বাড়ির পাশের গলিটায়
বাড়ির পাশের গলিটায় এখন একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে সবসময়। গাঢ় চকোলেট রঙের গাড়ি, প্রায় নতুনের মতন ঝকঝকে। সন্তু মাঝে-মাঝেই ছাদ থেকে উঁকি মেরে গাড়িটাকে দেখে। কখনও পায়রা কিংবা কাক গাড়িটার ওপর ননাংরা ফেললে সন্তু দৌড়ে নীচে নেমে গিয়ে পরিষ্কার করে দেয়। আদর করে হাত বুলোয় গাড়িটার গায়। এর মধ্যেই সন্তু গাড়িটার একটা নাম দিয়ে ফেলেছে, গিংগো। সে ছাড়া এ নাম আর কেউ জানে না।
গাড়িটা দেখাশুনোর দায়িত্ব সন্তুর ওপর। কিন্তু এটা তাদের গাড়ি নয়। বিমানদা প্রায় জোর করেই গাড়িটা এখানে রেখে গেছে এক সপ্তাহ আগে। বিমানদা দেড় মাসের ছুটি নিয়ে গেছে জার্মানিতে। তার বাড়িতে গ্যারাজ নেই, গাড়িটা আগে রাত্তিরবেলা রাখা হত একটা পেট্রোল পাম্পে। কিন্তু এই দেড় মাস গাড়িটা সেখানে থাকলে তারা যদি ভাড়া খাটায়? যদি যে-সে গাড়িটা চালায়। সেইজন্য বিমানদা যাওয়ার আগে কাকাবাবুকে এসে বলেছিল, গাড়িটা আপনারা রাখুন। আপনারা ব্যবহার করবেন।
কাকাবাবু হেসে বলেছিলেন, আমরা কী করে ব্যবহার করব? আমি কি গাড়ি চালাই? দাদাও গাড়ি চালাতে জানেন না। সন্তু এখনও শেখেনি। তা হলে?
বিমানদা বলেছিল, একটা ঠিকে-ড্রাইভার রেখে দেবেন। যখন দরকার হবে, তখন গাড়িটা নিয়ে বেরোবেন। গাড়িটা শুধু-শুধু পড়ে থাকার চেয়ে মাঝে-মাঝে চালালেই ভাল হয়।
কাকাবাবু বলেছিলেন, কিন্তু গাড়িটা গলির মধ্যে রেখে দেবে, যদি চুরি হয়ে যায়?
বিমানদা বলেছিল, আপনার বাড়ির পাশ থেকে গাড়ি চুরি করবে, কার এমন বুকের পাটা?
কাকাবাবু আবার হেসে ফেলে বলেছিলেন, তুমি বলছ কী বিমান, গাড়ি-চোররাও আমাকে চেনে? আমার নাম-ডাক অতটা ছড়ায়নি বোধ হয়!
বিমানদা গাড়ি-চুরির ব্যাপারটা তবু গুরুত্ব দেয়নি। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিল, চুরি হয় তো হবে! ইনশিওর করা আছে। আমি পেট্রোল পাম্পে রাখতে চাই না।
তারপর সন্তুর কাঁধে হাত রেখে বলেছিল, যদি ড্রাইভার না আসে তা হলে তুই রোজ একবার গাড়িটা স্টার্ট দিবি! না হলে ব্যাটারি ডাউন হয়ে যাবে। ইচ্ছে করলে তুই এর মধ্যে গাড়ি চালানো শিখেও নিতে পারিস!
বিমানদা তো গাড়িটা রেখে দিয়ে চলে গেল। গাড়ি চালানো শেখার এরকম আচমকা সুযোগ পেয়ে সন্তুর দারুণ উৎসাহ হয়েছিল, কিন্তু বাবা জানতে পেরে বলেছিলেন, ওসব চলবে না। পরের গাড়ি নিয়ে শিখতে যাবে, যদি ধাক্কা লেগে ভেঙেচুরে যায়? যদি কখনও নিজে উপার্জন করে গাড়ি কিনতে পারো, তখনই গাড়ি চালাবে। তার আগে নয়।
এর মধ্যে কাকাবাবু আবার দিল্লি চলে গেলেন, তাই ড্রাইভার রাখারও প্রশ্ন ওঠেনি। বাবা বাড়ি থেকে বেরোতেই চান না। মা মাঝে-মাঝে আপনমনে বলেন, কতদিন থেকে একবার কালীঘাট মন্দিরে যাব ভাবছি, বরানগরের সেজোমাসি অনেকবার যেতে বলেছেন, একটা গাড়ি থাকলে কত সুবিধে, একদিনে সব সেরে আসা যায়, ওখান থেকে দক্ষিণেশ্বরেও …। বাবা এসব কথা শুনেও না-শোনার ভান করে থাকেন। মুখ ঢেকে রাখেন খবরের কাগজে।
কালবেলা ঘুম থেকে উঠেই সন্তু তড়িঘড়ি গাড়িটা স্টার্ট দিতে যায়। বিমানদা শিখিয়ে দিয়ে গেছে। কদিন ধরে শীত পড়েছে বেশ। সন্তু ফুলপ্যান্ট ও কোট পরে নিয়ে স্টিয়ারিং ধরে বসে। গিয়ার নিউট্রাল করা থাকলে গাড়ি এগোবে না। সন্তু চাবি ঘুরিয়ে ক্লাচে পা রেখে চাপ দেয়। প্রথম কয়েকবার খ্যারর খ্যারর আওয়াজ হয়, তারপর গম্ভীরভাবে গাড়ির এঞ্জিনের স্বাভাবিক শব্দ বেরোয়।
তখন সন্তু মনে-মনে গাড়ি ছোটায়। নতুন বিদ্যাসাগর সেতু পেরিয়ে গঙ্গার ওপার। তারপর ফাঁকা রাস্তা। বম্বে রোড ধরে ঝড়ের বেগে ছুটছে গাড়ি, স্টিয়ারিংটা চেপে ধরে, সামনে একটু ঝুঁকে সন্তু ফিসফিস করে বলে, কাম অন গিংগো, আরও জোরে, আরও জোরে …। গাড়ি নয়, সন্তু যেন ঘোড়া ছোটাচ্ছে!
হঠাৎ গলি দিয়ে জোজোকে আসতে দেখে সে লজ্জা পেয়ে গেল।
জোজো ভোরবেলা কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। কোনওদিন গঙ্গার ধার, কোনওদিন বালিগঞ্জ লেক, কোনওদিন সল্টলেকের নলবন পর্যন্ত যায়। মাঝে-মাঝে সন্তুকেও ডাকতে আসে।
গাড়িটার বনেটে একটা চাঁটি মেরে জোজো জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু গাড়ি কিনলেন বুঝি? কবে কেনা হল? দেখেই বোঝা যাচ্ছে সেকেন্ড হ্যান্ড!
সন্তু বলল, আমরা কিনিনি, এটা বিমানদার গাড়ি। মোটেই সেকেন্ড হ্যান্ড নয়, নতুন।
জোজো ভুরু তুলে বলল, আমায় গাড়ি চেনাবি? কোন গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে ভেঙে তুবড়ে গিয়েছিল, আবার সারিয়ে-সুরিয়ে রং করা হয়েছে, তা আমি এক নজরে বলে দিতে পারি। এই গাড়িটা একদিন রেড রোডে অ্যাকসিডেন্ট করেছিল, ধাক্কা মেরেছিল ট্রাকের সঙ্গে, ঠিক বেলা এগারোটায়।
সন্তু বলল, তুই বুঝি উপস্থিত ছিলি সেখানে?
জোজো দুদিকে মাথা নেড়ে বলল, না।
সন্তু বলল, অ্যাকসিডেন্ট করতে পারে, কিন্তু রেড রোডে, বেলা এগারোটায়, তা তুই কী করে বুঝলি?
জোজো সন্তুর মুখের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল, কী করে আমি বুঝি, তা যদি তুই বুঝতি, তা হলে তোর নামই তো জোজো হত! চ, এ গাড়িতে ডায়মন্ড হারবার ঘুরে আসি।
সন্তু স্টার্ট বন্ধ করে বলল, কে চালাবে? স্টিয়ারিং ধরে বসে আছি বলে বুঝি ভাবছিস আমি চালাতে শিখে গেছি!
জোজো বলল, তুই শিখিসনি? তা হলে সরে বোস, আমি চালাব!
তুই আবার শিখলি কবে?
আমি তো বাচ্চা বয়েস থেকে চালাচ্ছি। সাহারা মরুভূমিতে জিপ গাড়ি চালিয়েছি। আর একবার উগান্ডার পাহাড়ি রাস্তায়…
ভাই জোজো, এটা পরের গাড়ি, এটা নিয়ে ঘোরাঘুরি করা ঠিক হবে না।
ডায়মন্ড হারবার যেতে আর কতক্ষণ লাগবে? দুপুরের আগেই ফিরে আসব।
না ভাই থাক। যদি খারাপ-টারাপ হয়ে যায়।
সন্তু গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। জোজো হা-হা করে হেসে উঠে বলল, আমি জানতুম, তুই কিছুতেই আমাকে চালাতে দিবি না!
সন্তু বলল, সেইজন্যই বুঝি তুই বললি যে, তুই গাড়ি চালাতে জানিস? আমাদের তো লাইসেন্স পাওয়ার বয়েসই হয়নি।
জোজো বলল, লাইসেন্স না পেলে বুঝি শেখা যায় না? আমাকে একবার চাবিটা দিয়ে দ্যাখ না, বোঁ করে তোকে এক পাক ঘুরিয়ে নিয়ে আসব!
সন্তু সরু চোখে জোজোর দিকে তাকিয়ে রইল।
জোজোকে বোঝা খুব মুশকিল, ওর কোন কথাটা যে সত্যি আর কোন কথাটা ডাহা গুল, তা ধরা যায় না। জোজোর এক মামার গাড়ি আছে, কিছুদিন জোজো সেই মামার গাড়িতে ঘুরে বেড়িয়েছে, এবাড়িতেও সে গাড়িতে দুবার এসেছিল, তখন হয়তো গাড়ি চালানো শিখে নিতেও পারে। সাহারা মরুভূমিতে জিপ চালিয়েছিল কি না, তার তো প্রমাণ পাওয়ার কোনও উপায় নেই।
সন্তু বলল, চল ভেতরে যাই।
জোজো বলল, আজ কী বার? শনিবার। তোরা শনিবার সকালে লুচি-বেগুনভাজা আর মোহনভোগ খাস, তাই না?
সন্তু বলল, সেটা রবিবার। আজ শুধু টোস্ট আর ডিমসেদ্ধ। ওমলেটও হতে পারে।
ওমলেট? একটা ডিমের, না দুটো ডিমের?
একটা।
দুর-দুর! ওমলেট যখন খাবি, ডাবল ডিমের না হলে ঠিক স্বাদ হয় না।
ঠিক আছে। মা-কে বলব তোকে ডাবল ডিমের ওমলেট করে দিতে।
টোস্ট খাস কেন, স্যান্ডুইচ খেতে পারিস না? এই শীতকালে ভাল হ্যাম পাওয়া যায়। কিংবা সার্ডিন মাছ।
তুই বাড়িতে সকালবেলা কী খাস রে, জোজো? ওঃ কদিন ধরে কী দারুণ জিনিস খাচ্ছি। বাবার এক ভক্ত অনেকখানি ক্যাভিয়ার পাঠিয়েছিল। ক্যাভিয়ার কাকে বলে জানিস? পৃথিবীর সবচেয়ে দামি খাবার। স্টার্জন মাছের ডিম। ক্যাম্পিয়ান সাগরের নাম শুনেছিস তো? সেই সাগরে এই মাছ পাওয়া যায়। মাছটা এলেবেলে, ডিমটুকুই আসল। সহজে পাওয়া যায় না, তাই তো এত দাম!
এত চমৎকার জিনিস, আমাকে একটু খাওয়াবি না জোজো?
কেন খাওয়াব না? কাল সকালে আমাদের বাড়িতে চলে আয়। এক ধরনের বিশেষ বিস্কুটের ওপর মাখন মাখিয়ে তার ওপরে ক্যাভিয়ার রেখে খেতে হয়। খেলে তোর মনে হবে অমৃত! অবশ্য আজ বিকেলবেলা ইজিপ্টের অ্যাম্বাসাডর আসবেন বাবার সঙ্গে দেখা করতে। তিনি পিরামিড দেখাবার জন্য আমাদের অনেকবার ওদেশে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। ওঁর মেয়ের খুব অসুখ, বাবার কাছ থেকে যজ্ঞিড়ুমুর নিতে আসছেন এবার। ওঁকে খাতির করার জন্য বাবা যদি সবটা ক্যাভিয়ার খাইয়ে দেন, তা হলে আর কাল সকালে কিছু পাবি না।
সন্তু মনে-মনে ভাবল, কাল সকালে কেন, আজ সকালে, এক্ষুনি গেলেই তো হয়। জোজো কেন সে-কথা বলছে না? সন্তু নিজেও মুখ ফুটে জোজোকে আজই যাওয়ার কথা বলতে পারল না।
যজ্ঞিড়ুমুরটাই বা কী জিনিস কে জানে! তাতে কঠিন রোগ সেরে যায়?
ওপরের ঘরে গিয়ে ওমলেট আর টোস্ট খেতে-খেতে কিছুক্ষণ গল্প করল দুজনে। এবার পড়াশুনোর সময়। ক্লাসের পড়ার চাপ না থাকলে সন্তু প্রত্যেক সকালবেলা একটি করে বাংলা বা ইংরেজি কবিতা মুখস্থ করে। তাদের বাড়িতে বাবা, কাকাবাবু, দিদি, এমনকী মায়েরও অনেক কবিতা মুখস্থ। মাঝে-মাঝে কম্পিটিশন হয়। কবিতা মুখস্থ করলে নাকি স্মৃতিশক্তি বাড়ে। একবার রবীন্দ্রনাথের এবার ফিরাও মোরে কবিতাটি কে নির্ভুল বলতে পারে, তা নিয়ে কম্পিটিশন হয়েছিল। সন্তু ভুলে গিয়েছিল দুটো লাইন, ফার্স্ট হয়েছিল দিদি। দিদি অবশ্য এখন আর এ বাড়িতে থাকে না।
সন্তু বলল, আয় জোজো, আমরা রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা মুখস্থ করি। এইটা করবি, দুই পাখি।
খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে
বনের পাখি ছিল বনে
একদা কী করিয়া মিলন হলো দোঁহে
কী ছিল বিধাতার মনে…
জোজো সন্তুর হাতের বইটার দিকে উঁকি দিয়ে বলল, ওরে বাবা, এ তো মস্ত বড় কবিতা, এটা একদিনে মুখস্থ হয় নাকি?
সন্তু বলল, সবটা নয়, প্রথম দুটো স্ট্যাঞ্জা। এই যে আমি কেমনে বন-গান গাই! এই পর্যন্ত। এক ঘণ্টা টাইম। তারপর মিলিয়ে দেখা হবে।
জোজো অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, কম্পিটিশন? আমার এক ঘণ্টাও লাগবে। বড়জোর চল্লিশ মিনিট। আমি ফার্স্ট হলে তুই কী খাওয়াবি বল?
সন্তু বলল, চিকেন রোল। তুই হেরে গেলেও খাওয়াবি তো?
দুজনে জোরে জোরে পড়া শুরু করল কবিতাটা। দুমিনিট বাদে থেমে গিয়ে জোজো বলল, অ্যাই সন্তু, তুই আমার সঙ্গে জোচ্চুরি করছিস?
সন্তু অবাক হয়ে বলল, তার মানে?
জোজো বলল, তুই প্রথমেই এই কবিতাটার কথা বললি কেন? এটা তোর আগে থেকেই মুখস্থ আছে, তাই না?
সন্তু বলল, না, না, আমার মুখস্থ নেই। সত্যি বলছি।
জোজো বলল, ওসব চালাকি চলবে না। কবিতা আমি বাছব।
সন্তু বলল, ঠিক আছে। তুই তা হলে বল কোনটা?
জোজো রবীন্দ্র রচনাবলীর পাতা ওলটাতে-ওলটাতে এক জায়গায় থেমে গিয়ে বলল, এই যে এইটা। সোনার তরী। গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা
সন্তু বলল, জোজো মাস্টার, এটা যে তোমার আগে থেকে মুখস্থ নয়, তা কী করে বুঝব? এবার তুমি আমায় ঠকাচ্ছ?
জোজো বলল, এই বিদ্যা ছুঁয়ে বলছি, এটা আমার মুখস্থ নেই। দু-একবার পড়েছি অবশ্য। প্রথম একুশ লাইন আজ মুখস্থ করি আয়–।
এবারে পাঁচ মিনিট পড়ার পর সন্তু হেসে ফেলল।
জোজো থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, হাসছিস কেন? এটা কি হাসির কবিতা নাকি?
সন্তু তবু হাসতে-হাসতে বলল, আগের কবিতাটা আমার সত্যি মুখস্থ ছিল না। তুই বিশ্বাস করলি না। তুই যেটা বার করলি, এই সোনার তরী আমার পুরো মুখস্থ। ধরে দ্যাখ! আমি ভাই সত্যি কথা বেশিক্ষণ চেপে রাখতে পারি না।
জোজো বইটা বন্ধ করে দিয়ে বলল, ধ্যাত! আজ আর কবিতা-টবিতার দরকার নেই। এমন চমৎকার সকাল, চল না, কোথাও বেড়াতে যাই! শীতকালেই বেড়াতে ভাল লাগে।
কোথায় যাবি?
ট্রেনে উঠে কোথাও চলে গেলেই হয়। কাকাবাবু কোথায় রে, সন্তু?
কাকাবাবু দিল্লিতে। কবে ফিরবেন ঠিক নেই।
কোনও রহস্যসন্ধানে গেছেন বুঝি? তোকে এবার সঙ্গে নিলেন না?
সেরকম কিছু ব্যাপার নয়। নরেন্দ্র ভামা ডেকে নিয়ে গেছেন। নরেন্দ্র ভার্মার সিমলায় একটা বাড়ি আছে। ওঁর এখন ছুটি। কাকাবাবুকে সঙ্গে নিয়ে সিমলায় ছুটি কাটাবেন শুনেছি।
এই শীতকালে সিমলায়? সেখানে তো বরফ পড়ছে!
কাকাবাবু অনেকবার বলেছেন, শীতকালেই শীতের দেশে বেড়াতে যেতে হয়। লোকজন কম থাকে।
কাকাবাবু না থাকলে ভাল লাগে না। কোথাও না গেলেও অনেক গল্প তো শোনা যায়! তুই নরেন্দ্র ভার্মার ঠিকানা জানিস?
তা জানব না কেন? ওঁর বাড়িতে আমি গেছি দুবার।
একটা কাজ করবি সন্তু? বেশ মজা হবে। তুই কাকাবাবুর নামে একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দে। তাতে লিখবি, জোজো মিসিং! জোজোকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তা হলেই কাকাবাবু হন্তদন্ত হয়ে ফিরে আসবেন।
মিথ্যে টেলিগ্রাম পাঠাব? যাঃ, তা হয় নাকি? ফিরে এসে কাকাবাবু কী বলবেন আমাকে?
মিথ্যে কেন হবে? আমি কটা দিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকব। কিছুদিন ধরে সেরকম কিছুই ঘটছে না। কেউ এসে কাকাবাবুর সাহায্য চাইছে না। তা হলে আমাদেরই রহস্য তৈরি করতে হবে। আমি কোথাও লুকিয়ে থাকব। কাকাবাবু এলে তুই বলবি, কয়েকজন তাতার দস্যু এসে আমাকে গুম করেছে। তারপর দেখা যাক, কাকাবাবু কী করে আমাকে খুঁজে বার করেন।
মানুষ খোঁজা কাকাবাবুর কাজ নয়। উনি পুলিশে খবর দিয়ে দেবেন। তুই যেখানেই ঘাপটি মেরে থাকিস না কেন, পুলিশ ঠিক কাক করে তোকে টেনে আনবে!
একবার জানিস তো সত্যিই আমাকে গুণ্ডারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। এখানে, কম্বোডিয়ায়। একটা পাহাড়ের গুহায় আমাকে হাত-পা বেঁধে লুকিয়ে রেখে তারা কম্বোডিয়ার রাজা সিহানুককে চিঠি পাঠাল যে কুড়ি লক্ষ টাকা র্যানসম, মানে মুক্তিপণ না পেলে তারা আমার মুণ্ডু কেটে ফেলবে। রাজা তো সেই চিঠি পেয়েই ভয় পেয়ে গিয়ে টাকাটা পাঠাবার হুকুম দিয়ে দিলেন। আর একটু হলেই—
সন্তু বাধা দিয়ে বলল, কম্বোডিয়ার রাজা তোকে চিনলেন কী করে? তিনি তোর জন্য টাকা দেবেন কেন?
জোজো এমনভাবে তাকাল, যেন সন্তু নেহাত ছেলেমানুষ। কিছুই বোঝে না। তারপর বলল, বাঃ, আমার বাবা তো তখন কম্বোডিয়ায়। রাজার ঠিকুজি-কুষ্ঠি তৈরি করছিলেন। বাবা সেই চিঠিটা হাতে নিয়ে রাজাকে বললেন, দাঁড়ান, দাঁড়ান, টাকা পাঠাতে হবে না। আমার ছেলেকে আটকে রাখার সাধ্য কারও নেই। বাবা সেই চিঠির দিকে সাত মিনিট তাকিয়ে রইলেন, রাগে তাঁর চোখ জ্বলতে লাগল। তারপর পকেট থেকে পাঁচটা যজ্ঞিড়ুমুর বার করে তাতে মন্ত্র পড়ে মাটিতে ছুড়ে দিয়ে বললেন, যাঃ! অমনই সেই ড়ুমুরগুলো গড়াতে লাগল। গড়াতে-গড়াতে রাজসভা ছেড়ে চলে গেল রাস্তায়। রাজার বাছাই করা কুড়িজন সৈন্য ছুটতে লাগল সেই ড়ুমুরগুলোর সঙ্গে-সঙ্গে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পরে একটা পাহাড়ের কাছে আসতেই দেখা গেল, পাঁচজন লোক সেই পাহাড় থেকে রক্তবমি করতে করতে নেমে আসছে। গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে তাদের মুখ দিয়ে। তারা সৈন্যদের পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে বলতে লাগল, ক্ষমা চাইছি, মাপ চাইছি, ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি, আমাদের বাঁচান। শেষপর্যন্ত ওই ডাকাতদের রক্তবমি থামল কী করে জানিস? প্রত্যেককে এই মন্ত্র-পড়া যজ্ঞিড়ুমুর একটা করে খাইয়ে দেওয়া হল!
আবার যজ্ঞিড়ুমুর? তার এত শক্তি!
সন্তু জিজ্ঞেস করল, যজ্ঞিড়ুমুর কী রে, জোজো?
জোজো বলল, এক ধরনের ড়ুমুর, তুই দেখিসনি? এমনিতে সাধারণ, কিন্তু মন্ত্র পড়ে দিলে এক-একরকম রেজাল্ট পাওয়া যায়। ওই ড়ুমুরগুলো খুব মন্ত্র ধরে রাখতে পারে।
সন্তু বলল, তোকে এখানে যদি কেউ ধরে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখে, তা হলে মন্ত্রও লাগবে না। ড়ুমুরও লাগবে না। কলকাতার পুলিশ খুব কাজের, তারা ঠিক খুঁজে বার করবে!
জোজো বলল, তবু পুলিশের বড়বড় কর্তাদের প্রায়ই আমার বাবার কাছে আসতে হয়, তা জানিস?
সন্তু সে-কথা শুনল না। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, গলিতে কীসের শব্দ হচ্ছে।
তাড়াতাড়ি বাইরে গিয়ে ছাদের রেলিং ধরে উঁকি মারল নীচে। ঠিকই শুনেছে সন্তু। দুটো বাচ্চা ছেলে গাড়িটা নিয়ে খেলা শুরু করেছে। একজন চেষ্টা করছে দরজা খোলার জন্য, অন্যজন চড়তে চাইছে গাড়িটার ওপরে।
সন্তু চেঁচিয়ে উঠল, এই, এই, কী হচ্ছে কী? গাড়িতে হাত দিবি না!
জোজো বলল, মাথায় ইট মারব। শিগগির পালা!
ছেলে দুটি সঙ্গে সঙ্গে চোঁ-চাঁ দৌড় মারল। প্রায় তক্ষুনি একটা ট্যাক্সি এসে থামল বাড়ির সামনে। তার থেকে নামলেন কাকাবাবু!
সন্তু আর জোজো দুজনেরই মুখ খুশিতে ঝলমল করে উঠল। কাকাবাবু মুখ উঁচু করে ওদের দেখতে পেয়ে হাত তুললেন। তারপর ক্রাচ দুটো গাড়িতে হেলান দিয়ে রেখে পকেটের ব্যাগ থেকে ভাড়ার টাকা বার করতে লাগলেন।
জোজো হঠাৎ আনন্দে চিৎকার করে উঠল, দ্যাখ, দ্যাখ, সন্তু, কাকাবাবু ক্রাচ ছাড়াই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পা ঠিক হয়ে গেছে! পা ঠিক হয়ে গেছে!