে না। উনি এমনিই যাবেন আমাদের সঙ্গে।
মিঃ রায়চৌধুরী, এই সকালবেলা বাড়িতে বউ-ছেলেমেয়ের সঙ্গে সময় না কাটিয়ে আপনার এখানে আমরা নিশ্চয়ই ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতে আসিনি। আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশ গুরুতর। আপনি তৈরি হয়ে নিন। আপনি এই শহরের কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তিকে চেনেন?
কাকাবাবু বললেন, প্রোফেসর ভার্গব আমার বন্ধু। ইতিহাসের বিখ্যাত পন্ডিত। তাঁর সঙ্গে দেখা করার কথা আছে আজ দশটার সময়।
পুলিশ দুজন মাথা নাড়ল। তারা কেউ ভার্গবকে চেনে না।
কাকাবাবু জিভের চুকচুক শব্দ করে বললেন, বোধ হয় ভার্গবের নাম করাটা আমার ভুল হল। আপনারা তাকেও স্মাগলার ভেবে জ্বালাতন করবেন হয়তো। নাঃ, এখানে আর কাউকে আমি চিনি না।
রামা রাও বলল, তা হলে চলো আমাদের সঙ্গে!
কাকাবাবু বললেন, আমার ক্রাচটা দিন। আমি বাথরুমে গিয়ে পোশাক বদলে আসছি।
রামা রাও বলল, না, না, বাথরুম-টাথরুমে যাওয়া চলবে না। তোমাকে আর চোখের আড়াল হতে দিচ্ছি না।
ক্রাচ দুটো আমার কাছে থাকবে, ভেঙে দেখব ভেতরে কিছু আছে কি না। এর মধ্যে তোমার ঘরটাও সার্চ করে দেখব!
কাকাবাবু লাফাতে-লাফাতে গেলেন নিজের বিছানার কাছে। বালিশের তলা থেকে টেনে বার করলেন রিভলভার।
রামা রাও তা দেখে ব্যস্তসমস্ত হয়ে নিজের কোমর থেকে রিভলভার বার করে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে উলটে পড়ে গেল বেতের চেয়ারসুন্ধু।
কাকাবাবু আবার হেসে বললেন, আরে না, না, ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। আমি কি পুলিশের ওপর গুলি চালাব নাকি? আপনাদের দুজনকে ঢিট করার ইচ্ছে থাকলে আমার রিভলভারেরও প্রয়োজন ছিল না। আপনারা বললেন, আমার ঘর সার্চ করবেন, তাই রিভলভারটা আগেই দেখিয়ে দিলাম। আমার লাইসেন্স আছে। আপনারা সত্যিই পুলিশ তো?
রঙ্গরাজও কাকাবাবুর হাতে রিভলভার দেখে একধারে সিঁটিয়ে গিয়েছিল।
এবারে সোজা হয়ে বসে বলল, সে-বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আপনাকে আমরা থানাতেই নিয়ে যাব। সেখানে আপনার যা বলবার তা বলবেন।
কাকাবাবু রিভলভারটা রঙ্গরাজের কোলের ওপর ছুড়ে দিয়ে বললেন,
এটা আপনার কাছে রাখুন। আপনারা আমার নামে যে অভিযোগ এনেছেন, সেটা অস্বীকার করলে আপনারা আমার ওপর অত্যাচার করবেন? আমার পেট থেকে কথা বার করার জন্য আমার গায়ে আগুনের ছ্যাকা দেবেন।
রঙ্গরাজ বলল, প্রথমেই সত্যি কথা বলে দিলে সে সব কিছুর দরকার হবে না।
রামা রাও কোনওরকমে উঠে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, কী করে মুখ খোলাতে হয় আমরা জানি। আঙুলে আলপিন ফোটালেই সবাই বাপ বাপ করে সব কথা বলতে শুরু করে দেয়!
কাকাবাবু বললেন, না, না, আলপিন-টালপিন ফোটাবেন না, তাতে আমার খুব লাগবে। আপনারা যা জিজ্ঞেস করবেন, আমি সব উত্তর দেব।
তারপর আবার ফিক করে হেসে ফেলে বললেন, আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না যে, একটা ছিচকে অপরাধীর মতন পুলিশ আমায় থানায় ধরে নিয়ে যাচ্ছে! আমার বন্ধুরা শুনলে খুব মজা পাবে।
রামা রাও চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, এতদিন ধরে স্মাগলিং করে আসছ, একবারও ধরা পড়োনি? কলকাতার পুলিশ তোমায় ধরতে পারেনি! আমরা সবকটাকে জেলে ভরব!
কাকাবাবু বললেন, ছিঃ, ওরকমভাবে কথা বলতে নেই। আমি যে স্মাগলার, তা কি প্রমাণ হয়েছে? প্রমাণ হওয়ার আগে কারও নামে দোষ দেওয়া পুলিশেরও উচিত নয়।
তারপর রঙ্গরাজের দিকে ফিরে বললেন, আপনারা আমার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। নিজের মুখে আমার কিছুটা পরিচয় দিই?
আমি এক সময় ভারত সরকারের জিওলজিক্যাল সার্ভে দফতরের কতা ছিলাম। একটা অ্যাকসিডেন্টে পা খোঁড়া হয়ে গেছে। তারপর বেশ কিছুদিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দফতর, অর্থাৎ সি বি আই-এর উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছি। অনেক রহস্য সমাধানের জন্য পুলিশকেও সাহায্য করেছি। এ-কারণে আমার অনেক শত্রু আছে। বোঝাই যাচ্ছে, সেরকম কেউ হয়রান করার জন্য আমাকে স্মাগলার সাজাচ্ছে।
রঙ্গরাজ গম্ভীরভাবে বলল, এসব কথা আমায় বলে লাভ নেই। থানায় গিয়ে বলবেন।
কাকাবাবু বললেন, আপনারা চাইছেন যখন, নিশ্চয়ই আমি থানায় যাব। তার আগে ব্রেকফাস্ট খেয়ে নিই? আপনারা দুজনেই আমার সঙ্গে ব্রেকফাস্ট খেতে পারেন। এই হোটেলে মাশরুম দিয়ে খুব ভাল ওমলেট বানায়।
রামা রাও বলল, আমরা পরের পয়সায় কিছু খাই না। তোমাকে আর ঠিক পাঁচ মিনিট সময় দেওয়া হচ্ছে তৈরি হওয়ার জন্য।
কাকাবাবু এতক্ষণ পরে বিরক্তভাবে কাঁধ ঝাঁকালেন। এরা এতই ছোটখাট পুলিশ যে, কিছুই বুঝবে না।
গায়ে একটা জামা গলিয়ে নেওয়ার পর তিনি বললেন, যাওয়ার আগে একটা টেলিফোন করতে পারি?
রামা রাও বলল, না। রঙ্গরাজ বলল, হ্যাঁ, করে নিন, তাতে আর কতক্ষণ লাগবে!
কাকাবাবু ফোন তুলে দিল্লির একটা নম্বর চাইলেন।
সৌভাগ্যের বিষয় যে, সঙ্গে-সঙ্গে লাইন পাওয়া গেল।
কাকাবাবু তাঁর বন্ধু নরেন্দ্র ভার্মার গলার আওয়াজ পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, কী ব্যাপার, রাজা? অনেকদিন তোমার পাত্তা নেই, কোনও যোগাযোগ রাখোনি। আজ হঠাৎ এই অসময়ে যে ফোন করলে?
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, অসময়ে কেন?
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, রোজ এই সময়ে আমি যোগব্যায়াম করি তা জানো?
কাকাবাবু বললেন, যোগ-ব্যায়াম। যোগ-নিদ্রায় তো ছিলে না।
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এ-সময়ে আমি টেলিফোনও ধরি না। আজ কেন যেন ধরে ফেললাম। যাকগে, কেমন আছ তাই বলো!
কাকাবাবু বললেন, কুড়ি মিনিট আগেও খুব ভাল ছিলাম। এখন ভাল নেই। কলকাতা থেকে নয় কিন্তু, আমি কথা বলছি ভাইজাগ থেকে।
সেখানে আবার কী করছ? কেউ ডেকে নিয়ে গেছে বুঝি?
না, বেড়াতেই এসেছি বলতে পারো। তুমি তো প্রোফেসর ভার্গকে চেনো, তাঁর সঙ্গে আরাকু ভ্যালিতে একটা জিনিস দেখতে যাওয়ার কথা আছে।
আরাকু ভ্যালি? নাম শুনিনি। সেখানে কী আছে?
সেসব কথা পরে হবে। এর মধ্যে একটা ছোট্ট ঝঞ্ঝাটে পড়েছি। দুজন পুলিশের লোক আমাকে হোটেলে অ্যারেস্ট করতে এসেছে। এরা বলছে, আমি নাকি স্মাগলার!
নরেন্দ্র ভার্মার অট্টহাসি পুলিশ দুজনও শুনতে পেল।
নরেন্দ্র ভার্মা খুব ভাল বাংলা জানে। অধিকাংশ কথাই বলছে বাংলায়। মাঝেমধ্যে দু-একটা ইংরিজি শব্দ।
রামা রাও আর রঙ্গরাজ উৎকর্ণ হয়ে কথাগুলো শোনার চেষ্টা করছে, বাংলা কিছুই বুঝতে পারছে না।
নরেন্দ্র ভার্মা হাসি থামিয়ে প্রায় ধমক দিয়ে বলল, রাজা রায়চৌধুরী, তুমি কি এই সকালবেলা আমার সঙ্গে রং-তামাশা করতে চাইছ?
কাকাবাবু বললেন, না হে, রং-তামাশা নয়। পুলিশ দুজন এখানেই বসে আছে। প্রায় আমার ঘাড়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। এরা বন্দর এলাকায় কাল একজন স্মাগলারকে ধরেছে, তার কাছে নাকি আমার নামে চিঠি পাওয়া গেছে। সে নাকি স্বীকার করেছে, এর আগে একুশবার আমাকে, কোকেন সাপ্লাই করেছে। কোকেন জিনিসটা কীরকম, তা আমি চোখেই দেখিনি।
তোমাকে সত্যি-সত্যি ওরা ধরে নিয়ে যেতে এসেছে?
গোঁয়ারের মতন তাই তো জেদ ধরেছে দেখছি।
ওরা তোমাকে চেনে না? তোমার কীর্তি কাহিনী কিছু শোনেনি?
নাঃ, এরা কিছুই জানে না। দেখা যাচ্ছে অন্ধ্রপ্রদেশে আমার একটুও জনপ্রিয়তা নেই। তুমি কিছু করতে পারো?
সরাসরি পুলিশকে নির্দেশ দেওয়ার অধিকার আমার নেই। ওদের বড়কর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ওদের বলল, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে। আমি কয়েক জায়গায় ফোনটোন করে দেখি।
এরা পাঁচ মিনিটও অপেক্ষা করতে রাজি নয়। আমাকে ব্রেকফাস্টও খেতে দিচ্ছে না। তুমি ওদের সঙ্গে কথা বলবে? যদি বুঝিয়ে দিতে পারো—
টেলিফোনে আমার কথা শুনে ওরা কী করে বিশ্বাস করবে যে, আমি নরেন্দ্র ভার্মা, না রাম-শ্যাম-যদু-মধু? এ তো মহা মুশকিল হল দেখছি! তোমাকে কেউ ফাঁসিয়েছে।
যে ফাঁসিয়েছে, সে আমার হাতে শাস্তি পাবেই। কিন্তু এখন কী করা যায়?
এক্ষুনি তো কিছু করা যাচ্ছে না। ওরা যখন নেবেই বলছে, তা হলে যাও, জেলখানার খিচুড়ি কেমন হয়, খেয়ে দেখো!
জেলের খাবার আমি কখনও খাইনি। এ-জীবনে খাওয়ার ইচ্ছেও নেই।
ফোনটা রেখে দিয়ে, কাকাবাবু পুলিশ দুজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে, চলুন আপনাদের থানাটা একবার দেখা যাক!